মধুর সম্ভাষে তবে ধর্ম্ম নরপতি।
সবিনয়ে কহিলেন মাতলিব প্রতি।।
তোমার সমান বন্ধু নাহি কোন জন।
দেবেন্দ্রে কহিবে তুমি মম নিবেদন।।
রাজপুত্র হয়ে মম সমান দুঃখেতে।
আমার না লয় মনে, আছে পৃথিবীতে।।
সহায় সম্পদ মাত্র তাঁহার চরণ।
আপনি কহিবে মোর, এই নিবেদন।।
মাতলি চলিল তবে ত্বরিত গমনে।
ধর্ম্ম কহিছেন পার্থে মধুর বচনে।।
কহ ভাই, এবে নিজ শুভ সমাচার।
যে কর্ম্ম করিলে, তাহা লোকে চমৎকার।।
শুনিতে উৎসুক বড় আছে মম মন।
ক্রমে ক্রমে কহ ভাই সব বিবরণ।।
শুনিয়া লোমশ ধৌম্য দেন অনুমতি।
কহিতে লাগিল পার্থ সবাকার প্রতি।।
বিদায় হইয়া গিয়া সবার চরণে।
চলিতে উত্তর মুখে প্রবেশিয়া বনে।।
তপস্যার অনুসারে হইয়া বিকল।
হিমালয়ে দেখিলাম অতি রম্য স্থল।।
দেখিয়া বনের শোভা করিতে ভ্রমণ।
দিলেন জটিল বেশে ইন্দ্র দরশন।।
ছল করি কহিলেন যত ছল কথা।
কদাচিত ভাবিত না হইবে সর্ব্বথা।।
দিলেন প্রকাশ্যরূপে পাছে পরিচয়।
আমি ইন্দ্র, বর মাগ বীর ধনঞ্জয়।।
শুনি কহিলাম মম এই নিবেদন।
প্রসন্ন হইলে যদি দেহ অস্ত্রগণ।।
ইন্দ্র বলিলেন, অস্ত্র পাইবে পশ্চাৎ।
তপস্যায় আগে তুষ্ট কর বিশ্বনাথ।।
শুনিয়া ইন্দ্রের কথা হরিষ মানসে।
আরম্ভ করিনু তপ হরের উদ্দেশে।।
পর্ণাহার, ফলাহার, আহার ত্যজিয়া।
ঊর্দ্ধপদে অধোমুখে বৎসর ব্যাপিয়া।।
হেনমতে তুষ্ট করিলাম আশুতোষ।
আসিলেন শিব তবে কিরাতের বেশে।।
শিকার শূকর এক ধেয়ে যায় আগে।
পশ্চাৎ কিরাত বীর আসিতেছে বেগে।।
অসমর্থ দেখি তারে শ্রান্ত কলেবর।
ধনু ধরি অস্ত্র মারি বধিনু শূকর।।
দেখিয়া কিরাত হৈল ক্রোধপরায়ণ।
ছলেতে নিন্দিয়া বহু মাগিলেন রণ।।
ক্রোধে করিলাম যত অস্ত্রেতে প্রহার।
গিলিল ধনুক সহ সে অস্ত্র আমার।।
তবে মল্লযুদ্ধ করিলাম প্রাণপণে।
তুষ্ট হয়ে পরিচয় দিলেন সেক্ষণে।।
মন্ত্র সহ দিলেন সে অস্ত্র পাশুপত।
এ তিন ভুবনে যার অতুল মহত্ত্ব।।
বর দিয়া সদানন্দ করিলা গমন।
ইন্দ্র জানিলেন এইসব বিবরণ।।
রথ পাঠাইল তবে শচীর ঈশ্বর।
আমারে নিলেন স্বর্গে করিয়া আদর।।
নানা নৃত্য গীত বাদ্যে হর্ষ কুতূহলে।
সভায় বসিয়া দেখি অমর সকলে।।
দেখি নৃত্য করিতেছে কৌতুকে অপ্সরী।
আছিল তাহার মাঝে ঊর্ব্বশী সুন্দরী।।
তারে দেখি পূর্ব্ব কথা হইল স্মরণ।
ঈষৎ হাসিয়া আমি করি নিরীক্ষণ।।
তাহাতে সঙ্কেত বুঝি আনন্দ বিশেষে।
ইন্দ্রের আদেশে সেই আসে মম পাশে।।
দেখিয়া অন্তরে বড় হইল বিস্ময়।
পূর্ব্ব পিতামহ মাতা এই নারী হয়।।
প্রণাম করিয়া তবে করি নিবেদন।
কহ গো জননি নিশাগমন কারণ।।
অন্যভাবে আসিয়া শুনিল বিপরীত।
কহিতে লাগিল তবে হইয়া দুঃখিত।।
যেইক্ষণে দেখিয়াছি তোমার বদন।
সেইক্ষণে হরিল মম অন্তর মন।।
সে কারণে আসিলাম ঘোর নিশাকালে।
এ হেন কুৎসিত ভাষা কি হেতু কহিলে।।
না করিলে আশা পূর্ণ পুরুষের কাজ।
ক্লীব হয়ে থাক তুমি স্ত্রীগণেরে মাঝ।।
এত বলি নিজ ঘরে চলিল দুঃখিত।
পুরন্দর শুনি পাছে হৈলেন লজ্জিত।।
ঊর্ব্বশীরে আজ্ঞা দিল সহস্রলোচন।
করহ অর্জ্জুনে শীঘ্র শাপ বিমোচন।।
উর্ব্বশী কহিল, শাপ খণ্ডন না যায়।
ক্লীব হবে বৎসরেক অজ্ঞাত সময়।।
উপকার হইবে অজ্ঞাতবাস যবে।
স্বস্তি স্বস্তি উচ্চারণ করে ইন্দ্র তবে।।
তারপর দেবরাজ কত দিনান্তর।
তব স্থানে পাঠান লোমশ মুনিবর।।
তবে ইন্দ্র করিলেন অস্ত্র সমর্পণ।
সেমত দিলেন আর যত দেবগণ।।
যক্ষ রক্ষ গন্ধর্ব্বাদি সবে করি দয়া।
অস্ত্র সহ শিখাইল সবে নিজ মায়া।।
হেনমতে নিজ কার্য্য করিনু সাধন।
দেখিয়া আনন্দমতি সহস্রলোচন।।
আছিল দুরন্ত দৈত্য অমর বিবাদী।
কালকেয় নিবাতকবচ দৈত্য আদি।।
স্নেহের কারণ ইন্দ্র কিছু না কহিল।
নগর ভ্রমণ হেতু ছলে পাঠাইল।।
একে একে দেখিলাম অমর নিলয়।
সঞ্জীবনীপুরী যথা ব্রহ্মার আলয়।।
দেখিয়া তাঁহার পুরী করিতে গমন।
মাতলি আনিল রথ যথা দৈত্যগণ।।
নগর প্রাচীর ঘর পুষ্পের উদ্যান।
জিনিয়া অমরাবতী পুরীর নির্ম্মাণ।।
দেখিয়া বিস্ময় বড় হইল আমার।
পূর্ব্বে না দেখিয়াছিনু হেন চমৎকার।।
মাতলি সারথি ছিল অতি বিচক্ষণ।
জিজ্ঞাসিতে কহিলেক সব বিবরণ।।
পিতৃবৈরী জানি তবে করিনু বিরোধ।
ধাইল দানব দুষ্ট করি মহাক্রোধ।।
অপ্রমেয় বল ধরে, অগণিত সেনা।
সমুদ্র সদৃশ্য তাহা, কে করে গণনা।।
নানা অস্ত্র ধরি আসে সর্ব্ব দৈত্যগণে।
দ্বিতীয় প্রহর যুদ্ধ কর প্রাণপণে।।
সন্ধান করিনু পাছে অস্ত্র পাশুপত।
ভস্ম হয়ে উড়ে যায় দুষ্ট দৈত্য যত।।
কার্য্যসিদ্ধি জানি তবে প্রফুল্ল হৃদয়।
আইলাম পুনঃ সুখে ইন্দ্রের আলয়।।
শুনিয়া সানন্দমতি অমর প্রধান।
অগ্রসর হয়ে বহু করিল সম্মান।।
দিল দিব্য কিরীট কুণ্ডল মনোহর।
অক্ষয় যুগল তৃণ পূর্ণ দিব্য শর।।
আশ্বাস করিয়া কহিলেন এই কথা।
যেই আমি সেই তুমি, জানহ সর্ব্বথা।।
যেমতে আমার শত্রু করিলে নিধন।
সেইমত মরিবেক তব শত্রুগণ।।
আমা হৈতে তব কার্য্য হইবেক যেই।
শুনিলে করিব, মম অঙ্গীকার এই।।
মাতলি সহিত তবে পাঠাইয়া দিল।
পূর্ব্বের বৃত্তান্ত শুন, যথা যে হইল।।
কেবল ভরসামাত্র তোমার চরণ।
মুহূর্ত্তেকে বিনাশিতে পারি ত্রিভুবন।।
শত কর্ণ আসে যদি, দুর্য্যোধন শত।
স্বপক্ষ করিয়া সাথে দিক্পাল যত।।
কেবল তোমার মাত্র চরণ প্রসাদে।
ক্ষুদ্র জন্তু সম জ্ঞানে বধিব নির্ব্বাদে।।
অর্জ্জুনের মুখে শুনি এতেক বচন।
যুধিষ্ঠির কহিলেন করি আলিঙ্গন।।
এ তিন ভুবনে তব অদ্ভুত চরিত্র।
আমার ভারত বংশ করিলে পবিত্র।।
শত্রুরূপ গভীর সাগর হৈতে পার।
সহায় সম্পদ মম তুমি কর্ণধার।।
এই সব রহস্যে হরিষ মনোরথে।
রহিলেন পঞ্চ ভাই গন্ধমাদনেতে।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।