৭১তম অধ্যায়
উত্তম প্রজাপালন রীতি
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! নরপতি কিরূপে প্রজাপালন করিলে মনস্তাপশূন্য ও ধর্ম্মের নিকট অপরাধবিহীন হইতে পারেন?”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! সমুদয় শাশ্বত ধর্ম্ম সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিয়া কোন কালেই শেষ করা যায় না; অতএব উহা সংক্ষেপে কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। তুমি বেদবেদাঙ্গবেত্তা ধৰ্ম্মনিষ্ঠ ব্রাহ্মণগণকে দেখিবামাত্র গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তাঁহাদিগের চরণবন্দন ও অর্চ্চনা করিয়া পুরোহিতসমভিব্যাহারে অন্যান্য কাৰ্য্যসমুদয় সম্পাদনে প্রবৃত্ত হইবে। মঙ্গলানুষ্ঠান ও ধৰ্ম্মকাৰ্য্য সমাধান করিয়া ব্রাহ্মণমুখে আপনার অর্থসিদ্ধি ও জয় আশীর্ব্বাদ শ্রবণ করিবে এবং সরল প্রকৃতি হইয়া ধৈৰ্য্য ও বুদ্ধিবলে সত্যের আশ্রয়গ্রহণপূর্ব্বক কামক্রোধ-পরিত্যাগে যত্নবান হইবে। যে নরপতি কামক্রোধের বশীভূত হইয়া অর্থোপার্জ্জনের চেষ্টা করে, সে মূর্খ কদাপি ধর্ম্ম বা অর্থলাভে সমর্থ হয় না। তুমি লুব্ধ ও মুর্খদিগকে কদাপি কোন কার্য্যে নিযুক্ত করিও না। লোভবিহীন বুদ্ধিমান্ ব্যক্তিদিগের প্রতি সমুদয় কাৰ্য্যের ভারাপণ করা কর্ত্তব্য। কাৰ্য্যনৈপুণ্যবিহীন কামক্রোধপরায়ণ মূর্খ রাজ্যসম্পকীয় কাৰ্য্যে নিযুক্ত হইলে প্রজাগণকে যারপরনাই ক্লেশ ভোগ করিতে হয়। রাজা শাস্ত্রানুসারে অপরাধীদিগের দণ্ডবিধান এবং প্রজাদিগের শস্যাদির ষষ্ঠাংশ, শুল্ক ও সুরক্ষিত বণিকদিগের প্রদত্ত ধনগ্রহণপুৰ্ব্বক অর্থসংগ্রহ করিবেন। রাজনীতি অনুসারে প্রজাগণের মঙ্গলবিধান, অলাব্ধবস্তু লাভ ও লব্ধবস্তু রক্ষা করা রাজার অবশ্য কর্ত্তব্য। নরপতি কামদ্বেষবিবর্জ্জিত, প্রজারক্ষণে যত্নবান, ধর্ম্মপরায়ণ ও বদান্য হইলে মানবগণ তাঁহার প্রতি নিতান্ত অনুরক্ত হয়। তুমি কদাচ লোভের বশীভূত হইয়া অধৰ্ম্মানুসারে ধনাগমের চেষ্টা করিও না। যে রাজা শাস্ত্রবিরুদ্ধ কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করেন, তাঁহার ধর্ম্মার্থলাভের সম্ভাবনা নাই। শাস্ত্রজ্ঞানবিহীন ভূপতি কদাচ ধর্ম্মার্থলাভে সমর্থ হয়েন না। তাঁহার সমুদয় সঞ্চিত অর্থ বৃথা বিনষ্ট হইয়া যায়। যে রাজা ধনলোভ শাস্ত্রবিরুদ্ধ অপরিমিত কর গ্রহণপূর্ব্বক প্রজাপীড়নে প্রবৃত্ত হয়েন, তিনি স্বয়ং আপনার হিংসা করেন। দুগ্ধলাভাগী ব্যক্তি ধেনুর আপীন[পালান] ছেদন করিলে যেমন দুগ্ধলাভে সমর্থ হয় না, তদ্রূপ রাজা প্রজাগণকে নিপীড়িত করিলে কখনই সম্পত্তিশালী হইতে পারেন না। সদয়ভাবে দুগ্ধবতী গাভীকে দোহন করিলে যেমন প্রচুর দুগ্ধ লাভ করা যায়, তদ্রূপ শাস্ত্রানুযায়ী উপায় অবলম্বনপূর্ব্বক রাজ্যভোগ করিলে প্রচুর অর্থলাভ হইয়া থাকে। রাজ্য সদুপায়দ্বারা সুরক্ষিত হইলে কোষবৃদ্ধি হইবার বিলক্ষণ সম্ভাবনা। জননী যেমন পরিতৃপ্ত হইয়া সন্তানগণকে স্তন্য প্রদান করেন, তদ্রূপ পৃথিবী রাজাকর্ত্তৃক সুরক্ষিত হইয়া রাজা ও প্রজাগণকে প্রচুর পরিমাণে ধান্য ও হিরণ্য প্রদান করিয়া থাকেন। অতএব তুমি অঙ্গারকে দৃষ্টান্ত পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মালাকারের দৃষ্টান্তের অনুসরণ কর; তাহা হইলেই দীর্ঘকাল প্রজাপালন ও রাজ্যভোগ করিতে পারিবে। যদি পররাজ্য আক্রমণ করিলে তোমার বিপুল ধনক্ষয় হয়, তাহা হইলে তুমি সান্ত্বনাসহকারে ব্রাহ্মণ ভিন্ন অন্য জাতিদিগের নিকট হইতে ধন গ্রহণ করিবে। তুমি যদি নিতান্ত ধনহীন হও, তথাপি ব্রাহ্মণগণকে ধনবান্ দেখিয়া বিচলিতচিত্ত হইও না। উহাদিগকে যথাশক্তি ধনদান, সান্ত্বনা ও তাঁহাদের রক্ষণাবেক্ষণে তৎপর হইলেই তুমি স্বর্গলাভ করিতে পারিবে।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! যদি তুমি উক্তরূপ ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিতে পার, তাহা হইলে নিশ্চয়ই তোমার প্রভূত যশঃ ও অতুল কীৰ্ত্তিলাভ হইবে এবং মনঃপীড়াশূন্য হইয়া সুখস্বচ্ছন্দে কালাতিপাত করিবে। প্রজারক্ষণে যত্নবান্ হওয়াই রাজার প্রধান ধৰ্ম্ম। প্রাণীগণের প্রতি দয়া প্রকাশ ও তাহাদিগের রক্ষণাবেক্ষণ করা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট ধর্ম্ম কিছুই নাই। এই নিমিত্ত ধৰ্ম্মজ্ঞ পণ্ডিতেরা দয়াবান্ প্রজাপালননিরত নরপতিকে পরমধার্ম্মিক বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। রাজা ভয়প্রযুক্ত একদিন প্রজারক্ষা না করিয়া যে পাপসঞ্চয় করেন, তাহাকে পরলোকে সহস্র বৎসর সেই পাপের ফলভোগ করিতে হয়। আর তিনি একদিন ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিয়া যে পুণ্যসঞ্চয় করেন, পরলোকে দশসহস্র বৎসর তাহার ফলভোগ করিয়া থাকেন। গৃহস্থ, ব্রহ্মচারী ও বানপ্রস্থাশ্রমবাসী ব্যক্তিরা সুচারুরূপে স্ব স্ব ধর্ম্ম প্রতিপালন করিয়া যেসমস্ত লোক জয় করেন, রাজা ক্ষণকাল ধৰ্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিয়া অনায়াসে সেই সমুদয় লোকলাভে সমর্থ হয়েন; অতএব তুমি উক্তরূপ ধর্ম্ম প্রতিপালন কর, তাহা হইলে পুণ্যফললাভ, মনঃপীড়া নিবারণ ও স্বর্গে বিপুল ঐশ্বৰ্য্য অধিকার করিতে পারিবে। ভূপতি ভিন্ন অন্য কেহই পূর্বোক্তরূপ ধর্ম্মলাভে সমর্থ হয় না এবং তুমি ধৈর্য্যশালী হইয়া ধৰ্ম্মানুসারে রাজ্যপালনপূর্ব্বক সোমরসদ্বারা ইন্দ্রের ও অভিলষিত বস্তুদ্বারা সুহৃদ্গণের তৃপ্তিসাধন কর।”