০৬-১০. আদ্রেঁ মারা গেল বেলা বারোটায়

আদ্রেঁ মারা গেল বেলা বারোটায়। লাউঞ্জে তার এগারোজন সঙ্গী, মনোজ, রোজমারি, সোনালি, সুব্রত, শুভ, মৈত্রেয়ী এবং কয়েকজন বিশিষ্ট নাগরিক সময়োচিত গাম্ভীর্য মুখে মেখে দাঁড়িয়েছিল। ঘটনাটা বড় আকস্মিক এবং সকলেই খানিকটা অস্বস্তির মধ্যে রয়েছে।

ডেলিগেটদের প্রধান একজন বয়স্ক কোলকুঁজো মানুষ। পদবি লোম্যান। চোখদুটি নীল এবং চাউনি তীব্র। মনোজ তার কাছাকাছি গিয়ে মৃদু স্বরে বলল, আদ্রেঁর পরিবারকে খবরটা কীভাবে জানানো যায়?

লোম্যান মাথা নেড়ে বলল, আদ্রেঁর পরিবার কেউ নেই। একা মানুষ। কাউকে কিছু জানানোর নেই।

ও।

আমি একটা কথা জানতে চাই। আদ্রেঁর ডেডবডি আমরা নিয়ে যেতে চাইলে সেটা কত তাড়াতাড়ি সম্ভব?

দেরি হওয়ার তো কথা নয়।

যদি আজই নিয়ে যেতে চাই?

বোধহয় ব্যবস্থা করা যাবে।

লোম্যান একটা নিশ্চিন্তের খাস ছেড়ে বলল, যাক, বাঁচা গেল।

আপনারা কি মায়ানমার যাওয়ার প্রোগ্রাম বাদ দিচ্ছেন?

অবশ্যই। আদ্রেঁর মৃতদেহ যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়াই হবে আমার এখন সবচেয়ে জরুরি কাজ।

মনোজ একটু অবাক হয়ে বলে, কেন বলুন তো! আদ্রেঁর তো কেউ নেই বললেন।

লোম্যান তার দিকে মিটমিটে চোখে চেয়ে বলল, কাজ আছে মিস্টার ঘোষ। জরুরি কাজ। আপনি দয়া করে আমাদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করুন। ডেডবডির জন্য ভাল কফিন চাই।

ভাববেন না। সব ব্যবস্থাই হয়ে যাবে।

ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেট কি দিয়েছে?

হ্যাঁ। সুব্রতর কাছে আছে।

মনোজ ডেথ সার্টিফিকেটটা নিয়ে লোম্যানকে দিল। লোম্যান সেটা দেখে পকেটে রেখে দিল। বলল, আপনার সঙ্গে ডিলটা এবার হল না। যা হোক, আমাদের দু’জন প্রতিনিধি আগামী মাসেই আসবে। তারা চুক্তি পাকা করে যাবে।

ধন্যবাদ।

রোজমারি মনোজের কাছাকাছি এসে চাপা গলায় বলল, ডেথ সার্টিফিকেটে কী লিখেছে দেখেছ?

হার্ট অ্যাটাক।

হ্যাঁ। কিন্তু ঘটনাটা কি তাই?

মনোজ একটু অবাক হয়ে বলে, অন্যরকম কেন হবে?

রোজমারি একটু চিন্তিত মুখে বলল, কিছু বিষ আছে যা ধরা যায় না। খুব অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে পরীক্ষা করা হলে হয়তো ধরা পড়বে। সেই ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই।

মনোজ ভীষণ অবাক হয়ে বলে, বিষ! বিষের প্রশ্ন উঠছে কেন? এটা সহজ সরল হার্ট অ্যাটাক। আদ্রেঁর বয়স ষাটের কাছাকাছি।

সেটা হলেই ভাল। কিন্তু আমার কেন যেন ব্যাপারটা অদ্ভুত লাগছে।

অদ্ভুত কেন?

আঁদ্রে সাক্কি ইনকরপোরেটেডের হয়ে কাজ করে।

তাতে কী?

খুবই গুরুত্বপূর্ণ মানুষ। মস্ত বিশেষজ্ঞ। মনোজ, ওরা যদি আরে মৃতদেহ দেশে নিয়ে গিয়ে অটোপসি করে এবং ওর শরীরে কোনও বিষ পাওয়া যায় তা হলে কী হবে?

কী যে বলছ পাগলের মতো। এটা সেরকম কোনও ঘটনাই নয়।

তবু আমার ভয় করছে।

মনোজ রোজমারিকে বাঁ হাতে বেষ্টন করে বলল, কেন বলো তো! তোমার মতো সাহসী মেয়ের ভয় পাওয়ার মতো কী হল?

আমাদের বিরুদ্ধে কোনও ষড়যন্ত্র হচ্ছে না তো?

মনোজ অবাক থেকে আরও অবাক হয়ে বলল, ষড়যন্ত্র! ষড়যন্ত্র করার মতো কী আছে আমাদের? একটা অ্যালয় তৈরি করি, তা সেরকম অ্যালয় আরও কেউ কেউ তৈরি করে। খামোখা আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হবে কেন?

সেটাই তো বুঝতে পারছি না, বুঝতে চাইছি। হঠাৎ এই দত্ত লোকটাই বা কেন প্যারিস থেকে এসে হাজির হল? কেন আদ্রেঁ মারা গেল? কেন আমাকে পাঠানো হল রক্তগোলাপ? প্রশ্ন যে অনেক।

তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুলছ। আমি এমনিতেই নার্ভাস লোক, তোমার ওপর নির্ভর করে চলি। তুমি ভয় পেলে আমার আর ভরসা কীসের?

চলো আমরা ঠান্ডা মাথায় ঘটনাগুলো নিয়ে একটু ভাবি।

 ঠিক আছে, কিন্তু তার আগে আদ্রেঁর ডেডবডি দেশে পাঠানো এবং ডেলিগেটদের ফিরে যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।

ভাববার কিছু নেই। ওরা ফার্স্ট ক্লাসের যাত্রী। ওদের ব্যবস্থা করা কঠিন হবে না। একটা এয়ারলাইন্সে জায়গা না হলে অন্য এয়ারলাইন্সে যেতে পারবে।

তা জানি। কিন্তু ব্যবস্থাটা এখনই চালু করা দরকার।

সুব্রত অত্যন্ত দক্ষ এবং চটপটে ছেলে। ছিপছিপে বেতের মতো চেহারা। একসময়ে ভাল টেনিস খেলত। খুব স্মার্ট আর অনেক যোগাযোগ। পিআরও হিসেবে তাকে মোটা মাইনে দেওয়া হয়। তাকে ডেকে পরিস্থিতিটা বুঝিয়ে দিল মনোজ।

সুব্রত সব শুনল। তারপর বলল, কিছু ভাববেন না স্যার। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

লোম্যান লোকটা খুঁতখুঁতে। একটু দেখো, পরে যেন কথা শুনতে না হয়।

সুব্রত হাসল, না স্যার, কথা শুনতে হবে না।

তা হলে আমরা যাচ্ছি। আমাদের কিছু জরুরি কাজ আছে।

 ঠিক আছে স্যার। এদিকটা আমি সামলাচ্ছি।

***

দ্বিতীয় ফোনটাও করেছিল পল।

মঁসিয়ে, খবরের কাগজে টেলিফোন করে আমাদের সম্পর্কে খোঁজ নেওয়ার কোনও দরকার ছিল কি?

খবরের কাগজে ফোন করেছিলাম কে বলল?

আপনার টেলিফোন যে আমরা ট্যাপ করব তা আন্দাজ করা আপনার উচিত ছিল।

আমার মতো পরিস্থিতিতে পড়লে এ কাজ আপনিও করতেন মসিয়া পল।

ওদের চেয়ে বেশি ইনফর্মেশন আমিই আপনাকে দিতে পারতাম। আমাদের প্যারিস হেড কোয়ার্টার্সের চিফ মঁসিয়ে দাতা এখন প্যারিসের বাইরে। তাকে আপনার প্রয়োজন হলে একটা ফোন নম্বর লিখে নিন। কিন্তু একটা কথা। এই নম্বরটা দয়া করে পুলিশকে দেবেন না। দিলে আপনি বোকা বনবেন। কারণ এটি একটি নিরীহ রেস্তোরাঁর টেলিফোন। পুলিশ এখানে কিছুই খুঁজে পাবে না।

বুঝেছি, নম্বরটা বলুন?

পল বলল, গোপীনাথ টুকে নিল।

এখানে ফোন করে মিশেলের সঙ্গে কথা বলতে চাইবেন। ওরা বলবে, মিশেল বলে এখানে কেউ নেই। তখন আপনি বলবেন, সে কী, আজ যে মিশেলের সঙ্গে আমার নোতরদাম যাওয়ার কথা।

বুঝেছি। এটাই কোড তো?

হ্যাঁ। তবে মঁসিয়ে দাতাকে অকারণে বিরক্ত না করাই ভাল। আপাতত উনি এখানে নেই। আমি ওঁর হয়ে কাজ চালাচ্ছি।

গোপীনাথ একটা খাস ফেলে বলল, তাই বুঝি? আচ্ছা, শুভরাত্রি।

ফোন রেখে গোপীনাথ দ্রুত ভাবতে লাগল। যা করার এখনই করতে হবে। এখনই তাকে একটা সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শত্রুপক্ষ প্রবল এবং সতর্ক।

গোপীনাথ চটপট একটা অ্যাটাচি কেস গুছিয়ে নিল। পোশাক পরল। তারপর মধ্যরাত্রিতেই বেরিয়ে পড়ল পথে। চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সন্দেহজনক কিছুই দেখতে পেল না।

খানিক দুরে হেঁটে গিয়ে সে একটা ট্যাক্সি ধরল। হাজির হল একটা দিনরাতের গ্যারেজে। ক্রেডিট কার্ডের জোরে সে একখানা সেকেন্ড হ্যান্ড সিট্রিয়ে গাড়ি ভাড়া করে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। দূর প্রাচ্যের প্লেন তার প্যারিস থেকে আর ধরা হবে না।

গাড়ির টেলিফোন তুলে সে ডায়াল করল তাদের মূল ল্যাবরেটরি লাইপজিগে। সিকিউরিটির প্রধান মালিককে। মালিক একজন আফগান।

মালিক, ল্যাবরেটরির সিকিউরিটি কেমন?

সব ঠিক আছে।

না, সব ঠিক নেই। সিকিউরিটি বাড়াও। চারদিকে কড়া নজর রাখো। খুব তৎপর থেকো।

ঠিক আছে। কোনও হামলা হবে বস?

হতে পারে।

আমি গা গরম করতে ভালবাসি।

তুমি ভিকিজ মব-এর নাম শুনেছ?

কে শোনেনি? সবাই জানে।

ভিকিজ মব আমাদের পিছনে লেগেছে।

তা হলে দুঃসংবাদ বস। ঈশ্বর আমাদের রক্ষা করুন।

আপাতত ঈশ্বরের চেয়ে তোমার ওপরেই আমার নির্ভরতা বেশি, কিন্তু ঘাবড়ানোর কিছু নেই। ওরা এখনই রেড করবে বলে মনে হয় না। তবু সাবধান থাকা ভাল।

গোপীনাথ গাড়ি চালাতে চালাতে গম্ভীরভাবে ভাবতে লাগল। এই যে সে পালাচ্ছে, সে জানে এটা পণ্ডশ্রম। কিছুতেই সে ভিকিজ মবকে এড়াতে পারবে না। তবু অন্তত কিছুক্ষণের জন্য অনুসরণকারীদের ঝেড়ে ফেলা একান্তই দরকার। রোমে তাদের রিসার্চ সেন্টারে আদ্রেঁর কিছু ডকুমেন্ট আছে। সেটা সরিয়ে ফেলা দরকার।

দ্বিতীয় ফোনটা সে করল রোমে।

বিল্লে, কী খবর?

কী খবর চান?

অস্বাভাবিক কিছু ঘটেনি তো!

না। কেন?

ভাল করে মনিটরটা চেক করো। ল্যাবের সব দিক দেখো। কোথাও কোনও অস্বাভাবিকতা দেখলে আমাকে জানাও। আর, আদ্রেঁর ঘরটা ভাল করে দেখো, দরজা ভাঙার বা খোলার কোনও চেষ্টা হয়েছে কি না।

আদ্রেঁর দরজায় ইলেকট্রনিক লক আছে। কোড ছাড়া খুলবে না। তবু দেখছি।

আমি আবার পনেরো মিনিট পরে ফোন করব।

পনেরো মিনিট বাদে ফের ফোন করল গোপীনাথ। বিল্লে বলল, সব ঠিক আছে।

গোপীনাথ একটা উজ্জ্বল এয়ারপোর্ট টার্মিনালে ঢুকে গাড়ি থামাল। শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে সে অন্তত একটা কদমও এগোতে পেরেছে কি? মাত্র একটি বা দুটি ঘণ্টা সময় তার দরকার। তাকে ভাবনায় ফেলেছে আদ্রেঁর নিজস্ব অফিসঘরের দরজায় ইলেকট্রনিক লক। দরজাটা খোলা দরকার। আদ্রেঁর রিসার্চ পেপার এবং কম্পিউটরের তথ্য তার ভীষণ প্রয়োজন। ওটা হাতছাড়া হলে তাদের এত পরিশ্রম বৃথা যাবে।

দু’বার প্লেন বদল করে রোমে যখন নামল গোপীনাথ তখন বিকেল। সারাক্ষণই নানা অস্বস্তি ও সন্দেহে কেটেছে তার কেউ অনুসরণ করছে কি না, কেউ লক্ষ করছে কি না সারাক্ষণ কেবল এই চিন্তা।

সবচেয়ে কঠিন কাজ তার রোমেই। প্রথম কথা আদ্রেঁর ঘরের ইলেকট্রনিক লক খোলা। কাজটা অসম্ভব যদি না লকের কোড জানা থাকে। আদ্রেঁ কোডটা কোথাও নোট করে রেখেছে এরকম একটা ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে। এবং তা নোট করে রাখার সম্ভাবনা আছে তার ডেবুক এ। ডেবুক যদি আদ্রেঁ সঙ্গে করে নিয়ে না গিয়ে থাকে তা হলে তা আছে। আরে ফ্ল্যাটে আদ্রেঁ একা থাকে, সুতরাং গোপীনাথ বসুকে এখন যে কাজটা করতে হবে তা অতীব আইনবিরুদ্ধ এবং অপরাধমূলক। তাকে তালা ভেঙে ঢুকতে হবে আদ্রেঁর ফ্ল্যাটে, চোরের মতোই।

গোপীনাথ আদ্রেঁর ফ্ল্যাট চেনে, বেশ কয়েকবার এসেছে। আদ্রেঁ একা বলেই বোধহয় মাঝে মাঝে পার্টি দিত। ইতালির বেশ কয়েকজন গণ্যমান্য আর্টিস্টের সঙ্গে তার ছিল প্রগাঢ় বন্ধুত্ব। তারাও এসেছে।

গোপীনাথ দু’বার ট্যাক্সি বদল করে যখন আদ্রেঁর ফ্ল্যাটবাড়ির সামনে পৌঁছোল তখন শহরতলির অভিজাত পাড়াটি নির্জন। রাত আটটা বাজে। সময়টা চৌর্যবৃত্তির পক্ষে প্রশস্ত নয়। কিন্তু গোপীনাথের হাতে আর সময় নেই। যা করার এখনই করতে হবে।

এইসব ফ্ল্যাটবাড়িতে অ্যাপয়েন্টমেন্ট ছাড়া ঢোকা বেশ শক্ত। প্লেক্সি গ্লাসের শক্ত পাল্লা ইলেকট্রনিক সংকেত ছাড়া খোলে না। দরজার বাইরে একটা ইলেকট্রনিক বোর্ড আছে। তাতে বাসিন্দাদের নামের কার্ড লাগানো। পাশে বোতাম। যার সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে তার নামের বোম টিপলে সে ওপর থেকে আর একটা বোতাম টিপে দেয়। একমাত্র তখনই দরজা খোলে। গোপীনাথ দরজাটা থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

প্রায় পনেরো মিনিট বাদে একজন লম্বাচওড়া লোককে দরজার কাছে যেতে দেখে গোপীনাথ দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেল। লোকটা ভিজিটর। একটা বোতাম টিপে অপেক্ষা করতে লাগল। গোপীনাথও একটা বোতামে আঙুল ছোঁয়াল, কিন্তু টিপল না। লোকটা যাতে বুঝতে না পারে যে সে ফাঁকতালে ঢোকার মতলব করছে।

কাঁচের দরজা খুলে যেতেই সে লোকটার পিছু পিছু ঢুকে পড়ল ভিতরে। লোকটা তাকে বিশেষ গ্রাহ্য করল না। একটু মাল খেয়ে আছে, বোঝা যাচ্ছিল। গিয়ে লিফটের কাছে দাঁড়াল।

আদ্রেঁ তিনতলায় থাকে। গোপীনাথ এলিভেটর নিল না। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এল ওপরে। অ্যাটাচি কেসটা খুলে একটা সরু শিকের মতো জিনিস বের করল সে। তারপর দ্রুত হাতে তালাটা খোলার চেষ্টা করতে লাগল। উত্তেজনায় তার কপালে ঘাম ফুটতে লাগল। প্রায় পাঁচ মিনিট ধরে চেষ্টা করল সে। কঠিন দরজা অনড় রইল। যতদুর মনে হচ্ছে আদ্রেঁ কোনও বার্গলার অ্যালার্ম লাগিয়ে যায়নি। তা হলে এতক্ষণে গার্ডরা ছুটে আসত।

লম্বা প্যাসেজ দিয়ে দুটো লোক হেঁটে আসছিল। নিঃশব্দে। গোপীনাথ একটু শক্ত হয়ে গেল। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সে নিজের টাইয়ের নটটা একটু ঠিকঠাক করে নিতে লাগল। যতদূর সম্ভব স্বাভাবিক ভাবভঙ্গি। লোকদুটো যখন তার কাছাকাছি চলে এসেছে তখন গোপীনাথ দুটো হাত মুঠো করে রইল। এরা ভিকির লোক হতে পারে কিংবা নিরীহ সজ্জন।

লোকদুটো দাঁড়াল না। তাকে পেরিয়ে গেল। গিয়ে থামল এলিভেটরের সামনে। এক মিনিট পর তারা লিফটে উঠে যেতেই আবার কাজ শুরু করে দিল গোপীনাথ। বিস্ময়ের কথা, দ্বিতীয়বার প্রায় বিনা ভূমিকায় দরজা খুলে গেল।

ভিতরটা অন্ধকার। দরজাটা বন্ধ করে আলো জ্বালল গোপীনাথ। আদ্রেঁ একা থাকলেও খুব গোছানো লোক। ফ্ল্যাটটা বিশাল বড়। অন্তত তিন হাজার স্কোয়ার ফুট। ঢুকতেই হলঘর। এক ধারে বসবার জায়গা। অন্য ধারে একটা লাইব্রেরির মতো। দুটো মস্ত শোয়ার ঘরের মধ্যে একটা হল আদ্রেঁর কাজের ঘর। অন্তত গোটা পাঁচেক কম্পিউটার সাজানো রয়েছে চারধারে। একটা ল্যাপটপ কম্পিউটারও রয়েছে বাড়তির মধ্যে। একটা ওয়ার্কিং টেবিলে নানা ধরনের মডেল। সবচেয়ে অবাক কাণ্ড দেয়ালে শাগলের একখানা ওরিজিন্যাল পেইন্টিং ঝুলছে। আদ্রেঁ ছবি-পাগল লোক ছিল। বিজ্ঞানী না হলে হত অবশ্যই একজন আর্টিস্ট।

ডেবুকটা বাইরে কোথাও পড়ে নেই। টেবিলের ড্রয়ারগুলো খুলে খুলে দেখল গোপীনাথ। কখনও কাজের জিনিসটা সহজে পাওয়া যায় না।

পাশের শোয়ার ঘরে গিয়ে গোপীনাথ দেখতে পেল, বিশাল রাজকীয় একখানা খাট ও বিছানা। আদ্রেঁ একটু বিলাসবহুল জীবন কাটাতে ভালবাসত। ভালবাসত একা থাকতে। অনেকে সন্দেহ করে আদ্রেঁ হোমোসেক্সয়াল। গোপীনাথ অবশ্য ততটা ভাল করে জানে না। শুনেছে, এই পর্যন্ত। আদ্রেঁ আর যাই হোক, ছিল অসম্ভব কাজপাগলা।

শোয়ার ঘরে খুঁজতে খুঁজতেও হয়রান হল সে৷ কোথায় রাখতে পারে ডে-বুকটা? গোপীনাথ অবশেষে বাথরুমে হানা দিল। বাথরুমটাও রাজকীয়। কোনও আধুনিক গ্যাজেট বাদ নেই।

বাথরুমে থাকার কথা নয়। তবু বাথরুমেই পেয়ে গেল ডায়েরিটা গোপীনাথ। একটা টেনশনমুক্তির দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দেখল, ডে-বুকের প্রথম পৃষ্ঠাতেই তার দরজা খোলার কোডটা লেখা রয়েছে। আদ্রেঁ কোড পালটাত না। তার স্বভাব একটু একবগগা। পরিবর্তন জিনিসটা সে পছন্দ করত না।

ডায়েরিটা অম্লানবদনে অ্যাটাচি কেসে ভরে বাতি নিভিয়ে দরজার সামনে একটু অপেক্ষা করল গোপীনাথ। আদ্রেঁ কি মারা গেছে?

সে ফের বাতি জ্বালাল এবং টেলিফোনের সামনে এসে বসে একটা নম্বর ডায়াল করল।

ও পাশ থেকে একটা পুরুষ গলা বলে উঠল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়।

আমি রোম থেকে বলছি। সুব্রত রায় কি আছেন?

না। উনি অফিসের বাইরে।

আমি একটা ইনফর্মেশন চাই। রিগার্ডিং আদ্রেঁ। ডেলিগেটদের একজন।

 হ্যাঁ, উনি আজ মারা গেছেন সকাল এগারোটায়।

টেলিফোনের ওপরে গোপীনাথের মুঠো শক্ত হয়ে গেল। সে ঠান্ডা গলাতেই বলল, ডেডবডি কি নিয়ে আসা হচ্ছে?

হ্যাঁ। আজ রাতের ফ্লাইটে।

টেলিফোনটা রেখে গোপীনাথ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল।

৭.

দরজাটা খুব সাবধানে চুল পরিমাণ ফাঁক করল গোপীনাথ। নিবিষ্ট চোখে করিডরটা দেখল। ফাঁক দিয়ে শুধু বাঁ দিকের করিডরটাই দেখা যায়। ডান দিকেরটা দেখতে হলে মুন্ডু বের করতে হবে।

কিন্তু ভয় পেলে এবং বেশি সাবধানতা অবলম্বন করতে গেলে মূল্যবান সময়ের অপচয়। ভিকিজ মব-এর চেয়ে এক-দুই কদম এগিয়ে না থাকলে এতদিনের এত পরিশ্রম পণ্ড হবে।

গোপীনাথ দরজাটা ঝড়াক করে খুলে ফেলল। না, ডানধারেও কেউ নেই। যদি থাকেও তবে সে বা তারা নিশ্চয়ই গোপীনাথের সামনে বোকার মতো বুক চিতিয়ে হাজির হবে না। থাকলে তারা আড়ালে বাঘের মাসির মতো ওত পেতে অপেক্ষা করছে। যথাসময়ে ঘাড়ে এসে পড়বে। সুতরাং ভেবে লাভ কী?

গোপীনাথ নামবার সময়েও লিফট নিল না। দু’ধাপ করে সিঁড়ি দ্রুত পায়ে ভেঙে নীচে নামল। তার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। পচিশ-ত্রিশ বছর আগেকার ছোটখাটো তুচ্ছ ঘটনাসমূহও তার হুবহু মনে থাকে। সে কারও নাম একবার শুনলে আর ভোলে না। বিশেষ করে সংখ্যার ব্যাপারে তার স্মৃতি আরও তীক্ষ্ণ। ইলেকট্রনিক সুইচ বোর্ডটার কাছে গিয়ে সে মাত্র দু’সেকেন্ড ভাবল। আদ্রেঁ যে চারটে নম্বর টিপে দরজা খুলত সেটা ফটোগ্রাফের মতো তার চোখের সামনে ভেসে উঠল। সাত দুই তিন চার।

দরজা খুলে বাইরে বেরিয়ে এল গোপীনাথ। হাতে সময় বড্ড কম। দ্রুত পায়ে সে পাড়া ছাড়িয়ে ভিড়ের রাস্তায় চলে এল এবং ট্যাক্সি নিল। সারাদিন তাকে যথেষ্ট দূরত্ব অতিক্রম করতে হয়েছে, উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠা তাড়া করেছে। তবু উত্তেজক পরিস্থিতিতেই সে ভাল থাকে। তার বোধ, বুদ্ধি, রিফ্লেক্স সবই যেন চনমনে হয়ে ওঠে।

ইতালিয়ান আধবুড়ো ট্যাক্সিওয়ালার সঙ্গে দু’-একটা রসিকতাও করল। ল্যাবরেটরিতে পৌঁছে গেল রাত দশটার মধ্যেই।

 সাক্কি ইনকরপোরেটেডের এই ল্যাবরেটরিটি বিশাল। চারদিকে উঁচু ঘের-পাঁচিল তো আছেই, তা ছাড়া আছে নানারকম ইলেকট্রনিক সিকিউরিটি এবং বার্গলার অ্যালার্ম। সশস্ত্র প্রহরী এবং পাহারাদার কুকুর সারা এলাকা সর্বক্ষণ পাহারা দেয়।

ফটকে নিজের আইডি কার্ডটা যন্ত্রে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করতে হল তাকে। ছাড় পেয়ে দ্বিতীয় গাঁট। নিজের গাড়িতে এলে কথা ছিল না। কিন্তু ট্যাক্সি নিয়ে ভিতরে যাচ্ছে বলেই গার্ডরা এসে উকিঝুঁকি দিয়ে ভিতরটা দেখে নিল। আইডি কার্ড দেখল। তারপর বলল, ওকে

স্যার, ইউ মে এন্টার।

ট্যাক্সিটা ছেড়ে দ্রুত পায়ে গোপীনাথ ভিতরে ঢুকল। এসকালেটরে উঠে এল দোতলায়। আদ্রেঁর ঘর দোতলাতেই।

গোপীনাথ বৈদ্যুতিক সংকেতে দরজা খুলল, ঘরে ঢুকল এবং আলো জ্বালল। আদ্রেঁ অত্যন্ত গোছানো মানুষ। তার সবকিছুই খুব নিখুঁত ও পারস্পরিক। আদ্রেঁ যে চেয়ারটায় বসে কাজ করে সেটায় কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল গোপীনাথ, তারপর ধীরে ধীরে কাগজপত্র ঘাঁটতে লাগল। কম্পিউটার চালু করে কিছুক্ষণ দেখল। প্রিন্ট আউট বের করল।

রাত ক্রমে গভীর হচ্ছে। সে অনেকক্ষণ কিছুই খায়নি। খিদে পাচ্ছে এবং দুর্বল লাগছে। কাজ শেষ করে অ্যাটাচি কেসে কাগজপত্র ভরে সে বেরিয়ে এল।

রিসেপশন থেকে ফোন করে একটা ট্যাক্সি আনাল সে। তারপর বেরিয়ে পড়ল। নিজের অ্যাপার্টমেন্টে এসে সে প্রথমেই কালো কফি খেল। তারপর ফ্রিজ খুলে কিছু খাবার বের করে গরম করে গোগ্রাসে খেল।

খাওয়ার পর সে আরও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ কলকাতায় সুব্রতকে ফোন করল।

সুব্রত, গোপীদা বলছি। কী খবর?

গোপীদা, খবর খারাপ। আদ্রেঁ মারা গেছে।

অ্যাজ এক্সপেক্টেড। ডেডবডি?

ওরা আজই নিয়ে যাচ্ছে।

ভাল। অটোপসিটা এখানে হলেই ভাল হয়।

অটোপসি হবে কেন গোপীদা? ডাক্তাররা তো হার্ট অ্যাটাক বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে।

কারণ আছে বলেই হবে। ক্রিমিন্যাল সায়েন্সও অনেক এগিয়ে গেছে, বুঝলি? আর কী খবর?

আপনি কি জানেন যে, ইন্টারপোলের একজন বাঙালি এজেন্ট এসে হাজির হয়েছে?

না তো। কেন?

শুনছি সে নানারকম এনকোয়ারি করছে।

ইন্টারপোলের ইন্টারেস্ট কী?

বউদি আমাকে বলেছেন, ব্যাপারটা আপনাকে জানাতে।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে বলল, সোনালিকে তুই এখনও বউদি বলে ডাকিস নাকি?

আরে না। আমার ঘাড়ে ক’টা মাথা?

কী বলে ডাকিস?

 দিদি। সোনালিদি।

সোনালি হঠাৎ ইনফর্মেশনটা আমাকে দিতে বলল কেন? সে তো আমার নাম শুনতেও পারে না।

বোধহয় সিচুয়েশনটা ঘোরালো বলেই বলেছেন।

 কী বলেছে?

লোকটার নাম সুধাকর দত্ত, ইন্টারপোল এজেন্ট। সাক্কি ইনকরপোরেটেড সম্পর্কে খুব ইন্টারেস্ট।

সাক্কি সম্পর্কে আজকাল সকলেরই ইন্টারেস্ট দেখা যাচ্ছে।

কী ব্যাপার গোপীদা?

তা জানি না। তবে চারদিকে বেশ একটা তৎপরতা শুরু হয়েছে। শোন সুব্রত, লোকটা সম্পর্কে ভাল করে খোঁজ নে। চেহারার বিবরণ এবং আর যা কিছু।

বউদির সঙ্গে লোকটার আলাপ হয়েছে। লম্বা প্রায় ছ’ফুট। বেশ ভাল পেটানো স্বাস্থ্য। গলার স্বর খুবই ভাল। হ্যান্ডসাম। প্যারিসে হেড কোয়ার্টার। এতে হবে?

ওর আইডেন্টিটি কার্ড কি সোনালি দেখেছে?

না বোধহয়। তবে আমাদের অফিসে চেক করা হয়েছে বোধহয়। মিস্টার সেন তো কাঁচা লোক নন।

গোপীনাথ একটু হাসল। বলল, এ যুগটা অত্যন্ত বুদ্ধিমানদের যুগ। বুঝলি? ক্ষুরধার বুদ্ধি ছাড়া এই কম্পিটিটিভ এজ-এ কিছু করা খুব কঠিন। মনোজের সেই বুদ্ধি নেই।

কিন্তু আপনি তো ওঁকে চেনেন না গোপীদা।

না। ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। কিন্তু অনুমান করতে পারি। সিম্পল ডিডাকশন।

মেমসাহেব কিন্তু বুদ্ধিমতী।

রোজমারি সম্পর্কে আমার কোনও রিজার্ভেশন নেই। রোজ সত্যিই বুদ্ধিমতী। কিন্তু ওর একটা অতীত আছে। সেইটেই বিপজ্জনক।

সে কী গোপীদা?

 সময়মতো জানতে পারবি হয়তো। এখন একটা কথা মন দিয়ে শোন।

বলুন গোপীদা।

আমার একটা বিপদ চলছে।

কী বিপদ?

একটা আন্তর্জাতিক ক্রিমিন্যাল গোষ্ঠীকে কেউ আমার পিছনে লেলিয়ে দিয়েছে। এই গোষ্ঠীর নাম ভিকিজ মব।

ও বাবা! এরা তো সাংঘাতিক।

আমার ধারণা আদ্রেঁকে ওরাই মেরেছে।

মেরেছে! ওয়াজ ইট এ মার্ডার?

হ্যাঁ সুব্রত। নিট অ্যান্ড ফুলপ্রুফ।

সর্বনাশ! তা হলে এরা তো আপনাকেও

না সুব্রত। আমাকে এখনই মারবে না। তার কারণ সাক্কি ইনকরপোরেটেডের একটা গুরুতর প্রোজেক্টের আমি কো-অর্ডিনেটের সায়েন্টিস্ট। প্রোগ্রাম চিফও আমি। আমাকে মারলে প্রোজেক্টটা বানচাল হয়ে যাবে ঠিকই, কিন্তু ভিকিজ মব-এর উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে না। ওরা প্রোজেক্টটার ব্লু প্রিন্ট চায়।

বুঝেছি।

সেইজন্যই ওরা আমাকে ভয় দেখাচ্ছে। প্রয়োজন হলে অবশ্য মারতে দেরি করবে না। তবে ভয় হচ্ছে, অ্যাবডাকশনের।

আপনাকে চুরি করবে?

হ্যাঁ, আমার ফটোগ্রাফিক মেমরির কথা ওরা জানে। যদি আমাকে চুরি করতে পারে তা হলে ওদের খানিকটা সুবিধে হবে।

আপনি পালাচ্ছেন না কেন?

গোপীনাথ হেসে বলল, তোর জানা কোনও নিরাপদ জায়গা আছে নাকি? শোন বোকা ছেলে, দুনিয়ার কোথায় আমি মরতে চাই তা ওরা প্রথমেই জানতে চেয়েছিল। অর্থাৎ বুঝিয়ে দিয়েছিল যে পৃথিবীর সব জায়গায় ওদের কুশলী খুনিরা আছে।

তা হলে কী হবে গোপীদা?

আমার কাছে আদ্রেঁর কিছু কাগজপত্র আছে। আমি সেগুলোর কিছু জেরক্স কপি আজ রাতেই করে রাখছি। কিন্তু আমার অ্যাপার্টমেন্ট নিরাপদ নয়। ওরা ইচ্ছে করলে চুরি করতে পারবে। এখন শোন, আমি কাগজগুলোর কয়েকটা ছবি আমার হ্যাসেলব্লাড ক্যামেরায় তুলে রাখছি। ইন কেস আমার যদি কিছু হয় তা হলে তুই একটা ফোন করে সিসি নামে এক মহিলাকে ব্যাপারটা জানিয়ে দিবি।

সিসিকে আপনিই কেন জানাচ্ছেন না?

তার কারণ হল, সিসি সদ্য বিয়ে করে নতুন বরের সঙ্গে সমুদ্রযাত্রায় বেরিয়েছে। এক মাসের ছুটি। আরও পঁচিশ দিন তাকে ধরা যাবে না।

হ্যাসেলব্লাড ক্যামেরাটা কোথায় আছে?

বলছি। আমার অ্যাপার্টমেন্টে একটা ডার্করুম আছে। সেখানেই ক্যামেরাটা মাউন্ট করা আছে। আমি ছবি তুলব কিন্তু ফিল্ম ক্যামেরার মধ্যেই থেকে যাবে। বুঝেছিস।

বুঝেছি গোপীদা। কিন্তু আমার যে আপনার জন্য ভয় করছে।

ভয় করে লাভ কী? এখন সিসির ফোন নম্বরটা টুকে নে।

বলুন।

গোপীনাথ ফোন নম্বরটা বলল। তারপর বলল, আজ ছাড়ছি। অনেক রাত হয়েছে। আমি খুব টায়ার্ড। ঘুমোনোর সময় হচ্ছে না।

গুড নাইট গোপীদা।

গোপীনাথ ফোন রেখে তার শোয়ার ঘরের কাবার্ড খুলে একটা শক্তিশালী পিস্তল বের করে আনল। ফ্লিপটা খুলে দেখে নিল, সব গুলি আছে কি না। সব ঠিকই আছে। অনেক দিন আগে কেনা জিনিসটা গোপীনাথের কোনও কাজেই লাগেনি। হয়তো ভবিষ্যতেও লাগবে না। তবু কাছে থাক, একটা ভরসা তো।

ডার্করুমে ঢুকে সে আদ্রেঁর কাগজপত্রগুলো একটা বোর্ডে পিন দিয়ে সাঁটল। তারপর বিশাল হ্যাসেলব্লাড ক্যামেরায় একটার পর একটা ছবি তুলল। তারপর কপি মেশিনে কয়েকটা করে কপি তুলে নিল। স্টাডিতে ঢুকে কাগজপত্রগুলোকে কয়েকটা বইয়ের মধ্যে ভাঁজ করে ঢুকিয়ে দিল। এসব ছেলেমানুষি ছাড়া কিছু নয়। শত্রুপক্ষ যদি পেশাদার অপরাধী হয়ে থাকে তবে সব জায়গাই নিপুণভাবে খুঁজে দেখবে। ভরসা একটাই, আঁদ্রের কাগজপত্র কিছু কিছু জায়গায় কোডেড।

গোপীনাথ তার বড় অ্যাপার্টমেন্টটা ভাল করে ঘুরে দেখল। তার অনুপস্থিতিতে কেউ ঢোকেনি বা জিনিসপত্র ঘটেনি বলেই আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে।

রাত প্রায় একটা বাজে। গোপীনাথ ঘরের আলো নেভাল এবং জানালার ধারে দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ বাইরের দিকে চেয়ে রইল। নিজের জীবনটাকে তার কখনও অভিশপ্ত বলে মনে হয়। সোনালির সঙ্গে তার বিয়ে হয়েছিল। সম্বন্ধ করা বিয়ে। জাত গোত্র সব দেখেশুনেই তার বিয়ে হয়েছিল। কিন্তু বিয়ের পর থেকেই বউ আর কাজ এই দুইয়ের মধ্যে সমতা রক্ষা করা কঠিন থেকে কঠিনতর হতে লাগল। তখন গোপীনাথ সাক্কিতে ছিল না। অন্য কোম্পানিতে। সারা দুনিয়া দৌড়ঝাপ করে বেড়াতে হত। বাড়ি ফেরার ঠিক ছিল না। দিনের পর দিন সারা রাত গবেষণার কাজে কাটাতে হয়েছে ল্যাবরেটরিতে। সোনালি যদি সেই একাকিত্ব সহ্য করতে না পেরে থাকে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় না।

গোপীনাথ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।

বিছানার দিকেই যাচ্ছিল গোপীনাথ। হঠাৎ ফোন বেজে উঠল।

আমি আপনার বন্ধু পল।

গোপীনাথের শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। তবু সে গলাটা নিরুদ্বেগ রেখে বলল, হ্যাঁ পল, বলুন।

চোস্ত ফরাসিতে পল বলল, আপনার প্যারিস থেকে রোমে আসার গোটা অ্যাডভেঞ্চারটাই আমরা খুব কৌতূহলের সঙ্গে লক্ষ করেছি মঁসিয়ে বোস।

গোপীনাথ একটু কেঁপে গেল। যা ভয় করেছিল তাই। ওরা সারাক্ষণ তাকে মনিটর করেছে।

মঁসিয়ে পল, আমাকে কাজ করে খেতে হয়। আমাকে নিজের কাজেই আসতে হয়েছে।

অবশ্যই মঁসিয়ে। এমনকী নিজের কাজে আপনাকে চুরি এবং বাটপাড়িও করতে হচ্ছে তাও আমরা জানি।

চুরি! বাটপাড়ি। কী যে বলেন মঁসিয়ে পল।

 মঁসিয়ে বোস, আপনি যদি ক্রিমিন্যাল হতেন তা হলে জীবনে উন্নতি করতে পারতেন। আমাদের অভিনন্দন।

অভিনন্দন কেন?

আদ্রেঁর কাগজপত্রগুলো উদ্ধার করে আনার জন্য।

গোপীনাথ নার্ভাস বোধ করছিল। বলল, এরকম ঘটনা ঘটেছে নাকি?

মঁসিয়ে বোস, আপনি বোধহয় ভুলে গিয়েছিলেন যে, আপনাদের ল্যাবরেটরির প্রত্যেকটা ঘরেই ইলেকট্রনিক আই বসানো আছে। প্রত্যেকটা ঘরই সারাক্ষণ মনিটর করা হয়।

গোপীনাথ ঠান্ডা গলায় বলল, জানব না কেন?

আমরা মনিটরে আপনার সব কার্যকলাপই খুব মন দিয়ে দেখেছি।

গোপীনাথ দ্রুত ভাবছিল। তাদের ল্যাবরেটরির সিকিউরিটি অত্যন্ত উচ্চমানের। বাইরের লোক ঢোকা অসম্ভব। তা হলে কি ভিতরেই কিছু পাজি লোক আছে?

গোপীনাথ বলল, আপনারা আমাদের ল্যাবরেটরিতে মনিটরিং রুমে ঢুকেছিলেন কী করে?

আমাদের লোক সর্বত্র আছে, আপনাকে আগেই বলেছি।

গোপীনাথ বলল, ঠিক আছে। এবার কাজের কথাটা বলুন।

প্রিন্ট আউটটা আমাদের চাই।

গোপীনাথ মৃদু স্বরে বলল, আপনি নিশ্চয়ই বোকা নন।

 কেন বলুন তো!

আদ্রেঁর কাগজপত্রের বা কম্পিউটারের প্রিন্ট আউট পেলেই তো আর হবে না। প্রোজেক্টটা বিরাট, জটিল। অনেক সায়েন্টিস্ট কাজ করছে।

আপনি কো-অর্ডিনেটর, আপনি ভালই জানবেন কার কাছে কী আছে।

না মঁসিয়ে পল, আমিও জানি না। এত বড় প্রোজেক্ট যে, একজনের পক্ষে সব জানা বা মনে রাখা সম্ভব নয়। আমরা মাঝে মাঝে মিটিং করে নানা তথ্য বিনিময় করি। প্রত্যেকেই নিজের নিজের ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ। প্রত্যেকেরই কাজের ধরন আলাদা।

আমরা তা জানি মঁসিয়ে বোস। আমাদের সবচেয়ে বেশি জানা দরকার আপনাদের জ্বালানি সম্পর্কে। আপনারা কী জ্বালানি ব্যবহার করছেন মঁসিয়ে বোস?

দুঃখিত পল। আমার তা জানা নেই।

এ ব্যাপারে আদ্রেঁর কিছু অবদান আছে, তাই না?

হয়তো। কিন্তু আদ্রেঁকে খুন করে আপনারা হয়তো বিজ্ঞানের এক মস্ত সম্ভাবনাকেই নষ্ট করে দিলেন।

তাই কি মঁসিয়ে বোস?

তাই তো মনে হচ্ছে।

এই প্রথম পল যেন একটু দ্বিধায় পড়ল। একটু চিন্তা করল। তারপর বলল, হতে পারে আদ্রেঁকে খুন করাটা এক মস্ত ভুল।

গোপীনাথ মৃদুস্বরে বলল, মস্ত, মস্ত, ভীষণ ভুল মঁসিয়ে পল। আপনারা উন্মাদের মতো কাজ করেছেন।

দয়া করে রাগ করবেন না। রেগে লাভ নেই।

গোপীনাথ ঠান্ডা গলায় বলল, রাগ করে লাভ নেই জানি। কিন্তু বোকামি আমার সহ্য হয়। আদ্রেঁকে হত্যা করার মতো বোকা লোককে আপনারা সহ্য করেন কী করে?

পল হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলল, তাকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া হবে, নিশ্চিন্ত থাকুন।

কী শাস্তি?

আমাদের শাস্তি মোটামুটি একটাই। এলিমিনেশন।

গোপীনাথ একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। অন্তত একটা শয়তান তো নিকেশ হবে।

০৮.

সকালটি বেশ মনোরম। চারদিকে ঝলমল করছে রোদ। মনোজের অফিস ঘরেও বাইরের আলোর আভা আসছে। স্বাভাবিক আলো, স্বাভাবিক বাতাস মনোজের খুব প্রিয়। সে একটু প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ। নিজের অফিসঘরে বসে সকালে সে প্রথমেই এক কাপ কালো কফি খায়। খুব শিথিল ভঙ্গিতে বসে। এ সময়টায় সে একা থাকতে ভালবাসে। কফি শেষ করে কাজ শুরু করে।

ব্যাবসায় একটা টেনশন থাকেই। মনোজ টেনশন ভালবাসে না। ব্যাবসা জিনিসটার প্রতি বরাবর তার একটা ভীতি আছে। ব্যাবসা একটা অনিশ্চিত ব্যাপার। সে জার্মানিতে একটা মোটা মাইনের গবেষণাধর্মী চাকরি করত। খুব নিশ্চিন্ত ছিল তখন। বছরে একবার কি দু’বার ইউরোপে বা অন্য কোথাও বেড়াতে যেত। রোজমারির সেই বাঁধা জীবন ভাল লাগছিল না। তাকে টেনে নামাল ব্যাবসায়, প্রোডাকশনে। রোজমারি একটু অ্যাডভেঞ্চারাস টাইপের। তবে ব্যাবসাটা ইউরোপে করলে ভাল হত। নিজের দেশকে চেনে মনোজ, এখানে ব্যাবসা করতে গেলে পদে পদে বাধা। সস্তা শ্রমিক এবং ওভারহেড খরচ কম বলে এবং ভারতবর্ষের প্রতি একটা করুণামিশ্রিত ভালবাসা আছে বলে রোজমারি এদেশেই কারখানা করার গোঁ ধরেছিল। আর করেই ছাড়ল। কাজটা উচিত হয়েছে কি না তা মনোজ এখনও বুঝতে পারছে না। তবে মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি। বিদেশে যাওয়ার পর থেকেই এদেশের প্রতি তার একটা বিরূপতা জন্মেছিল। সেটা এখনও কাটেনি।

কফি শেষ হয়ে গেল। এখন অনেক কাজ। সোনালি এবং সুব্রতকে ডাকা দরকার। আজ কোনও মিটিং বা অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে কি না, অর্ডার এবং প্রোডাকশন সংক্রান্ত খোঁজখবর এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ে তাদের এসময়ে কথা হয়।

মনোজ খানিকক্ষণ বসে রইল। চুপচাপ। ডেলিগেটরা ফিরে গেছে। আদ্রেঁর মৃতদেহ এতদিনে কবরস্থ হয়ে গেছে নিশ্চয়ই। শুধু একটা দাগ থেকে গেল। মুখে একটা তেতো স্বাদ।

মনোজ ইন্টারকম তুলে প্রথমে সুব্রতকে ডাকল।

 গুড মর্নিং স্যার।

মর্নিং সুব্রত।

সুব্রত এমন একটি ছেলে যাকে দেখলেই ভাল লাগে। বেশ বাঙালি ধরনের সুপুরুষ। অনেকটা জমিদারদের মতো অভিজাত চেহারা। আসলে বোধহয় ওরা জমিদারই। এর পদবি রায়চৌধুরী। বয়স আঠাশ-উনত্রিশের মতো হতে পারে। বিজনেস ম্যানেজমেন্টের ডিগ্রি বা ডিপ্লোমা কিছু একটা আছে, যা মনোজ ভাল করে জানে না। এসব স্টাফ নিয়োগ করেছে রোজমারি নিজে দেখেশুনে। কোনও নির্বাচনই খারাপ বলে মনে হচ্ছে না মনোজের।

 সুব্রত বসল। বলল, আজ তেমন গুরুতর কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেই স্যার।

নেই?

না। ফিনান্স সেক্রেটারির সঙ্গে একটা মিটিং ছিল, কিন্তু তিনি জরুরি কাজে দিল্লি গেছেন।

মনোজ মৃদু হেসে বলল, আমি যে মিটিং অপছন্দ করি সেটা তুমি টের পেয়ে গেছ, না?

হ্যাঁ স্যার। মিটিংগুলো একটু বোরিং…

মনোজ একটু চুপ করে থেকে বলল, খুব বোরিং।

আপনি আজ রিল্যাক্স করুন স্যার।

আচমকা মনোজ জিজ্ঞেস করল, পুলিশের সঙ্গে তোমার জানাশুনো কেমন সুব্রত? নো এনি বিগ গাই?

না স্যার। আমার চেয়ে আপনি বেশি চেনেন। কিন্তু কেন?

মনোজ মাথা নেড়ে বলে, সেভাবে চিনি না। জাস্ট সোশ্যাল মেলামেশা একটু-আধটু। কারণটা হচ্ছে রোজমারিকে কেউ একজন সেদিন লাল গোলাপ পাঠিয়ে একটু রসিকতা করেছে। লাঞ্চ টেবিলেও লাল গোলাপ ছিল, যদিও ইনস্ট্রাকশন ছিল অন্যরকম। আর আই পোলক নামে একজন লোক নাকি কাণ্ডটা ঘটিয়েছে।

শুনেছি স্যার।

আমি গুরুত্ব দিচ্ছি না। কিন্তু রোজমারির টেনশন হচ্ছে। আমি লোকাল থানায় একটা রিপোর্ট করেছিলাম। ওরা ব্যাপারটাকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। ভাবছি একটা পুলিশ ইনভেস্টিগেশন হলে কেমন হয়।

সুব্রত সামান্য গম্ভীর হয়ে বলল, আপনি কথাটা বলার আগেই আমি নিজে সামান্য এনকোয়ারি করেছি। ফুলওলার বক্তব্য হল, লোকটা ইনস্ট্রাকশন দিয়েছে টেলিফোনে এবং ইংরেজিতে। পেমেন্টের টাকাটা খামে পুরে আগের দিন ওদের লেটার বক্সে রেখে যায়।

তা হলে তো চিন্তার কথা সুব্রত।

সুব্রত মাথা নেড়ে বলে, চিন্তার কিছু নেই স্যার। বোধহয় ওঁর কোনও বন্ধু বা বান্ধবীই কাজটা করেছে। এখানে তো ওঁর অনেক বন্ধু।

মনোজ একটু অসহায় গলায় বলে, তা হলে তো ভালই। রোজি সাহসী মহিলা, সহজে ঘাবড়ায় না। কিন্তু এই ঘটনার পর থেকে একটু নার্ভাস।

পুলিশ যাতে ব্যাপারটা একটু এনকোয়ারি করে তা আমি দেখব স্যার।

দেখো। এবার সোনালিকে ডাকা যাক। লেট আস স্টার্ট আওয়ার মর্নিং সেশন।

সোনালি এল। রোজকার মতোই গম্ভীর মুখ, হাতে ফাইল। প্রথমে কয়েকটা চিঠিপত্রে সই করিয়ে নিল। তারপর বসল।

মনোজ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সোনালিকে বলল, সেই সুধাকর দত্ত লোকটার কী খবর মিস সোম?

কোনও খবর পাইনি তো?

লোকটা কি এখনও এদেশে আছে?

তাও জানি না।

লোকটা একটু অদ্ভুত টাইপের না?

সোনালি মৃদু স্বরে বলল, হ্যাঁ।

কী মনে হল আপনার সেদিন? আপনি তো ওকে কারখানা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন?

লোকটার সঙ্গে কিছু গ্যাজেটস ছিল। ওয়াকি টকি ধরনের।

আর কিছু?

একটু বেশি জানতে চাইছিল। শচি ইনকরপোরেটেড সম্পর্কে কৌতূহলটাই বেশি।

শচি? ওর আসল নাম সাক্কি৷ কী জানতে চায়?

আমরা সাক্কির সঙ্গে ব্যাবসা করি কি না।

সাক্কি আমাদের স্টেডি ক্লায়েন্ট।

সেটা আমি ওঁকে বলিনি। লোকটাকে আমার ভাল লাগেনি বলেই বলিনি।

বললেও ক্ষতি ছিল না। সাক্কি এক্সপ্লোসিভ নিয়ে কাজ করত। ইদানীং সলিড ফুয়েল নিয়ে করছে। গোপন করার কিছু নেই। কিন্তু লোকটা ইন্টারেস্টেড কেন তা বোঝা যাচ্ছে না। সুব্রত, কিছু আন্দাজ করতে পারো?

না স্যার।

আমিও পারছি না। ইন ফ্যাক্ট, আমরা যে অ্যালয়টা তৈরি করি তা বিজ্ঞানের অনেক সম্ভাবনা খুলে দিচ্ছে। শুনেছি, এই এলিমেন্টটা নানা কাজে লাগে। কতরকম কাজে লাগে তা আমিও জানি না।

সুব্রত একটু দ্বিধা করে হঠাৎ বলল, আদ্রেঁ ছিলেন সাক্কির ফুয়েল এক্সপার্ট।

মনোজ মাথা নেড়ে বলল, ওদের কে যে কী তা আমি জানিনা। রোজি জানে হয়তো। তবে হাই পাওয়ার ডেলিগেশন। আদ্রেঁর মৃত্যুটা খুব আকস্মিক। ভেরি ডিস্টার্বিং। ডেলিগেটদের লিডার রীতিমতো ক্ষুব্ধ কিন্তু আমাদের তো দোষ নেই। হার্ট অ্যাটাকের জন্য তো আমরা দায়ী হতে পারি না।

সুব্রত মৃদুস্বরে বলল, ওদের সন্দেহ, আদ্রেঁ পয়জনিং-এ মারা গেছে।

মনোজ অবাক হয়ে বলে পয়জনিং! কিন্তু সেরকম হলে ডাক্তাররা ডেথ সার্টিফিকেট দিত না।

পয়জনিং নানারকমের হয় স্যার। অনেক সময়ে ধরা যায় না। তাই ওঁরা ডেডবডি নিয়ে গেছেন দেশে গিয়ে অটোপসি করাবেন।

অটোপসি! মাই গড!

সুব্রত অপ্রস্তুত হয়ে বলল, ওদের কথাবার্তা শুনে তাই মনে হল।

কিন্তু পয়জনিংই বা হবে কেন? কী কারণে?

 বলা মুশকিল স্যার।

মনোজ খানিকক্ষণ ঝিম মেরে বসে রইল। তারপর বলল, তুমি আমার দুশ্চিন্তাটা বাড়িয়ে দিলে সুব্রত।

আমাদের দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। ওদের ব্যাপার ওরা বুঝুক। আমাদের কী?

ফুড পয়জনিং মনে করছে কি?

না স্যার। ওদের সন্দেহ এটা খুন।

সর্বনাশ, এ তো ভয়ংকর কথা!

আপনি রিল্যাক্স করুন স্যার। আমার মনে হয় ওঁরা একটু বাড়াবাড়ি করছেন। এটা আসলে হয়তো নরম্যাল ডেথ।

মনোজ সোনালির দিকে চেয়ে বলল, কফি খাবেন?

না।

কাইন্ডলি আমার আর সুব্রতর জন্য দুটো কফির কথা বলে দিন।

সোনালি উঠে গিয়ে বেয়ারাকে কফির কথা বলে এল।

মনোজ খানিকক্ষণ চুপচাপ বসে ঘটনাবলিকে সাজানোর চেষ্টা করল মনে মনে। পারল না। মানসিক শৃঙ্খলা বলতে তার এখন কিছু নেই।

কফি এল। দু’জনে নিঃশব্দে কফি শেষ করার পর মনোজ বলল, তা হলে আজ আমার কিছু করার নেই?

সুব্রত বলল, না স্যার।

আমি তা হলে ল্যাবরেটরিতে গিয়ে কিছু কাজ করি। অনেকদিন রিসার্চ ওয়ার্ক কিছু করা হয়নি।

সুব্রত গলা খাঁকারি দিয়ে খুব সতর্ক গলায় বলল, স্যার, একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?

কী কথা সুব্রত?

এখানে যে অ্যালয় তৈরি হয় সেটা কি খুব রেয়ার অ্যান্ড এক্সক্লসিভ?

মনোজের ভ্রু একটু কুঁচকে গেল। তারপর একটু ভেবে সে বলল, বিজ্ঞানে নিত্য নতুন জিনিস তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে বিস্তর বাই প্রোডাক্টও আছে। অনেক সময়ে দেখা যায়, কোনও একটা বাই প্রোডাক্ট মূল জিনিসটার চেয়েও ইম্পর্ট্যান্ট হয়ে উঠেছে। আমরা যে অ্যালয়টা তৈরি করি তার প্রসেসটা কমপ্লিকেটেড। একজন জার্মান বৈজ্ঞানিক এটা প্রথম তৈরি করেন। তখনও এটার ইউটিলিটি সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, অনেক সফিস্টিকেটেড ইন্ডাস্ট্রিতে এটার ডিম্যান্ড হয়েছে। এক্সকুসিভ বলা যাবে না, কারণ পৃথিবীতে এই অ্যালয় আরও কোথাও কোথাও তৈরি হয়। তবে বেশি নেই, একথা ঠিক। ইস্টার্ন জোনে আমরাই শুধু তৈরি করছি। কিন্তু একথা কেন জিজ্ঞেস করলে?

এমনিই। জাস্ট কৌতূহল।

মনোজ একটু ভেবে খুব চিন্তিতভাবে বলল, এমন হতে পারে যে, আমরা যা ভেবে জিনিসটা তৈরি করছি অন্য কেউ সেটা সেভাবে ব্যবহার করছে না। এমন হওয়া অসম্ভব নয় যে এ জিনিসটার এমন কিছু প্রপার্টি বা ইউসেজ আছে যা আমরা জানি না।

সেটা কীরকম স্যার? আপনি নিজেও তো সায়েন্টিস্ট আপনি কেন জানবেন না?

 মনোজ ম্লান হেসে বলল, আমি সায়েন্টিস্ট ঠিকই, কিন্তু উর্বর মস্তিষ্কের মানুষের অভাব তো নেই। এই অ্যালয় হয়তো অন্য কোনও ম্যাটারের সঙ্গে রি-অ্যাক্ট করে, তার হয়তো জটিল প্রক্রিয়া আছে। সব কি আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব?

আপনি কি মনে করেন অ্যালয়টা বিপজ্জনক?

না সুব্রত, অ্যাপরেন্টলি বিপজ্জনক নয়। কিন্তু জিনিসটা নতুন, এখনও এর সব প্রপার্টি নিয়ে গবেষণা হয়নি। আমাদের ল্যাবরেটরিতে তো সবসময়েই জিনিসটা নিয়ে রিসার্চ হচ্ছে।

আমি টেকনিক্যাল লোক নই স্যার, বিজ্ঞানের কিছুই জানি না। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই অ্যালয়টা কারও কারও কাছে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস।

হতে পারে। তুমি কি বলতে চাও রোজমারিকে সেইজন্যই ভয় দেখানো হচ্ছে?

তা জানি না স্যার।

মনোজ চিন্তিত মুখে চেয়ে থেকে বলল, কারখানাটা অনেকে বহু টাকায় কিনতেও চাইছে।

হ্যাঁ স্যার, জানি।

 মনোজ অসহায়ভাবে হাত উলটে বলল, কিছুই বুঝতে পারছি না। দেয়ার মাস্ট বি এ প্যাটার্ন সামহোয়ার। আদ্রেঁকে যদি খুন করা হয়ে থাকে তা হলে বুঝতে হবে আমাদের খুব নিশ্চিন্ত থাকা চলবে না। তুমি আমাকে ভাবিয়ে তুললে।

সোনালি মাথা নিচু করে বসে ছিল। একটিও কথা বলেনি। তার দিকে চেয়ে মনোজ বলল, মিস সোম, আজকের দিনটা আমি ল্যাব-এ কাটাতে চাই। রোজমারি আজ একটা অনাথ আশ্রমে গেছে। আপনারা এদিকটা একটু ম্যানেজ করবেন। আই মাস্ট নট বি ডিস্টার্বড।

সোনালি উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ঠিক আছে।

চিন্তিত মনোজ উঠে পড়ল। মিটিং শেষ।

সোনালি নিজের ছোট ঘরখানায় এসে তার কাজকর্ম নিয়ে ব্যস্ত রইল কিছুক্ষণ। তারপরই ফোন এল।

সোনালিদি।

বলুন।

বস কি একটু ভয় পেয়েছেন?

হ্যাঁ সুব্রতবাবু, ওভাবে বলাটা আপনার ঠিক হয়নি।

একটু অ্যালার্ট করার দরকার ছিল। এতে উনি সতর্ক হবেন। ওঁর এখন সত্যিই বিপদ।

কীসের বিপদ?

আপনি ভিকিজ মব-এর নাম শুনেছেন?

শুনব না কেন?

ভিকিজ মব ফিন্ডে নেমে পড়েছে।

তার মানে?

মানে বিপদ।

কিছু বুঝতে পারছি না।

আমিও কি ছাই পারছি। তবে আপনি যার নাম শুনলেই চটে যান সেই ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার মাঝে মাঝে টেলিফোনে কথা হচ্ছে, উনিই খবরটা দিয়েছেন।

খবরটা কী?

সেটা আপনার জানার দরকার নেই। তবে গোপীদাও এখন বেশ ঝামেলার মধ্যে আছেন।

তাতে আমাদের কী?

একটু আমাদেরও ব্যাপার আছে। যতদূর মনে হচ্ছে এই অ্যালয়টা নিয়েই গণ্ডগোল।

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, আমাদের কি কিছু করার আছে?

না। কিন্তু চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখা ভাল।

ঠিক আছে।

আর একটা কথা।

কী?

 মিস্টার সুধাকর দত্ত ইন্টারপোল এখনও কলকাতাতেই আছে।

তাই বুঝি?

হ্যাঁ। আমি তাকে দেখতেও পাচ্ছি। এইমাত্র আমাদের রিসেপশনে ঢুকল এসে।

৯.

রিসেপশন থেকে যে টেলিফোনটা আশা করেছিল সোনালি সেটা এল বটে, কিন্তু এল আরও দশ মিনিট পর।

মিস সোম, আপনার সঙ্গে মিস্টার সুধাকর দত্ত দেখা করতে চান।

 সোনালি ভেবে পেল না, দশ মিনিট দেরি হল কেন এবং সুধাকর তার কাছে কী চায়। সে শুধু বলল পাঁচ মিনিট পরে পাঠিয়ে দিন।

পাঁচ মিনিট সময়টা দরকার। এই পাঁচ মিনিট তাকে মন ও চিন্তাভাবনাকে গুছিয়ে নিতে হবে। লোকটা তাকে প্রশ্ন করবেই। কিন্তু জেরা করার মতো করে নয়। খুব প্রাসঙ্গিকভাবে এবং সারল্যের সঙ্গে। অনেকটা বাচ্চা ছেলেদের মতো ‘এটা কী, ওটা কী’ গোছের হঠকারী প্রশ্নই। কিন্তু ওগুলোই হল বেশি বিপজ্জনক। ছদ্ম মোড়কে ঢাকা ওইসব প্রশ্নই মানুষের সতর্কতাকে ভন্ডুল করে দেয়। সুধাকরের এখন অনেক কিছু জানা বাকি। কিন্তু সোনালি তাকে সবকিছু বলতে চায় না। তাই কী বলবে এবং কী বলবে না তা এখনই ঠিক করে নেওয়া দরকার।

সোনালি চেয়ারে মেরুদণ্ড সোজা করে বসে ধ্যানস্থ হল। এই ধ্যানের প্রক্রিয়া তার খুব প্রিয়। এতে মনের শক্তি বাড়ে, ইচ্ছাশক্তিরও বৃদ্ধি ঘটে।

পাঁচ মিনিট পর দরজায় মৃদু ও ভদ্র করাঘাত। সোনালি তার কম্পিউটার মনিটরের ওপর চোখ রেখে ব্যস্ততার ভাবটি শরীরে ফুটিয়ে রেখে সামান্য অধৈর্যের গলায় বলল, কাম ইন।

সুধাকরের চেহারাটা সত্যিই অ্যাথলিটদের মতো। একখানা আড়া মাল্টি কালার স্ট্রাইপের টি-শার্ট পরে আছে বলে শরীরের ছমছমে ভাবটা বেশ ফুটে উঠেছে। হয়তো স্পোর্টসম্যান ছিল।

সুধাকর তার ঝকঝকে দাঁত দেখিয়ে একটু হেসে বলল, জ্বালাতে এলাম। আপনি বোধহয় খুব ব্যস্ত।

সোনালি একটু ক্লান্তির অভিনয় করে বলল, না, ঠিক আছে। আপনি বসুন।

টেবিলের ওধারে মুখোমুখি বসল সুধাকর। একটু চিন্তিত, একটু গম্ভীরও। আগের দিন বেশ বাচাল ছিল।

মিস সোম, আপনার পক্ষে কি একটা কাজ করা সম্ভব?

সোনালি উদ্বিগ্ন হয়ে বলল, কী কাজ?

আমাকে এক কাপ কফি খাওয়ানো কি আপনার পক্ষে কঠিন হবে?

সোনালি তার ইচ্ছের বিরুদ্ধেই একটু হেসে বলল, না, কঠিন আর কী।

বেল বাজিয়ে বেয়ারাকে কফির কথা বলে দিয়ে সোনালি বলল, এবার দরকারের কথাটা বলুন।

সুধাকর যেন একটু অবাক হয়ে বলল, দরকার? না, দরকার কিছুই নেই। জাস্ট প্যারিসে ফিরে যাওয়ার আগে একবার দেখা করে যাওয়া।

প্যারিসে ফিরে যাওয়ার আগে তার সঙ্গে দেখা করার কী দরকার তা বুঝল না সোনালি। বলল, ও।

বাই দি বাই, গোপীনাথবাবুকে আপনার কোনও মেসেজ দেওয়ার আছে কি? থাকলে আমাকে দিতে পারেন। বা যে-কোনও জিনিস। অনেকে তো এখান থেকে আমসত্ত্ব, পাটালি গুড় আর বাংলা বই পাঠায়, তাও দিতে পারেন।

 সোনালির মুখখানা কঠিন হয়ে গেল। নিরাসক্ত গলায় বলল, আপনি ভুলে গেছেন যে, ওঁর সঙ্গে আমার আর সম্পর্ক নেই। তিনি কোথায় আছেন তাও জানি না।

সুধাকর জিব কেটে বলল, তাই তো, ইস ছি ছি, বড্ড ভুল হয়ে গেছে। ডিভোর্সের কথাটা আমার খেয়াল ছিল না।

অভিনয়টা চমৎকার করল সুধাকর। কিন্তু সেটা অভিনয় বলে বুঝে নিতে সোনালির কষ্ট হল না। সে মনিটরটার দিকে চেয়ে অকারণেই একটা পুরনো প্রোগ্রাম রিকল করল।

সুধাকর খুবই লজ্জিতভাবে একটা স্বগতোক্তি করল, অবশ্য উনি বোধহয় এখন প্যারিসে নেইও। আছেন রোমে, ওঁর হেড কোয়ার্টাসে।

যেখানেই থাকুন আমার কিছু যায়-আসে না।

সে তো বটেই।

বলে সুধাকর খুব চিন্তিত মুখে বসে রইল।

আর কিছু বলবেন?

না, না, আপনি কাজ করুন। আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করছি না তো!

সোনালি জবাব দিল না।

আবার কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর সুধাকর বলল, আপনি বোধহয় রোমে থাকতেন, না?

না। জুরিখে।

 চলে এলেন কেন?

সোনালি বিরক্ত হয়ে বলল, চলে আসব না কেন? আমি তো বিদেশে থাকতে যাইনি। বিয়ে ভাঙার পর চলে আসতে ইচ্ছে হল।

হ্যাঁ হ্যাঁ, ঠিকই তো। তখন বোধহয় মিস্টার বোস সাক্কিতে জয়েন করেননি, না?

না।

বাই দি বাই, সাক্কির সঙ্গে আপনাদের কানেকশনটা চেক করে দেখেছেন?

 দেখেছি। সাক্কি আমাদের ক্লায়েন্ট। বানান আর উচ্চারণের তফাতটা জানা ছিল না বলে সেদিন বলতে পারিনি।

একটা কথা বলবেন? সাক্কির পারচেজের পরিমাণ কি এখন হঠাৎ একটু বেড়ে গেছে?

বেড়ে থাকতে পারে।

সাক্কি কি আপনাদের ইউরোপিয়ান এজেন্ট?

না। আমরা সাক্কিকে এজেন্ট হিসেবে অ্যাপয়েন্ট করিনি। তারা প্রোডাকশন কিনে নেয়, তারপর কী করে তা জানি না।

ঠিক কথা। মিস সোম, সাক্কি ঠিক কীসের বিজনেস করে তা কি আপনি জানেন?

খুব ভাল জানি না। শুনেছ এক্সপ্লোসিভস অ্যান্ড কো-রিলেটেড থিংস।

বাঃ, এই তো অনেক জানেন।

সাক্কি নামকরা কোম্পানি। সবাই জানে। আমি বরং কমই জানি।

গোপীনাথবাবু যে এই কোম্পানিতে আছেন তা আপনি জানতেন না, না?

না। আমি ওঁর কোনও খবর রাখি না।

ঠিক কথা। আফটার অল হি হ্যাজ ডেজার্টেড ইউ।

প্রসঙ্গটা আর না তুললেই খুশি হব।

সরি। গোপীনাথ বসু ইজ নাউ এ ফ্লাই ইন ইয়োর অয়েন্টমেন্ট। কিন্তু ওঁর প্রসঙ্গটা উঠছে কেন জানেন? হি ইজ এ বিগ গাই ইন হিজ ফিল্ড।

হতে পারে, আই অ্যাম নট ইন্টারেস্টেড।

সে তো ঠিক কথাই। আচ্ছা মিস সোম, আমি কি আপনাকে একটা গুরুতর প্রশ্ন করতে পারি?

ভ্রু কুঁচকে সোনালি বলে, কী প্রশ্ন?

 প্রশ্নটা হল, কফি আসতে এত দেরি হচ্ছে কেন বলুন তো!

সোনালি ফের একটু হাসল এবং বেল বাজাল। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ট্রে-তে দু’ কাপ কফি নিয়ে বেয়ারা ঢুকল।

বেয়ারা কফি রেখে চলে যাওয়ার পর সুধাকর তার কফিতে একটা চুমুক দিয়ে বলল, বাঃ, চমৎকার! এরকম কফির জন্যই বেঁচে থাকাটার একটা মানে খুঁজে পাওয়া যায়।

সোনালির মনে হল, কথাটা বড্ড বাড়াবাড়ি এবং বাহুল্য। সে মৃদুস্বরে বলল, আপনি বুঝি খুব কফি খান?

হ্যাঁ। তবে এরকম নয়। পারকোলেটরে তৈরি করা ব্ল্যাক তেতো কফি। ব্ল্যাক কফি ইজ এ ম্যাসকুলিন ড্রিঙ্ক।

আর এটা বুঝি ফেমিনিন?

না, না, তা নয়। এটাও চমৎকার। অত্যন্ত চমৎকার। ধন্যবাদ।

সোনালি লোকটাকে মনেপ্রাণে মোটেই পছন্দ করতে চাইছে না। আবার লোকটাকে তার খারাপও লাগছে না। এরকম বিপরীত প্রতিক্রিয়া তার আর কখনও হয়নি।

হঠাৎ সোনালি বেমক্কা প্রশ্ন করল, সাক্কিকে নিয়ে আপনি এত চিন্তিত কেন মিস্টার দত্ত?

সুধাকর কফির কাপে তার অখণ্ড মনোযোগ অব্যাহত রেখে খুবই মৃদু স্বরে বল, গুজব। সাক্কিকে নিয়ে হাজারও গুজব।

কীসের গুজব?

সেসব আপনার জানার দরকার নেই, সুখে থাকতে ভূতের কিল খাবেন কেন? এসব কারবারে যত না জেনে থাকা যায় ততই ভাল।

তাই বুঝি?

ঠিক তাই। এই যে আমি হাজার হাজার মাইল দৌড়ে মরছি তার অধিকাংশই হল পণ্ডশ্রম। চিলে কান নিয়ে গেছে শুনে চিলের পিছনে ছোটার মতো বোকামি। ওয়াইল্ড গুজ চেজ। সাক্কিকে নিয়ে যা রটেছে তাও এরকমই ব্যাপার হতে পারে।

তাই বুঝি?

আচ্ছা মিস সোম, আপনি নিজে সাক্কিকে নিয়ে চিন্তিত নন তো!

অবাক হয়ে সোনালি বলল, আমি! আমি কেন সাক্কিকে নিয়ে চিন্তিত হব?

 ঠিক ঠিক, তাই তো। আপনার তো টেনশনের কারণ নেই।

না নেই।

আপনার বস মনোজ সেনের আছে কি?

ওঁর কথা আমি কী করে বলব?

 তাও তো বটে। আপনি তো আর থট রিডার নন। আচ্ছা উনি এমনিতে তো লোক ভালই, না?

হ্যাঁ, ভালই তো।

আমারও তাই মনে হল। বেশ লোক। তবে ভাল লোকেরা তেমন বুদ্ধিমান বা যাকে চালাক চতুর চটপটে বলে তা হন না, তাই না?

সোনালি একটু হাসল। কিছু বলল না। আপনার কি মনে হয় মনোজবাবু খুব বুদ্ধিমান?

সোনালি মুখটা গম্ভীর করে বলল, বোকা হলে কি এত বড় কারখানা তৈরি করতে পারতেন?

হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাও একটা পয়েন্ট।

সোনালি এবার সুধাকরের চোখে অকপট চোখ রেখে ঠান্ডা গলায় বলল, আপনি নিশ্চয়ই গালগল্প করতে আমার কাছে আসেননি। কী জানতে চান স্পষ্ট করে বলুন তো।

খুবই বিব্রত হয়ে সুধাকর কফির কাপটা রেখে বলল, এই দেখুন আমি আপনাকে ডিস্টার্ব করে ফেললাম। আসলে আমি একটু মাঠো লোক। কিছু মনে করবেন না। আমার বোধহয় এখন বিদায় নেওয়াই উচিত, কী বলেন?

ভ্রু কুঁচকে সোনালি বলল, প্রয়োজন শেষ হয়ে থাকলে অবশ্যই বিদায় নেবেন।

সুধাকর উঠতে গিয়েও ফের বসে পড়ে বলল, প্রয়োজন! প্রয়োজনের কথা বলেই মুশকিলে ফেললেন। আপনার কম্পানিটাই এত লোভনীয় যে সেটাকেই প্রয়োজন বলে ধরে নেওয়া যায়।

মিস্টার দত্ত, ফ্ল্যাটারি আমি পছন্দ করি না।

সুধাকর খুবই অপ্রতিভ হয়ে বলল, যথার্থ বলেছেন। ফ্ল্যাটারি জিনিসটা বোধহয় ভালও নয়। তবু মানতেই হবে যে, জিনিসটা খুবই প্রয়োজনীয়। অবস্থা বিশেষে খুবই কাজে লাগে।

কিন্তু ভুল জায়গায় হলে উলটো ফল হতে পারে।

সুধাকর দত্ত ঘনঘন নেতিবাচক মাথা নাড়া দিয়ে বলল, আমি আপনাকে মোটেই ফ্ল্যাটারি করিনি। এ যুগের প্রয়োজন অনুযায়ী যেমন হওয়া উচিত আপনি ঠিক তেমনই। আপরাইট, স্পষ্টবক্তা এবং সাহসী। ইউ আর রিয়েলি এ গুড কম্পানি।

আপনার কথা কি শেষ হয়েছে মিস্টার দত্ত?

হ্যাঁ হ্যাঁ, এবার আমি উঠব।

আসুন নমস্কার।

হ্যাঁ হ্যাঁ, নমস্কার। আচ্ছা মিস সোম, লাল গোলাপের ব্যাপারটা কি একটু বলতে পারেন?

লাল গোলাপ?

গুজবই হবে। তবে শুনেছি রোজমারি সেনকে কে বা কারা লাল গোলাপ পাঠিয়ে থ্রেট করেছে!

সোনালি ফের ভ্রু কোঁচকায়। তারপর বলে, থ্রেট হবে কেন? হয়তো কেউ রসিকতা করেছে।

আপনি তাই মনে করেন?

আমার মনে করায় কী আসে যায় বলুন।

তা বটে। তবে আমাদের প্রত্যেকেরই নিজস্ব ব্যক্তিগত কিছু ডিডাকশন আছে। আপনার ডিডাকশন কী বলে?

সেটা তো বললামই।

রসিকতা? তা হলে তাই হবে। কিন্তু এরকম রসিকতা কে করতে পারে বলুন তো!

তা জানি না। তবে মিসেস সেনের অনেক বন্ধু আছে কলকাতায়।

তাই নাকি?

হ্যাঁ।

সুধাকর কিছুক্ষণ চিন্তিত মুখে সোনালির দিকে চেয়ে থেকে হঠাৎ বলল, অঙ্কটা মিলছে না।

 কীসের অঙ্ক?

আমার ব্যক্তিগত ডিডাকশন। সেখানে কিছু গণ্ডগোল হচ্ছে।

তার মানে?

আদ্রেঁ এবং লাল গোলাপ দুটো এক হাতের কাজ নয়। বাট হু ইজ দি সেকেন্ড পার্টি?

কী বলছেন আমি বুঝতে পারছি না।

সরি। আই ওয়াজ জাস্ট থিঙ্কিং অ্যালাউড।

তাই নাকি?

আজ্ঞে হ্যাঁ। আচ্ছা, রোজমারি বোধহয় খুবই বুদ্ধিমতী। না?

হ্যাঁ।

এই প্রোজেক্টটা কি উনিই চালান?

তা কেন? মিস্টার সেনও আছেন।

 দু’জনের মধ্যে কাকে আপনার বেশি এফিশিয়েন্ট বলে মনে হয়?

দু’জনকেই সমান এফিশিয়েন্ট বলে মনে হয়।

ঠিক আছে ঠিক আছে। আমি আপনাকে কিছু কমিট করতে বলছি না। জাস্ট সিম্পল কৌতূহল। কিছু মনে করবেন না।

মনে করিনি। কিন্তু এখন আমি কাজ করব।

ছি ছি, সত্যিই আমি একটা ইডিয়ট। আপনার মূল্যবান সময় অনেকটা নষ্ট করলাম। আসি তা হলে?

আসুন।

সুধাকর উঠল এবং দরজার কাছ বরাবর গিয়ে ফিরে এল।

আচ্ছা মিস সোম এই যে অ্যালয়টা এঁরা তৈরি করছেন এর কোনও পিকিউলিয়ার ইউসেজের কথা কি আপনি কিছু জানেন?

সোনালি একটু হেসে বলল, আমি নন-টেকনিক্যাল হ্যান্ড। আমার কাজ করেসপন্ডেন্স অ্যান্ড অফিস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। ওসব ব্যাপার আমার জানার কথা নয়।

তাও তো ঠিক কথা। আমারই ভুল। কিন্তু অনেক সময়ে অনেক কিছু তো আন্দাজও করে মানুষ।

মাথা নেড়ে বিরক্ত সোনালি বলল, না, আমার অত আন্দাজ করার মতো ক্ষমতা নেই।

 মিস সোম, ইউ আর রিয়েলি এ গুড কম্পানি।

ধন্যবাদ।

 আচ্ছা, তা হলে গোপীনাথবাবুকে আপনার কোনও মেসেজ দেওয়ার নেই।

সোনালি কঠিন দৃষ্টিতে চেয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছে আপনি ইচ্ছে করেই আমাকে উত্ত্যক্ত করতে চাইছেন।

জিব কেটে সুধাকর বলল, তা নয়, তা নয়। আসলে আমি তো এখন রোমেই যাচ্ছি। দেয়ার ইজ এ পসিবিলিটি অফ এ চান্স মিটিং। ঠিক আছে মিস সোম, আমি যাচ্ছি।

আসুন।

সুধাকর দত্ত চলে যাওয়ার পর সহজ হতে পারল সোনালি। আবার তার লোকটাকে খারাপও লাগছে না। যদি আবার কখনও দেখা হয় তা হলে সোনালি অন্তত বিরক্ত হবে না। লোকটা খুবই অদ্ভুত। বিরক্তিকর, অস্বস্তিকর, কিন্তু আকৰ্ষকও।

সোনালি কাজকর্ম শুরু করতে যাচ্ছিল, টেলিফোন বাজল।

সোনালিদি আমি সুব্রত।

হ্যাঁ, বলুন।

দত্ত তো চলে গেল দেখলাম।

হ্যাঁ।

খুব জ্বালিয়েছে নাকি আপনাকে?

একটু।

কেন যেন লোকটাকে আমার বিপজ্জনক মনে হয়।

হতে পারে। ভেবে কী করবেন?

১০.

একটা পোর্টেবল আইসিবিএম তৈরি করাটাই আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আমি একজন ভাড়াটে বেতনভুক বৈজ্ঞানিক। প্রভুরা যা চান আমার তা করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। সাক্কির হয়ে আমি যা করেছি তা একজন কর্মচারী হিসেবেই করেছি। কর্মচারী হওয়া ছাড়া একজন বৈজ্ঞানিকের এ যুগে উপায়ও নেই। তার কারণ বহুল ব্যয়সাপেক্ষ গবেষণা চালাতে গেলে তার দরকার অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও বিশাল সংগঠন, যা ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা যায় না। কর্মচারী হিসেবে আমি প্রচুর বেতন ও সুবিধা পাই। তার চেয়েও অনেক বেশি পাই কাজ করার অফুরন্ত সুযোগ ও পরিবেশ। সাক্কি অস্ত্রের কারবারি। তাদের তৈরি অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র নরমেধেই প্রযুক্ত হয়। তাদের বিধ্বংসী অস্ত্রে অনেক কলকারখানা, বাড়িঘর, নগর বন্দর ছারেখারে যায় আমি জানি। এইসব অস্ত্র তৈরিতে আমাদের মতো বৈজ্ঞানিকদের অবদান তো কম নয়। এই যে পোর্টেবল, স্বল্প ওজনের দুরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রটি তৈরি হচ্ছে এটি ভবিষ্যৎ পৃথিবীর পক্ষে এক অভিশাপ হয়ে রইল। সাক্কি কোনও দেশের হয়ে কাজ করে না, তার কোনও স্থানিক পরিচয়ও নেই। এটি একটি নৈর্ব্যক্তিক, অর্থগৃধ্বু, ক্ষমতালিপ্সু প্রতিষ্ঠান। পৃথিবী ছারেখারে গেলেও এর কিছু যায়-আসে না। কিন্তু এদের ক্ষমতা ও অর্থবল বিশাল। এদের হাতে যেন আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ। কিন্তু আমি–গোপীনাথ বসু এই বিশাল সংগঠনের কতটুকু? লক্ষ ভগ্নাংশও নয়। কিন্তু এই আইসিবিএম তৈরি করতে গিয়ে আদ্রেঁ এবং আমি একটি অদ্ভুত জিনিস দেখতে পাই। আলোকোত্তর প্রতিভার অধিকারী আদ্রেঁ-ধাতব রসায়ন বিক্রিয়া থেকে জ্বালানি তৈরির কথা ভেবেছিল। তাই ওকে একটা সুযোগ দেওয়া হয়েছিল সাক্কিতে। জ্বালানি তৈরির জটিল ও সূক্ষ্ম কাজে দিনের পর দিন মগ্ন থেকেছে সে। অবশেষে সে একদিন আমাকে তার স্বভাবসিদ্ধ মৃদু স্বরে বলেছিল, হয়তো আমি স্বপ্ন দেখছি না মঁসিয়ে বোস। জিনিসটা হয়তো আমাদের নাগালে এসে গেছে।

ঠিক যে ধরনের আপাত-অসম্ভব জ্বালানির কথা আদ্রেঁ ভেবেছিল তা সত্যিই তৈরি হলে শুধু সাক্কির আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রই উড়বে না, তার চেয়েও অনেক বড় কাজ হবে, আদিগন্ত ভবিষ্যতের জন্য মানুষের জ্বালানি সমস্যারও সমাধান হয়ে যেতে পারে।

যে অ্যালয় নিয়ে বিভিন্ন রাসায়নিক বিক্রিয়ার কাজ করছিল আদ্রেঁ, সেটি কলকাতা এবং পৃথিবীর আরও কয়েকটি জায়গায় তৈরি হয়। কিংবা আরও অন্য কোনও ধাতু বা সংকর ধাতু নিয়ে সে কাজ করছিল। আমি সঠিক জানি না, কিন্তু তার এই কাজ সম্পূর্ণ করার জন্য আর একজন আদ্রেঁ দরকার। নইলে একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে ব্যর্থ হয়ে যাবে এত বড় একটা প্রয়োজনীয় আবিষ্কার। ধ্বংসের বিজ্ঞান থেকে অন্তত এটুকু সদর্থক একটা কিছু বেরিয়ে এলে আমি খুশি হতাম। তা হল না, কোন মূর্খ ঘাতক তাকে খুন করে দিল।

আজই আদ্রেঁর অটোপসির রিপোর্ট আমরা পেয়েছি। তার মৃত্যু হয়েছিল অত্যাধুনিক বিষে। খুব সূক্ষ্ম পরীক্ষা ছাড়া যা ধরাই যায় না। হার্ট অ্যাটাকের সমুদয় লক্ষণ নিয়েই মানুষ মারা যায়। তবু সন্দেহের বশে তার ময়নাতদন্ত করা হয়েছে বিশেষজ্ঞ দিয়ে।

 জানি না ভিকিজ মব-ই তাকে মেরেছে কি না। যদি তারাই এ কাজ করে থাকে তা হলে তাদের অবিলম্বে পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া দরকার। জানি তা সম্ভব নয়। এই পৃথিবীতে যা কিছু অসুন্দর, নিষ্ঠুর ও দুষণীয় তা দুর করা যায়নি, যাবেও না। কিন্তু আদ্রেঁর মৃত্যু যে আমাদের কতখানি ক্ষতি করল তা তোমাকে বোঝাতে পারব না। আমি বড় অসহায় বোধ করছি।

সুব্রত, তোমাকে সবই বুঝিয়ে লিখলাম। ভিকিজ মব আমার ওপর সর্বত্র ও সর্বক্ষণ নজর রাখছে বটে, কিন্তু আমার কাজে এখনও বাধা দিচ্ছে না। তার কারণ আদ্রেঁ মারা যাওয়ায় আমাদের প্রোজেক্ট এক বিরাট ধাক্কা খেয়েছে। আরে অসমাপ্ত কাজ শেষ করার মতো কেউ নেই। আশা করছি ভিকিজ মব কয়েকদিনের মধ্যে ব্যাপারটা বুঝতে পেরে নিরস্ত হবে। কিন্তু বিপদ আসছে অন্যদিক থেকে। অপ্রত্যাশিত বলব না, এরকম যে ঘটবে তা আমি জানতাম।

বিপদটা হল, সাক্কি ইনকরপোরেটেডের কর্তৃপক্ষ গন্ধ পেয়ে গেছে যে, আদ্রেঁর গবেষণার ভিতরে সোনার খনি রয়েছে। সাধারণত তাদের ভাড়াটে বৈজ্ঞানিকরা কী কাজ করে সে সম্পর্কে সাক্কি কর্তৃপক্ষ ততটা খবর রাখে না। তাদের মূল লক্ষ্য ব্যাবসা এবং মুনাফা। তুমি তো জানোই, এই জ্বালানির ব্যাপারে আজ সারা পৃথিবী জুড়ে কীরকম প্রচেষ্টা চলছে। এই নতুন রকেট ফুয়েল শুধু আইসিবিএম নয়, সামান্য হেরফের ঘটিয়ে প্রায় সব ব্যাপারেই এই জ্বালানিকে কাজে লাগানো যাবে, যদি না কোনও বিষাক্ত প্রতিক্রিয়ার সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু আপাতত সাক্কি এ ব্যাপারে খুবই আগ্রহী হয়ে উঠেছে। গত পরশু সাক্কির বোর্ড অফ ডিরেক্টরস আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিল। তাদের হাবভাব আমার ভাল লাগছে না। নানারকমভাবে তারা আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। তারা বলছে প্যারিস থেকে পালিয়ে আসার পর আদ্রেঁর কাগজপত্র সরানো এবং ফটোকপি করা ইত্যাদির সব খবরই তারা রাখে। তাদের সন্দেহ আমার উদ্দেশ্য খুবই অসাধু। আমি তাদের ভিকিজ মবের কথা বুঝিয়ে বলেছি, কিন্তু তারা সেটা বিশ্বাস করছে না। আমার দূরভিসন্ধিমূলক কাজকর্ম তারা বরদাস্ত করতেও রাজি নয়। আরে যাবতীয় কাজকর্মের ফটোকপি তাদের হাতে আমি তুলে দিয়েছি, কিন্তু তারা তাতেও খুশি নয়। আমার কাছ থেকে সন্তোষজনক ব্যাখ্যা না পেলে তারা সহজে ছাড়বে না আমাকে।

কাজেই ভিকিজ মব-এর সঙ্গে সাক্কির ভাড়াটে গুন্ডারাও আমার ওপর নজরদারি করছে। আপাতত রোম ছেড়ে আমার কোথাও যাবার উপায় নেই। ল্যাবরেটরিতে আমার প্রবেশ নিষেধ হয়েছে। সাক্কি যাদের কাজে লাগিয়েছে তারা সিসিলির মাফিয়া। চোখের পলকে খুন করে বসে।

আমি বেঁচে থাকার কোনও আশা দেখছি না। মৃত্যু অবধারিত বলেই মনে হচ্ছে। তবে তুমি তো জানোই, কাজ ছাড়া বেঁচে থাকাটাও আমার কাছে অর্থহীন। আমার মনে হয় না সাক্কি আমাকে কাজ করতে দেবে। আমি জীবনের আশা ছেড়ে দিয়েছি।

আমার বিষয়সম্পত্তি নিয়েই প্রশ্ন। তুমি তো জানোই যে, আমার নিকট আত্মীয়স্বজন বলতে কেউ নেই। মা-বাবা গত হয়েছেন। আমার দিদি সম্প্রতি আমেরিকায় মারা গেছেন। তার ছেলেমেয়েরা আছে বটে, কিন্তু তারা আমাকে চেনেও না। সুতরাং আমার উত্তরাধিকারী বলে কেউ নেই। একমাত্র সোনালি আছে–যে আইনত আমার কেউ নয়, কিন্তু একসময়ে সে আমার স্ত্রী ছিল। এখানে আমি আমার অ্যাটর্নি মারফত যাবতীয় সম্পত্তি সোনালির নামে ট্রান্সফার করার ব্যবস্থা করেছি। তাকে সরাসরি এ কথা জানানোর উপায় আমার নেই। কারণ আমার প্রতি তার একটা ঘৃণার ভাব আছে। অতীত যে কত বড় বর্তমান হয়ে বাধার সৃষ্টি করে। সে যাক, খবরটা তুমিই তাকে দিয়ো। আমি জানি তার তেমন আর্থিক সচ্ছলতা নেই। ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যালয়ের চাকরি থেকে প্রাপ্ত বেতন থেকে তাকে বাপের বাড়ির জন্য অনেকটাই খরচ করতে হয়। সে আমার কাছ থেকে খোরপোষ বা ক্ষতিপূরণ বাবদও কিছু নেয়নি। হয়তো এবারও নেবে না। কিন্তু আমার তো আর কেউ নেই। তাকে বোলো, গ্রহণ করলে আমি বড় শান্তি পাব।

আমাকে আমার অ্যাপার্টমেন্ট ছাড়তে হয়েছে। আমি একটা রুমিং হাউসে। এখানে টেলিফোন আছে বটে, তবে পাবলিক ফোন। সাক্কি আপাতত আমার অ্যাপার্টমেন্টের চার্জ নিয়েছে। কেন তা জানি না। আমি হয়তো বা গৃহবন্দি, কারণ, সবসময়ে একটা অস্বস্তি বোধ করছি। আমার চারদিকে অনেক নজরদার।

 সোনালিকে আমার অসহায় অবস্থার কথা বোলো। আমার অ্যাটর্নি কয়েকদিনের মধ্যেই ওর সঙ্গে যোগাযোগ করবে। ও যেন প্রত্যাখ্যান না করে। ওকে রাজি করানোর ভার তোমার ওপর ছেড়ে দিলাম।

রোমে আমার একটা ভিলা আছে। আছে কিছু শেয়ার আর নগদ টাকা। খুব কম করে ধরলেও সব মিলিয়ে দশ কোটি টাকার ওপর হবে। সোনালি বিদেশে থাকা পছন্দ করে না। যদি চায় অ্যাটর্নি মারফত বিক্রি করে সব টাকা কলকাতায় ওর অ্যাকাউন্টে ট্রান্সফার করে নিতে পারে। আর যদি আসে তা হলে তো নিজেই সব বুঝে নিতে পারবে। যদি বেঁচে থাকি সাতদিন বাদে আমি তোমাকে ফোন করব। সোনালি রাজি হল কি না জানার জন্য উদগ্রীব রয়েছি। ভালবাসা জেনো। গোপীদা।

.

চিঠিটা পেয়ে সুব্রতর মন খারাপ হয়ে গেল। এতটাই খারাপ যে, চোখে জল এল তার। গোপীনাথ শুধু তার ডাকের দাদা নয়, গোপীনাথ ছিল তার আশৈশব হিরো। মেধাবী, সাহসী ও প্রচণ্ড প্রাণবান গোপীনাথ যাতে হাত দিত তাতেই সোনা ফলিয়ে তুলতে পারত। চমৎকার অভিনয় করত, মূর্তি বানাত, ছবি আঁকত, বাচ্চাদের ব্যায়াম শেখাত। তবে গোপীনাথ ছিল গরিব। কষ্ট করে, লড়াই করে বড় হয়েছে। চিররুণ বাবা গোপীনাথের কিশোরবয়সেই মারা যান। মা মারা গেলেন গোপীনাথ কলেজে ভরতি হওয়ার আগেই। গোপীনাথের দিদি সুন্দরী ছিলেন বলে অল্পবয়সেই বিয়ে হয়ে গিয়েছিল এবং বিয়ের পরই যে বিদেশে চলে গিয়েছিলেন, আর বড় একটা আসতেন না। গোপীনাথ প্রায় একা একা জীবন কাটিয়েছে। মা মারা যাওয়ার পর থেকেই গোপীনাথ শুধু লেখাপড়া আর চিন্তাভাবনায় সময় কাটাত। ছাত্র অবস্থা থেকেই চেষ্টা করত বিদেশে চলে যাওয়ার। শেষ অবধি গেল। আমেরিকায়। দারুণ সব রেজাল্ট করল, বড় চাকরি পেল। তারপর সাধের বিয়ে।

সুব্রত আজও বিয়ে ভাঙার আসল কারণ জানে না। গোপীনাথ ভেঙে কিছু বলেনি কখনও। কিন্তু সোনালির সঙ্গে একটা যোগাযোগ সুব্রতর ছিল বরাবর। বিয়ের আগে থেকেই চেনা। এই যে সোনালি আর সে একই কোম্পানিতে চাকরি করে এটা কোনও অ্যাক্সিডেন্ট নয়, একটি ধুরন্ধর মাথার ঠান্ডা, হিসেব করা প্ল্যানিং। গোপীনাথ বসু দুর থেকে কলকাঠি নেড়ে এটা ঘটিয়েছে। সোনালি জানে না, সুব্রত জানে। কিন্তু গোপীদা কেন এটা ঘটিয়েছে তা স্পষ্ট জানে না সুব্রত।

চিঠিটা পেয়ে সুব্রত কিছুক্ষণ বিমূঢ় হয়ে বসে রইল। গোপীদা যদি খুন হয় তবে তার ভীষণ খারাপ লাগবে। লোকটা জীবনে কখনও সুখ পায়নি। টাকা রোজগার করেছে অনেক, কিন্তু সেই টাকারও ভাগীদার নেই, গোপীদা এমনই দুর্ভাগা। একটি দুঃখী লোক বিদেশ বিভুয়ে অকারণে গুন্ডাদের হাতে খুন হবে, ভাবতেই তার বুক হাহাকার করে।

পরদিন অফিসে এসেই সুব্রত সোনালির ঘরে ফোন করে বলল, ম্যাডাম, একটু কথা আছে।

কী কথা?

একটু সময় লাগবে। লাঞ্চে কি ফ্রি আছেন?

লাঞ্চ বলে কিছু তো আমার নেই। তবে বেলা একটায় সময় দিতে পারব।

 তা হলে ওই কথাই রইল।

সোনালি কম কথার মানুষ। বেশ ব্যক্তিত্বও আছে। সোনালি কেন গোপীদাকে পছন্দ করতে পারেনি সেটা আজও রহস্য রয়ে গেল সুব্রতর কাছে।

লাঞ্চ পর্যন্ত সুব্রত আজ অন্যমনস্ক রইল। কাজে তেমন মন বসল না। বেলা একটায় ফোন করল সোনালিকে।

সোনালিদি, আর ইউ ফ্রি নাউ?

হ্যাঁ।

আমি কি আপনার ঘরে আসব?

আসুন।

সুব্রত যখন সোনালির ঘরে গিয়ে ঢুকল, তখন সোনালি নিশ্চিন্তে বসে বাড়ি থেকে আনা স্যান্ডউইচ আর কফি খাচ্ছে। বাঁ হাতে একটা টাইপ করা চিঠি দেখছে। সোনালি সবসময়ে কাজ ভালবাসে।

তার দিকে বড় বড় চোখ করে চেয়ে সোনালি বলল, কী ব্যাপার বলুন তো। বেশ টেনশ দেখাচ্ছে আপনাকে।

হ্যাঁ। আমি একটু টেনশনেই আছি।

বসুন।

সুব্রত বসে খানিকক্ষণ চুপ করে রইল। কী করে কথাটা বলবে তা সে গুছিয়ে আসেনি। একটু এলোমেলো লাগছে ভিতরটা।

বলুন। বলে সোনালি খুব গা ছেড়ে বসল।

সুব্রত সামান্য একটু দ্বিধা করে পকেট থেকে গোপীনাথের চিঠিটা বের করে সোনালির হাতে দিয়ে বলল, এ চিঠিটা পড়ুন।

কার চিঠি?

পড়লেই বুঝবেন।

চিঠিটা যতক্ষণ পড়ল সোনালি ততক্ষণ তার মুখের দিকে চেয়ে রইল সুব্রত। ভাবান্তর দেখার জন্যই।

ভাবান্তর হল। মুখটা ধীরে ধীরে শুকিয়ে যেতে লাগল। ভীষণ গম্ভীর হয়ে গেল সোনালি। ভ্রু কুঁচকে রইল। চিঠিটা পড়া শেষ করে সুব্রতর দিকে নীরবে চেয়ে রইল সোনালি।

সুব্রত বলল, কিছু বুঝলেন?

কী বুঝব?

গোপীদা আপনার একটা জবাব চাইছে।

সোনালি ভীষণ বিরক্ত হয়ে বলল, আঃ, ও তো বিষয়সম্পত্তির কথা। তা দিয়ে আমার কী হবে?

কিন্তু গোপীদা যে—

সোনালি কেমন যেন লাল হয়ে বলল, একটু চুপ করবেন? আমাকে ভাবতে দিন।

সুব্রত থতমত খেয়ে গেল।

কিছুক্ষণ পরে সোনালি বলল, ও টেলিফোনে অ্যাকসেসেবল নয়। তা হলে কী করে যোগাযোগ করবেন?

চিঠি।

চিঠি? বলে যেন অবিশ্বাসের চোখে চেয়ে রইল সোনালি। তারপর বলল, চিঠি পৌঁছোতে তো সময় লাগবে।

তা ছাড়া উপায় কী? সাতদিন বাদে টেলিফোন করবেন বলে লিখেছেন। আমার হিসেবে আগামীকাল। কিছু বলতে হবে?

না। আমার কথা ওকে কিছু বলবেন না, প্লিজ।

তা হলে?

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, টাকার লোভ যে একটা মানুষকে কতখানি নষ্ট করে ফেলে।

কার কথা বলছেন?

আপনার গোপীদার কথা।

গোপীদা কি লোভী?

আর কী বলা যায় বলুন তো! ভূতের মতো খাটে, দু’হাতে পয়সা রোজগার করে, এ ছাড়া আর কী করে আপনার গোপীদা? জীবনটা কি ওরকম? শুধু কাজ আর টাকা?

আপনি ভুল বুঝছেন।

সোনালি মাথা নেড়ে বলল, ভুল বুঝব কেন? আমি ঘর করেছি বলেই জানি। পরিণতিটাও দেখুন, একটাও নিজের জন নেই লোকটার, ওর টাকা হাত পেতে নেওয়ার লোক নেই। ওর তো এরকমই হওয়ার কথা।

আপনি একটু ভুল বুঝছেন ম্যাডাম।

 সোনালি একটা তীব্র হেসে বলল, ভুল বুঝলে তো ভালই হত। আপনিই দেখুন, বিপদে পড়েও এখন শুধু ওর বিষয়সম্পত্তি আর টাকার কথাই ভাবছে।

সকলেই তো তাই ভাবে। মরার সময়ে যাবতীয় উত্তরাধিকার কাউকে দিয়ে যেতে চায়।

ওটা মানি-সেন্ট্রিকের ভাবনা।

সুব্রত কী একটা বলতে গেল, কিন্তু জুতসই কিছু খুঁজে পেল না। চুপ করে রইল।

 সোনালি মৃদু স্বরে বলল, ওকে বলে দেবেন ওর টাকায় আমার দরকার নেই।

 সোনালিদি, আপনি বড্ড নিষ্ঠুরতা করছেন। একটু ভেবে বলুন।

আমার ভাবনাচিন্তা অনেক আগেই হয়ে গেছে। আমি কোনওভাবেই গোপীনাথ বসুর উত্তরাধিকারী নই।

তা হলে কী হবে সোনালিদি?

কী আবার হবে। ওর সব টাকাপয়সা বাড়ি গাড়ি সরকার নিয়ে নিক। আমার দরকার নেই।

সুব্রত তবু কিছুক্ষণ বসে রইল। সোনালি তার স্যান্ডউইচ আর খেল না। তুলে বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দিল। কফিটাও আর ছুঁল না।

সোনালিদি, আমাকে আজ একটা কথা বলবেন?

কী কথা?

গোপীদাকে আপনি এত অপছন্দ করেন কেন?

অপছন্দ করার মতো বলেই।

এর বেশি কিছু বলবেন না?

আজ থাক সুব্রতবাবু, অন্য দিন বলব।

গোপীদা কি হৃদয়হীন?

সোনালি একটু চুপ করে থেকে বলল, তাই তো মনে হয়।

আমি ছেলেবেলা থেকে ওকে চিনি, আপনি তো জানেন।

জানি। পুরনো কথা শুনে আমার লাভ নেই। গোপীনাথ জীবনে যা চেয়েছে পেয়েছে। তার বেশি কিছু চায়নি, পায়নি।

সুব্রত একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠল।

পরদিন রাত প্রায় দশটায় গোপীনাথের ফোন এল তার বাড়িতে।

সুব্রত, গোপীদা বলছি।

 হ্যাঁ, গোপীদা, ওদিককার কী খবর?

খবর ভাল নয়। জাল গুটিয়ে আনছে।

তার মানে?

মেয়াদ খুব কম। সোনালি কী বললে?

 ভেবে বলবে।

গোপীনাথ একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, জানতাম।