০৬-১০. হরিপুরের নদীর ধারে

হরিপুরের নদীর ধারে সকালে বাজার বসেছে। হরিপুরের বাজারের বেশ নামডাক। তার ওপর আজ হাটবার হওয়ায় লোকে একেবারে লোকারণ্য।

গজানন হালুইকরের দোকানে বিখ্যাত সাড়ে সাত প্যাঁচের জিলিপি ভাজা হয়েছে। গন্ধে চারদিক মম, মানুষ ভেঙে পড়েছে দোকানের সামনে। আড়াই প্যাঁচের ফিনফিনে জিলিপি এ নয়। গজানন হাতের কায়দায় সাড়ে সাত প্যাঁচ এমন সুন্দর মিলিয়ে করে যে ছোট-বড় হওয়ার উপায় নেই।

জিলিপির লাইনে একটু পেছনের দিকে জগা আর পাগলু দাঁড়িয়ে। পাছে লোকে চিনতে পারে সেই ভয়ে দুজনেরই মুখ বাঁদুরে টুপিতে প্রায় ঢাকা। তার ওপর গামছা জড়িয়ে মুখ এমন আবডাল করেছে, যে চেনা লোকও চিনতে পারবে না।

জগা চারদিকে ভাঁটার মতো চোখে তাকাচ্ছিল, হঠাৎ চাপা গলায় বলল “ওই যে!”

পাগলু জগার মতো নয়, তার চোখ ভাঁটার মতো ঘোরে না, বরং সবসময়ে একটা ঘুসঘুস ভাব। বলল, “কোথায়?”

পেছনে বাঁ দিকে, পানের দোকানের আয়নায় গোঁফ চোমরাচ্ছে। গায়ে সবুজ জামা আর কালো পাতলুন।

পাগলু গম্ভীর গলায় বলল, “হুঁম।”

“দেখেছ?”

“দেখে নিয়েছি।”

“এখন কী করবে?”

“চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাক। আমরা যে দেখেছি তা বুঝতে দিসনি।”

“ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে আগেভাগেই বলে রাখছি, আমার কিন্তু গজাননের সাড়ে সাত প্যাঁচের জিলিপি খাওয়ার একটুও ইচ্ছে নেই। সকালে এককাঁড়ি পান্তাভাত খেয়ে তার ওপর এক হাঁড়ি দই আর আঠারোটা সন্দেশ খেয়ে তবে এসেছি।”

পাগলু বলল, “পান্তাভাত খেয়েছিস সে বুঝলাম, কিন্তু দই আর সন্দেশটা সকালে কোথায় পেলি? লটারি মেরেছিস নাকি?”

জগা মাথা চুলকে বলে, “আর বলল কেন, কাল সুধীর ঘোযের মেয়ের বিয়ে ছিল, জোগানি সেজে ঢুকে পড়েছিলুম, যদি কিছু সরানো যায়। তা গয়নাগাটি পয়সাকড়ি কিছু তেমন জুটল না। শেষ অবধি দু’ হাঁড়ি দই আর দু’ বাক্স সন্দেশ নিয়ে পালিয়ে এসেছি।”

“ছোঃ, তোর নজর নিচু হয়ে যাচ্ছে জগা।”

“কী করব বলো, আমার কপালটাই ওরকম, এই তো সেদিন সনাতন সাহার বাড়িতে সিঁদ কেটে ঢুকে কী অবস্থা, সনাতনের এমন কাশি উঠল যে, বাড়ির লোক উঠে পড়ল, ডাক্তারবদ্যির খোঁজ হতে লাগল, আমি খাটের তলায় ঘাপটি মেরে বসে বসে মশার কামড় খেলাম। শেষে হাতের কাছে খানিকটা পুরনো তেঁতুল পেয়ে তাই নিয়েই পালিয়ে এলাম।”

ঘন ঘন মাথা নেড়ে পাগলু চলল “না না, তোর নজর নিচু হয়ে গেছে রে জগা। তোকে দিয়ে আর বড় কাজ হবে না।”

জগা মুখোনা বড্ড কাঁচুমাচু করে বলল, “ওরকম করে বোলো না গো পাগলুদাদা, বুকের ভেতরটা কেমন যেন করে ওঠে, ভাগ্যের চাকা একদিন ঘুরবে এই আশা নিয়েই তো বেঁচে আছি, তাই তো চিরকুটটা পেয়েই তোমাকে খবর দিয়ে এনেছি এখানে, এবার যদি দাও মারা যায় একখানা।”

“কিন্তু চিরকুটটায় কী লেখা ছিল তাই তো স্পষ্ট বলতে পারছিস না।”

“লেখাপড়া জানা থাকলে কি আর বলতে পারতাম না। অক্ষরজ্ঞানই যে নেই। তাই পাশের বাড়ির বিশেকে ডেকে পড়াতে হল।”

“এই সেরেছে। বিশে তো জেনে গেল হলে; কথাটা যে পাঁচকান হয়ে যাবে।”

“আরে না, বিশে মোটে কেলাস ফোর-এ পড়ে, সে অত তালেবর নয়।”

“চিরকুটটায় ঠিক কী লেখা ছিল বল তো!”

“ওই তো বললুম, কাল হাটবার, গজাননের জিলিপির দোকানের সামনে থেকো। সবুজ জামা পরা একটা লোক আসবে। সে যেমন বলবে তেমনিই যদি করো তা হলে আখেরে লাভ হবে।”

“নিচে নাম সই ছিল?”

“না, এই দ্যাখো না কেন, আমার পেছনের পকেটেই তো রয়েছে চিরকুটটা।”

“পাগলু উদাস মুখে বলল, ও দেখে কী করব? আমিই কি পড়তে জানি?”

“তোমার কী মনে হয় বলো তো পাগলুদাদা? এতদিনে কি ভগবান মুখ তুলে চাইবেন?”

“ভগবানের তো খেয়েদেয়ে কাজ নেই, এত লোক থাকতে তোর-আমার মতো অখদ্দে লোকের দিকে মুখ তুলে চাইবে, চিরকুটটা তো পেয়েছিস তোর ঘরের মেঝেয়। তা সেটা বাতাসে উড়ে জানালা দিয়ে এসেও তো পড়তে পারে। কে কাকে কী উদ্দেশ্যে লিখেছে কে জানে।”

“না গো পাগলুদাদা, তা নয়, যত্ন করে ভাঁজ করা কাগজ, জানালার নীচেই পড়ে ছিল, কেউ জানালা দিয়ে টুক করে ভেতরে ফেলে গেছে। দেখছ।

পানের দোকানের সামনে সবুজ জামা গায়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আড়ে আড়ে এদিকে দেখছে!”

“তুই তো একটা সবুজ জামা দেখেই কাত হয়ে পড়লি, আমি যে বিস্তর সবুজ জামা দেখছি। ওই তো হরুর সেলুনে খেউরি হচ্ছে এক সবুজ জামা, ওই দ্যাখ গোপালের দোকানে আর এক সবুজ জামা চটি সারাচ্ছে।”

“বটে!”

“বটে কী রে! ওই দ্যাখ এক সবুজ জামা এক বাচ্চা ছেলেকে বেলুন কিনে দিচ্ছে। আর এক সবুজ জামা তেলেভাজার দোকানে ওই দ্যাখ কেমন সাপটে বেগুনি গিলছে।”

“তাই তো পাগলুদাদা, এ যে দেখছি হাটভর্তি সবুজ জামা! আজ কি সবাই আমাদের সঙ্গে শত্রুতা করতেই সবুজ জামা পরে এল নাকি?”

“তোরও বলিহারি যাই, কোথাও কিছু না, একটি চিরকুট কুড়িয়ে পেয়েই গুপ্তধন পাওয়ার মতো নেচে উঠলি। যাকগে গজাননের জিলিপির দুটো বারকোশ শেষ হয়ে এখন তিন নম্বরটা শুরু হবে। এবার আমাদের পালা।”

“তুমি খাও পাগলুদাদা, আমি একটু খোলা হাওয়ায় দাঁড়াই গিয়ে।”

“দাঁড়া।”

জগা ভিড় ছেড়ে একটু তফাত হয়ে দাঁড়িয়ে চারদিক সলুমালু করে চাইতে লাগল। বাস্তবিক জীবনে সে এত সবুজ জামা পরা লোক সকসঙ্গে দেখেনি। আজ যেন চারদিকে সবুজের মিছিল।

পিরানের পকেটে ডান হাতে চিরকুটটা নাড়াচাড়া করতে করতে বেকুবের মতো জগা ভাবছিল, কেউ রসিকতা করল নাকি? কিন্তু সে এতই অপদার্থ লোক, এতই সামান্য যে, তার সঙ্গে রসিকতা করার লোকই বা কে হবে?

একখানা ভারী হাত আচমকা গদার মতো তার বাঁ কাঁধে এসে পড়তেই জগার ভিরমি খাওয়ার জোগাড়, ককিয়ে উঠে বলল, “আমি না …..আমি কিছু করিনি…..”

সেই গোঁফ কামানো লোকটা হাসি-হাসি মুখ করে বলল, “তুমি ছিচকে জগা না?”

জগা মিটমিট করে চেয়ে লোকটাকে দেখল। মস্ত লম্বা আর চওড়া বিভীষণ চেহারা, গায়ে সবুজ জামা ঠিক আছে। মাথায় বাবরি চুল, ডান হাতে লোহার বালা, ভগবান কি মুখ তুলে চাইলেন।

জগা ক্ষীণ গলায় বলল, “আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“তোমার মতো একজন হিঁচকেকেই আমি খুঁজছিলুম।”

জগার বুকের মধ্যেটা তোলপাড় করে উঠল, হ্যাঁ এই তো সেই সবুজ জামা পরা লোক!

জগা খুব অমায়িক গলায় হাতটাত কচলে বলল, “আজ্ঞে কাজটা কী, বন্দোবস্তটা কীরকম হবে তা যদি একটু খোলসা করে বলেন, তা হলে বড্ড ভাল হয়।”

“খোলসা করে বলছি। গত চোত মাসে তুমি নয়ন লাহিড়ীর রান্নাঘরে হানা দিয়ে দুটো ডেকচি আর একটা কড়াই চুরি করেছিলে না?”

“যে আজ্ঞে, কিন্তু ওসব ছোটখাটো কাজ আর করব না বলেই ঠিক করেছি।”

“গত আশ্বিনে তুমি তারকনাথ দাসের গোয়ালঘর থেকে তাদের এঁড়ে বাছুর চুরি করে নবীগঞ্জের হাটে বেচে দিয়ে এসেছিলে।”

“আজ্ঞে তা হতে পারে।”

“তোমার ছিচকে চুরির যে লিস্টি আমার কাছে আছে তা বেশ লম্বা।”

জগা একটু লাজুক মুখ করে বলল, “ছোট ছোট কাজে হাত পাকিয়েছি বলে ধরে নেবেন না যেন যে, বড় কাজ পেরে উঠব না। বড় কাজ দিয়ে দেখুন কেমন নিখুঁতভাবে নামিয়ে দিই।”

“শোনো বাপু, তোমাকে যে কাজটা দিচ্ছি, তা নিতান্ত ছিচকে চোরের কাজ। ঠিকমতো যদি কাজটা উদ্ধার করে দিতে পারো তা হলে পঞ্চাশটা টাকা পাবে।”

“পঞ্চাশ! মোটে পঞ্চাশ! কী বলছেন আজ্ঞে?”

“ভুল শোনোনি, পঞ্চাশ টাকা কি খোলামকুচি নাকি?”

মাথা নেড়ে জগা বলে, “আজ্ঞে না, আমি আর ছুঁচো মেরে হাতগন্ধ করতে পারব না।”

“খুব পারবে। তোমার চুরির যে লিস্টিটা আমার সঙ্গে আছে তা যদি থানায় গিয়ে বড়বাবুর সামনে ফেলে দিই তাহলে তোমার ক’ বছরের মেয়াদ হয় জানো?”

“ভয় দেখাচ্ছেন কেন বলুন তো! ছিচকে চোরেরা কি চিরকাল ছিচকে চোর থেকে যাবে? তাদের জীবনে কি উন্নতি করার সুযোগ আসবে না মশাই? চিরটা কাল যদি তাদের দাবিয়ে রাখেন তাহলে কি দেশের ভাল হবে?”

“আচ্ছা ঠিক আছে। পঞ্চাশের জায়গায় পুরো একশোই পাবে। হল তো!”

“আরে, একশো টাকাটা আজকাল কোনও টাকার মধ্যেই পড়ে না, আর একটু উঠুন। শয়ের জায়গায় হাজার করুন, কাজ করে দেব।”

লোকটা হঠাৎ অট্টহাস্যে গোটা হাট কাঁপিয়ে দিয়ে বলল, “হাজার! অ্যাঁ! হাজার চাইছে হিঁচকে চোর জগা?”

এরকম চেঁচিয়ে কথাগুলো বলায় জগা টক করে মুখ ঢেকে ফেলল। হাটে যদি চোর বলে লোকে চিনতে পারে তাহলে কিলিয়ে কাঁঠাল পাকিয়ে দেবে।

সে চাপা গলায় বলল, “দোহাই, চেঁচাবেন না, কাজটা কী?”

লোকটা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, “এখানে নয়, একটু তফাতে চলো।”

.

০৭.

জগার কাঁধটা একরকম বাঘের থাবায় চেপে ধরে লোকটা তাকে খালধারে বাঁশঝোঁপের দিকে নিয়ে যাচ্ছিল।

লোকটার ভাবগতিক জগার ভাল ঠেকছে না, সে চিঁ চিঁ করে বলল, ও মশাই এমন কি গোপন কথা যে অত আবডালে যেতে হবে। একটু খাটো গলায় বললেই তো হয়। হাটুরে গণ্ডগোলে গোপন কথা বলার ভারি সুবিধে।

লোকটা তাকে একখানা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, নির্জনে আরও সুবিধে।

জগা ভয় খেয়ে বলল, যে আজ্ঞে।

খালের ওপর একখানা পুরনো নড়বড়ে বাঁশের সাঁকো। তার ওপারে বাবলাবনের ভেতর দিয়ে একখানা জঙ্গুলে পথ আছে বটে, কিন্তু লোকবসতি নেই। লোকটা জগাকে বাঁশের সাঁকোর মুখটায় এনে ফেলল, ঘাড়টা এমন চেপে ধরে আছে যে জগা অন্যরকম কিছু করতে পারছে না।

সে বলল, এবার বলে ফেলুন।

লোকটা খ্যাক খ্যাক করে হেসে উঠে বলল, বড্ড তাড়া দেখছি যে হে জগা ওস্তাদ। আমার হাত থেকে ছাড়া পেতে চাও নাকি? তাহলে যা বলব মুখ বুজে করবে, নইলে বিপদ।

জগা চিঁচিঁ করে বলল, করবটা কী মশাই, সেইটে আগে বলুন।

শোনো জগা, কাজটা তোমার প্রথমটায় শক্ত মনে হতে পারে। তবে এ ধরনের কাজ প্রথমটায় শক্ত লাগলেও ধীরে ধীরে দেখবে সড়গড় হয়ে যাবে।

যে আজ্ঞে। মোটে একশ টাকায় শক্ত কাজ করা যে ভারি শক্ত হয়ে যাচ্ছে। মশাই, তাও কাজটা কতটা শক্ত তা এখনও বলেননি।

কাজটা শক্ত বলেছি বুঝি? তা হবে, তবে তোমার কাছে হয়তো তেমন শক্ত নাও মনে হতে পারে।

কাজটা কী?

লোকটা একটু গলাটা নামিয়ে বলল, একজন বুড়ো মানুষকে বৈতরণীটা একটু পার করে দিতে হবে।

বৈতরণীটা পার করতে হবে? কথাটা ঠিক মাথায় যেন সেঁধোচ্ছে না মশাই।

বৈতরণী জানো না?

সে জানি, ওই তো মরার পর যে খালটা পেরোতে হয়।

বাঃ, এই তো বুঝেছো।

না, ঠিক বুঝতে পারছি না আজ্ঞে।

বুড়ো মানুষটার বয়স নব্বইয়ের ওপর, কঞ্জুস লোক, টাকার পাহাড়ের ওপর বসে আছেন। এই মানুষটি ভবলীলা সাঙ্গ না করলে কিছু অসুবিধে দেখা দিচ্ছে।

জগা হঠাৎ লোকটার প্রস্তাবের অর্থ বুঝতে পেরে চোখ কপালে তুলে বলল, আপনি কি খুন-খারাপির কথা কইছেন নাকি?

লোকটা চোখ একটু ছোটো করে চেয়ে বলল, তুমিই একটু আগে বলছিলে ছিচকে চোর হয়ে থাকতে তোমার ঘেন্না করে। তুমি জীবনে উন্নতি করতে চাও, বলোনি?

জগা কাঁপতে কাঁপতে বলে, আজ্ঞে তা বলেছি, তবে খুন-খারাপি আমি পেরে উঠবো না। ও আমার পোষাবে না মশাই।

তাহলে যে তোমার কপালে দুঃখ আছে জগাইচাঁদ।

জগা লোকটার দিকে চেয়ে বলল, আমাকে ছেড়ে দিন। মেলা লোক পাবেন, আমাদের নিবারণ শীলই তো টাকা নিয়ে খুন করে বেড়ায়। তাকে ধরুন।

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, উঁহু, আমার তোমাকেই দরকার।

জগা বলল, কিছু চিন্তা করবেন না মশাই, নিবারণ আমার পিসতুতো ভাইয়ের শালার পাশের গাঁয়ে থাকে। খুব চেনা লোক, দশ বিশ টাকা কমিয়েও দিতে পারব।

লোকটা মাথা নেড়ে বলল, নিবারণ নয়, কাজটা যে তোমাকেই করতে হবে জগাইচাঁদ।

আজ্ঞে, ও এলেম আমার নেই।

আছে কি না সেটারই পরীক্ষা হবে, শোনো জগা, কার ভেতরে কোন গুণ আছে তা আমার মতো কম লোকই বুঝতে পারে। আমি হলাম মানুষের জহুরী। তোমাকে দেখেই বুঝেছি, এই ছিচকে চোরের জীবন তোমার নয়। তোমার অন্যরকম জীবন হওয়া উচিত।

জগা মলিন মুখ করে বলল, ওসব কি আমার সাধ্যি বাবু? ও আমি পেরে উঠব না।

একশো টাকার কথা শুনে হতাশ হয়ো না। একশো টাকাটা কথার কথা। কাজটা উদ্ধার যদি করে দাও, কোনওরকম গঙগোল যদি না হয়, তাহলে পাঁচটি হাজার টাকা পাবে।

পাঁ- পাঁচ …

হ্যাঁ, পাঁচ হাজারই।

জগা তবু কাঁপতে কাঁপতে বলল, আজ্ঞে শুনে কাজ করার লোভও হচ্ছে, কিন্তু মনটা সায় দিচ্ছে না যে! বুকটা কাঁপছে।

লোকটা হাসল, বলল, আচ্ছা আচ্ছা, দশ হাজারই পাবে। এবার কাঁপুনিটা কমেছে?

জগা একটু নড়েচড়ে বলল, যে আজ্ঞে, বুকটা আর কাঁপছে না তো।

যদি আরও পাঁচ হাজার দিই?

জগা বুক চিতিয়ে বলল, আজ্ঞে কখন করতে হবে কাজটা?

.

জিলিপি মাথায় উঠেছিল পাগলুর। সে বড়বড় চোখ করে দেখছিল দশাসই লোকটার পাল্লায় পড়ে জগার কেমন বেড়ালের থাবায় ইঁদুরের মতো অবস্থা। বেগতিক দেখে পাগলু আর এগোয়নি। একটু ঘাপটি মেরে থেকে লক্ষ্য করল, লোকটা জগাকে খালধারে বাঁশঝোঁপের আড়ালে ঘাড়ে ধরে নিয়ে গেল। মারবে না কাটবে কে জানে বাবা, চেঁচামেচি করলে লোক জড়ো হবে বটে, কিন্তু সেটা তাদের পক্ষে ভাল হবে কি না কে বলতে পারে। গাঁয়ে মোটেই তাদের সুনাম নেই। লোক জড়ো হলে উলটে তারাই না হাটুরে কিল খেয়ে যায়।

পাগলুকে সুতরাং অপেক্ষা করতেই হল। ভরসার কথা, দশাসই লোকটার গায়ে সবুজ জামা, এই লোকই যদি চিঠি দিয়ে থাকে? তবে হয়তো মারধর করবে না।

খুব বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না পাগলুকে। কিছুক্ষণ পরেই দেখল জগা হাসিহাসি মুখে বেশ তরতরিয়ে এদিক পানে আসছে। সঙ্গে দশাসই লোকটা নেই।

রমেশের ছিটকাপড়ের দোকানের পাশে পাগলু ধরল জগাকে, কী রে, কখন থেকে তোকে খুঁজছি!”

“ওঃ পাগলুদাদা, মার দিয়া কেল্লা।”

“মেরেছিস!”

“তবে আর বলছি কী? এই দেখ কড়কড়ে দুশো টাকা, চলো, জিলিপি খাই। আমার এখন খিদেটা চাগাড় দিয়েছে।”

পাগলু চোখ ছোটো করে গম্ভীর মুখে বলল, “দ্যাখ জগা, আমি একটু আগেই তোকে বলেছিলাম কি না যে, তোর নজর বড্ড ছোট হয়ে যাচ্ছে।”

জগা খ্যাঁক করে উঠে বলল, “কেন কেন, নজরটা ছোটো বুঝলে কিসে?”

“মাত্র দুশো টাকা পেয়েই বলছিস মার দিয়া কেল্লা? একে ছোটো নজর বলে না তো কাকে বলে? দু-পাঁচ হাজার টাকার বরাত পেতিস তা হলে না হয় বুঝতাম, মাত্র দুশো টাকা পেয়ে কেউ এত লাফায়?”

উত্তেজিত জগা বেশ চড়া গলায় বলল, “দুশো টাকা কী বলছ গো? বিশ লাখ টাকার বরাত পেয়ে এলাম আর দুশো বলছ? জগা কি ছোটোলোক নাকি গো পাগলুদাদা?”

পাগলু এমন আঁতকে উঠল যে, বাক্য সরতে চাইল না, বিশ লাখ কথাটা যেন জীবনে প্রথম শুনছে। মাথাটাও এক পাক ঘুরে গেল। কিছুক্ষণ দম ধরে থেকে বলল, “কত বললি?”

জগা অট্টহাসি হেসে বলল, “বিশ লাখ, বুঝলে? বিশ লাখ!”

চারদিক থেকে লোকজন তাদের দিকে তাকাচ্ছে, পাগলু হঠাৎ জগার মুখটা হাতের চেটোয় চাপা দিয়ে ধরে বলল, “বুদ্বু কোথাকার! এসব কথা চেঁচিয়ে বলতে আছে?”

জগা কাঁচুমাচু হয়ে চারদিকে চেয়ে গলা খাটো করে বলে “টাকাটা বড়ই বেশি তো, তাই গলাটা আপনা থেকেই ওপরে উঠে গেছে।”

“আমারও মাথাটা কেমন পাক মারছে। খালি পেটে এসব উত্তেজক কথাবার্তা ভাল নয়। চ, আগে পেটপুরে জিলিপি খেয়ে নিই। তারপর পেট আর মাথা দুই-ই ঠাণ্ডা হলে একটু ফাঁকে বসে নিরালায় কথা হবে।”

“তাই চলো।”

“তা দু’জনেই বেশ উত্তেজিত বলে খিদেটাও জম্পেশ রকমেরই হয়েছিল। ইয়া বড়বড় সাইজের জিলিপি এক-একজনে ত্রিশটা করে খেয়ে টিপকলে গলা অবধি জল গিলে মুখ মুছে হাটের বাইরে একখানা জামগাছের তলায় জুত করে বসল। তারপর পাগলু বলল, “এবার ধীরেসুস্থে বেশ গুছিয়ে বল।”

“এই সে-ই লোক, বুঝলে?”

“কোন লোক? যে চিঠি দিয়েছিল?”

“তা আমি জিজ্ঞেস করিনি, তবে সে ছাড়া আর কে হবে?”

“তা না হয় হল, কিন্তু বিশ লাখ টাকা দিচ্ছে, ব্যাপারটা তো সোজা নয়, কাজটাও গুরুতরই হবে। কাজের কথা কিছু বলল?”

“সে কথায় আসছি। তার আগে একটা কথা।”

“কী কথা বলো তো!”

“তুমি কি জানো যে পৃথিবীতে মানুষের সংখ্যা খুব বেড়ে যাচ্ছে?”

“তা আর জানি না! এই হরিপুরের হাটেই কি দশ বছর আগে এত লোক হত? আজকাল গিজগিজ করছে মানুষ। পৃথিবীতে লোক বাড়ছে এটা সবাই জানে।”

“সে কথা ঠিক। কিন্তু বাড়াটা উচিত হচ্ছে কি?”

“সবাই তো বলে মোটেই উচিত হচ্ছে না। যত লোক বাড়বে ততই অভাব-অনটন বাড়বে, গণ্ডগোল বাড়বে, খেয়োখেয়ি বাড়বে।”

“তা হলেই বোঝো, দুনিয়াটা একদম উচ্ছন্নে যাবে যদি লোকের সংখ্যা আরও বাড়ে।”

“অত ঘুরিয়ে বলছিস কেন? আসল কথাটা বলে ফেল।”

“সেই কথাতেই আসছি। তাড়াহুড়ো করতে নেই। গুছিয়ে না বলতে পারলে ব্যাপারটা তোমার মাথায় ঢুকবে না।”

“তা হলে গুছিয়েই বল, কিন্তু ঘুরিয়ে বলিস না বাপ।”

“তা হলে শোনো, এই যে লোক বাড়ছে এটা যদি ভাল না হয় তা হলে এর উলটোটাই ভাল, কী বলো?”

“তার মানে?”

“ধরো, যদি লোক আর বাড়তে না দিয়ে যদি ধীরে ধীরে কমিয়ে ফেলা যায় তাহলে কেমন হয়?”

পাগলু চোখ সরু করে জগার দিকে তাকিয়ে বলল, “কমাবি? কেমন করে কমাবি?”

জগা উদাস গলায় বলে, “কাজটা যদি ভালই হয়, কমানোই যদি সাব্যস্ত হয় তবে তার জন্য যা করা দরকার তা করতে হবে।”

মাথা নেড়ে পাগলু বলল, “কথাটা বুঝলুম না। আরও খোলসা করে বল।”

“ইয়ে মানে, বলছিলাম কি, ধরো যদি দুনিয়া থেকে কিছু লোকজন লোপাট করে দেওয়া যায় তাহলে কাজটা কি খারাপ হবে?

“লোপার্ট করবি কীভাবে?”

“তোমার সঙ্গে কথা বলাটা বড় ঝকমারি হয়ে যাচ্ছে। এত কম বোঝো, কেন বলো তো? বুদ্ধির গোড়ায় একটু জল দাও।”

পাগলু খুবই গম্ভীর হয়ে বলল, “বুঝতে যে একেবারে পারছি না তা নয়। কিন্তু যা বুঝেছি তা-ই তুই বলতে চাইছিস কি না সেটাও তো বোঝা দরকার।”

“কী বুঝছ সেইটা আগে বলো।”

“তুই খুন-খারাপির কথা বলতে চাইছিস নাকি?”

“আহা, খুন-খারাপি হিসেবে না ধরলেই তো হয়। ধরো, পৃথিবীর ভালই করতে চাইছি। একটা লোক কমে যাওয়া মানে হল একটা পেট কমল, একখানা ঘর, একখানা বিছানা খালি হল, খাসের জন্য একটু অক্সিজেন বাঁচল। সব হিসেব করে দেখলে দেখবে, ব্যাপারটা যত খারাপ শোনাচ্ছে। ততটা খারাপ নয়।”

“পাগলু থমথমে মুখ করে বলে, “লোকটা তোকে কী প্রস্তাব দিয়েছে সেটা আমাদের বাংলা ভাষায় বলতো বাপ। বাবু ভাইদের মতো সোজা কথাকে প্যাঁচে ফেলিস না।”

জগা একটু চুপ করে থেকে বলল, “কাজটা খুবই সোজা। মহামায়াতলায় একজন বুড়ো মানুষ আছেন, বয়স তা ধরো পঁচানব্বই-ছিয়ানব্বই হবে। খুব কঙুষ লোক, তা এই লোকটিকে বৈতরণী পার করিয়ে দিতে হবে। তা হলেই হাতে একেবারে কড়কড়ে বিশ হাজার”

“হাজার? এই না বিশ লাখ বললি?”

“বলেছি! পাগলুদাদা, আমাদের কাছে হাজারে আর লাখে তফাত কী বলো তো! কত টাকায় হাজার হয় তা-ই তো আজ অবধি জানলাম না। বললে ভুলই বলেছি। লাখ নয়, হাজার।”

একটা শ্বাস ফেলে পাগলু বলল, “তার মানে লোকটা তোকে খুনের কাজে লাগাতে চাইছে।”

“আহা, খুনটুন বললে ভাল শোনায় না পাগলুদাদা।”

“কেমন শোনায় জানি না। কিন্তু কাজটা খুনই, শোন, তোর সঙ্গে অনেক দিনের সম্পর্ক। তোকে ছোট ভাইয়ের মতো দেখি। কিন্তু তোর মাথায় যদি

এসব পাপের চিন্তা ঢোকে তা হলে আর তোর ছায়াও মাড়াব না।”

জগা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “তা হলে কি চিরটা কাল ছিচকে চোরই থেকে যাবো পাগলুদাদা? জীবনে উন্নতি করতে পারব না?”

“চোর থেকে খুনি হওয়া কি উন্নতি রে পাগল? তোর ধর্মে কী বলে?”

“ফস করে ধর্মের কথা তোলো কেন বলো তো!”

“ধর্ম বলে একটা ব্যাপার আছে, তাই বলি, চুরিও অধর্ম কিন্তু জীবহত্যা ওরে বাপ রে!”

“হাসালে পাগলুদাদা। জীবহত্যা যদি পাপ হবে তবে পাঁঠা কাটলে, মাছ মারলে, মশা মারলে যা পাপ মানুষ মারলেও তার বেশি পাপ হওয়ার কথা নয়।”

পাগলু কাহিল মুখে একটু হেসে বলল, “তোর বুদ্ধি খুব খুলেছে রে জগা। বেশ বলেছিস। কিন্তু আমি ওর মধ্যে নেই। তোকে বলি, তুইও থাকিস। মশা মারলে ফাঁসি হয় না। কিন্তু মানুষ মারলে হয়, এটা তো মানিস!”

“ফাঁসি হয়, ধরা পড়লে, ধরা না পড়লে কিছু হয় না।”

“ধরা পড়বি না কে বলতে পারে?”

“ভেবে দেখতে হবে।”

“লোকটাকে খুন করতে চায় কেন এই লোকটা?”

“তা অত খোলসা করে বলেনি। আন্দাজ করছি, বুড়ো মানুষটা এর মামা বা কাকা গোছের কেউ হয়। সে মারা গেলে এ-লোকটা সম্পত্তি পাবে।”

“বটে! তা দেশে কি খুনির অভাব? টাকা ফেললেই কত লোক গিয়ে খুন করে আসবে। লোকটা তোকে এ-কাজের জন্য বাছল কেন?”

“আমার মধ্যে নাকি মস্ত বড় হওয়ার মতো গুণ আছে। সেই দেখেই।”

“তোর মাথা।”

“তা হলে কী?”

“বলব? বললে বিশ্বাস করবি?”

“বলেই দ্যাখো না।”

“খুন যদি তুই করিসও লোকটা তোকে ফাঁসিয়ে দেবে। একটি পয়সাও আর পাবি না। উলটে ধরা পড়ে ফাঁসিতে যাবি। লোকটা তোকে বলির পাঁটা করেছে।”

শুনে একটু ছাইবর্ণ হয়ে গেল জগা, বলল, “তাই নাকি পাগলুদাদা?”

“তাই তো মনে হচ্ছে।”

“কিন্তু কাজটা যদি না করি তা হলে যে লোকটা পুলিশের কাছে যাবে। তার কাছে আমার সব অপকর্মের একটা ফর্দ আছে।”

“তা থাক। তুই বরং পালা।”

“পালাব! কোথায় পালাব?”

দু’জনের যখন এরকমতরো কথা হচ্ছে, কারোই কোনও দিকে খেয়াল নেই, তখন হঠাৎ পেছনের বাবলা ঝোঁপের আড়াল থেকে বেঁটেখাটো একটা লোক বেরিয়ে এসে বলল, “ওঃ, তোমাকে খুঁজে খুঁজে যে হয়রান হলাম হে জগা!”

লোকটার গায়ে সবুজ জামা। দুজনে হাঁ করে চেয়ে রইল।

.

০৯.

গোপেশ্বরকে দেখে অবাক হওয়ার কিছু ছিল না। হরিপুরে আজ হাটবার, আর হাটবারে কে না হাটে আসে! তবে জগা আর পাগলু একটু ঘাবড়ে গেছে, যদি গোপেশ্বর তাদের কথাবার্তা শুনে থাকে! খুন-খারাপি নিয়ে কথাবার্তা তো ভাল নয়।

গোপেশ্বরের মুখ দেখে তার মনের ভাব বুঝবার উপায় নেই। ভারি অমায়িক মুখে মিষ্টি একটু হাসি। মোলায়েম গলায় বলল, “তা ভায়াদের যে মুখ বড় শুকনো দেখছি! এ তো ভাল কথা নয়। মায়াবদ্ধ জীব তো মনের ঘানিতে ঘুরবেই। বেঁচে থাকা মানেই পাকে-পাকে জড়িয়ে পড়া। তা কথাটা হচ্ছিল কী নিয়ে?”

জগার মুখে বাক্য সরল না। পাগলু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “এই দ্রব্যগুণ নিয়েই কথা হচ্ছিল আজ্ঞে।”

“দ্রব্যগুণ! বলো কী হে? দ্রব্যগুণ নিয়ে তো মাথায় ঘামায় রামহরি কবিরাজ।”

পাগলু জিভ কেটে মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে মুখ্যুসুখ্যু মানুষ, কী বলতে কী বলে ফেলি! দ্রব্যগুণ বলতে জিনিসপত্রের দামের কথাই হচ্ছিল আজ্ঞে। কুমড়োর দাম কী চড়াটাই চড়েছে বলুন তো! মুলো বলুন, শাকপাতা বলুন, কোনটা গরিবের নাগালে আছে বলতে পারেন?”

“তা বটে। তা হলে দ্রব্যগুণ নিয়েই কথা হচ্ছিল তোমাদের?”

“যে আজ্ঞে।”

“আমার বয়স হয়েছে। কানেও ভাল শুনি না। তবে যেন ঝোঁপের আড়াল থেকে মনে হল, কারা যেন খুন-খারাপি নিয়ে কথা কইছে।”

পাগলু একগাল হেসে বলল, “খুনই তো, খুন ছাড়া একে আর কী বলা যায়? এই জগা বলছিল, “পাগলুদাদা, জিনিসপত্রের যা গলাকাটা দাম দেখছি এতে গরিবেরা সব খুন হয়ে যাবে।”

“বটে। তা ঠিক কথাই তো!”

“আজ্ঞে, নিয্যস কথা। তা আপনি কিছু কইবেন?”

“গোপেশ্বর মিষ্টি হাসিটি বজায় রেখেই বলল, “সেইজন্যেই তো হাটময় খুঁজে বেড়াচ্ছি তোমাদের হে। এসো, এই গাছতলায় জুত করে বসি। কথা আছে।”

“জগা খুবই ভয় পেয়েছে। বসতে গিয়ে সে দেখল তার হাতে-পায়ে খিল ধরে কেমন শক্ত হয়ে গেছে। হাঁটু ভাঁজ হতে চাইছে না। সে বলল, “আপনারা কথা বলুন, আমি একটা কচু দর করে এসেছি, দেখি গিয়ে সেটা আবার কেউ নিয়ে গেল নাকি।”

গোপেশ্বর মিষ্টি গলায় বলল, “কচুর জন্য ভাবনা কী হে? আমার বাড়ির পেছনেই মেলা হয়েছে। দাম দিতে হবে না, অমনি দিয়ে দেবখন তোমাকে একটা, আর কথাটাও তোমার সঙ্গেই কিনা।”

জগা বলল, “আজ আমার সঙ্গে অনেকেরই কথা আছে দেখছি।”

গোপেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, “যা বলেছ, মানুষ নিজের গুণেই বড় হয় কিনা! আর বড় হওয়ার ওইটেই রাজলক্ষণ। তখন সবাই তাকে খোঁজে, একটু আগেই তো দেখছিলাম যেন একজন লম্বা দশাসই চেহারার লোক খালধারে দাঁড়িয়ে তোমার কাঁধে হাত রেখে কথা কইছিল!”

জগার হাত-পায়ের খিল খুলে গেল লহমায়। সে অবশ হয়ে ধপ করে বসে পড়ল মাটিতে। মুখে বলল, “কই না তো!”

“আমার চোখের দোষও হতে পারে। বয়স তো বড় কম হল না হে। চোখ-কানের আর দোষ কী? মনে হল যেন মথুরাপুরের দিকেই দেখলুম।

হলেই মঙ্গল, কারণ দিনু তো খুব একটা ভাল লোক নয়।”

জগা কাহিল গলায় বলে, “দিনু কে মশাই?” গোপেশ্বর মাথা মৃদু-মৃদু ডাইনে-বাঁয়ে নেড়ে বলে, “না না, ভুলই হয়েছে বলে ধরে নাও, দিনুর তো এখানে হাজির হওয়ার কথা নয়। তার নামে চৌদ্দটা খুনের মামলা ঝুলেছে। কয়েদ আছে আজ প্রায় সাত মাস। ফাঁসি তার হবেই। সে এখানে আসবে কী করে?”

জগা হাঁ হয়ে গেল। “দিনু? দিনু মানে যদি দিনু হালদার হয়ে থাকে, তা হলে যে সর্বনাশ! মথুরাপুরের দিনুর নামে পুলিশ দারোগারও কম্প ওঠে।”

পাগলু একটু ক্ষীণ গলায় বলল, “আর যদি ভুল না দেখে থাকেন? যদি লোকটা দিনুই হয়ে থাকে?”

গোপেশ্বর একটু গম্ভীর হয়ে বলে, “তা হলে বড় ভয়ের কথা হে ভায়া বড়ই ভয়ের কথা। দিনু যদি কাউকে ধরে তবে তার রক্ষে নেই। কিন্তু সে তো এখন হাজতে চোখের ভুলই হবে।”

জগা কাঁচুমাচু হয়ে বলে, “আমার কিন্তু দোষ নেই মশাই। আমি হাটে কচুর দর করছিলুম। এমন সময়ে ঘটোৎকচের মতো লোকটা এসে আমাকে ধরল। আমি দিনু হালদারকে কস্মিনকালেও চিনি না।”

গোপেশ্বর জিভ দিয়ে একটা চুকচুক শব্দ করে বলল, “আহা, দোষটা তোমাকে দিচ্ছে কে? হাটে হাজারো লোক আসে, কে ভাল কে মন্দ তা চেনা কি চাট্টিখানি কথা? তবে লোকটা তোমাকে বলছিল কী?”

মাথা নেড়ে জগা বলল, “সে আমার ঠিক স্মরণ হচ্ছে না।”

“তা হলে তো বড়ই দুঃখের কথা ভায়া। স্মরণ না হলে যে অনেক সময়ে ব্যাপার কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কুশল প্রশ্নই করছিল নাকি ষঙটা?”

আজ্ঞে তাও হতে পারে। খিদের চোটে তখন আমার মাথাটা ভাল কাজ করছিল না কিনা। কী সব যেন বলছিল।”

গলাটা যেন আরও মেজে ঘষে, আরও মোলায়েম করে গোপেশ্বর বলল, “কথাটা কী জানো? একটা কানাঘুষো যেন শুনছিলাম দু’দিন আগে। কুসুমপুরে এক যজমান বাড়িতেই যেন শুনছিলুম, পাঁচজন বলাবলি করছে, দিনু হালদার গরাদ ভেঙে পালিয়েছে। তখন কথাটা বিশ্বাস হয়নি।”

পাগলু বলল, “আরও একটু খোলসা করে বলুন বাবাজি।”

গোপেশ্বর নিমীলিতনয়নে কিছুক্ষণ দুয়ের দিকে চেয়ে থেকে বলল, “পাপে পৃথিবীটা একেবারে ভরাভর্তি হয়ে গেল হে।”

“আজ্ঞে যা বলেছেন, পাপ ছাড়া আর আছেটাই বা কী? তা দিন হালদারের বৃত্তান্তটা কী বাবাজি?”

“যে মুখে হরিকথা কই, সেই মুখে এসব কথা কইতে বড় ঘেন্না হয় হে।”

“আজ্ঞে তা তো বটেই।”

“দিনুর তিনকুলে থাকার মধ্যে আছে এক মামা। দাসপুকুরে বাড়ি। একসময়ে অবস্থা ভালই ছিল। এখনও নেই-নেই করে ধরো তো প্রায় লাখ বিশেক টাকার সোনাদানা আছে। ওয়ারিশ আছে মেলাই। হরিপদ দাসের নিজের ছেলেপুলে নেই, স্ত্রীও গত হয়েছে কয়েক বছর। মরলে সম্পত্তি পাওয়ার কথা তার ভাইপোদের। কিন্তু মুশকিল হল, হরিপদর অত সোনাদানা কোথায় আছে তার হদিস কেউ জানে না।”

জগার চোখ দুটো একটু জুলজুল করে উঠল। সে তাড়াতাড়ি বলে উঠল, “লুকিয়ে রেখেছে নাকি?”

“চারদিকে চোর ডাকাতের যা উপদ্রব, না লুকিয়ে উপায়ই বা কী বলো!”

জগা বলল, “তা বটে।”

গোপেশ্বর বলল, “হরিপদ দাসের বিরাট বাড়ি, খুবই পুরনো। সেই বাড়ির একতলায় হরিপদ দাস একখানা মস্ত ঘরে থাকে। লোকের বিশ্বাস, ওই ঘরেই সোনাদানা সব আছে। কিন্তু হরিপদ কস্মিনকালেও সেই ঘরে কাউকে ঢুকতে দেয় না। নিজেও ঘরের বাইরে বড় একটা আসে না। তার সাত-আটটা শিকারি কুকুর আর গোটা দশেক হলো বেড়াল আছে। আর আছে বাহাদুর নামে একজন পুরনো বিশ্বাসী কাজের লোক। তারাই বাড়ি পাহারা দেয়। কাকপক্ষীও ঢুকতে পারে না।”

জগা ফস করে বলল, “হরিপদবাবুর বয়সটা কিরকম হল বলতে পারেন?”

“তা পারি। চুরানব্বই পুরে এই পঁচানব্বই না। তবে বুড়ো বলে জরাজীর্ণ ভেবো না। হরিপদ দাস এখনও বেশ সক্ষম মানুষ। দাঁত পড়েনি, চুলও পাকেনি। শোনা যায়, এখনও নাকি সকালে মুগুর ভাঁজেন। হেসেখেলে একশো পেরোবেন। আর সেইজন্যই দিনু কিন্তু বড় উতলা হয়ে পড়েছে।”

পাগলু বলল, “কারণটা কী?”

“মামা মরলেও তার কোনও আশা নেই। কারণ আইনত সে সম্পত্তি পায় না। সে ফিকির করছে মামাকে যদি দুনিয়া থেকে সরাতে পারে তা হলে সোনাদানা গাপ করা সহজ হয়। বলে রাখি ভায়ারা, দিন বড় পাপী লোক।”

পাগলু বলে ওঠে, “যে আজ্ঞে, সে আর বলতে

“আর একথাটাও জেনে রাখো, হরিপদ দাসও বিশেষ ভাল লোক নয়। সুদখোর মানুষ, চিরকাল গরিবকে ঠকিয়ে টাকা করেছে। কত বিধবার শেষ সম্বল যে ঠকিয়ে নিয়েছে তার লেখাজোখা নেই। দিনুর উপযুক্ত মামাই বটে। একেবারে শঠে শঠ্যাং। আমি বলি কী, দিনু যদি তার মামাকে মারতেই চায় তো মারুক। কিন্তু তোমরা ওর মধ্যে থেকো না।”

জগা বলে উঠল, “আজ্ঞে না। কখনওই না।”

“শোনো বাপু, দিনুর বৃত্তান্ত বলতে আমার আসা নয়। আমার আরও কিছু কথা আছে।”

পাগলু বলে, “কী কথা বাবাজি?”

“কথা শূলপাণিকে নিয়ে।”

.

১০.

গোপেশ্বরের মুখে শূলপাণির নাম শুনে জগা আর পাগলু একটু মুখ তাকাতাকি করে নিল। তারপর পাগলু খুব অমায়িক গলায় বলল, আজ্ঞে কথাটা কী?

গোপেশ্বর তোধিক অমায়িক মোলায়েম গলায় বলল, আহা, পাগল মানুষটাকে যে কে গুম করে ফেলল! তোমরা জানো নাকি কিছু ভায়ারা?

দুজনেই সমস্বরে বলে ওঠে, কিছু না। কিছু না।

গোপেশ্বর মৃদু হেসে বলল, জ্ঞানের চেয়ে অজ্ঞানতাই কখনও সখনও ভাল বলে মনে হয়। যত না জানা যায় ততই বিপদের ভয় কম, কে আর ঝাটে জড়াতে চায় বলো!

দুজনেই বলল, ঠিক কথা।

তবু জিজ্ঞেস করছি কেন বলো? তোমরা দুটি তো সব বাড়িতেই রাত বিরেতে হানা দাও। অনেক সময়ে আড়ি পেতে ভেতরকার গুহ্য কথাও শুনে ফেল। অনেকের হাঁড়ির খবর তোমাদের একেবারে নখদর্পণে। তাই না?

জগা লজ্জিত হয়ে ঘাড়টাড় চুলকে বলে, না না, কী যে বলেন। সামান্য মানুয আমরা।

গোপেশ্বর মাথা নেড়ে বলে, আহা, অত বিনয় করতে হবে না। তোমরা যে কাজের লোক তা আমি ভালই জানি।

যে আজ্ঞে।

শোনো ভায়ারা, শূলপাণি হঠাৎ যেন গায়েব হয়ে গেল সেই কথাটা আমার জানা দরকার।

পাগলু মাথা নেড়ে বলে, আজ্ঞে আমরা কাজটা করিনি। ছোটোখাটো চুরি-ছাচড়ামি করে থাকি বটে, কিন্তু গুম বা খুনটুন আমাদের লাইনের ব্যাপার নয়।

কাজটা যে তোমরা করেছে এমন কথা আমি স্বপ্নেও ভাবিনি। বলছি কি, শূলপাণির ঘরে কখনও হানাটানা দিয়েছো?

জগা বলল, আজ্ঞে না। ওখানে গিয়ে হবেটা কী? শূলপাণি পাগল মানুষ, কুকুর-বেড়াল নিয়ে থাকত, তার বাড়িতে হানা দিয়ে হবে কোন লবডঙ্কা?

তা বটে। কিন্তু শূলপাণি যে নিয্যস পাগল একথাটা আমার প্রত্যয় হয় না। আমার বরাবরই মনে হয়েছে শূলপাণি একজন সাজা পাগল।

পাগলু অবাক হয়ে বলে, বটে! তাহলে তো আপনি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি খবর রাখেন।

খবর তুমিও বড় কম রাখো না।

পাগলু একটু তেড়িয়া হয়ে বলে, তার মানে?

মানে আমার চেয়েও তোমাদের আরও বেশি খবর রাখার কথা। তোমাদের দুজনেরই শূলপাণির বাড়িতে রীতিমতো যাতায়াত ছিল। আমার স্বচক্ষে দেখা। অস্বীকার করে লাভ নেই।

জগা আর পাগলু ফের একটু মুখ তাকাতাকি করে নেয়। তারপর পাগলু গলাটা একটু নামিয়ে বলে, সে ঠিক কথা, আমরা ভাবতুম সে মস্ত ম্যাজিসিয়ান, কোন বিপদে কখন কোন কাজে লাগে কে জানে। তাই ম্যাজিক শিখতে কিছুদিন যেতুম বটে।

শূলপাণি তোমাদের কী ম্যাজিক শেখাতো?

জগা রেগে উঠে বলল, কিছু না মশাই, কিছু না। আমরা গেলেই সে অংবং করে কী সব বলত, মুখ ভ্যাঙাতো, অঙ্গভঙ্গি করত, দু-চারবার ঠ্যাঙা নিয়ে তাড়াও করেছে।

বটে, এ তো খুব অন্যায় কথা!

অন্যায় বলে অন্যায়! তাকে খুশি করার জন্য ধারকর্জ করে বনমালীর তেলেভাজা, আসগরের চপ, গোবিন্দপুরের দৈ কতবার ভেট নিয়ে গেছি। তা উনি সেসব বেশ জুৎ করেই খেতেন, কিন্তু শেখানোর বেলায় লবডঙ্কা।

কিন্তু বাপু, কথাটা হল সে যে ম্যাজিক জানে একথাটা তোমাদের বলল কে?

জগা মাথা চুলকে বলল, অনেকেই বলাবলি করত, ওরকম ধারা খ্যাপাটে মানুষেরা কিছু না কিছু গুপ্তবিদ্যে জানেই মশাই, হাটে-বাজারে লোকে বলাবলি করত শূলপাণি নাকি রাত-বিরেতে পাখির মতো আকাশে উড়ে বেড়ায়, তার বাড়িতে নাকি জিন-পরি-ভূতপ্রেত নিত্যি আসা-যাওয়া করে।

তুমি নিজে কি কিছু দেখেছো?

মাথা নেড়ে জগা বলে, না মশাই, আমাদের যে কিছু দেখাত না। আমরা গেলেই পাগল সাজত।

আচ্ছা, একটা কথা।

বলুন।

রাত আটটার সময় শূলপাণি যে অট্টহাসিটা হাসত সেটা কখনও শুনেছো?

শুনব না? রোজ শুনতুম। গাঁশুদ্ধু লোকও শুনত।

যে সময়ে সে হাসত সে সময়ে কখনও তার কাছে ছিলে?

যে আজ্ঞে।

কিরকমভাবে হাসত একটু বলবে?

আজ্ঞে সে বড় বিদঘুঁটে হাসি। শুনে পিলে চমকে যেত। প্রথম দিন ওই হাসি শুনে তো আমার মূৰ্ছা যাওয়ার জোগাড়।

কেন হাসত তা জানো?

আজ্ঞে না।

কখনও জিজ্ঞেস করেছিলে?

তা করেছিলুম। প্রথম দিন যখন সন্ধের মুখে তাঁর কাছে যাই তখন খানিকতক গরম গরম জিবেগজা নিয়ে গিয়েছিলুম। তা উনি জিবেগজা খেতে খেতে বিড়বিড় করে কী যেন বলছিলেন। চোখ দুটো আধবোজা, একটু একটু দুলছেন বসে বসে। আমি হাতজোড় করে সামনেই বসে আছি। হঠাৎ যেন। ভূমিকম্পের মতো কী একটা হয়ে গেল। বললে বিশ্বাস করবেন না। ঠিক যেন নাভি থেকে শব্দটা ওঁর গলায় উঠে এল। এমন দমকা লহর তোলা হাসি জীবনে শুনিনি বাবা। ভিরমি খেয়েছিলাম মনে আছে। তারপর চেতন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, বাবাজী, এটা কী হল?

তা উনি কী বললেন?

বলাটলার ধার ধারতেন নাকি? শুধু একবার কটমট করে তাকালেন।

কেন হাসত তা ঠাহর করেছো কখনও?

মাথা নেড়ে জগা বলল, আজ্ঞে না!

তোমরা কি জানো যে শূলপাণি একেবারে ঘড়ি ধরে ঠিক রাত আটটার সময়ে হাসিটা হাসত, কখনও এক চুল এদিক-সেদিক হত না?

পাগলু বলল, আজ্ঞে সেরকমই শুনেছি। কিন্তু আমাদের তো আর ঘড়ি নেই যে মিলিয়ে দেখব।

গলাটা আরও এক পর্দা নামিয়ে গোপেশ্বর বলল, আরও একটা কথা ভায়ারা। শূলপাণির বাড়ি থেকে নাকি লাল নীল সবুজ ধোঁয়া বেরোতো তোমরা দেখেছো নাকি?

দুজনেই মাথা নেড়ে বলল, আজ্ঞে না।

আচ্ছা, ধোঁয়া নয় না-ই দেখলে, আর কিছু দেখনি? চোখে লাগে এমন কিছু?

জগা ফস করে বলে ওঠে, অনেকক্ষণ ধরে বকাচ্ছেন মশাই। আমাদের তো সময়ের একটা দাম আছে।

গোপেশ্বর ভারি অমায়িক হেসে বলে, তা আছে ভায়ারা, তা অবশ্যই আছে। একটু আগেই যেন দেখলুম। আমাদের জগা ভায়া দিনুর কাছ থেকে কড়কড়ে দুশো টাকা পেল! তা সেটাও কি ওই সময়েরই দাম নাকি?

জগা একটু দমে গেল। বলল, ঠিক আছে, যা জিজ্ঞেস করার করুন, তবে সময় বেশি নেবেন না। বেলা চড়ছে, আমাদের বিষয়কৰ্ম পড়ে আছে কিনা।

জানি বাপু, তুমি বড় কাজের লোক। তা বলি কখনও শূলপাণির কাছে কাউকে যাতায়াত করতে দেখনি?

তা দেখব না কেন? শূলপাণি বাবাজীর কাছে সবাই যেত। এমন কি গোঁসাই, আপনিও যেতেন। কতদিন দেখেছি আপনি আর জটেশ্বরদাদা মুড়িসুড়ি দিয়ে গভীর রাতের দিকে বাবাজীর ডেরায় গিয়ে সেঁধোচ্ছেন।

আহা, আমরা গাঁয়ের লোক, তার ভালমন্দের খোঁজ নিতে যেতুম আর কি! আমাদের কথা হচ্ছে না। বাইরের কেউ আসত? অচেনা মানুষজন?

তাও আসত। তবে কার কথা জানতে চান সেইটে খোলসা করে বলুন।

ইয়ে ধরো যদি বলি একজন খুব বেঁটেখাটো লোক?

জগা আর পাগলু ফের মুখ তাকাতাকি করে নেয়।

জগা বলল, তা নানা সাইজেরই আসত। বেঁটে, লম্বা, মোটা, রোগা, কালো, ধলা।

আমি একজন বিশেষ বেঁটে লোকের কথা বলছি।

পাগলু বলল, বড্ড খিদে পেয়ে গেল যে গোঁসাই। এই অবস্থায় তো কথা চলে না।

গোপেশ্বর গম্ভীর হয়ে বলে, তাই বুঝি? বলি কথাটা ভাঙবার জন্য ঘুষ চাও নাকি? ঠিক আছে, দিনুর কাছ থেকে যে টাকা খেয়েছে সেটা নগেন দারোগার কানে তুলে দেবোখন। নগেন দারোগা রিটায়ার করলে কী হয় এখনও পাপীতাপীর যম।

পাগলু খিক করে একটু হেসে বলল, সে আপনার ইচ্ছে হলে বলুন গে। আর ইদিকে আমরাও কথাটা একটু দিনুর কাছে নিবেদন করে দেবোখন যে, আপনি আমাদের ভয়টয় দেখাচ্ছেন।

গোপেশ্বর গম্ভীর হয়ে বলল, প্যাঁচ কষছো ভায়ারা?

তা আপনি কষলে আমাদেরও কষতে হয়।

গোপেশ্বর ফের মোলায়েম হয়ে বলে, দারোগাবাবুকে বলে দেবো বলেছিলাম, তা সে কথাটা ধোরো না। আসলে কী জানেনা, খবর পেয়েছি। একটা বেঁটেমতো লোক শূলপাণির কাছে খুব যাতায়াত করত। শূলপাণির গুম হওয়ার পেছনে তার হাত থাকতে পারে।

জগা বলল, গুমটুম বাজে কথা। শূলপাণি বাবাজীর আর এখানে পোষাচ্ছিল না, তিনি হিমালয়ে গিয়ে সাধু হয়েছেন বলেই লোকের বিশ্বাস।

গোপেশ্বর খানিকক্ষণ চিন্তিতভাবে বসে থেকে হঠাৎ বলল, জিলিপি খাবে নাকি ভায়ারা? তা এই নাও পাঁচটি টাকা। আমি গরিব মানুষ, এর বেশি পেরে উঠব না। এতে কি হবে?

জগা ঘাড় হেলিয়ে বলল, হয়ে যাবে কোনওরকমে, কী বলল পাগলুদাদা?

পাগলু বিরক্ত হয়ে বলল, তোর বড় ছোটো নজর রে জগা।

আহা বোষ্টম মানুষ, যা দিচ্ছেন নিয়েই নাও।

পাগলু অনিচ্ছুক হাতে টাকাটা নিয়ে ট্র্যাকে খুঁজে বলল, বেঁটে লোকটাকে আপনার কিসের দরকার?

বেঁটে বলে তাকে অবহেলা কোরো না ভায়ারা। তার নামে একটা তল্লাট কাঁপে। ছোটোখাটো মানুষ হলে কি হয়, সে হল অ্যাটম বোম। তার নাম হল নিতাই পাল। চেনো?

একগাল হেসে পাগলু বলল, নিতাই পালকে চিনব না। তবে তিনি যে এত ভয়ঙ্কর লোক তা জানা ছিল না।

অনেক কিছুই তোমাদের জানা নেই ভায়া। তা নিতাই আসত?

প্রায়ই আসতেন। কী সব গুজগুজ ফুসফুস কথাও হত দুজনের মধ্যে।

বটে!

আজ্ঞে। সাতগাঁ না কোথায় যেন বাড়ি।

সাতগাঁয়েই।

আপনি কি তাকে চেনেন গোঁসাই?

চিনি মানে ওই আর কি। মুখ চেনা বলতে পারো। কথাটা হল, নিতাই পালকে একটু ফিট না করলেই নয়। তাকে চেপে ধরলে শূলপাণির খবর পাওয়া যাবে। আর শূলপাণির খবর পেলে সরলাবুড়ির গুপ্তধনেরও হদিস মিলবে।

জগা হেসে উঠে বলল, গোঁসাই গুপ্তধনের স্বপ্ন দেখছেন। ওসব বাজে কথা। সরলাবুড়ির বাড়ি আমরা আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখেছি। গুপ্তধন নেই।

আলবাৎ আছে। অন্তত দু ঘড়া মোহর।