০৬. হলঘরটিতে মানুষের বসতি

হলঘরটিতে মানুষের বসতির প্রায় সবই এসেছে। খাওয়ার পর আজকে বিশেষ পানীয় সরবরাহ করা হয়েছে, পানীয়তে কয়েক মাত্রা উত্তেজক এনজাইম ছিল তাই যারা উপস্থিত আছে তাদের সবাই হইচই করছে, অল্পতেই হেসে গড়াগড়ি খাচ্ছে বা আনন্দে চ্যাঁচামেচি করছে। হইচইয়ের মাত্রা যখন একটু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে পৌঁছে গেল তখন রুহান তার পানীয়ের গ্লাস টেবিলে রেখে উঠে দাঁড়াল, সাধারণত এরকম পরিস্থিতিতে সবাই শান্ত হয়ে যায়, যিনি দাঁড়িয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন তার কী বলার আছে শোনার জন্য সবাই খানিকটা সময় দেয়। আজকে তার কোনো সম্ভাবনা দেখা গেল না। তাই রুহানকে টেবিলে কয়েকবার থাবা দিয়ে শব্দ করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হল, যখন হইচই একটু কমে এল তখন রুহান উচ্চৈঃস্বরে বলল, প্রিয় মানববসতির সদস্যরা, সবাইকে আন্তরিক শুভেচ্ছা।

এটি অত্যন্ত সাদামাঠা সম্ভাষণ কিন্তু উত্তেজক এনজাইমের কল্যাণে সবার কাছে এই সম্ভাষণটিকেই এত হৃদয়গ্রাহী মনে হল যে সবাই চিৎকার করে হাত নেড়ে প্রত্যুত্তর দিল।

তোমরা জান–রুহান গলা উচিয়ে বলতে চেষ্টা করে, আজকে আমরা এখানে একটি বিশেষ কারণে উপস্থিত হয়েছি। আমাদের মানববসতির উন্নয়ন পরিষদের নবীন সদস্য রুখ আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে। রুহানকে এই সময় একটু থামতে হল কারণ। উপস্থিত সবাই রুখকে সম্ভাষণ জানানোর জন্য বিকট গলায় চঁচামেচি করতে শুরু করল। অতি উৎসাহী কয়েকজন তরুণ–তরুণী আরো একধাপ এগিয়ে রুখকে টেবিলের উপর টেনে তোলার চেষ্টা করছিল কিন্তু রুথ বেশ কষ্ট করে নিজেকে মুক্ত করে মোটামুটি নিরাপদ দূরত্বে সরে গেল। রুহান হাত তুলে সবাইকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করতে করতে বলল, আমি জানি এটি আমাদের সবার জন্য খুব আনন্দের ব্যাপার—এর আগে আমরা এভাবে আমাদের। প্রিয়জনকে হারিয়েছি। তারা বুদ্ধিমান এনরয়েডদের সাথে দেখা করার জন্য মূল নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে গিয়ে আর ফিরে আসে নি। আমরা লক্ষ করেছি আমাদের মাঝে যারা বেশি প্রাণবন্ত যারা বেশি বুদ্ধিমান তারা সাধারণত আর ফিরে আসে না–সে কারণে আমরা রুখকে নিয়ে। খুব বেশি দুশ্চিন্তিত ছিলাম। যা–ই হোক–সে সুস্থ দেহে আমাদের মাঝে ফিরে এসেছে, আজ আমাদের খুব আনন্দের দিন। আমি সবার পক্ষ থেকে রুখকে সাদর সম্ভাষণ জানাচ্ছি।

রুখ রুহানের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ একটু অন্যমনস্ক হয়ে যায় তার কেন জানি মনে হতে থাকে রুহানের এই কথাগুলোর মাঝে যেন কী একটা অসঙ্গতি রয়েছে কিন্তু সেটা কী সে ঠিক ধরতে পারে না। রুখ অসঙ্গতিটা কোথায় বোঝার চেষ্টা করছিল। তাই ঠিক লক্ষ করে নি যে সমবেত সবাই চিৎকার করে তাকে ডাকছে, তাকে কিছু একটা বলতে বলছে। ক্রীনা তার পাজরে খেচা দিয়ে ডাকল, রুখ

কী হল?

তুমি কিছু একটা বল।

আমি?

হ্যাঁ–দাঁড়াও।

রুখ তার জায়গায় দাঁড়িয়ে কেশে একটু গলা পরিষ্কার করে বলল, তোমরা সবাই জান যারা বুদ্ধিমান এবং প্রাণবন্ত সাধারণত তারা বুদ্ধিমান এনরয়েডদের কাছে গেলে আর ফিরে আসে না। দেখতেই পাচ্ছ আমি ফিরে এসেছি কাজেই আমি নিশ্চয়ই বোকা এবং অলস।

উপস্থিত সবাই উত্তেজক পানীয়ের কারণে উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করে, রুখ সবার হাসির দমক কমে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করে বলল, কিন্তু যদি আমাকে তোমরা জিজ্ঞেস কর তুমি কি বুদ্ধিমান এবং প্রাণবন্ত হয়ে মারা যেতে চাও নাকি বোকা এবং অলস হয়ে বেঁচে থাকতে চাও–আমি তা হলে বলব বোকা এবং অলস হয়ে বেঁচে থাকতে চাই।

সবাই আবার হাসতে শুরু করে এবং রুখের হঠাৎ মনে হতে থাকে সে এইমাত্র যে কথাটি বলল তার মাঝে কিছু একটা অসঙ্গতি আছে। অসঙ্গতিটি কী সে মনে করার চেষ্টা করে কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারে না। রুখ আবার অন্যমনস্ক হয়ে যায় এবং প্রায় অন্যমনস্কভাবেই নিচু গলায় বলল, আমরা মানুষেরা সম্ভবত খুব গুরুত্বপূর্ণ।

উপস্থিত অনেকে কথাটিকে একটি রসিকতা হিসেবে নিয়ে হেসে ওঠে কিন্তু রুখ তাদের হাসিকে উপেক্ষা করে নেহায়েত অপ্রাসঙ্গিকভাবে গলায় অনাবশ্যক গুরুত্ব আরোপ করে বলল, আমি যতই চিন্তা করি ততই নিশ্চিত হতে থাকি যে মেতসিসে আমাদের অবস্থান খুব গুরুত্বপূর্ণ।

ক্রীনা একটু অবাক হয়ে বলল, কেন? তুমি একথা কেন বলছ?

যেমন মনে কর অক্সিজেনের কথা–পৃথিবীতে অক্সিজেনের মতো ভয়ঙ্কর গ্যাস খুব কম রয়েছে। যে কোনো পদার্থ অক্সিজেনের সংস্পর্শে এলে অক্সিডাইজড হয়ে যায়। যন্ত্রপাতি মরচে ধরে যায়, নষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু আমরা–মানুষেরা অক্সিজেন ছাড়া এক মিনিট বাচতে পারি না। তাই শুধুমাত্র আমাদের জন্য মেতসিসের বাতাসে শতকরা কুড়ি ভাগ অক্সিজেন ভরে দেওয়া হয়েছে। চিন্তা করতে পার এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে যত এনরয়েড, রোবট, যন্ত্রপাতি আছে তাদের কী দুর্দশা হচ্ছে? তবু তারা সেটা সহ্য করে যাচ্ছে। একদিন নয় দুদিন নয় বছরের পর বছর শতাব্দীর পর শতাব্দী। কেন সহ্য করছে? নিশ্চয়ই এর কোনো কারণ আছে।

উপস্থিত সবাই একটু অবাক হয়ে রুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। মেতসিসে মানুষের মোটামুটি নিরুপদ্রব জীবনে সাধারণত এই ধরনের কথাবার্তা প্রকাশ্যে আলোচনা করা হয় না। এই মহাকাশযানে মানুষ থেকে লক্ষগুণ বেশি বুদ্ধিমান এনরয়েড রয়েছে, তাদের অনুকম্পা ছাড়া মানুষ এখানে এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারত না–এরকম পরিবেশে মানুষের গুরুত্ব বেশি না বুদ্ধিমান এনরয়েডের গুরুত্ব বেশি সেই আলোচনা নেহায়েত অনাবশ্যক!

রুহান মৃদু হেসে বলল, রুখ, তোমার জ্ঞানগম্ভীর আলোচনার জন্য এখন কেউ প্রস্তুত নয়। উত্তেজক পানীয় সবার নিউরনে এখন আলোড়ন সৃষ্টি করছে। কঠিন একটা বক্তৃতা দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে না দিয়ে তুমি বরং আমাদের একটি গান শোনাও।

রুখ হেসে ফেলল, বলল, ঠিকই বলেছ। কিন্তু আমি যদি গান গাই সম্ভবত সবাই আরো দ্রুত পালিয়ে যাবে।

রুহান বলল, দেখই না চেষ্টা করে!

টেবিলের নিচে থেকে বাদ্যযন্ত্র বের করে আনা হল, তাল লয় এবং মাত্রার পরিমাপ ঠিক করে কিছু মডিউল নিয়ন্ত্রণ করা হল, একটি–দুটি সুর পরীক্ষা করা হল এবং রুখ হাততালি দিয়ে গান গাইতে শুরু করল। তার ভরাট গলার স্বর সারা হলঘরে গমগম করতে থাকে– উপস্থিত সবাই হাততালি দিয়ে তার সাথে তাল মিলাতে শুরু করে।

গানের কথাগুলো বহু পুরোনো। পৃথিবী ছেড়ে মানবশিশু যাচ্ছে মহাকাশে অজানার উদ্দেশে, সেখানে কি নীল আকাশ আছে? সাগরের ঢেউ আছে? বাতাসের ক্রন্দন আছে? সেই শিশু কি পৃথিবীর স্মৃতি ছড়িয়ে দেবে অনাগত ভবিষ্যতে? মানুষের ভালবাসা কি বেঁচে থাকবে মানুষের হৃদয়ে?

গানের কথা শুনতে শুনতে ক্রীনার চোখে হঠাৎ পানি এসে যায়। সে সাবধানে তার নিও পলিমারের কোনা দিয়ে চোখ মুছে ফেলে।

.

যে হলঘরটি কিছুক্ষণ আগেই অসংখ্য মানুষের আনন্দোল্লাসে ভরপুর ছিল এখন সেখানে কেউ নেই–এলোমেলো চেয়ার, অবিন্যস্ত টেবিল, পরিত্যক্ত পানীয়ের গ্লাস সবকিছু মিলিয়ে হলঘরটিতে একধরনের বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে। হলঘরের মাঝামাঝি বিশাল টেবিলের এক কোনায় রুখ দুই হাতে তার মাথা ধরে বসে আছে, তার খুব কাছে ক্রীনা দাঁড়িয়ে ক্রীনার চোখেমুখে একধরনের চাপা অস্থিরতা। সে রুখের মাথায় হাত রেখে বলল, রুখ। তোমার কী হয়েছে?

রুখ মাথা তুলে ক্রীনার দিকে তাকাল, বলল, আমি জানি না।

তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব ভয় পাচ্ছ।

হ্যাঁ। কিন্তু সেটা কী আমি জানি না।

ক্রীনা চিন্তিত মুখে বলল, বুদ্ধিমান এনরয়েডের ওখানে কী হয়েছিল মনে করার চেষ্টা কর।

সেটা তো তোমাকে বলেছি–

ক্রীনা মাথা নেড়ে বলল, আমাকে যেটা বলেছ সেটা তোমার স্মৃতিতে বাচিয়ে রাখা হয়েছে। কিন্তু নিশ্চয়ই কিছু একটা তোমার স্মৃতি থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিছু একটা তোমার স্মৃতিতে জোর করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্ক যেভাবে কাজ করে সেখানে এটা খুব সহজ নয়– সবসময়েই অন্য কোনো স্মৃতিতে তার প্রভাব পড়ে। তুমি মনে করার চেষ্টা কর–ভেবে দেখ, কোনো ধরনের অসঙ্গতি কোনো ধরনের অস্বাভাবিকতা তোমার চোখে পড়েছে কি না।

না। রুখ মাথা নেড়ে বলল, আমি কোনো ধরনের অসঙ্গতি মনে করতে পারছি না। তবে

তবে?

তবে যতবার আমি মানুষের বেঁচে থাকা নিয়ে ভাবি ততবার মনে হয় কী যেন হিসাব মিলছে না।

হিসাব মিলছে না?

না। মনে হয় বেঁচে থাকাটা আসলে–আসলে রুখ হঠাৎ কেমন যেন অসহায় ভঙ্গিতে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, আমি জানি না।

ক্রীনা চিন্তিত মুখে বলল, আমার কী মনে হয় জান?

কী?

বুদ্ধিমান এনরয়েডদের ওখানে গিয়ে তুমি কিছু একটা দেখেছ বা কিছু একটা জেনেছ। সেটার সাথে মানুষের বেঁচে থাকার খুব গভীর একটা সম্পর্ক আছে। সেটা নিশ্চয়ই খুব ভয়ঙ্কর একটা তথ্য–সেটা তোমার মস্তিষ্ক থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু তোমার অবচেতন মনে এখনো তার ছাপ রয়ে গেছে–সে জন্য তুমি এরকম অস্থির হয়ে ছটফট করছ।

রুখ কেমন যেন ক্লান্ত ভঙ্গিতে ক্রীনার দিকে তাকাল। একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, তোমার তাই মনে হয়?

হ্যাঁ। চেষ্টা কর মনে করতে। তোমার মস্তিষ্কে তথ্যটা আছে। ক্রীনা রুখের চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি জানি–তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ।

রুখ দুই হাতে মাথা রেখে কয়েক মুহূর্ত চোখ বন্ধ করে রইল, তারপর অসহায় ভঙ্গিতে বলল, না, কিছু মনে করতে পারছি না। শুধু–

ক্রীনা উৎসুক মুখে বলল, শুধু কী?

শুধু কেন জানি আমার মায়ের কথা মনে পড়ছে

তোমার মায়ের কথা? তোমার মা তো অনেক আগে মারা গেছেন।

আমি জানি।

তোমার মায়ের কথা কী মনে পড়ছে

মনে হচ্ছে আমি যেন আমার মায়ের সাথে যাচ্ছি। মা একটা বিশাল হলঘরের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। হলঘরের দরজা খুলে ভয় পেয়ে চিৎকার করতে শুরু করলেন।

কী দেখে ভয় পেয়েছিলেন?

মানুষ।

মানুষ? কী রকম মানুষ?

রুখ আবার খানিকক্ষণ চিন্তা করে মাথা নেড়ে বলল, না, মনে করতে পারছি না।

মানুষেরা কি মৃত না জীবিত?

মনে হয় জীবিত মনে হয় ঘুমিয়ে আছে।

ঘুমিয়ে আছে?

হ্যা তাদেরকে ঝুলিয়ে রাখা আছে। তারা একসময় জেগে উঠবে তখন ভয়ঙ্কর একটা বিপদ হবে। ভয়ঙ্কর ভয়ঙ্কর বিপদ।

ক্রীনা অবাক হয়ে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, নিশ্চয়ই কোনো একটা দুঃস্বপ্ন দেখেছি। তাই না?

হয়তো দুঃস্বপ্ন। হয়তো দুঃস্বপ্ন নয়, হয়তো সত্যি। কিন্তু আমরা তো তার ঝুঁকি নিতে পারি না।

তুমি কী করতে চাও?

চল বের হই। যারা বয়স্ক যারা তোমার মাকে দেখেছে তাদের সাথে কথা বলে আসি।

কী নিয়ে কথা বলবে?

সত্যি সত্যি তোমার মা কি কখনো তোমাকে নিয়ে কোথাও গিয়ে ভয় পেয়েছিলেন? সেটা নিয়ে কি কারো সাথে কথা বলেছিলেন?

রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, তাতে কী লাভ?।

জানি না। কিন্তু আমার মনে হয় দেরি করে লাভ নেই। সত্যি যদি তুমি বুদ্ধিমান। এনরয়েড থেকে গোপন কোনো তথ্য এনে থাক–সেটা আমাদের জানা দরকার।

.

গভীর রাতে রুহানকে ঘুম থেকে ডেকে তোলা হল, রুহান যেটুকু অবাক হল তার থেকে অনেক বেশি ভয় পেয়ে গেল। ফ্যাকাসে মুখে রুখ আর ক্রীনার দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে?

না, রুহান কিছু হয় নি। ক্রীনা হেসে বলল, এমনি এসেছি।

রুহান ভুরু কুঁচকে বলল, এমনি কেউ এত রাতে আসে না। বল কী হয়েছে?

রুখ একটু অপরাধীর মতো বলল, আমি আসলে এত রাতে আসতে চাই নি কিন্তু ক্রীনা। বলল দেরি করে লাভ নেই।

কী ব্যাপারে দেরি করে লাভ নেই?

আমি বলছি, শোন। ক্রীনা তখন অল্প কথায় পুরো ব্যাপারটি রুহানকে বুঝিয়ে বলে। রুখ আশা করছিল রুহান পুরোটুকু শুনে ক্রীনার আশঙ্কাকে হেসে উড়িয়ে দেবে। কিন্তু সে উড়িয়ে দিল না, খুব চিন্তিত মুখে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল।

ক্রীনা বলল, আমরা তোমার কাছে এসেছি রুখের মায়ের কথা জানতে। রুখের মা কি কখনো বিশাল কোনো হলঘরে গিয়ে–

না। রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমাদের মানববসতিতে কোনো বিশাল হলঘর নেই। রুখের মা কখনো কিছু দেখে ভয় পায় নি–আমি জানি। রুখের মা–বাবা দুজনকেই আমি ভালো করে জানতাম। রুখের বাবা যখন মারা যায় আমি তার খুব কাছে ছিলাম। অনেকদিন আগের ঘটনা কিন্তু আমার কাছে মনে হয় মাত্র সেদিন–

ক্রীনা মাথা নাড়ল, স্মৃতি খুব সহজে প্রতারণা করতে পারে।

হ্যাঁ। রুহান মাথা নাড়ল, যে–জিনিসটা মনে রাখা দরকার সেটা মনে থাকে না কিন্তু খুব অপ্রয়োজনীয় একটা জিনিস স্পষ্ট মনে থাকে।

রুখ দুর্বলভাবে হেসে বলল, আমার জন্যে পুরো ব্যাপারটি আরো ভয়ঙ্কর। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা সম্ভবত আমার স্মৃতিকে ওলটপালট করে দিয়েছে। এখন কোনটা সত্যি আর কোনটা মিথ্যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

ক্রীনা কোনো কথা না বলে তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে রুখের দিকে তাকিয়ে রইল। রুখ বলল, কী হল তুমি আমার দিকে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

তুমি এইমাত্র কী বললে?

বলেছি তুমি এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?

না, তার আগে।

রুখ একটু অবাক হয়ে বলল, তার আগে বলেছি, আমার স্মৃতির কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যা আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি না।

ক্রীনা হঠাৎ ঘুরে রুহানের দিকে তাকাল, রুহান তুমি কি সত্যি বলতে পারবে তোমার কোন স্মৃতিটি সত্যি–কোনটি মিথ্যা?

রুহান হতচকিতের মতো ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল, খানিকক্ষণ পর একটু হেসে বলল, স্মৃতি তো মিথ্যা হতে পারে না।

কিন্তু রুহান তুমি জান আমাদের বুদ্ধিমত্তা নিনীষ স্কেলে মাত্র আট। বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের যেভাবে ইচ্ছে সেভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আমাদের স্মৃতিতে যা ইচ্ছে তা প্রবেশ করাতে পারে। আমাদের ভয়ঙ্কর স্মৃতি মুছে সেখানে আনন্দের স্মৃতি প্রবেশ করিয়ে দিতে পারে। আনন্দের স্মৃতি মুছে সেখানে ভয়ঙ্কর স্মৃতি প্রবেশ করাতে পারে।

কিন্তু কেন? কী লাভ?

আমি জানি না। হয়তো হয়তো

হয়তো কী? ক্রীনা কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল।

রুহান কিছুক্ষণ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, তুমি বলতে চাইছ আমাদের সব স্মৃতি সত্যি নয়?

না। আমি বলতে চাইছি কেউ যদি আমাদের স্মৃতিকে নিয়ে খেলা করে আমরা সেটা জানব না। জানার কোনো উপায় নেই।

রুখ খানিকক্ষণ ক্রীনার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মনে হতে থাকে ঠিক এই ধরনের একটা কথা সে আগে কখনো কোথাও শুনেছে–কিন্তু ঠিক কোথায় সে মনে করতে পারে না।

রুহান মাথা নেড়ে বলল, আমরা ইচ্ছা করলেই তো কিছু একটা নিয়ে সন্দেহ করতে পারি। পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র নিয়ে সন্দেহ করতে পারি, বলতে পারি আলোর গতিবেগ পরিবর্তনশীল। কিংবা বলতে পারি আমাদের অস্তিত্ব মিথ্যা –এটা আসলে একটা বিশাল গুবরে পোকার স্বপ্ন–কিন্তু সবকিছুর তো একটা ভিত্তি থাকতে হয়। ভিত্তিহীন সন্দেহ তো কোনো কাজে আসে না। আমাদের স্মৃতি মিথ্যা এটা নিয়ে সন্দেহ করার মতো কোনো ভিত্তি আছে?

ক্রীনা মাথা নাড়ল, আছে।

রুখ এবং রুহান দুজনেই ঘুরে ক্রীনার দিকে তাকাল, আছে?

হ্যাঁ।

সেটা কী?

ক্রীনা একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমাদের এই মানুষের বসতিতে কত জন মানুষ রয়েছে?

রুহান বলল, হাজার দেড়েক।

যদি কোনো বসতিতে হাজার দেড়েক মানুষ থাকে তুমি আশা করবে তার মাঝে সকল বয়সের মানুষ থাকবে। শিশু থাকবে, কিশোর–কিশোরী থাকবে, তরুণ–তরুণী থাকবে, যুবক–যুবতী, মধ্যবয়স্ক এবং বৃদ্ধ–বৃদ্ধাও থাকবে। আমাদের বসতিতে কোনো শিশু নেই, কোনো বৃদ্ধ নেই।

রুহান একটু অবাক হয়ে ক্রীনার দিকে তাকাল, ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কী বলছ ক্রীনা? বসতিতে যারা শিশু ছিল তারা বড় হয়ে গেছে, যারা বৃদ্ধ ছিল তারা মারা গেছে। আমার স্পষ্ট মনে আছে তোমার জন্ম হল–।

ক্রীনা মাথা নাড়ল, না, তোমার কী মনে আছে সেটা আমি বিশ্বাস করি না।

তুমি বলতে চাইছ।

আমি বলতে চাইছি হয়তো তুমি অতীতে যেটা দেখেছ সেটা কাল্পনিক স্মৃতি। এখন, এই মুহূর্তে যেটা দেখছি শুধু সেটাই আমরা বিশ্বাস করতে পারি। এই মুহূর্তে যেটা দেখছি সেটা অস্বাভাবিক–সেখানে কোনো শিশু নেই, বৃদ্ধ নেই কোনো জন্ম নেই কোনো মৃত্যু নেই। তাই আমি সন্দেহ করছি হয়তো এটাই মেতসিস। মানববসতিতে কিছু মানুষ থাকে–একসময় তাদের সরিয়ে দিয়ে অন্য মানুষেরা আসে। তাদের মাঝে একটা স্মৃতি দিয়ে দেওয়া হয় যেন তারা অনেকদিন থেকে বেঁচে আছে। আসলে এখানে সবাই ক্ষণস্থায়ী।

ক্রীনা–_ রুখ হঠাৎ চিৎকার করে উঠল, ক্রীনা!

কী?

তুমি ঠিকই সন্দেহ করেছ। এখন আমার মনে পড়েছে।

মনে পড়েছে?

হ্যাঁ। মনে আছে আমি বলেছিলাম–বিশাল হলঘরে সারি সারি মানুষ ঝুলিয়ে রাখা আছে? সবাই ঘুমিয়ে আছে। তারা–তারা–

তারা কারা?

তারা আমরা। আমি, তুমি, রুহান সবাই। সবাই।

আমরা?

হ্যাঁ। একই জিনেটিক কোড দিয়ে তৈরি একই মানুষ। রুখ জোরে জোরে নিশ্বাস নিতে থাকে, তার মুখে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে ওঠে, সে ভয়ার্ত চোখে একবার রুহান আর ক্রীনার দিকে তাকাল, তারপর আর্ত গলায় বলল, একদিন আমরা সবাই মারা যাব। সবাই একসাথে। তখন অন্য আমাদের জাগিয়ে তোলা হবে, তারা এসে এখানে থাকবে। যেভাবে একদিন আমরা এসেছি। তার আগে অন্য আমরা এসেছি। তার আগে অন্য আমরা–তার আগে–

রুখ হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে নিজের মাথা ধরে আর্তচিৎকার করে ওঠে, তার শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে, সে তার নিজের পায়ের উপর আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। হাঁটু ভেঙে মাটিতে লুটিয়ে পড়ল।

ক্রীনা রুখের কাছে ছুটে যায়, তার মাথাটি নিজের কোলের উপরে টেনে নিয়ে তার উপর ঝুঁকে পড়ে। চোখের পাতা টেনে তার চোখের পিউপিলের দিকে তাকাল, হৃৎস্পন্দন শুনল তারপর ঘুরে রুহানের দিকে তাকিয়ে বলল, হঠাৎ করে মাথার উপর চাপ পড়েছে, তাই অজ্ঞান হয়ে গেছে। আমার মনে হয় ভয়ের কিছু নেই। তবে–

তবে কী?

আমি জানি না বুদ্ধিমান এনরয়েডরা আমাদের কত তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে। যদি খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে তা হলে–

তা হলে?

তা হলে খুব শিগগিরই আমাদের দিন শেষ হয়ে আসবে রুহান।

রুহান কোনো কথা না বলে ক্রীনার দিকে তাকিয়ে রইল।