৭১তম অধ্যায়
দময়ন্তী স্বয়ংবরবার্ত্তায় ঋতুপর্ণের বিদৰ্ভযাত্রা
বৃহদশ্ব কহিলেন, “মহারাজ! রাজা ঋতুপর্ণ সুদেবমুখে এই বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া বাহুককে মধুরবাক্যে সান্ত্বনা করিয়া কহিলেন, ‘হে অশ্ববিদ্যাবিশারদ! আমি শুনিলাম, দময়ন্তীর পুনঃস্বয়ংবর সমুপস্থিত; তদুপলক্ষে আমি একদিবসমধ্যে বিদর্ভনগরীতে উপস্থিত হইতে অভিলাষ করি; এবিষয়ে তুমি কি বিবেচনা কর? এই কথা শ্রবণ করিবামাত্র নলরাজের হৃদয় দুঃখে বিদীর্ণ হইয়া গেল। তিনি চিন্তা করিতে লাগিলেন, দময়ন্তী দুঃখবিমোহিত হইয়া যথার্থতঃই ঐরূপ অনুষ্ঠান করিবে, ইহা নিতান্ত অসম্ভব বোধ হয়, আমার নিমিত্তই এই উপায় উদ্ভাবন করিয়াছে। হা! আমি তৎকালে একান্ত অনুরাগিণী সহধর্ম্মিণীকে প্রতারণা করিয়া নিতান্ত ক্ষুদ্রের ন্যায় কি কুকর্ম্মই করিয়াছি! স্ত্রীলোকের স্বভাব অতিচঞ্চল; আমারও দোষ অতি নিদারুণ; সুতরাং দময়ন্তী চিরবিরহে তাদৃশ অসাধারণ অনুরাগ এককালে বিস্মৃত হইয়া পুনঃস্বয়ংবরের অনুষ্ঠান করিবে, ইহাও আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। কিন্তু দময়ন্তী পতিবিয়োগজনিত শোক ও নৈরাশ্যে সাতিশয় উৎকণ্ঠিতা আছে; বিশেষতঃ আমার ঔরসে তাহার দুইটি সন্তান জন্মিয়াছে; ইহাতে বোধহয়, স্বয়ংবরসংক্রান্ত কিংবদন্তী নিতান্ত অমূলক। যাহা হউক, তথায় উপস্থিত হইয়া এ বিষয়ের সত্যসত্য সম্যক অবগত হইব। এক্ষণে আমার স্বার্থসিদ্ধির নিমিত্ত ঋতুপর্ণরাজের মনোরথ পূর্ণ করিতে হইবে, সন্দেহ নাই।”
“বাহুক মনে মনে এইরূপ সিদ্ধান্ত স্থির করিয়া অতি দীনমনে কৃতাঞ্জলিপুটে ঋতুপর্ণ-রাজকে কহিলেন, “মহারাজ! আমি আপনার বাক্যে অনুমোদন করিতেছি, একদিবসমধ্যেই আপনাকে লইয়া বিদর্ভনগরীতে উপস্থিত হইব।” অনন্তর নৃপতির আদেশানুসারে অশ্বশালায় গমন করিয়া অশ্বগণকে পরীক্ষা করিতে লাগিলেন। পরে রাজার ব্যগ্রতায় শশব্যস্ত হইয়া বারংবার বিচার ও পরীক্ষা করিয়া কয়েকটি গমনপটু কৃশ অশ্ব প্রাপ্ত হইলেন। ঐ অশ্বসকল তেজোবল-সংযুক্ত, উৎকৃষ্টজাতিসম্ভূত, সুশিক্ষিত, সিন্ধুদেশজাত, হীনলক্ষণ-বিবর্জ্জিত, মারুতগামী ও দশ আবর্তে [চক্রাকার লোমরাজি—ঘুরান ঘুরান লোমদ্বারা যে চক্রাকার চিহ্ন হয়] অলঙ্কৃত; তাহাদিগের হনুদেশ বিস্তীর্ণ ও প্রোথ [নাসিকার অগ্রভাগ] অতিপৃথু।
“ঋতুপর্ণ-রাজ ঐ সকল অশ্বকে দৃষ্টিগোচর করিবামাত্র ক্ৰোধাবিষ্ট হইয়া কহিলেন, ‘অহে বাহুক! তুমি কি আমার প্রার্থনাসিদ্ধিবিষয়ে প্রতারণা করিতেছ? এই সকল অল্পপ্রাণ ও হীনবল হয়গণ কিরূপে এই দুৰ্গম বর্ত্ম [পথ] অতিক্রম করিবে?” বাহুক কহিলেন, “মহারাজ! এইসকল অশ্বের ললাটদেশে একটি, মস্তকে দুইটি, পার্শ্ব ও উপপার্শ্বে চারিটি, বক্ষঃস্থলে দুইটি ও পশ্চাদ্ভাগে একটি, এই দশটি আবর্ত্ত আছে। নিঃসংশয়ে কহিতেছি, ইহারাই বিদর্ভ-দেশে গমন করিতে সমর্থ হইবে। অথবা আপনি যে-সকল অশ্বগণকে মনোনীত করিবেন, তাহাদিগকেই আমি যোজনা করি।” ঋতুপর্ণ-রাজ কহিলেন, “হে বাহুক! তুমি অশ্বপরীক্ষায় দক্ষ, অতএব তুমি যাহাদিগকে কাৰ্যক্ষম বিবেচনা করিবে, অবিলম্বে তাহাদিগকেই রথে যোজনা কর।”
ছদ্ম-নলচালিত রথে ঋতুপর্ণের বিন্দৰ্ভে উপস্থিতি
“তখন বাহুক সুজাতিজাত, সুশিক্ষিত ও বেগগামী তুরঙ্গমচতুষ্টয় রথে যোজনা করিলে, রাজা সত্বর রথোপরি আরোহণ করিলেন। অশ্বরত্নসকল জানুসঙ্কোচ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইল। নরবর রাজা নল [ছদ্ম—নল—প্রচ্ছন্ন নাল-বাহুক] তৎক্ষণাৎ তাহাদিগকে সান্ত্বনা ও বার্ষ্ণেয় সারথিকে রথে আরোপিত করিয়া স্বয়ং বলগাগ্রহণপূর্ব্বক বায়ুবেগে অশ্বচালনা করিতে লাগিলেন। অশ্বগণ প্ৰণালীক্ৰমে চালিত হইয়া গগনমার্গে উত্থিত হইলে অযোধ্যাধিপতি ঋতুপর্ণ তাহাদিগের বেগতিশয্যসমোবলোকনে সাতিশয় বিস্ময়াবিষ্ট হইলেন। বার্ষ্ণেয় সারথি রথের অনির্ব্বচনীয় শব্দ ও বাহুকের তাদৃশ হয়সংগ্ৰহবৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া মনে মনে তাহার অশ্ববিদ্যার বিষয় চিন্তা করিতে লাগিল, “বোধ হয়, ইনি ত্ৰিদশাধিপতি ইন্দ্রের সারথি মাতলি, কারণ, এই মহাবীরের বাহুতে তদীয় সমস্ত লক্ষণ লক্ষিত হইতেছে অথবা অশ্বকুলতত্ত্বজ্ঞ শালিহোত্র পরামশোভন মানুষকলেবর পরিগ্রহ করিয়া পৃথিবীতে অবতীর্ণ হইয়া থাকিবে কিংবা ইনি পরপুরঞ্জয় নলরাজ; কারণ, তিনি যেরূপ অশ্ববিদ্যাবিশারদ, বাহুকও তদ্রূপ সুশিক্ষিত। বাহুক বয়ঃক্রম ও অশ্ববিজ্ঞানবিষয়ে নলরাজের তুল্য লক্ষিত হইতেছে; কিন্তু ইনি নলরাজ নহেন; তৎসদৃশ অন্য কোন মহাত্মা হইবেন; কারণ, কত শত লোক দৈববিধানানুসারে অথবা শাস্ত্রোজ্ঞ নিয়মাবলম্বী হইয়া প্রচ্ছন্নবেশে পৃথিবীতে সঞ্চরণ করিয়া থাকেন। বাহুক নল অপেক্ষা নিতান্ত বিরূপ ও শারীরিক পরিমাণবিষয়েও একান্ত পরিহীন। যদিও বয়ঃক্রমতুল্য, তথাপি রূপাদিতে সম্যক ব্যতিক্রম দৃষ্ট হইতেছে। নলরাজের যে-সকল অসাধারণ গুণ আছে, বাহুকেরও সেই সকল গুণ থাকিতে পারে।” সারথি বার্ষ্ণেয় মনে মনে এইরূপ বিচার ও চিন্তা করিয়া হর্ষসাগরে মগ্ন হইল; রাজা ঋতুপর্ণ বাহুকের অসাধারণ হয়জ্ঞতা, তাদৃশ হয়সংগ্ৰহ, একাগ্রচিত্ততা, উৎসাহ ও দৃঢ়তর যত্ন নিরীক্ষণ করিয়া সাতিশয় সন্তুষ্ট হইলেন।”