৭০তম অধ্যায়
উভয়পক্ষে বহুসৈন্য হতাহত
সঞ্জয় কহিলেন, “মহারাজ! শান্তনুনন্দন ভীষ্ম ভীমসেন হইতে দুৰ্য্যোধনপ্রভৃতি আপনার পুত্ৰগণকে রক্ষা করিবার নিমিত্ত তুমুল যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। দিবসের পূর্ব্বাহ্ণে কৌরব ও পাণ্ডবগণের অতি ভয়ঙ্কর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। রণস্থল হইতে গগনতলস্পর্শী তুমুল কোলাহল সমুত্থিত হইতে লাগিল। মাতঙ্গগণের বৃংহিতধ্বনি, অশ্বের হ্রেষারব এবং ভেরী ও শঙ্খের শব্দে রণস্থল তুমুল হইয়া উঠিল। মহাবলপরাক্রান্ত সমরাভিলাষী বীরপুরুষেরা বিজযলাভার্থী হইয়া গোষ্ঠে বৃষভের ন্যায় পরস্পরের প্রতি তর্জ্জন-গর্জ্জন করিতে লাগিলেন। নিশিতশরপ্ৰহারে বীরগণের মস্তকসকল অনবরত ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল; বোধ হইল যেন, নভোমণ্ডল হইতে প্রস্তরবৃষ্টি হইতেছে। পরে কনকোজ্জল-কুণ্ডলালঙ্কৃত উষ্ণীষধারী মস্তকসকল রণক্ষেত্রে নিপতিত রহিয়াছে নিরীক্ষিত হইতে লাগিল এবং কাহার উত্তমাঙ্গ ছিন্ন, কাহার কবচমণ্ডিত দেহ, কাহার কুণ্ডলবিভূষিত মস্তক, কাহার অলঙ্কৃত বাহুদণ্ড এবং কাহারও বা রক্তপ্ৰান্তলোচনসনাথ [নয়নপ্রীত রক্তবর্ণসমন্বিত] শশিসঙ্কাশ মুখমণ্ডলদ্বারা ক্ষণকালমধ্যে বসুন্ধরা পরিপূর্ণ হইল। বহুসংখ্যক গজবাজীর ছিন্নভিন্ন কলেবরে চতুর্দ্দিক সমাচ্ছন্ন হইয়া গেল। তখন উভয়পক্ষীয় বীরগণের যুদ্ধ সুরাসুর যুদ্ধের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল; ধূলিজাল ঘনমণ্ডলীর ন্যায় সমুত্থিত হইল, শস্ত্ৰসকল বিদ্যুতের ন্যায় স্ফূরিত হইতে লাগিল, আয়ুধধ্বনি মেঘনির্ঘোষের ন্যায় অনুভূত হইল এবং রুধিরপ্রবাহ বারিধারার ন্যায় পরিদৃশ্যমান হইতে লাগিল।
“যুদ্ধদুর্ম্মদ ক্ষত্রিয়গণ সেই ভয়ঙ্কর লোমহর্ষণ তুমুল সংগ্রামকালে অনবরত শরজাল বর্ষণ করিতে লাগিলেন। উভয়পক্ষীয় কুঞ্জরগণ বাণবৃষ্টিদ্বারা নিতান্ত সন্তপ্ত হইয়া চীৎকার করিয়া উৰ্দ্ধশ্বাসে ধাবমান হইল। অতি তেজস্বী রোষাবিষ্ট ধীরপ্রকৃতিসম্পন্ন বীরগণের তলধ্বনিপ্রভাবে কিছুই শ্রুতিগোচর হইল না; চতুর্দ্দিক শোণিতসমাচ্ছন্ন ও কবন্ধসকল সমুত্থিত হইলে অন্যান্য ভূপালগণ শক্রবধে উদ্যত হইয়া ধাবমান হইলেন। অর্গলতুল্য ভুজযুগলসম্পন্ন বীরগণ শর, শক্তি, গদা ও খড়্গপ্ৰহারে পরস্পরকে সংহার করিতে লাগিলেন। কুঞ্জর সকল শরবিদ্ধ ও নিরঙ্কুশ হইয়া ভ্ৰমণ করিতে প্রবৃত্ত হইল। উভয়পক্ষীয় অশ্বগণ আরোহী বিনষ্ট হইলে দশদিকে ধাবমান হইতে লাগিল এবং কোন কোন অশ্ব এক-একবার উত্থিত ও পরীক্ষণেই শরাহত হইয়া ভূতলে নিপতিত হইল। হে মহারাজ! ভীষ্মের সহিত ভীমের সংগ্রাম উপস্থিত হইলে চতুর্দ্দিকে মস্তক, বাহু, কার্ম্মুক, গদা, পরিঘ, ঊরু, চরণ ও কেয়ুর প্রভৃতি ভূষণের রাশি পরিদৃশ্যমান হইতে লাগিল। কোন কোন স্থলে ধাবমান অশ্ব ও বিনিবৃত্ত [পলায়মান] মাতঙ্গসমূহ দৃষ্টিগোচর হইল। ক্ষত্ৰিয়গণ কালপ্রেরিত হইয়া গদা, অসি, প্রাস ও সন্নতপর্ব্ব শরনিকর দ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিতে লাগিল। কোন কোন সমরনিপুণ বীর লৌহময় অর্গলসদৃশ বাহুযুগলদ্বারা যুদ্ধ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। হে মহারাজ! আপনার পক্ষীয় বীরগণ পাণ্ডবদিগের সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইয়া মুষ্টি, জানু, তল ও কফোণি[কনুই]দ্ধারা পরস্পর প্রহার করিতে লাগিলেন। পাণ্ডবগণ কখনো পতিত, কখনো পীড়িত, কখনো ভূপৃষ্ঠে বিচেষ্টমান [হস্তপদসঞ্চালন—ছট্ফট্ করা] হইতে লাগিলেন। এইরূপে ঘোরতর যুদ্ধ হইতে আরম্ভ হইলে রথিসকল রথচ্যুত হইয়া খড়্গধারণপূর্ব্বক পরস্পরকে বধ করিবার নিমিত্ত ধাবমান হইল। অনন্তর মহারাজ দুৰ্য্যোধন বহুসংখ্যক কলিঙ্গদেশীয় বীরপুরুষে পরিবেষ্টিত হইয়া ভীষ্মকে পুরস্কৃত করিয়া পাণ্ডবদিগের প্রতি গমন করিলেন। পাণ্ডবেরাও বেগগামী যানে আরূঢ় হইয়া মাহবীর বৃকোদরকে বেষ্টন করিয়া ক্রোধাবিষ্টচিত্তে ভীষ্মের প্রতি বিমনা হইলেন।”