শনিবার সকালে হিন্দুস্থান রোডের বাড়ির দোতলার দরজা ভেঙে মালঞ্চর মৃতদেহ পুলিস আবিষ্কার করল এবং পরের শুক্রবার মানে ঠিক পাঁচদিন পরে যেন সমস্ত ব্যাপারটা নাটকীয় একটা মোড় নিল। সুরজিৎ ঘোষাল যা স্বপ্নেও ভাবেননি তাই হল। সংবাদপত্র ব্যাপারটা ফ্লাশ করল।
বালিগঞ্জ হিন্দুস্থান রোডের এক দ্বিতল গৃহে, রুমালের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে হত্যা করা হয়েছে এক মহিলাকে। শোনা যাচ্ছে ঐ মহিলাটি কোন একটা নামকরা ফার্মের ম্যানেজিং ডাইরেক্টরের নাকি রক্ষিতা ছিল। সেই রক্ষিতাকে ভদ্রলোকটি ওই বাড়িটি কিনে দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক নিয়মিত সন্ধ্যায় ঐ রক্ষিতার গৃহে যেতেন এবং রাত্রি এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি থেকে আবার চলে আসতেন।
পুলিস বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছে যে যেদিন রাত্রে হত্যা সংঘটিত হয়, সেই দিন সন্ধ্যায়ও অর্থাৎ শুক্রবার সন্ধ্যাতেও ঐ ভদ্রলোক তার গৃহে গিয়েছিলেন। পুলিস জোর তদন্ত চালাচ্ছে। ঘরের মেঝেতে একটি বহুমূল্য মুক্তোর মালা ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া। গিয়েছে। আরো সংবাদ যে, যে রুমালের সাহায্যে গলায় ফাঁস দিয়ে ওই স্ত্রীলোকটিকে হত্যা করা হয়েছে সেই রুমালের এক কোণে নাকি লাল সুতোয় ইংরেজী আদ্যক্ষরে S লেখা আছে। এখনো কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আগের দিন সন্ধ্যার কিছু পরে, অর্থাৎ সোমবার সুশীল চক্রবর্তী এসেছিলেন পার্ক স্ট্রীটে সুরজিৎ ঘোষালের গৃহে।
সুরজিৎ ঘোষাল সবেমাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন তখন। জামা কাপড়ও ছাড়েননি। ভৃত্য সনাতন এসে জানাল, বালিগঞ্জ থানার ও.সি. সুশীলবাবু দেখা করতে এসেছেন।
সুশীল চক্রবর্তী। চমকে ওঠেন সুরজিৎ।
পাশেই দাঁড়িয়েছিলেন স্ত্রী স্বর্ণলতা। তিনি উদ্বিগ্ন কণ্ঠে শুধালেন, বালিগঞ্জ থানার ও. সি. আবার কেন এলো গো?
—কি করে জানব! দেখি—সুরজিৎ ঘোষাল উঠে পড়লেন।
নীচের পার্লারে সুশীল চক্রবর্তী অপেক্ষা করছিলেন। সুরজিৎ ঘোষাল নীচে এসে পার্লারে প্রবেশ করলেন।
—মিঃ ঘোষাল, এ সময় আপনাকে বিরক্ত করার জন্যে আমি সত্যই দুঃখিত।
–কি ব্যাপার মিঃ চক্রবর্তী?
—এই রুমালটা দেখুন তো–বলে কাগজে মোড়া একটা রুমাল পকেট থেকে বের করে সুরজিৎ ঘোষালের সামনে ধরলেন সুশীল চক্রবর্তী।
–রুমাল! কেমন যেন অসহায় ভাবে কাগজের মোড়কটার দিকে তাকালেন সুরজিৎ ঘোষাল!
—এই রুমালটার সাহায্যেই সেদিন মালঞ্চ মল্লিককে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়েছিল! দেখুন তো, এই রুমালটা চিনতে পারেন কি না—
সুরজিৎ ঘোষালের সমস্ত দেহটা কেমন যেন অবশ হয়ে গেল। মুখে একটিও কথা নেই। কেমন যেন শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন তিনি রুমালটার দিকে। রুমালটার এক কোণে লাল সুতো দিয়েই ইংরেজী S লেখা।
—চিনতে পারছেন, কার রুমাল এটা?
–রুমালটা মনে হচ্ছে আমারই—
—এই রুমালটা সম্পর্কে আপনার কিছু বলবার আছে?
সুরজিৎ ঘোষাল একেবারে যেন বোবা, পাথর।
–আচ্ছা, সে রাত্রে আপনি হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে ঠিক কতক্ষণ ছিলেন?
—আধঘণ্টা মত হবে। —তারপর সেখান থেকে বের হয়ে আপনি কোথায় যান?
—কেন, আমি—আমি তো সোজা এখানেই, মানে বাড়িতেই চলে আসি–
—না, আপনি তা আসেন নি। রাত সাড়ে এগারোটার সময় আপনাকে বালিগঞ্জের হরাইজন ক্লাবে ড্রিংক করতে দেখা গিয়েছে।
—কে—কে বললে?
–আমরা সংবাদ পেয়েছি। আপনি যেখানে যেখানে যেতেন সব জায়গাতেই আমরা খোঁজ নিয়েছি—আপনি হরাইজন ক্লাবে প্রায়ই যেতেন, আপনি সেখানকার মেম্বার। সে রাতে আপনি পৌনে এগারোটা নাগাদ সেই ক্লাবে যান। সুতরাং রাত আটটা নাগাদ যদি আপনি হিন্দুস্থান রোডের বাড়ি থেকে বের হয়ে এসে থাকেন তাহলে ঐ সময়টা–মানে রাত আটটা থেকে পৌনে এগারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন?
-I was feeling very much disturbed—মনটার মধ্যে একটা অস্থিরতা, তাই আমি গাড়ি নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম।
—আপনার ড্রাইভার সঙ্গে ছিল?
-না, হিন্দুস্থান রোডের বাড়িতে বরাবর আমি নিজেই ড্রাইভ করে যেতাম। কিন্তু মিঃ চক্রবর্তী, আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না!
—নিহত মালঞ্চ মল্লিকের গলায় ফাঁস দেওয়া অবস্থায় এই রুমালটা পাওয়া গিয়েছে, আর আপনি স্বীকার করছেন এ রুমালটা আপনারই, আপনি সে রাত্রে সেখানে গিয়েছিলেন, মানে দুর্ঘটনার রাত্রে। তাছাড়া একমাত্র আপনার কাছেই মালঞ্চর ঘরের দরজার এবং বাড়ির সদর দরজার ড়ুপলিকেট চাবি থাকত। সুতরাং বুঝতেই পারছেন আমি কি বলতে চাইছি।
—তাহলে আপনার কি ধারণা আমিই সে রাত্রে মালঞ্চকে হত্যা করেছি?
—সেটা এখনো প্রমাণ না হলেও ঐ হত্যার ব্যাপারে একজন suspect হিসাবে আপাতত আপনাকে আমি arrest করতে এসেছি। আমার সঙ্গে আপনাকে থানায় যেতে হবে।
—বেশ চলুন। লম্বা দীর্ঘশ্বাস মোচন করে সুরজিৎ বললেন।
দশ মিনিট পর সুশীল চক্রবর্তী তার জীপে সুরজিৎ ঘোষালকে তুলে নিয়ে, লালবাজারের দিকে চলে গেলেন।
সুরজিৎ ঘোষালকে থানা অফিসার গ্রেপ্তার করে নিয়ে গিয়েছে এই সংবাদটা সনাতনই ওপরে এসে কাঁদতে কাঁদতে স্বর্ণলতাকে জানাল। স্বর্ণলতা সংবাদটা শুনে যেন পাথর হয়ে গেলেন। সুরজিতের বড় ছেলে যুধাজিৎ আরো আধঘণ্টা পরে এলো ইউনিভারসিটি, থেকে। সনাতনই তাকে প্রথম সংবাদটা দিল। যুধাজিৎও সংবাদটা শুনে একেবারে স্তম্ভিত। সে তাড়াতাড়ি মার ঘরে গিয়ে ঢুকল।
—এসব কি শুনছি মা? সানয়নে স্বর্ণলতা নিঃশব্দে ছেলের মুখের দিকে তাকালেন।
-বাবাকে arrest করে নিয়ে গিয়েছে! মামাগো, কথা বলছ না কেন? স্বর্ণলতা চোখে আঁচল চাপা দিয়ে কেবল ফুলে ফুলে কঁদতে লাগলেন। কেলেঙ্কারির কিছুই আর বাকী থাকবে না—কাল সকালেই সংবাদপত্রে নামধাম দিয়ে সব কথা হয়তো ছেপে দেবে। তারপর তিনি মুখ দেখাবেন কি করে?
–কেঁদো না মা, I dont believe, আমি বিশ্বাস করি না বাবা ঐ কাজ করতে পারেন। আমি এক্ষুনি আমাদের সলিসিটার মিঃ বোসের কাছে যাচ্ছি বলে যুধাজিৎ দাঁড়াল না। বের হয়ে গেল গাড়ি নিয়ে।
সলিসিটার মিঃ নির্মল বসু সব কিছু শুনে বললেন, সর্বাগ্রে সুরজিতের জামিনের ব্যবস্থা করতে হবে। তবে হত্যার সন্দেহে তাকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিস, হয়তো জামিন দিতে চাইবে না, ৩০২ ধারার কেস। তবু চলুন, একবার অ্যাডভোকেট মিঃ ভাদুড়ীর কাছে। যাওয়া যাক।
সোমনাথ ভাদুড়ী ক্রিমিন্যাল সাইডের আজকের সব চাইতেনামকরা অ্যাডভোকেট। তিনি ব্যাপারটার আদ্যোপান্ত নীরবে শুনলেন যুধাজিতের কাছ থেকে, কেবল তার হাতের মোটা লালনীল পেনসিলটা দু-আঙুলের মধ্যে ঘুরতে লাগল।
সব শুনে তিনি বললেন, ব্যাপারটা বেশ জটিল বলেই মনে হচ্ছে নির্মলবাবু, কালই আদালতে মিঃ ঘোষালকে যখন হাজির করা হবে, তখন আমরা জামিনের জন্য আর্জি ফাইল করব। তারপর দেখা যাক কি হয়। একটু থেমে সোমনাথ ভাদুড়ী আবার বললেন, যুধাজিৎবাবু, আইনের দিক থেকে অতঃপর যা কিছু করবার আমরা করব, করতেও হবে আমাদের, এবং আইন আদালতের ব্যাপার তো বুঝতেই পারছেন, কতটা মন্দাক্রান্তা গতিতে চলে। ইতিমধ্যে আমার পরামর্শ যদি চান তো একটা কথা বলি।
বলুন। যুধাজিৎ বলল।
এদিকে যা হবার হোক, আপনারা ইতিমধ্যে একজনের সাহায্য নিলে বোধ হয় ভাল করতেন।
—কার সাহায্য?
—কিরীটী রায়ের নাম শুনেছেন?
সঙ্গে সঙ্গে নির্মল বসু বললেন, নিশ্চয়, শুনেছি বৈকি।
-চলুন না, তার কাছে একবার যাওয়া যাক। বিচার বিশ্লেষণের অদ্ভুত ক্ষমতা মশাই ভদ্রলোকটির। দুটো কেসের ব্যাপারে ওঁর সঙ্গে আমি কাজ করে ওঁর তীক্ষ্ণ অনুসন্ধানী মনের পরিচয় পেয়ে চমৎকৃত হয়েছি। তবে ভাবছি তিনি রাজী হবেন কি না–
-কেন, রাজী হবেন না কেন, যা ফিস্ লাগে–Whatever amount he wants, যুধাজিৎ বলল, I am ready to pay.
সোমনাথ ভাদুড়ী হাসলেন, টাকার অঙ্ক দিয়ে তাকে রাজী করাতে পারবেন না যুধাজিৎবাবু। টাকা তিনি অবিশ্যি নেন, কিন্তু আসলে গোয়েন্দাগিরি করা ওঁর একটা নেশা। এককালে রহস্য উদ্ঘাটনের ব্যাপারে নেশা ছিল ভদ্রলোকের কিন্তু ইদানীং আর তেমন যেন কোন উৎসাহ দেখি না। রহস্যের ব্যাপারে যেন মাথাই ঘামাতে চান না, তাছাড়া ভদ্রলোক প্রচণ্ড খেয়ালী।
—আপনি যদি একবার অনুরোধ করেন মিঃ ভাদুড়ী—যুধাজিৎ বলল। সোমনাথ ভাদুড়ী প্রত্যুত্তরে যুধাজিতের দিকে তাকিয়ে বললেন, আমিই যখন তার নাম করেছি তখন আমি অবশ্যই বলব।
—তাহলে আর দেরি করে লাভ কি, চলুন না এখনই একবার তার কাছে যাই
—এখন না, কাল বিকেলের দিকে আসুন, যাওয়া যাবে। সকালটা আমায় জামিনের ব্যাপারে ব্যস্ত থাকতে হবে।
নির্মল বসু বললেন, মিঃ ভাদুড়ী, আমিও কি আসব?
—আসতে পারেন, তবে না এলেও চলে, আমিই যুধাজিৎবাবুকে নিয়ে যাব।
—তাহলে সেই কথাই রইল, আমি না এলে যুধাজিৎবাবুই আসবেন। আজ উঠি—
পরদিন আদালতে পুলিস সুরজিৎ ঘোষালকে হাজির করল।
কিন্তু সংবাদপত্রের রিপোর্টাররা কি করে জানি সংবাদটা ঠিক পেয়ে গিয়েছিল, ঐদিনকার সংবাদপত্রে সুরজিৎ ঘোষালের গ্রেপ্তারের কাহিনী ছাপা হয়ে গিয়েছে দেখা গেল। সারা কলকাতা শহরে যেন একটা সাড়া পড়ে যায়। এত বড় একজন মানী লোক,—জনসাধারণের কৌতূহল যেন সীমা ছাড়িয়ে যায়।
আদালতে কিন্তু জামিন পাওয়া গেল না, সরকার পক্ষের কৌঁসুলি মিঃ চট্টরাজ তীব্র ভাষায় জামিন দেওয়ার ব্যাপারে বিরোধিতা করলেন।
সোমনাথ ভাদুড়ী যদিও বললেন, তার ক্লায়েন্ট সমাজের একজন গণমান্য ও প্রতিষ্ঠিত লোক, তাকে জামিনে খালাস দেওয়া উচিত। কিন্তু তার উত্তরে চট্টরাজ বললেন, জামিন দিলে তদন্তের অসুবিধা হবে, চার্জ গঠন করা যাবে না।
জজসাহেব উভয়পক্ষের সওয়াল শুনে সুরজিৎকে আরো দশদিন হাজতে থাকবার নির্দেশ দিলেন। আরো দশদিন পরে ধার্য হল শুনানির দিন, পুলিসের তদন্তের সাহায্য করবার জন্য।
বলাই বাহুল্য, পরের দিনের সংবাদপত্রে সমস্ত ব্যাপারটা বড় বড় অক্ষরে ছাপা হয়ে গেল। সুরজিৎ ঘোষালকে জামিন দেননি জজ, আরো তদন্ত সাপেক্ষে জেল হাজতে থাকবার হুকুম দেওয়া হয়েছে। দুশ্চিন্তার একটা কালো ছায়া গ্রাস করল সুরজিৎ ঘোষালের গৃহকে।