০৬. হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ

০৬.

হাইপোডারমিক সিরিঞ্জ হাতে নিঃশব্দে বাঙ্কে উঠে এলেন ডাক্তার লিম। এক মুহূর্তে থেমে গেল সমস্ত হাসি। থমথমে নিস্তব্ধতা নেমে এল সারা ঘরে। বাইরের হাওয়াও বোধহয় থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। বুক-চাপা নীরবতায় একগাদা মানুষ বোকার মতো দাঁড়িয়ে রইল।

ডক্টর রায়ের দিকে তাকিয়ে হতাশায় মাথা নাড়লেন ডাক্তার লিম, না, কোনও আশা নেই। কোনও উপায় নেই বোঝানোর।

অনিশ্চয়তার সুরে হেসে উঠলেন বিশ্বনাথ কুমার। আমাকেও আর বোকা বোঝতে পারবে না, ডাক্তার। এর জন্যে তুমি দায়ী, কাইবুলুস্কি।

না, কাইবুলুস্কিকে সম্পূর্ণ দায়ী করা উচিত হবে না। বললেন ডাক্তার লিম।

 কেন উচিত হবে না? সমস্ত কথাই বলেছিলাম ওকে। স্বপ্নের মধ্যে দৈত্যটার আর এক ক্ষমতার কথাও জেনেছিলাম আমি। টেলিপ্যাথি জানে দৈত্যটা, আর সেই চিন্তাই পাগল করে তুলেছে আমাকে।

ধমকে উঠলেন ডাক্তার লিম। তুমিও ম্যাকডেভিডের মতো পাগল হলে নাকি? আমি বলছি দৈত্যটা এখন মরে গেছে।

সামনের দিকে এগিয়ে এলেন কাইবুলুস্কি। বললেন, তুমি তো জানো সৌরেন, সেই পুরোনো সৌরেনই আছে। শুধু দেখতে নয়, চিন্তা, বুদ্ধি, কাজ কর্মেও সে আগেকার সৌরেন। শুধু দেহের অনুকরণ করলেই হবে না, চিন্তা বুদ্ধিবৃত্তি প্রভৃতিও নিখুঁতভাবে আয়ত্ত করতে হবে। আবার যদি ধরা যায় সৌরেন রূপান্তরিত হয়ে গেছে, তাহলেও তো চিন্তার কোনও কারণ দেখি না। কারণ দৈত্যটার জ্ঞান বুদ্ধি চিন্তা প্রভৃতি সবকিছু অন্য জগতের। কোনও মিল নেই পৃথিবীর সঙ্গে। সুতরাং চেহারায় ধরা না পড়লেও অপার্থিব ব্যবহারই বলে দেবে যে সে আগেকার সৌরেন নয়। এত সহজে আমাদের চোখে ধুলো দেওয়া সম্ভব নয়।

যতই বোঝাবার চেষ্টা করো না কেন, তবুও বলব যে তুমিই এর একমাত্র কারণ। আমার প্রতিটি কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছে, বিরাট বড় মনে করেছ নিজেকে। তুমি-তুমিই দায়ী, কাইবুলুস্কি। উত্তেজনায় থর থর করে কেঁপে উঠলেন বিশ্বনাথ কুমার।

সৌরেনের ঠিক পাশে সুন্দরম দাঁড়িয়ে। আলোটা একটু ত্যারছাভাবে ওর মুখে পড়েছে। সারা মুখ বসন্তর দাগে ভরতি। আলোছায়ায় কীরকম যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। সৌরেনের দিকে একবার আড়চোখে তাকাল সুন্দরম। তারপর দ্রুত উনুনের কাছে চলে গেল। অনাবশ্যকভাবে উনুনের ছাই ঝাড়তে আরম্ভ করল।

ডাক্তার লিম বললেন, এখন মাথা গরম করো না, বিশ্বনাথ। যা হবার তো হয়ে গেছে। একটা উপায় বার করতে হবে এখন। মনে হয় শুধু রূপান্তরিত হয়ে বিশেষ কিছু সুবিধে হবে না। এত কম সময়ে আমাদের সমস্ত কিছু অনুকরণ করা অসম্ভব। তা ছাড়া আমাদের কোন প্রাইভেসি নেই এখানে। সুতরাং লুকিয়ে থাকাও চলবে না। এখানে সকলে সকলকে ভালোভাবে জানে চেনে। এতগুলো লোকের চোখে ধূলো দেওয়া অসম্ভব।

ওঃ, আপনিও ওই দলে! তিক্তস্বরে বললেন বিশ্বনাথ কুমার। পিছু হটতে হটতে ঘরের এক কোণে এসে দাঁড়াল সৌরেন। উদ্রান্তের ছাপ সারা মুখে। এত ঠান্ডার মধ্যেও বিন্দু বিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে ওর কপালে। ম্যাকডেভিডের কথাগুলো বেশ ভাবিয়ে তুলেছে সকলকে। যদি সত্যি হয় কথাগুলো? ছোট্ট একটা কালো মেঘ আস্তে আস্তে ছেয়ে ফেলছে সারা আকাশ। ঘনীভূত হচ্ছে সন্দেহ। সৌরেনের কাছ থেকে সবাই দূরে দূরে থাকতে চাইছে। আর সৌরেন? তার মনেও আলোড়ন চলেছে। সকলে সন্দেহ করছে তাকে। ভূতগ্রস্তের মতো ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে সৌরেন।

ভগবানের দোহাই, আর সহ্য করতে পারছি না। অসহ্য–অসহ্য হয়ে পড়েছে। দয়া করে চুপ করুন আপনারা! হঠাৎ চিৎকার করে উঠল সৌরেন। ঘরের মাঝখানে নাটকীয়ভাবে এগিয়ে এল সে। কী, কী হয়েছে আমার? আমি কি চিড়িয়াখানার জন্তু নাকি?

অপলক দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে রইলেন কাইবুলুস্কি। তারপর হতাশার সুরে বললেন, বেশ ভালো সময় এসেছে আমাদের। জানি না কী হবে! যাক, শোনো সৌরেন, তুমি যদি মনে করো যে সকলে তোমাকে সন্দেহ করছে তবে আমার বলার কিছু নেই। তুমি যা জানো আমরা তা জানি না। তুমিই একলা দৈত্যটাকে পাহারা দিচ্ছিলে। সুতরাং কেউ সন্দেহ করলে অবাক হবার কিছু নেই। যদি আমার কথা বলো তবে বলবো, হ্যাঁ, আমরা সন্দেহ করছি, ভয় করছি তোমাকে।

কী বলছেন আপনি? আপনিও অবিশ্বাস করেন না আমাকে! না, না, দোহাই আপনার, অবিশ্বাস করবেন না। উঃ, কী চাউনি তোমাদের? চেও না, চেও না অমন করে। শুধু একবার ভেবে দেখো আমার কথা। সৌরেনের চোখেমুখে এক ভয়ার্ত আকুলতা ফুটে উঠল।

আপনি কিছু করুন, ডাক্তার। শান্ত কণ্ঠে বললেন ডক্টর রায়, অন্তত একটা কিছু উপায় বার করুন।

উত্তেজিতভাবে সৌরেন বলল, আমিই তাহলে সব সমস্যার মূল। শুধু একবার আসুন আমার কাছে। দেখুন কী মারাত্মক চাউনি ওদের। কুকুরের মতো হিংস্র দৃষ্টিগুলো। শঙ্কর। শঙ্কর! তুমি কুড়ুল তুলছ কেন?

ব্রোঞ্জের তৈরি লালচে রংয়ের কুড়ুলটা ছিটকে পড়ল শঙ্করের হাত থেকে। পরক্ষণেই নিচু হয়ে তুলে নিল। তীব্র হিংসায় জ্বলে জ্বলে উঠছে চোখ দুটো।

ম্যাকডেভিডের পাশে এসে বসলেন ডাক্তার লিম। জ্বলন্ত উনুনের মধ্যে একটা কয়লা সশব্দে ফেটে গেল। বহুদূর সুড়ঙ্গপথ বেয়ে একটা কুকুরের কাতর আর্তনাদ ভেসে এল।

মাইক্রোস্কোপ দিয়ে পরীক্ষা করলেও বোধহয় কিছু পাওয়া যাবে না! ডাক্তারের স্বরে চিন্তার আভাষ। ভেবে দেখলাম, ম্যাকডেভিডের কথাই ঠিক। সিরাম টেস্ট ছাড়া কোনও পথ নেই।

ডক্টর রায় প্রশ্ন করলেন, সিরাম টেস্ট? ঠিক বুঝতে পারছি না তো ব্যাপারটা?

এ অবস্থায় সিরাম টেস্ট ছাড়া কোনও পথ নেই, ডক্টর রায়। একটু বললেই বুঝতে পারবেন। সিরাম টেস্টে খরগোশ বাঞ্ছনীয়। খরগোশকে প্রথমে মানুষের রক্ত ইনজেকশন করা হয়। জানেন বোধহয় নিজের জাতের রক্ত ছাড়া অন্য যে কোনও রক্ত প্রাণীদের দেহে বিষতুল্য। যাক, একবার করলে হবে না ইনজেকশন। বেশ কিছুদিন ধরে রক্তের পরিমাণ বাড়িয়ে বাড়িয়ে ইনজেকশন করে যেতে হবে। তারপর এমন এক সময় আসবে যখন দেখা যাবে যে, খরগোশটা হিউম্যান ইমিউন হয়ে পড়েছে, মানে, মানুষের রক্তের প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠেছে খরগোশটার মধ্যে। তখন সেই খরগোশের কিছুটা রক্ত একটা টেস্ট টিউবে থিতুতে দিলে টেস্ট টিউবের ওপর দিকে পরিষ্কার সিরাম জমবে। তারপর কয়েক ফোঁটা মানুষের রক্ত ওই টেস্ট টিউবের মধ্যে ফেললেই এক প্রতিক্রিয়া দেখা দেবে। তাতে প্রমাণ হয় যে শেষ রক্তটা মানুষের। আর মানুষের রক্ত ছাড়া যে কোনও প্রাণীর রক্ত দিলে কোনও প্রতিক্রিয়া হবে না। এবার নিশ্চয় বুঝতে পারছেন ডক্টর রায়, সিরাম টেস্টকে কেন বেছে নিয়েছি।

কিন্তু এখানে খরগোশ কোথায়?

 খরগোশ পাওয়া যে সম্ভব নয় এখানে তা জানি। খরগোশের অভাবে যে কোনও জন্তু নিয়ে এ পরীক্ষা চলতে পারে। কুকুর নিয়ে পরীক্ষা করব ঠিক করেছি। তবে একটু বেশি সময় লাগবে, এই যা। তা ছাড়া কুকুর বড় জন্তু বলে রক্তের পরিমাণও বেশি লাগবে। তাই রক্তটা আমরা দুজনে দেব ঠিক করেছি।

আমিও তো দিতে পারি ডাক্তার? জিজ্ঞাসা করলেন ডক্টর রায়।

আপনাকে নিয়েই তো দু-জন বললাম।

ইতিমধ্যে সৌরেনের কী হবে? ওর জন্যে রাঁধতে পারব না আমি। সুন্দরমের স্বরে একটা রুক্ষতার স্পর্শ।

এ কথা কেন বলছে, সুন্দর? ও তো আমাদের মতো মানুষও হতে পারে?

বোমার মতে ফেটে পড়ল সৌরেন। মানুষ! মানুষ হতে পারি! শয়তানের দল। কী ভেবেছিস তোরা? মানুষ নই আমি?

রক্তলাল হয়ে উঠল সৌরেনের মুখ। প্যারালিসিস রুগীর মতো কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ল সে। সমস্ত কিছু যেন ধোঁয়াটে হয়ে উঠল। যেন হাজার হাজার ঢাক বাজতে আরম্ভ করল কানের মধ্যে। স্বপ্নের মতো ভেসে আসতে লাগলো ডাক্তার লিমের কথাগুলো।

একবার যখন সন্দেহ হয়েছে তখন মানুষ বলে বিশ্বাস করতে দ্বিধা হচ্ছে আমাদের। সেই জন্য সিরাম টেস্ট না হওয়া পর্যন্ত বন্দী থাকতে হবে তোমাকে। সাধারণ মানুষ না হলে ম্যাকডেভিডের চেয়েও মারাত্মক তুমি। অবশ্য ম্যাকডেভিডকেও বন্দী করে রাখা হবে। ম্যাকডেভিডকে বন্দী না করলে সে তোমাকে খুন করতে চাইবে। শুধু তোমাকে খুন করেই ও শান্ত হবে না, একে একে সবাইকে খুন করবে সে। মরফিয়ার প্রভাবটা কেটে গেলেই এটাই তার বদ্ধমূল ধারণা হবে যে আমরা কেউ মানুষ নই। এ অবস্থার পর অবশ্য ওর মৃত্যুই শ্রেয়। কিন্তু এমন করে মরতে দেওয়া যায় না। যাকগে ওসব কথা, শোনো সৌরেন, কসমিক তাঁবুতে বন্দী করে রাখা হবে তোমাকে। আর একটা কথা, পালাবার চেষ্টা করলে বিশেষ সুবিধে হবে না কিন্তু।

আমি মানুষ। বিশ্বাস করুন, আমি মানুষ! সিরাম টেস্টটা খুব তাড়াতাড়ি করুন। ওঃ আমি পারছি না। পারছি না! আচ্ছন্নের মতো বলে চলল সৌরেন।

হলদে রঙের প্রকাণ্ড এক কুকুর নিয়ে ঘরে ঢুকল লিওন। কিছুক্ষণের মধ্যে কাজ আরম্ভ করলেন ডাক্তার লিম। ইনজেকশনের ছুঁচ ফোঁটাবার সঙ্গে সঙ্গে যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠল কুকুরটা।

ডক্টর রায়ের বাঁ হাতের কনুইয়ের কাছটা শক্ত করে চেপে ধরে স্ফীত শিরার মধ্যে একটা মোটা ছুঁচ ঢুকিয়ে দিলেন ডাক্তার লিম। সিরিঞ্জের মধ্যে ধীরে ধীরে রক্ত জমা হতে লাগল। যন্ত্রণায় শিরশির করে উঠল সমস্ত শরীর।

ঠিক কত দিন লাগবে বলুন তো, ডাক্তার? যন্ত্রণায় বিকৃত মুখে প্রশ্ন করলেন ডক্টর রায়।

সঠিক ভাবে বলতে পারব না ঠিক কতদিন লাগবে। তবে সাধারণ নিয়মটা জানি। খরগোশ নিয়ে পরীক্ষাও করেছি। কিন্তু কুকুর নিয়ে এই প্রথম। খরগোশের তুলনায় কুকুর বড় বলে সময়ও লাগে বেশি। তা ছাড়া বড় বড় শহরে হিউম্যান ইমিউন খরগোশ কিনতে পাওয়া যায়।

কীসের জন্য এত সিরাম টেস্টের প্রয়োজন পড়ে, ডাক্তার।

খুব বেশি কাজে লাগে অপরাধী নির্ণয়ে। যেমন মনে কর ক বলল যে সে খুন করেনি। শার্টের রক্তটা মুরগি কাটার সময় লেগেছে। তখন দেখা হয় যে শার্টের রক্তটা কোন সিরামের ওপর রিঅ্যাকশন হয়–চিকেন না হিউম্যান ইমিউন খরগোশের ওপর। আর এই পরীক্ষার পর ক-র কথায় সত্যাসত্য বিচার করা হয়।

আচ্ছা ডাক্তার, ম্যাকডেভিডের কী হবে? চিন্তান্বিতভাবে বললেন ডক্টর রায়, ওর ঘুম ভেঙে গেলেই তো আবার… তা ছাড়া সৌরেনও…

সৌরেন সম্বন্ধে কিছুই ভাবার নেই। স্মিথ আর জিতেন কসমিক তাঁবুর দরজাতে কড়া লাগাচ্ছে। জানেন, খুব শান্ত হয়ে গেছে সৌরেন। মনে হয় সকলের সন্দেহ থেকে বাঁচতে চায় ও। নির্জনতাই এখন কাম্য ওর। জানি না, হয়তো আমরা সবাই একদিন এমন নির্জনতা খুঁজব। কেমন একটা বিষণ্ণতার সুর ফুটে উঠল ডক্তার লিমের স্বরে।

তিক্ত স্বরে হেসে উঠল লিওন৷ সকলকে আলাদাভাবে বন্দী করলেই তো ভালো হয়। কাউকেই কেউ সন্দেহ করবে না তখন।

লিওনের কথায় কর্ণপাত না করে ডাক্তার লিম বলে চললেন, ম্যাকডেভিডকে আলাদা ঘরে রাখাই ভালো। নয় তো ঘুম ভাঙলেই একটা পুরানো গল্পের কথাই মনে হবে ওর।

কী গল্প, ডাক্তার?

গল্পটা আর কিছুই নয়। মুরগিদের সংক্রামক রোগের গল্প। গল্পের মূল কথা এই যে, রোগগ্রস্ত মুরগি না থাকলে মুরগিদের মধ্যে রোগ ছড়াবার কোনও সম্ভাবনাই থাকবে না। তাই রোগগ্রস্ত বা ওদের কাছাকাছি আছে এমন সমস্ত মুরগিদের মেরে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ। ম্যাকডেভিড, নিজে একজন প্রাণী তত্ত্ববিদ। সুতরাং ছাড়া পেলেই আমাদের সকলকে হত্যা করে ভিনগ্রহের দৈত্যের হাত থেকে পৃথিবীকে বাঁচাবার চেষ্টা করাটাই ওর পক্ষে স্বাভাবিক।

নিচের ঠোঁটটা কামড়ে ধরল লিওন, ঠিক সন্দেহ করেছেন আপনি। অবশ্য এক একটা ভালো দিকও আছে। অবস্থা ঘোরালো হয়ে পড়লে ম্যাকডেভিডকে ছেড়ে দিলেই হবে। অন্তত আত্মহত্যার হাত থেকে বাঁচা যাবে।

হেসে ফেললেন ডাক্তার লিম। তাই যদি হয় তবে এখানকার শেষ মানুষটি আমাদের মতো মানুষ থাকবে না, লিওন। আর সবাই যদি দৈত্য হয়ে যায় তখন তো আত্মহত্যার কোনও প্রশ্নই উঠবে না?

আচ্ছা ডাক্তার, প্রোটোপ্লাজমকে ইচ্ছেমতো পরিবর্তন করতে পারলে দৈত্যটা তো পাখি হয়ে উড়ে যেতেও পারত!

কুকুরটাকে জোরে চেপে ধরে ডাক্তার লিম বললেন, আপনার অনুমান বোধহয় ঠিক। নয়, ডক্টর রায়। শতাব্দীর পর শতাব্দী পাখিকে পরীক্ষা করছে মানুষ। পাখিদের ওড়ার কৌশল কিন্তু আয়ত্ত করতে পারেনি। পাখির ডানার গঠনরীতি, হাড়-মাংস টিসু প্রভৃতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জানা আর আকাশে ওড়ার কৌশল আয়ত্ত করার মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। তা ছাড়া ওর গ্রহের আবহাওয়ার সঙ্গে এখানকার কোনও মিল নাও থাকতে পারে। তাই ওখানকার পাখি এখানে হয়তো নাও উড়তে পারে।

হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে ঢুকলো স্মিথ। সব ঠিক করে দিয়েছি, ডক্টর। এখন ম্যাকডেভিডকে কোথায় রাখা হবে বলুন তো!

সত্যি তো কোথায় রাখা যায়?

আচ্ছা, পুবদিকের ছোট তাঁবুতে রাখলে কেমন হয়? বিশেষ কিছুই তো নেই ওখানে। রেডিয়োর কিছু বাড়তি পার্টস আছে শুধু। ডাক্তার, ম্যাকডেভিড কি নিজের দেখাশোনা নিজেই করতে পারবেন, না, অন্য লোকের দরকার হবে?

না, অন্য লোকের দরকার হবে না। শুধু বাইরে থেকে নজর রাখলেই হবে। একটা স্টোভ, কয়েক ব্যাগ কয়লা, কিছু খাবার আর কয়েকটা ছোটখাটো জিনিস রাখলেই হবে।

যন্ত্রগুলো আবার হাতে তুলে নিল স্মিথ।

 কিন্তু একটা বিষয়ে ভাবিয়ে তুলছে আমাকে। দৈত্যটা যদি সত্যিই টেলিপ্যাথির ক্ষমতা থাকে?

দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে ডাক্তার লিম বললেন, আমার বিশ্বাস আছে টেলিপ্যাথিতে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডক্টর নীহার রুদ্র এ বিষয়ে বিশদ পরীক্ষা করছেন। তিনি দেখিয়েছেন যে, টেলিপ্যাথি দ্বারা যেমন অন্যের চিন্তার ভাষা জানা সম্ভব, ঠিক তেমনি অন্যের মনে নিজের চিন্তাধারা প্রক্ষেপ করাও সম্ভব। যাক এসব কথা, আমাদের অভিযানের কী হবে, ডক্টর?

কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন ভক্টর রায়। তারপর হতাশভাবে বললেন, আর অভিযান। এত লোকের পরিশ্রম, লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ, সব কিছুই ব্যর্থ হয়ে যাবে।

না, না, ডক্টর, অভিযান ব্যর্থ হবে না। এতদিন তো আমরা চুপ করে বসেছিলাম না। কসমিক রে, চৌম্বক ধর্ম বা আবহাওয়া সম্বন্ধে অনেক নতুন তথ্য তো পেয়েছি আমরা।

হতাশভাবে হেসে উঠলেন ডক্টর রায়। ডাক্তার, শুধু সেদিনের কথা ভাবছিলাম আমি। যেদিন রেডিয়ো মারফত বলতে পারতাম সম্পূর্ণ সফল হয়েছি আমরা। না! সেদিন আর আসবে না আমাদের।

কী বলছেন আপনি? বিপদ কি চিরকাল থাকবে নাকি? জোর দিয়ে বলল স্মিথ।

ডক্টর রায় হাঃ হাঃ করে হেসে উঠলেন। বললেন, তোমার উপযুক্ত কথাই বলেছে, স্মিথ! জলে ডোবা মানুষ বাঁচবার চেষ্টা তো করবেই।

.

০৭.

ছোট তাঁবুর মধ্যে উত্তেজিতভাবে পায়চারী করছেন ম্যাকডেভিড। উদ্ভান্ত দৃষ্টিতে মাঝে মাঝে স্বাভাবিক স্পন্দন ফিরে আসছে। ঘরের মধ্যে স্মিথ, কাইবুলুস্কি, ডাক্তার লিম আর জিতেন ঘোষ একমনে কাজ করে যাচ্ছে।

ম্যাকডেভিড আর ওদের মাঝখানে রয়েছে একটা টেবিল, আর টেবিলের ওপর জ্বলন্ত একটা স্টোভ। একে একে অন্যান্য জিনিসগুলো টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখল স্মিথ।

ম্যাকডেভিড চিৎকার করে উঠলেন, কাউকে আসতে দেব না আমার কাছে। নিজের রান্না নিজেই করে নেব। যে রকম করেই হোক পালাতে হবে। না, না, তোমাদের ছোঁয়া কোনও কিছু খাব না। সিল করা টিনের খাবার দাও। হ্যাঁ, সিল করা।

কাইবুলুস্কি বললেন, শান্ত হোন আপনি। আপনার কথা মতোই করা হবে। তবে আমি বরং…

কথা শেষ করার আগেই বাঘের মতে তেড়ে এলেন ম্যাকডেভিড, বেরিয়ে যাও! বেরিয়ে যাও এখান থেকে। তোমরা মানুষ নও! দৈত্য, দৈত্য! এক একটা বীভৎস দানব তোমরা। তাঁবুর মোটা শক্ত তিরপলের দেওয়ালটা ছিঁড়ে ফেলার চেষ্টা করলেন একবার। দূর হ দূর হ! আমি তোদের দলে যোগ দেব ভেবেছিস! আমি মানুষ! মানুষ!

অবাক হয়ে পিছু হটে এলেন কাইবুলুস্কি। ডাক্তার লিম বললেন, ওকে একলা থাকতে দাও। একলা থাকা দরকার এখন।

একে একে চারজনেই বেরিয়ে এল। দরজার পাল্লা দুটোতে বড় বড় দুটো ঝুঁ মারল জিতেন। তারপর দরজা বন্ধ করে স্টিলের মোটা তার দিয়ে ভ্রু দুটোকে শক্ত করে বাঁধা হল। ড্রিল দিয়ে দরজার মধ্যে একটা ছোট গর্ত করল স্মিথ। গর্তের মধ্যে দিয়ে ভেতরটা পরিষ্কার দেখা যায়।

ঘরের ভেতরে অস্থিরভাবে পায়চারী করছেন ম্যাকডেভিড। হঠাৎ ঘড় ঘড় করে ভারী কোনও কিছু টানার আওয়াজ শোনা গেল। গর্তের মধ্যে দিয়ে দেখার চেষ্টা করল স্মিথ। ডাক্তার লিমও ঝুঁকে পড়লেন ওর কাঁধের ওপর। বড় টেবিলটাকে দরজার ঠিক সামনে রেখেছেন ম্যাকডেভিড। বাইরে থেকে দরজা খোলা অসম্ভব এখন।

 কী সাংঘাতিক ভয়! দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন কাইবুলুস্কি।

 উত্তর দিগন্তরেখায় সূর্যালোক হাজার হাজার রামধনু তৈরি করে চলেছে। সূর্যাস্ত হতে এখনও দু-ঘণ্টা দেরি। ঝিরঝির করে তুষার পড়ছে। লক্ষ লক্ষ তুষার কণায় এক সূর্য কোটি কোটি সূর্য হয়ে ঝরে পড়ছে মাটির বুকে। মাঝে মাঝে তুষার ঘূর্ণিতে চতুর্দিক ছেয়ে যাচ্ছে। আকাশের দিকে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এরিয়েলটা। যেন আকাশকে আহ্বান করছে নেমে আসার জন্যে।

বসন্ত এসে গেল, ক্লান্ত স্বরে বলল জিতেন, কবে যে মুক্তি পাব এখান থেকে।

 কাইবুলুস্কি হঠাৎ জিজ্ঞাসা করলেন, কুকুরটার খবর কী, ডাক্তার? কোনও ফল হল?

আরও ত্রিশ ঘণ্টা পরে বোঝা যাবে। আজকে আমার রক্ত দেওয়ার দিন। তবে কাজ শেষ হতে আরও পাঁচদিন লাগবে। তাড়াতাড়ি করলে হয়তো কোনও ফল হবে না।

ভয় হচ্ছে ইতিমধ্যে সৌরেন যদি পালটে যায়। কিন্তু তা-ই যদি হবে তবে ওই জন্তুটা পালাবার সঙ্গে সঙ্গে সে আমাদের জানাল কেন? অনায়াসে তো দেরি করতে পারত! বিড়বিড় করে বললেন কাইবুলুস্কি।

স্মিথ বলল, ওসব কথা থাক এখন। আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয়? ফিজিক্সের একটা শক্ত প্রবলেম যদি দেওয়া যায় সৌরেনকে? করতে না পারলেই বোঝা যাবে ও সৌরেন নয়!

না, না। তাতে বোঝা যাবে না। দৈত্যটার টেলিপ্যাথি জানা থাকলে এ কৌশল খাটবে না। অর্জুন সিং চেষ্টা করেছিল এ বিষয়ে। কিন্তু কোনও ফল পাওয়া যায়নি।

কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখা দরকার। জিতেনের কথায় চমকে উঠল সবাই। ওর গলার স্বরে কেমন একটা রুক্ষ কর্কশ ভাব। এখানে আমরা চারজন আছি। এখন চারজন যদি চারজনকেই সন্দেহ করতে শুরু করি তবে আমাদের মরা ছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। মনে করে দেখুন সৌরেনের শেষ কথাগুলো মারাত্মক সন্দেহ কেন তোমাদের চোখে। উঃ, ওর মত অবস্থা হলে নিশ্চয় পাগল হয়ে যেতাম আমি। তাই, তাই মনে হয় সৌরেন সম্বন্ধে চিন্তা করা দরকার।

তোমার সন্দেহ অমূলক, জিতেন। দৈত্যটা সত্যি সত্যি মারা গেছে এখন। সুতরাং অন্য কাউকে সন্দেহ করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। সৌরেনের কথা আলাদা। কারণ সারারাত সে একলা ছিল দৈত্যটার সঙ্গে। আর সৌরেন সন্দেহমুক্ত হলে আমিই খুশি হব সবচেয়ে বেশি! শান্ত স্বরে বললেন ডাক্তার লিম।

.

০৮.

অস্বাভাবিক উজ্জ্বলতায় জ্বলজ্বল করছে চোখ দুটো। ঐকান্তিক আগ্রহে উত্তেজিতভাবে অপেক্ষা করছে সৌরেন। কাচের টেস্ট টিউবের অর্ধেকটা লালচে রঙের তরল পদার্থে ভরতি। বিস্ফারিত নেত্রে সেই দিকে চেয়ে আছে ও। ওর শরীরের রক্ত রয়েছে ওই টেস্ট টিউবে। টেস্ট টিউবটাকে ভালো করে ঝাঁকিয়ে গরম জল ভরতি এক বিকারের মধ্যে রাখলেন ডাক্তার লিম। টেস্ট টিউবে গায়ে লাগানো থার্মোমিটারে রক্তের উত্তাপ লক্ষ করা যাচ্ছে। হঠাৎ ছোট্ট থার্মোস্ট্যাট যন্ত্র থেকে ক্লিক করে আওয়াজ উঠল। সঙ্গে সঙ্গে ইলেকট্রিক হট প্লেটটা গরমে লাল হয়ে উঠতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যে টেস্ট টিউবের তলায় বিন্দু বিন্দু করে সাদামতো কিছু থিতিয়ে জমা হতে লাগল।

আরও কাছে এগিয়ে এল সৌরেন। অদ্ভুত দেখাচ্ছে ওকে। প্রচণ্ড ঠান্ডার মধ্যেও বড় বড় ফোঁটা ঘাম ফুটে উঠেছে সারা মুখে। উত্তেজনায় নাকের পাটাটা ফুলে ফুলে উঠছে। একবার শুকনো ঠোঁট দুটো জিব দিয়ে ভিজিয়ে নিল সে।

হে ভগবান! অর্ধস্ফুট আর্তনাদ করে উঠল সৌরেন। দু-হাতে মুখ ঢেকে বাচ্চা ছেলের মতো কাঁদতে শুরু করল। ছ-দিন। পুরো ছ-দিন ছ-রাত, পাগলের মতো ভেবেছি যদি পরীক্ষায়…

আলতো ভাবে পিঠের ওপর হাত রাখলেন ডক্টর রায়। শান্ত হও, সৌরেন। হিউম্যান ইমিউন ছিল কুকুরের রক্তটা আর তোমার সিরামের প্রতিক্রিয়া হয়েছে ওর ওপর। সত্য কোনদিনও চাপা থাকে না।

সৌরেন, সৌরেন তাহলে মানুষ! একটু থেমে থেমে বললেন বিশ্বনাথ কুমার। উঃ, কী আনন্দ! দৈত্যটা সত্যি সত্যি মরে গেছে? মরে ভূত হয়ে গেছে!

ডাক্তার লিম গম্ভীর গলায় ঘোষণা করলেন, সৌরেন মানুষ! দৈত্য নয়!

হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ… হঠাৎ মৃগী রুগীর মতো হাসতে শুরু করল সুন্দরম। চকিতের মধ্যে কাইবুলুস্কি ঘুরে দাঁড়ালেন। তারপর ঠাস ঠাস করে ওর দু-গালে চড় মারলেন। কিন্তু তবুও হাসতে লাগল সে, কাঁদতে শুরু করল। তারপর দু-হাতে মুখ ঢাকা দিয়ে বিড় বিড় করে বলল, ভগবানের অসীম দয়া। আমি বেঁচে গেছি৷ বেঁচে গেছি আমি।

কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আনন্দস্রোতে ভেসে গেল স্বর্গপুরী। হাসি, ঠাট্টা চিঙ্কারে মুখরিত হয়ে উঠল চতুর্দিক। একসঙ্গে সবাই কথা বলতে চায়। দরদর করে দু-চোখ দিয়ে জল পড়ছে সৌরেনের। কাইবুলুস্কি জড়িয়ে ধরল ওকে। কিছুক্ষণ আগের পাথরচাপা নিস্তব্ধতা এক নিমেষেই উড়ে গেল।

আর একটা সম্ভাবনার কথাও বড় হয়ে দেখা দিল এখন। ম্যাকডেভিডও বোধহয় ভালো হয়ে যাবে।

কিছুক্ষণের মধ্যে সবাই ম্যাকডেভিডের তাঁবুর দিকে রওনা হয়ে গেল। সুড়ঙ্গপথের অনেক দূর থেকে কুকুরদের চিৎকার ভেসে এল। ওরাও যেন বুঝতে পেরেছে দৈত্যটা আর বেঁচে নেই। তাই বুঝি আনন্দে চিৎকার করে উঠছে থেকে থেকে। ডক্টর রায়, ডাক্তার লিম, কাইবুলুস্কি আর সৌরেন কেবল রইল স্বর্গপুরীতে। আবার কাজ আরম্ভ করলেন ডাক্তার লিম। নিজের অজান্তে ভ্র দুটো কুঁচকে উঠল একবার। টেস্ট টিউবটা হাতে নিয়ে জ্বলন্ত বার্নারের দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি। একটা তরল পদার্থ ঢাললেন টেস্ট টিউবের মধ্যে। আর সঙ্গে সঙ্গে মড়ার মতো সাদা হয়ে উঠল ডাক্তারের সারা মুখ।

ভয়ংকর আতঙ্কে বিস্ফারিত হয়ে উঠল চোখ দুটো। ঠোঁট দুটো থর থর করে কেঁপে উঠল।

নিজের চোখ দুটো একবার রগড়ে নিলেন কাইবুলুস্কি। এ কী স্বপ্ন! সব মিথ্যে হয়ে গেল! মাথাটা কেমন যেন ঝিমঝিম করে উঠল।

ডাক্তার লিম চিৎকার করে উঠলেন, ডক্টর রায়! ডক্টর রায়! তাড়াতাড়ি আসুন একবার! খুব তাড়াতাড়ি।

দ্রুতপায়ে কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন ডক্টর রায়। থমথমে নীরবতা নেমে এল স্বর্গপুরীতে। যেন পাথরের মতো নিস্পন্দ হয়ে গেল সৌরেন।

ডক্টর রায়, দৈত্যটার নিজের রক্তেও প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সমস্ত পরিশ্রম ব্যর্থ হয়ে গেল। কিন্তু কিন্তু এর থেকে কী প্রমাণ হচ্ছে জানেন? কেবল আপনি আর আমিই তো রক্ত দিয়েছি। উঃ, ভাবতে পারছেন! কী সাংঘাতিক পরিণাম! আমাদের দুজনের মধ্যে একজন নিশ্চয়ই…?

.

০৯.

ম্যাকডেভিডকে জানানোর আগেই সকলকে ডেকে পাঠাও, স্মিথ। একটা ক্লান্ত সুর ফুটে উঠল ডাক্তার লিমের স্বরে।

মাথা নিচু করে বাইরে চলে গেল স্মিথ। দূর থেকে ওর চিৎকার ভেসে এল। সবাইকে ফিরে আসার জন্যে বলছে স্মিথ।

কাইবুলুস্কি!

আমাকে ডাকছেন, ডক্টর রায়?

হ্যাঁ, কাইবুলুস্কি। শোনো, এখন থেকে এই অভিযানের নেতৃত্বভার তোমার। ভগবান তোমার সহায় হোন। এই অবস্থায় আমার দলপতি থাকা উচিত নয়।

দীর্ঘদেহী কাইবুলুস্কি ধীরে ধীরে মাথা নত করলেন। জলে ভরে উঠল চোখ দুটো। ডক্টর রায় বললেন, দু-জনের মধ্যে একজন আমি। আমি জানি আমি মানুষ, আসল ডক্টর রায়। কিন্তু কী প্রমাণ দেব আমি? সিরাম টেস্ট ব্যর্থ হয়েছে। আবার একটা কথাও ভেবে দেখা দরকার। ডাক্তার যদি মানুষ না হতেন তাহলে কখনওই সিরাম টেস্টকে ব্যর্থ বলতেন না। কারণ পরীক্ষা সফল হয়েছে বললে তো দৈত্যটারই লাভ হত বেশি। কিন্তু ডাক্তার তা করেনি। আর এতেই প্রমাণ হয় ডাক্তার মানুষ।

ডাক্তার লিগ বাঙ্কের ওপর বসে পড়লেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, আমিও বলছি আমি মানুষ। কিন্তু প্রমাণ দিতে পারছি না। তবে এটা ঠিক আমাদের দু জনের মধ্যে নিশ্চয় একজন মিথ্যে কথা বলছি। আমাদের মধ্যে একজন মানুষ নয়। আর আপনি যা বললেন ডক্টর রায়, তার সত্যিকারের প্রমাণ কোথায়?

কিছুক্ষণ নিজের গায়ে মাথায় হাত বোলালেন ডাক্তার লিম। উদভ্রান্তের মতো বেশ কিছু সময় চেয়ে রইলেন সামনের দিকে। তারপর হঠাৎ বাঙ্কের ওপর শুয়ে পড়ে হাসতে শুরু করলেন। আমাদের দুজনের মধ্যে যে একজন মানুষ একথাও বলে না সিরাম টেস্ট। হাঃ হাঃ হাঃ… সবাই দৈত্য হলে একই ফল হত। আমরা সবাই দৈত্য। ভিনগ্রহের ভয়ংকর দৈত্য! হাঃ হাঃ হাঃ হাঃ…

কাইবুলুস্কি, আপনার তো এই বিষয়ে ভালো জ্ঞান আছে। ডক্টরেট অব মেডিসিন পরীক্ষা না দিয়েই তো আবহবিদ্যা শিখেছেন আপনি। দেখুন না চেষ্টা করে যদি কোনও পথ পাওয়া যায়। আন্তরিকভাবে অনুরোধ করলেন অর্জুন সিং।

কোনও কথা না বলে হাইপেডারমিক সিরিঞ্জটা তুলে নিলেন কাইবুলুস্কি। ৯৫% ভাগ অ্যালকোহলে যত্নের সঙ্গে পরিষ্কার করে নিলেন সিরিঞ্জটা।

চিন্তান্বিত সুরে কাইবুলুস্কি বললেন, ডাক্তার হয়তো সত্যি কথা বলেছে। যাক অর্জুন, একটু সাহায্য করবে আমাকে?

সিরিঞ্জের চুঁচটা প্রায় সবটাই ঢুকে গেল ডাক্তারের মাংসল উরুতে। তবুও নির্বিকারভাবে হাসতে লাগলেন ডাক্তার লিম। ক্রমে ক্রমে হাসি কান্নায় পরিণত হল। কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুমিয়ে পড়লেন ডাক্তার লিম।

একে একে সবাই ফিরে এল তাঁবুর মধ্যে। অনেকের হাতে পায়ে এখনও সাদা সাদা তুষার লেগে রয়েছে। সৌরেনের হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। পুড়ে পুড়ে ছোট হয়ে গেছে ওটা। ছ্যাঁকা লাগছে হাতে। বিরক্তিতে হাতের দিকে একবার তাকাল সৌরেন। তারপর জ্বলন্ত সিগারেটটা পায়ের তলায় ফেলে জুতো দিয়ে ঘষে দিল।

এবার কাইবুলুস্কি বললেন, ডাক্তার লিমের কথাই বোধহয় ঠিক। আমি জানি আমি মানুষ, কিন্তু প্রমাণ দিতে পারছি না। এটাই সবচেয়ে বড় সমস্যা। যাই হোক, নিজের জন্যেই আর একবার সিরাম টেস্ট করব আমি। ইচ্ছে করলে তোমরাও যোগ দিতে পার আমার সঙ্গে।

সবাই নির্বাক। কোনও শব্দ নেই কোনওখানে। এক ছুঁয়ে যেন নিবে গেল আনন্দের শিখা।

কিছুক্ষণ পরে টেস্ট টিউবটা তুলে ধরলেন কাইবুলুস্কি। লালচে রঙের তরল পদার্থের তলায় সাদা সাদা কিছু জমছে।

মানুষের রক্তের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। সুতরাং বোঝা যায় ওর দু-জনে দৈত্য নয়।

 আমারও তাই মনে হয়। সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন অর্জুন সিং।

মৃদু হেসে বললেন কাইবুলুস্কি, মনে হয় বললে তো চলবে না। প্রমাণ করতে হবে। খিল খিল করে হেসে উঠল সুন্দম। আমি কি জানি যে আমি দৈত্য হয়ে গেছি? আমার শরীরের দৈত্যের প্রভাব কি ধরতে পারতাম? ওঃ ভগবান, হয়তো ইতিমধ্যে দৈত্যই হয়ে গেছি আমি।

সে কথা তো তুমিই ভালো জান সুন্দরম। কঠোরস্বরে বললেন কাইবুলুস্কি। শিশির মধ্যে সিরামের এখনও কিছু অবশিষ্ট আছে। শিশিটা হাতের মধ্যে তুলে নিলেন কাইবুলুস্কি।

লিওন আর অর্জুন, একটু সাহায্য করবে আমাকে? না, না, সকলের প্রয়োজন নেই। দু জন গেলেই হবে।

সুড়ঙ্গপথে কুকুরদের তাঁবুর দিকে এগিয়ে চললেন কাইবুলুস্কি। লিওন আর অর্জুন সিংও চলল সঙ্গে সঙ্গে।

আরও সিরামের দরকার হবে? যেতে যেতে প্রশ্ন করল লিওন।

মাথা নাড়লেন কাইবুলুস্কি, হ্যাঁ, আরও পরীক্ষা করতে হবে। চারটে গোরু, একটা ষাঁড় আর সত্তরটা কুকুর আছে এখানে। সুতরাং সিরাম পেতে কোনও অসুবিধাই হবে না, কী বলো?

.

১০.

কোনও কথা না বলে হাত-পোয়া বেসিনের কাছে দাঁড়ালেন কাইবুলুস্কি। কিছুক্ষণ পরে লিওন আর অর্জুন সিংও পাশে এসে দাঁড়ালো। নিচের ঠোঁটটাকে বারে বারে কামড়ে ধরার চেষ্টা করল লিওন।

কী করছেন আপনি? আরও ইমিউনাইজিং করতে হবে? জিজ্ঞাসা করল সৌরেন।

 ধমকে উঠল লিওন, চুপ করে থাকো না। যা করছি তো দেখতেই পাচ্ছ।

 শান্ত স্বরে বলল অর্জুন সিং, না সৌরেন, আর কাউকে ইমিউন করতে হবে না। তা ছাড়া ইমিউন করা কুকুরটা বেশ ভালোই আছে।

ওটা ছাড়া অন্য একটা কুকুরকে ইমিউনাইজ করলে কেমন হয়? উৎসুক ভাবে জিজ্ঞাসা করলেন বিশ্বনাথ কুমার।

না, তা আর সম্ভব নয়। কুকুর, গোরু আর কোনও কিছুই নেই। সুতরাং ইমিউন করার কোন প্রশ্নই ওঠে না।

কুকুর নেই! কেন? তাহলে কী.. হতাশভাবে বাঙ্কের ওপর বসে পড়ল জিতেন।

সব শেষ করে দিয়েছি আমরা। জানো, রূপ পালটাবার সময় খুব ভয়ানক দেখায় ওদের। কিন্তু খুব আস্তে আস্তে হয় পরিবর্তনটা। ইলেকট্রোকিউটারের কাছে সব বাছাধনই কাবু। একমাত্র ইমিউন করা কুকুরটাকেই বোধহয় নাগাল পায়নি দৈত্যটা। উঃ, ভাবতে পার কী সাংঘাতিক ব্যাপার! সংক্ষেপে সব বলে গেল অজুন সিং।

উত্তেজিতভাবে উঠে দাঁড়াল সুন্দরম, গোরুগুলোকেও..

হ্যাঁ হ্যাঁ, গোরুগুলোও। ইলেকট্রোকিউটারের স্পর্শে গলে যাবার সময় কী বড় বড় চোখ করে তাকাচ্ছিল ওরা। একজনও পালাতে পারেনি। পালাবার আগেই শক্ত করে বেঁধে ফেলেছিলাম আমরা।

চোখ-মুখ উত্তেজনায় লাল হয়ে উঠল সুন্দরমের। ভয় ভয় ভাবে এদিক ওদিক কী যেন খোঁজার চেষ্টা করল। সামনে র‍্যাকের ওপর একটা বালতি বসানো ছিল। বালতির দিকে চোখ পড়তেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠল সুন্দরম। তারপর আস্তে আস্তে দরজার দিকে পিছু হটতে শুরু করল।

দুধগুলো… ঠিক একঘণ্টা আগে দুয়েছিলাম আমি। থেমে থেমে বলল সে। শেষের কথাগুলো আর্তনাদের মতো শোনাল। সকলের বোঝবার আগেই এক দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। মোটা জামাকাপড় বা গগস কোনও কিছুই নিল না।

অর্জুন সিং বলল, আবার একজন পাগল হল। আবার ও তো নিজেই দৈত্য হতে পারে। নয়তো ছুটে পালাবে কেন? তা ছাড়া স্কি-ও নিল না! একটা ব্লো টর্চ নিয়ে কেউ যাও তো ওর সঙ্গে।

হুড়মুড় করে কয়েকজন দৌড়ে বাইরে চলে গেল। বাঙ্কের ওপর চিত হয়ে শুয়ে পড়লেন বিশ্বনাথ কুমার। ঘটনার পর ঘটনায় চিন্তাশক্তি যেন লোপ পাচ্ছে।

কাইবুলুস্কি, ঠিক কতক্ষণ আগে গোরুগুলো ভিনগ্রহের জীবে রূপান্তরিত হয়ে ছিল বলতে পার?

অসহায়ভাবে মাথা নাড়লেন কাইবুলুস্কি। টেস্ট টিউবটা নিয়ে দুধের বালতির কাছে চলে এলেন। পরীক্ষা করতে হবে দুধটাকে। টেস্টটিউবের মধ্যে কয়েক ফোঁটা দুধ ফেলতেই কেমন যেন ঘোলা ঘোলা হয়ে গেল। সঠিকভাবে কোনও কিছু বোঝা যায় না এতে। কিছুক্ষণ চেষ্টা করার পর হতাশভাবে টেস্ট টিউবটা ফেলে দিলেন কাইবুলুস্কি।

না, কোনও কিছু বোঝা গেল না। এর থেকে দুটো মানে হয়। হয় গোরুগুলো গোরুই ছিল, নয়তো সম্পূর্ণ পালটে গেছল ওরা। আর সেই জন্যেই আসল নকলের তফাত ধরা যাচ্ছে না।

ঘুমের মধ্যে অস্থির হয়ে উঠলেন ডাক্তার লিম। বিকৃত স্বরে হেসে উঠলেন একবার।

মরফিয়াতেও কিছু হল না দেখছি। তাহলে মরফিয়াতেও কি–

ভগবান জানেন! জীবন্ত প্রাণী ছাড়া জড়পদার্থকেও আক্রমণ করতে পারে কি না বলতে পারি না।

আস্তে আস্তে কাইবুলুস্কির কাছে এগিয়ে এল সৌরেন। বলল, আচ্ছা কাইবুলুস্কি, দৈত্যটার ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে বা টুকরো টুকরো মাংস খাওয়ার জন্যই তো কুকুরটা দৈত্য হয়ে গেছে। কিন্তু আমি তো একটা ঘরে বন্দী ছিলাম। এতেও কী প্রমাণ হয় না…

না সৌরেন, কোনও কিছুই প্রমাণ হয় না এতে। একটু রুক্ষভাবে বলল অর্জুন সিং।

কাইবুলুস্কি বললেন, এত সহজে কোনও কিছুই প্রমাণ হয় না, অর্জুন সিং। ভিনগ্রহের জীবনটার বিষয়ে কিছুই জানি না আমরা। সঠিকভাবে প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত কোনও কিছু বিশ্বাস করা উচিত হবে না। তবে একটা সহজ উপায় আছে। হৃৎপিণ্ডে গুলি করে দেখা যেতে পারে। না মরলে বুঝতে হবে যে সে মানুষ নয়। এবার মুখ খুললেন ডক্টর রায়, কুকুর নেই, গোরুও নেই। সবই তো গেছে। তুমি বলছ যে, দৈত্যটা এবার মানুষের রূপ নিয়েছে। বেশ ভালো কথা, কিন্তু তোমার পরীক্ষায় তো কেবল দৈত্যরাই বাঁচবে। মানুষগুলো তো সব মরে যাবে। তবে লাভ হবে কি? আমাদের উদ্দেশ্য তো দৈত্যদেরই মেরে ফেলা। অবশ্য তুমি এখন নেতা! তোমার আদেশই মানতে হবে। আর আমিও তো এখন তোমাদের সন্দেহ দলভুক্ত। তাই না কাইবুলুস্কি?