৬.
রবিবার মে ১৫, ২০১১
হোবোকেনে রওনা হবার একটু আগে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে একেনবাবুর ফোন এল। অকারণে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ফোন করেন না।
“কী বললেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“অশোকবাবুর পোস্ট মর্টেমের রিপোর্টটার জন্যে ওঁকে রিকোয়েস্ট করেছিলাম। সেটা পেয়েছেন। কিন্তু একটা স্যাড নিউজ দিলেন স্যার, বব ক্যাসেল মারা গেছেন।”
“বব ক্যাসেল! মানে বিপাশা মিত্রের সেক্রেটারি?”
“হ্যাঁ স্যার, সম্ভবত সুইসাইড।”
“কিন্তু বব ক্যাসেলের খবরটা হঠাৎ আপনাকে দিলেন কেন?”
“বিপাশা মিত্রের অফিসে বব ক্যাসেলের সঙ্গে হয়তো আমাদের পরিচয় হয়েছে স্যার, এই ভেবে। বিপাশা মিত্র তো আমাদের ডেকেছিলেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের রেকমেন্ডশনে।”
.
নিউজটা এত আকস্মিক, আমাদের কারোর মুখেই কোন কথা নেই। আমি একটু বাদে জিজ্ঞেস করলাম, “সম্ভবত’ সুইসাইড মানে? ওঁর কি ধারণা এটা খুনও হতে পারে?”
“এ ব্যাপারে নিশ্চিত হতে সময় লাগে স্যার।”
“কী করে মারা গেলেন?”
“হাইরাইজ বিল্ডিং থেকে লাফ দিয়ে।”
“মাই গড! কোন জায়গায়?”
“থার্ড অ্যাভেনিউ আর ফিফটি সেকেন্ড স্ট্রিটের কাছাকাছি।”
“আপনার সাহায্য চাইলেন নাকি?”
.
ম্যানহাটানে আমাদের দেশের কেউ খুন হলে, অনেক সময়ে কনসাল্টেন্ট হিসেবে একেনবাবুর ডাক পড়ে। কালচারাল অ্যাঙ্গেল থেকে কিছু কিছু বিচার বিবেচনা এসে পড়তে পারে সমস্যার সমাধানে। এক্ষেত্রে তার অবশ্য কোনও প্রয়োজন নেই।
প্রমথ শুধু বলল, “আশাকরি খুন নয়, খুন হলে…।” বলে চুপ করল।
“খুন হলে কী?”
“কে জানে, হঠাৎ মনে হল এর সঙ্গে বিপাশার ফটো চুরি জড়িয়ে নেই তো?”
এলোমেলো কিছু কথা হল এই নিয়ে।
“বিপাশা নিশ্চয় খুব আপসেট। কালকে ওকে একটা ফোন করা উচিত আপনার, আমি একেনবাবুকে বললাম। “তাছাড়া অন্য দু’জন সাসপেক্টের ফোন নম্বরও তো আপনাকে ওঁর দেবার কথা।”
“অবশ্যই স্যার, অবশ্যই।”
.
হোবোকেনে আমরা গাড়ি করেই গেলাম। রবিবার সন্ধ্যে সাতটা, লাকিলি রাস্তায় আজ ভিড়টা একটু কম। আমাদের বাড়ি থেকে হোবোকেনে যাবার সবচয়ে সহজ রাস্তা হাডসন নদীর নীচ দিয়ে হল্যান্ড টানেল ধরা। টানেলের মুখ প্রায় সবসময়েই একটু জ্যাম থাকে, তাই হাতে একটু সময় নিয়েই বেরিয়েছি। কিন্তু আজকে দেখি টানেলের মুখ ফাঁকা, বলতে গেলে সাঁ করে বেরিয়ে গেলাম। আটকা যেটা পড়লাম সেটা টানেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে মেইন বুলেভার্ডে ঢুকে। রাস্তায় কিছু কাজ হচ্ছে বলে একটা লেন বন্ধ। তাও
আটটার অনেক আগেই হোবোকেনে পৌঁছে গেলাম।
ইন্দ্রকে আটটার আগে পাওয়া যাবে না। একেনবাবু বললেন, “চলুন স্যার, অশোকবাবু যেখানে খুন হয়েছেন, সে জায়গাটা একটু দেখা যাক।”
রাস্তার নামটা মনে ছিল। আমার গাড়িতে একটা জিপিএস আছে। সেখানে রাস্তার নাম ঢুকিয়ে দিলে, কম্পিউটার ভয়েস-এ ডিরেকশন পাওয়া যায়। বাঘের বাচ্চা টেকনোলজি, খুঁজে পেতে কোনও অসুবিধা হল না।
.
বহু বছর ধরে অবহেলিত নির্জন রাস্তা, ওয়ান-ওয়ে। এক দিকে একটা পরিত্যক্ত ফ্যাক্টরি। দুটো উঁচু শেড, সঙ্গে লাগোয়া বিল্ডিং। বিল্ডিং-এর পলস্তারাগুলো জায়গায় জায়গায় খসে পড়েছে। জানলাগুলোর কাঁচ বেশির ভাগই ভাঙ্গা। পুরো চত্বরটা ইটের দেয়াল দিয়ে ঘেরা। সামনে তালা দেওয়া লোহার গেট। এককালে রঙ বোধহয় সবুজ ছিল। মরচে ধরে এখন সবুজত্বের প্রায় কিছুই নেই। রাস্তার উলটো দিকে ভাঙাচোরা কংক্রিটের পার্কিং লট। সেটা কেউ ব্যবহার করে বলে মনে হয় না। ফাটা কংক্রিটের ফাঁক-ফোকর দিয়ে এখানে সেখানে আগাছা গজিয়েছে। চতুর্দিকে প্ল্যাস্টিক, ভাঙ্গা কাঁচ, বিয়ারের বোতল, কাগজ আর হাবিজাবি জিনিস ছড়ানো। পার্কিং লটের পাশে বেশ কয়েকটা দোকান এককালে ছিল। এখন সবগুলোই উঠে গেছে। দোকানগুলোর দরজা-জানলা প্লাইউডের বোর্ড দিয়ে ঢাকা। তার উপর চিত্রবিচিত্র নানা রঙের গ্রাফিতি। বোর্ডগুলোরও জরাজীর্ণ অবস্থা, দুয়েকটা প্রায় খুলেও এসেছে। আটটা এখনো বাজেনি। মে মাসের মাঝামাঝি বলে সূর্য অস্ত যায়নি, চারিদিকে যথেষ্ট আলো। গাড়ি থেকে নেমে কিছুক্ষণ এদিক ওদিক ঘুরলাম। ভাবছিলাম রাস্তার ধারে যদি কোথাও রক্তের দাগ থাকে। আর কিছু না থাক, পুলিশের আঁকা চকের মার্কিং থাকবে। কিছুই না, ক’দিন আগে এখানে একটা খুন হয়ে গেছে, তার কোনও চিহ্নই নেই। একেনবাবু দেখলাম লোহার গেটের ফাঁক দিয়ে ভিতরে উঁকিঝুঁকি মারছেন।
“কী খুঁজছেন?”
“কিছু না স্যার, চলুন যাওয়া যাক প্রায় আটটা বাজতে চলল।”
আমি যাবার জন্যে রেডি। এতক্ষণ এখানে আছি, এর মধ্যে একটা গাড়িও এখান দিয়ে যায়নি! চারিদিকে একটা থমথমে ভাব– কী জায়গারে বাবা!
.
যখন গাড়িতে উঠছি তখন দেখি পার্কিং লটের পাশে পরিত্যক্ত দোকানগুলোর পেছন থেকে একটা লোক আমাদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে বেরিয়ে আসছে। মুখে দাড়িগোঁফের জঙ্গল, চুলে চিরুনি পড়েনি বহুদিন, গায়ে নোংরা সার্ট, প্যান্টটা জায়গায় জায়গায় ছেঁড়া। লোকটা স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। হাতে খয়েরি কাগজে ঢাকা একটা বোতল। সেখান থেকে
এক ঢোঁক খেয়েও নিল। নিশ্চয় ভাঙা দোকানগুলোর পেছনে বসে এতক্ষণ মদ্যপান করছিল।
প্রমথ ফাজলামি করল, “একেবারে জনশূন্য নয়। কথা বলবি নাকি লোকটার সঙ্গে? মনে হচ্ছে আই-উইটনেস হতে পারে!”
“তুই বল,” গাড়ি স্টার্ট করে লোকটাকে যখন পাশ কাটিয়ে যাচ্ছি, ‘হেই’ বলে চেঁচিয়ে জানলায় দুয়েকটা থাবড়া মারল। মাতালের সঙ্গে ঝগড়া করার কোন অর্থ হয় না। একেনবাবু দেখলাম পেছন ফিরে তাকাচ্ছেন। প্রমথকে জিজ্ঞেস করলেন, “আর কাউকে দেখতে পাচ্ছেন স্যার, দোকানগুলোর পেছনে?”
আমরা যে অ্যাঙ্গেলে আছি সেখান থেকে দোকানগুলোর পেছন ভালোভাবে দেখা অসম্ভব। আমি বললাম, “দেখতে পান বা না পান, আমি গাড়ি থামাচ্ছি না।”
ইন্দ্রের বাড়ি গাড়ি করে পৌঁছতে প্রায় মিনিট দশেক লেগে গেল। হেববাকেনের বাস সার্ভিস সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। কাছাকাছি বাস না পেলে ওই ভাঙাচোরা ফ্যাক্টরি থেকে হাঁটা পথে বাড়িতে আসতে অশোকবাবুর অনেক সময় লাগত। কেন উনি ওরকম নির্জন জায়গায় গিয়েছিলেন কে জানে? মনে হয় মৃত্যু রহস্যটা সেখানেই লুকিয়ে আছে।
.
ইন্দ্রদের বাড়িটা পুরোনো, কিন্তু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। চারতলার ওপরে একটা টু-রুম ফ্ল্যাট। একটা বসার ঘর, তার সঙ্গে লাগোয়া ছোট্ট কিচেন। বসার ঘর থেকে একটা প্যাসেজ চলে গেছে ভিতরের দিকে। তার দু’পাশে দুটো বেডরুম। প্যাসেজের শেষে একটা কমন বাথরুম। বসার ঘরটা একেবারে ছবির মতো সাজানো। আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকলে প্রথমেই চোখ পড়বে কফি টেবিলে ডাঁই করে রাখা নিউ ইয়র্ক টাইমস, আধ-খাওয়া কফির কাপ, যত্রতত্র কাগজের টুকরো, কোকাকোলার ভোলা ক্যান,…। আমরা সবাই এর কন্ট্রিবিউটার, তবে একেনবাবু নিঃসন্দেহে আমাদের লিডার।
আমি তো বসার ঘর দেখে মুগ্ধ। বলেই ফেললাম, “আপনার অ্যাপার্টমেন্ট খুব গোছানো।”
“থ্যাঙ্ক ইউ।”
ইন্দ্র আমাদের জন্যে কফি বানানোর চেষ্টা করছিলেন, সবাই মিলে নিরস্ত করলাম। বেশি সময় নষ্ট না করে অশোকের ঘরটা দেখে চলে যাব।
.
অশোকের বেডরুমে ফার্নিচার বলতে একটা টুইন সাইজের বেড, চেস্ট অফ ডুয়ার্স আর পড়ার টেবিল। চেস্ট অফ ড্রয়ার্স-এর ওপর দুটো বুক-এন্ড-এর মধ্যে বেশ কয়েকটা বই। টেবিলটা বেশ বড়। সেখানে অনেকটা জায়গা জুড়ে ওয়েবক্যাম লাগানো বিশাল কম্পিউটার মনিটর। তার এক দিকে ক্রিস্টালের একটা সুন্দর ফুলদানি। অন্য পাশে বয়স্ক দম্পতির ফ্রেমে বাঁধানো ফটো, সম্ভবত অশোকের বাবা-মা। এই সাইজের মনিটর বা ক্রিস্টালের ফুলদানি খুব একটা সস্তা নয়। আমি সেগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি দেখে ইন্দ্র বলল, “কম্পিউটার আমরা হোটেল থেকে পাই।”
“ফুলদানিটা মনে হচ্ছে ক্রিস্টালের তাই না?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“হ্যাঁ, এটা ক’দিন আগে বিপাশা মিত্র অশোককে উপহার দিয়েছিলেন– ওঁর একটা পার্টি অশোক খুব ভালো ভাবে অর্গানাইজ করেছিল বলে।”
“আপনারা বিপাশা মিত্রকে চেনেন?” আমি একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“চিনি মানে কাজের সূত্রে। ওঁর অনেক পার্টি আমরা অর্গানাইজ করি। গতবারের পার্টি অশোক করেছিল। অশোক অবশ্য ঝিনচা পার্টি পছন্দ করে না। কিন্তু বিপাশা মিত্র সেটাই চেয়েছিলেন বলিউড স্টাইলের পার্টি, মানি নো অবজেক্ট। অশোক হল প্রফেশনাল। নিজের রুচির সঙ্গে না মিললেও মোস্ট গ্ল্যামারাস একটা পার্টি অ্যারেঞ্জ করেছিল। হলিউডের বেশ কয়েকজন সেলিব্রেটি এসেছিলেন।”
“কতদিন আগে ওই পার্টিটা হয়েছিল স্যার?” একেনবাবু প্রশ্ন করলেন।
“এই সপ্তাহ তিনেক হবে।”
“বব ক্যাসেলকেও আপনি নিশ্চয় চেনেন স্যার?”
“চিনি, তবে তেমন করে নয়।”
“অশোকবাবু চিনতেন?”
“খুব ভালো করে। বিপাশা মিত্রের পার্টির ব্যাপারে অশোকের প্রাইমারি কন্ট্যাক্ট ছিলেন উনিই। সেই সূত্রেই এক আধবার আমার সঙ্গে কথা হয়েছিল। আপনারা চেনেন বব ক্যাসেলকে?”
“অল্পই স্যার।” বলে আর কিছু বললেন না একেনবাবু। মনে হল একেনবাবু ওঁর মৃত্যুর খবরটা দিতে চান না। আমরাও ব্যাপারটা নিয়ে উচ্চবাচ্য করলাম না।
.
পুলিশ যে জিনিসপত্রগুলো লণ্ডভণ্ড করেছে সেটা বোঝা যায়। বিশেষ করে চেস্ট অফ ডুয়ার্সের ভিতরে সবকিছুই ওলট-পালট। ওপরে বইগুলো স্থানচ্যুত হয়নি ঠিকই, কিন্তু সাজানো অবস্থাতেও নেই কয়েকটা আপসাইড ডাউন, মনে হয় পুলিশের বাংলা না জানার ফল। বিছানাটা শুধু পরিষ্কার করে পাতা। বেড-কভার টান টান। ওগুলোতে হয় পুলিশ হাত দেয়নি অথবা পরে ঠিক ঠাক করেছে।
একেনবাবু বিছানার তোশকটা তুলে তুলে দেখলেন নীচে কিছু আছে নাকি। বইপত্রগুলো একটু ঘাঁটলেন। ইন্টারেস্টিং তেমন কিছু আমার চোখে পড়ল না। হোটেল ম্যানেজমেন্টের গোটা দুই বই, ক্রস-ওয়ার্ড পাজল-এর বেশ মোটা একটা বই, আর যে দুয়েকটা ইংরেজি বই ছিল, সেগুলো মনে রাখার মতো নয়। তবে ‘ব্যোমকেশ সমগ্র’ আর ফেলুদার কয়েকটা বই ছিল। অশোক বোধহয় ব্যোমকেশ সমগ্র’ পড়ছিল, বইয়ের মাঝামাঝি পেজমার্ক করার জন্যে একটা কার্ড গোঁজা। একেনবাবু সেটা বার করে পড়লেন। অশোকের কোম্পানির দেওয়া কার্ড, কিন্তু তাতে ওর নিজের পার্সোনাল ইমেল অ্যাড্রেসও কালি দিয়ে লেখা। অ্যাড্রেসটা বেশ মনে রাখার মতো [email protected]। হটমেল-এ অজস্র অশোক আছে, তাই এই লেজুড়। নামের পেছনে সংক্ষেপে নিউ হেরিটেজ হোটেল নিউ ইয়র্ক দিয়ে নামটাকে একমেবাদ্বিতীয়ম করা হয়েছে। একেনবাবুকে কার্ডটা রেখে দিচ্ছিলেন, কী ভেবে ওটাকে পকেটে পুরলেন। একেনবাবু যখন ড্রয়ার হাতড়াচ্ছেন, তখন আরেকটা বই আমার চোখে পড়ল, ‘হাউ টু প্লে পোকার’। বইটার পাতা উলটে দেখলাম ওটা অশোককে দেওয়া এড গুয়ান্সিয়ালের উপহার।
আমি পাতাটার দিকে তাকিয়ে আছি দেখে ইন্দ্র বললেন, “আমরা অশোককে দলে টানার চেষ্টা করছিলাম। তাই এড বইটা এনে ওকে দিয়েছিল।”
“পোকার বাজি রেখে খেলতে হয় না?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
প্রশ্নটাতে ইন্দ্র একটু যেন বিচলিত। “আমরা মাত্র দু-এক পয়সা বাজি রাখি, খেলার শেষে পাঁচ দশ ডলারের বেশি কেউ জেতে না।”
প্রমথ বলল, “চিপসের বদলে পয়সা ব্যবহার করলেও সেটা কিন্তু গ্যাম্বলিং। নিউ জার্সিতে এটা কি লিগ্যাল?”
প্রশ্নটাতে ইন্দ্র একটু নার্ভাস হয়ে গেলেন। “এড তো বলল, অল্প বেটে কোনও অসুবিধা নেই। ওর কাছেই আমি পোকার খেলতে শিখেছি।”
“তা শিখুন, কিন্তু অল্প-প্রেগনেন্ট বলে কোনও কথা নেই, হয় প্রেগনেন্ট কিংবা নয়। সেরকম অল্প-গ্যাম্বলিং বলে কোনও কথা নেই, অল্প-গ্যাম্বলিংও গ্যাম্বলিং। একটু খোঁজ নিয়ে দেখবেন। দু-চার পয়সার জন্যে হাজতবাস করবেন কেন?”
প্রমথটার সত্যি কোনও কাণ্ডজ্ঞান নেই। চেনা হোক, অচেনা হোক –অকারণে মানুষকে ঘাবড়ে দিতে ভালোবাসে। ইন্দ্রের মুখটা কেমন শুকিয়ে গেল।
আমি ইন্দ্রকে ভরসা দিতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু কিছু বলার আগেই ড্রয়ারগুলো বন্ধ করতে করতে একেনবাবু প্রশ্ন করলেন, “এখান থেকে কি কোনও জিনিস পুলিশ নিয়ে গেছে স্যার?”
“তা তো বলতে পারব না। যখন পুলিশ এসেছিল, তখন আমি ছিলাম না, দেবরাজদা ছিল।”
“অশোকবাবু কি অফিসে ওঁর পার্সোনাল জিনিস কিছু রাখতেন?”
“তাও বলতে পারব না। একটা পার্সোনাল লকার আমাদের আছে। সেখানে যদি কিছু থেকে থাকে।”
“তার চাবি?”
“অফিস সিকিউরিটির কাছে একটা থাকবে। আর সব কিছু এখন পুলিশের হেফাজতে।”
“পুলিশ কী কী নিয়েছে তার লিস্ট কি আপনার কাছে আছে?”
“না, দেবরাজদার কাছে বোধহয় কপি আছে।”
“ফাইনাল প্রশ্ন স্যার, অশোকবাবুর কাছে বা ওঁর ঘরে কোনও ফটোগ্রাফ দেখেছিলেন?”
“হ্যাঁ, ওই তো। আঙ্কল আর আন্টির ছবি। ইন্দ্র আঙুল দিয়ে দেখালেন।
“না, না, স্যার, এটা না। এই ধরুন, একটা পুকুরের সামনে দু’জন লোকের ছবি।”
“না, তেমন কোনও ফটো তো চোখে পড়েনি!” ইন্দ্রর চোখে বিস্ময়।
“কোনও খাম দেখেছিলেন স্যার, স্ট্যাম্প লাগানো পুরোনো খাম?”
“ইন্ডিয়ার?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“ইন্ডিয়া থেকে এক আধটা চিঠি আসতে দেখেছি।”
“ওঁর চিঠিপত্রগুলো কোথায় থাকে?”
“যা থাকার ঐ ড্রয়ারেই থাকে। বহু চিঠি ও ফেলে দিত।”
“ড্রয়ারে কোনো চিঠি নেই স্যার।”
“যেগুলো ছিল, সেগুলো হয়তো পুলিশ নিয়ে গেছে।”
.
ইন্দ্রের বাড়ি থেকে যখন বেরোচ্ছি, তখন একেনবাবু হঠাৎ থেমে মুখ ঘুরিয়ে যে প্রশ্নটা করলেন, সেটা আমি এক্সপেক্ট করিনি। কারণ পোকার নিয়ে যখন আমরা কথা বলছিলাম, উনি তখন ড্রয়ার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। কানে একটা কথাও ঢুকছিল বলে মনে হয়নি। কিন্তু হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, “ও হ্যাঁ স্যার, আরেকটা প্রশ্ন করতে তো ভুলে গেলাম, অশোকবাবু কি কোনোদিন আপনাদের সঙ্গে পোকার খেলতে বসেছিলেন?”
আবার পোকার নিয়ে প্রশ্নে ইন্দ্রের মুখেচোখে অসোয়াস্তিটা পরিষ্কার। বললেন, “একবার এড প্রায় জোরজুলুম করে বসিয়েছিল।”
“হেরেছিলেন, না জিতেছিলেন?”
“ঠিক মনে নেই।”
“কতদিন আগের কথা স্যার?”
“প্রায় দিন কুড়ি।”
“কিন্তু আপনার মনে নেই স্যার?”
“বোধহয় জিতেছিল। ও হ্যাঁ, মনে পড়েছে, জিতেছিল। বিগিনার্স লাক।”
“তারপর উনি আর খেলেননি?”
“না।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার?” বলে হাঁটা দিলেন একেনবাবু। আবার থামলেন। মাথা চুলকোতে চুলকোতে ফিরে তাকিয়ে একটু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “উনি কি স্ট্যাম্প জমাতেন
স্যার?”
ইন্দ্র ঘরের দরজা প্রায় ভেজিয়ে ফেলেছিলেন। মুখটা বার করে বললেন, “না।”
“থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ স্যার।”
ইন্দ্রর মুখের এক্সপ্রেশনটা দেখার মতো। আমরা অদৃশ্য না হওয়া পর্যন্ত উনি দরজা খুলে দাঁড়িয়ে রইলেন। পাছে আরেকটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়।
.
গাড়ি স্টার্ট দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি ফটো আর স্ট্যাম্প নিয়ে এত প্রশ্ন করলেন যে? আপনার কি ধারণা বিপাশার ফটো চুরির সঙ্গে অশোকের মৃত্যুর কোনো যোগ আছে?”
“আই হ্যাভ নো ফ্লু স্যার। বিপাশা ম্যাডামকে অশোক চিনতেন জানলাম, সুতরাং ফটোটা দেখে থাকতে পারেন। টাকার লোভে হয়তো চুরিও করতে পারেন। হু নোজ?”
“করে থাকলে তো আপনার সুবিধাই হয়, এক ঢিলে দুই পাখি মারা যায়!” প্রমথ বলল।
“এটা ভালো বলেছেন স্যার।”
“হয়তো বব ক্যাসেলও ফটো চুরির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ব্যাপারটা জানিয়ে রাখবেন।” প্রমথ ঠাট্টার ছলেই কথাটা বলল।
“কিছুই অসম্ভব নয় স্যার।”
“বিশেষ করে অশোক আর বব ক্যাসেল যখন দু’জনে দু’জনকে চিনতেন। বব ক্যাসেল যদি সত্যিই খুন হয়ে থাকেন ইট উড বি টু মাচ অফ এ কোয়েন্সিডেন্স। আপনি এটা নিয়ে সিরিয়াসলি একটু খোঁজ খবর করুন,” আমি বললাম।
“তা তো করতেই হবে স্যার, আপনারা যখন সন্দেহ করছেন ফটো চুরির সঙ্গে দুটো খুনের যোগ আছে।”
“ও, আর আপনি করছেন না? শুধু আমরা বলছি বলেই আপনি ওতে মাথা গলাবেন! আপনি মশাই সামথিং!” প্রমথ বলল।
একেনবাবু আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “প্রমথবাবু না স্যার, সত্যি!”
“প্রমথর কথা ছাড়ন,” আমি বললাম, “ওর শুধু একটাই গুণ আমাদের রান্না করে খাওয়ায়। সেই গুণে সব দোষ মাপ।”
“তোদের পছন্দ করি বলেই, খোঁচাগুলো দিই। মনে রাখিস, তোমার প্রেমে আঘাত আছে, নয় তো অবহেলা’– প্রমথ গুনগুন করে গেয়ে উঠল।”
“ওরে বাবা, একেবারে গুরুদেবের গান ধরলি, আমি ইমপ্রেসড!”
“শুনলেন,” একেনবাবুকে প্রমথ বলল, “কে কাকে খোঁচা মারছে?”
.
৭.
সোমবার, মে ১৬, ২০১১
এই সময়টা আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি। ক্লাস থাকে না ঠিকই, তবে কাজ থাকে–
সেমিনার, ছাত্রদের অ্যাডভাইস দেওয়া, নিজের রিসার্চ, এছাড়া ডিপার্টমেন্টের অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ কিছু কাজ। আজ একটা সেমিনার ছিল, তার ওপর কয়েকটা ছাত্রের সঙ্গে মিটিং। কোনও মতে কফি খেয়ে কলেজ চলে এসেছি। পত্রিকাটাও ভালো করে পড়তে পারিনি। তবে বব ক্যাসেলের মৃত্যুর খবরটা দেখেছি বেরিয়েছে। ছোট্ট করেই দিয়েছে, তবে নতুন কিছু তথ্য পেলাম। যে হাই রাইজ বিল্ডিং থেকে উনি পড়ে যান সেটা বিপাশা মিত্রেরই প্রপার্টি। ওখানে কিছু কনস্ট্রাকশন চলছে, সেই সূত্রেই বব ওখানে মাঝে মাঝে যেতেন। সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ উনি যখন বাইশ তলায় উঠেছিলেন, তখন সেই তলায় সম্ভবত আর কেউ ছিল না, কারণ রবিবারে ওখানে কোনও কাজ হয় না। পুলিশ তদন্ত শুরু করেছে। এখানে খবরের সঙ্গে বয়সটাও থাকে। ববের বয়স হয়েছিল ৩৫। এটা যে সুইসাইড, তার কোনও উল্লেখ অবশ্য দেখলাম না। তবে যে ভাবে তথ্যগুলো দেওয়া হয়েছে, তাতে সেটা মনে হওয়াই স্বাভাবিক। এ নিয়ে একেনবাবু বা প্রমথ কারো সঙ্গেই কথা বলার ফুরসত পাইনি।
.
সকালের কাজগুলো সেরে লাঞ্চ খেতে গিয়ে ক্যাফেটেরিয়াতে ফ্রান্সিস্কার সঙ্গে এক ঝলক দেখা। আজ সন্ধ্যায় যে একেনবাবু আমাদের সবাইকে খাওয়াচ্ছেন ইতিমধ্যেই ও জানে। এমন কি একেনবাবুকে যে একটা ব্লু সাফায়ার কিনে দিতে হবে, সেটাও প্রমথ ওকে বলেছে। আমাকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি রাজু চুগানিকে চেন?”
“না।”
“শি নোজ ইউ!” এমন ভাবে আমায় কথাটা বলল, যেন আমি ইচ্ছে করে পরিচয়টা চেপে যাচ্ছি।
আমাকে একজন মেয়ে চেনেন, আর আমি তাঁকে চিনি না! হঠাৎ মনে পড়ল লাইব্রেরিতে একজন নতুন ভারতীয় মেয়ে কাজ করছেন, তাঁর ডেস্কে বোধহয় ওই নামেরই একটা নেমপ্লেট দেখেছি।
“লাইব্রেরিতে যিনি কাজ করছেন?”
“ইয়েস। ওর বর হেমন্ত একজন বড় ডায়মন্ড মার্চেন্ট। ইস্ট ফর্টিফিফথ স্ট্রিটে তার একটা দোকান আছে। রাজু প্রমথ আর আমাকে একবার নিয়েও গেছে ওখানে। ওখানেই ডিনারের আগে সবাই মিলে যাব।”
সকালের মধ্যে যে এতগুলো প্ল্যান হয়ে গেছে আমি ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। কিন্তু প্রমথ ফ্রান্সিস্কাকে নিয়ে ডায়মন্ডের দোকানে গেছে, ব্যাপারটা কি? ব্যাটা নিশ্চয় ফ্রান্সিস্কাকে এনেগেজমেন্ট রিং দেবার কথা ভাবছে? রাস্কেলটা তো একবারও আমাকে বলেনি! আমি একটু চোখ টিপে ওকে জিজ্ঞেস করলাম, “শুড আই এক্সপেক্ট সাম গুড নিউজ সুন?”
“মে বি,” বলে মুচকি হেসে ফ্রান্সিস্কা চলে গেল।
চারটে বাজতে না বাজতেই ওরা সবাই আমার অফিসে এসে হাজির। মেয়েদের গয়নার প্রতি আকর্ষণ একেবারে ইউনিভার্সাল। ফ্রান্সিস্কারই এ ব্যাপারে সবচেয়ে উৎসাহ। একেনবাবুকে বলল, “ডিটেকটিভ (ওই নামেই ফ্রান্সিস্কা একেনবাবুকে সম্বোধন করে), যখন জুয়েলরি শপ-এ যাচ্ছ, তখন তোমার বৌয়ের জন্যেও একটা আংটি কেন। দশ বছর একটা বড় মাইলস্টোন।”
বেচারা একেনবাবু। প্রমথই বাঁচাল। “একে শনির দশা চলছে, তার ওপর আমাদের খাওয়াতে হবে, নীলা কিনতে হবে। এর ওপর যদি আর একটা আংটি কেনার চাপ দাও, উনি হার্টফেল করবেন– শনির দশা একেবারে ষোলকলায় পূর্ণ হবে।”
“ডোন্ট বি সিলি!” প্রমথকে একটা ধমক দিল ফ্রান্সিস্কা। তারপর একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা ডিটেকটিভ, এই স্যাটার্নের ব্যাপারটা কি?”
“ব্যাপারটা খুব গোলমেলে, ম্যাডাম। কুষ্ঠি মানে বার্থ চার্টের একটা বাজে গ্রহ হল শনি। সময়ের সাথে সাথে চার্টে শনির পজিশন বদলায়। এক একটা পজিশনে শনি তার কুদৃষ্টি ফেলে, সেটাই ডেঞ্জারাস সময়। কঠিন কঠিন অসুখ–শ্বাসরোগ, যক্ষ্মা, হাড়ের রোগ… এগুলো তো আছেই, এমন কি মৃত্যুও এই শনির হাতে।”
“মাই গড!”
“কিছু বুঝলে?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“নট রিয়েলি।”
“বোঝার কিছু নেই, পুরো জিনিসটাই ধাপ্পাবাজি।”
ফ্রান্সিস্কা প্রমথর কথা কানে তুলল না। বলল, “সত্যি ডিটেকটিভ! ব্লু স্যাফায়ার সঙ্গে থাকলে শনি কিছু করতে পারবে না? তাহলে তোমার সঙ্গে আমিও একটা ব্লু স্যাফায়ার কিনব।”
নিশ্চয় মজা করেই বলল। কিন্তু একেনবাবু খুব সিরিয়াস হয়ে গেলেন। “না, না ম্যাডাম, নীলা সবার স্যুট করে না, আপনি অন্য কিছু পরবেন।”
বোঝা যায় রাজুর বর হেমন্ত চুগানি বেশ পয়সা-অলা ডায়মন্ড মার্চেন্ট। কুড়ি তলার ওপর একটা পেন্ট হাউসে ওঁর দোকান। ছোটো ছোটো অনেকগুলো ঘর, সেখানে প্রাইভেটলি কাস্টমারদের ডায়মন্ড দেখানো হয়। কিছু ডায়মন্ড ডিসপ্লেতে দেখলাম। ডায়মন্ডের দাম সম্পর্কে আমার কোনও ধারণা নেই। তবে ম্যানহাটানে এত বড় জায়গা জুড়ে যার দোকান, তার ভাড়া মেটাতে গেলে বেশ ভালো রকমের রোজগার দরকার, ইউনিভার্সিটি লাইব্রেরিতে বৌয়ের চাকরির ওপর ভরসা করা চলে না। লাকিলি আমরা যখন গেছি, দোকানে কেউই ছিল না। ফ্রান্সিস্কাকে দেখে হেমন্ত ওঁর নিজের ঘরে আমাদের নিয়ে বসালেন। কথায় কথায় জানলাম যে, ওঁর স্ত্রী রাজু কিছুদিন এখানে সেলস-এ ছিলেন, কিন্তু কাজটা তেমন ভালো না লাগায়, হেমন্তই রাজুকে লাইব্রেরিয়ানশিপ পড়ান। একটু গর্বভরেই হেমন্ত জানালেন রাজুর ভালো নাম রাজশ্রী, এক কালে নাকি বলিউডের দুয়েকটা ছবিতে হিরোইন হিসেবে নেমেছিলেন। আমি অবশ্য মনে করতে পারলাম না। একজন রাজশ্রীর নাম আমি বাবা-মার কাছে শুনেছি। ষাটের দশকে খ্যাতির তুঙ্গে একজন আমেরিকানকে বিয়ে করে লস এঞ্জেলেস না কোথায় চলে এসেছিলেন। এই রাজশ্রীর বয়স বড় জোর তিরিশ হবে। তবে কিনা বলিউড থেকে অজস্র ছবি রিলিজ করে, অল্প কটিই হিট হয়। আমাদের এইসব কথাবার্তার মধ্যেই রাজু এসে হাজির। ফ্রান্সিস্কাকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন, আমাদেরও হায়’ বললেন। বলিউডের কি ম্যাজিক! আমি এতদিন রাজুকে দেখে তেমন সুন্দরী ভাবিনি। এখন মনে হল, না, একটা আকর্ষণীয়তা ওঁর মধ্যে আছে।
আমাদের দোকানে আসার কারণ দেখলাম হেমন্ত আগে থেকেই জানেন। ফ্রান্সিস্কা নিশ্চয় রাজুকে বলেছে, রাজু হেমন্তকে। হেমন্ত বললেন, “ব্ল স্যাফায়ার আমার কাছে আছে, কিন্তু আমি ওগুলো চেনাজানা লোককে দিতে একটু দ্বিধা বোধ করি।”
এই প্রথম একেনবাবু মুখ খুললেন, “কেন স্যার?”
“এটা সবার ঠিক স্যুট করে না। কিনে নেবার পর নানান সমস্যা হয়।”
“এটা কি কোনও সায়েন্টিফিক স্টাডি থেকে বলছেন, না আপনার ধারণা?” প্রশ্নটা প্রমথর।
“সায়েন্টিফিক স্টাডি আমরা কী করব বলুন, বাপ-ঠাকুরদার কাছে যা শুনেছি সেই থেকে বলছি।”
“আপনার নিজের কোনও অভিজ্ঞতা আছে?”
“তেমন নেই, তবে কিছুদিন আগে আমার পরিচিত এক সাহেব আমার দোকান থেকে একটা ব্র-স্যাফায়ারের আঙটি কিনে নিয়ে গেলেন। আমি তাকেও বিক্রি করার আগে একই কথা বলেছিলাম। উনি হেসে উড়িয়ে দিলেন কথাটা। সেদিন শুনলাম ইন্ডিয়াতে গিয়ে খুন হয়েছেন।”
“সেটা কি ব্লু-স্যাফায়ারের জন্যে না ভাগ্যের দোষে?”
“হু নোজ। কিন্তু আপনারা রাজুর বন্ধু, তাই সতর্ক করছি। আপনারা কিনলে তো আমারই লাভ।”
“ভদ্রলোকের নামটা কী স্যার– যিনি মারা গেলেন?”
“জন হেক্টার। এক সময়ে ইন্ডিয়াতে প্রায়েই যেতেন। তখনই আমার বাবার সঙ্গে ওঁর পরিচয় হয়। বেশ নামকরা লোক, পত্রিকাতেও খবরটা বেরিয়েছিল।”
“ইনিই কি বিখ্যাত আর্ট ক্রিটিক?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“ঠিক। ওই আর্ট নিয়েই বাবার সঙ্গে ওঁর আলাপ। বাবারও আর্ট, স্কাল্পচার, ইত্যাদিতে নেশা ছিল। আমি তখন খুব ছোটো ত্রিচি-তে থাকতাম। উনি এসেছিলেন তামিলনাড়ুর মন্দিরগুলোর উপরে একটা বই লিখবেন বলে। এনিওয়ে এসব আমার মনেও ছিল না। হঠাৎ করে একটা পার্টিতে ওঁর সঙ্গে দেখা হয়। আমার পদবী শুনে আমার বাবার নাম জানতে চান, তখনই পুরোনো সূত্রটা বেরিয়ে পড়ে। তারপর আমাদের বাড়িতে কয়েকবার এসেছেন। এই দোকানেও।”
কথাগুলো বলতে বলতে হেমন্ত ড্রয়ার থেকে কয়েকটা জুয়েলারি বাক্স বার করলেন। তার একটা খুলে বড়সড় নীলার একটা আংটি দেখালেন।
“কী রকম দাম এটার?”
“তিন হাজার।”
“তিন হাজার… মানে ডলার!” একেনবাবু প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন।
আমি বললাম, “এর থেকে সস্তা কিছু নেই?”
“এটা আছে– দু’হাজারের মধ্যে।” আরেকটা বাক্স খুলে দেখালেন হেমন্ত।
“দু-তিনশোর মধ্যে কিছু নেই?” একেনবাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“আসল নীলা ওই দামে পাবেন না। খুব ছোটো সাইজের নীলা একসঙ্গে সেট করা অবস্থায় যদি পান। আমি সে সব জিনিস রাখি না। আর্টিফিশিয়াল নীলায় যদি চলে, তাহলে একশো ডলারের কমেও পাবেন। অন-লাইনেই কিনতে পাবেন।”
“আর্টিফিশিয়াল নীলা কি স্যার ইকুয়ালি এফেক্টিভ?”
“আপনাকে কি কেউ এটা পরতে বলেছেন?” হেমন্ত জিজ্ঞেস করলেন।
“হ্যাঁ স্যার।”
“তা হলে মনে হয় জেনুইন জিনিসই ব্যবহার করা উচিত।”
বেচারা একেনবাবু, মুখটা দেখলাম কাঁচুমাচু। শনির দশা কাটাবেন, না দু’হাজার ডলার গচ্চা দেবেন! প্রমথ একেনবাবুকে অনবরত বাক্যবাণে বিদ্ধ করলেও, সত্যিকারের বিপদের সময় ঠিকই এগিয়ে আসে। বলল, “আপনি শুধুই দুশ্চিন্তা করছেন। ন্যাচারাল নীলা আর আর্টিফিশিয়াল নীলার কেমিস্ট্রির কোনও তফাৎ নেই –দুটোই আসলে কার্বন। দুটোই তৈরি হয়েছে প্রবল চাপের ফলে। খনিতে পাওয়া যায় ন্যাচারাল নীলা, আর্টিফিশিয়াল নীলা বানানো হয় ফ্যাক্টরিতে, কার্বনকে কৃত্রিম ভাবে চাপ দিয়ে। দুটোর এফেক্টই এক হওয়া উচিত।”
কথাটা একেনবাবুর মনে ধরল। “এটা ভালো বলেছেন স্যার একেবারে ফান্ডামেন্টাল প্রিন্সিপল থেকে। তাহলে তাই করি।” তারপর হেমন্তের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আপনার অনেক সময় নষ্ট করলাম স্যার।”
“এতটুকু নয়। আপনারা রাজুর বন্ধু এটুকু সময় আপনাদের দিতে পারব না!”
ফেরার পথে আমিই প্রশ্নটা তুললাম। “আচ্ছা, জন হেক্টার হঠাৎ নীলা কিনতে গেলেন কেন?”
“প্রশ্নটা আমাদের না করে হেমন্তকে করলেই পারতিস, প্রমথ বলল।
“হেমন্ত উত্তরটা জানে সেটা কেন ভাবছিস?”
“কারণ জানার তবু একটা সম্ভাবনা আছে, যা আমাদের একেবারেই নেই।”
.
৮.
শুক্রবার মে ২০, ২০১১
[একেনবাবুর কাহিনি আমি আমার ডায়রির নোটগুলো দেখে লিখি। লিখতে বসে দেখছি সোমবারের পরে কোনো এন্ট্রি নেই। পরের এন্ট্রি শুক্রবার থেকে আরম্ভ হয়েছে। এখন মনে পড়ছে একেনবাবু দিন চারেক অন্য একটা কাজে বাইরে গিয়েছিলেন।]
আমাদের ডিপার্টমেন্টে দু’জন অফিস অ্যাসিস্টেন্ট। যে সিনিয়র, তার নাম হেলেন ওয়েবার। পঞ্চাশ পঞ্চান্ন বছরের ব্রুনেট, মোটাসোটা মেট্রন টাইপ। অসম্ভব এফিশিয়েন্ট। ডিপার্টমেন্টের সবকিছু ওর নখদর্পণে। মাস চারেক হল একটি নতুন মেয়ে কাজে ঢুকেছে, নাম বেভার্লি বেসিমার। বেভার্লি বা বেভের বয়স তেইশ কি চব্বিশ। সোনালি চুল, নীল চোখ, সুন্দর ফিগার, অ্যাট্রাক্টিভ চেহারা। লোকাট টপ আর শর্ট স্কার্ট ছাড়া কখনো ওকে দেখিনি। আগে ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টে ছিল, সেখান থেকে বোধহয় তাড়িত হয়ে এখানে এসেছে। সবসময়েই দেখি চেয়ারে বসে নানারকম খুটখাট করে নিজেকে আরও সুন্দরী করার চেষ্টা করছে। কোনও কাজ করতে বললেই মুখটা ভারী হয়ে যায়। ফলে যা দরকার তা হেলেনকেই বলি। এর ওর মুখে শুনি বেভ নাকি ভীষণ পার্টি গার্ল, হাজার হাজার ছেলেকে নাচায়। কথাটায় সত্যতা কিছুটা নিশ্চয় আছে। আমাদের ডিপার্টমেন্টে আসছে জেনে ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টের রামসুন্দর রেড্ডী আমাকে সাবধান করেছিল, “অ্যাভয়েড হার লাইক এ প্লেগ। এটা আমি অক্ষরে অক্ষরে পালন করি। আমার এক সিনিয়র কলিগ বেভকে ফাদারলি অ্যাডভাইস দিতে গিয়েছিল। বলেছিল, “তুমি এত লো-কাট টপ পরে এসো না, এটা অ্যাকাডেমিক ইনস্টিট্যুশন– অনেকে এতে অসুবিধা বোধ করে।
“ডিস্ট্রাক্টেড হয়’ কথাটা বোধহয় বলেনি। বেভ নাকি মুচকি হেসে উত্তর দিয়েছিল, ‘আমাকে কেন বদলাতে বলছ, প্রব্লেমটা তো ওদের।
কথাটা যে খুব ভুল তা নয়। প্রাচীন কালে অপ্সরাদের দেখে মুনিঋষিদের যখন পদস্খলন হত, তখন পাপ বা দোষটা মুনিঋষিদের ওপরেই বর্তাত, অপ্সরাদের ওপরে নয়। যাক সে কথা, আমার এক পুরানো ক্লাস ফ্রেন্ড কিশোর রাও হঠাৎ বেভের প্রেমে পড়েছে। একদিন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তখনই নিশ্চয় পরিচয় হয়েছিল—ডিটেলটা আমি জানি না। যেটা জানি, কিশোরের অবস্থা এখন বেশ শোচনীয়। বেভ নিশ্চয় প্রেমের ব্যাপারে উদারপন্থী। একজনের সঙ্গে প্রেম করছে বলে, অন্য কারো প্রেম ফিরিয়ে দেবে, এমন সঙ্কীর্ণমনা সে নয়। ফলে জটিলতা দেখা দিয়েছে। এই জটিলতার মধ্যে অনিচ্ছাসত্বেও আমি জড়িয়ে পড়েছি। প্রেমের ব্যাপারে আমি যে কমপ্লিট ফেইলিওর, বার বার জানিয়েও কিশোরের হাত থেকে নিষ্কৃতি পাইনি। ওর ধারণা আমি খুব ধীরস্থির বিচক্ষণ লোক, নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে সব কিছু যাচাই করতে পারি। তার ওপর বেভকে আমি চিনি, তাই তার কথা বা হাবভাবের পেছনে সত্যিকারের যে সঙ্কেত লুকিয়ে আছে সেটা আমিই একমাত্র ধরতে পারব। কোয়ায়েট এ কমপ্লিমেন্ট, যদিও রংলি প্লেস্ট। এই চারমাসে আমি বেভের সঙ্গে সব মিলিয়ে আধ ঘণ্টা সময় ব্যয় করেছি কিনা সন্দেহ। যখন করেছি, নিতান্ত দায় ঠেকে। কিন্তু সেগুলো সবিস্তারে জানিয়েও নিষ্কৃতি পাইনি। আমার ধারণা কিশোর একজন শ্রোতা চায়। ইদানীং তাই ওর সঙ্গে বসে মাঝেমাঝেই আমায় কফি খেতে হয়।
.
কিশোরের সঙ্গে কফি খাব বলেই বেরিয়েছিলাম। কফি কর্নারটা আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে যাবার পথেই পড়ে, কলেজ থেকে মাত্র দু’ব্লক দূরে। হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ দোকানটা নজরে পড়ল। এতদিন এই পথে কত হেঁটেছি, কিন্তু চোখে পড়েনি। চোখে না পড়ারই মতো। ঢোকার মুখটা সরু, সাইনবোর্ডটাও সাদামাটা। ফিলাটেলিস্ট কর্নার এমন ভাবে লেখা, সেটা উদ্ধার করতে যে সময়টা লাগবে ম্যানহাটানের ব্যস্ত পথচারীদের তা নেই। আজকেও নজরে পড়ত না, যদি না সেখান থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে আমার সামনে এসে দাঁড়াতেন!
“হ্যালো দেয়ার, আপনাকেই খুঁজছি, আপনার স্ট্যাম্পের একজন কাস্টমার পাওয়া গেছে।”
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “আমার স্ট্যাম্পের কাস্টমার? কী বলছেন আপনি?”
ভদ্রলোক একটু যেন থতমত খেয়ে গেলেন। “আপনি যে স্ট্যাম্পটা বিক্রি করতে এনেছিলেন, সেটার কথা বলছি।”
“আপনি নিশ্চয় লোক ভুল করছেন।”
“ও, আই অ্যাম সো সরি, কিছু মনে করবেন না”, ভদ্রলোক লজ্জা পেয়ে দ্রুত দোকানে ঢুকে গেলেন।
.
পাঁচটার সময় কিশোরকে বলেছি কফি কর্নারে আসব, কী একটা নতুন ডেভালপমেন্ট হয়েছে সেটা নিয়ে আলোচনা করতে চায়! কফি হাউসে পৌঁছে দেখলাম কিশোর নেই। ঘড়িতে পাঁচটা কুড়ি। নিশ্চয় অধৈর্য হয়ে চলে গেছে। যাবার আগে আমাকে একটা ফোন করতে পারল না?
শেষবারের মতো উঁকিঝুঁকি মেরে বেরোতে যাব, দেখি রাজু আর তার বর হেমন্ত এক বৃদ্ধ ভদ্রলোককে নিয়ে কফি খাচ্ছেন। আমাকে দেখে রাজু হাত নেড়ে ডাকলেন।
“আপনার ফোন তো সুইচড অফ?”
সুইচড অফ! ফোনটা পকেট থেকে বার করতে করতেই মনে পড়ল দুপুরে একটা সেমিনারে ঢোকার আগে ওটা বন্ধ করেছিলাম, তারপর চালু করা হয়নি। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি এই গোপন তথ্যটা জানলেন কী করে?”
মুচকি হাসলেন রাজু। “কিশোর আমাদের সঙ্গেই এতক্ষণ বসে ছিল, আপনাকে ধরার চেষ্টা করছিল।”
“আপনি কিশোরকে চেনেন?”
“কিশোর আমার দাদার ছেলেবেলার বন্ধু। যেটা জানতাম না, সেটা হল কিশোরভাই আপনার এত বন্ধু।”
“স্মল ওয়ার্ল্ড।”
হেমন্ত বললেন, “বসুন না, একটু কফি খান আমাদের সঙ্গে।” বলে কফির অর্ডার করলেন।
খুব একটা বসার ইচ্ছে ছিল না, তাও বসলাম। “মিস্টার সেন কি নীলার আংটি কিনেছেন?” হেমন্ত জিজ্ঞেস করলেন।
“ইন্টারনেটে সেদিন খুঁজছিলেন দেখেছি, কিন্তু আঙ্গুলে ফিট করবে কি না, সে নিয়ে দুশ্চিন্তা করছিলেন।”
“আপনারা সেদিন চলে যাবার পর রাজু রাগ করল। বলল, আমার আরও হেল্পফুল হওয়া উচিত ছিল। একশো দু’শো ডলারের মধ্যে আর্টিফিশিয়াল নীলা নিশ্চয় জোগাড় করে দিতে পারতাম। কিন্তু মুশকিল কি জানেন? শনির দশা কাটাতে চাইলে জেনুইন জিনিসের উপরই ভরসা করা উচিত।”
আমি একটু ইতস্তত করে বললাম, “সেদিন অবশ্য এ নিয়ে একবার কথা হয়েছে, তাও আরেকবার জিজ্ঞেস করছি, আপনি কি সত্যি সত্যি নীলার এফেক্টে বিশ্বাস করেন?”
“করি। আমি জুয়েল বেচে খাই, এগুলো বিশ্বাস না করলে বেচব কেন? ওই যা, আপনার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়নি। ইনি আমার আঙ্কল মিস্টার বিলাস চুগানি। ইন্ডিয়া থেকে বেড়াতে এসেছেন। আর ইনি প্রফেসর দে, রাজুর ইউনিভার্সিটিতে পড়ান।”
.
বৃদ্ধ ভদ্রলোক এতক্ষণ ব্লু-লেস মুখ করে আমাদের কথা শুনছিলেন। হেমন্ত পরিচয় করিয়ে দিতেই হাত জোড় করে বললেন, “নমস্তে।”
আমিও নমস্কার করলাম।
হেমন্ত ওঁর আঙ্কলকে সংক্ষেপে আমাদের কথাগুলোর সূত্র ধরিয়ে দিলেন। সেটা শুনে মিস্টার চুগানি বললেন, “তুমি ঠিকই করেছ হেমন্ত, নীলা নিয়ে ছেলেখেলা নয়। সবাইকে।
ওটা বিক্রি করা ঠিক নয়, দেখলে তো জন হেক্টারের কী হল?”
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি জন হেক্টারকে চিনতেন?”
“খুব ভালো করে। সেকি আজকের কথা ১৯৭০ সাল থেকে চিনি। সাউথ ইন্ডিয়ার টেম্পেল আর্কিটেকচার নিয়ে একটা বই লিখবে বলে এসেছিলেন। মন্দিরের প্রচুর ছবি তুলেছিলেন। ত্রিচিতেও ছিলেন বেশ কিছুদিন, সেখানেই আমার আর হেমন্তের বাবার সঙ্গে ওঁর আলাপ। ত্রিচিতে থাকতে থাকতেই ইংল্যান্ডের একটা কাগজের স্টাফ রিপোর্টারের কাজ পেয়ে গিয়ে বেশ কয়েক বছর ইন্ডিয়াতে ছিলেন।”
“উনি মারা গেলেন কী ভাবে?”
“সেটাই রহস্য। কিছুদিন আগে উনি আবার ইন্ডিয়াতে এসেছিলেন। আমি যেদিন দেশ থেকে রওনা দিই, তার ঠিক দু’দিন আগে আমার বাড়ি এসে খুব হইচই করলেন। পুরোনো দিনের অনেক কথা হল। তখনই হেমন্তের কাছ থেকে কেনা আংটিটা দেখালেন। আমি অবশ্য সাবধান করলাম জ্যোতিষ না দেখিয়ে নীলা ধারণ করার ব্যাপারে। একেবারেই পাত্তা দিলেন না। যেদিন আমার ফ্লাইট, সেদিন সকালে নিউজে শুনি হোটেলে কেউ ওঁকে গুলি করেছে!”
“আশ্চর্য! আচ্ছা, ওঁর কথাবার্তায় এরকম যে কিছু ঘটতে পারে আঁচ করতে পেরেছিলেন কি?”
“একেবারেই নয়। সাউথে বহুদিন উনি কাটিয়েছেন, এসেছিলেন পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে। প্রথম দিনই ফোনে পরিচিত অনেকের খবর নেন। যাদের ফোন নম্বর আমার কাছে ছিল সেগুলো দিই। শুধু একজনের খবর আমি জানতাম না। জানতে চেয়েছিলেন, কল্পনা কোথায় আছে? প্রথমে বুঝিনি কার কথা বলছেন। তারপর মনে পড়ল বহু বছর আগের ঘটনা। ত্রিচিতে একটা টেম্পল মার্ডার কেসে যে কনভিক্টেড হয়েছিল তার কথাই নিশ্চয় হবে। কল্পনাকে আমি চিনতাম না। তবে ওর বাবাকে আমার বাবা চিনতেন। তিনি ছিলেন সেই মন্দিরের পুরোহিত।”
“মাই গড, টেম্পলে এরকম মার্ডার হয়?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“আপনি সাউথ ইন্ডিয়ায় মন্দিরগুলো দেখেছেন কিনা জানি না, সেখানে ভক্তদের দেওয়া সোনাদানা হীরে জহরৎ যা থাকে, তা যে কোনও ব্যাঙ্কের ডোল্ট বা রাজা মহারাজার সিন্দুককে হার মানাতে পারে। চুরি-ডাকাতির বড় টার্গেট।”
“কিন্তু জন হেক্টার ওই মহিলার খোঁজ করছিলেন কেন? উনিও কি চুরি-ডাকাতি করার প্ল্যান করছিলেন? নিশ্চয় ওই নীলা-ধারণের ফল!” আমি একটু ফাজলামি করেই কথাটা বললাম।
মিস্টার চুগানি বোধহয় ঠাট্টাটা বুঝলেন না। এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললেন, “তুমি ইয়ং ম্যান, তার ওপর বাঙালি– তুমি বা তোমরা হয়তো ভাব এগুলো কুসংস্কার। কিন্তু ট্রাস্ট মি, নীলা সবার স্যুট করে না, এটা নিয়ে ছেলেখেলা করা উচিত নয়, এর এফেক্ট কুড বি ডেঞ্জারাস।”
.
ইতিমধ্যে কফি এসে গেছে। আমি বৃদ্ধ ভদ্রলোকের বিশ্বাসে আর আঘাত করতে চাইলাম না, কফিতে চুমুক দিয়ে বললাম, “ইউ মে বি রাইট। কিন্তু একটা জিনিস এখনো স্ট্রেঞ্জ লাগছে, মিস্টার হেক্টার হঠাৎ ওই মহিলার প্রসঙ্গ তুললেন কেন, ওঁরা কি বন্ধু ছিলেন?”
“তা বলতে পারব না। পরিচয় নিশ্চয় থাকতে পারে, মন্দির নিয়ে যখন বই লিখছিলেন।”
এমন সময় আমাকে অবাক করে দিয়ে হেমন্ত বললেন, “আমি কিন্তু জানতাম জন হেক্টার কল্পনার খোঁজ করবেন। উনি ক্রিমিনালদের নিয়ে ফলো-আপ স্টোরি লিখছিলেন। অপরাধ করে দোষী ধরা পড়লে, তার শাস্তি না হওয়া পর্যন্ত খুব হইচই হয়। তারপরে তাদের কথা সবাই ভুলে যায়। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে তারা কে কী করছে, সেই খবরটা আর পাওয়া যায় না। ওঁর লেখা সেই সব গল্প কাহিনি পত্রিকায় মাঝে মাঝে বেরোয়। যাবার আগে আমায় কল্পনার গল্পটা বলেছিলেন।”
“কী গল্প?” আমি প্রশ্ন করলাম।
“বিরাট কোনও গল্প নয়। আঙ্কল যা বললেন তাই… ইট ওয়াজ এ রবারি, সেটা আটকাতে গিয়ে একজন খুন হয়। তবে পুলিশ বুঝতে পেরেছিল কল্পনা একা কাজটা করেনি, কিন্তু দলে আর কারা জড়িত– সেটা উদ্ধার করা যায়নি। পুলিশের অনুমান অন্য যারা ছিল তাদের মধ্যে একজন কল্পনার বয়ফ্রেন্ড।” এটা বলে হেমন্ত ওর আঙ্কলকে জিজ্ঞেস করল, “তুমিও কি এটা শুনেছিলে?”
“হ্যাঁ, এরকমই কিছু একটা শুনেছিলাম। এও শুনেছিলাম জেলে কল্পনা খুব মানসিক কষ্টে ছিল, একবার আত্মহত্যার চেষ্টাও করেছিল। তখন নাকি জেলার আর জেলারের স্ত্রীর চেষ্টায় অবস্থার কিছু উন্নতি হয়। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে মাঝেমাঝেই নাকি মাথায় গোলমাল হত, সত্যি কি না জানি না।”
“এটা আমি জানতাম না,” বলে ঘড়ির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে হেমন্ত উঠে পড়লেন। “আই অ্যাম সরি, আমায় এখন দোকানে যেতে হবে, আপনারা বসে বসে গল্প করুন।”
আমি বললাম, “না, না, আমাকেও উঠতে হবে।”
কফির পয়সা দিতে চাইলাম হেমন্ত কোনও কথা কানে তুললেন না। বললেন, “আঙ্কল থাকতে থাকতেই একদিন বাড়িতে আসুন না, ভালো করে গল্প করা যাবে।”
‘‘আসব।”
“গুড, তাহলে রাজু আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে সুবিধা মতো একটা দিন ঠিক করে নেবে।”
.
৯.
বাড়ি পৌঁছে দেখি একেনবাবু ধ্যানস্থ হয়ে বসে আছেন।
“কী ব্যাপার?”
“বুঝলেন স্যার, নীলাটা না কিনলে চলছে না।”
“কিনুন না, আপত্তি করছে কে, সেদিন তো অন-লাইনে দেখলেন আপনার বাজেটের মধ্যেই পাচ্ছেন।”
“তা পাচ্ছি স্যার, কিন্তু ওগুলো জেনুইন নয়।”
“কম্পোজিশন তো এক, প্রমথর লেকচার শুনলেন না সেদিন?”
প্রমথ যে রান্নাঘরে আমি বুঝিনি। একটা হুঙ্কার দিল সেখান থেকে, “আমার নামে একটা বাজে কথা বলেছিস তো, তোর মাথা ভাঙব।”
“বাজে কথা বলব কেন, তোকে সাপোর্ট করেই তো বলছি।”
“টোনটা সাপোর্টের নয়।”
“বেশ, সাপোর্টিং টোনেই বলছি।” বলে একেনবাবুকে বললাম, “দুশ্চিন্তা না করে, প্রমথের উপদেশ মতো আর্টিফিশিয়াল নীলা কিনে ফেলুন। কিছু উপকার তো হবে, আর যদি কোনও কারণে স্যুট না করে, বড়সড় ক্ষতি অন্তত হবে না।”
“বুঝলাম না স্যার।”
“কেন, সেদিন শুনলেন না, জেনুইন নীলা ধারণ করায় জন হেক্টারের ট্র্যাজেডি? আজ আরও ভালো করে জানলাম।”
প্রমথ দুকাপ কফি হাতে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে জিজ্ঞেস করল, “কী জানলি?”
আমি চুগানীদের সঙ্গে যা কথাবার্তা হয়েছে বললাম।
সাধারণত একেনবাবু আর প্রমথকে একসঙ্গে কিছু বলা সহজ ব্যাপার নয়। প্রমথ শুনতে চায় সামারি বা চুম্বক, আর একেনবাবু চান পুংখানুপুঙ্খ ডিটেলে। পদে পদেই থামিয়ে প্রশ্ন করে চলেন… ‘এ কথাটা যখন বললেন স্যার, তখন কি ওঁর মুখটা খুব গম্ভীর ছিল?’, ‘উনি কি খুব রিল্যাক্সড ছিলেন না উত্তেজিত ছিলেন?’, ‘বডি ল্যাঙ্গোয়জ কিরকম ছিল স্যার?’… এরকম হাজারো প্রশ্ন। ফলে ওঁকে কিছু বলতে যাওয়া একটা বিড়ম্বনা। আজ দেখলাম একেনবাবু অন্যমনস্ক। বিশেষ কোনও প্রশ্ন করলেন না, যা বললাম চুপচাপ শুনে গেলেন। বলা শেষ হলে প্রমথই জানতে চাইল, “জন হেক্টার খুন হলেন কেন সে সম্পর্কে কিছু জানা গেছে?”
“তার উত্তরটা শোনা হয়নি। আমার মনে হয় হেমন্তের আঙ্কল জানেন না, কারণ যেদিন খুন হবার খবর পান সেদিনই তিনি দেশ ছেড়েছেন।”
“আই, সি,” প্রমথ টেবিল থেকে ল্যাপটপটা তুলে চালু করল। “কী দেখছিস?”
“কয়েকদিন আগে কিছু ঘটলেও ইন্টারনেটে পাওয়া যাবে।”
প্রমথ যখন হেক্টারের খবর খুঁজছে, তখন হঠাৎ মনে পড়ল.. বললাম, “ও আরেকটা কথা বলতে তো ভুলেই গেছি, একটু মজারই। কফি কর্নারে যাবার সময় অচেনা একটা লোক আচমকা আমায় রাস্তায় দাঁড় করিয়ে বলল, আমার স্ট্যাম্পের এক খদ্দের পেয়েছে। পরে অবশ্য ভুল বুঝতে পেরে অদৃশ্য হল।“
এই প্রথম একেনবাবু মুখ খুললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার। রাস্তায় আপনাকে ধরে হঠাৎ এই কথা বলল?”
“ওয়েল, রাস্তাতেই, তবে একটা স্ট্যাম্পের দোকানের সামনে। নিশ্চয় দোকানের কোনও লোক, আমায় দেখতে পেয়ে বেরিয়ে এসেছিল।”
“দোকানটা কোথায় স্যার?”
“সালিভ্যান স্ট্রিটে।”
“ও হ্যাঁ, ফিলাটেলিস্ট কর্নার।”
“আপনি দোকানটা দেখেছেন?”
“পথেই তো পরে স্যার।”
“আমি তো খেয়ালই করিনি আগে!”
প্রমথ আমাদের কথা কানে দিচ্ছিল না। হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল, “ইউরেকা, পেয়েছি!”
“কী পেলি?”
“কী করে নিউজটা মিস করেছিলাম জানি না, নিউ ইয়র্ক টাইমস-এই বেরিয়েছিল। জন হেক্টারকে খুনই করা হয়েছে। পড়ছি, শোন–
ওঁর হোটেলের ঘর থেকে টাকাকড়ি, ক্যামেরা, ঘড়ি, ল্যাপটপ সবকিছু নিয়ে কেউ অদৃশ্য হয়েছে। পুলিশের ধারণা চুরি করাই ছিল উদ্দেশ্য। শুক্রবার রাত্রে উনি কারোর সঙ্গে ডিনার খেতে বেরিয়েছিলেন। অজ্ঞাত কারণে তাড়াতাড়ি ফিরে আসেন। ঘরে ঢুকে আততায়ীদের দেখতে পান, তখনই ওঁকে খুন করা হয়। সম্ভবত সিকিউরিটি গার্ডের কেউ এর সঙ্গে জড়িত, তদন্ত চলছে। ইন্ডিয়া জন হেক্টারের অতি পরিচিত ও প্রিয় জায়গা। সত্তর দশকে গিয়ে উনি প্রায় বারো বছর ওখানে ছিলেন বেশ কিছুদিন দ্য টাইমসের রিপোর্টার হিসেবে। পরেও বহুবার বেড়াতে গেছেন। ..
“হেমন্তের আঙ্কল তাহলে ভুল কিছু বলেননি,” আমি বললাম।
‘মার্ডারের ব্যাপারটা ভুল বলেননি, তবে…”, প্রমথ কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
“তবে কী?”
“ভাবছি, এই হেক্টার লোকটা ঠিক কে?”
“তার মানে?”
“একটা লোক মন্দিরের ওপর বই লিখবে বলে ইন্ডিয়াতে গেল, প্রচুর ছবি তুলল, শুধু বইটা লিখল না। অথচ রিপোর্টার হয়ে বারোটা বছর কাটিয়ে দিল! এখনও মাঝে মাঝেই ইন্ডিয়ায় যায়। হোয়াই? এটা কি ইন্ডিয়া-প্রেম, না হি ওয়াজ ইনভভড ইন সামথিং এক্স।”
“কী সামথিং এন্স?”
“নিশ্চয় সিআইএ এজেন্ট, তা ছাড়া কি? রিপোর্টার সেজে থাকত, চমৎকার কাভার। নানান জায়গায় ঘুরে বেড়ানো, যত্রতত্র ছবি তোলা, সবকিছুই রিপোর্টিং-এর মধ্যে পড়ছে। আমি বাজি ধরছি, ওঁর খুনিরা সিম্পলি চুরি করতে ঢোকেনি, ঢুকেছিল হয় ইনফরমেশনের খোঁজে, নয় ওঁকে খতম করতে। সাধারণ চোর নয়, আলকায়েদা অন্য কোনও কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের লোক।”
প্রমথর কল্পনাশক্তি যে আমার থেকে বেশি অস্বীকার করতে পারি না। কিন্তু মাঝে মাঝে সীমা ছাড়িয়ে যায়!
“আপনি কী বলেন একেনবাবু?” জিজ্ঞেস করলাম।
একেনবাবু পা নাচাতে নাচাতে ওঁর ফেভারিট লাইনটা আওড়ালেন, “বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকু জানি।”
.
এইসব কথাবার্তার মধ্যে মনে পড়ল কিশোরের কাছে অ্যাপলাইজ করা হয়নি। যখন দেরি হচ্ছিল তখনই ওকে ফোন করা উচিত ছিল। যাইহোক, এখন অন্তত করি। মোবাইলটা পকেট থেকে বার করতে যাচ্ছি, প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কাকে ফোন করছিস?”
“কিশোরকে।”
প্রমথ বেভ আর কিশোরের ব্যাপারটা জানত। কিশোর যে মাঝে মধ্যে এ ব্যাপারে আমার অ্যাডভাইস নেয় সেটাও অজ্ঞাত নয়। আমায় খোঁচা দিল, “আবার অ্যাডভাইস? এক অন্ধ পথ দেখাচ্ছে আরেক অন্ধকে!”
“চুপ কর, রাস্কেল,” বলে আমি কিশোরের নম্বর বার করে কল বাটন টিপলাম। কয়েকটা রিং-এর পরেই কিশোর ফোন ধরল।
আমি ‘সরি’ বলতে না বলতেই বলল, “আরে, আমি তো বুঝতেই পেরেছিলাম কিছুতে আটকা পড়েছ, এত সরি বলার কী আছে!”
কিশোরের গলার স্বর শুনে মনে হল বেশ উজ্জীবিত, বেভের সঙ্গে নিশ্চয় পজিটিভ কিছু ঘটেছে। বলল, “অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে, ফোনে হবে না।”
“তুমি যদি চাও, কালকে কফি খেতে পারি,” ওকে বললাম।
“কালকে হবে না। বেভকে নিয়ে হোবোকেনে ওর আন্টি মিশেলের কাছে যাচ্ছি। রবি, সোম থাকছি না। মঙ্গলবারও নয়, ওই দিনও বোধহয় বেভকে নিয়ে আন্ট মিশেলের কাছে যেতে হবে। হাউ অ্যাবাউট বুধবার– সেইম টাইম, সেইম প্লেস।”
“দ্যাট্স ফাইন।”
.
মিশেল নামটা শুনে আমার খষ্কা লাগল। ফোন নামিয়ে একেনবাবুকে বললাম, “হহাবোকেনের এক মিশেল আমাদের সেক্রেটারি বেভের মাসি।”
“তাতে হলটা কি?” প্রমথ বলল। “হোবোকেনে হয়তো পাঁচশো মিশেল আছে, তাদের মধ্যে শ-দুয়েক হয়তো কারো না কারো মাসি।”
এর উত্তরে কিছু বলার আগেই একেনবাবু প্রসঙ্গটা সম্পূর্ণ পালটে দিয়ে বললেন, “ভালো কথা স্যার, সোমবার কখন আপনি ইউনিভার্সিটি যাবেন?”
“সকাল দশটা নাগাদ। কেন?”
“আমিও আপনার সঙ্গে বেরোবো।”
“বেশ তো, কোথায় যাবেন?”
“একবার ওই স্ট্যাম্পের দোকানটায় যাব ভাবছিলাম।”
আমি আঁচ করতে পারছি, একেনবাবুর মাথায় কী ঘুরছে। কিন্তু এমন সময়ে মিত্রা মাসির একটা ফোন আসায় সেটা নিয়ে প্রশ্ন করা হল না। মিত্রা মাসি মায়ের মাসতুতো বা পিসতুতো বোন, শিকাগোতে ছেলের কাছে বেড়াতে এসেছেন। মাঝে মাঝে আমাকে ফোন করেন। ব্রেভিটি ইজ নট হার স্ট্রং পয়েন্ট। এক থেকে দু’ঘণ্টা আমার সময় নষ্ট করে তারপর ফোন ছাড়েন। কথা শেষ হতে হতে একেনবাবু দেখলাম কোথায় অদৃশ্য হয়েছেন।
.
১০.
শনিবার / রবিবার মে ২১/২২, ২০১১
আমি দেখেছি, মাথায় যদি কোনও প্রশ্ন জাগে, যতক্ষণ সেটার উত্তর না মেলে, মনটা ছটফট করতে থাকে। খুবই অকিঞ্চিৎকর প্রশ্ন, বেভের আন্টিই অশোক দুবের সেই মিশেল কিনা সেটা নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাতে ভালো ঘুম হল না। সকালে উঠে দেখি প্রমথ বা একেনবাবু কেউই বাড়িতে নেই। আজকাল শনি-রবিবার প্রমথর দেখা পাওয়া ভার। সাত সকালে ফ্রান্সিস্কার অ্যাপার্টমেন্টে চলে যায়। মাঝে মাঝে উইক-এন্ডটা সেখানেই কাটিয়ে আসে। আমার ধারণা দে আর স্লিপিং টুগেদার। নট দ্যাট আই কেয়ার। আজ বাদে কাল তো বিয়েও করবে। একেনবাবু সাধারণত বাড়িতেই থাকেন। তিনি কোথায় অদৃশ্য হয়েছেন কে জানে? একটু বাদে একেনবাবুর ফোন পেলাম। উইক-এন্ডে আমার প্ল্যান জানতে চান।
“কোনো প্ল্যান নেই।”
“তাহলে, চলুন না, কুইন্সে উইক-এন্ডটা কাটাই।”
“কুইন্স? অফ অল দ্য প্লেসেস?”
“আসলে স্যার, আমার খুড়তুতো শ্যালক কলকাতা থেকে কাল রাতে এসেছে। কুইন্সে ওর এক বন্ধুর কাছে আছে। আমি ওঁদের সঙ্গেই এখন গল্প করছি। আমাদের সবাইকে নেমন্তন্ন করেছেন সেই বন্ধু– উইক-এন্ডটা এক সঙ্গে কাটাবার জন্যে।”
“আপনি যান। প্রমথ তো নেই, আর আমারও কলেজের কিছু কাজ বাকি পড়ে আছে, সেগুলো এই ফাঁকে সেরে নেব।”
“আপনি একা একা থাকবেন স্যার?”
“তাতে কী হয়েছে? আপনার কি রাইড লাগবে? আমি আপনাকে কুইন্সে পৌঁছে দিয়ে আসতে পারি।”
“ছি, ছি, স্যার, কী যে বলেন! ওঁরাই আমাদের নিয়ে যেতেন।”
“ব্যাস, তাহলে তো চুকেই গেল।”
একেনবাবু কিছু একটা বলতে গিয়ে চুপ করে গেলেন। বুঝলাম আমাকে একা ফেলে রেখে যেতে একেনবাবুর খারাপ লাগছে। প্রমথ যখন উইক-এন্ডগুলো বাইরে কাটায়, তখন এক আধ সময় একেনবাবুকে আমি বলেছি, এটা হল ট্রায়াল, ধীরে ধীরে প্রমথকে ছাড়াই আমাদের থাকতে হবে। উই উইল মিস হিম। এক বছর বাদে একেনবাবুরও দেশে ফিরে যাবার কথা। ওঁর ফুলব্রাইট ফেলোশিপ শেষ হচ্ছে। ওঁরা চলে গেলে এই তিন বেডরুমের অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে দিয়ে ছোটোখাটো কিছু খুঁজতে হবে। এই নিয়ে একেনবাবুর সঙ্গে আগে কয়েকবার কথাও হয়েছে। প্রতিবারই একেনবাবু বলেছেন, “আপনি স্যার, কলকাতায় চলে আসুন। প্রমথবাবুর ম্যাডাম আছেন, ওঁর পক্ষে দেশে ফিরে আসা হবে না। আপনি তো স্যার মুক্ত পুরুষ। আমি একেনবাবুকে বলেছি, কেন, আমি কি এখানে কোনও ম্যাডাম জোগাড় করতে পারি না?” একেনবাবু লজ্জা পেয়ে বলেছেন, কী যে বলেন স্যার, তাহলে তো খুবই ভালো হয়।
সত্যি কথা বলতে কী, কেউ না থাকায় দিব্বি কাটল। নিজের কাজগুলো হল, সুচিত্রা উত্তমের ডিভিডি ‘চাওয়া-পাওয়া’ দেখলাম। আমার এখনও মায়েদের সময়কার রোম্যান্টিক ছবিগুলো ভালো লাগে। প্রমথর জ্বালায় ওগুলো আনা যায় না। ওর মতে পুরোনো ছবিগুলো সব সিলি সেন্টিমেন্টাল ট্র্যাশ। একজনকে মুখ ফুটে ভালোবাসি বলতে যদি দু’ঘণ্টা কেটে যায়, সেটা আবার একটা সিনেমা হল নাকি? বাংলা বইও ও পড়ে না। একবার শরৎচন্দ্রের ‘দত্তা’ অনেক বুঝিয়ে সুঝিয়ে ওকে পড়িয়েছিলাম। পড়ে ক্ষেপে আগুন! ওর কনকুশন– বিজয়াকে যদি বা ক্ষমা করা যায়, নরেন একটা ইডিয়ট। আর আমার মস্তিষ্ক পরীক্ষা করানো উচিত এইসব পুরানো বস্তাপচা রাবিশ এখনো পড়ি বলে!
.
শনিবার সন্ধ্যায় একটা ফোন পেলাম। এক ভদ্রলোক একেনবাবুর খোঁজ করছিলেন। নামটা বলেছিলেন, কিন্তু প্রথমে ঠিক শুনতে পাইনি। দুয়েকটা কথার পরে চিনতে পারলাম। বিপাশা মিত্রের ফ্যামিলি মিউজিয়ামের কিউরেটর সতীশ কুমার। বব ক্যাসেলের মৃত্যুতে খুব আপসেট দেখলাম সতীশ কুমারকে। দু’জনে বোধহয় ভালো বন্ধু ছিলেন।
একেনবাবুকে কিছু বলতে হবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে সতীশ বললেন, বব ক্যাসেলের মা ক্যাথি ক্যাসেল একেনবাবুর সঙ্গে বিশেষ প্রয়োজনে একটু কথা বলতে চান, কবে এলে দেখা হবে। কারণটা অবশ্য সতীশ আমার কাছে ভাঙলেন না। তবে বললেন, বিপাশা মিত্রের কাছে সতীশ শুনেছেন যে, একেনবাবু একজন ভালো ডিটেকটিভ। সতীশই ক্যাথিকে একেনবাবুর নামটা দিয়েছেন। ক্যাথি ক্যাসেলের বয়স পঁচাত্তর– পার্কিনসন্স, আরথ্রাইটিস ও অন্যান্য দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছেন। একেনবাবু একটা সময় দিলে সতীশ কুমার নিজেই ওঁকে নিয়ে আসবেন। একেনবাবুকে আমি চিনি। উনি কখনোই চাইবেন না যে, একজন বৃদ্ধা এত কষ্ট করে আসবেন ওঁর কাছে। আমি ক্যাথি ক্যাসেলের নম্বরটা নিয়ে নিলাম। বললাম একেনবাবু যোগাযোগ করবেন।
রবিবার রাত্রে প্রমথ ফিরল। হাতে একটা প্যাকেট। ফ্রান্সিস্কা একটা ফুটকেক বানিয়েছে। তার থেকে পেল্লায় সাইজের একটা অংশ প্যাক করে দিয়েছে আমার আর একেনবাবুর জন্যে। ভেরি সুইট। একেনবাবু ফিরলেন প্রমথর একটু পরেই। তিনিও মিষ্টির একটা প্যাকেট এনেছেন। আমি কফির সঙ্গে সেগুলোর সদ্ব্যবহার করতে করতে একেনবাবুকে। বললাম, “বব ক্যাসেলের মা ক্যাথি ক্যাসেল আপনার সঙ্গে কথা বলতে চান।”
“কেন স্যার?”
“ঠিক জানি না, তবে একজন ডিটেকটিভের খোঁজ করছিলেন। সতীশ কুমার আপনার নাম সাজেস্ট করেছেন। বৃদ্ধা অসুস্থ, সতীশ কুমার নিজেই ওঁকে নিয়ে আসতেন এখানে। বললাম, আপনি ফোন করবেন।”
“নম্বরটা দিন স্যার। এখন রাত্রি হয়ে গেছে, কাল ফোন করব।”
.
ফুটকেকটা ফ্র্যান্সিস্কা দুর্দান্ত বানিয়েছে। প্রমথকে বললাম, “তুই মাঝে মাঝে প্লিজ ফ্রান্সিস্কার কাছে গিয়ে থাকিস। হোয়াট এ ট্রিট!”
“রাস্কেল!” বলে প্রমথ শুতে চলে গেল।