সর্ব্ব শিষ্যগণ যবে হইল প্রখর।
দ্রোণ বলিলেন যথা অন্ধ নৃপবর।।
ভীষ্ম কৃপাচার্য্য আদি যত ক্ষত্রগণ।
সবার কহেন ভরদ্বাজের নন্দন।।
বিদ্যায় পরাগ হৈল সকল কুমার।
সাক্ষাতে পরীক্ষা কর বিদ্যা সবাকার।।
এত শুনি ধৃতরাষ্ট্র আনন্দিত মন।
বিদুরে ডাকিয়া আজ্ঞা করেন তখন।।
রঙ্গভূমি সুসজ্জ করহ শীঘ্রগতি।
যেইরূপ আচার্য্য করহ শীঘ্রগতি।।
যেইরূপ আচার্য্য কহেন মহামতি।
রাজ-আজ্ঞা পাইয়া বিদুর ততক্ষণে।।
আদেশ করেন যত অনুচরগণে।।
ক্ষেত্র এক প্রশস্ত চৌদিকেতে সোসর।
রঙ্গভূমি বিরচিল তাহার ভিতর।।
চতুর্দ্দিকে নির্ম্মাইল উচ্চগৃহগণ।
নানারত্নে গৃহ সব করিল মণ্ডন।।
রাজগণ বসিবারে তাহার উপর।
বিচিত্র পালঙ্ক শয্যা রাখিল বিস্তর।।
রাজ-নারীগণ হেতু কৈল ভিন্ন স্থল।
ভূমি হৈতে তাহা অতি করিল উচল।।
হেন মতে রঙ্গভূমি করিয়া নির্ম্মাণ।
বিদুর জানাইলেন ধৃতরাষ্ট্র স্থান।।
শুভদিন করিয়া চলিল সর্ব্বজন।
অন্ধ ধৃতরাষ্ট্র আর গঙ্গার নন্দন।।
বাহ্লীক চলিলসহ পুত্র সোমদত্ত।
আর যত রাজগণ আইল প্রমত্ত।।
গান্ধারী সুবল-সুতা কুন্তী আদি করি।
আইল সকল যত অন্তঃপুর-নারী।।
রথ-গজ-অশ্বপৃষ্ঠে মঞ্চের উপরে।
শতপুর করিয়া বসিল দেখিবারে।।
নানাবাদ্য বাজে, শব্দে কর্ণে লাগে তালি।
প্রলয়কালেতে যেন সিন্ধুর কল্লোলি।।
হেনকালে আইলেন আচার্য্য মহাশয়।
তারা মধ্যে হৈল যেন চন্দ্রের উদয়।।
শুক্লবাস শুক্লকেশ শুক্লপুষ্প মালে।
সর্ব্বাঙ্গে লেপিত শুক্ল মলয়জ ভালে।।
পুত্র সহ গুরু দাণ্ডাইলা সভামাঝে।
আজ্ঞা কৈল আসিবারে পাণ্ডব-অগ্রজে।।
সভাতে প্রবেশ করিলেন যুধিষ্ঠির।
বিকচ-পঙ্কজ-মুখ নির্ম্মল শরীর।।
টঙ্কারিয়া ধনুর্গুণ সন্ধি দিব্য শর।
মহাশব্দে প্রহারিল লোকে ভয়ঙ্কর।।
এক অস্ত্রে বহু অস্ত্র করেন সৃজন।
বায়ব্য অনল আদি বহু অস্ত্রগণ।।
ধন্য ধন্য করি সবে করিল বাখান।
সবে বলে, কেহ নাহি ইহার সমান।।
নিবর্ত্তিয়া যুধিষ্ঠিরে দ্রোণ তপোধন।
আজ্ঞা করিলেন, এস ভীম দুর্য্যোধন।।
গদা হাতে এল তবে দুই মহাবীর।
মল্লবেশে রঙ্গমাটি -ভূষিত শরীর।।
মাথায় মুকুট, পরিধান বীর ধড়া।
দুই ভিতে দোঁহে যেন পর্ব্বতের চূড়া।।
গদা হাতে করি ভ্রমে করিয়া মণ্ডলী।
দোঁহার হুঙ্কার শব্দে কর্ণে লাগে তালি।।
দুই মত্ত গজ যেন শুণ্ডে জড়াজড়ি।
চরণে চরণে, মুণ্ডে মুণ্ডে তাড়াতাড়ি।।
দোঁহার দেখিয়া কর্ম্ম লোকে ভয়ঙ্কর।
পরস্পরে কথা হয় সভার ভিতর।।
কেহ বলে, মহাবলী বীর বৃকোদর।
কেহ বলে, ভীম হৈতে বলী কুরুবর।।
হেনমতে দুই পক্ষ হইল সভায়।
উঠিল প্রবল-শব্দ কথায় কথায়।।
ধৃতরাষ্ট্র গান্ধারী পাণ্ডবগণ-মাতা।
তিন জনে বিদুর কহেন সব কথা।।
বুঝিয়া লোকের মর্ম্ম দ্রোণ মহাশয়।
আজ্ঞা করিলেন দোঁহে নিবৃত্ত যে হয়।।
মধ্যে গিয়া দাঁড়াইল গুরুর নন্দন।
নিবৃত্ত হইল দোঁহে ভীম দুর্য্যোধন।।
তবে আজ্ঞা কৈল গুরু অর্জ্জুনে আসিতে।
আইলেন ধনঞ্জয় ধনুঃশর হাতে।।
নব-জলধর-প্রায় অঙ্গের বরণ।
পূর্ণ-শশধর মুখে, রাজীব লোচন।।
দেখিয়া মোহিত হৈল যত সভাজন।
কেহ বলে, আইলেন কুন্তীর নন্দন।।
কেহ বলে, পাণ্ডুপুত্র পাণ্ডব মধ্যম।
কেহ বলে, কুরুশ্রেষ্ঠ রিপুগণ-যম।।
বীর-ধর্ম্মশীল সাধু সর্ব্বলোকে বলে।
ইহা সম বীর্য্যবন্ত নাহি ভূমণ্ডলে।।
এইমত কথাবার্ত্তা হয় যে সভাতে।
ধন্য ধন্য বলি শব্দ হৈল আচম্বিতে।।
শব্দ শুনি ধৃতরাষ্ট্র বিদুরে পুছিল।
কি হেতু এমত শব্দ সভাতে উঠিল।।
বিদুর বলেন, রাজা আইল অর্জ্জুন।
সভাসদ্ সকলে প্রশংসে তার গুণ।।
ধৃতরাষ্ট্র শুনি প্রশংসিলেন বিস্তর।
কুরু-বংশে ভাগ্য মম এমত কুমার।।
ধন্য কুন্তী হেন পুত্র গর্ভে জন্মাইল।
যাহার মহিমা যশ সভাতে পূরিল।।
কুন্তীদেবী শুনি আনন্দিত হৈল মন।
স্তনযুগে ঝরে দুগ্ধ, সজল নয়ন।।
তবে পার্থ মহাবীর সভামধ্যে গিয়া।
সভাতে পূরেন শব্দ ধনু টঙ্কারিয়া।।
মারিল অনল-অস্ত্র হইল অনল।
অগ্নি পরশিল গিয়া গগন-মণ্ডল।।
দেখিয়া সকল লোক মানিল বিস্ময়।
চতুর্দ্দিকে দেখে সব, হৈল অগ্নিময়।।
যুড়িয়া বরুণ-বাণ কুন্তীর কুমার।
নিবর্ত্তিল অগ্নিবৃষ্টি, বর্ষে জলাধার।।
বায়ু অস্ত্রে নিবারিল জল-বরিষণ।
আকাশ-অস্ত্রেতে বায়ু করেন বারণ।।
সন্ধিয়া পর্ব্বত-অস্ত্রে করি গিরিবর।
পর্ব্বত করেন চূর্ণ মারি বজ্রশর।।
ভূমি-অস্ত্রে নির্ম্মাণ করেন ভূমণ্ডল।
সিন্ধু-অস্ত্রে জল পূর্ণ করেন সকল।।
অন্তর্দ্ধান-অস্ত্র মারি লুকাইল নিজে।
কোথায় আছেন, কেহ নাহি পায় খুঁজে।।
কভু রথে ধনঞ্জয়, কভু ভূমিপরে।
বাদিয়ার বাজি যেন চক্ষে ধাঁ ধাঁ করে।।
হেনমতে নানাবিদ্যা অর্জ্জুন প্রকাশে।
ধন্য ধন্য বলি সর্ব্ব সভাসদে ভাষে।।
নিবর্ত্তিয়া সব বিদ্যা ইন্দ্রের নন্দন।
বাহুস্ফোটে করিলেন বজ্রের নিঃস্বন।।
সেই শব্দে সবার কর্ণেতে লাগে তালি।
গুরু-আগে রহিলেন করি কৃতাঞ্জলি।।
মহাভারতের কথা অমৃত-অর্ণবে।
পাঁচালী-প্রবন্ধে কহে কাশীরাম দেবে।।