০৬-১০. জরিবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন

জরিবাবু ক্ষীণ গলায় বললেন, “তাহলে উপায়?”

“কিসের উপায় খুঁজছেন খোলসা করে বলে ফেলুন, উপায় বাতলে দেব। পঞ্চানন্দ থাকতে উপায়ের অভাব কী? আপনার বাবাকেও কত উপায় বাতলে। দিয়েছি। পাগল-ছাগল মানুষ, কখন কী করে বসেন তার ঠিক নেই। মাঝে মাঝে বিপাকে পড়ে যেতেন খুব। একবার তো কী একটা ওষুধ বানিয়ে খেয়ে বসেছিলেন। আমি তাঁর জাদুইঘরের বারান্দায় শুয়ে আছি। নিশুত রাত্রি। হঠাৎ ‘হাউরে মাউরে চেঁচানি শুনে কঁচা ঘুম ভেঙে ধড়মড় করে উঠে বসেছি। তারপর দৃশ্য দেখে চোখ চড়কগাছ। কী দেখলাম জানেন? সামনে ধুতি পাঞ্জাবি পরা একটা লোক।”

জরিবাবু হাঁ করে শুনছিলেন, এবার নিশ্চিন্তে শ্বাস ফেলে বললেন, “লোক! যাক বাবা, আমি ভাবলাম বুঝি……”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “উঁহু, অত নিশ্চিত হবেন না। তোক বলেছি বলেই কি আর লোক। এমন লোক কখনও দেখেছেন যার মুণ্ডু নেই, হাত নেই, পা নেই, চোখ চুল নখ কিছু নেই,তবু লোকটা আছে?”

“আজ্ঞে না।”

“মাঝরাতে আমি উঠে যাকে দেখলাম তারও ওই অবস্থা। তার গলার স্বর শুনছি, ধুতি-পাঞ্জাবি দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু লোকটা গায়েব। কিছুক্ষণ, মশাই, আমার হাতে পায়ে সাড় ছিল না। তারপর গলার স্বর শুনে আর পাঞ্জাবির বুকপকেটের ভেঁড়াটা দেখে বুঝতে পারলাম যে, অদৃশ্য লোকটা আসলে শিবুবাবু, আপনার স্বর্গত পিতামশাই।”

“বলেন কী?”

“যা বলছি স্রেফ শুনে যান। বিশ্বাস না করলেও চলবে। তবে কিনা ঘটনাটা নির্জলা সত্যি। শিবুবাবু তো আমার হাত জাপটে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, “ওরে পঞ্চু, তুই না বাঁচালে আর আমার রক্ষে নেই। সলিউশন এ এন ফর্টি খেয়ে এই দ্যাখ আমার অবস্থা। স্রেফ গায়েব হয়ে গেছি। আয়নায় ছায়া পড়ছে, নিজেকে হারিয়েও ফেলেছি। একটু খুঁজে দে বাবা। ওরে, আমি আছি তো!”

“বটে!”

“তবে আর বলছি কী? আমি ঠাহর করে করে বাবুর মাথাটা খুঁজে হাত বুলিয়ে বললাম, “অত চেঁচামেচি করবেন না। লোক জড়ো হয়ে যাবে। ঠাণ্ডা হয়ে বসুন, আমার মাথায় ফন্দি এসে গেছে। তারপর কী করলাম জানেন?”

“কী করলেন?”

“বলছি, তার আগে বেশ ভাল করে একটা পান খাওয়ান দেখি। কালোয়াতরা শুনেছি গলা সজুত রাখতে পান আর জর্দা খায়। তা আপনার বেশ ভালো জর্দা আছে তো?”

জরিবাবু এবার খানিকটা স্বাভাবিক গলায় বললেন, “আছে।”

“লাগান একখানা জম্পেশ করে।”

জরিবাবুর হাত এখনও কাঁপছে। তবু পেতলের বাটা থেকে এক খিলি সাজা। পান আর জর্দা পঞ্চানন্দকে দিয়ে নিজেও এক খিলি খেলেন। বললেন, “তারপর?”

পঞ্চানন্দ জারিবাবুর পিতলের পিকদানিতে পিক ফেলে কিছুক্ষণ আরামে চোখ বুজে পানটা চিবিয়ে নিমীলিত চোখে বলল, “ফন্দিটা এমন কিছু নয়। ওর চেয়ে ঢের বেশি বুদ্ধি আমাকে খেলাতে হয়। করলাম কি, সেই রাতের মতো শিববাবুকে ঘুম পাড়িয়ে রেখে পরদিন সকালেই বাজারে গিয়ে খানিকটা তেলরং কিনে আনালাম। তারপর শিবুবাবুর হাতে-পায়ে মুখে খুব যত্ন করে রং লাগাতেই ফের আসল মানুষটা ফুটে উঠল। বলতে নেই, আপনার বাবামশাই বেশ কালোই ছিলেন। আমি এক পোচ ফর্সা করে দিলাম। একটা মুশকিল হল, চোখে তো আর রং লাগাতে পারি না। তাই একজোড়া পরকলা পরিয়ে দিতে হল। দিব্যি দেখাত। তাই বলছিলাম, পঞ্চানন্দ থাকতে উপায়ের অভাব?”

জরিবাবু হাঁ করে শুনতে শুনতে জর্দাসুদ্ধ পিক গিলে ফেলে হেঁচকি তুলতে তুলতে বললেন, “বাবাকে রং করলেন?”

“তবে আর বলছি কী? কেন, টেন পাননি আপনারা? শিবুবাবুর গায়ের রংটা ছিল আদতে তেলরং।”

“আর কখনও ওরিজিন্যাল চামড়া ফুটে ওঠেনি?”

“তাই ওঠে? সলিউশন এ এম ফর্টি বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস। তবে উপকারও হত। একবার রহিম শেখ পড়ল একটা মিথ্যে খুনের মামলায়। লোকটা ভাল, সাতচড়ে রা নেই। তবু কপাল খারাপ। এসে শিবুবাবুর হাত জাপটে ধরল;, শিবু, বাঁচাও। তখন শিবুবাবুর অগতির গতি ছিলাম আমি। উনি এসে আমাকে বললেন, “রহিম আমার ছেলেবেলার বন্ধু রে পঞ্চু, একটা উপায় কর। আমি তখন দিলাম সলিউশন এ এম ফর্টি এক চামচ ঠেসে। রহিম শেখ গায়েব হয়ে গেল। দিব্যি খায় দায়, ফুর্তি করে বেড়ায়, পুলিশের নাকের ডগা দিয়েই ঘোরে, পুলিশ রহিম শেখকে খুঁজে খুঁজে ওদিকে নাচার হয়ে পড়ে। সে ভারি মজার ঘটনা। তা এ-রকম আরও কিছু-কিছু লোককে আমরা গায়েব করে দিয়েছিলাম বটে। তাদের মধ্যে কেউ-কেউ এখনও আছে। কখনও অশরীরী গলার আওয়াজ পান না?”

হরিবাবু আঁতকে উঠলেন। তারপর চারপাশটা সন্ধিগ্ধ চোখে একটু দেখে নিয়ে বললেন, “ঠিক মনে পড়ছে না।”

“একটু চেপে মনে করার চেষ্টা করুন। এখনও দু’চারজন ঘোরাফেরা করে। একটু আগে আপনার ঘরে ঢোকার মুখেই কার সঙ্গে যেন একটা ধাক্কা লাগল। ব্যাটাকে ধরতে পারলাম না। আমাকে দেখেই পালিয়ে গেল। তবে আছে তারা।

“ওরে বাবা! ধাক্কাও দেয়?”

পঞ্চানন্দ খুব হাসল। পানের পিক ফেলে বলল,”ধাক্কা তো ভাল জিনিস। ইচ্ছে করলে কত কী করতে পারে। আপনাকে পছন্দ হল না তো গলাটাই রাত্তিরে নামিয়ে দিয়ে গেল, কি তানপুরার তারগুলো ছিঁড়ে তা ফাঁসিয়ে রেখে গেল। কেউ তো আর তাদের ধরতে পারছে না।”

“তাহলে কী হবে?”

“এর জন্য আপনার বাবাই দায়ী। ওষুধটা পরীক্ষা করতে যাকে-তাকে ধরে এনে খাইয়ে দিতেন। লোকগুলো ভাল কি মন্দ তা খুঁজে দেখতেন না। তাই রহিম শেখের মতো লোকও যেমন আছে তেমনি কালুগুণ্ডা, নিতাই-খুনে, জগা চোরেরও অভাব নেই। কখন যে কী করে বসে তারা!”

“ওরে বাবা!”

“তবে আপনি ভয় পাবেন না। পঞ্চানন্দ তো আর ঘোড়ার ঘাস কাটে না। তার কাছেও জরিবুটি আছে। শিবুবাবু আমাকে একটা দোরঙা কাঁচের চশমা দিয়ে গেছেন। পাঁচজনের হাতে দেওয়া বারণ। তবে সেই চশমা চোখে দিলেই আমি অদৃশ্য লোকগুলোকে পরিষ্কার দেখতে পাই। আমি থাকতে চিন্তা নেই।”

“আপনি থাকবেন তো?”

“দেখি ক’দিন থাকতে পারি। হিমালয়ও বড় ডাকছে। দেখি কতদিন মনটাকে বেঁধে রাখতে পারি।”

জরিবাবু পানের বাটাটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আর একটা পান ইচ্ছে করুন।”

করলাম। আহা বেশ পান। সেই কাশীতে থাকতে একবার রাজা ললিতমোহন খাইয়েছিল। বড় মিঠে আর মোলায়েম পাতা।”

“আমি আপনাকে রোজ খাওয়াব।”

পঞ্চানন্দ মাথা নেড়ে বলল, “সে হবে’খন। তা ইদিকে শীতটাও পড়েছে এবার জেঁকে, ইয়ে আপনার বেশ নরম কম্বল-টম্বল নেই। একখানা ধার পেলে হত।”

“হ্যাঁ আছে, নেবেন?”

“ধার হিসেবে। জাদুইঘরের বারান্দাতেই তো শুতে হবে রাতে। ঠাণ্ডা লাগবে।”

জরিবাবু শশব্যস্ত বলেন, “তা কেন, আমার পাশের ঘরখানাই এমনি পড়ে থাকে। আপনি বাবার বন্ধু, থাকবেন সে তো সৌভাগ্য আমাদের। তবে আপনার কথায় মনে পড়ল, কিছুদিন আগে সন্ধেবেলায় পিছনের উঠোনে ঘুরে ঘুরে একটু সুর তৈরি করার সময় হঠাৎ যেন আমার গায়েও কে একটু আলতো করে ধাক্কা মেরেছিল।”

‘অ্যাঁ?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ, তখন মনে হয়েছিল মনের ভুল। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ব্যাপারটা তা নয়। আরও কথা আছে…’

“অ্যাঁ! কী সর্বনাশ!”

“সেদিন সকালে রেওয়াজের সময় কিছুতেই রেখাবটা লাগাতে পারছিলাম। হঠাৎ কানের কাছে কে যেন গলা খেলিয়ে সুরটা ধরিয়ে দিল। তখন মনে হয়েছিল, গলাটা বোধহয় খৈয়াম খয়ের। তা যে নয়, এখন বুঝতে পারছি। আমার বাবা কি কোনও গায়ককে অদৃশ্য করে দিয়েছিলেন?”

পঞ্চানন্দ জর্দাসুদ্ধু পানের পিক গিলে ফেলে হেঁচকি তুলতে লাগল। জবাব দিতে পারল না।

০৭.

হরিবাবুর বড় দুই ছেলের নাম হল ঘড়ি আর আংটি। পোশাকি নাম অবশ্য আছে, সেটা কেবল স্কুলের খাতায়। দুজনেই অতি দুর্দান্ত প্রকৃতির দুষ্টু। সামলাতে সবাই হিমসিম।

ছুটির দিনে আজ দুজনেই গিয়েছিল জেলা স্কুলের সঙ্গে ক্রিকেট ম্যাচ খেলতে। দু’ভাইয়ের আর তেমন কোনও গুণ না থাকলেও তারা খেলাধুলোয় খুব ভালো। তল্লাটে খেলোয়াড় হিসেবে দুজনেরই বেশ নামডাক। হরিবাবু অবশ্য খেলাধুলো পছন্দ করেন না। তিনি কবি মানুষ এবং মনে প্রাণে কবি বলেই বোধহয় এসব স্থল খেলাধুলোকে তাঁর ভারি ছেলেমানুষি বলে মনে হয়। ফুটবলের নাম শুনলে তিনি আঁতকে উঠে বলেন, “বর্বরতা। ফুটবল মানেই হচ্ছে তোণ্ডুতি, ল্যাং মারামারি, ডুসোর্টুসি, বর্বরতা।” ক্রিকেটের কথা শুনলে নাক সিঁটকে বলেন, “কে যেন বলেছে ক্রিকেট হল উইলো কাঠের কবিতা! ছ্যাঃ, সে লোকটা কবিতার। ক-ও বোঝে না। ডাংগুলি, স্রেফ ডাংগুলি, সাহেবরা মান বাঁচাতে নাম দিয়েছে ক্রিকেট।”

বলা বাহুল্য হরিবাবু দৌড়ঝাঁপ লাফালাফিও পছন্দ করেন না। তিনি চান সকলে সব সময়ে শান্তশিষ্ট হয়ে থাকুক। চেঁচামেচি ঝগড়া কাজিয়া না করুক। কথা কম বলুক। আরও বেশি করে ভাবুক। কবিতা ছাড়া অন্য কোনও বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতে ভালবাসেন না। কপালদোষে তার বড় এবং মেজো ছেলে ঘড়ি আর আংটি স্বভাবে হয়েছে বিপরীত। দুটোই দুর্দান্ত বর্বর।

হরিবাবুর বড় ছেলে খুবই ভাল ব্যাটসম্যান। আংটি বোলার। ফুটবলও তারা খুবই ভাল খেলে। দৌড়ঝাপেও কম যায় না। বিনোদবিহারী হাইস্কুল যে জেলার মধ্যে খেলাধুলোর সেরা, তা এই দুজনের জন্যই।

জেলা স্কুলের সঙ্গে বিনোদ হাই-এর রেষারেষি অনেক দিনের। এবছর কলকাতা থেকে তিন-চারটি টাটকা খেলোয়াড় ছেলে এসে ভর্তি হওয়ায় জেলা স্কুলের জেল্লা বেড়ে গেছে। জেলা ক্রিকেট লিগে তারা ইতিমধ্যেই প্রায় সব স্কুলকে গো-হারা হারিয়ে দিয়েছে। আশিস রায় নামে তাদের একজন পাকা ব্যাটসম্যান আছে। দেবর্ষি ভট্টাচার্য দুরন্ত ফাস্ট বোলার, একজন গুগলিবাজও আছে-মদন মালাকার। তিনজনেরই দারুণ নামডাক। কলকাতায় এরা ফার্স্ট ডিভিশনে খেলত।

জেলা স্কুলের ক্যাপটেন আশিস টসে জিতে ব্যাট নিল। বিনোদ হাই-এর ক্যাপটেন ঘড়ি তার দলকে প্যাভিলিয়নের সামনে জড়ো করে বলল, “জেলা স্কুলের প্রধান ভরসা আশিস। সে নামবে ওয়ান ডাউন। ওদের ওপেনার নাড় আর গণেশের মধ্যে গণেশটা গেঁতো, সহজে আউট হবে না। সুতরাং আমরা কনসেনট্রেট করব নাড়র ওপর। তাকে চটপট ফেলে আশিসকে মুখোমুখি এনে ফেললেই আসল লড়াই শুরু হবে। মনে রেখো, আশিসের অফ সাইড স্টোক ভাল নয়। আংটি,তুই অফ স্টাম্পে বা অফ স্টাম্পের বাইরে বল দিবি। জ্যোতি, তুইও অ্যাটাক করবি অফ স্টাম্প। ক্যাচ যেন আজ একটাও মাটি না ছোঁয়।”

বিনোদ হাই-এর লেখাপড়ায় নাম না থাকলেও খেলায় খুব সুনাম। তাই মাঠ ভেঙে পড়েছে লোকে। লিগ চ্যাম্পিয়নশিপের এইটাই চূড়ান্ত খেলা। যে জিতবে, সে-ই চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাবে। কাজেই উত্তেজনা স্বাভাবিক।

প্রবল হাততালির মধ্যে নাড়ু আর গণেশ ব্যাট করতে নামল। গণেশ প্রথম

বোলারের মোকাবিলা করবে। ঘড়ি একটু ভেবে বলটা জ্যোতির হাতে দিয়ে বলল, “প্রথম ওভারটা তুই-ই কর। বেশি জোরে বল করার দরকার নেই। লেংথটা রেখে যাস। গণেশ রান নেবে না, শুধু বাঁচিয়ে যাবে।”

তাই হল। জ্যোতি গুড লেংথে মিডল স্টাম্প লক্ষ্য করে বল দিয়ে গেল। তার তিনটে বল ছিল ইন-সুইঙ্গার। গণেশ দেখে দেখে প্রতিটি বল ব্লক করে গেল।

দ্বিতীয় ওভার বল করতে এল আংটি। তার বলে জোর বেশি, বৈচিত্র্যও বেশি। দু’রকম সুইং আছে তার হাতে, তার ওপর মাঝে-মাঝে অফকাটার বলও দিতে পারে। নাড়ু একটু ছটফটে ব্যাটসম্যান। মারকুট্টা বলে সে দ্রুত রান তুলে দেয়। আবার আউটও হয় চটপট।

আংটি আজ উত্তেজনাবশে প্রথম বলটাই লেংথে ফেলতে পারল না। একটু ওভারপিচ হয়ে গেল। নাড়ু দেড় পা এগিয়ে এসে সেটাকে মাটিতে পড়ার আগেই লং অফ দিয়ে চাবকে বাইরে পাঠাল। চার। প্রবল হাততালি।

দ্বিতীয় বল করতে গিয়ে আংটি বলটা ফেলল গুড লেংথ, তবে লেগ স্টাম্পের বাইরে সোজা বল। নাড় একটা চার মেরে গরম হয়েছিল। বলটাকে ব্যাকফুটে সরে গিয়ে হুক করল। আবার চার।

ঘড়ি এগিয়ে এসে আংটিকে বলল, “লোপরপা বলই দিয়ে যা। এবা শর্ট পিচ, লেগ স্টাম্পের বাইরে। আমি দেবুকে ডিপ ফাইন লেগে রাখছি। ও ক্যাচ ফেলে না।”

আংটি দাদার নির্দেশমতো লেগ স্টাম্পের বাইরে শর্ট পিচ বল দিল। যে কোনও ব্যাটসম্যানের কাছে তার চেয়ে লোভনীয় বল আর নেই। নাড় ব্যাকফুটে সরে গিয়ে বলটাকে স্কোয়ার লেগ দিয়ে বুলেটের গতিতে চালিয়ে দিল। আবার চার এবং ক্যাচ উঠলই না।

আংটির মতো সাঙ্ঘাতিক বোলারের প্রথম তিন বলেই তিনটে চার হওয়ায় মাঠে রীতিমত উত্তেজনা; জেলা স্কুলের সমর্থকদের হাততালি আর উল্লাস। থামতেই চায় না।

চতুর্থ বলটা করার আগে আংটি একটু ভেবে নিল। আবার একটা লোপা। বল দিলে নাড়ু যদি আবার চার মারে, তাহলে ব্যাপারটা বেশ ঘোরালো হয়ে উঠবে তার পক্ষে।

তবু দাদার নিদের্শ সে ফেললও না। ঘড়ি ক্যাপটেন হিসেবে খুবই ভাল। স্কোয়ার লেগে বাউন্ডারির কাছ-বরাবর সে আর-একজন ফিল্ডারকে টেনে এনেছে।

আংটি দৌড় শুরু করল এবং বেশ ধীরগতির শর্ট পিচ বলটা ফেলল আবার লেগ স্টাম্পের বাইরে। বলটা সামান্য উঠল। নাডুকে পায় কে। ব্যাকফুটে সরে গিয়ে সে বলটাকে সপাটে আকাশে তুলল ছয় হাঁকড়াতে।

বলটা ছয় হয়েই মাঠের বাইরে পড়ছিল। কিন্তু স্কোয়ার লেগ-এর ফিল্ডার মোহন বিশাল লম্বা। হাতে পায়ে ভীষণ চটপটে। নাডুর ছয়ের মার যখন সীমানা ঘেঁষে নেমে আসছিল, সে তখন শুধু পা দুখানা মাঠের ভিতরে রেখে লম্বা হাত বাড়িয়ে শূন্যেই বলটা নিঃশব্দে লুফে নিল। মাঠটা হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেল এই ঘটনায়। তারপর তুমুল উল্লাসে ফেটে পড়ল বিনোদ হাই-এর সমর্থকরা।

আশিস যখন এসে গার্ড নিল, তখন তার মুখে কোনও উদ্বেগ নেই। আত্মবিশ্বাসে ঝলমল করছে সে।

ঘড়ি এগিয়ে এসে আংটিকে বলল, “এবার ঠিক করে বল দে। গুড লেংথ অফ স্টাম্পের ওপর।”

আংটি তার স্বভাবসিদ্ধ দৌড় শুরু করল এবং দুর্দান্ত জোরে শরীর ভেঙে বলটা করল। গ্রিপ-এ কোনও ভুল ছিল না। বলটা বাতাস কেটে ইনসুইং হয়ে গুড লেংথে পড়ে অফ স্টাম্পে ছোবল তুলল। এ বল ব্যাটসম্যানকে খেলতেই হয়। ছেড়ে দেওয়া বিপজ্জনক। এল বি ডবলিউ বা বোল্ড হওয়ার সম্ভাবনা।

আশিস বলটাকে সোজা ব্যাটে খেলল।

খেলল, আবার খেললও না। কারণ বলটা ছিল কোনাচে। যতখানি ফ্রন্টফুটে এখোনো দরকার ছিল, আশিস ততটা এগোনোর সময় পায়নি। কারণ সে প্যাভিলিয়নে বসে দেখেছে, আংটি বল ফেলেছে লেগ স্টাম্পের বাইরে। সুতরাং সে-রকমই আশা করেছিল। আচমকা অফ স্টাম্পের বল তাকে কিছুটা অপ্রস্তুত করেছিল বোধহয়।

আটকানোর জন্য বাড়ানো ব্যাটের কানা ছুঁয়ে বলটা স্লিপের দিকে ছিটকে গেল। মাত্র ছ’ইঞ্চি উঁচ হওয়া সেই বলটা একটু নিচু হয়ে ঘড়ি তুলে নিল চিতাবাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে।

মাঠ ফেটে পড়ল উল্লাসে।

এক ওভারে দুই উইকেট পাওয়া আংটি একটু হাসল।

পরের ব্যাটসম্যান রঘু। ঠাণ্ডা মেজাজের ছেলে। অনেকটা গণেশের মতোই। তবে প্রথম কয়েক ওভার সে আনতাবড়ি খেলে, সেট হতে সময় নেয়।

ঘড়ি আংটির কানে কানে বলে গেল,”মিডল স্টাম্পে বল রাখিস। ইয়র্কার গোছের।”

আংটি মাথা নাড়ল। ঠিক আছে।

ওভারের শেষ বলটায় উইকেট পেলে হ্যাঁট্রিক হবে। কিন্তু হ্যাঁট্রিকের চিন্তা মাথায় থাকলে বলটা ঠিকমতো দেওয়া যাবে না। তাই আংটি মনে-মনে দাদুর

ল্যাবরেটরির ভূতটার কথা ভাবতে ভাবতে রান আপ করতে গেল।

হ্যাঁ, তার দাদুর ল্যাবরেটরির ভূতটাকে সে বেশ কয়েকবার দেখেছে। লম্বামতো, জোব্বা পরা। গভীর রাতে ল্যাবরেটরির ধারেকাছে ঘোরাঘুরি করে। দাদু নিজেই নয় তো!

শেষ বল। আংটি দৌড় শুরু করল। তার রান আপ একটু কোনাচে, সে দৌড়য় সহজ সাবলীল মসৃণ গতিতে। ডান হাতটা দোল খায়।

দৌড়ে এসে বলটাকে বাতাসে ছেড়ে দিয়ে পায়ে ব্রেক কষল আংটি। বলটা পড়ল ওভারপিচে। ব্যাটের তলায়। তারপর ইঁদুরের মতো ব্যাট পিচের ভিতরের ছোট্ট ফঁকটুকু দিয়ে গলে গিয়ে মিডল স্টাম্পকে মাটিতে শুইয়ে উইকেট কিপার শম্বুর হাতে গিয়ে জমা হল।

হট্টগোলে কানে তালা লাগবার উপক্রম। বিনোদ হাই-এর কয়েকজন সমর্থক মাঠে ঢুকে আংটিকে কাঁধে নিয়ে খানিক নাচানাচি করে ফিরে গেল। এর পরের ইতিহাস খুবই সংক্ষিপ্ত। আংটি আর জ্যোতির দুমুখো ধারালো আক্রমণে জেলা স্কুল বাষট্টি রানে গুটিয়ে গেল। আংটি কুড়ি রানে সাত উইকেট নিল। দুটি জ্যোতি। একজন রান আউট।

ঘড়ি সাধারণত ওপেন করে না। আজ করল। ইচ্ছে করেই। দেবর্ষির ওভারটা তাকেই খেলতে হবে। মনোবল যদি ভাঙতে হয়, তবে প্রথম ওভারেই। মার পড়লে বোলারের বল ঢিলে হয়ে যায়।

গুনে গুনে পাঁচটা বাউন্ডারি মারল ঘড়ি। লেট কাট, কভার ড্রাইভ, অফ ড্রাইভ, অন ড্রাইভ, আর একটা অফ স্টাম্পের বল অফ-এর দিকে সরে গিয়ে স্কোয়ার লেগ-এ হুক।

মাত্র আট ওভারেই বিনা উইকেটে জয়ের রান তুলে নিল বিনোদ হাই।

০৮.

খেলার শেষে দুই ভাইকে কাঁধে নিয়ে বিনোদ হাই-এর ছেলেরা মাঠে চক্কর দিল। কত লোক যে এসে পিঠ চাপড়াল, ভীম আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরল আর হ্যান্ডশেক করল, তার হিসেব নেই। অভ্যেস না থাকলে এরকম আদরের আতিশয্যে শরীরে ব্যথা হওয়ার কথা। তবে কিনা ঘড়ি আর আংটি খেলার মাঠে এরকম পাইকারি ভালবাসা অনেক পেয়েছে।

বিনোদ হাই-এর গেমস্যার পাঠান সিং। নামটা পাঠানি হলেও আসলে তিনি নিৰ্যস বাঙালি। ছেলেবেলা থেকেই বীরত্বের প্রতি তাঁর তীব্র আকর্ষণ। পাঠানরা যে বীরের জাত, তাও তার জানা ছিল। তাই ম্যাট্রিকের ফর্ম পূরণ করার সময় তিনি নিজের পল্লব নামটা পাল্টে অম্লানবদনে পাঠান করে দিলেন। এর জন্য হেডস্যারের বেত এবং বাপের চটির ঘা সহ্য করতে হয়েছিল বিস্তর। কিন্তু একবার ম্যাট্রিকের ফর্মে যে নাম উঠে যায়, তা নাকি আর পাল্টনো যায় না। পাঠানবাবু খেলা-পাগল মানুষ। নিজেও সব রকম খেলাধুলো করেছেন যৌবন–বয়সে। কোনও খেলাতেই বিশেষ নামডাক হয়নি। তবে গেম-স্যার হিসেবে তিনি চমৎকার। ছেলেদের প্রাণ দিয়ে খেলা শেখান। ঘড়ি আর আংটি তাঁর বিশেষ

হৈ-চৈ একটু থামলে এবং পুরস্কার বিতরণ শেষ হলে পর পাঠানবাবু এসে ঘড়ি আর আংটিকে চুপি-চুপি আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, “তোমাদের ভাগ্য খুবই ভাল। আজ হাতরাশগড়ের মহারাজা নারনারায়ণ রায় মাঠের পাশে তার গাড়িতে বসে আমাদের খেলা দেখেছেন। ভদ্রলোকের নাম শোনা ছিল, আগে কখনও দেখিনি। তবে বিশাল ধনী। ওঁর খুব ইচ্ছে তোমাদের ভাল করে খেলাশেখার সুযোগ করে দেবেন। খরচ সব ওঁর। খেলা শেষ হওয়ার পর ওঁর সেক্রেটারি এসে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়েছিল মহারাজার কাছে।”

দুই ভাই একটু অবাক হয়ে মুখ-তাকাতাকি করতে লাগল।

পাঠানবাবু হেসে বললেন, “কপাল যখন ফেরে, এমনি করেই ফেরে। এখন চলো, মহারাজ তোমাদের জন্য বসে আছেন।”

পাঠানবাবুর পিছু পিছু দুই ভাই গিয়ে দেখে, জামতলায় বিশাল একখানা পুরনো মডেলের গাড়ি দাঁড়ানো। জানালার পর্দা রয়েছে বলে ভিতরে কিছু দেখা যায় না। তবে দরজার কাছেই মহারাজের লম্বা সুড়ঙ্গে চেহারার সেক্রেটারি অপেক্ষা করছিল। কাছে যেতেই খুব সম্ভ্রমের সঙ্গে দরজা খুলে গলা খাঁকারি দিল।

ভিতর থেকে বিশাল চেহারার এক ভ ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। যেমন লম্বা, তেমনি চওড়া। ভুড়ি নেই, চর্বি নেই, বেশ শক্তপোক্ত শরীর। বয়সও বড়জোর ত্রিশ-পঁয়ত্রিশ। পরনে কালো স্যুট। মহারাজের গায়ের রং খুব ফর্সা নয়, তবে চেহারায় বেশ একটা অহংকারী আভিজাত্যের ছাপ আছে। চোখে হালকা রঙের গগলস এবং মোটা গোঁফ থাকায় বেশ সুন্দর দেখাচ্ছিল মহারাজাকে।

মহারাজা হাত বাড়িয়ে দুই ভাইয়ের সঙ্গে যখন হ্যান্ডশেক করলেন, তখনই ঘড়ি আর আংটি বুঝে গেল যে, মহারাজার একটি হাতেই দশটা হাতির জোর। হ্যান্ডশেকের পর দুই ভাই-ই গোপনে বাঁ হাত দিয়ে ডান হাতটা একটু মালিশ করে নিল।

মহারাজ যখন হাসলেন, তখন দেখা গেল তার দাঁতের পাটিও খুব সুন্দর এবং ঝকঝকে। বজ্রগম্ভীর কণ্ঠস্বর। সেই স্বরেই বললেন, “একটা জরুরী কাজে এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। ক্রিকেট খেলা হচ্ছে দেখে গাড়িটা দাঁড় করিয়েছিলাম কিছুক্ষণের জন্য। কিন্তু তোমরা এমন খেলাই দেখালে যে, শেষ অবধি কাজে আর যাওয়াই হল না। যাগকে, আমি ঠিক করে ফেলেছি, তোমাদের দুজনকে কলকাতায় পাঠাব। ভাল কোচের কাছে খেলা শিখবে। ফার্স্ট ডিভিশনে খেলার ব্যবস্থাও হয়ে যাবে। পড়াশুনো এবং হস্টেলে থাকার খরচ আমার এস্টেট থেকে দেওয়া হবে। রাজি?”

আলাদিনের প্রদীপ থেকে জিন বেরিয়ে এলে যেমন হত, দুই-ভাইয়ের এ কথায় সেইরকমই হল। কিছুক্ষণ কথাটথা এলই না মুখে।

পাঠান-স্যার তাড়াতাড়ি বললেন, “হ্যাঁ, হা, খুব রাজি। এত বড় সুযোগ কি আর পাবে।……”

ঘড়ি একটু ঘাড় চুলকে বলল, “বাবাকে একবার জিজ্ঞেস না করে তো কিছু বলা যাবে না”

মহারাজ হাসলেন, বললেন, “ আরে সে তো আমি জানি। তবে আমি যখন ডিসিশন নিই, তখন সেটা কাজে করে তুলতে দেরি আমার সয় না। তোমাদের বাবার কাছে এখনই গিয়ে মত করিয়ে নিচ্ছি। ওঠো, গাড়িতে ওঠো।”

এই বলে মহারাজা গাড়ির ভিতরে ঢুকে গেলেন। সেক্রেটারি দরজাটা ধরে রেখে ঘড়ি আর আংটিকে ইশারা করলে উঠে পড়তে। দুই ভাই একটু ইতস্তত করে উঠে পড়ল। তাদের পিছু পিছু পাঠান-স্যারও উঠতে যাচ্ছিলেন। কিন্তু সেক্রেটারি পট করে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে একটু কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, “সরি স্যার, গাড়িতে আর জায়গা নেই।”

পাঠানবাবু কাঁচুমাচু হয়ে ফিরে গেলেন।

গাড়ির ভিতরে দুই ভাই বাইরের এই ঘটনা কিছু টের পেল না। তবে গাড়ির ভিতরকার ব্যবস্থা দেখে তারা মুগ্ধ। নরম গদি। সামনে পা ছড়ানোর অনেকটা জায়গা। মেঝেয় পুরু কার্পেট পাতা। তা ছাড়া বাইরের কোনও শব্দ আসে না ভিতরে। সামনের সিট আর পিছনের সিটের মাঝখানে একটা কাঁচের পার্টিশন দেওয়া। কেউ কারও কথা শুনতে পায় না।

দুই ভাইয়ের মধ্যে ঘড়ি একটু বেশি বুদ্ধিমান, এবং তার পর্যবেক্ষণও বেশ তীক্ষ্ম। গাড়ি ছাড়ার পরেই তার খেয়াল হল যে পাঠান-স্যার গাড়িতে ওঠেননি। পিছনে তারা তিনজন, এবং সামনে সেই সেক্রেটারি বসে গাড়ি চালাচ্ছে। ঘড়ি আরও লক্ষ্য করল যে মহারাজা, তাদের বাড়ির ঠিকানা জিজ্ঞেস করলেন না। গাড়ি কিন্তু বেশ স্পিডে চলছে।

মহারাজা একদৃষ্ঠে সামনের দিকে চেয়ে ছিলেন। সেইভাবে বসে থেকেই বললেন, “তোমাদের নিশ্চয়ই জানা আছে যে,আজকাল খেলাধুলোর কদর খুব বেশি। ভাল খেলোয়াড়দের ভবিষ্যৎ খুবই উজ্জ্বল। সঙ্গে একটু লেখাপড়া জানা থাকলে তো কথাই নেই।”

ঘড়ি হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, “আপনি নিজেও নিশ্চয়ই খেলাধুলো কিছু করেন।

মহারাজা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “ইচ্ছে তো খুবই ছিল, কিন্তু এস্টেট আর ব্যবসা নিয়ে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে, সময় দিতে পারি না। একসময়ে আমি অ্যামেরিকায় মার্শাল আর্ট শিখতাম। বেসবলও খেলেছি। তবে এখন আর কিছু করি না।”

ঘড়ি খুব সন্তর্পণে আংটিকে একটা চিমটি দিল।

দুই ভাইয়ের মধ্যে বোঝাঁপড়া চমৎকার। চিমটি খেয়ে আংটি চমকাল না বা কোনও প্রশ্ন করল না। কিন্তু হঠাৎ একটু সোজা হয়ে বসল। দাদা তাকে সাবধান হতে বলছে।

গাড়িটা শহর ছাড়িয়ে এসেছে। কিন্তু ঠিক কোন পথে যাচ্ছে তা বোঝা মুশকিল। গাঢ় খয়েরি রঙের পর্দায় জানালাগুলো একদম ঢাকা। সামনের কাঁচ দিয়েও কিছু দেখার উপায় নেই। কারণ, পিছনের সিটের গদি নিচু এবং গভীর। সামনের সিটটা অনেকটা উঁচু বলে উইন্ডস্ক্রিনটাকে আড়াল করে আছে।

ঘড়ি হঠাৎ বলল, “মহারাজ, আমরা কোনদিকে যাচ্ছি?”

“কেন, তোমাদের বাড়িতে।”

“আপনি কি আমাদের বাড়ি চেনেন?”

মহারাজা একটু হাসলেন। তারপর পকেট থেকে একটা রুমাল বের করে নাকটা চাপা দিয়ে বললেন, “আমার সেক্রেটারি চেনে।”

ঘড়ি আংটির পায়ে ছোট্ট একটা লাথি মারল। কিন্তু দুই ভাই এখনও বুঝতে পারছে না ব্যাপারটা কী ঘটছে। একটু প্রস্তুত ও সতর্ক হয়ে বসে থাকা ছাড়া তাদের আর কিছুই করার নেই।

মহারাজা হঠাৎ একটু কাসলেন। তারপর পিছনে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজলেন। নাকটা তেমনই রুমালে চাপা দেওয়া।

হঠাৎ ঘড়ি আর আংটি মৃদু অস্বস্তিকর একটা গন্ধ পেল। ঘড়ি আর আংটির বহুবার হাত-পা ভেঙেছে। কয়েকবার হাসপাতালে হাড় জোড়া দিতে তাদের অজ্ঞান করা হয়েছে। অজ্ঞান করার জন্য ব্যবহৃত গ্যাসের গন্ধ তাদের চেনা। এ গন্ধটা অনেকটা সেইরকম।

ঘড়ি আংটির দিকে চেয়ে চাপা, প্রায় নিঃশব্দ গলায় বলল, “অ্যাকশন।” মারপিট দাঙ্গাবাজিতে দুজনেই সিদ্ধহস্ত। তার ওপর মহারাজা চোখ বুজে আছেন।

আংটি হাতের পাঞ্জাটা শক্ত করে আচমকা তরোয়ালের মত সেটা চালিয়ে দিল মহারাজার গলায়। একই সঙ্গে ঘড়ি আর-একটা ক্যারেটে চপ বসাল মহারাজার মাথার পিছন দিকটায়।

নিঃশব্দে মহারাজা দরজার দিকে ঢলে পড়লেন। মাথাটা কাত হয়ে লটপট করতে লাগল।

মহারাজার সেক্রেটারি কিছু টের পাওয়ার আগেই ঘড়ি তার দিককার দরজাটার হাতল ঘুরিয়ে প্রস্তুত হয়ে রইল। গাড়ির স্পিড একটু কমলেই দরজা খুলে লাফিয়ে পড়বে।

০৯.

আচমকা একটা মোড়ের কাছে গাড়ির স্পিড কমে গেল। সামনে একটা ছৈ ওলা গোরুর গাড়ি রাস্তা জুড়ে চলেছে। এই রকম সুযোগ আর আসবে না।

ঘড়ি দরজাটা ঠেলল। কিন্তু বজ্ৰ-আঁটুনিতে দরজা এঁটে আছে। ঘড়ি হাতলটা ওপরে নীচে দ্রুত ঘুরিয়ে ঠেলা এবং ধাক্কা দিতে লাগল প্রাণপণে। কপালে একটু ঘামও দেখা দিল তার। কিন্তু দরজা যেমনকে তেমন আঁট হয়ে রইল।

হঠাৎ একটা হাই তোলার শব্দে দুই ভাই-ই চমকে উঠে ডান দিকে তাকিয়ে দেখে মহারাজ নরনারায়ণ সকৌতুকে তাদের দিকে চেয়ে আছেন। আর একটা হাই তুলে আড়মোড় ভেঙে বললেন, “দরজাটা লক করা আছে। সহজে খুলবে না, খামোখা চেষ্টা করছ।”

দুই ভাই বেকুব হয়ে অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে থাকে। মহারাজ নরনারায়ণ লম্বা চাওড়া লোক সন্দেহ নেই। কিন্তু দু-দুটো প্রাণঘাতী ক্যারাটে চপ খেয়েও এত স্বাভাবিক থাকা চাট্টিখানি কথা নয়।

ঘড়ি আর আংটির মুখে কথা সরছে না দেখে মহারাজা নিজেই সদয় হয়ে বললেন, “এত ব্যস্ত হওয়ার কিছুই ছিল না। তোমাদের আমার প্রাসাদে নিয়ে গিয়ে একটু আপ্যায়ন করা হবে। তারপর বাড়ি পৌঁছে দেওয়ার কথা ভাবা যাবে। এখন হাত-পা না ছুঁড়ে চুপ করে বসে থাকলেই আমি খুশি হব।”

ঘড়ি আর আংটি পরস্পরের দিকে একটু তাকাল। আংটির রোখ আছে, জেদিও বটে, কিন্তু সে সবসময় তার দাদাকে মেনে চলে। ঘড়ির গুণ হল, সে চট করে কিছু করে না, ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে করে। মহারাজাকে আক্রমণ করাটা হয়ত একটু ভুলই হয়ে থাকবে। ঘড়ি তো জানত না যে, মহারাজ অনেক উঁচুদরের খেলোয়াড়।

বুদ্ধি খেলিয়ে ঘড়ি চট করে স্থির করে ফেলল, আর গা-জোয়ারি দেখিয়ে

লাভ নেই। এখন তালে তাল দিয়ে চলাটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। তাই সে। খুব অমায়িকভাবে একটু হেসে হাত কচলাতে কচলাতে বলল, আমরা ভয় পেয়ে। ওরকম করে ফেলেছি। আপনার বেশি লাগেনি তো?”

রাজা নরনারায়ণ নিজের গলায় একটু হাত বুলিয়ে বললেন, “আংটি আর তুমি যে দুটো মার বসিয়েছ তাতে যে-কোনও লোকের মরে যাওয়ার কথা। তোমরা দুজনেই সাক্ষাৎ-খুনে।”

আংটি মুখোনা থোতা করে বলল, “কিন্তু আপনি তো মরেননি।”

নরনারায়ণ একটু হেসে বললেন, “রূপকথার গল্পে পড়োনি, সেই যে রাক্ষসের প্রাণভোমরা থাকে জলের তলায় একটা স্তম্ভের মধ্যে সোনার কৌটোয়? আমারও হল সেরকম। সোজাসুজি আমাকে মারা অসম্ভব। তবে যদি কোনওদিন আমার প্রাণভোমরটাকে খুঁজে পাও তাহলে পুটুস করে আমাকে মেরে ফেলতে পারবে। কিন্তু কাজটা শক্ত।”

ঘড়ি আর আংটি ফের চোরা চোখে দৃষ্টি বিনিময় করে নিল। ঘড়ি ইঙ্গিতে ভাইকে জানাল, মহারাজার মাথায় গোলমাল আছে।

মহারাজ তাদের দিকে দৃকপাতও করলেন না। পিছনে নরম গদিতে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে বললেন, “আমি ক্লান্ত। বুঝলে? খুব ক্লান্ত। একটু বিশ্রাম নিতে দাও।”

ঘড়ি আর আংটি কাঠ হয়ে বসে রইল।

গাড়ি কোন দিকে যাচ্ছে, কোথায় যাচ্ছে তা তারা বুঝতে পারছে না। তবে এটা বুঝতে পারছে, গাড়ির মধ্যে একটু আগে তারা যে ঘুমপাড়ানি ওষুধের গন্ধ পেয়েছিল সেটা মোটেই ঘুমপাড়ানি ওষুধ নয়। তাদের মত দুর্বল ও অসহায় দুটি ছেলেকে ঘুম পাড়িয়ে গুম করার প্রয়োজনই নরনারায়ণের নেই।

তবে গন্ধটা খুব অদ্ভুত। চুপচাপ বসে থেকে ঘড়ি টের পেল এই গন্ধটা শ্বাসের সঙ্গে যতবার ভিতরে যাচ্ছে ততবারই সে যেন বেশ তরতাজা আর ঝরঝরে হয়ে উঠছে। তবে গন্ধটা কিসের তা সে জানে না।

একটু বাদে গাড়িটা একটা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকল। সামনের উইন্ডস্ক্রিন দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, বিশাল বিশাল গাছ। চারদিকটা অন্ধকার-অন্ধকার। রাস্তাটাও বেশ এবড়ো-খেবড়ো। গাড়িটা লাফাচ্ছে, আঁকুনি খাচ্ছে।

জঙ্গলের ভিতরে প্রায় পনেরো মিনিট চলার পর গাড়ি ধীরে ধীরে গতি কমাল। তারপর দাঁড়িয়ে গেল।

সামনের সিট থেকে ড্রাইভার তড়াক করে নেমে পিছন দিকের দরজা খুলে বংশব্দ ভঙ্গিতে দাঁড়াল।

প্রথমে মহারাজ এবং তাঁর পিছু পিছু ঘড়ি আর আংটি নেমে এল। ওদের ভাবখানা নিপাট বাধ্য ছেলের মতো।

জঙ্গলের মধ্যে একটু ফাঁকা একটা জায়গা। কোথাও কোনও প্রাসাদ দূরে থাক কুঁড়েঘরের চিহ্ন নেই। তবে সামনে বড় বড় কোমরসমান ঘাসজঙ্গলের মধ্যে ভগ্নস্তূপের মতো কিছু একটা দেখা যাচ্ছে বটে।

সন্ধে হয়ে এসেছে। জঙ্গলের মধ্যে বেশ শীত। ঘড়ি আর আংটি শীতের বাতাসে একটু কেঁপে উঠল। খানিকটা শীতে, খানিকটা ভয়ে।

ঘড়ি আড়চোখে চারদিকটা দেখে নিচ্ছিল। যে রাস্তাটা দিয়ে গাড়িটা তাদের এইখানে নিয়ে এসেছে সেটা কাঁচা রাস্তা। রাস্তাটা এখানে এসেই শেষ হয়ে গেছে। চারদিককার জঙ্গল তেমন ঘন নয়। ঘড়ি শুনেছে তাদের বাড়ি থেকে কিছু দূরে হাতরাশের জঙ্গল আছে। একটা ছোট নদীও আছে সেখানে। মাঝে-মাঝে শীতকালে ছেলেরা দল বেঁধে চড়ুইভাতি করতে যায়। কেউ কেউ পাখি শিকার করতেও আসে। এটাই সেই জঙ্গল কি না কে জানে, সে কখনও হারতাশের জঙ্গলে যায়নি।

দেখেশুনে ঘড়ির মনে হল, হঠাৎ যদি তারা দুই ভাই খুব জোরে দৌড়ে জঙ্গলের মধ্যে ঢুকে যায় তা হলে এই নকল রাজা আর তার সুড়ঙ্গে সেক্রেটারির হাত থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব। এদের মতলব যে ভাল নয় তা এতক্ষণে জলের মতো পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে।

মহারাজা গাড়ি থেকে নেমে খুব আলস্যভরে আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর ঘুম-ঘুম চোখে চারদিকে চেয়ে দেখতে লাগলেন। পাশে দাঁড়িয়ে তার সেক্রেটারি গুনগুন করে কী যেন বলছে। একটু দূরে দাঁড়ানো জড়োসড়ো দুই ভাই কিছু বুঝতে পারছে না।

ঘড়ি আংটির দিকে চেয়ে চোখের একটা ইশারা করল। তারপর আড়চোখে মহারাজ আর তার সেক্রেটারিকে দেখে নিল। না,ওঁরা তাদের লক্ষ্য করছেন না।

ঘড়ি আর আংটি একটু হাত-পা ঝেড়েঝুড়ে নিল। বন দৌড়ের আগে ওয়ার্ম আপ করতে হয়, না হলে পেশীতে টান ধরে। তবে বেশিক্ষণ ওয়ার্ম-আপ করার সময় নেই। দু-একটা লাফঝাঁপ দিয়ে একটু ওঠবোস করে নিয়ে দুই ভাই পরস্পরের দিকে চেয়ে চোখে-চোখে কথা বলে নিল।

তারপর জেলার দুই বিখ্যাত স্পোর্টসম্যান হঠাৎ বিদ্যুৎগতিতে দৌড়ে সামনের ঘাস জঙ্গলে গিয়ে পড়ল। জঙ্গলের মধ্যে ছুটবার হাজারো অসুবিধে। কিন্তু প্রাণের দায় বড় দায় এবং ভয় জিনিসটা মানুষকে অনেক অসাধ্য সাধন করায়।

দুই ভাই ঘাস-জঙ্গলটা প্রায় চোখের পলকে পার হয়ে গেল। লাফিয়ে লাফিয়ে এবং বড় বড় পা ফেলে। ধ্বংসস্তূপটা ডানদিকে, সেদিকে তারা গেল না। বাঁ দিক দিয়ে কোনাকুনি দৌড়ে তারা বড় বড় গাছের জঙ্গলে ঢুকে গেল।

ঘড়ি একবার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল রাজা বা সেক্রেটারি কী করছেন। অবাক হয়ে সে দেখল, তাদের দিকে ভূক্ষেপও না করে রাজা আর সেক্রেটারি তখনও কথা বলে যাচ্ছেন।

লোকগুলো কি বোকা? নাকি অতিশয় ধূর্ত? ভাবতে ভাবতে ঘড়ি দৌড়তে থাকে। পাশাপাশি আংটি।

আংটি জিজ্ঞেস করল, “কী হল রে দাদা? কেউ তো পিছু নিল না?”

“তাই তো ভাবছি।”

“লোকটা কি খুব পাজি?”

“মনে তো হয়।”

“তা হলে আমাদের পালাতে দিল কেন?”

“বুঝতে পারছি না।”

“রাজা তো প্রাসাদের কথা বলছিলেন। সেই প্রাসাদই বা কোথায়?”

“কী করে বলব? তবে দৌড়োতে থাক। এখন পালানোটাই বড় কথা।”

“লোকটার হয়তো কুকুর আছে। লেলিয়ে দেবে।”

“বন্দুকও থাকতে পারে। দৌড়ো।”

দুই ভাই নিঃশব্দে দৌড়াতে থাকে। জঙ্গলটা খুব ঘন নয়। কিন্তু অন্ধকার হয়ে আসায় সব কিছু আস্তে-আস্তে অস্পষ্ট হয়ে আসছে। জঙ্গলের মধ্যে কুয়াশাও উঠছে জমাট বেঁধে। কোথায় যাচ্ছে তা তারা বুঝতে পারছে না।

১০.

কেউ তাড়া করছে না দেখে ঘড়ি আর আংটি দৌড়ের গতি কমিয়ে দিল। কুয়াশা এবং গাছগাছালির জন্য জোরে দৌড়নো সম্ভবও নয়। অন্ধকার হয়ে। এসেছে। দুলকি চালে দৌড়াতে দৌড়াতে ঘড়ি বলল, “খুব বেঁচে গেছি। লোকটার গায়ে ভীষণ জোর।” আংটি বলল, “শুধু জোরই নয়, যে-দুটো সাঙ্ঘাতিক ক্যারাটের মার হজম করল, তাতেই বোঝা যায় মারপিটের লাইনের লোক। রাজা-ফাজা কিছু নয়।

বড় বড় গাছ সংখ্যায় কমে আসছে। জঙ্গলটা ফাঁকা হয়ে যাচ্ছে ক্রমে। ঘড়ি সামনের দিকে চেয়ে বলল, “আমরা বড় রাস্তার কাছাকাছি এসে গেছি। মনে হচ্ছে।”

বাস্তবিকই তাই। সামনে একটা বড়-বড় ঘাসের জঙ্গল। তারপরই বড় রাস্তা। সামনে লরি মেরামত হচ্ছে। এক-আধটা সাইকেলও যাচ্ছে আসছে।

লোকজন দেখে দুই-ভাই নিশ্চিন্ত হয়ে রাস্তায় উঠে এল। দু’পাশে তাকিয়ে দেখল, মহারাজার গাড়ির কোনও চিহ্নই নেই। এ জায়গাটা ঘড়ি বা আংটির চেনা জায়গা নয়। এদিকটায় তারা কখনও আসেনি।

হাট সেরে কয়েকজন পেঁয়ো লোক ফিরছিল। ঘড়ি তাদের একজনকে জিজ্ঞেস করল, “এ জায়গাটার নাম কী?”

“হরিহরপুর।”

“আমরা শহরের দিকে যাব। কী ভাবে যাওয়া যায়?”

লোকটা একটু অবাক হয়ে বলল, “তার ভাবনা কী? একটু বাদেই বাস গাড়ি এসে যাবে। চেপে বসলেই শহরে নিয়ে গিয়ে তুলবে। ওই বোধহয় আসছে, এ পাশটায় দাঁড়িয়ে হাত তুলুন।”

ঘড়ি আর আংটি দেখল সত্যিই একটা বাস আসছে। খুবই লজ্রঝড়ে চেহারা। ভিড়ে ভিড়াক্কার। ভিড় দেখে তারা আজ খুশিই হল।

বাসে উঠে দুই ভাই ভিড়ের ভিতর সেঁদিয়ে দাঁড়াল। এতক্ষণে একটু নিশ্চিন্ত লাগছে।

দুতিনটে স্টপ পার হওয়ার পর কিছু লোক হুড়মুড় করে নেমে যেতে বাসটা হঠাৎ বেশ ফাঁকা হয়ে গেল।..

হঠাৎ আংটি চাপা স্বরে বলল, “দাদা, পিছনে দ্যাখ।”

ঘড়ি তাকিয়ে দেখে থ হয়ে গেল। পিছনের সিটে জানালার ধারে একটা সুড়ঙ্গে লম্বা লোক বসে বসে ঢুলছে। বাসের আবছা আলোতেও লোকটার চেহারা ভুল হওয়ার নয়। রাজা নরনারায়ণের সেক্রেটারি।

লোকটা কী করে বাসের মধ্যে এল বুঝতে পারল না ঘড়ি। তবে সে চাপা স্বরে বলল, “মুখ ঘুরিয়ে রাখ। দেখতে পাবে।”

লোকটা অবশ্য দেখল না। বসে-বসে যেমন ঢুলছে তেমনই ঢুলতে লাগল। আড়চোখ চেয়ে ঘড়ি মাঝে-মাঝে দেখছিল, নোকটার ঘাড় লটপট করছে। মাথাটা বাসের ঝাঁকুনিতে মাঝে-মাঝে জোরসে ঠুকে যাচ্ছে জানালায়। তবু কী ঘুম বাবা!

একটুও চোখ মেলল না।

বাস থামছে। লোকজন নামা-ওঠা করছে। সেক্রেটারি নির্বিকার ঘুমোচ্ছ বসে বসে।

আংটি চাপা স্বরে বলল, “দাদা, লোকটা বোধহয় আমাদের দেখতে পেয়েছে। ঘুমের ভান করে নজর রাখছে।”

ঘড়ি তীক্ষ্ম চোখে আর একবার দেখে নিয়ে মাথা নেড়ে বলল, “তাও হতে পারে, তবে সাবধানের মার নেই। মুখটা আড়াল করে থাক।”

একটু বাদে কয়েকজন নেমে যাওয়ার পর দুই ভাই বসবার জায়গা পেয়ে গেল। বসে দুজনেই মাথা নামিয়ে রেখে আড়ে-আড়ে নজর রাখতে লাগল।

আশ্চর্যের বিষয়, সুড়ঙ্গে সেক্রেটারি একবারও চোখ মেলল না বা তাদের দিকে তাকাল না। সেক্রেটারির পাশে বসে লোকটা মাঝে-মাঝে বিরক্ত হয়ে ধমক নিচ্ছিল,”ও মশাই, গায়ের ওপর ওরকম হেলে পড়ছেন কেন? সোজা হয়ে বসুন না।

কিন্তু সেক্রেটারির তাতে ভূক্ষেপ নেই।

পাশে বসা লোকটা পেঁয়ো প্রকৃতির। বেশ জোরে জোরেই গজগজ করে বলতে লাগল, “সেই হরিহরপুর থেকেই এমন কাণ্ড শুরু করেছে যে, অতিষ্ট হয়ে গেলাম! এমন গায়ে-পড়া লোক জন্মে দেখিনি বাবা। কতবার সোজা হয়ে বসতে বলছি, তা ইনি কথাটা কানেই তুলছেন না। চাষার ঘুমকেও হার মানিয়ে দিয়েছেন।”

ঘড়ি আর আংটি সবই শুনল। পরস্পরের দিকে একটু তাকিয়ে নিল দুজনে।

সামনের একটা গঞ্জে বাসটা দাঁড়াতেই পেছনের সিট থেকে সেক্রেটারির পাশে বসা লোটা একটা পুঁটুলি নিয়ে উঠে দাঁড়াল এবং নেমে পড়ল। সেক্রেটারি জানালায় হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে।

অনেকে নেমে যাওয়ায় সেক্রেটারির পাশে আর কেউ বসল না। বাস প্রায় ফাঁকা। আর দুমাইল দূরে শহর।

বাসটা আবার ছাড়তেই হঠাৎ পেছনের সিটে একটা বিকট শব্দ শোনা গেল। সকলে চমকে চেয়ে দেখে, সুড়ঙ্গে সেক্রেটারি মেঝের ওপর পড়ে আছে সটান হয়ে।

হৈহৈ করে ওঠে লোজন, “পড়ে গেছে……অজ্ঞান হয়ে গেছে…..জল…পাখা…।

ঘড়ি আর আংটি খানিকটা থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি অন্য সব লোকজনের সঙ্গে মিলেমিশে এগিয়ে গিয়ে দেখল।

যা দেখল, তাতে তাদের চোখ চড়কগাছ। এরকম ঘটনা তারা স্বপ্নেও কল্পনা করতে পারেনি।

লোকজন প্রচণ্ড চেঁচাতে লাগল, “রক্ত…..রক্ত……উরেব্বাস রে….. খুন……খুন….”

খুন যে তাতে কোনও সন্দেহ নেই। সেক্রেটারি উপুড় হয়ে পড়ে আছে। সমস্ত পিঠটা রক্তে ভাসাভাসি মাখামাখি।

বাস থেমে গেল। লোকজন সব নেমে পড়তে লাগল দুড়দাড় করে। বাইরে চেঁচামেচি শুনে আবার লোকজন জুটেও গেল অনেক।

এই চেঁচামেচি আর বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঘড়ি মাথা ঠাণ্ডা রেখে চটপট যা দেখার দেখে নিল। সেক্রেটারির পরনে সেই নীলচে ধূসর রঙের স্যুটটাই রয়েছে। লোকটার মাথার চুল পাতলা। বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। পায়ে বেশ ঝচকচকে একজোড়া জুতো।

রক্তে-মাখা পিঠটার ঠিক মাঝামাঝি মেরুদণ্ডের ওপর একটা ছ্যাদা লক্ষ্য করল ঘড়ি। বন্দুক বা পিস্তলের গুলিই হবে, ঘড়ি আরও লক্ষ করে, যেখানে সেক্রেটারি বসেছিল ঠিক সেইখানে বাসের পেছন দিককার সিটেও একটা ফুটো। সন্দেহ নেই কেউ পিছন থেকে গুলি চালিয়েছে; সেই গুলি বাস ফুটো করে সেক্রেটারির শরীরে ঢুকে গেছে। সম্ভবত মৃত্যুও হয়েছে তৎক্ষণাৎ। কিন্তু কোণের দিকে ভিড়ের চাপে সেঁটে বসে ছিল বলে এতক্ষণ পড়ে যায়নি।

ঘড়ি চাপা গলায় বলল, “আংটি, চল, কেটে পড়ি। এখানে আর থাকা বিপজ্জনক।”

আংটি মাথা নেড়ে বলে, “সেই ভাল।” দুই ভাই নেমে পড়ল।

এ জায়গাটা তাদের চেনা। বহুবার এসেছে। লালমণিপুর। এখানে মন্টু নামে ঘড়ির এক বন্ধু থাকে; বেশ বড়লোক।

ঘড়ি বলল, “চল, মন্টুর মোটর সাইকেলটা নিয়ে ফিরে যাই।” মন্টুর বাড়ি বেশি দূর নয়। রাস্তার ওপরেই তাদের বিশাল বাগানঘেরা বাড়ি।

মন্টু বাড়িতেই ছিল। তারা যেতেই বেরিয়ে এসে বলল, “আরে! তোদের কী খবর বল তো! আজ এত বড় একটা ম্যাচ জেতার পর কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিলি? সবাই তোদের খোঁজ করে অস্থির। কোন্ রাজা নাকি তোদের নিয়ে গেছে।”

ঘড়ি বেশি ভাঙল না। বলল, “পরে সব বলব। এখন তোর মোটর সাইকেলটা দে। বাড়ি ফিরতে হবে।”