৭২তম অধ্যায়
দুষ্টের দমন, শিষ্টের পালন—বায়ু-পুরূরবাসংবাদ
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! যিনি সাধু ব্যক্তিদিগের রক্ষণাবেক্ষণ ও অসাধুদিগের শাসন করিতে পারেন, তাহাকেই পুরোহিত করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। এই বিষয়ে বায়ু ও ঐলের পুত্র পুরূরবার কথোপকথন উপলক্ষে যে পুরাতন ইতিবৃত্ত কীৰ্ত্তিত আছে, তাহা কহিতেছি, শ্রবণ কর।
“একদা পুরূরবা বায়ুকে সম্বোধনপূৰ্ব্বক কহিলেন, পবন! ব্রাহ্মণ ও অন্যান্য বর্ণত্রয় কোথা হইতে সম্ভূত হইল এবং ব্রাহ্মণই বা কি নিমিত্ত শ্রেষ্ঠ বলিয়া পরিগণিত হইলেন, তাহা কীৰ্ত্তন কর।
“বায়ু কহিলেন, ‘মহারাজ! ব্রাহ্মণ ব্রহ্মার মুখ হইতে, ক্ষত্রিয় বাহু ইতে, বৈশ্য ঊরুযুগল হইতে এবং চতুর্থ বর্ণ শূদ্র উহার পাদদেশ হইতে সম্ভূত হইয়াছেন। এইরূপে বর্ণচতুষ্টয় সমুৎপন্ন। হইলে ব্রহ্মা এই নিয়ম করিলেন যে, ব্রাহ্মণ সকলের শ্রেষ্ঠ হইয়া ধৰ্ম্মের রক্ষণাবেক্ষণ, ক্ষত্রিয় পৃথিবীর অধীশ্বর হইয়া নিয়মিত দণ্ডবিধানদ্বারা প্রজাগণের প্রতিপালন, বৈশ্য ধনধান্যদ্বারা তিনবর্ণের ভরণপোষণ এবং শূদ্র এই তিনবর্ণের পরিচর্য্যা করিবে।
“পুরূরবা কহিলেন, ‘সমীরণ! ব্রাহ্মণ ও ক্ষত্রিয় এই দুইবর্ণের মধ্যে ধর্ম্মানুসারে কাহার পৃথিবীতে অধিকার আছে?
“বায়ু কহিলেন, ‘মহারাজ! ধৰ্ম্মবিৎ পণ্ডিতেরা কহেন যে, ব্রাহ্মণ সৰ্ব্ববর্ণের অগ্রে জন্মগ্রহণ করিয়াছেন, অতএব জগতিস্থ সমুদয় পদার্থেই ব্রাহ্মণের অধিকার আছে। ব্রাহ্মণ যাহা ভোজন, যাহা পরিধান ও দান করিয়া থাকেন, তৎসমুদয়ই তাঁহার আপনার দ্রব্য। ব্রাহ্মণ সমুদয় বর্ণের গুরু এবং সৰ্ব্বাপেক্ষা জ্যেষ্ঠ ও শ্রেষ্ঠ। কামিনীগণ যেমন পতির অবর্ত্তমানে দেবরকে পতিত্বে বরণ করে তদ্রূপ পৃথিবী ব্রাহ্মণকর্ত্তৃক পালিত না হওয়াতেই ক্ষত্রিয়কে পতিত্বে বরণ করিয়াছেন। এক্ষণে যদি তোমার ধর্ম্মানুসারে অত্যুৎকৃষ্ট স্বর্গলাভের আশা থাকে, তাহা হইলে যে কিছু ভূসম্পত্তি পরাজয় করিবে, তৎসমুদয়ই শাস্ত্রজ্ঞানসম্পন্ন, ধর্ম্মপরায়ণ, তপস্বী, স্বধর্ম্মাবলম্বী, ধনতৃষ্ণাশূন্য ব্রাহ্মণকে প্রদান করা তোমার অবশ্য কৰ্ত্তব্য। সঙ্কুলসম্ভূত, কৃতবিদ্য, বিনীতস্বভাব ব্রাহ্মণই স্বীয় অসাধারণ ধীশক্তিপ্রভাবে বিবিধ উপদেশদ্বারা নরপতির মঙ্গল বিধান করেন। যে নরপতি অহঙ্কারপরিশূন্য হইয়া ক্ষত্রিয়ধৰ্ম্মে অবস্থানপূৰ্ব্বক ব্রাহ্মণনির্দিষ্ট ধর্ম্ম প্রতিপালন করেন, তাঁহার যশঃশশধর[কীর্ত্তিরূপ চন্দ্র] চিরকাল ভূমণ্ডলে দেদীপ্যমান থাকে। রাজপুরোহিতও রাজার অনুষ্ঠিত ধৰ্ম্মের অংশভাগী হয়েন। প্রজাবর্গ নরপতিকর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া নির্ভীচিত্তে স্বধৰ্ম্ম প্রতিপালনে সমর্থ হইলে ভূপতি সেই প্রজাদিগের ধৰ্ম্মের চতুর্থ ভাগ লাভ করিয়া থাকেন। মনুষ্য, গন্ধৰ্ব্ব ও রাক্ষস সকলেই যজ্ঞদ্বারা জীবিকানির্ব্বাহ করে। দেবলোক ও পিতৃলোক যজ্ঞদ্বারাই পরিতৃপ্ত হয়েন; কিন্তু সেই যজ্ঞের অনুষ্ঠান আবার নরপতিরই আয়ত্ত। অরাজক রাজ্যে যজ্ঞের প্রসঙ্গও থাকে না। লোকে গ্রীষ্মকালে জল, বায়ু ও ছায়াদ্বারা এবং শীতকালে অগ্নি, আতপ ও বসনদ্বারা সুখলাভ করে। উৎকৃষ্ট শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধদ্বারা সকলেরই মন প্রফুল্ল হয়, কিন্তু অন্তঃকরণ সতত ভীত থাকিলে কেহই কোনপ্রকার সুখলাভে সমর্থ হয় না। অতএব যিনি জীবদিগকে অভয়দানপূর্ব্বক তাহাদের প্রাণদান করেন, তিনিই উৎকৃষ্ট পুণ্যফললাভের পাত্র সন্দেহ নাই। ত্রিলোকমধ্যে প্রাণদানের তুল্য উৎকৃষ্ট দান আর কি আছে? রাজা ইন্দ্র, যম ও ধৰ্ম্মরূপ হইয়া সমুদয় পৃথিবী প্রতিপালন করিতেছেন।”