০৬-১০. রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে

রামচরণ মাত্র আঠারো বছর বয়সে এ বাড়িতে এসে চাকরি নিয়েছিল অনাদি চক্রবর্তীর কাছে। বাড়ি তার মেদিনীপুরে। দীর্ঘ পঁয়তাল্লিশ বছর তার এ বাড়িতে কেটে গেছে। ষাটের উদ্ধে বর্তমানে তার বয়স হলেও একমাত্র কেশে পাক ধরা ছাড়া দেহের কোথাও বার্ধক্যের দাঁত বসেনি। বেঁটেখাটো বেশ বলিষ্ঠ গঠনের লোক। পরিধানে একটা পরিষ্কার সাদা ধুতি ও সাদা মেজাই। কাঁধে একটা পরিষ্কার ভোয়ালে।

রামচরণ মিঃ বসাকের ডাকে এগিয়ে এসে বললে, আমাকে ডাকছিলেন ইন্সপেক্টারবাবু?

হ্যাঁ। তোমার চা হল?

জল ফুটে গেছে, এখুনি নিয়ে আসছি।

এঁদের জন্যেও চা নিয়ে এস, এঁদের বোধ হয় তুমি চিনতে পারছ না?

আজ্ঞে না তো।

এঁরা তোমার কাবাবুর ভাইপো ও ভাইঝি। উপরে এঁদের থাকবার ব্যবস্থা করে দাও। আর হ্যাঁ, দেখ, বাইরে দারোয়ানের ঘরে এঁদের জিনিসপত্র আছে, সেগুলো মালীকে দিয়ে ভিতরে আনাবার ব্যবস্থা কর।

যে আজ্ঞে—

রামচরণ বোধ হয় আজ্ঞা পালনের জন্যই চলে যাচ্ছিল, কিন্তু হঠাৎ সুজাতার কথায় থমকে দাঁড়াল।

সুজাতা বলছিল, কিন্তু আমি তো এখানে থাকতে পারব না ছোড়দা, আমি কলকাতায় যাব।

মিঃ বসাক ফিরে তাকালেন সুজাতার দিকে তার কথায়, কেন বলুন তো সুজাতাদেবী?

না না—আমি এখানে থাকতে পারব না, আমার যেন কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে। ছোড়া, আমি কলকাতায় যাব।

কেমন যেন ভীত শুষ্ক কণ্ঠে কথাগুলো বলে সুজাতা।

মিঃ বসাক হাসলেন, বুঝতে পারছি সুজাতাদেবী, আপনি একটু নার্ভাস হয়ে পড়েছেন। কিন্তু ভয়ের কিছু নেই, আমিও আজকের রাত এখানেই থাকব, কলকাতায় ফিরে যাব না। তাছাড়া এই রাত্রে কলকাতায় গিয়ে সেই হোটেলেই তো উঠবেন। তার চাইতে আজকের রাতটা এখানেই কাটান না, কাল সকালে যা হয় করবেন।

হ্যাঁ। সেই ভাল সুজাতা। রজত বোঝাবার চেষ্টা করে।

না ছোড়দা, কেমন যেন দম বন্ধ হয়ে আসছে। থাকতে হয় তুমি থাক, আমি কলকাতায় ফিরেই যাব। সুজাতা আবার প্রতিবাদ জানায়।

তা যেতে হয় যাবেনখন। আবার বললেন মিঃ বসাক।

এবার সুজাতা চুপ করেই থাকে।

কিন্তু আজকের রাতটা সত্যিই থেকে গেলে হত না সুজাতা? রজত বোঝাবার চেষ্টা করে।

না–

শোন্ একটা কথা বলে রজত সুজাতাকে একপাশে নিয়ে যায়।

কী?

তোর যাওয়াটা বোধ হয় এক্ষুনি উচিত হবে না।

কেন?

কাকার কি করে মৃত্যু হল সেটাও তো আমাদের জানা প্রয়োজন। তাছাড়া আমি রয়েছি, আরও এত পুলিসের লোক রয়েছে–ভয়টাই বা কি?

না ছোড়দা—

যেতে হয় কাল সকালেই না হয় যাস। চল–

ঐ সময় মিঃ বসাকও আবার বললেন, চলুন, ঘরে চলুন। শুধু আমরাই নয় মিস রয়, এ বাড়ি ঘিরে আট-দশজন পুলিস প্রহরীও আছে এবং সারা রাতই তারা থাকবে।

.

সকলে এসে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করলেন।

এ ঘরের সাইজটাও নেহাত ছেট নয়। বেশ প্রশস্তই। চারিদিকে চেয়ে মনে হল ঘরটা ইদানীং খালিই পড়ে থাকত। একটা টেবিল ও এদিক-ওদিক খানকতক চেয়ার ও একটা আরাম-কেদারা ছাড়া ঘরের মধ্যে অন্য কোন আসবাবপত্রই আর নেই।

ঘরের আলোটা কম শক্তির নয়। বেশ উজ্জ্বলই। টেবিলের উপরে একটা সিগারেটের টিন, একটা দেশলাই ও একটা ফ্ল্যাট ফাইল পড়ে ছিল। মিঃ বসাক রজতের দিকে তাকিয়ে বললেন, বসুন রজতবাবু, বসুন সুজাতাদেবী। পুরন্দরবাবু বসুন।

সকলে এক-একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন।

রজতই প্রথমে কথা বললে।

মিঃ বসাক তাঁর ডায়েরীতে রজতবাবু সম্পর্কে যা লিখেছিলেন তা হচ্ছে রজতবাবুর বয়স ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে। বেশ বলিষ্ঠ দোহারা গঠন। গায়ের রং কালো। চোখে মুখে একটা বুদ্ধির দীপ্তি আছে। এম. এ পড়তে পড়তে পড়াশুনা ছেড়ে দিয়ে লাহোরের একটা মার্চেন্ট অফিসে তাঁর মামার সুপারিসেই চাকরি পেয়ে বছর পাঁচ আগে লাহোরে চলে যান। রজতবাবুর মামা লাহোরের সেই অফিসেই উচ্চপদস্থ একজন কর্মচারী ছিলেন।

কিন্তু গত বছর দুয়েক হল রজতবাবু সে চাকরি ছেড়ে দিয়ে লাহোরে আনারকলি অঞ্চলে একটা ওষুধ ও পারফিউমারীর দোকান নেন এক পাঞ্জাবী মুসলমান বন্ধুর সঙ্গে আধাআধি বখরায়।

মধ্যে মধ্যে প্রায়ই ব্যবসার প্রয়োজনে কলকাতায় আসতেন বটেতবে কখনও কাকা বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেননি বা উত্তরপাড়ায় ইতিপূর্বে কখনও আসেননি।

***

আর সুজাতাদেবী! রজতবাবুর চাইতে বছর চার-পাঁচেক বয়সে ছোটই হবে। দেখতে অপরূপ সুন্দরী। সে বোধ হয় তার অপরূপ সুন্দরী পিতামহী সুরধনী দেবীর চোখ-ঝলসানো রূপের ধারাটাকে বহন করে এনেছিল। চোখে মুখে অদ্ভুত একটা শান্ত নিরীহ সরলতা যেন। সুজাতা লক্ষৌতে চাকরি করছে। বি. এ. পাস। বিবাহ করেনি।

.

০৭.

রজতই প্রথমে কথা বললে, কিন্তু কি করে কি হল কিছুই যে আমি বুঝে উঠতে পারছি না মিঃ বসাক। ছোট্রকার সঙ্গে দীর্ঘদিন ধরে আমাদের কোন যোগাযোগ ছিল না সত্যি বটে, তবে তাঁকে তো ভাল করেই জানতাম। তাঁর মত অমন ধীর স্থির শান্ত চরিত্রের লোককে কেউ হত্যা করতে পারে এ যে কখনও কিছুতেই বিশ্বাস করে উঠতে পারছি না।

মিঃ বসাক মৃদু কণ্ঠে বললেন, বিশ্বাস না করতে পারলেও ব্যাপারটা যে ঘটেছে তা তো অস্বীকার করতে পারবেন না রজতবাবু। তাছাড়া দীর্ঘদিন বিনয়েন্দ্রবাবুর সঙ্গে আপনাদের কোন যোগাযোগ পর্যন্ত ছিল না। তাঁর সম্পর্কে কোন কথাও আপনারা শোনেননি।

তা অবশ্য ঠিক।

এই সময়ের মধ্যে তাঁর কোন পরিবর্তন হয়েছিল কিনা এবং এমন কোন কিছু ঘটেছিল কিনা যেজন্য এই দুর্ঘটনা ঘটল তাও তো আপনি বলতে পারেন না।

তা অবশ্য পারি না।

আচ্ছা পুরন্দরবাবু,–হঠাৎ মিঃ বসাক পাশ্বেই উপবিষ্ট পুরন্দর চৌধুরীর দিকে ফিরে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন, আপনিই তো তাঁর বিশেষ বন্ধু ছিলেন, তাঁর সম্পর্কে কোন কিছু আপনি জেনেছিলেন?

না। He was a perfect gentleman। গম্ভীর কণ্ঠে প্রত্যুত্তর দিলেন পুরন্দর চৌধুরী।

এবারে আবার মিঃ বসাক রজতের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন, আমি লালবাজার থেকে এসে পৌঁছবার আগেই এখানকার থানা-ইনচার্জ রামানন্দবাবু যতটা সম্ভব তদন্ত করেছিলেন। তাঁর রিপোর্ট থেকে যতটা জানতে পেরেছি, বিনয়েন্দ্রবাবু নাকি ইদানীং সাত আট বছর অত্যন্ত secluded life lead করতেন। দিবারাত্র তাঁর ল্যাবরেটরী ঘরের মধ্যেই কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। পাড়ার কারোর সঙ্গেই তাঁর বড় একটা মেলামেশা ছিল না। আশপাশের ভদ্রলোকেরা কেউ তাঁর সম্পর্কে কোন কথা বলতে পারেননি। একজন ভদ্রলোক তো বললে, লোকটা যে বাড়িতে থাকে তাই জানবার উপায় ছিল না।

ঐ সময় রামচরণ চায়ের ট্রে হাতে ঘরে এসে প্রবেশ করল।

রজত রামচরণের দিকে তাকিয়ে মিঃ বসাককে সম্বোধন করে বললে, রামচরণ তো এ বাড়ির অনেকদিনকার পুরনো চাকর। ওকে জিজ্ঞাসা করেননি? ও হয়তো অনেক কথা বলতে পারবে।

হ্যাঁ, রামচরণের কাছে কিছু কিছু information পেয়েছি বটে তবে সেও অত্যন্ত এলোমেলো।

রামচরণ একবার রজতের মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু কোন কথা না বলে চায়ের কাপগুলো একটার পর একটা টেবিলের উপরে নামিয়ে রেখে নিঃশব্দে ঘর থেকে যেমন এসেছিল তেমনি বের হয়ে গেল।

চা পান করতে করতে মিঃ বসাক আবার বলতে লাগলেন।

.

প্রথম ভোরের লোকাল ট্রেনে পুরন্দর চৌধুরী বিনয়েন্দ্রবাবুর একটা জরুরী চিঠি পেয়ে এখানে এসে পৌঁছান। পুরন্দর চৌধুরী আসছেন সিঙ্গাপুর থেকে। ভোরবেলায় তিনি প্লেনে করে কলকাতা এসে পৌঁছান এবং সোজা একেবারে ট্যাক্সিতে করে অন্য কোথায়ও না গিয়ে উত্তরপাড়ায় চলে আসেন।

ইতিপূর্বে অবশ্য পুরন্দর চৌধুরী বার তিন-চার এ বাড়িতে এসেছেন, তিনি নিজেও তা স্বীকার করেছেন এবং রামচরণও বলেছে।

পুরন্দর চৌধুরী এককালে কলেজ লাইফে বিনয়েন্দ্রর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। তারপর বি.এস-সি পরীক্ষায় ফেল করে কাউকে কিছু না জানিয়ে জাহাজে খালাসীর চাকরি নিয়ে সিঙ্গাপুরে চলেযানভাগ্যান্বেষণে। এখনও সেখানেই আছেন। পুরন্দরচৌধুরী এখানে এসে নিচেরামচরণের দেখা পান। রামচরণকেই জিজ্ঞাসা করেন তার বাবু কোথায়।

রামচরণ ঐ সময় প্রভাতী চা নিয়ে বাবুর ল্যাবরেটরীর দিকেই চলেছিল। সে বলে, গত রাত থেকে বাবু ল্যাবরেটরীতেই কাজ করছেন। এখনও বের হননি।

এ রকম প্রায়ই নাকি মধ্যে মধ্যে সারাটা রাত বিনয়েন্দ্র ল্যাবরেটরীতেই কাটিয়ে দিতেন।

সকলের উপরে কঠোর নির্দেশ ছিল বিনয়েন্দ্র যতক্ষণ ল্যাবরেটরীতে থাকবেন কেউ যেন তাঁকে কোন কারণেই না বিরক্ত করে। সেইজন্যই রামচরণ সেরাত্রে তাঁকে বিরক্ত করেনি।

রামচরণের জবানবন্দি থেকেই জানা যায়, গত রাত্রে এগারোটা নাগাদ একবার নাকি ল্যাবরেটরী থেকে বের হয়েছিলেন বিনয়েন্দ্র।

সেই সময় খাওয়ার কথা জিজ্ঞাসা করায় বিনয়েন্দ্র বলেছিলেন, রাত্রে আর তিনি কিছু খাবেন না। এক গ্লাস দুধ যেন কেবল গরম করে আঁর শোবার ঘরে রামচরণ রেখে দেয়। প্রয়োজন হলে তাই তিনি খাবেন।

রামচরণ প্রভুর নির্দেশমত এক গ্লাস দুধ গরম করে ল্যাবরেটরী-সংলগ্ন তাঁর শয়নঘরে রেখে শুতে যায়, রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা।

তারপর সে নীচে এসে তার নিজের ঘরে শুতে যায়।

কেন জানি না সেদিন রাত্রি দশটার সময় রাত্রের আহার শেষ করবার পর থেকেই অত্যন্ত ঘুম পাচ্ছিল রামচরণের। অন্যান্য রাত্রে তার চোখে ঘুম আসতে আসতে সেই রাত বারোটা বেজে যায়। অত ঘুম পাচ্ছিল বলেই রামচরণ বোধ হয় বিছানায় গিয়ে শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ে।

অন্যান্য দিন খুব সকালেই তার ঘুম ভাঙ্গে, কিন্তু গতকাল ঘুম ভাঙ্গে তার প্রায় সাড়ে সাতটায়। তাও লছমনের ডাকাডাকিতে।

লছমন এ বাড়িতে পাচকের কাজ করে। ঘুম ভেঙ্গে অত বেলা হয়ে গেছে দেখে সে একটু ভীতই হয়ে পড়ে। কেন না বাবুর খুব ভোরে চা-পানের অভ্যাস। এবং সময়মত প্রভাতী চা না পেলে গালাগালি দিয়ে তিনি ভূত ছাড়াবেন।

লছমনকে জিজ্ঞাসা করে, বাবু তাঁকে ডেকেছেন কিনা চায়ের জন্য।

লছমন বলে, না।

যা হোক তাড়াতাড়ি চা নিয়ে যখন সে উপরে চলেছে, পুরন্দর চৌধুরীর সঙ্গে সিঁড়ির সামনে তার দেখা।

সাহেব, আপনি কখন এলেন? রামচরণ জিজ্ঞাসা করে।

এই আসছি। তোমার বাবু কেমন আছেন?

ভালই। চলুন, বাবু বোধ হয় কাল রাত থেকে ল্যাবরেটরী ঘরেই আছেন।

উভয়ে উপরে এসে দেখে ল্যাবরেটরী ঘরের দরজা ঈষৎ খোলা; যেটা ইতিপূর্বে খোলা থাকতে কেউ দেখেনি। রামচরণ বেশ একটু আশ্চর্যই হয়।

রামচরণ চায়ের কাপ হাতে ল্যাবরেটরী ঘরে প্রবেশ করে, পুরন্দর চৌধুরী বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন।

রামচরণকে শুধু বলে দেন তাঁর আসার সংবাদটা বাবুকে দিতে।

সরাসরি ঢোকেন না তিনি ল্যাবরেটরীতে, কেননা সংবাদ না দিয়ে ও অনুমতি না নিয়ে যে ল্যাবরেটরী ঘরে একমাত্র রামচরণ ব্যতীত এ বাড়ির কারুর প্রবেশ করবার হুকুম ছিল না সেটা পুরন্দরের অজানা ছিল না।

বারান্দার ঘরের সামনে দোতলায় পুরন্দর চৌধুরী দাঁড়িয়েছিলেন; হঠাৎ একটা কাঁচ ভাঙার ঝনঝন শব্দ ও আর্তকণ্ঠের চিৎকার তাঁর কানে এল।

কী হল?

ল্যাবরেটরীর ভিতর থেকে আবার রামচরণের চাপা আর্তস্বর শোনা গেল। এবং পুরন্দর চৌধুরী কিছু বুঝে উঠবার আগেই খোলা দরজাপথে একপ্রকার ছুটতে ছুটতেই বের হয়ে এল রামচরণ। তার সর্বাঙ্গ তখন থরথর করে কাঁপছে।

কী! কী হয়েছে রামচরণ? পুরন্দর চৌধুরী প্রশ্ন করেন।

বাবু–বাবু বোধ হয় মরে গেছেন!

.

০৮.

কি বলছ রামচরণ! বাবু মরে গেছেন কি! .

হ্যাঁ। আসুন, দেখবেন চলুন।

পুরন্দর চৌধুরী সোজা ঘরের মধ্যে ছুটে যান। প্রথমটায় তাঁর কিছুই চোখে পড়ে না। ল্যাবরেটরী ঘরের সব কটা জানলাই বন্ধ। এবং জানলার উপর সব ভারি কালো পর্দা ফেলা। সাধারণতঃ ল্যাবরেটরী ঘরে যে উজ্জ্বল হাজার পাওয়ারের বিদ্যুৎবাতি জ্বলে, তখনও ঘরে সে আলোটা জ্বলছে। আর কাজ করবার লম্বা টেবিলটা, যার উপরে নানা ধরনের বিচিত্র সব কাঁচের যন্ত্রপাতি—মাইক্রোসকোপ, বুনসেন বানার প্রভৃতি সাজানো—সেই লম্বা টেবিলটারই সামনে একটা বসবার উঁচু টুলটার পাশেই চিৎ হয়ে পড়ে আছেন বৈজ্ঞানিক বিনয়েন্দ্র সান্ন্যালের নিথর নিস্পন্দ দেহটা।

পরিধানে তখনও তাঁর পায়জামা ও গবেষণাগারের সাদা অ্যাপ্রন। ভূপতিত নিষ্কম্প দেহটা এবং তাঁর মুখের দিকে দৃষ্টিমাত্রেই বুঝতে কষ্ট হয় না যে, সে দেহে প্রাণের লেশমাত্রও আর নেই।

বহুক্ষণ পূর্বেই তাঁর দেহান্ত ঘটেছে। এবং সমস্ত মুখখানা হয়ে গেছে নীলাভ। আতঙ্কিত, বিস্ফারিত দুটি চক্ষুতারকা। ঈষৎ বিভক্ত ও প্রসারিত নীলাভ দুটি ওষ্ঠের প্রান্ত দিয়ে ক্ষীণ একটা রক্তাক্ত ফেনার ধারা গড়িয়ে নেমেছে।

দুটি হাত মুষ্টিবদ্ধ।

মৃতদেহের পাশেই তখনও পড়ে রয়েছে একটি গ্লাস-বিকার। সেই গ্লাস-বিকারের তলদেশে তখনও সাদা মত কী সামান্য খানিকটা তরল পদার্থ অবশিষ্ট পড়ে আছে।

প্রথম দর্শনেই ব্যাপারটা মনে হবে বিনয়েন্দ্র যেন কিছু খেয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

পুরন্দর চৌধুরীই দারোয়ান ধনবাহাদুরের হাতে চিঠি দিয়ে স্থানীয় থানায় সংবাদ প্রেরণ করেন। সংবাদ পাওয়ামাত্রই থানা-ইনচার্জ রামানন্দ সেন চলে আসেন। নীলকুঠিতে এসে ব্যাপারটা তদন্ত করে এবং মৃতদেহ পরীক্ষা করে থানা-ইনচার্জের মনে যেন কেমন একটা খটকা লাগে। তিনি তাড়াতাড়ি থানার এ.এস.আই-কে একটা সংবাদ পাঠান, লালবাজার স্পেশাল ব্রাঞ্চে ফোন করে তখুনি ব্যাপারটা জানাবার জন্য।

মৃত্যুর ব্যাপারটা যে ঠিক সোজাসুজি আত্মহত্যা নয়, তিনটি কারণে থানা-ইনচার্জের সন্দেহ হয়েছিল। প্রথমত ঘাড়ের ঠিক নীচেই ১—১২x পরিমাণ একটি কালসিটার চিহ্ন ছিল। দ্বিতীয়ত সুদৃশ্য টেবিল-টাইম-পিষ্ট ভগ্ন অবস্থায় ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিল এবং তৃতীয়ত ল্যাবরেটারীর ঘরের দরজাটা ছিল খোলা।

ঘণ্টা দুইয়ের মধ্যে বেলা দশটা নাগাদ ইন্সপেক্টার মিঃ বসাক লালবাজার থেকে চলে আসেন।

থানা-ইনচার্জ তখন নীলকুঠির সমস্ত লোকদের নীচের একটা ঘরে জড়ো করে পুলিস-প্রহরায় একজন একজন করে পাশের ঘরে ডেকে নিয়ে জেরা করছেন।

নীলকুঠীতে লোকজনের মধ্যে এ বাড়ির পুরাতন ভৃত্য প্রৌঢ় রামচরণ, পাচক লছমন, বয়স তার ত্রিশ-বত্রিশের মধ্যে বছর দুই হল এখানে চাকরিতে লেগেছে। আর একজন ভৃত্য বাইরের যাবতীয় বাজার ও ফাইফরমাস খাটবার জন্য, নাম রেবতী। পূর্ববঙ্গে বাড়ি। বয়েস ত্রিশ-বত্রিশইহবে। বছর পাঁচেক হল এ বাড়িতে কাজ করছে। দারোয়ান নেপালী ধনবাহাদুর থাপা। সেও এ বাড়িতে প্রায় বছর ছয়েক আছে। আর সোফার ও ক্লীনার করালী। করালী এ বাড়িতে কাজে লেগেছে বছরখানেক মাত্র। তার আগে যে ড্রাইভার ছিল গাড়িতে অ্যাক্সিডেন্ট করে এখন হাজতবাস করছে বছর দেড়েক ধরে।

বিরাট নীলকুঠী। ত্রিতল। তিনতলায় দুখানা ঘর, দোতলায় সাতখানা ও একতলায় ছখানা ঘর। এছাড়া বাড়ির সামনে অনেকখানি জায়গা জুড়ে ফুলের বাগান। একধারে গ্যারেজ ও দারোয়ানদের থাকার ঘর।

গ্যারেজটা মস্ত বড়। এককালে সেখানে তিনটি জুড়ি গাড়ি ও চারটে ওয়েলার ঘোড়া থাকত।

অনাদি চক্রবর্তীর মৃত্যুর বছরখানেক বাদেই শেষ গাড়িখানা ও শেষ দুটি ঘোড়া বিক্রয় করে দিয়ে, সহিস ও কোচওয়ানকে তুলে দিয়ে মস্ত একটা ফোর্ড গাড়ি কিনেছিলেন বিনয়েন্দ্র।

মোটরগাড়িটা অবিশ্যি কেনা পর্যন্তই।

কারণ বেশীর ভাগ সময়েই গ্যারেজে পড়ে থাকত, কচিৎ কখনও বিনয়েন্দ্র গাড়িতে চেপে বের হতেন। ড্রাইভার বসে বসেই মোটা মাইনে পেত। বাড়ির পশ্চাৎ দিকেও মস্ত বড় বাগান, চারিদিকে তার একমানুষ সমান উঁচু লোহার রেলিং দেওয়া প্রাচীর। তারই ঠিক নীচে প্রবহমাণ জাহ্নবী। একটা বাঁধানো প্রশস্ত ঘাটও আছে চক্রবর্তীদেরই তৈরী তাদের নিজস্ব ব্যবহারের জন্য।

ঘাটের গায়েই একটা লোহার গেট। তবে গেটটা সদাসর্বদা বন্ধই থাকে। একদা ঐ পশ্চাৎ দিককার বাগানে অত্যন্ত সমারোহ ছিল, এখন অযত্নে ও অবহেলায় ঘন আগাছায় ভরে গেছে।

রামচরণ, রেবতী, লছমন ও করালী সকলেই খানতিনেক ঘর নিয়ে বাড়ির নীচের তলাতেই থাকে।

নীলকুঠীতে ঐ চারজন লোক থাকলেও বিনয়েন্দ্রর সঙ্গে সম্পর্ক ছিল একমাত্র রামচরণেরই। অন্যান্য সকলের সঙ্গে বাবুর দেখাসাক্ষাৎ কচিৎ কখনও হত। তবে মাইনেপত্র নিয়মিত সকলে মাসের প্রথমেই বাড়ির পুরাতন সরকার প্রতুলবাবুর হাত দিয়েই পেত।

প্রতুলবাবু নীলকুঠীতে থাকতেন না। ঐ অঞ্চলেই কাছাকাছি একটা বাসা নিয়ে গত তের বৎসর ধরে পরিবার নিয়ে আছেন। অনাদি চক্রবর্তীর আমল থেকেই নাকি ঐ ব্যবস্থা বহাল ছিল। বিনয়েন্দ্র তার কোন অদলবদল করেননি তাঁর আমলেও।

প্রত্যহ সকালবেলা একবার প্রতুলবাবু নীলকুঠীতে আসতেন। বেলা দশটা সাড়ে দশটা নাগাদ চলে যেতেন, তারপর আবার আসতেন গোটা পাঁচেকের সময়, যেতেন সেই রাত নটায়।

অনাদি চক্রবর্তীর আমলে অনেক কাজই প্রতুলবাবুকে করতে হত, অনেক কিছুরই দেখাশোনা করতে হত, কিন্তু বিনয়েন্দ্র আসার পর ক্রমে ক্রমে তার দায়িত্ব ও কাজগুলো নিজেই তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন।

গতকাল প্রতুলবাবু উত্তরপাড়ায় ছিলেন না, তাঁর এক ভাইঝির বিবাহে দিনচারেকের জন্য শ্যামনগর গিয়েছেন।

ভৃত্য, পাচক, সোফার ও দারোয়ান কাউকেই জিজ্ঞাসা করে এমন কোন কিছু জানতে : পারা যায়নি, যা বিনয়েন্দ্রর মৃত্যু-ব্যাপারে আলোকসম্পাৎ করতে পারে।

মিঃ বসাক শুধু একাই আসেন নি, তিনি আসবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন পুলিস সার্জেন ডাঃ বক্সিকেও।

থানা-ইনচার্জ রামানন্দবাবুও ওঁদের দেখে উঠে দাঁড়িয়ে অভ্যর্থনা জানালেন।

চলুন। কোন্ ঘরে মৃতদেহ আছে, একবার দেখে আসা যাক।

.

০৯.

মিঃ বসাক সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতে বললেন, ব্যাপারটা আপনার তাহলে সুইসাইড নয়, হোমিসাইড বলেই মনে হচ্ছে?

হ্যাঁ স্যার।

মাথার নীচে ঘাড়ে abbression ছাড়া অন্য কিছু কি দেখতে পেয়েছেন, যাতে করে আপনার মনে হয়েছে ব্যাপারটা হোমিসাইড?

হ্যাঁ, আরও একটা কারণ আছে স্যার।

কি?

মৃতদেহ দেখেই অবশ্য বোঝা যায়, যে, বিষই মৃত্যুর কারণ এবং মৃতদেহের পাশে যে গ্লাস-বিকারটি পাওয়া গেছে, সেটার যে অবশিষ্টাংশ তরল পদার্থ এখনও বর্তমান আছে, সেটার chemical analysis হলে হয়তো সেটাও বিষই প্রমাণিত হবে, রামানন্দবাবুবললেন।

বসাক বললেন, কিন্তু বিষই যদি তিনি খেয়ে আত্মহত্যা করবেন, তাহলে মেঝেতে শুয়ে খেলেন কেন? তারপর ঘড়িটা ভাঙা অবস্থায় বা পাওয়া গেল কেন? বরং আমার যেন সব শুনে মনে হচ্ছে তাঁকে কেউ অতর্কিতে প্রথমে পিছন দিক থেকে কোন ভারি বস্তু দিয়ে আঘাত করে, তারপর হয়তো বিষ প্রয়োগ করেছে অজ্ঞান অবস্থায়। আরও একটা কথা, ভেবে দেখেছেন কি ঘরের দরজা খোলাই ছিল! অথচ দেখা যায় আত্মহত্যার সময় সাধারণ লোক দরজা বন্ধ করেই রাখে।

থানা-অফিসার রামানন্দ সেনের কথার জবাবে মিঃ বসাক কোন সাড়া দিলেন না বা। কোনরূপ মন্তব্য করলেন না।

ল্যাবরেটরী ঘরের দরজায় থানা-অফিসার ইতিমধ্যে তালা লাগিয়ে রেখেছিলেন। চাবি তাঁর কাছেই ছিল।

ঘরের তালা খুলে সকলে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলেন।

মিঃ প্রশান্ত বসাক মাত্র বছর কয়েক পুলিস লাইনে প্রবেশ করলেও ইতিমধ্যেই তাঁর কর্মদক্ষতায় স্পেশাল ব্রাঞ্চেরইন্সপেক্টরের পদে উন্নীত হয়েছিলেন। বয়স তাঁর বত্রিশ-তেত্রিশের মধ্যে হলেও ঐ ধরনের জটিল সব কেসে অদ্ভুত ও আশ্চর্য রকমের ঘটনা বিশ্লেষণের ন্যাক ছিল তাঁর।

ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে সর্বাগ্রে তিনি ঘরের চতুর্দিকে একবার তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিলেন।

বসাক ভাবছিলেন তখন থানা-অফিসারের অনুমান যদি সত্যিই হয়, সত্যিই যদি ব্যাপারটা একটা নৃশংস হত্যাকাণ্ডই হয় তো এই ঘরের মধ্যেই সেটা গতরাত্রেই সঘটিত হয়েছে। সেক্ষেত্রে হত্যাকারী কি তার কোন দুর্বল মুহূর্তে কোন চিহ্নই আর দুষ্কৃতি রেখে যায়নি! নিশ্চয়ই গিয়েছে। আজ পর্যন্ত জগতের কোথাও এমন কোন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় নি যার কিছু-না-কিছু চিহ্ন অকুস্থানে হত্যাকারীকে অনিচ্ছায় হোক বা অজ্ঞাতেই হোক ফেলে যেতে হয়েছে।

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মিঃ বসাক লম্বা গবেষণার টেবিলটার সামনেই। যেখানে তখনও মৃতদেহটা ভূপতিত ছিল তার অতি নিকটে এসে দাঁড়ালেন।

মৃত্যু! তবে আত্মহত্যা, না হত্যাই সেইটাই ভাববার কথা।

মৃতের দুটি বিস্ফারিত চক্ষু–প্রাণহীন হলেও বোঝা যায় তার মধ্যে রয়েছে একট ভয়ার্ত : বিস্ময়। যেন একটা আকস্মিক জিজ্ঞাসায় সন্ত্রস্ত হয়েই সেই অবস্থাতেই থেমে গিয়েছে।

কিসের প্রশ্ন! কিসের আশঙ্কা মৃতের ঐ চোখের তারায়!

দুটি মুষ্টিবদ্ধ হাত। শেষ মুহূর্তটিতে কিছু কি আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলেন!

কোন আশ্রয়ের সন্ধানে বা কোন অবলম্বনের শেষ প্রচেষ্টায়! এখনও তাই হাত দুটি মুষ্টিবদ্ধ হয়েই আছে।

একেবারে সোজা লম্বালম্বিভাবে দেহটা চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে আছে।

কিন্তু কই! দেহের মধ্যে আত্মহত্যা করবার পরের শেষ ও প্রচণ্ড আক্ষেপ কোথায়! বিষ-প্রক্রিয়ায় সাধারণত যা হয়ে থাকে।

যে বিষ আচমকা দেহান্ত ঘটায়, সে বিষ আক্ষেপও দেয় পেশীতে পেশীতে প্রচণ্ড একটা।

নীচু হয়ে মৃতদেহের পাশে বসলেন মিঃ বসাক।

ঈষৎ বিস্ফারিত নীলাভ ওষ্ঠের প্রান্ত বেয়ে ক্ষীণ একটা লালা-মিশ্রিত রক্তের ধারা কালচে হয়ে জমাট বেঁধে আছে।

দৃষ্টি আরও তীক্ষ্ণ করে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন মৃতের মুখখানি মিঃ বসাক।

দেখতে গিয়ে হঠাৎ তাঁর নজরে পড়ল নিচের ওষ্ঠটা যেন একটু ফোলা; ডান দিক এবং শুধু তাই নয় সেখানে একটা ক্ষতচিহ্নও আছে। যে ক্ষতচিহ্নে রক্ত একটু জমাট বেঁধে আছে এখনও।

কিসের ক্ষতচিহ্ন ঐ ওষ্ঠে? আর কেনই বা ক্ষতচিহ্ন? তবে কি? চিন্তা ও বিশ্লেষণ অতি দ্রুত মস্তিষ্কের কোষগুলির মধ্যে যেন বিদ্যুৎ-তরঙ্গের মত বহে যেতে থাকে।

সঙ্গে সঙ্গে একটা সম্ভাবনা মনের মধ্যে ক্রমে ক্রমে দানা বেঁধে উঠতে থাকে বসাকের।

একবারমুখ তুলেপার্শেই দণ্ডায়মান থানা-অফিসারের দিকে তাকালেন মিঃ বসাক, ওষ্ঠপ্রান্তে তাঁর জেগে ওঠে নিঃশব্দ স্মিত হাসির একটা ক্ষীণ রেখা।

পুলিস সার্জেন ডাঃ বক্সীও ইতিমধ্যে পাশে দাঁড়িয়ে দেহটা লক্ষ্য করছিলেন। মৃতের হাতের শক্ত আঙুলগুলো এবার টেনে দেখলেন ডাঃ বক্সী।

কতক্ষণ মারা গেছে বলে আপনার মনে হয় ডাঃ বক্সী? বসাক প্রশ্ন করলেন ডাক্তারকে।

তা ঘণ্টা নয়-দশ তো হবেই। মৃদু কণ্ঠে জবাব দিলেন ডাঃ বক্সী।

তাহলে রাত একটা দেড়টা নাগাদ মৃত্যু হয়েছে, এই তো?

হ্যাঁ। ঐ রকমই মনে হচ্ছে।

মৃত্যুর কারণ কী বলে মনে হচ্ছে?

মনে তো হচ্ছে a case of poisoning-ই।

অতঃপর ডাঃ বক্সী মৃতদেহটাকে উল্টে দিলেন মেঝের উপরই।

Occipital protuberence-এর ঠিক নীচেই একটি ১ X ১ ইঞ্চি পরিমাণ একিমোসিসের চিহ্ন। হাত দিয়ে পরীক্ষা করে দেখলেন ডাঃ বক্সী। তারপর মৃদু অনুচ্চারিত কণ্ঠে মিঃ বসাককে সম্বোধন করে বললেন, শুধু একিমোসিসই নয় মিঃ বসাক, ল্যাসারেসনও আছে। আর মনে হচ্ছে base of the skull-এর ফ্র্যাকচারও সম্ভবত আছে! আমার তো মনে হচ্ছে বেশ ভারি ও শক্ত কিছু যেমন ধরুন কোন লোহার রড জাতীয় জিনিস দিয়েই ঘাড়ে আঘাত করা হয়েছিল। এখন কথা হচ্ছে—

কী? মিঃ বসাক ডাঃ বক্সীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন।

ঐ আঘাতটাই primary cause of death, না poison-ই primary এবং আঘাতটা secondary—এইটাই এখন ভাববার বিষয়।

আমার কিন্তু মনে হচ্ছে থানা-অফিসার রামানন্দবাবুর অনুমানই ঠিক। পরিষ্কার এটা একটা হত্যাকাণ্ড। এবং আঘাতটা primary, আর secondary হচ্ছে poison। এখন কথা হচ্ছে হত্যাকারী প্রথমে মারাত্মক আঘাত হেনে পরে আরও sure হবার জন্য poison-এর ব্যবহার করেছিল, না হত্যা করে পরে poison দিয়েছিল ব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ একটা অন্য light দেবার জন্য

মানে, বলতে চাইছেন অন্যের চোখে ব্যাপারটাকে আত্মহত্যা বোঝাবার জন্য, তাই তো?

ঠিক তাই।

কিন্তু কেন আপনার সে কথা মনে হচ্ছে বলুন তো মিঃ বসাক। ডাঃ বক্সী প্রশ্ন করলেন।

চেয়ে দেখুন ভাল করে, মৃতের নীচের ওষ্ঠে ক্ষতচিহ্ন রয়েছে, এবং শুধু ক্ষতচিহ্নই নয়, জায়গাটা একটু ফুলেও আছে। তাতে করে কি মনে করতে পারি না আমরা যে, হয়তো কোন আঘাত দিয়ে অজ্ঞান করবার পর ব্যাপারটাকে আত্মহত্যার light দেবার জন্যই metal tube বা ঐ জাতীয় কোন কিছুর সাহায্য মুখের মধ্যে বিষ ঢেলে দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ যার দ্বারা প্রমাণিত হচ্ছে এটা pure simple case of homicide নৃশংস হত্যা, আত্মহত্যা আদৌ নয়।

এবারে ডাঃ বক্সী একটু বিশেষ দৃষ্টি দিয়েই মৃতের ওষ্ঠটা আবার পরীক্ষা করলেন, তারপর বললেন, সত্যিই তো, আপনার অনুমান হয়তো মিথ্যা নাও হতে পারে মিঃ বসাক। আমার মনে হচ্ছে, you are right। হ্যাঁ, আপনিই হয়তো ঠিক।

ভাঙা জামান টাইমপিসটা লম্বা টেবিলটার উপরেই রাখা ছিল। মিঃ বসাক ঘড়িটা হাতে তুলে নিলেন এবারে দেখবার জন্য।

ঘড়ির কাচটা ভেঙে শত চিড় খেয়ে গেলেও কাঁচের টুকরোগুলো খুলে পড়ে যায় নি। ঘড়িটা ঠিক একটা বেজে বন্ধ হয়ে আছে।

ঘড়িটা বার দুই নাড়াচাড়া করে মিঃ বসাক পুনরায় সেটা টেবিলের উপরেই রেখে দিলেন।

খুব সম্ভবত ঘড়িটা বন্ধ হয়ে গেছে রাত একটায়।

যে কোন কারণেই হোক ঘড়িটা নিশ্চয়ই ছিটকে পড়েছিল এবং যার ফলে ঘড়ির কাচটা ভেঙেছে ও ঘড়িটাও বন্ধ হয়ে গেছে।

ঘড়িটা কোথায় পেয়েছেন? মিঃ বসাক থানা-অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলেন।

মেঝেতে পড়েছিল।

ভৃত্য রামচরণকে পরে জিজ্ঞাসা করে জানা গিয়েছিল ঘড়িটা ওই টেবিলটার উপরেই নাকি সর্বদা থাকত।

.

১০.

যদিচ থানা-অফিসার সকলেরই জবানবন্দি নিয়েছিলেন, তথাপি মিঃ বসাক প্রত্যেককেই আবার পৃথক পৃথকভাবে ডেকে জিজ্ঞাসা করেন। বিশেষ করে একটা প্রশ্ন সকলকেই করলেন, রাত সাড়ে বারোটা থেকে একটার মধ্যে কোনরূপ শব্দ বা চিৎকার শুনতে কেউ পেয়েছিল কিনা।

কিন্তু সকলেই জবাব দেয়, না। তারা কোনরূপ শব্দই শোনেনি। কারও কোন চিৎকারও শোনেনি।

সমস্ত গবেষণা-ঘরটা মিঃ বসাক চারদিক খুব ভাল করে দেখলেন অন্য কোন সূত্র অথাৎ clue পাওয়া যায় কিনা।

.

গবেষণা-ঘরটি প্রশস্ত একটি হলঘরের মতই বললে অত্যুক্তি হয় না। দরজা মাত্র দুটি; একটি বাইরের বারান্দার দিকে ও অন্যটি পাশের ঘরের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে। অতএব এই দুটি দরজা ভিন্ন ওই ঘরে যাতায়াতের আর দ্বিতীয় কোন রাস্তাই নেই।

বারান্দার দিকে তিনটি জানলা। সেগুলো বোধ হয় দীর্ঘদিন পূর্বেই একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে ভিতর থেকে স্কু এঁটে। অন্যদিকে যে জানলাগুলো সেগুলোতে পূর্বে খড়খড়ির পাল্লা ছিল। বিনয়েন্দ্রনাথ ঘরটিকে ল্যাবরেটরী করবার সময় সেগুলো ফেলে দিয়ে বড় বড় কাঁচের পাল্লা সেট করিয়ে নিয়েছিলেন। পাল্লাগুলো ফ্রেমের মধ্যে বসানো। তার দুটি অংশ। নীচের অংশটি ফিক্সড়, উপরের অংশটি কার উপরে ওঠানো-নামানোর ব্যবস্থা আছে কর্ডের সাহায্যে।

ঘরের ভিতর থেকে জানলার সামনে আবার ভারী কালো পর্দা টাঙানো। সেই পর্দাও কর্ডের সাহায্যে ইচ্ছামত টেনে দেওয়া বা সরিয়ে দেওয়া যায়।

মধ্যে মধ্যে গবেষণার কাজের জন্য ডার্করুমের প্রয়োজন হত বলেই হয়তো জানলায় পর্দা দিয়ে বিনয়েন্দ্রন্দ্ৰ ঐরূপ ব্যবস্থা করে নিয়েছিলেন।

ঘরের তিন দিকেই দেওয়াল ঘেঁষে সব লোহার র‍্যাক, আলমারি, রেফ্রিজ, কোল্ড স্টোরেজ। নীল কুঠী আলমারি ও র‍্যাকে নানাজাতীয় শিশি বোতল রং-বেরংয়ের ওষুধে সব ভর্তি। কোন কোন র‍্যাকে ভর্তি সব মোটা মোটা রসায়ন বিজ্ঞানের বই।

গবেষণা-ঘর নয় তো, জ্ঞানী কোন তপস্বীর জ্ঞানচর্চার পাদপীঠ।

হত্যাকারী এই মন্দিরের মধ্যেও তার মৃত্যু-বীজ ছড়িয়ে যেন এর পবিত্রতাকে কলঙ্কিত করে গেছে।

কাঁচের জানলার ওদিকে বাড়ির পশ্চাৎ দিক। জানলার সামনে এসে দাঁড়ালে পশ্চাতের বাগান ও প্রবহমান গঙ্গার গৈরিক জলরাশি চোখে পড়ে।

ঘরের দুটি দরজা। দুটিই খোলা ছিল। অতএব হত্যাকারী যে কোন একটি দরজাপথেই ঘরে প্রবেশ করতে পারে। তবে বারান্দার দরজাটা সাধারণত যখন সর্বদা বন্ধই থাকত তখন মনে হয়, বিনয়েন্দ্রর শয়নঘর ও গবেষণাঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথেই সম্ভবত হত্যাকারী ঐ ঘরে প্রবেশ করেছিল এবং হত্যা করে যাবার সময় দ্বিতীয় দরজাটা খুলে সেই পথে ঘর থেকে বের হয়ে গিয়েছে।

গবেষণাঘরের মেঝেটি সাদা ইটালীয়ান মার্বেল পাথরে তৈরী। মসৃণ চকচকে।

মৃতদেহের আশেপাশে মেঝেটা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করতে করতে মিঃ বসাকের সহসা নজর পড়ে এক জায়গায়।

মেঝের উপরে খানিকটা অংশে যেন একটা হলদে ছোপ পড়ে আছে। মনে হয় যেন কিছু তরল জাতীয় রঙিন পদার্থ মেঝেতে পড়েছিল, পরে মুছে নেওয়া হয়েছে।

মেঝেটা দেখতে দেখতে হঠাৎ মিঃ বসাকের দৃষ্টি একটা ব্যাপারে আকর্ষিত হয়। মৃতের পা একেবারে খালি। বিনয়েন্দ্র কি খালিপায়েই গবেষণা করতেন।

রামচরণ একটি পাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিল। তাকে মিঃ বসাক প্রশ্ন করলেন, রামচরণ, তোমার বাবু কোন স্যাণ্ডেল বা স্লিপার ব্যবহার করতেন না বাড়িতে?

হ্যাঁ, বাবুর পায়ে সর্বদা একটা সাদা রবারের স্লিপার তো থাকত।

কিন্তু তাহলে গেল কোথায় স্লিপার জোড়া?

সমস্ত ঘর তন্ন তন্ন করে ও পাশের শয়নঘরটি অনুসন্ধান করেও বিনয়েন্দ্রর নিত্যব্যবহৃত, রামচরণ-কথিত সাদা রবারের স্লিপার জোড়ার কোন পাত্তাই পাওয়া গেল না।

রামচরণ বিস্মিত কণ্ঠে বললে, আশ্চর্য! গেল কোথায় বাবুর স্লিপার জোড়া? বাবু তো এক মুহূর্তের জন্যও কখনও খালিপায়ে থাকতেন না।

সত্যি মৃত বিনয়েন্দ্রর পায়ের পাতা দেখে সেটা বুঝতে কষ্ট হয় না।

তবে স্লিপার জোড়া দেখা গেল না। এবং বাথরুম থেকে বের হয়ে আসবার মুখে আর একটি ব্যাপারে মিঃ বসাকের দৃষ্টি পড়ল, গবেষণাগারের একটি জলের সিঙ্ক।

সিঙ্কের কলটি খোলা। কলের ভোলা মুখ দিয়ে জল ঝরে চলেছে তখনও। এবং সেই জল সিঙ্কের নির্গম পাইপ দিয়ে বাইরে চলে যাচ্ছে।

ভাঙা টাইমপিস, ভোলা কল ও অপহৃত নিত্যব্যবহার্য স্লিপার, ঘরের দুটি দ্বারই খোলা এবং মেঝেতে কিসের একটা দাগ; এ ভিন্ন অন্য কোন কিছু দৃষ্টি আকর্ষণ করবার মত মিঃ বসাকের মনে লাগল না।

মনের মধ্যে কেবলই ঐ তিনটি ব্যাপার চক্রাকারে আবর্ত রচনা করে ফিরতে লাগল মিঃ বসাকের।

ঘড়িটা ভাঙল কি করে?

স্লিপার জোড়া কোথায় গেল?

সিঙ্কের কলটা ভোলা ছিল কেন?

আর সর্বশেষে মেঝেতে ঐ দাগটা কিসের?

হত্যাকারী সম্ভবত পশ্চাৎ দিক থেকে অতর্কিতে বিনয়েন্দ্রকে আক্রমণ করেছিল। তার সঙ্গে বিনয়েন্দ্রর কোন struggle-এর সুযোগ মেলেনি।

আপাততঃমৃতদেহটা ময়নাঘরে পাঠাবার ব্যবস্থা করে মিঃ বসাক সকলকে নিয়ে নীচে নেমে এলেন।

থানা-অফিসার আবার ঘরে তালা দিয়ে দিলেন।

নীচে এসে ডাঃ বক্সী বিদায় নিয়ে চলে গেলেন।

সমস্ত বাড়িটার চারপাশ থেকে পাহারার ব্যবস্থা করবার জন্য মিঃ বসাক থানা-অফিসারকে নির্দেশ দিলেন।

থানা-অফিসারও তখনকার মত বিদায় নিলেন।

রামচরণের নিকট হতে রজত ও সুজাতার ঠিকানা নিয়ে মিঃ বসাকই জরুরী তার করে দিলেন তাদের, তার পেয়েই চলে আসবার জন্য নির্দেশ দিয়ে।