৭৬তম অধ্যায়
কৃষ্ণকর্ত্তৃক ভীমের অভিনন্দন
কৃষ্ণ কহিলেন, “হে ভীমসেন! আমি আপনার অভিপ্ৰায় অবগত হইবার মানসে প্ৰণয়পূর্ব্বক আপনাকে ঐ সকল কথা কহিয়াছি; স্বীয় পাণ্ডিত্য বা ক্রোধবশতঃ ‘আপনাকে কহি নাই এবং আপনাকে আত্মশ্লাঘাদোষে দূষিত করিতেও আমার অভিলাষ ছিল না। আমি আপনার মাহাত্ম্য, বল ও ধর্ম্ম বিশেষরূপে অবগত আছি। আপনাকে পরিভব করিতে আমার কিছুমাত্র চেষ্টা নাই। আপনি আপনার প্রভাবের বিষয় যেরূপ অনুভব করেন, আমি উহা তদপেক্ষা সহস্ৰগুণ জ্ঞান করিয়া থাকি। আপনি যেরূপ সর্ব্বরাজাভিপূজিত [সমস্ত রাজমণ্ডলে সমাদৃত] কুলে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, প্রভাবও তদনুরূপ লক্ষিত হইতেছে এবং বন্ধুবান্ধবগণও তদনুসারে মিলিত হইয়াছেন।
“হে বৃকোদর! লোকে দৈব ও মানুষ ধর্মে সন্দেহ সমুপস্থিত হইলে তন্নিরাকরণার্থ বিজ্ঞ লোককে জিজ্ঞাসা করিয়াও কৃতনিশ্চয় হইতে পারে না। ধর্ম্ম পুরুষের অর্থসিদ্ধির হেতু, বিনাশেরও কারণ হইয়া উঠে, কিন্তু পুরুষকারের ফলের স্থিরতা নাই। দোষদর্শী পণ্ডিতগণ বিশেষ বিবেচনা করিয়া যাহা কর্ত্তব্যপক্ষে নিশ্চয় করিয়াছেন, তাহাও বায়ুবেগের ন্যায় পরিবর্ত্তিত হইয়া থাকে। মনুষ্য উত্তমরূপে মন্ত্রণা করিয়া ন্যায়ানুসারে সম্যকপ্রকারে কাৰ্য্য অনুষ্ঠান করিলেও দৈবপ্রভাবে উহা নিস্ফল হইয়া যায়। স্বভাবজাত শীত, গ্ৰীষ্ম, বর্ষা, ক্ষুধা, পিপাসা প্রভৃতি দৈবকাৰ্য্যসমুদয়ও পুরুষকারদ্বারা নিবারিত হয়। প্রারব্ধ কর্ম্ম ব্যতীত অন্যান্য কর্ম্মসমুদয়ের ফল পরলোকে অবশ্যই ভোগ করিতে হয়, তত্ত্বজ্ঞান বা প্ৰায়শ্চিত্তদ্বারা উক্ত কর্ম্মসমুদয় বিনষ্ট হইতে পারে, অতএব পুরুষকার সর্ব্বতোভাবে প্রধান। তথাপি মনুষ্য পুরুষকার পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল দৈব বা দৈব পরিত্যাগপূর্ব্বক কেবল পুরুষকার অবলম্বন করিয়া জীবনধারণ করিতে পারে না। যে ব্যক্তি এইরূপ কৃতনিশ্চয় হইয়া কর্মে প্রবৃত্ত হয়, সে কর্ম্মসিদ্ধি না হইলে ব্যথিত বা কর্ম্মসিদ্ধি হইলে সন্তুষ্ট হয় না। অতএব আমার মতে শক্রগণের সহিত সংগ্রাম করিয়া নিশ্চয়ই জয়লাভ করিব, এ কথা বক্তব্য নহে। কিন্তু শত্ৰুগণের নিকট নিতান্ত নিস্তেজের ন্যায় আচরণ করাও অকর্ত্তব্য; তাহা হইলে পরিণামে বিষণ্ন ও গ্লানিযুক্ত হইতে হয়।
যাহা হউক, আমি কল্য প্রভাতসময়ে ধৃতরাষ্ট্রের নিকট গমন করিয়া আপনাদের স্বার্থের অব্যাঘাতে শান্তি সংস্থাপন করিতে চেষ্টা করিব। যদি কৌরবগণ তাহাতে সম্মত হয়, তাহা হইলে আমার অনন্ত যশোলাভ, আপনাদের কার্য্যসিদ্ধি ও কৌরবগণের মঙ্গল হইবে। আর যদি তাহারা আমার কথায় উপেক্ষা করে, তবে তুমুল সংগ্রাম সমুপস্থিত হইবে। হে ভীমসেন! সেই যুদ্ধে আপনি ও ধনঞ্জয় আপনারা উভয়ে ধুরন্ধর হইয়া অন্যান্য জনসমুদয়কে সংগ্ৰহ করিবেন। আমার যুদ্ধ করিতে বিলক্ষণ অভিলাষ আছে; কিন্তু অর্জ্জুনের অভিলাষানুসারে আমি উহার সারথি হইব। হে বৃকোদার! আমি কেবল আপনাকে নিস্তেজের ন্যায় বাক্যপ্রয়োগ করিতে দেখিয়া আপনার তেজ উদ্দীপিত করিবার নিমিত্তই আপনার প্রতি তাদৃশ বাক্যপ্রয়োগ করিয়াছি।”