৭৫তম অধ্যায়
কেশিনী-কথিত লক্ষণে নল-পরিচয়
বৃহদশ্ব কহিলেন, “হে রাজন! দময়ন্তী কেশিনীর নিকট বাহুকসংক্রান্ত বৃত্তান্ত-সকল শ্রবণগোচর করিয়া তাহাকেই নল বলিয়া সংশয় করিয়া নিতান্ত শোকাভিভূত হইয়া কেশিনীকে কহিলেন, “কেশিনি! তুমি পুনরায় তাহার নিকট গমন কর ও কিছু না বলিয়া সমীপবর্ত্তিনী হইয়া তাঁহাকে চরিত্রসকল পরীক্ষা কর। তিনি যেসময়ে যেকোন কাৰ্য্য-সম্পাদনে চেষ্টা করেন, তুমি তৎক্ষণাৎ তাহার চেষ্টিত-সকল পৰ্য্যবেক্ষণ করিবে। তিনি অনল প্রার্থনা করিলে তুমি তাহার প্রতিবন্ধকতাচরণ করিবে; কদাচ অগ্নি প্রদান করিবে না; তিনি জলানয়নের অনুমতি করিলে তুমি তৎক্ষণাৎ তাহার প্রতিকূলবর্ত্তিনী হইবে। হে কেশিনী! তুমি এরূপে তাঁহার চরিত্র-সকল পরীক্ষা করিয়া আমাকে নিবেদন করিবে। ইহা ভিন্ন তাঁহাতে যে-সকল লৌকিক বা অলৌকিক লক্ষণ লক্ষিত হইবে, তাহাও আমাকে কহিবে।” দময়ন্তী কেশিনীকে এই প্রকার উপদেশ প্রদান করিয়া পুনর্ব্বার বাহুকসমীপে প্রেরণ করিলেন।
“কেশিনী নলরাজের যে-সকল চিহ্ন অবগত হইল এবং তাহাতে যে সকল লৌকিক ও অলৌকিক লক্ষণ নিরীক্ষণ করিল, দময়ন্তী সমীপে আগমনপূর্ব্বক সেই সমুদয় অবিকল নিবেদন করিতে লাগিল। “হে ভর্ত্তৃদারিকে! আমি পূর্ব্বে কখন ঈদৃশ মনুষ্য দর্শন বা শ্রবণগােচর করি নাই। পৃথিবী ও সলিল প্রভৃতি অনেক পদার্থ তাহার নিকট আজ্ঞাবহ হইয়া রহিয়াছে। তিনি অতি হ্রস্বদ্বারে প্রবিষ্ট হইবার সময়েও অবনত হয়েন না; অতি সঙ্কুচিত দ্বারবিবরও তাঁহাকে অবলোকন-করিবামাত্র অধিকতর বিবৃতদ্বার [বিস্তৃতদ্বার] হইয়া থাকে। রাজা ভীম ঋতুপর্ণ নরাধিপের নিমিত্ত নানাবিধ ভোজ্যসামগ্ৰী ও পাশব মাংস প্রেরণ করিয়াছিলেন এবং সেই সকল দ্রব্যজাত প্ৰক্ষালন করিবার নিমিত্ত তথায় কতকগুলি শূন্যকুম্ভ সংস্থাপিত হইয়াছিল, কিন্তু বাহুকের দৃষ্টিমাত্রেই সেই সমস্ত কুম্ভ একেবারে বারিপূর্ণ হইয়া উঠিল। তিনি তাহাতে সেইসমস্ত খাদ্যবস্তু প্রক্ষালন করিয়া একমুষ্টি তৃণগ্রহণপূর্ব্বক সূৰ্য্যদেবকে ধ্যান করিবামাত্র ঐ তৃণে সহসা হুতাশন প্রজ্বলিত হইয়া উঠিল। আমি এই সমস্ত আশ্চৰ্য্য ব্যাপার অবলোকনে বিস্ময়াবিষ্ট হইয়া আপনার নিকট আগমন করিলাম। ইহা ভিন্ন তাঁহাতে আরও অনেকগনেক আশ্চৰ্য্য বিষয় দর্শন করিয়াছি। তিনি অগ্নি স্পর্শ করিলেও দগ্ধ হয়েন না; সলিল তাহার ইচ্ছানুসারে তৎক্ষণাৎ সমুপস্থিত হইয়া প্রবাহিত হয়। তিনি কতকগুলি পুষ্প গ্রহণ করিয়া হস্তদ্বারা অল্পে অল্পে মর্দ্দন করিলেন, কিন্তু পুষ্পগুলি তদীয় করে মর্দ্দিত হইয়াও বিকৃত হইল না; প্রত্যুত পুনরায় বিকশিত হইয়া অধিকতর সৌরভ বিস্তার করিতে লাগিল। আমি এই সকল অদ্ভুত লক্ষণ নিরীক্ষণ করিয়া দ্রুত পদে আগমন করিতেছি।’
নলাগমন জ্ঞানে আনন্দিত দময়ন্তীর তৎসমীপে পুত্রদ্বয় প্রেরণ
“দময়ন্তী কেশিনীর মুখে বাহুকের আচার-ব্যবহার শ্রবণ করিয়া ‘আজ জীবিতেশ্বরকে প্রাপ্ত হইলাম’ বলিয়া বোধ করিতে লাগিলেন; কিন্তু পুনরায় কৌশলদ্বারা স্বামীবিষয়ক সন্দেহ-সকল নিঃশেষে অপনোদন করিবার নিমিত্ত রোদন করিতে করিতে মধুরবাক্যে কেশিনীকে কহিলেন, “হে ভাবিনি! পুনরায় সেই প্ৰমত্ত বাহুকের সমীপে গমন করিয়া মহানস [রন্ধনশালা-রান্নাঘর] হইতে তাঁহার সংস্কৃত [পাচিত-পাককরা] মাংস আনয়ন কর।’
“কেশিনী তৎক্ষণাৎ ত্বরিতপদে বাহুকসমীপে গমনপূর্ব্বক অত্যুষ্ণ মাংস আনয়ন করিয়া দময়ন্তীকে প্ৰদান করিল। তিনি অনেকবার তাঁহার পাকরস আস্বাদন করিয়া জাতসংস্কার [আস্বাদের পরিচয়প্রাপ্ত] হইয়াছেন, সুতরাং এক্ষণে সেই মাংস-ভোজনে তাহাকে নলরাজ বলিয়া বিলক্ষণ প্রতীতি হওয়ায় নিতান্ত দুঃখিত ও একান্ত কাতর হইয়া সাতিশয় শোকাবেগে রোদন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে ধৈৰ্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক মুখ-প্রক্ষালন করিয়া কেশিনীর সহিত ইন্দ্ৰসেনা ও ইন্দ্ৰসেন এই উভয় সন্তানকে নলসমীপে প্রেরণ করিলেন। নলরাজ সুরসন্তানসদৃশ স্বীয় সন্তানদ্বয়কে নিরীক্ষণ করিয়া সত্বরে আলিঙ্গনপূর্ব্বক উৎসঙ্গে [ক্ৰোড়ে] আরোপিত করিলে তাঁহার অন্তঃকরণ এরূপ শোকাকুলিত হইয়া উঠিল যে, তিনি ধৈৰ্য্যাবলম্বনে অসমর্থ হইয়া মুক্তকণ্ঠে অতিমাত্র রোদন করিতে লাগিলেন। পরিশেষে চিত্তবিকারপ্রকাশে আত্মপ্রকাশ-সম্ভাবনায় সহসা সন্তানদ্বয়কে পরিত্যাগ করিয়া কেশিনীকে কহিলেন, “ভদ্রে! আমি স্বীয় সন্তানসদৃশ এই দারকদ্বয়কে [বালকদ্বয়] দর্শন করিয়া সহসা অশ্রুবিসর্জ্জন করিয়াছি, তুমি ইহাতে অন্য শঙ্কা করিও না। যাহা হউক, এক্ষণে আমরা এদেশে অতিথিস্বরূপ হইয়া আসিয়াছি; তুমি বারংবার আমাদের নিকট যাতায়াত করিতেছ। দেখিয়া লোকে দোষের আশঙ্কা করিতে পারে; অতএব তোমাকে নমস্কার করি, তুমি এ স্থান হইতে প্ৰস্থান কর।’ ”