এক দিন তথা যত কুরুপুত্রগণ।
নগর বাহিরে ক্রীড়া করে সর্ব্বজন।।
এক গোটা লৌহ ভাঁটা ভূমিতে ফেলিয়া।
হাতে দণ্ড করি তাহা যায় গড়াইয়া।।
হেন লৌহ-ভাঁটা তবে দৈব নির্ব্বন্ধনে।
নিরুদক কূপ মধ্যে পড়িল তাড়নে।।
কূপেতে পড়িল দেখি সকল কুমার।
তাহা তুলিবারে যত্ন করিল অপার।।
কিছু কিছুতেই কৃতকার্য্য না হইল।
হতাশ হইয়া সবে ভাবিতে লাগিল।।
লজ্জিত হইল সবে মলিন বদন।
হেনকালে আইলেন দ্রোণ তপোধন।।
শুক্লবেশ শুক্লবস্ত্র স্বন্ধেতে উত্তরী।
শ্যামল দেহের বর্ণ, গতি মত্তকরী।।
শিশুগণে দেখি দ্রোণ বিরস বদন।
জিজ্ঞাসেন মনোদুঃখ কিসের কারণ।।
এতেক শুনিয়া বলে যতেক কুমার।
ধিক্ ক্ষত্রকূলে জন্ম আমা সবাকার।।
ধিক্ প্রাণ, ধিক্ ধনু, ধিক অধ্যয়ন।
ভাঁটা উদ্ধারিতে শক্ত নহি কোন জন।।
হের দেখ জলহীন কূপের ভিতরে।
পড়িয়াছে লৌহ-ভাঁটা পাই দেখিবারে।।
এত শুনি দ্রোণাচার্য্য বলেন হাসিয়া।
কূপ হৈতে ভাঁটা দেখ দেই উদ্ধারিয়া।।
এই ইষিকার তেজে করিব উদ্ধার।
ভোজ্য দিয়া তুষ্ট তবে করিবা আমার।
একবাক্য হৈয়া সবে কর অঙ্গীকার।
অবশ্য উদ্ধারি দিব লৌহ-ভাঁটা যার।।
এত শুনি যুধিষ্ঠির ধর্ম্মের নন্দন।
দ্রোণাচার্য্য প্রতি বলে বুঝিয়া কারণ।।
কূপ হৈতে ভাঁটা পার করিতে উদ্ধার।
কি ভোজ্য ভোজনে তবে, সকলি তোমার।।
কৃপাচার্য্য সহিত ভুঞ্জহ নানা সুখ।
এত শুনি দ্রোণাচার্য্য পরম কৌতুক।।
দ্রোণ বলিলেন, সবে থাক স্থির-রূপে।
এইত অঙ্গুরী আমি ফেলি এই কূপে।।
অঙ্গুরী তুলিব আর উদ্ধারিব ভাঁটা।
এত বলি লইলেন ইষিকা একটা।।
মন্ত্র পড়ি দ্রোণচার্য্য ইষিকা মারিল।
মন্ত্রতেজে লৌহ-ভাঁটা সকল ভেদিল।।
পুনঃ পুনঃ তথিপর মারেন অপার।
ইষিকা ইষিকা যুড়ি হৈল দীর্ঘাকার।।
ইষিকার মূল তবে দ্রোণ ধরি করে।
আকাশে তুলেন ভাঁটা উঠিল উপরে।।
আশ্চর্য্য হইয়া সবে মানিল বিস্ময়।
তবে ধনুর্ব্বাণ লয়ে দ্রোণ মহাশয়।।
মন্ত্র পড়ি অঙ্গুরী উপরে বাণাঘাতে।
শর সহ অঙ্গুরী উঠিল আসি হাতে।।
দেখিয়া দুষ্কর কর্ম্ম সকল কুমার।
জিজ্ঞাসিল দ্বিজবরে করি পরিহার।।
কোথা হৈতে এলে দ্বিজ, কোথায় নিবাস।
কি কারণে আগমন, করহ প্রকাশ।।
অদ্ভুত তোমার কর্ম্ম লোকে অনুপাম।
কহ শুনি দ্বিজবর কিবা তব নাম।।
আজ্ঞা কর দ্বিজবর, যেই লয় মন।
যে আজ্ঞা করিবা, তাহা করিব পালন।।
এতেক বচন যদি শিশুগণ কৈল।
শুনিয়া সন্তুষ্ট দ্বিজশ্রেষ্ট যে হইল।।
দ্রোণ বলে, শুন সবে আমার উত্তর।
মম সমাচার কহ ভীষ্মের গোচর।।
রূপ গুণ আমার কহিবা তাঁর স্থান।
আপনি জানিয়া ভীষ্ম করিবে বিধান।।
এত শুনি শীঘ্রগতি যতেক কুমার।
পিতামহ-আগে কহে সব সমাচার।।
বৃদ্ধ এক দ্বিজবর শ্যামবর্ণ ধরে।
তাঁহার যতেক গুণ অদ্ভুত সংসারে।।
নাম ধাম করিলাম জিজ্ঞাসা তাঁহারে।
কহিলেন তোমার গোচর করিবারে।।
এত শুনি গঙ্গাপুত্র ভাবিয়া হৃদয়।
জানিলেন এতাদৃশ অন্য কেহ নয়।
দ্রোণাচার্য্য বিনা অন্য কেহ নাহি জানে।
আইলেন দ্রোণ, জানিলাম এ বিধানে।।
কুরুবংশ-যোগ্য গুরু মিলে এতদিনে।
দ্রো-অনুসারে ভীষ্ম চলিল আপনে।।
দ্রোণে দেখি প্রণমিল গঙ্গার নন্দন।
আশীর্ব্বাদ করি দ্রোণ, দেন আলিঙ্গণ।।
ভীষ্ম বলিলেন, কহ আপন-কল্যাণ।
বড় ভাগ্যে কুরুবংশে দ্রোণ-অধিষ্ঠান।।
এতেক শুনিয়া ভরদ্বাজের নন্দন।
কহিতে লাগিল সব আত্ম-বিবরণ।।
তপোবনে থাকি বহু করি তপঃক্লেশ।
ফলমূলাহারী ধরি জটা-বল্ক-বেশ।।
এইরূপে বহুদিন থাকি তপোবন।
হেনকালে পিতৃবাক্য হইল স্মরণ।।
বংশ-হেতু কতদিনে পিতৃ-আজ্ঞা পেয়ে।
গৌতমী কৃপের ভগ্নী করিলাম বিয়ে।।
জন্মিল তাহার গর্ভে একটি নন্দন।
অশ্বত্থামা নাম তার দিল দেবগণ।।
কতদিনে ক্রীড়া-কাল পাইল কুমার।
শিশুগণ-সঙ্গে সদা করয়ে বিহার।।
আচম্বিতে একদিন আইল ধাইয়া।
আমার অগ্রেতে কহে কান্দিয়া কান্দিয়া।।
গবীদুগ্ধ পান করে সকল বালক।
সেই মত দুগ্ধ দেহ আমারে জনক।।
অনেক রোদন করি মাগিল নন্দন।
দুগ্ধ হেতু করিলাম বহু পর্য্যটন।।
গবীর কারণে ভ্রমিলাম বহু স্থান।
সত্যশীল কেহ না করিল গবীদান।।
নাহি চাহিলাম কোন অধমের স্থান।
গবী না পাইয়া গৃহে করিনু প্রস্থান।।
গৃহে আসি দেখিলাম বালকের দল।
আনিয়াছে পাত্রভরি পিটালির জল।।
পিটালির জলে সবে দুগ্ধ বলি দিল।
আনন্দিত হৈয়া শিশু তাহা পান কৈল।।
সকল বালকগণ নৃত্য করে রঙ্গে।
অশ্বত্থামা নাচিতে লাগিল শিশু সঙ্গে।।
ইহা দেখি শিশুগণ বলাবলি করে।
যার পুত্র পিষ্টোদক পিয়ে হর্ষভরে।।
দুগ্ধপান কৈনু বলি নাচিছে সঘনে।
ধিক্ ধিক্ শত ধিক্ ধনহীন দ্রোণে।।
শিশুগণ উপহাস তাহারে করিল।
পুনরপি আসি পুত্র আমারে কহিল।।
পুত্রের বচন শুনি চিত্তে হৈল তাপ।
জননী শুনিয়া বহু করিল বিলাপ।।
বহুমতে বিলাপিয়া ভাবি মনে মনে।
আপন কর্ম্মের ফল না হয় খণ্ডনে।।
ধিক্ তপ ধিক্ জন্ম ধিক্ পরিবার।
ধিক্ ধ্যান জ্ঞান মোর, ধিক্ কলেবর।।
ধিক্ ধিক্ শতধিক আমার জীবনে।
পৃথিবীতে গৃহবাসী ধিক্-ধনহীনে।।
এতেক ভাবিয়া পূর্ব্ব হইল স্মরণ।
বালক কালেতে সখা পৃষত-নন্দন।।
অত্যন্ত সৌহৃদ ছিল তাহার সহিত।
পাঞ্চালে গেলাম ভাবি পূর্ব্বের পিরীত।।
সখা বলি সম্ভাষ করিনু দ্রুপদেরে।
দেখিয়া অনেক নিন্দা করিল আমারে।।
কোথায় দরিদ্র তুমি, আমি নৃপমণি।
তব সনে সখ্য কবে, আমি নাহি জানি।।
পুনঃ পুনঃ কত বলে নিষ্ঠুর বচন।
সেবকে বলিল, দেহ একটি ভোজন।।
এতেক নিষ্ঠুর বাক্য শুনিয়া তাহার।
ক্ষণেক বিলম্ব তথা না করিনু আর।।
ভেদিলেম মর্ম্ম মম তাহার বচনে।
এ প্রতিজ্ঞা করিলাম তথির কারণে।।
আইলাম প্রতিজ্ঞা করিয়া নিজ চিতে।
প্রতিকার করিবে তাহার ভবিষ্যতে।।
সেই হেতু আইলাম হস্তিনা-নগর।
কি করিব প্রীতে তব, কহ নৃপবর।।
ভীষ্ম বলিলেন, ভাগ্য বড়ই আমার।
অতএব হেথায় করিলা আগুসার।।
এই কুরু-জাঙ্গল কৌরব-অধিকার।
রাজ্য অর্থ পরিবার সব আপনার।।
পৌত্রগণে সমর্পি তোমার বিদ্যমান।
কৃপায় সবারে কর অস্ত্র শিক্ষা দান।।
এত বলি ভীষ্ম তবে পূজি বহুতর।
রহিবারে দিলেন রত্নমণ্ডিত ঘর।।
মহাভারতের কথা অমৃত-সমান।
কাশীরাম দাস কহে, শুনে পুণ্যবান।।