তবে একদিন তথা দ্রোণ-গুরু-স্থানে।
আইল নিষাদ এক শিক্ষার কারণে।।
হিরণ্যধনুর পুত্র একলব্য নাম।
দ্রোণের চরণে আসি করিল প্রণাম।।
যোড়হাত করি বলে বিনয় বচন।
শিক্ষা হেতু আইলাম তোমার সদন।।
দ্রোণ বলিলেন তুই হোস্ নীচ জাতি।
তোরে শিক্ষা করাইলে হইবে অখ্যাতি।।
অনেক বিনয়ে বলে নিষাদ-নন্দন।
তথাপি তাহারে না করান অধ্যয়ন।।
দ্রোণাচার্য্য-মুখে বাক্য নিষ্ঠুর শুনিল।
দণ্ডবৎ করিয়া অরণ্যে প্রবেশিল।।
নিষাদের বেশ ত্যাজি হৈল ব্রহ্মচারী।
জটা-বল্ক-পরিধান, ফল-মূলাহারী।।
মৃত্তিকার দ্রোণ মূর্ত্তি করিয়া রচন।
নানা পুষ্প দিয়া তাঁর করয়ে পূজন।।
নিরন্তর একলব্য হাতে ধনুঃশর।
সর্ব্ব অস্ত্র শিখি হৈল মহা ধনুর্দ্ধর।।
তবে কতদিন পরে কৌরব-নন্দন।
সেই বনে গেল সবে মৃগয়া কারণ।।
কেহ রথে, কেহ গজে, কেহ তুরঙ্গমে।
সঙ্গেতে চলিল পরিবার ক্রমে ক্রমে।।
মৃগয়া-নিপুণ গুণী লইয়া সংহতি।
মহাবনে প্রবেশ করিল শীঘ্রগতি।।
মৃগয়া করিছে যত রাজার কোঙর।
হেনকালে এক পাণ্ডবের অনুচর।।
করিয়া কুক্কুর সঙ্গে যায় পাছে পাছে।
উত্তরিল যথায় নিষাদপুত্র আছে।।
মৃত্তিকা-পুত্তলি আগে করি যোড়কর।
বসিয়াছে ব্রহ্মচারী হাতে ধনুঃশর।।
শব্দ করে কুক্কুর দেখিয়া ব্রহ্মচারী।
চারিভিতে ভ্রমে তারে প্রদক্ষিণ করি।।
কুক্কুরের শব্দে তার ভাঙ্গিল যে ধ্যান।
ক্রোধে কুক্কুরের মুখে মারে স্তব্ধবাণ।।
না মরিল কুক্কুর না হৈল মুখে ঘা।
অলক্ষিতে কুক্কুরের রুধিলেক রা।।
কুক্কুর নিঃশব্দে ধায় মুখে স্তব্ধশর।
কতক্ষণে গেল তবে কুমার-গোচর।।
কুক্কুরের মুখে শর আশ্চর্য্য দেখিয়া।
জিজ্ঞাসিল অনুচরে বিস্ময় হইয়া।।
এ হেন অদ্ভুতকর্ম্ম কভু নাহি শুনি।
বহুবিদ্যা জানি হেন বিদ্যা নাহি জানি।।
লজ্জায় মলিন হৈল যত ভ্রাতৃগণ।
চল যাই দেখিব বিন্ধিল কোন্ জন।।
অনুচরে লৈয়া গেল যথা ব্রহ্মচরী।
দেখিল বসিয়া আছে ধনুঃশর ধরি।।
জিজ্ঞাসিল, হও তুমি কোন্ মহাজন।
কার স্থানে এ বিদ্যা করিলা অধ্যায়ন।।
ব্রহ্মচারী বলে, মম একলব্য নাম।
দ্রোণ-গুরুস্থানে অস্ত্র-শিক্ষা করিলাম।।
শুনিয়া বিস্ময় মানে যতেক কুমার।
অর্জ্জুন শুনিয়া চিন্তা করেন অপার।।
মৃগয়া সম্বরি তবে যত ভ্রাতৃগণ।
দ্রোণস্থানে করিলেন সব নিবেদন।।
বিনয়ে কহেন পার্থ বিরস-বদন।
আমারে নিগ্রহ কর বুঝিনু এখন।।
পূর্ব্বেতে আমার কাছে কৈলা অঙ্গীকার।
তব সম প্রিয় শিষ্য নাহিক আমার।।
তোমার সদৃশ বিদ্যা নাহি দিব কারে।
এখন ছলনা প্রভু করিলা আমারে।।
পৃথিবীতে যেই বিদ্যা অগোচরে নরে।
হেন বিদ্যা শিখাইলে নিষাদ-কুমারে।।
অর্জ্জুনের বাক্যে দ্রোণ মানিয়া বিস্ময়।
ক্ষণেক নিঃশব্দে চিন্তা করেন হৃদয়।।
অর্জ্জুনেরে বলেন, সে আছে কোন্ স্থানে।
শীঘ্রগতি চল তথা যাব দুইজনে।।
দ্রোণ আর অর্জ্জুন করিলেন গমন।
দ্রোণে দেখি ধীরে উঠি নিষাদ-নন্দন।।
দূরে থাকি ভূমে লুটি প্রণাম করিল।
কৃতাঞ্জলি হইয়া অগ্রেতে দাণ্ডাইল।।
নিষাদ-নন্দন বলে মধুর বচন।
আজ্ঞা কর গুরু, হেথা কোন্ প্রয়োজন।।
দ্রোণ বলিলেন, যদি তুমি শিষ্য হও।
তবে গুরুদক্ষিণা আমারে আজি দাও।।
একলব্য বলে প্রভু মম ভাগ্যবশে।
কৃপা করি আপনি আইলা মোর পাশে।।
এ দ্রব্য সে দ্রব্য নাহি করিব বিচার।
সকল দ্রব্যেতে হয় গুরু-অধিকার।।
যে কিছু মাগিবা প্রভু সকলি তোমার।
আজ্ঞা কর গুরু করিলাম অঙ্গীকার।।
দ্রোণ বলিলেন, যদি সন্তোষ করিবে।
দক্ষিণ হস্তের বৃদ্ধ অঙ্গুলিটা দিবে।।
গুরুর আজ্ঞায় সে বিলম্ব না করিল।
ততক্ষণে কাটিয়া অঙ্গুলি গোটা দিল।।
তুষ্ট হইলেন দ্রোণ আর ধনঞ্জয়।
পার্থ জানিলেন, গুরু আমারে সদয়।।
তাহার কঠোর কর্ম্ম দেখি দুইজন।
প্রশংসা করিয়া দেশে করিলা গমন।।
মহাভারতের কথা সুধার সাগর।
কাশীরাম দাস কহে শুনে সাধু নর।।