৭৫তম অধ্যায়
ষষ্ঠ-দিবসীয় যুদ্ধ-ব্যূহরচনা
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! অনন্তর কৌরব ও পাণ্ডবগণ রজনী প্রভাত হইবামাত্র পুনরায় যুদ্ধার্থ গমন করিলেন। রথসমুদয় যোজিত, হস্তিসকল সুসজ্জিত এবং পদাতি ও অশ্বসমুদয় বর্ম্মিত ও উভয়পক্ষে ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইল এবং চতুর্দ্দিকে শঙ্খ ও দুন্দুভির ধ্বনি হইতে লাগিল। তখন মহারাজ যুধিষ্ঠির ধৃষ্টদ্যুম্নকে কহিলেন, “হে মহাবাহো! অবিলম্বে অরাতিকুল-হৃদয়-তাপন মকরব্যূহ প্রস্তুত কর।”
“মহারথ ধৃষ্টদ্যুম্ন যুধিষ্ঠিরের বাক্য শ্রবণ করিয়া সমুদয় রথিগণকে উক্ত ব্যূহের যথাস্থানে সন্নিবেশিত হইতে আদেশ করিলেন। মহারাজ দ্রুপদ ও ধনঞ্জয় ঐ ব্যূহের মস্তক, নকুল ও সহদেব উহার চক্ষু ও মহাবল ভীমসেন উহার মুখ হইলেন। মহাবীর অভিমন্যু, দ্ৰৌপদীতনয়গণ, রাক্ষস ঘটোৎকচ, সাত্যকি ও ধর্ম্মরাজ ঐ ব্যূহের গ্ৰীবায়, বাহিনীপতি বিরাট ও ধৃষ্টদ্যুম্ন বহুসংখ্যক সৈন্যসমভিব্যাহারে উহার পৃষ্ঠে, কেকয়েরা পঞ্চভ্রাতা উহার বামপার্শ্বে, নরশ্রেষ্ঠ ধৃষ্টকেতু ও চেকিতান উহার দক্ষিণপার্শ্বে, মহারথ কুন্তিরাজ শতানীক অসংখ্য সৈন্যসমভিব্যাহারে উহার পাদদ্বয়ে এবং সোমকসমবেত শিখণ্ডী ও ইরাবান উহার পুচ্ছে অবস্থান করিতে লাগিলেন।
“হে মহারাজ! যুদ্ধাৰ্থ বর্ম্মিতকলেবর পাণ্ডবগণ সূৰ্য্যোদয়সময়ে সেই মহাব্যূহ ব্যূহিত এবং ধ্বজ, ছত্র ও নির্ম্মল নিশিত শস্ত্রসমুদয় উন্নত করিয়া প্রভূত হস্তী, অশ্ব, রথ ও পদাতিগণের সহিত কৌরবগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর শান্তনুতনয় পাণ্ডবসৈন্যগণকে ব্যূহিত দেখিয়া কৌরবসৈন্যগণকে ক্ৰৌঞ্চব্যূহে ব্যূহিত করিতে লাগিলেন। মহাধনুৰ্দ্ধর দ্রোণাচাৰ্য্য সেই ব্যূহের তুণ্ডে, অশ্বত্থামা উহার নয়নদ্বয়ে, সর্ব্বধনুৰ্দ্ধরাগ্রগণ্য মহাবীর কৃতবর্ম্মা কাম্বোজ ও বাহ্লীকগণসমভিব্যাহারে উহার মস্তকে, মহাবীর শূরসেন ও দুৰ্য্যোধন বহুসংখ্যক ভূপতিসমভিব্যাহারে উহার গ্ৰীবায়, প্ৰাগজ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত মদ্র, সৌবীর ও কেকয়দেশীয় অসংখ্য সেনাসমভিব্যাহারে উহার বক্ষঃস্থলে, প্রস্থলাধিপতি সুষেণ স্বীয় সৈন্যগণসমভিব্যাহারে উহার বামপক্ষে, তুষার, যবন, শক ও চুলিকগণ উহার দক্ষিণপক্ষে এবং শ্রুতায়ু ও সৌমদত্তি পরস্পরকে রক্ষা করিয়া উহার জঘনে অবস্থান করিতে লাগিলেন।
“পরে পাণ্ডবগণ কৌরবদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন; উভয়পক্ষে ঘোরতর সমর হইতে লাগিল। নাগসমুদয় রথীদিগের প্ৰতি, রথীগণ নাগসকলের প্রতি ও গজারোহীদিগের প্রতি, অশ্বগণ অশ্বারোহিগণের প্রতি, অশ্বারোহিগণ রথিসকলের, অশ্বসকলের ও হস্তিসকলের প্রতি এবং গজারোহিগণ অশ্বারোহীদিগের প্রতি ধাবমান হইল। পদাতিগণসমবেত রথী ও অশ্বারোহিগণ পরস্পর আক্রমণ করিতে লাগিল। পাণ্ডবসেনা ভীম, অর্জ্জুন, নকুল ও সহদেবকর্ত্তৃক সংরক্ষিত হইয়া নক্ষত্রমণ্ডলবিভূষিত যামিনীর ন্যায় শোভা ধারণ করিল। কৌরবসেনাও ভীষ্ম, দ্রোণ, শল্য এবং দুৰ্যোধনপ্রভৃতি বীরগণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া গ্রহমণ্ডলাবৃত আকাশমণ্ডলের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিল।
দ্ৰোণ-ভীমযুদ্ধ
“তখন পরাক্রমশালী বৃকোদার দ্রোণাচাৰ্য্যকে অবলোকন করিয়া মহাবেগগামী আশ্বসংযুক্তরথে আরোহণপূর্ব্বক তাঁহার সেনাভিমুখে ধাবমান হইলেন। মহাবীর দ্রোণ তদর্শনে ক্রুদ্ধ হইয়া ভীমের মর্ম্মস্থল লক্ষ্য করিয়া নয়বাণ নিক্ষেপ করিলে মহাবল ভীমসেন নিতান্ত নিপীড়িত হইযা ক্রোধভরে তাঁহার সারথিকে শমনভবনে প্রেরণ করিলেন। তখন মহাবীর দ্রোণাচাৰ্য্য স্বয়ং অশ্বগণকে ধারণ করিয়া পাবকের তুলারাশিদহনের ন্যায় পাণ্ডবসৈন্যগণকে নিধন করিতে লাগিলেন। সৃঞ্জয় ও কেকয়গণ দ্রোণ ও ভীষ্মকর্ত্তৃক দৃঢ়তর আহত হইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। কৌরবসৈন্যগণও ভীমার্জ্জুনবাণে পরিক্ষীণ হইয়া মদমত্ত বারাঙ্গনার ন্যায় মোহপ্ৰাপ্ত হইতে লাগিল। এইরূপে সেই উভয়পক্ষীয় সৈন্যগণকেই একস্থানে অবস্থান করিয়া সংগ্রাম করিতে দেখিয়া সকলে চমৎকৃত হইল। হে মহারাজ! এইরূপে পাণ্ডব ও কৌরবগণ পরস্পরের প্রতি অন্ত্রসন্ধানপূর্ব্বক ঘোরতর সমর করিতে লাগিলেন।”