সপ্তসপ্ততিতম অধ্যায়
দেবযানীর কচ-পাণিপ্রার্থনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, ব্রতপরায়ণ কচ গুরু কর্ত্তৃক আদিষ্ট হইয়া ত্রিদশালয়ে প্রস্থান করিতে উদ্যত হইলে দেবযানী কহিলেন, “হে মহর্ষি অঙ্গিরার পৌৎত্র কচ! তুমি কুল, শীল, বিদ্যা, তপস্যা ও শম-দমাদি দ্বারা অলঙ্কৃত হইয়াছ। মহাযশাঃ অঙ্গিরা যেমন আমার পিতার মান্য, তোমার পিতা বৃহস্পতিও আমার সেইরূপ মান্য ও পূজনীয়। এই সকল আলোচনা করিয়া আমি যাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর। হে তপোধন! তুমি নিয়মস্থ বা ব্রতনিষ্ঠ হইলে আমি তোমার সবিশেষ শুশ্রূষা করিতাম; এক্ষণে তুমি কৃতবিদ্য হইয়াছ, আমি তোমার প্রতি নিতান্ত অনুরক্তা, অতএব মন্ত্রোচ্চারণপূর্ব্বক আমার পাণিগ্রহণ কর।” কচ কহিলেন, “হে শুভে! তোমার পিতা শুক্রাচার্য্য আমার যেরূপ মান্য ও পূজনীয়, তুমিও তদ্রূপ পূজনীয়া। হে ভদ্রে! তুমি ভগবান্ ভার্গবের প্রাণ হইতেও প্রিয়তরা কন্যা। তুমি ধর্ম্মতঃ আমার গুরুপুৎত্রী; সুতরাং আমাকে এরূপ কথা বলা তোমার উচিত হইতেছে না।” দেবযানী কহিলেন, “তুমি আমার পিতার পুৎত্র নহ। তুমি পিতার গুরুপুৎত্রের পুৎত্র। কেবল এই নিমিত্ত তুমি আমার মান্য ও পূজনীয়। কিন্তু অসুরেরা তোমাকে বারংবার নষ্ট করিয়াছিল। সেই অবধি আমি তোমাতে একান্ত অনুরক্তা হইয়াছি। তোমার প্রতি আমি যেরূপ ভক্তি, সৌহার্দ্দ্য ও অনুরাগ করিয়া থাকি, তাহার কিছুই তোমার অবিদিত নহে; অতত্রব হে ধর্ম্মজ্ঞ! এখন তুমি এ নিরপরাধিনীকে পরিত্যাগ করিও না।” কচ কহিলেন, “হে শুভব্রতে! অন্যায্য বিষয়ে আমাকে নিয়োগ করা উচিত হইতেছে না। হে বালে! তুমি আমার গুরু হইতেও গুরুতরা। এক্ষণে তুমি আমার প্রতি প্রসন্না হও। হে বিশালাক্ষি! তুমি যে শুক্রের ঔরসে উৎপন্ন হইয়াছ, আমি তাঁহারই উদরে বাস করিয়াছিলাম; সুতরাং তুমি ধর্ম্মতঃ আমার ভগিনী হইলে, অতএব এরূপ কথা আর কহিও না। হে ভদ্রে! এতদিন এই স্থলে সুখে বাস করিলাম, এক্ষণে অনুমতি কর, গৃহে গমন করি এবং অশীর্ব্বাদ কর, যেন পথিমধ্যে আমার কোন বিঘ্ন-ঘটনা না হয়। কথাপ্রসঙ্গে আমাকে এক একবার স্মরণ করিও এবং সতত সাবধানে আমার গুরু শুক্রাচার্য্যের পরিচর্য্যা করিও।”
কচ-দেবযানীর পরস্পর শাপ
দেবযানী কহিলেন, “হে কচ! তুমি আমাকে প্রত্যাখ্যান করিলে তোমার সঞ্জীবনীবিদ্যা ফলবতী হইবে না।” কচ কহিলেন, “আমি কোন দোষাশঙ্কায় তোমাকে প্রত্যাখ্যান করিতেছি, এমন নহে; গুরুপুৎত্রী বলিয়া প্রত্যাখ্যান করিতেছি এবং এ বিষয়ে গুরুরও অনুমতি নাই, সুতরাং তুমি অকারণে আমাকে অভিসম্পাত করিলে। হে দেবযানী! আমি তোমাকে আর্যধর্ম্মের [ঋষিসম্মত ধরর্ম্মের] উপদেশ প্রদান করিয়াছিলাম; তথাপি তুমি আমাকে অভিশাপ দিলে। ফলতঃ আমি শাপের উপযুক্ত নহি এবং তোমার এই শাপও ধর্ম্মতঃ নহে, কামতঃ; অতএব আমি তোমাকে প্রতিশাপ প্রদান করিতেছি, তুমি যাহা অভিলাষ করিতেছ, তাহা নিষ্ফল হইবে এবং অন্য কোন ঋষিকুমারও তোমার পাণিগ্রহণ করিবেন না। আর তুমি আমাকে অভিসম্পাত করিলে যে, তোমার অধীত বিদ্যা সিদ্ধ হইবে না; ভাল, তাহা আমি স্বীকার করিলাম; কিন্তু আমি যাহাকে ঐ বিদ্যা অধ্যয়ন করাইব, সে তদ্বিষয়ে কৃতকার্য্য হইতে পারিবে।” কচ দেবযানীকে এইরূপ প্রতিশাপ প্রদান করিয়া সত্বর দেবলোকে উপনীত হইলেন। ইন্দ্রাদি দেবগণ কচকে অভ্যাগত দেখিয়া বৃহস্পতি সমক্ষে তাঁহাকে এই কথা কহিলেন, “হে কচ! তুমি আমাদিগের যে পরমাদ্ভুত হিতকার্য্য সম্পাদন করিলে, তাহাতে তোমার যশ চিরস্থায়ী হইবে এবং তুমি আমাদিগের অংশভাগী হইবে।”