দ্বিসপ্ততিতম অধ্যায়
বিশ্বামিত্রের তপোভঙ্গ
“অনন্তর পিতা সেই ঋষিকে কহিলেন, ইন্দ্র মেনকার প্রার্থনানুসারে বায়ুকে আদেশ করাতে বায়ু মেনকার সহিত মহর্ষি বিশ্বামিত্রের আশ্রমে গমন করিলেন। বরবর্ণিনী মেনকা তথায় উপস্থিত হইয়া দেখিল, মহর্ষি তপস্যা দ্বারা সমস্ত পাপ ধ্বংস করিয়াও ক্ষান্ত হয়েন নাই, ঘোরতর তপোনুষ্ঠান করিতেছেন। পরে সে সভয়-অন্তঃকরণে ঋষিকে প্রণাম করিয়া তাঁহার সম্মুখে ক্রীড়া করিতে আরম্ভ করিল। বায়ু অবসর বুঝিয়া তাহার পরিধেয়-বস্ত্র হরণ করিয়া দূরে নিক্ষেপ করিল। মেনকা সাতিশয় লজ্জিত হইয়া বসন আনায়নার্থে দ্রুতপদে গমন করিতেছে, এমন সময়ে অগ্নিসম-তেজস্বী মহর্ষি বিশ্বামিত্রে তাহাকে তদবস্থান্বিতা দেখিলেন এবং তাহার রূপলাবণ্য দর্শনে কন্দর্পশরে জর্জ্জরিতহৃদয় হইয়া নিকটে আহ্বান করিলেন। মেনকার তাহাই অভিসন্ধি ছিল, সুতরাং সে তাহাতে সম্মত হইয়া মুনিসন্নিধানে গমন করিল। মহর্ষি তাহাকে পাইয়া তপ, জপ প্রভৃতি সমস্ত ধর্ম্মকর্ম্মে জলাঞ্জলি প্রদানপূর্ব্বক দিনযামিনী কেবল সেই কামিনীর সহিত ক্রীড়াকরতঃ পরমসুখে কালাতিপাত করিতে লাগিলেন।
শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত
এইরূপে কিয়দ্দিন অতীত হইলে মেনকা মুনির সহযোগে গর্ভবতী হইল। অনন্তর মেনকা যথাকালে হিমালয়ের প্রস্থে এক কন্যা প্রসব করিল এবং সেই সদ্যোজাতা কন্যাকে মালিনী নদীর তীরে নিক্ষেপ করিয়া দেবরাজসভায় প্রস্থান করিল। পক্ষিগণ হিংস্রজন্তু-সমাকীর্ণ নির্জ্জন বনে সেই সদ্যোজাতা অসহায়া কন্যাকে পতিতা দেখিয়া সদয় হৃদয়ে তাহার চতুর্দ্দিক্ বেষ্টন করিয়া রক্ষা করিতে লাগিল। হে তপোধন! আমি সেই সময়ে মালিনীতে স্নান করিতে গমন করিয়াছিলাম, সেই সদ্যোজাত কন্যাকে নির্জ্জন কাননে পক্ষিগণমধ্যে অধিশয়ানা দেখিয়া আমার হৃদয়ে কারুণ্যরসের উদয় হইল। পরে তথা হইতে আশ্রমে আনয়ন করিয়া স্বীয় কন্যার ন্যায় লালন-পালন করিতে লাগিলাম। কন্যাটি শকুন্ত অর্থাৎ পক্ষিকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়াছিল বলিয়া তাহার নাম শকুন্তলা রাখিলাম। ধর্ম্মশাস্ত্রে কথিত আছে, শরীরদাতার ন্যায় প্রাণদাতা ও অন্নদাতাকেও পিতা বলা যায়, এই নিমিত্ত শকুন্তলা আমার কন্যা হইয়াছেন। অগর্হিতা শকুন্তলাও আমাকে যথার্থ-ই পিতা বলিয়া জানেন।”
শকুন্তলা রাজাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে নরনাথ! মহর্ষি কণ্ব সেই মুনিকর্ত্তৃক পৃষ্ট হইয়া তাঁহাকে আমার জন্মবৃত্তান্ত এইরূপ কহিয়াছিলেন, অতএব আপনিও আমাকে এইরূপে কণ্বের দুহিতা জানুন। আমি স্বীয় পিতাকে জানি না, ভগবান্ কণ্বকেই আমি পিতা বলিয়া জানি। হে রাজন্! আমি পূর্ব্বে পিতার মুখে যাহা শ্রবণ করিয়াছিলাম, তাহা অবিকল বর্ণন করিলাম।”