৭১তম অধ্যায়
ভীষ্ম-অর্জ্জুন যুদ্ধ—বহুসন্যৈ হত
সঞ্জয় কহিলেন, “অনন্তর ধনঞ্জয় ভ্রাতৃগণ ও অন্যান্য পার্থিবদিগকে ভীষ্মের সহিত সংগ্রাম করিতে দেখিয়া অস্ত্ৰ উদ্যত করিয়া ধাবমান হইলেন। তাঁহার পাঞ্চজন্যের [শঙ্খের] নির্ঘোষ ও তাঁহার গাণ্ডীবের টঙ্কার শ্রবণ এবং ধ্বজদণ্ড সনদর্শন করিয়া আমাদিগের অন্তঃকরণে ভয়সঞ্চার হইল। আমরা সিংহলাঙ্গুলভূষিত, বহুবর্ণচিত্রিত, বানরলাঞ্ছিত, আকাশে প্রজ্বলিত পর্ব্বতের ন্যায় উত্থিত ধূমকেতুর সদৃশ তাঁহার দিব্যধ্বজ নিরীক্ষণ করিলাম, উহা কদাচ বৃক্ষে সংলগ্ন হয় না। যোদ্ধৃগণ নভোমণ্ডলে মেঘমধ্যস্থ বিদ্যুতের ন্যায় দীপ্তিসম্পন্ন সুবর্ণপৃষ্ঠ গাণ্ডীবশরাসন সন্দর্শন করিতে লাগিল। তিনি কৌরবসৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত হইলে আমরা দেবরাজ ইন্দ্রের ন্যায় তাঁহার অতি গভীর গর্জ্জন ও ঘোরতর তলশব্দ শ্রবণ করিতে লাগিলাম। যেমন প্রচণ্ড বায়ুপ্রেরিত ঘোরগর্জ্জনশীল সৌদামিনীমণ্ডিত ঘনমণ্ডলী চারিদিকে বারিবর্ষণ করিয়া থাকে, তদ্রূপ মহাবীর অর্জ্জুন চারিদিকে শরবর্ষণ করিয়া ভীষ্মের প্রতি ধাবমান হইলেন; কিন্তু তিনি পূর্ব্ব কি পশ্চিমাভিমুখে গমন করিলেন, তাহা আমরা অস্ত্ৰবিমোহিত [বহু অন্ত্রপাতে বিমূঢ়] হইয়া কিছুই অনুভব করিতে পারিলাম না। শ্রান্তবাহন, হতাশ্ব, হতচেতন যোদ্ধৃগণ পরস্পর আলিঙ্গন করিয়া দুর্য্যোধনাদির সহিত পলায়ন করিয়া ভীষ্মের শরণাপন্ন হইলে তিনি তাহাদিগকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। রথিসকল ভীত হইয়া, রথ হইতে ও অশ্বারোহীসকল অশ্ব হইতে নিপতিত হইতে লাগিল এবং পদাতিগণ ভূতলে পতিত হইল। সৈন্যসকল অশনিনির্ঘোষসদৃশ গাণ্ডীবাশব্দ শ্রবণ করিয়া নিতান্ত ভীত হইয়া পলায়ন করিতে লাগিল। কলিঙ্গ অধিপতি শীঘ্ৰগামী কাম্বোজদেশীয় অশ্বগণে, রক্ষাকুশল বহুসহস্ৰ গোপবলে [গোপসৈন্যে] এবং মদ্র, সৌবীর, গান্ধার, ত্ৰৈগর্ত্ত ও প্রধান প্রধান কলিঙ্গদেশীয় ব্যক্তিসমূহে পরিবৃত হইলেন। মহারাজ জয়দ্রথ বহুসংখ্যক মনুষ্য ও ভূপালগণের সহিত সমবেত হইয়া দুঃশাসনকে অগ্ৰে করিয়া রণক্ষেত্রে অবস্থান করিতে লাগিলেন। চতুৰ্দশসহস্র উৎকৃষ্ট অশ্বারোহী মহারাজ দুৰ্য্যোধনের আদেশানুসারে সৌবলকে বেষ্টন করিয়া রহিল।
“হে মহারাজ! অনন্তর পাণ্ডবগণ সমবেত হইয়া, রথ ও বাহনসকল বিভাগপূর্ব্বক আপনার পক্ষীয় বীরগণকে বিনাশ করিতে লাগিলেন। তখন সেই রণস্থলে রথ, বারণ, অশ্ব ও পদাতিদ্বারা ভুলিজাল নভোমণ্ডলে উড্ডীন হইয়া মহামেঘের ন্যায় প্রতিভাত হইল। মহাবীর ভীষ্ম তোমর, প্রাস, নারাচ, গজ, অশ্ব ও রথভূয়িষ্ঠ [রথবহুল] বলসমূদয়ে পরিবৃত হইয়া অর্জ্জুনের নিকট সমুপস্থিত হইলেন। অবন্তিরাজ কাশিরাজের সহিত, সিন্ধুরাজ ভীমসেনের সহিত, অজাতশত্রু রাজা যুধিষ্ঠির পুত্র ও অমাত্যগণসমভিব্যাহারে মদ্রাধিপতি শল্যের সহিত, বিকৰ্ণ সহদেবের সহিত ও চিত্ৰসেন শিখণ্ডীর সহিত যুদ্ধ করিবার নিমিত্ত মিলিত হইলেন। মৎস্যগণ মহারাজ দুৰ্য্যোধন ও শকুনির প্রতি গমন করিল। দ্রুপদ, চেকিতান ও সাতকি দ্রোণাচাৰ্য্য ও অশ্বত্থামার সহিত সমাগত হইলেন। কৃপ ও কৃতবর্ম্মা ধৃষ্টদ্যুম্নের প্রতি ধাবমান হইলেন। এইরূপে চতুর্দ্দিকে ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইলে রথ, অশ্ব ও হস্তিসকল ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিল। মেঘশূন্য নভোমণ্ডলে বিদ্যুৎ ও সুগভীর নিৰ্ঘোষসহকারে উল্কাসকল প্রাদুর্ভূত হইল। দিঙ্মণ্ডল ধূলিজালে সমাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল। বায়ু প্ৰচণ্ডবেগে প্রবাহিত ও অনবরত কর্কর বর্ষিত হইতে লাগিল। দিবাকর সৈন্যসমুত্থিত রেণুদ্বারা সমাচ্ছন্ন হইয়া নভোমণ্ডলে অন্তৰ্দ্ধান হইলেন। সমরোত্থিত ধূলিজালদ্বারা প্ৰাণীসকল বিমোহিত হইল। বীরবাহু-বিসৃষ্ট [বীরগণের হস্তক্ষিপ্ত] বর্ম্মভেদী শরসমূহের শব্দ অতি তুমুল হইয়া উঠিল। নক্ষত্রমণ্ডলের ন্যায় শস্ত্ৰসকল বিমল-প্রভাসম্পন্ন বীরগণের বাহুদণ্ডদ্বারা উত্তোলিত হইয়া গগনতল সুপ্রকাশিত করিল। সুবর্ণজাল সমালস্কৃত বিচিত্ৰ গোচর্ম্মসকল চতুর্দ্দিকে নিপতিত হইতে লাগিল। শরীর ও মস্তকসকল দিবাকরের ন্যায় নিতান্ত দুর্নিরীক্ষ্য, খড়্গদ্বারা নিকৃত্ত [ছিন্ন] ও চতুর্দ্দিকে নিপতিত হইয়া পরিদৃশ্যমান হইল। রথের চক্ৰ ভগ্ন, হস্তসমুদয় ছিন্ন ও অশ্বসকল বিনষ্ট হইলে মহারথীসকল ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিলেন। কতকগুলি অস্ত্রশস্ত্ৰদ্বারা ক্ষতবিক্ষতকলেবর হইয়া ভূপৃষ্ঠে পতিত হইল; কোন স্থলে রথিসকল বিনষ্ট হইলে রথসমুদয় ইতস্ততঃ ভ্ৰমণ করিতে লাগিল। কোন স্থলে বদ্ধযোক্ত্র [রজ্জুদ্বারা আবদ্ধ] অশ্বগণ শরাহত ও ভিন্নদেহ হইয়া যুগকাষ্ঠসকল আকর্ষণ করিতে লাগিল। কোন স্থানে মহাবেগসম্পন্ন একমাত্র শরদ্বারা রথী, সারথি ও অশ্ব বিনষ্ট হইল। উভয় সৈন্য পরস্পর মিলিত হইলে করিগণ অন্য হস্তীদিগের মদগন্ধ আঘ্রাণ করিয়া নাসিকদ্বারা সমীরণ গ্ৰহণ করিতে লাগিল; নারাচ-নিহত গজসমুদয় তোরণ ও মহামাত্রের সহিত নিপতিত হইয়া রণস্থল সমাচ্ছন্ন করিল, হস্তিপকদ্বারা পরিচালিত কতকগুলি হস্তী অন্য উৎকৃষ্ট হস্তীদ্বারা পরাজিত হইয়া আরোহীর সহিত নিপতিত হইল। কোন স্থলে করিগণ নাগরাজসদৃশ শুণ্ডদ্বারা রথের যুগন্ধরসকল ভগ্ন করিল এবং রথীদিগকে বৃক্ষশাখার ন্যায় কেশাকর্ষণ করিয়া চূৰ্ণ করিতে লাগিল। করিযূথ পরস্পর-সংযুক্ত রথসমূহ আকর্ষণ করিয়া চতুর্দ্দিকে গমন করিতে প্ৰবৃত্ত হইল। যেমন অন্যান্য করিকুল সরোবরে পরস্পর সংযুক্ত নলিনাজাল আকর্ষণ করিয়া শোভা পায়, তখন সেইসকল করিবার তদ্রূপ শোভা পাইতে লাগিল। এইরূপে ঐ সংগ্রামভূমি সাদী, পদাতি ও সমুন্নতধ্বজ মহারথগণদ্বারা সমাচ্ছন্ন হইয়া উঠিল।’ ”