এদিকে ইন্দ্রের পুরে বীর ধনঞ্জয়।
ইন্দ্রের আদরে পান সর্ব্বত্র বিজয়।।
নানা বিদ্যা পাইলেন, নাহি পরিমাণ।
নৃপে গুণে পরাক্রমে ইন্দ্রের সমান।।
দেবতা গন্ধর্ব্ব যক্ষ রক্ষ বিদ্যাধর।
আছিল ছত্রিশ কোটি যত পরাৎপর।।
শিখাইল অস্ত্র সহ সবে নিজ মায়া।
ইন্দ্রের নন্দন জানি সবে করে দয়া।।
নৃত্যগীতে বিশারদ ক্ষমী নম্র ধীর।
শান্ত মূর্ত্তি সদা সর্ব্বগুণেতে গভীর।।
হেনমতে মহাসুখে আছে কুন্তীসুত।
দেখিয়া আনন্দযুত দেব পুরুহূত।।
তবে ইন্দ্র জানিল অর্জ্জুন পরাক্রম।
সুরাসুর নাগ নরে কেহ নহে সম।।
নিবাতকবচ দৈত্য কালকেয় আদি।
অসাধ্য সাধন যত দেবের বিবাদী।।
বিনা পার্থ নাশিবারে নাহি অন্য জন।
আনিলাম অর্জ্জুনেরে এই সে কারণ।।
প্রাণের অধিক প্রিয় পুত্র ধনঞ্জয়।
হেন সঙ্কটেতে পাঠাইতে যোগ্য নয়।।
নহিলে না হয় কিন্তু বৈরী নিপাতন।
সাক্ষাতে কহিতে লজ্জা করে বিবেচন।।
এমন উদ্বেগচিত্ত অমরের পতি।
ডাকিয়া আনিল শীঘ্র মাতলি সারথি।।
একে একে কহিল যতেক সমাচার।
পার্থ বিনা নাহি ইথে করিতে উদ্ধার।।
না কহিয়া ধনঞ্জয়ে এই বিবরণ।
ছলে পাঠাইব স্বর্গ করতে ভ্রমণ।।
সহিত যাইবে তুমি, জানাবে সকল।
প্রথমে যাইবে যত দেবতার স্থল।।
সপ্ত স্বর্গে বাস করে যত যত জন।
দেবতা গুহ্যক সিদ্ধ গন্ধর্ব্ব চারণ।।
ক্রমে ক্রমে দেখাইবে সবার আলয়।
প্রফুল্ল দেখিবে যবে বীর ধনঞ্জয়।।
আমার পরম শত্রু কহিবে অসুর।
গতায়াতে পথভ্রমে যাইবে সে পুর।।
জানিয়া বিরোধ পার্থ অবশ্য করিবে।
অর্জ্জুনের বাণে দুষ্ট সংহার হইবে।।
এমত হইলে তবে ঘুচিবে অনর্থ।
এইরূপে সাধ কার্য্য না জানিবে পার্থ।।
শুনিয়া মাতলি কহে, যে আজ্ঞা তোমার।
এরূপ হৈলে হইবে অসুর সংহার।।
মাতলিরে বিদায় করিল সুরমণি।
কোনমতে গেল দিন, প্রভাত রজনী।।
উঠিয়া সানন্দমতি সহস্রলোচন।
নিত্য নিয়মিত কর্ম্ম করি সমাপন।।
বসিলা সভার মাঝে সহস্রলোচন।
মাতলি আসিয়া আগে করে নিবেদন।।
হেনকালে উপনীত পার্থ ধনুর্দ্ধর।
নিজ পার্শ্বে বসাইল শচীর ঈশ্বর।।
প্রশংসা করিয়া অঙ্গে বুলাইল হাত।
কহিল পার্থের প্রতি বিবুধের নাথ।।
স্বকার্য্য সাধিলা পুত্র আপনার গুণে।
অনেক বিলম্ব হৈল সেই সে কারণে।।
না দেখি তোমার মুখ ধর্ম্মের তনয়।
চিন্তাযুক্ত থাকিবেন, মম মনে লয়।।
এখন বিলম্বে আর নাহি কিছু কাজ।
ভেটিতে উচিত হয় শীঘ্র ধর্ম্মরাজ।।
রথ আরোহণ করি মাতলি সংহতি।
স্বর্গের বৈভব দেখি এস শীঘ্রগতি।।
আজ্ঞা পেয়ে আনে রথা মাতলি সত্বর।
ইন্দ্রেরে প্রণাম করি পার্থ ধনুর্দ্ধর।।
সসজ্জ হইয়া ধনুর্ব্বাণ লয়ে হাতে।
গোবিন্দ বলিয়া বীর চড়িলেন রথে।।
মাতলি চালায় রথ, অতি বিচক্ষণ।
পবন অধিক বেগে রথের গমন।।
ক্রমে ক্রমে দেখে যত অমর আলয়।
নন্দন কাননে যান বীর ধনঞ্জয়।।
অতি সে সুন্দর বন মুনি মনোলোভা।
প্রফুল্লিত পুষ্পবন মনোহর শোভা।।
নিরন্তর মূর্ত্তিমন্ত আছে ছয় ঋতু।
মত্ত হয়ে বিহার, করয়ে মৎস্যকেতু।।
মধুপানে মদমত্ত ভ্রমর ঝঙ্কার।
কোকিলের রব বিনা নাহি শুনি আর।।
প্রতি ডালে কলরব করে নানা পক্ষ।
মৃগমৃগী মৃগেন্দ্রাদি চরে লক্ষ লক্ষ।।
নানা পক্ষী সুশোভিত, রম্য ফুল ফল।
মন্দ মন্দ সদা গতি বায়ু সুশীতল।।
দেখিয়া বনের শোভা পরম কৌতুকে।
দিন কত এই স্থানে রহে হেন সুখে।।
তথা হৈতে গেল পার্থ গন্ধর্ব্বের পুরী।
দেখিল নিবসে যত কৌতুকে বিহরি।।
নৃত্য গীতে আনন্দিত সবাকার মন।
সমান বয়স বেশ আছে যত জন।।
হেনমতে অপ্সর কিন্নর আদি যত।
ভ্রমণ করয়ে পার্থ চালাইয়া রথ।।
যথাক্রমে সপ্ত স্বর্গ দেখিয়া সকল।
আনন্দে বিহ্বল চিত্ত পার্থ মহাবল।।
আপনারে সাধুবাদ করিলেন মনে।
ধন্য আমি, এত সব দেখিনু নয়নে।।
তবেত মাতলি গেল যমের ভবন।
নানা কার্য্য দেখিলেন কুন্তীর নন্দন।।
দেখেন ধর্ম্মের সভা, ধর্ম্মের বিচার।
পুণ্যবন্ত সুখে আছে, দুঃখে পাপাচার।।
পুণ্যবন্ত লোক যত দিব্য সিংহাসনে।
করিছে বিবিধ ভোগ আনন্দ বিধানে।।
পাপীর কষ্টের কথা কহনে না যায়।
প্রহার করিয়া তারে নরকে ডুবায়।।
মহাপাপী যতজন পড়িয়া নরকে।
কৃমির কামড়ে পাপী পরিত্রাহি ডাকে।।
ঘোর অন্ধকার কূপে পাপী মারা যায়।
গোময় পোকায় তার মাথা খুলি খায়।।
দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন পাণ্ডুর নন্দন।
মাতলি জানিয়া তবে করিল গমন।।
চোরের নিদ্রায় যথা নাহি প্রয়োজন।
ইন্দ্রকার্য্যে জাগে তথা মাতলির মন।।
সপ্ত স্বর্গে ছিল যত কৌতুক অশেষ।
অর্জ্জুনে দেখায়ে যায় দৈত্যগণ দেশ।।
মহাভারতের কথা অমৃত সমান।
কামীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবাণ।।