৭২তম অধ্যায়
ভীষ্মযুদ্ধে পাণ্ডবাপরাজয়
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর শিখণ্ডী মৎস্যরাজ বিরাটের সহিত সমবেত হইয়া দুৰ্জয় ভীষ্মের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। মহাবীর ধনঞ্জয় দ্রোণ, কৃপ, বিকর্ণ ও মহাবলপরাক্রান্ত অন্যান্য ভূপালগণের অভিমুখে গমন করিলেন। ভীমসেন অমাত্য ও বন্ধুবৰ্গসমবেত সৈন্ধব [জয়দ্ৰথ], মহাধনুৰ্দ্ধর দুৰ্য্যোধন, দুঃসহ ও অন্যান্য প্রাচ্য ও দাক্ষিণাত্য ভূপালগণের সন্নিহিত হইলেন। দুর্জ্জয় শকুনি ও তাঁহার পুত্র উলুকের নিকট গমন করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির দুৰ্য্যোধনকর্ত্তৃক পরাভূত হইয়া নাগবলে [গজারোহী সৈন্যমধ্যে] গমন করিলেন। যুদ্ধে ইন্দ্রতুল্য মাদ্রীতনয় নকুল ত্রিগর্ত্তগণের মহারথদিগের সহিত মিলিত হইলেন। সাত্যকি, চেকিতান ও অভিমন্যু শাল্ব ও কৈকয়দিগের প্রতি ধাবমান হইলেন। মহাবীর ধৃষ্টকেতু ও রাক্ষস ঘটোৎকচ দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি আপনার পুত্ৰগণের রথসৈন্যসন্নিধানে উপনীত হইলেন। সেনাপতি ধৃষ্টদ্যুম্ন উগ্রকর্ম্মা দ্রোণের নিকট গমন করিলেন। হে মহারাজ! এইরূপে আপনার পক্ষীয় বীরগণ পাণ্ডবদিগের সহিত সমবেত হইয়া ঘোরতর যুদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন। ভগবান মরীচিমালী নভোমণ্ডলের মধ্যবর্ত্তী হইয়া অতিশয় তাপিত করিলে কৌরব ও পাণ্ডবেরা পরস্পর প্রহার করিতে লাগিলেন। হেমচিত্রিত, ব্যাঘ্রচর্ম্মপরিবৃত, পতাকাসম্পন্ন রথীসকল রণস্থলে সঞ্চরণ করিতে লাগিল, জিগীষাপরবশ সমবেত বীরপুরুষেরা গর্জ্জনশীল সিংহের ন্যায় তুমুল ধ্বনি করিতে প্ৰবৃত্ত হইলেন। তখন আমরা সেই নিদারুণ কুরু-সৃঞ্জয়গণের সমর সন্দর্শন করিতে লাগিলাম; চতুর্দ্দিক শরজালে সমাচ্ছন্ন হইলে দিক, কি বিদিক, কি আকাশ, কি সূৰ্য্য, কিছুই দৃষ্টিগোচর হইল না। বিমলাগ্রভাগ [তীক্ষ্ন অগ্রভাগ] শক্তির, নিক্ষিপ্ত তোমারের ও নিশিত খড়্গের নীলোৎপলতুল্য প্রভায় এবং বিচিত্র কবচের ও ভূষণের কান্তিতে আকাশমণ্ডল উদ্ভাসিত হইল। ভূপালগণের চন্দ্ৰসূৰ্য্যসমপ্ৰভাসম্পন্ন দেহে রণস্থল সুশোভিত হইয়া উঠিল। রথারূঢ় প্রধান প্রধান বীর সকল রণস্থলে উপস্থিত হইয়া নভোমণ্ডলস্থ গ্রহের ন্যায় শোভা ধারণ করিলেন।
“মহাবীর ভীষ্ম ক্রোধাবিষ্ট হইয়া সৈন্যসমক্ষে ভীমসেকে নিবারণপূর্ব্বক রুক্সপুঙ্খ, শিলাশিত [তীক্ষ্নীকৃত-শাণ দেওয়া], তৈলধৌত, সুতীক্ষ্ন শরজাল পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবল পরাক্রান্ত ভীম ক্রুদ্ধ আশীবিষসঙ্কাশ মহাবেগসম্পন্ন এক শক্তি ভীষ্মের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। মহাবীর ভীষ্ম সন্নতপর্ব্বশরনিকরে সেই সুবৰ্ণদণ্ডমণ্ডিত নিতান্ত দুরাসদ শক্তি খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন এবং নিশিতভল্লদ্বারা ভীমসেনের কামুক দুই খণ্ড করিলেন। তখন সাত্যকি ভীষ্মের সন্নিহিত হইয়া আকর্ণসমকৃষ্ট, সুতীক্ষ্ন, অতিবেগশালী বহুসংখ্যক শরদ্বারা তাঁহাকে আচ্ছন্ন করিতে লাগিলেন। ভীষ্ম পরম দারুণ সুতীক্ষ্ন শরসন্ধান করিয়া সাত্যকির রথ হইতে সারথিকে নিপাতিত করিলেন। সারথি নিহত হইলে মনোমারুতগামী তুরঙ্গসমূহ ইতস্ততঃ ধাবমান হইল; তখন সৈন্যেরা কোলাহল করিতে লাগিল; পাণ্ডবেরা হাহাকার করিয়া উঠিলেন। “তোমরা ধাবমান হও, অশ্বদিগকে গ্ৰহণ কর, বন্ধন কর, যুযুধানের রথের প্রতি এইরূপ তুমুল শব্দ সমুত্থিত হইল। এই অবসরে শান্তনুনন্দন ভীষ্ম পাণ্ডবসেনা সংহার করিলেন; সোমক ও পঞ্চালসেনাসকল দৃঢ়তর অধ্যবসায়সহকারে তাঁহার প্রতি ধাবমান হইল এবং পাণ্ডবেরা ধৃষ্টদ্যুম্নপ্রভৃতি ভূপালবর্গের সহিত দুৰ্য্যোধন-সেনা বিনাশ করিবার নিমিত্ত ভীষ্মের অভিমুখে ধাবমান হইলেন। ভীষ্ম, দ্রোণপ্রভৃতি কৌরবপক্ষীয় বীরেরাও তাঁহাদিগের প্রতি বেগে গমন করিতে লাগিলেন। অনন্তর ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল।”