ত্রিসপ্ততিতম অধ্যায়
শকুন্তলার বিবাহপ্রস্তাব
দুষ্মন্ত কহিলেন, “হে কল্যাণি! তোমার জন্মবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া বুঝিলাম, তুমি রাজপুৎত্রী; অতএব তুমি আমার ভার্য্যা হইতে পার। এক্ষণে বল, তোমার কি প্রিয়কার্য্য সম্পাদন করিব। হে সুন্দরী! আমি তোমার নিমিত্ত স্বর্ণমালা, বস্ত্র, সুবর্ণকুণ্ডল ও নানাদেশোদ্ভব বিচিত্র মণিরত্নাদি আহরণ করিব এবং অদ্যাবধি আমার এই সাম্রাজ্য তোমার হস্তগত হইবে; তুমি আমাকে গান্ধর্ব্ববিধানানুসারে বিবাহ কর। গান্ধর্ব্ব-বিবাহ সকল বিবাহ অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ।” শকুন্তলা কহিলেন, “রাজন্! আমার পিতা ফল আহরণ করিতে গিয়াছেন। আপনি ক্ষণকাল বিলম্ব করুন, তিনি আসিয়া আমাকে আপনার হস্তে সম্প্রদান করিবেন।” দুষ্মন্ত কহিলেন, “সুন্দরী! তোমার রূপলাবণ্য দেখিয়া আমি নিতান্ত মুদ্ধ হইয়াছি; আমার মন অন্যান্য বিষয় পরিত্যাগ করিয়া কেবল তোমারই লাবণ্য-সলিলে মগ্ন হইয়াছে; আর তুমি ভাবিয়া দেখ, তোমার আপন শরীরের প্রতি তোমার সম্পূর্ণ হিতৈষিত্ব ও কর্ত্তৃত্ব আছে; অতএব তুমি স্বয়ংই আমার হস্তে আত্মসমর্পণ কর। ধর্ম্মশাস্ত্রে অষ্টবিধ বিবাহ নির্দ্দিষ্ট আছে। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য, প্রাজাপত্য, আসুর, গান্ধর্ব্ব, রাক্ষস ও পৈশাচ। ভগবান্ স্বয়ম্ভুব মনু এই সর্ব্ববিধ বিবাহের যথাসম্ভব ব্যবস্থা সংস্থাপন করিয়া গিয়াছেন। ব্রাহ্ম, দৈব, আর্য ও প্রাজাপত্য এই চারি প্রকার বিবাহ ব্রাহ্মণের পক্ষে প্রশস্ত। ব্রাহ্মাদি গান্ধর্ব্বান্ত যট্প্রকার বিবাহ ক্ষৎত্রিয়ের পক্ষে প্রশস্ত। রাজাদিগের উক্ত যট্প্রকার বিবাহে এবং রাক্ষস-বিবাহেও অধিকার আছে। বৈশ্য ও শূদ্রের পক্ষে কেবল আসুর বিবাহই বিহিত। অতএব ব্রাহ্মণ ও ক্ষৎত্রিয়ের পৈশাচ ও আসুর বিবাহ কদাপি কর্ত্তব্য নহে। দেখ, যদি গান্ধর্ব্ব ও রাক্ষস বিবাহ ক্ষৎত্রিয়দিগের ধর্ম্মসংযুক্ত হইল, তবে আর শঙ্কার বিষয় কি? এক্ষণে গান্ধর্ব্ব-বিধানেই হউক বা রাক্ষস বিধানেই হউক কিংবা গান্ধর্ব্ব ও রাক্ষস উভয়ের বিমিশ্র বিধানেই হউক, আমাকে বিবাহ করিয়া আমার মনোরথ পরিপূর্ণ কর।”
শকুন্তলা কহিলেন, “হে পৌরবশ্রেষ্ঠ! আপনি যাহা কহিলেন, ইহা যদি শাস্ত্রসম্মত হয় এবং আমার যদি আত্মসমর্পণে প্রভুতা থাকে, তবে, আমি যাহা প্রার্থনা করিতেছি, এই বিষয়ে আপনাকে অঙ্গীকার করিতে হইবে। আপনার ঔরসে আমার গর্ভে যে পুৎত্র জন্মিবে, সে আপনি বিদ্যমানে যুবরাজ ও অবিদ্যমানে অধিরাজ হইবে; যদ্যপি আপনি এই বিষয়ে প্রতিশ্রুত হন, তবে আমি আপনার হস্তে আত্মসমর্পণ করিতে পারি।”
দুষ্মন্ত-শকুন্তলার বিবাহ
রাজা দুষ্মন্ত শকুন্তলার সেই বাক্য শ্রবণে কিঞ্চিন্মাত্রও বিবেচনা না করিয়া ‘তথাস্তু’ বলিয়া স্বীকার করিলেন এবং কহিলেন, “হে নিতন্বিনি! আমি যথার্থই কহিতেছি, তোমাকে স্বীয় নগরে লইয়া যাইব।” এই বলিয়া গান্ধর্ব্ব-বিধানে সেই মরালগামিনী [রাজহংসীর ন্যায় মন্দগতিশালিনী] শকুন্তলার পাণিগ্রহণপূর্ব্বক তাঁহার সহিত ক্রীড়াকৌতুক করিলেন। রাজাধিরাজ দুষ্মন্ত এইরূপে শকুন্তলার পাণিগ্রাহণ করিয়া এবং “তোমাকে অচিরাৎ লইয়া যাইবার নিমিত্ত চতুরঙ্গিণী [অশ্ব, হস্তী, রথ ও পদাতি এই চারি প্রকার বলবিশিষ্ট] সেনা প্রেরণ করিব”, এই কথা বারংবার কহিয়া তাঁহার বিশ্বাসোৎপাদনপূর্ব্বক তথা হইতে প্রস্থান করিলেন।
রাজা গমনমার্গে চিন্তা করিতে লাগিলেন, মহাতপাঃ ভগবান্ কণ্ব এই ব্যাপার জানিতে পারিলে না জানি ক্রোধভরে আমার কি সর্ব্বনাশ করিবেন। তিনি এইরূপ নানাপ্রকার কল্পনা করিতে করিতে আপন নগরে প্রবেশ করিলেন। এদিকে ক্ষণমাত্র পরে মহর্ষি কণ্ব স্বীয় আশ্রমে আগমন করিলেন। শকুন্তলা লজ্জায় অধোমুখী হইয়া তাঁহার নিকট গমন করিতে পারিলেন না। তখন মহর্ষি দিব্যজ্ঞান-প্রভাবে সমস্ত ব্যাপার অবগত হইয়া কহিলেন, “বৎস! তুমি আমার অনুপস্থিতি সময়ে যে পুরুষসংসর্গ করিয়াছ, তাহাতে তোমার ধর্ম্ম নষ্ট হয় নাই। ক্ষৎত্রিয়দিগের গান্ধর্ব্ব-বিবাহই প্রশস্ত। সকামা স্ত্রীর সহিত সকাম পুরুষের নির্জ্জনে যে বিবাহ হয়, তাহাকেই গান্ধর্ব্ব-বিবাহ কহে। হে বৎস! রাজা দুষ্মন্ত অতি মহাত্মা ও ধর্ম্মাত্মা। তুমি সেই মহাত্মাকে পতিত্বে বরণ করিয়াছ। তোমার গর্ভে এক মহাবলপরাক্রান্ত পুৎত্র জন্মিবে। সেই পুৎত্র সসাগরা ধরার একাধিপতি হইয়া অপ্রতিহতরূপে সর্ব্বত্র গমনাগমন করিতে পারিবে।” মুনিবর এইরূপে শকুন্তলার লজ্জাপনোদনপূর্ব্বক স্কন্ধ হইতে ফলভার নামাইয়া পাদ-প্রক্ষালন করিলেন এবং বিশ্রামার্থ সুখাসনে উপবেশন করিলেন। তখন শকুন্তলা কহিলেন, “তাত! আমি মহারাজ দুষ্মন্তকে বরণ করিয়াছি। আপনি অনুকম্পা-প্রদর্শনপূর্ব্বক তাঁহার প্রতি প্রসন্ন হউন।” কণ্ব কহিলেন, “বৎসে! আমি তোমার নিমিত্ত রাজার প্রতি প্রসন্নই আছি। এক্ষণে তুমি স্বাভিলষিত বর প্রার্থনা কর।” শকুন্তলা মহর্ষির বাক্য শ্রবণ করিয়া রাজা দুষ্মন্তের হিতাকাঙ্ক্ষায় কহিলেন, “হে পিতাঃ! যদি প্রসন্ন হইয়া থাকেন, তবে এই বর প্রদান করুন যে, পুরুবংশীয়েরা যেন কখন রাজ্যচ্যুত বা অধর্ম্ম পরায়ণ না হন।” মহর্ষি কণ্ব ‘তথাস্তু’ বলিয়া বর প্রদান করিলেন।