অর্জ্জুনের বিদ্যা যদি হৈল সমাধান।
রঙ্গভূমি মধ্যে কর্ণ হৈল আগুয়ান।।
শত দল বর্ণ জিনি অঙ্গের বরণ।
শ্রবণ পরশে দিব্য পঙ্কজ-নয়ন।।
শ্রবণে কুণ্ডল-যুগ দীপ্ত দিনকর।
অভেদ্য কবচে-আবরিত কলেবর।।
দুই দিকে দুই তূণ বামে ধরে ধনু।
আজানু-লম্বিত ভুজ আনন্দিত তনু।।
অবহেলে অবজ্ঞা করিয়ে সর্ব্বজনে।
কহেন কর্ণ, এ ক্রীড়া নাহি লাগে মনে।।
কর্ণের বচন শুনি লোকে চমৎকার।
কেহ বলে, এই হবে দেবের কুমার।।
কেহ বলে, এই বীর পরম-সুন্দর।
অপ্সরা কিন্নর কিম্বা দেব পুরন্দর।।
অথবা গন্ধর্ব্ব কিবা, না জানি নির্ণয়।
আচম্বিতে কোথা হতে আইল দুর্জ্জয়।।
দেখিবারে তরে লোক করে হুড়াহুড়ি।
ঠেলাঠেলি একের উপরে আর পড়ি।।
কেহ বলে, এই বীর হরে বৈশ্বানর।
আচম্বিতে সমুদিত যেন দিবাকর।।
তবে কর্ণ মহাবীর সূর্য্যের নন্দন।
অর্জ্জুনে চাহিয়া বলে করিয়া গর্জ্জন।।
যতেক করিলা তুমি সভার ভিতর।
তাহা হৈতে বিদ্যা আমি জানি বহুতর।।
দেখিয়া আমার বিদ্যা হইবে বিস্ময়।
অসংখ্য আমার বিদ্যা, সংখ্যা নাহি হয়।।
এত শুনি সর্ব্বলোক বিস্মিত-বদন।
দুর্য্যোধন শুনি হৈল আনন্দিত-মন।।
বিরস বদন হইল বীর ধনঞ্জয়।
এত শুনি আজ্ঞা দেন দ্রোণ মহাশয়।।
কোন্ বিদ্যা জানহ সভার আগে কহ।
শুনি কর্ণ মহাবীর ঘুচায় সন্দেহ।।
প্রকাশিল নানা অস্ত্র লোকে অগোচর।
করিয়াছিলেন যত পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
দেখিয়া সবার মনে বিস্ময় জন্মিল।
দুর্য্যোধন নিরখিয়া প্রফুল্ল হইল।।
ভ্রাতৃগণ মধ্যে বসি ছিল দুর্য্যোধন।
অতি শীঘ্র উঠিয়া করিল আলিঙ্গন।।
ধন্য ধন্য বীর তুমি, ছিলা কোন্ দেশে।
হেথায় আইলা তুমি মম ভাগ্যবশে।।
ক্ষিতিমধ্যে যত ভোগ আছয়ে আমার।
আজি হৈতে সে সকলে দিনু অধিকার।।
কর্ণ বলে, সত্য আমি করি অঙ্গীকার।
আজি হৈতে সদা আমি হইনু তোমার।।
কেবল আছয়ে এই এক নিবেদন।
অর্জ্জুনের সঙ্গে ইচ্ছা করিবারে রণ।।
এতেক বলিল যদি কর্ণ মহাবীর।
ক্রোধে ধনঞ্জয় অতি কম্পিত শরীর।।
অর্জ্জুন বলিল, তোরে কে ডাকিল হেথা।
কে বা বলে তোমারে সভায় কহ কথা।।
অনাহূত আসি দ্বন্দ্ব করিস্ সভায়।
ইহার উচিত ফল পাবি রে ত্বরায়।।
নাহি জিজ্ঞাসিতে যেবা বলয়ে বচন।
আপনি আসিয়া খায় বিনা নিমন্ত্রণ।।
ঘোর নরকেতে গতি পায় সেই জন।
সেই গতি মম স্থানে পাইবি এখন।।
কর্ণ বলে, ধনঞ্জয় গর্ব্ব পরিহার।
সভাতে সকল লোক, জিনি অস্ত্রধর।।
বীর্য্যেতে অধিক যেই তারে বলি রাজা।
ধর্ম্মবন্ত লোক বীর্য্য বন্তে করে পূজা।।
হীন-লোক-প্রায় কেন দেহ গলাগালি।
অস্ত্রে অস্ত্রে দ্বন্দ্ব কর, তবে জানি বলী।।
মম সঙ্গে রণে জিন, তবে জানি বীর।
দ্রোণ-গুরু অগ্রেতে কাটিব তোর শির।।
এতেক শুনিয়া দ্রোণ ঘূর্ণিত নয়ন।
আজ্ঞা দেন অর্জ্জুনেরে কর গিয়া রণ।।
এত শুনি সুসজ্জ হইয়া ধনঞ্জয়।
ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া করেন প্রলয়।।
স্বপক্ষ হইল পৃষ্ঠে চারি সহোদর।
কৃপাচার্য্য দ্রোণাচার্য্য ভীষ্ম বীরবর।।
আগু হৈল কর্ণ বীর হাতে ধনুঃশর।
সপক্ষ হইল কুরু শত সহোদর।।
আর যত মহারথী যোদ্ধা লক্ষ লক্ষ।
কেহ পাণ্ডবের পক্ষ কেহ কুরু-পক্ষ।।
পুত্রস্নেহে গগনে আগত পুরন্দর।
অর্জ্জুনে করিল ছায়া যত জলধর।।
কর্ণভিতে যত তাপ করেন তপন।
সুসজ্জ হইল সবে করিবারে রণ।।
সকুঞ্জল বীর কর্ণ দেখি বিদ্যমানে।
কুন্তীদেবী চিনিলেন আপন নন্দনে।।
পুত্রে পুত্রে বিবাদ দেখিয়া কুন্তী দেবী।
ঘন ঘন মূর্চ্ছা যায় মহাতাপ লাগি।।
হেনকালে কৃপাচার্য্য বলিল ডাকিয়া।
সর্ব্বলোকে শুনে, কহে কর্ণেরে চাহিয়া।।
এই পার্থ বীর হয় পৃথার নন্দন।
কুরু মহাবংশে জন্ম, বিখ্যাত ভুবন।।
তোমার সহিত আজি করিবেক রণ।
তুমি কহ, কোন্ বংশ কাহার নন্দন।।
জ্ঞাত হৈলে দোঁহাকার করাইব রণ।
সমবংশ হৈলে যুদ্ধ হয় সুশোভন।।
নাহি অভিমান সম জয় পরাজয়।
রাজপুত্র ইতর-লোকেতে যুদ্ধ নয়।।
কেবা তব মাতা পিতা কহ বীরবর।
বল শুনি কোন্ রাজ্যে তুমি অধীশ্বর।।
এতেক শুনিয়া কর্ণ কৃপের বচন।
হেটমুণ্ড হৈল বীর বিরস বদন।।
না দিল উত্তর কিছু কর্ণ মহাবল।
বৃন্ত হৈতে ছিন্ন যেন কমলের দল।।
কৃপেরে চাহিয়া বলে রাজা দুর্য্যোধন।
ত্রিবিধ প্রকারে রাজা শাস্ত্রের বচন।।
সহজে বংশজ আর লোকে যারে পূজে।
সবা হৈতে যেই জন বীর্য্যবন্ত তেজে।।
যেই জন জানে সৈন্য-চালন-সন্ধান।
তাঁর সনে রণ সাজে, আছে এ বিধান।।
রাজা হৈলে পার্থ যদি করিবেক রণ।
আজি আমি কর্ণে রাজা করিব এখন।।
অঙ্গদেশে কর্ণ আজি হবে দণ্ডধর।
এত বলি আজ্ঞা দিল ডাকি অনুচর।।
অভিষেক দ্রব্য আনাইল ততক্ষণে।
বসাইল কর্ণ বীরে কনক-আসনে।।
শিরেতে ধরিল ছত্র রতনে মণ্ডিত।
রাজগণে চামর ঢুলায় চারিভিত।।
কনক-অঞ্জলি শিরে ফেলিল নিছিয়া।
ভীষ্ম দ্রোণ কৃপ রহেন বিস্মিত হৈয়া।।
তবে কর্ণ মহাবীর প্রসন্ন বদন।
দুর্য্যোধন প্রতি বলে হৈয়া হৃষ্টমন।।
অঙ্গদেশে দিলে মোরে তুমি রাজা করি।
যে আজ্ঞা করিবে তাহা প্রাণপণ করি।।
দুর্য্যোধন বলে, অন্যে নাহি প্রয়োজন।
হইবে আমার সখা এই মম মন।।
অচল সৌহৃদ্য-ইচ্ছা তোমার সহিতে।
এই মম বাঞ্ছা, আজ্ঞা কর তুমি মিতে।।
কর্ণ বলে, সখা মম সুদৃঢ় বচন।
পরম-স্নেহেতে দোঁহে করে আলিঙ্গন।।
হেনকালে অধিরত জাতিতে সারথি।
লোকমুখে শুনি, পুত্র হৈল নরপতি।।
বয়সে অত্যন্ত বৃদ্ধ চলে যষ্টিভরে।
উঠিতে পড়িতে বুড়া যায় দেখিবারে।।
বৃদ্ধ দেখি সব লোক ছাড়ি দিল পথ।
সভামধ্যে প্রবেশ করিল অধিরথ।।
অধিরথে দেখি কর্ণ শশব্যস্তে উঠি।
প্রণাম করিল শির ভূমিতলে লুঠি।।
কর্ণ প্রণমিল অধিরথের চরণে।
দেখিয়া বিস্ময় মানিলেক সভাজনে।।
পাণ্ডব জানিল, কর্ণ সূতের নন্দন।
উপহাস করি ভীম বলিল বচন।।
ওহে কর্ণ, তুমি অধিরথের নন্দন।
এতক্ষণ না জানি এ সব বিবরণ।।
অর্জ্জুন সহিত রণে তুমি শক্তিমন্ত।
এখন সে জানিলাম তোর আদি অন্ত।।
সভাতে সম্ভবে কার্য্য কর জাতিমত।
হাতেতে প্রবোধ-বাড়ি চালা গিয়া রথ।।
আরে নরাধম তোর কিমত যোগ্যতা।
অঙ্গদেশে রাজা হও, এ অদ্ভুত কথা।।
যজ্ঞের নিকট যদি শুনি কভু যায়।
যজ্ঞের বিভাগ হবি কুক্কুরে কি পায়।।
ভীমমুখে শুনি কর্ণ কাঁপয়ে অধর।
নিশ্বাস ছাড়িয়া কর্ণ চাহে দিনকর।।
সারথিই হই, কিংবা সারথি-তনয়।
যাহাই হই না আমি, দুঃখ তাহে নয়।।
কোন্ কুলে জন্মলাভ দৈব দেন করে।
পুরুষত্ব কিন্তু মোর মুষ্টির ভিতরে।।
এত শুনি মহাক্রুদ্ধ হৈল দুর্য্যোধন।
অগ্র হৈয়া বলে দম্ভে মেঘের গর্জ্জন।।
সখা করিলাম কর্ণে সভার ভিতর।
এ কথা কহিতে যোগ্য নহে বৃকোদর।।
সখা করিলাম কর্ণে সভার ভিতর।
এ কথা কহিতে যোগ্য নহে বৃকোদর।।
শ্রেষ্ঠ বলি ক্ষত্র-ধর্ম্মে বলিষ্ঠ যে জন।
শূর বা নদীর অন্ত পায় কোন্ জন।।
জল হৈতে শীতল যে না শুনি শ্রবণে।
তাহাতে জন্মিলে অগ্নি দহে ত্রিভুবনে।।
দধীচির হাড়েতে বজ্রের হৈল জন্ম।
দৈত্যের দনুজ দল করে শূরকর্ম্ম।।
কার্ত্তিকের জন্ম কেহ দৃঢ় নাহি জানে।
কেহ বলে শিব হৈতে, কেহ না আগুনে।।
গঙ্গার নন্দন কেহ বলে কৃত্তিকার।
জন্মের নিয়ম নাই পূজ্য সবাকার।।
বিপ্র হৈতে ক্ষত্র-জন্ম সর্ব্বলোকে জানি।
ক্ষত্র হৈয়া বিপ্র হৈল বিশ্বামিত্র মুনি।।
কলসে জন্মিল দ্রোণ, কৃপ শরবনে।
বশিষ্ঠ বেশ্যার পুত্র কেবা নাহি জানে।।
তোমা সবাকার জন্ম জানি ভালমতে।
তুমি নিন্দা কর মিত্রে আমার অগ্রেতে।।
কর্ণেরে কিমত বলি লয় তোর মনে।
ক্ষিতিমধ্যে আছে কেহ এমত লক্ষণে।।
সকুণ্ডল-কবচ যাহার কলেবর।
তোর চিত্তে লয় অধিরথের কোঙর।।
প্রত্যক্ষ দেখহ কর্ণ সম দিবাকরে।
ব্যাঘ্র কভু জন্ম লয় মৃগীর উদরে।।
সকল পৃথিবী শোভে কর্ণে অধিকার।
কর্ণ রাজা হৈল অঙ্গদেশ কোন্ ছার।।
কর্ণ-বাহু-বীর্য্যে সবে করিবেক পূজা।
আমা সহ অনুগত হবে সর্ব্ব রাজা।।
এতেক কহিল সভামধ্যে দুর্য্যোধন।
হাহাকার শব্দ হৈল সভাতে তখন।।
কেহ বলে, ভেদাভেদ হৈল ভ্রাতৃগণ।
কেহ বলে, দ্বন্দ্ব আর নহে নিবারণ।।
কেহ বলে, কুরুকুল আজি হৈল অস্ত।
কেহ বলে, পাণ্ডুকুল মজিল সমস্ত।।
অস্ত গেল দিবাকর, রজনী প্রবেশে।
রাজগণ চলি গেল যার যেই দেশে।।
কর্ণ-হস্ত ধরিয়া চলিল দুর্য্যোধন।
পশ্চাতে চলিল সমুদয় ভ্রাতৃগণ।।
পঞ্চ ভাই পাণ্ডব চলেন নিজস্থান।
আগে পাছে পরিবার করিল প্রয়াণ।।
হরষিতা কুন্তী-দেবী জানিয়া কারণ।
অঙ্গদেশে রাজা হৈল আমার নন্দন।।
দুর্য্যোধন হরষিত, হইল নির্ভয়।
নিরবধি কম্প হৈত দেখি ধনঞ্জয়।।
ত্যজিল অর্জ্জুন-ভয় কর্ণেরে পাইয়া।
যুধিষ্ঠির ভীত অতি কর্ণেরে দেখিয়া।।
কর্ণ সম বীর নাহি আর যে সংসারে।
এই ভয় সদা জাগে ধর্ম্মের অন্তরে।।
আদিপর্ব্ব ভারত ব্যাসের বিরচিত।
কাশীরাম দাস কহে রচিয়া সঙ্গীত।।