২৬
স্থান—বেলুড়মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮
শিষ্য॥ স্বামীজী, খাদ্যাখাদ্যের সহিত ধর্মাচরণের কিছু সম্বন্ধ আছে কি?
স্বামীজী॥ অল্পবিস্তার আছে বৈকি।
শিষ্য॥ মাছ-মাংস খাওয়া উচিত এবং আবশ্যক কি?
স্বামীজী॥ খুব খাবি বাবা! তাতে যা পাপ হবে, তা আমার.৫৭। তোদের দেশের লোকগুলোর দিকে একবার চেয়ে দেখ দেখি—মুখে মলিনতার ছায়া, বুকে সাহস ও উদ্যমশূন্যতা, পেটটি বড়, হাতে পায়ে বল নেই, ভীরু ও কাপুরুষ!
শিষ্য॥ মাছ-মাংস খাইলে যদি উপকারই হইবে, তবে বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবধর্মে অহিংসাকে ‘পরমো ধর্মঃ’ বলিয়াছে কেন?
স্বামীজী॥ বৌদ্ধ ও বৈষ্ণবধর্ম আলাদা নয়। বৌদ্ধধর্ম মরে যাবার সময় হিন্দুধর্ম তার কতকগুলি নিয়ম নিজেদের ভেতর ঢুকিয়ে আপনার করে নিয়েছিল। ঐ ধর্মই এখন ভারতবর্ষে বৈষ্ণবধর্ম বলে বিখ্যাত। ‘অহিংসা পরমো ধর্মঃ’—বৌদ্ধধর্মের এই মত খুব ভাল, তবে অধিকারী বিচার না করে বলপূর্বক রাজ-শাসনের দ্বারা ঐ মত জনসাধারণ সকলের উপর চালাতে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম দেশের মাথাটি একেবারে খেয়ে দিয়ে গেছে। ফলে হয়েছে এই যে, লোকে পিঁপড়েকে চিনি দিচ্ছে, আর টাকার জন্য ভায়ের সর্বনাশ করছে! অমন ‘বক-ধার্মিক’ এ জীবনে অনেক দেখেছি। অন্যপক্ষে দেখ—বৈদিক ও মনূক্ত ধর্মে মৎস্য-মাংস খাবার বিধান রয়েছে, আবার অহিংসার কথাও আছে। অধিকারিবিশেষে হিংসা ও অধিকারিবিশেষে অহিংসা-ধর্মপালনের ব্যবস্থা আছে। শ্রুতি বলছেন—‘মা হিংস্যাৎ সর্বভূতানি’; মনুও বলেছেন—‘নিবৃত্তিস্তু মহাফলা।’
শিষ্য॥ কিন্তু এমন দেখিয়াছি মহাশয়, ধর্মের দিকে একটু ঝোঁক হইলেই লোক আগে মাছ-মাংস ছাড়িয়া দেয়। অনেকের চক্ষে ব্যভিচারাদি গুরুতর পাপ অপেক্ষাও যেন মাছ-মাংস খাওয়াটা বেশী পাপ!—এ ভাবটা কোথা হইতে আসিল?
স্বামীজী॥ কোত্থেকে এল, তা জেনে তোর দরকার কি? তবে ঐ মত ঢুকে যে তোদের সমাজের ও দেশের সর্বনাশ সাধন করেছে, তা তো দেখতে পাচ্ছিস? দেখনা—তোদের পূর্ববঙ্গের লোক খুব মাছমাংস খায়, কচ্ছপ খায়, তাই তারা পশ্চিমবাঙলার লোকের চেয়ে সুস্থশরীর। তোদের পূর্ব-বাঙলার বড় মানুষেরাও এখনও রাত্রে লুচি বা রুটি খেতে শেখেনি। তাই আমাদের দেশের লোকগুলোর মত অম্বলের ব্যারামে ভোগে না। শুনেছি, পূর্ববাঙলার পাড়াগাঁয়ে লোকে অম্বলের ব্যারাম কাকে বলে, তা বুঝতেই পারে না।
শিষ্য॥ আজ্ঞা হাঁ। আমাদের দেশে অম্বলের ব্যারাম বলিয়া কোন ব্যারাম নাই। এদেশে আসিয়া ঐ ব্যারামের নাম শুনিয়াছি। দেশে আমরা দুবেলাই মাছ-ভাত খাইয়া থাকি।
স্বামীজী॥ তা খুব খাবি। ঘাসপাতা খেয়ে যত পেটরোগা বাবাজীর দলে দেশ ছেয়ে ফেলেছে। ও-সব সত্ত্বগুণের চিহ্ন নয়, মহা তমোগুণের ছায়া—মৃত্যুর ছায়া। সত্ত্বগুণের চিহ্ন হচ্ছে—মুখে উজ্জ্বলতা, হৃদয়ে অদম্য উৎসাহ, tremendous activity (প্রচণ্ড কর্মতৎপরতা); আর তমোগুণের লক্ষণ হচ্ছে আলস্য, জড়তা, মোহ, নিদ্রা—এই সব।
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, মাছ-মাংসে তো রজোগুণ বাড়ায়।
স্বামীজী॥ আমি তো তাই চাই। এখন রজোগুণেরই দরকার। দেশের যে-সব লোককে এখন সত্ত্বগুণী বলে মনে করছিস, তাদের ভেতর পনর আনা লোকই ঘোর তমোভাবাপন্ন। এক আনা লোক সত্ত্বগুণী মেলে তো ঢের! এখন চাই প্রবল রজোগুণের তাণ্ডব উদ্দীপনা। দেশ যে ঘোর তমসাচ্ছন্ন, দেখতে পাচ্ছিস না? এখন দেশের লোককে মাছ-মাংস খাইয়ে উদ্যমী করে তুলতে হবে, জাগাতে হবে, কার্যতৎপর করতে হবে। নতুবা ক্রমে দেশসুদ্ধ লোক জড় হয়ে যাবে, গাছ-পাথরের মত জড় হয়ে যাবে। তাই বলছিলুম, মাছ-মাংস খুব খাবি।
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, মনে যখন সত্ত্বগুণের অত্যন্ত স্ফূর্তি হয়, তখন মাছ-মাংসে স্পৃহা থাকে কি?
স্বামীজী॥ না, তা থাকে না। সত্ত্বগুণের যখন খুব বিকাশ হয়, তখন মাছ-মাংসে রুচি থাকে না। কিন্তু সত্ত্বগুণ-প্রকাশের এইসব লক্ষণ জানবি—পরের জন্য সর্বস্ব-পণ, কামিনী-কাঞ্চনে সম্পূর্ণ অনাসক্তি, নিরভিমানতা, অহংবুদ্ধিশূন্যতা। এইসব লক্ষণ যার হয়, তার আর animal-food (আমিষাহার)-এর ইচ্ছা হয় না। আর যেখানে দেখবি, মনে ঐসব গুণের স্ফূর্তি নেই, অথচ অহিংসার দলে নাম লিখিয়েছে—সেখানে জানবি হয় ভণ্ডামি, না হয় লোক-দেখান ধর্ম। তোর যখন ঠিক ঠিক সত্ত্বগুণের অবস্থা হবে তখন আমিষহার ছেড়ে দিস।
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, ছান্দোগ্য শ্রুতিতে তো আছে ‘আহারশুদ্ধৌ সত্ত্বশুদ্ধি’—শুদ্ধ বস্তু আহার করিলে সত্ত্বগুণের বৃদ্ধি হয়, ইত্যাদি। অতএব সত্ত্বগুণী হইবার জন্য রজঃ-ও তমোগুণোদ্দীপক পদার্থসকলের ভোজন পূর্বেই ত্যাগ করা কি এখানে শ্রুতির অভিপ্রায় নহে? স্বামীজী॥ ঐ শ্রুতির অর্থ করতে গিয়ে শঙ্করাচার্য বলেছেন—‘আহার’-অর্থে ‘ইন্দ্রিয়-বিষয়’, আর শ্রীরামানুজস্বামী ‘আহার’-অর্থে খাদ্য ধরেছেন। আমার মত হচ্ছে তাঁহাদের ঐ উভয় মতের সামঞ্জস্য করে নিতে হবে। কেবল দিনরাত খাদ্যাখাদ্যের বাছবিচার করে জীবনটা কাটাতে হবে, না ইন্দ্রিয়সংযম করতে হবে? ইন্দ্রিয়সংযমটাকেই মুখ্য উদ্দেশ্য বলে ধরতে হবে; আর ঐ ইন্দ্রিয়সংযমের জন্যই ভাল-মন্দ খাদ্যাখাদ্যের অল্পবিস্তর বিচার করতে হবে। শাস্ত্র বলেন, খাদ্য ত্রিবিধ দোষে দুষ্ট ও পরিত্যাজ্য হয়ঃ (১) জাতিদুষ্ট—যেমন পেঁয়াজ, রশুন ইত্যাদি। (২) নিমিত্তদুষ্ট—যেমন ময়রার দোকানের খাবার, দশগণ্ডা মাছি মরে পড়ে রয়েছে, রাস্তার ধুলোই কত উড়ে পড়েছে। (৩) আশ্রয়দুষ্ট—যেমন অসৎ লোকের দ্বারা স্পৃষ্ট অন্নাদি। খাদ্য জাতিদুষ্ট ও নিমিত্তদুষ্ট হয়েছে কিনা, তা সকল সময়েই খুব নজর রাখতে হয়। কিন্তু এদেশে ঐদিকে নজর একেবারেই উঠে গেছে। কেবল শেষোক্ত দোষটি—যা যোগী ভিন্ন অন্য কেউ প্রায় বুঝতেই পারে না, তা নিয়েই যত লাঠালাঠি চলছে, ‘ছুঁয়োনা ছুঁয়োনা’ করে ছুঁৎমার্গীর দল দেশটাকে ঝালাপালা করছে। তাও ভালমন্দ লোকের বিচার নেই; গলায় একগাছা সুতো থাকলেই হল, তার হাতে অন্ন খেতে ছুঁৎমার্গীদের আর আপত্তি নেই। খাদ্যের আশ্রয়দোষ ধরতে পারা একমাত্র ঠাকুরকেই দেখেছি। এমন অনেক ঘটনা হয়েছে, যেখানে তিনি কোন কোন লোকের ছোঁয়া খেতে পারেননি। বিশেষ অনুসন্ধানের পর জানতে পেরেছি—বাস্তবিকই সে-সকল লোকের ভিতর কোন-না-কোন বিশেষ দোষ ছিল। তোদের যত কিছু ধর্ম এখন দাঁড়িয়েছে গিয়ে ভাতের হাঁড়ির মধ্যে! অপর জাতির ছোঁয়া ভাতটা না খেলেই যেন ভগবান্ লাভ হয়ে গেল! শাস্ত্রের মহান্ সত্যসকল ছেড়ে কেবল খোসা নিয়েই মারামারি চলছে।
শিষ্য॥ মহাশয়, তবে কি আপনি বলিতে চান, সকলের স্পৃষ্ট অন্ন খাওয়াই আমাদের কর্তব্য?
স্বামীজী॥ তা কেন বলব? আমার কথা হচ্ছে তুই বামুন, অপর জাতের অন্ন নাই খেলি; কিন্তু তুই সব বামুনের অন্ন কেন খাবিনি? তোরা রাঢ়ীশ্রেণী বলে বারেন্দ্র বামুনের অন্ন খেতে আপত্তি হবে কেন? আর বারেন্দ্র বামুনই বা তোদের অন্ন না খাবে কেন? মারাঠী, তেলেঙ্গী ও কনোজী বামুনই বা তোদের অন্ন না খাবে কেন? কলিকাতার জাতবিচারটা আরও কিছু মজার। দেখা যায়, অনেক বামুন-কায়েতই হোটেলে ভাত মারছেন; তাঁরাই আবার মুখ পুঁছে এসে সমাজের নেতা হচ্ছেন; তাঁরাই অন্যের জন্য জাতবিচার ও অন্ন- বিচারের আইন করছেন! বলি—ঐ-সব কপটীদের আইনমত কি সমাজকে চলতে হবে? ওদের কথা ফেলে দিয়ে সনাতন ঋষিদের শাসন চালাতে হবে, তবেই দেশের কল্যাণ।
শিষ্য॥ তবে কি মহাশয়, কলিকাতায় অধুনাতন সমাজে ঋষিশাষন চলিতেছে না?
স্বামীজী॥ শুধু কলিকাতায় কেন? আমি ভারতবর্ষ তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখেছি, কোথাও ঋষিশাসনের ঠিক ঠিক প্রচলন নেই। কেবল লোকাচার, দেশাচার আর স্ত্রী-আচার—এতেই সকল জায়গায় সমাজ শাসিত হচ্ছে। শাস্ত্র-ফাস্ত্র কি কেউ পড়ে—না, পড়ে সেইমত সমাজকে চালাতে চায়?
শিষ্য॥ তবে মহাশয়, এখন আমাদের কি করিতে হইবে?
স্বামীজী॥ ঋষিগণের মত চালাতে হবে; মনু, যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিদের মন্ত্রে দেশটাকে দীক্ষিত করতে হবে। তবে সময়োপযোগী কিছু কিছু পরিবর্তন করে দিতে হবে। এই দেখ না ভারতের কোথাও আর চাতুর্বর্ণ্য-বিভাগ দেখা যায় না। প্রথমতঃ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র— এই চার জাতে দেশের লোকগুলোকে ভাগ করতে হবে। সব বামুন এক করে একটি ব্রাহ্মণজাত গড়তে হবে। এইরূপ সব ক্ষত্রিয়, সব বৈশ্য, সব শূদ্রদের নিয়ে অন্য তিনটি জাত করে সকল জাতিকে বৈদিক প্রণালীতে আনতে হবে। নতুবা শুধু ‘তোমায় ছোঁব না’ বললেই কি দেশের কল্যাণ হবে রে? কখনই নয়।
২৭
স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮
শিষ্য॥ স্বামীজী, বর্তমান কালে আমাদের সমাজ ও দেশের এত দুর্দশা হইয়াছে কেন?
স্বামীজী॥ তোরাই সে জন্য দায়ী।
শিষ্য॥ বলেন কি? কেমন করিয়া?
স্বামীজী॥ বহুকাল থেকে দেশের নীচ জাতদের ঘেন্না করে করে তোরা এখন জগতে ঘৃণাভাজন হয়ে পড়েছিস!
শিষ্য॥ কবে আবার আমরা উহাদের ঘৃণা করিলাম?
স্বামীজী॥ কেন? ভট্চাযের দল তোরাই তো বেদবেদান্তাদি যত সারবান শাস্ত্রগুলি ব্রাহ্মণেতর জাতদের কখনও পড়তে দিসনি, তাদের ছুঁসনি, তাদের কেবল নীচে দাবিয়ে রেখেছিস, স্বার্থপরতা থেকে তোরাই তো চিরকাল ঐরূপ করে আসছিস। ব্রাহ্মণেরাই তো ধর্মশাস্ত্রগুলিকে একচেটে করে বিধি-নিষেধ তাদেরই হাতে রেখেছিল; আর ভারতবর্ষের অন্যান্য জাতগুলিকে নীচ বলে বলে তাদের মনে ধারণা করিয়ে দিয়েছিল যে, তারা সত্যসত্যই হীন। তুই যদি একটা লোককে খেতে শুতে বসতে সর্বক্ষণ বলিস, ‘তুই নীচ’, ‘তুই নীচ’—তবে সময়ে তার ধারণা হবেই হবে, ‘আমি সত্যসত্যই নীচ।’ ইংরেজীতে একে বলে hypnotise (হিপনোটাইজ) বা মন্ত্রমুগ্ধ করা। ব্রাহ্মণেতর জাতগুলির একটু একটু করে চমক ভাঙছে। ব্রাহ্মণদের তন্ত্রেমন্ত্রে তাদের আস্থা কমে যাচ্ছে। পাশ্চাত্য শিক্ষার বিস্তারে ব্রাহ্মণদের সব তুকতাক এখন ভেঙে পড়ছে, পদ্মার পাড় ধসে যাবার মত, দেখতে পাচ্চিস তো?
শিষ্য॥ আজ্ঞা হাঁ, আচার-বিচারটা আজকাল ক্রমেই শিথিল হইয়া পড়িতেছে।
স্বামীজী॥ পড়বে না? ব্রাহ্মণেরা যে ক্রমে ঘোর অনাচার-অত্যাচার আরম্ভ করেছিল! স্বার্থপর হয়ে কেবল নিজেদের প্রভুত্ব বজায় রাখবার জন্য কত কি অদ্ভুত অবৈদিক, অনৈতিক, অযৌক্তিক মত চালিয়েছিল! তার ফলও হাতে হাতেই পাচ্ছে।
শিষ্য॥ কি ফল পাইতেছে, মহাশয়?
স্বামীজী॥ ফলটা কি দেখতে পাচ্ছিস না? তোরা যে ভারতের অপর সাধারণ জাতগুলিকে ঘেন্না করেছিলি, তার জন্যই এখন তোদের হাজার বছরের দাসত্ব করতে হচ্ছে, তাই তোরা এখন বিদেশীর ঘৃণাস্থল ও স্বদেশবাসিগণের উপেক্ষাস্থল হয়ে রয়েছিস।
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, এখনও তো ব্যবস্থাদি ব্রাহ্মণদের মতেই চলিতেছে; গর্ভাধান হইতে যাবতীয় ক্রিয়াকলাপেই লোকে ব্রাহ্মণেরা যেরূপ বলিতেছেন, সেইরূপই করিতেছে। তবে আপনি ঐরূপ বলিতেছেন কেন?
স্বামীজী॥ কোথায় চলছে? শাস্ত্রোক্ত দশবিধ সংস্কার কোথায় চলছে? আমি তো ভারতবর্ষটা সব ঘুরে দেখেছি, সর্বত্রই শ্রুতি-স্মৃতি-বিগর্হিত দেশাচারে সমাজ শাসিত হচ্ছে! লোকাচার, দেশাচার ও স্ত্রী-আচার—এই সব সর্বত্র স্মৃতিশাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে! কে কার কথা শুনছে? টাকা দিতে পারলেই ভট্চাযের দল যা-তা বিধি-নিষেধ লিখে দিতে রাজী আছেন! কয়জন ভট্চায বৈদিক কল্প-গৃহ্য ও শ্রৌত-সূত্র পড়েছেন? তারপর দেখ—বাঙলায় রঘুনন্দনের শাসন, আর একটু এগিয়ে দেখবি মিতাক্ষরার শাসন, আর একদিকে গিয়ে দেখ মনুস্মৃতির শাসন চলেছে! তোরা ভাবিস—সর্বত্র বুঝি একমত চলেছে! সেইজন্যই আমি চাই—বেদের প্রতি লোকের সম্মান বাড়িয়া বেদের চর্চা করাতে এবং সর্বত্র বেদের শাসন চালাতে।
শিষ্য॥ মহাশয়, তাহা কি এখন আর চলা সম্ভবপর?
স্বামীজী॥ বেদের সকল প্রাচীন নিয়মই চলবে না বটে, কিন্তু সময়োপযোগী বাদ-সাদ দিয়ে নিয়মগুলি বিধিবদ্ধ করে নূতন ছাঁচে পড়ে সমাজকে দিলে চলবে না কেন?
শিষ্য॥ মহাশয়, আমার ধারণা ছিল অন্ততঃ মনুর শাসনটা ভারতে সকলেই এখনও মানে।
স্বামীজী॥ কোথায় মানছে? তোদের নিজেদের দেশেই দেখ না—তন্ত্রের বামাচার তোদের হাড়ে হাড়ে ঢুকেছে। এমন কি, আধুনিক বৈষ্ণব ধর্ম—যা মৃত বৌদ্ধধর্মের কঙ্কালাবশিষ্ট—তাতেও ঘোর বামাচার ঢুকেছে। ঐ অবৈদিক বামাচারের প্রভাবটা খর্ব করতে হবে।
শিষ্য॥ মহাশয়, এ পঙ্কোদ্ধার এখন সম্ভব কি?
স্বামীজী॥ তুই কি বলছিস, ভীরু কাপুরুষ? অসম্ভব বলে বলে তোরা দেশটা মজালি। মানুষের চেষ্টায় কিনা হয়?
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, মনু যাজ্ঞবল্ক্য প্রভৃতি ঋষিগণ দেশে পুনরায় না জন্মালে উহা সম্ভবপর মনে হয় না।
স্বামীজী॥ আরে, পবিত্রতা ও নিঃস্বার্থ চেষ্টার জন্যই তো তাঁরা মনু-যাজ্ঞবল্ক্য হয়েছিলেন, না আর কিছু! চেষ্টা করলে আমরাই যে মনু-যাজ্ঞবল্ক্যের চেয়ে ঢের বড় হতে পারি! আমাদের মতই বা তখন চলবে না কেন?
শিষ্য॥ মহাশয়, ইতঃপূর্বে আপনিই তো বলিলেন, প্রাচীন আচারাদি দেশে চালাইতে হইবে। তবে মন্বাদিকে আমাদেরই মত একজন বলিয়া উপেক্ষা করিলে চলিবে কন?
স্বামীজী॥ কি কথায় কি কথা নিয়ে এলি! তুই আমার কথাই বুঝতে পারছিস না। আমি কেবল বলেছি যে, প্রাচীন বৈদিক আচারগুলি সমাজ ও সময়ের উপযোগী করে নূতন ছাঁচে গড়ে নূতন ভাবে দেশে চালাতে হবে। নয় কি?
শিষ্য॥ আজ্ঞা হাঁ।
স্বামীজী॥ তবে ও কি বলছিলি? তোরা শাস্ত্র পড়েছিস, আমার আশা-ভরসা তোরাই। আমার কথাগুলি ঠিক ঠিক বুঝে সেইভাবে কাজে লেগে যা।
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, আমাদের কথা শুনিবে কে? দেশের লোক উহা লইবে কেন?
স্বামীজী॥ তুই যদি ঠিক ঠিক বোঝাতে পারিস এবং যা বলবি, তা হাতে-নাতে করে দেখাতে পারিস তো অবশ্য নেবে। আর তোতাপাখীর মত যদি কেবল শ্লোকই আওড়াস, বাক্যবাগীশ হয়ে কাপুরুষের মত কেবল অপরের দোহাই দিস ও কাজে কিছুই না দেখাস, তা হলে তোর কথা কে শুনবে বল?
শিষ্য॥ মহাশয়, সমাজ-সংস্কার সম্বন্ধে এখন সংক্ষেপে দুই-একটি উপদেশ দিন।
স্বামীজী॥ উপদেশ তো তোকে ঢের দিলুম; একটি উপদেশও অন্ততঃ কাজে পরিণত কর। জগৎ দেখুক যে, তোর শাস্ত্র পড়া ও আমার কথা শোনা সার্থক হয়েছে। এই যে মন্বাদি শাস্ত্র পড়লি, আরও কত কি পড়লি, বেশ করে ভেবে দেখ—এর মূল ভিত্তি বা উদ্দেশ্য কি। সেই ভিত্তিটা বজায় রেখে সার সার তত্ত্বগুলি ও প্রাচীন ঋষিদের মত সংগ্রহ কর এবং সময়োপযোগী মতসকল তাতে নিবদ্ধ কর; কেবল এইটুকু লক্ষ্য রাখিস, যেন সমগ্র ভারতবর্ষের সকল জাতের—সকল সম্প্রদায়েরই ঐসকল নিয়ম পালনে যথার্থ কল্যাণ হয়। লেখ দেখি ঐরূপ একখানা স্মৃতি; আমি দেখে সংশোধন করে দেব’খন।
শিষ্য॥ মহাশয়, ব্যাপারটি সহজসাধ্য নয়; কিন্তু ঐরূপে স্মৃতি লিখিলেও উহা চলিবে কি?
স্বামীজী॥ কেন চলবে না? তুই লেখ না। ‘কালো হ্যয়ং নিরবধির্বিপুলা চ পৃথ্বী’—যদি ঠিক ঠিক লিখিস তো একদিন না একদিন চলবেই। আপনাতে বিশ্বাস রাখ। তোরাই তো পূর্বে বৈদিক ঋষি ছিলি, শুধু শরীর বদলিয়ে এসেছিস বৈ তো নয়? আমি দিব্যচক্ষে দেখছি, তোদের ভেতর অনন্ত শক্তি রয়েছে! সেই শক্তি জাগা; ওঠ, ওঠ, লেগে পড়, কোমর বাঁধ। কি হবে দু-দিনের ধন-মান নিয়ে? আমার ভাব কি জানিস? আমি মুক্তি-ফুক্তি চাই না। আমার কাজ হচ্ছে—তোদের ভেতর এই ভাবগুলি জাগিয়ে দেওয়া; একটা মানুষ তৈরী করতে লক্ষ জন্ম যদি নিতে হয়, আমি তাতেও প্রস্তুত।
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, ঐরূপ কার্যে লাগিয়াই বা কি হইবে? মৃত্যু তো পশ্চাতে।
স্বামীজী॥ দূর ছোঁড়া, মরতে হয় একবারই মরবি। কাপুরুষের মত অহরহ়ঃ মৃত্যু-চিন্তা করে বারে বারে মরবি কেন?
শিষ্য॥ আচ্ছা মহাশয়, মৃত্যু চিন্তা না হয় নাই করিলাম, কিন্তু এই অনিত্য সংসারে কর্ম করিয়াই বা ফল কি?
স্বামীজী॥ ওরে, মৃত্যু যখন অনিবার্য, তখন ইঁট-পাটকেলের মত মরার চেয়ে বীরের মত মরা ভাল। এ অনিত্য সংসারে দু-দিন বেশী বেঁচেই বা লাভ কি? It is better to wear out than rust out—জরাজীর্ণ হয়ে একটু একটু করে ক্ষয়ে ক্ষয়ে মরার চেয়ে বীরের মত অপরের এতটুকু কল্যাণের জন্যও লড়াই করে মরাটা ভাল নয় কি?
শিষ্য॥ আজ্ঞে হাঁ। আপনাকে আজ অনেক বিরক্ত করিলাম।
স্বামীজী॥ ঠিক ঠিক জিজ্ঞাসুর কাছে দু-রাত্রি বকলেও আমার শ্রান্তি বোধ হয় না, আমি আহারনিদ্রা ত্যাগ করে অনবরত বকতে পারি। ইচ্ছা করলে তো আমি হিমালয়ের গুহায় সমাধিস্থ হয়ে বসে থাকতে পারি। আর আজকাল দেখছিস তো মায়ের ইচ্ছায় কোথাও আমার খাবার ভাবনা নেই, কোন-না-কোন রকম জোটেই জোটে। তবে কেন ঐরূপ করি না? কেনই বা এদেশে রয়েছি? কেবল দেশের দশা দেখে ও পরিণাম ভেবে আর স্থির থাকতে পারিনে। সমাধ-ফমাধি তুচ্ছ বোধ হয়, ‘তুচ্ছং ব্রহ্মপদং’ হয়ে যায়। তোদের মঙ্গল কামনা হচ্ছে আমার জীবনব্রত। যে দিন ঐ ব্রত শেষ হবে, সে দিন দেহ ফেলে চোঁচা দৌড় মারব!
শিষ্য মন্ত্রমুগ্ধের মত স্বামীজীর ঐ-সকল কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হৃদয়ে নীরবে তাঁহার মুখের দিকে চাহিয়া কতক্ষণ বসিয়া রহিল। পরে বিদায় গ্রহণের আশায় তাঁহাকে ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া বলিল, ‘মহাশয়, আজ তবে আসি।’
স্বামীজী॥ আসবি কেন রে? মঠে থেকেই যা না। সংসারীদের ভেতর গেলে মন আবার মলিন হয়ে যাবে। এখানে দেখ—কেমন হাওয়া, গঙ্গার তীরে, সাধুরা সাধনভজন করছে, কত ভাল কথা হচ্ছে। আর কলিকাতায় গিয়েই ছাইভস্ম ভাববি।
শিষ্য সহর্ষে বলিল, ‘আচ্ছা মহাশয়, তবে আজ এখানেই থাকিব।’
স্বামীজী॥ ‘আজ’ কেন রে? একেবারে থেকে যেতে পারিস না? কি হবে ফের সংসারে গিয়ে?
শিষ্য স্বামীজীর ঐ কথা শুনিয়া মস্তক অবনত করিয়া রহিল; মনে যুগপৎ নানা চিন্তার উদয় হওয়ার কোনই উত্তর দিতে পারিল না।
২৮
স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮
স্বামীজীর শরীর সম্প্রতি অনেকটা সুস্থ; মঠের নূতন জমিতে যে প্রাচীন বাড়ীটি ছিল, তাহার ঘরগুলি মেরামত করিয়া বাসোপযোগী করা হইতেছে, কিন্তু এখনও সম্পূর্ণ হয় নাই। সমগ্র জমিটি মাটি ফেলিয়া ইতঃপূর্বেই সমতল করা হইয়া গিয়াছে। স্বামীজী আজ অপরাহ্নে শিষ্যকে সঙ্গে করিয়া মঠের জমিতে ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন। স্বামীজীর হস্তে একটি দীর্ঘ যষ্টি, গায়ে গেরুয়া রঙের ফ্লানেলের আলখাল্লা, মস্তক অনাবৃত। শিষ্যের সঙ্গে গল্প করিতে করিতে দক্ষিণমুখে ফটক পর্যন্ত গিয়া পুনরায় উত্তরাস্যে ফিরিতেছেন—এইরূপে বাড়ী হইতে ফটক ও ফটক হইতে বাড়ী পর্যন্ত বারংবার পদচারণা করিতেছেন। দক্ষিণ পার্শ্বে বিল্বতরুমূল বাঁধান হইতেছে; ঐ বেলগাছের অদূরে দাঁড়াইয়া স্বামীজী এইবার ধীরে ধীরে গান ধরিলেনঃ
গিরি, গণেশ আমার শুভকারী।
বিল্ববৃক্ষমূলে পাতিয়ে বোধন,
গণেশের কল্যাণে গৌরীর আগমন,
ঘরে আনব চণ্ডী, শুনব কত চণ্ডী,
আসবে কত দণ্ডী যোগী জটাধারী!
গান গাহিতে গাহিতে শিষ্যকে বলিলেনঃ ‘হেথা আসবে কত দণ্ডী যোগী জটাধারী!’ বুঝলি? কালে এখানে কত সাধু-সন্ন্যাসীর সমাগম হবে!—বলিতে বলিতে বিল্বতরুমূলে উপবেশন করিলেন এবং বলিলেন, ‘বিল্বতরুমূল বড়ই পবিত্র স্থান। এখানে বসে ধ্যানধারণা করলে শীঘ্র উদ্দীপনা হয়। ঠাকুর একথা বলতেন।’
শিষ্য॥ মহাশয়, যাহারা আত্মনাত্মবিচারে রত, তাহাদের স্থানাস্থান, কালাকাল, শুদ্ধি-অশুদ্ধি-বিচারের আবশ্যকতা আছে কি?
স্বামীজী॥ যাঁদের আত্মজ্ঞানে ‘নিষ্ঠা’ হয়েছে, তাঁদের ঐসব বিচার করবার প্রয়োজন নেই বটে, কিন্তু ঐ নিষ্ঠা কি অমনি হলেই হল? কত সাধ্যসাধনা করতে হয়, তবে হয়! তাই প্রথম প্রথম এক-আধটা বাহ্য অবলম্বন নিয়ে নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবার চেষ্টা করতে হয়। পরে যখন আত্মজ্ঞাননিষ্ঠা লাভ হয়, তখন কোন অবলম্বনের আর দরকার থাকে না।
শাস্ত্রে যে নানা প্রকার সাধনমার্গ নির্দিষ্ট হয়েছে, সে-সব কেবল ঐ আত্মজ্ঞান-লাভের জন্য। তবে অধিকারিভেদে সাধনা ভিন্ন ভিন্ন। কিন্তু ঐ-সব সাধনাদিও এক প্রকার কর্ম; এবং যতক্ষণ কর্ম, ততক্ষণ আত্মার দেখা নেই। আত্মপ্রকাশের অন্তরায়গুলি শাস্ত্রোক্ত সাধনরূপ কর্ম দ্বারা প্রতিরুদ্ধ হয়, কর্মের নিজের সাক্ষাৎ আত্মপ্রকাশের শক্তি নেই; কতকগুলি আবরণকে দূর করে দেয় মাত্র। তারপর আত্মা আপন প্রভায় আপনি উদ্ভাসিত হয়। বুঝলি? এইজন্য তোর ভাষ্যকার বলছেন, ‘ব্রহ্মজ্ঞানে কর্মের লেশমাত্র সম্বন্ধ নেই।’
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, কোন না কোনরূপ কর্ম না করিলে যখন আত্মপ্রকাশের অন্তরায়গুলির নিরাশ হয় না, তখন পরোক্ষভাবে কর্মই তো জ্ঞানের কারণ হইয়া দাঁড়াইতেছে।
স্বামীজী॥ কার্যকারণ-পরম্পরা-দৃষ্টিতে আপাততঃ ঐরূপ প্রতীয়মান হয় বটে। মীমাংসা-শাস্ত্রে ঐরূপ দৃষ্টি অবলম্বন করেই ‘কাম্য কর্ম নিশ্চিত ফল প্রসব করে’—এ-কথা বলা হয়েছে। নির্বিশেষ আত্মার দর্শন কিন্তু কর্মের দ্বারা হবার নয়। কারণ আত্মজ্ঞান পিপাসুর পক্ষে বিধান এই যে, সাধনাদি কর্ম করবে, অথচ তার ফলাফলে উদাসীন থাকবে। তবেই হল—ঐ-সব সাধনাদি কর্ম সাধকের চিত্তশুদ্ধির কারণ ভিন্ন আর কিছু নয়; কারণ ঐ সাধনাদি ফলেই যদি আত্মাকে সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষ করা যেত, তবে আর শাস্ত্রে সাধককে ঐ-সব কর্মের ফল ত্যাগ করতে বলত না। অতএব মীমাংসাশাস্ত্রোক্ত ফলপ্রসূ কর্মবাদের নিরাকরণকল্পেই গীতোক্ত নিষ্কাম কর্মযোগের অবতারণা করা হয়েছে। বুঝলি?
শিষ্য॥ কিন্তু মহাশয়, কর্মের ফলাফলেরই যদি প্রত্যাশা না রাখিলাম, তবে কষ্টকর কর্ম করিতে প্রবৃত্তি হইবে কেন?
স্বামীজী॥ শরীর ধারণ করে সর্বক্ষণ একটা কিছু না করে থাকতে পারা যায় না। জীবকে যখন কর্ম করতেই হচ্ছে, তখন যেভাবে কর্ম করলে আত্মার দর্শন পেয়ে মুক্তিলাভ হয়, সেভাবে কর্ম করতেই নিষ্কাম কর্মযোগে বলা হয়েছে। আর তুই যে বললি ‘প্রবৃত্তি হবে কেন?’ তার উত্তর হচ্ছে এই যে, যত কিছু কর্ম করা যায় তা সবই প্রবৃত্তিমূলক; কিন্তু কর্ম করে করে যখন কর্ম থেকে কর্মান্তরে, জন্ম থেকে জন্মান্তরেই কেবল গতি হতে থাকে, তখন লোকের বিচারপ্রবৃত্তি কালে আপনা-আপনি জেগে উঠে জিজ্ঞাসা করে—কর্মের অন্ত কোথায়? তখনি সে গীতামুখে ভগবান্ যা বলছেন, ‘গহনা কর্মণো গতিঃ’—তার মর্ম বুঝতে পারে। অতএব যখন কর্ম করে করে আর শান্তিলাভ হয় না, তখনই সাধক কর্মত্যাগী হয়। কিন্তু দেহধারণ করে কিছু একটা নিয়ে তো থাকতে হবে—কি নিয়ে থাকবে বল? তাই দু-চারটে সৎকর্ম করে যায়, কিন্তু ঐ কর্মের ফলাফলের প্রত্যাশা রাখে না। কারণ, তখন তারা জেনেছে যে, ঐ কর্মফলেই জন্মমৃত্যুর বহুধা অঙ্কুর নিহিত আছে। সেই জন্যই ব্রহ্মজ্ঞেরা সর্বকর্মত্যাগী—লোক-দেখান দু-চারটে কর্ম করলেও তাতে তাঁদের কিছুমাত্র আঁট নেই। এঁরাই শাস্ত্রে নিষ্কাম কর্মযোগী বলে কথিত হয়েছেন।
শিষ্য॥ তবে কি মহাশয়, নিষ্কাম ব্রহ্মজ্ঞের উদ্দেশ্যহীন কর্ম উন্মত্তের চেষ্টাদির ন্যায়?
স্বামীজী॥ তা কেন? নিজের জন্য, আপন শরীর-মনের সুখের জন্য কর্ম না করাই হচ্ছে কর্মফল ত্যাগ করা। ব্রহ্মজ্ঞ নিজ সুখান্বেষণই করেন না, কিন্তু অপরের কল্যাণ বা যথার্থ সুখলাভের জন্য কেন কর্ম করবেন না? তাঁরা ফলাসঙ্গরহিত হয়ে যা-কিছু কর্ম করে যান, তাতে জগতের হিত হয়—সে-সব কর্ম ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ হয়। ঠাকুর বলতেন, ‘তাঁদের পা কখনও বেচালে পড়ে না।’ তাঁরা যা যা করেন, তাই অর্থবন্ত হয়ে দাঁড়ায়। উত্তরচরিতে পড়িসনি—‘ঋষীণাং পুনরাদ্যানাং বাচমর্থোঽনুধাবতি।’—ঋষিদের বাক্যের অর্থ আছেই আছে, কখনও নিরর্থক বা মিথ্যা হয় না। মন যখন আত্মীয় লীন হয়ে বৃত্তহীন-প্রায় হয়, তখনই [ঠিক ঠিক] ‘ইহামুত্রফলভোগবিরাগ’ জন্মায় অর্থাৎ সংসারে বা মৃত্যুর পর স্বর্গাদিতে কোন প্রকার সুখভোগ করবার বাসনা থাকে না—মনে আর সংকল্প-বিকল্পের তরঙ্গ থাকে না। কিন্তু ব্যুত্থানকালে অর্থাৎ সমাধি বা ঐ বৃত্তিহীন অবস্থা থেকে নেমে মন যখন আবার ‘আমি-আমার’ রাজ্যে আসে, তখন পূর্বকৃত কর্ম বা অভ্যাস বা প্রারব্ধজনিত সংস্কারবশে দেহাদির কর্ম চলতে থাকে। মন তখন প্রায়ই super conscious (অতিচেতন) অবস্থায় থাকে; না খেলে নয়, তাই খাওয়া-দাওয়া থাকে—দেহাদি-বুদ্ধি এত অল্প বা ক্ষীণ হয়ে যায়। এই অতিচেতন ভূমিতে পৌঁছে যা যা করা যায়, তাই ঠিক ঠিক করতে পারা যায়; সে-সব কাজে জীবের ও জগতের যথার্থ হিত হয়, কারণ তখন কর্তার মন আর স্বার্থপরতায় বা নিজের লাভ-লোকসান খতিয়ে দূষিত হয় না। ঈশ্বর super conscious state-এ (জ্ঞানাতীত ভূমিতে) সর্বদা অবস্থান করেই এই জগদ্রূপ বিচিত্র সৃষ্টি করেছেন; এ সৃষ্টিতে সেজন্য কোন কিছু imperfect (অসম্পূর্ণ) দেখা যায় না। এইজন্যই বলছিলুম, আত্মজ্ঞের ফলাসঙ্গরহিত কর্মাদি অঙ্গহীন বা অসম্পূর্ণ হয় না—তাতে জীবের ও জগতের ঠিক ঠিক কল্যাণ হয়।
শিষ্য॥ আপনি ইতঃপূর্বে বলিলেন, জ্ঞান ও কর্ম পরস্পরবিরোধী। ব্রহ্মজ্ঞানে কর্মের তিলমাত্র স্থান নাই, অথবা কর্মের দ্বারা ব্রহ্মজ্ঞান বা আত্মদর্শন হয় না, তবে আপনি মহা রজোগুণের উদ্দীপক উপদেশ—মধ্যে মধ্যে দেন কেন? এই সেদিন আমাকেই বলিতেছিলেন, ‘কর্ম কর্ম কর্ম—নান্যঃ পন্থা বিদ্যতেঽয়নায়।’
স্বামীজী॥ আমি দুনিয়া ঘুরে দেখলুম, এ দেশের মত এত অধিক তামস-প্রকৃতির লোক পৃথিবীর আর কোথাও নেই। বাইরে সাত্ত্বিকতার ভান, ভেতরে একাবারে ইঁট-পাটকেলের মত জড়ত্ব—এদের দ্বারা জগতের কি কাজ হবে? এমন অকর্মা, অলস, শিশ্নোদরপরায়ণ জাত দুনিয়ায় কতদিন আর বেঁচে থাকতে পারবে? ওদেশ (পাশ্চাত্য) বেড়িয়ে আগে দেখে আয়, পরে আমার ঐ কথায় প্রতিবাদ করিস। তাদের জীবনে কত উদ্যম, কত কর্মতৎপরতা, কত উৎসাহ কত রজোগুণের বিকাশ! তোদের দেশের লোকগুলোর রক্ত যেন হৃদয়ে রুদ্ধ হয়ে রয়েছে, ধমনীতে যেন আর রক্ত ছুটতে পারছে না, সর্বাঙ্গে paralysis (পক্ষাঘাত) হয়ে যেন এলিয়ে পড়েছে! আমি তাই এদের ভেতর রজোগুণ বাড়িয়ে কর্মতৎপরতা দ্বারা এদেশের লোকগুলোকে আগে ঐহিক জীবনসংগ্রামে সমর্থ করতে চাই। শরীরে বল নেই, হৃদয়ে উৎসাহ নেই, মস্তিষ্কে প্রতিভা নেই! কি হবে রে, জড়পিণ্ডগুলো দ্বারা? আমি নেড়ে-চেড়ে এদের ভেতর সাড় আনতে চাই—এজন্য আমার প্রাণান্ত পণ। বেদান্তের অমোঘ মন্ত্রবলে এদের জাগাব। ‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত’—এই অভয়বাণী শোনাতেই আমার জন্ম। তোরা ঐ কাজে আমার সহায় হ। যা গাঁয়ে গাঁয়ে দেশে-দেশে এই অভয়বাণী আচণ্ডালব্রাহ্মণকে শোনাগে। সকলকে ধরে ধরে বলগে যা—তোমরা অমিতবীর্য, অমৃতের অধিকারী। এইভাবে আগে রজঃশক্তির উদ্দীপনা কর—জীবনসংগ্রামে সকলকে উপযুক্ত কর, তারপর মুক্তিলাভের কথা তাদের বল। আগে ভেতরের শক্তি জাগ্রত করে দেশের লোককে নিজের পায়ের ওপর দাঁড় করা, উত্তম অশন-বসন, উত্তম ভোগ আগে করতে শিখুক, তারপর সর্বপ্রকার ভোগের বন্ধন থেকে কি করে মুক্তি হতে পারবে, তা বলে দে। আলস্য, হীনবুদ্ধিতা, কপটতায় দেশ ছেয়ে ফেলেছে! বুদ্ধিমান্ লোক এ দেখে কি স্থির হয়ে থাকতে পারে? কান্না পায় না? মান্দ্রাজ, বোম্বে, পাঞ্জাব, বাঙলা—যেদিকে চাই, কোথাও যে জীবনীশক্তির চিহ্ন দেখি না। তোরা ভাবছিস—আমরা শিক্ষিত। কি ছাই মাথামুণ্ড শিখেছিস? কতকগুলি পরের কথা ভাষান্তরে মুখস্থ করে মাথার ভেতরে পুরে পাশ করে ভাবছিস, আমরা শিক্ষিত! ছ্যাঃ! ছ্যাঃ! এর নাম আবার শিক্ষা!! তোদের শিক্ষার উদ্দেশ্য কি? হয় কেরানীগিরি, না হয় একটা দুষ্ট উকিল হওয়া, না হয় বড়জোড় কেরানীগিরিরই রূপান্তর একটা ডেপুটিগিরি চাকরি—এই তো! এতে তোদেরই বা কি হল, আর দেশেরই বা কি হল? একবার চোখ খুলে দেখ, স্বর্ণপ্রস্থ ভারতভূমিতে অন্নের জন্য কি হাহাকারটা উঠেছে! তোদের ঐ শিক্ষায় সে অভাব পূর্ণ হবে কি?—কখনও নয়। পাশ্চাত্য-বিজ্ঞানসহায়ে মাটি খুঁড়তে লেগে যা, অন্নের সংস্থান কর—চাকরি গুখুরি করে নয়, নিজের চেষ্টায় পাশ্চাত্যবিজ্ঞানসহায়ে নিত্য নূতন পন্থা আবিষ্কার করে। ঐ অন্নবস্ত্রের সংস্থান করবার জন্যই আমি লোকগুলোকে রজোগুণ-তৎপর হতে উপদেশ দিই। অন্নবস্ত্রাভাবে চিন্তায় চিন্তায় দেশ উৎসন্ন হয়ে গেছে—তার তোরা কি করছিস? ফেলে দে তোর শাস্ত্র-ফাস্ত্র গঙ্গাজলে। দেশের লোকগুলোকে আগে অন্নসংস্থান করবার উপায় শিখিয়ে দে, তারপর ভাগবত পড়ে শোনাস। কর্মতৎপরতা দ্বারা ঐহিক অভাব দূর না হলে ধর্ম-কথায় কেউ কান দেবে না। তাই বলি আগে আপনার ভেতর অন্তর্নিহিত আত্মশক্তিকে জাগ্রত কর, তারপর দেশের ইতরসাধারণ সকলের ভেতর যতটা পারিস ঐ শক্তিতে বিশ্বাস জাগ্রত করে প্রথম অন্নসংস্থান, পরে ধর্মলাভ করতে তাদের শেখা। আর বসে থাকবার সময় নেই। কখন কার মৃত্যু হবে, তা কে বলতে পারে?
কথাগুলি বলিতে বলিতে ক্ষোভ দুঃখ ও করুণার সহিত অপূর্ব এক তেজের মিলনে স্বামীজীর বদন উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। চক্ষে যেন অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইতে লাগিল। তাঁহার তখনকার সেই দিব্যমূর্তি অবলোকন করিয়া ভয়ে ও বিস্ময়ে শিষ্যের আর কথা সরিল না! কতক্ষণ পরে স্বামীজী পুনরায় বলিলেনঃ
ঐরূপ কর্মতৎপরতা ও আত্মনির্ভরতা কালে দেশে আসবেই আসবে—বেশ দেখতে পাচ্ছি; There is no escape (গত্যন্তর নেই); … ঠাকুরের জন্মাবার সময় হতেই পূর্বাকাশে অরুণোদয় হয়েছে; কালে তার উদ্ভিন্ন ছটায় দেশ মধ্যাহ্ন-সূর্যকরে আলোকিত হবে।
২৯
স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—(ঐ নির্মাণকালে) ১৮৯৮
মঠ-বাটী নির্মাণ হইয়াছে, সামান্য একটু-আধটু যাহা বাকী আছে, স্বামীজীর অভিমতে স্বামী বিজ্ঞানানন্দ তাহা শেষ করিতেছেন। স্বামীজীর শরীর তত ভাল নয়, তাই ডাক্তারগণ তাঁহাকে নৌকায় করিয়া গঙ্গাবক্ষে সকাল-সন্ধ্যা বেড়াইতে বলিয়াছেন। নড়ালের রায়বাবুদের বজরাখানি কিছুদিনের জন্য মঠের সামনে বাঁধা রহিয়াছে। স্বামীজী ইচ্ছামত কখনও কখনও ঐ বজরায় করিয়া গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণ করিয়া থাকেন।
আজ রবিবার। শিষ্য মঠে আসিয়াছে এবং আহারান্তে স্বামীজীর ঘরে বসিয়া স্বামীজীর সহিত কথোপকথন করিতেছে। মঠে এই সময় স্বামীজী সন্ন্যাসী ও বালব্রহ্মচারিগণের জন্য কতকগুলি নিয়ম বিধিবদ্ধ করেন, গৃহস্থদের সঙ্গ হইতে দূরে থাকাই ঐগুলির মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল; যথা—পৃথক্ আহারের স্থান, পৃথক্ বিশ্রামের স্থান ইত্যাদি। ঐ বিষয় লইয়াই এখন কথাবার্তা হইতে লাগিল।
স্বামীজী॥ গেরস্তদের গায়ে-কাপড়ে আজকাল কেমন একটা সংযমহীনতার গন্ধ পাই; তাই মঠে নিয়ম করেছি, গেরস্তরা সাধুদের বিছানায় না বসে, না শোয়। আগে শাস্ত্রে পড়তুম যে, ঐরূপ পাওয়া যায় এবং সেজন্য সন্ন্যাসীরা গৃহস্থদের গন্ধ সইতে পারে না। এখন দেখছি—ঠিক কথা। নিয়মগুলি প্রতিপালন করে চললে বালব্রহ্মচারীদের কালে ঠিক ঠিক সন্ন্যাস হবে। সন্ন্যাস-নিষ্ঠা দৃঢ় হলে পর গৃহস্থদের সহিত সমভাবে মিলে-মিশে থাকলেও আর ক্ষতি হবে না। কিন্তু এখন নিয়মের গণ্ডীর ভেতর না রাখলে সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীরা সব বিগড়ে যাবে। যথার্থ ব্রহ্মচারী হতে হলে প্রথম প্রথম সংযম সম্বন্ধে কঠোর নিয়ম পালন করে চলতে হয়, স্ত্রীলোকের নাম-গন্ধ থেকে তো দূরে থাকতেই হয়, তা ছাড়া স্ত্রীসঙ্গীদের সঙ্গও ত্যাগ করতেই হয়।
গৃহস্থাশ্রমী শিষ্য স্বামীজীর কথা শুনিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল এবং মঠের সন্ন্যাসী-ব্রহ্মচারীদিগের সহিত পূর্বের মত সমভাবে মিশিতে পারিবে না ভাবিয়া বিমর্ষ হইয়া কহিল, ‘কিন্তু মহাশয়, এই মঠ ও মঠস্থ যাবতীয় লোককে আমার বাড়ী-ঘর স্ত্রী-পুত্রের অপেক্ষা অধিক আপনার বলিয়া মনে হয়। ইহারা সকলে যেন কতকালের চেনা! মঠে আমি যেমন সর্বতোমুখী স্বাধীনতা উপভোগ করি, জগতের কোথাও আর তেমন করি না!’
স্বামীজী॥ যত শুদ্ধসত্ত্ব লোক আছে, সবারই এখানে ঐরূপ অনুভূতি হবে। যার হয় না, সে জানবি এখানকার লোক নয়। কত লোক হুজুগে মেতে এসে আবার যে পালিয়ে যায়, উহাই তার কারণ। ব্রহ্মচর্যবিহীন, দিনরাত অর্থ অর্থ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, এমন সব লোকে এখানকার ভাব কখনও বুঝতে পারবে না, কখনও মঠের লোককে আপনার বলে মনে করবে না। এখানকার সন্ন্যাসীরা সেকেলে ছাই-মাখা, মাথায়-জটা, চিম্টে-হাতে, ঔষধ-দেওয়া সন্ন্যাসীদের মত নয়; তাই লোকে দেখে শুনে কিছুই বুঝতে পারে না। আমাদের ঠাকুরের চালচলন ভাব—সকলই নূতন ধরনের ছিল, তাই আমরাও সব নূতন রকমের; কখনও সেজেগুজে বক্তৃতা দিই, আবার কখনও ‘হর হর ব্যোম্ ব্যোম্’ বলে ছাই মেখে পাহাড়-জঙ্গলে ঘোর তপস্যায় মন দিই!
শুধু সেকেলে পাঁজি-পুঁথির দোহাই দিলে এখন আর কি চলে রে? এই পাশ্চাত্য সভ্যতার উদ্বেল প্রবাহ তরতর করে এখন দেশ জুড়ে বয়ে যাচ্ছে। তার উপযোগিতা একটুও প্রত্যক্ষ না করে কেবল পাহাড়ে বসে ধ্যানস্থ থাকলে এখন আর কি চলে? এখন চাই গীতায় ভগবান্ যা বলেছেন—প্রবল কর্মযোগ, হৃদয়ে অসীম সাহস, অমিত বল পোষণ করা। তবে তো দেশের লোকগুলো সব জেগে উঠবে, নতুবা তুমি যে তিমিরে, তারাও সেই তিমিরে।
বেলা প্রায় অবসান। স্বামীজী গঙ্গাবক্ষে ভ্রমণোপযোগী সাজ করিয়া নীচে নামিলেন এবং মঠের জমিতে যাইয়া পূর্বদিকে এখন যেখানে পোস্তা গাঁথা হইয়াছে, সেখানে পদচারণা করিয়া কিছুক্ষণ বেড়াইতে লাগিলেন। পরে বজরাখানি ঘাটে আনা হইলে স্বামী নির্ভয়ানন্দ, স্বামী নিত্যানন্দ ও শিষ্যকে সঙ্গে লইয়া নৌকায় উঠিলেন।
নৌকায় উঠিয়া স্বামীজী ছাতে বসিলে শিষ্য তাঁহার পাদমূলে উপবেশন করিল। গঙ্গার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তরঙ্গগুলি নৌকার তলদেশে প্রতিহত হইয়া কলকল শব্দ করিতেছে, মৃদুল মলয়ানিল প্রবাহিত হইতেছে, আকাশের পশ্চিমদিক এখনও সন্ধ্যার রক্তিম রাগে রঞ্জিত হয় নাই, ভগবান্ মরীচিমালী অস্ত যাইতে এখনও অর্ধঘণ্টা বাকী। নৌকা উত্তর দিকে চলিয়াছে। স্বামীজীর মুখে প্রফুল্লতা, নয়নে কোমলতা, কথায় উদাসীনতা! সে এক ভাবপূর্ণ রূপ—বুঝান অসম্ভব!
এইবার দক্ষিণেশ্বর ছাড়াইয়া নৌকা অনুকূল বায়ুবশে আরও উত্তরে অগ্রসর হইতেছে। দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ী দেখিয়া শিষ্য ও অপর সন্ন্যাসিদ্বয় প্রণাম করিল। স্বামীজী কিন্তু কি এক গভীর ভাবে আত্মহারা হইয়া এলোথেলো ভাবে বসিয়া রহিলেন! শিষ্য ও সন্ন্যাসীরা পরস্পরে দক্ষিণেশ্বরের কত কথা বলিতে লাগিল, সে-সকল কথা যেন তাঁহার কর্ণে প্রবিষ্টই হইল না। দেখিতে দেখিতে নৌকা পেনেটির দিকে অগ্রসর হইল। পেনেটিতে ৺গোবিন্দকুমার চৌধুরীর বাগানবাটীর ঘাটে নৌকা কিছুক্ষণের জন্য বাঁধা হইল। এই বাগানখানিই ইতঃপূর্বে একবার মঠের জন্য ভাড়া করিবার প্রস্তাব হইয়াছিল। স্বামীজী অবতরণ করিয়া বাগান ও বাটী বিশেষরূপে পর্যবেক্ষণ করিয়া বলিলেন, ‘বাগানটি বেশ, কিন্তু কলিকাতা থেকে অনেক দূর; ঠাকুরের শিষ্য (ভক্ত)-দের যেতে আসতে কষ্ট হত; এখানে মঠ যে হয়নি, তা ভালই হয়েছে।’
এইবার নৌকা আবার মঠের দিকে চলিল এবং প্রায় এক ঘণ্টাকাল নৈশ অন্ধকার ভেদ করিয়া চলিতে চলিতে মঠে আসিয়া উপস্থিত হইল।
৩০
স্থান—বেলুড় মঠ
কাল—১৮৯৯ খ্রীঃ প্রারম্ভ
শিষ্য অদ্য নাগ-মহাশয়কে সঙ্গে লইয়া মঠে আসিয়াছে।
স্বামীজী॥ (নাগ-মহাশয়কে প্রণাম করিয়া) ভাল আছেন তো?
নাগ-মহাশয়॥ আপনাকে দর্শন করতে এলাম। জয় শঙ্কর! জয় শঙ্কর! সাক্ষাৎ শিব-দর্শন হল। কথাগুলি বলিয়া নাগ-মহাশয় করজোড়ে দণ্ডায়মান রহিলেন।
স্বামীজী॥ শরীর কেমন আছে?
নাগ-মহাশয়॥ ছাই হাড়মাসের কথা কি জিজ্ঞাসা করছেন? আপনার দর্শনে আজ ধন্য হলাম, ধন্য হলাম।
ঐরূপ বলিয়া নাগ-মহাশয় স্বামীজীকে সাষ্টাঙ্গে প্রণিপাত করিলেন।
স্বামীজী॥ (নাগ-মহাশয়কে তুলিয়া) ও কি করছেন?
নাগ-মঃ॥ আমি দিব্য চক্ষে দেখছি, আজ সাক্ষাৎ শিবের দর্শন পেলাম। জয় ঠাকুর রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী॥ (শিষ্যকে লক্ষ্য করিয়া) দেখছিস, ঠিক ভক্তিতে মানুষ কেমন হয়!
নাগ-মহাশয় তন্ময় হয়ে গেছেন, দেহবুদ্ধি একেবারে গেছে! এমনটি আর দেখা যায় না। (প্রেমানন্দ স্বামীকে লক্ষ্য করিয়া) নাগ-মহাশয়ের জন্য প্রসাদ নিয়ে আয়।
নাগ-মঃ॥ প্রসাদ! প্রসাদ! (স্বামীজীর প্রতি করজোড়ে) আপনার দর্শনে আজ আমার ভবক্ষুধা দূর হয়ে গেছে।
মঠে ব্রহ্মচারী-ও সন্ন্যাসিগণ উপনিষদ্ পাঠ করিতেছিলেন। স্বামীজী তাঁহাদিগকে লক্ষ্য করিয়া বলিলেন, ‘আজ ঠাকুরের একজন মহাভক্ত এসেছেন। নাগ-মহাশয়ের শুভাগমনে আজ তোদের পাঠ বন্ধ থাকল।’ সকলেই বই বন্ধ করিয়া নাগ-মহাশয়ের চারিদিকে ঘিরিয়া বসিল। স্বামীজীও নাগ-মহাশয়ের সম্মুখে বসিলেন।
স্বামীজী॥ (সকলকে লক্ষ্য করিয়া) দেখছিস! নাগ-মহাশয়কে দেখ; ইনি গেরস্ত, কিন্তু জগৎ আছে কি নেই, এঁর সে জ্ঞান নেই; সর্বদা তন্ময় হয়ে আছেন! (নাগ-মহাশয়কে লক্ষ্য করিয়া) এই সব ব্রহ্মচারীদেরও আমাদের ঠাকুরের কিছু কথা শোনান।
নাগ-মঃ॥ ও কি বলেন! ও কি বলেন! আমি কি বলব? আমি আপনাকে দেখতে এসেছি; ঠাকুরের লীলার সহায় মহাবীরকে দর্শন করতে এসেছি; ঠাকুরের কথা এখন লোকে বুঝবে। জয় রামকৃষ্ণ! জয় রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী॥ আপনিই যথার্থ রামকৃষ্ণদেবকে চিনেছেন। আমরা ঘুরে ঘুরেই মরলুম।
নাগ-মঃ॥ ছিঃ! ও-কথা কি বলছেন! আপনি ঠাকুরের ছায়া—এপিঠ আর ওপিঠ; যার চোখ আছে, সে দেখুক।
স্বামীজী॥ এ-সব যে মঠ-ফঠ হচ্ছে, এ কি ঠিক হচ্ছে?
নাগ-মঃ॥ আমি ক্ষুদ্র, আমি কি বুঝি? আপনি যা করেন, নিশ্চয় জানি তাতে জগতের মঙ্গল হবে—মঙ্গল হবে।
অনেকে নাগ-মহাশয়ের পদধূলি লইতে ব্যস্ত হওয়ায় নাগ-মহাশয় উন্মাদের মত হইলেন। স্বামীজী সকলকে বলিলেন, ‘যাতে এঁর কষ্ট হয়, তা করো না।’ শুনিয়া সকলে নিরস্ত হইলেন।
স্বামীজী॥ আপনি এসে মঠে থাকুন না কেন? আপনাকে দেখে মঠের ছেলেরা সব শিখবে।
নাগ-মঃ॥ ঠাকুরকে ঐ কথা একবার জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি বললেন, ‘গৃহেই থেকো।’ তাই গৃহেই আছি; মধ্যে মধ্যে আপনাদের দেখে ধন্য হয়ে যাই।
স্বামীজী॥ আমি একবার আপনার দেশে যাব।
নাগ-মঃ॥ (আনন্দে উন্মত্ত হইয়া), এমন দিন কি হবে? দেশ কাশী হয়ে যাবে, কাশী হয়ে যাবে। সে অদৃষ্ট আমার হবে কি?
স্বামীজী॥ আমার তো ইচ্ছা আছে। এখন মা নিয়ে গেলে হয়।
নাগ-মঃ॥ আপনাকে কে বুঝবে—কে বুঝবে? দিব্য দৃষ্টি না খুললে চিনবার যো নেই। একমাত্র ঠাকুরই চিনেছিলেন; আর সকলে তাঁর কথায় বিশ্বাস করে মাত্র, কেউ বুঝতে পারেনি।
স্বামীজী॥ আমার এখন একমাত্র ইচ্ছা, দেশটাকে জাগিয়ে তুলি—মহাবীর যেন নিজের শক্তিমত্তায় অনাস্থাপর হয়ে ঘুমুচ্ছে—সাড়া নেই, শব্দ নেই। সনাতন ধর্মভাবে একে কোনরূপ জাগাতে পারলে বুঝব, ঠাকুরের ও আমাদের আসা সার্থক হল। কেবল ঐ ইচ্ছাটা আছে—মুক্তি-ফুক্তি তুচ্ছ বোধ হয়েছে। আপনি আশীর্বাদ করুন যেন কৃতকার্য হওয়া যায়।
নাগ-মঃ॥ ঠাকুরের আশীর্বাদ। আপনার ইচ্ছার গতি ফেরায় এমন কাকেও দেখি না; যা ইচ্ছা করবেন, তাই হবে।
স্বামীজী॥ কই কিছুই হয় না—তাঁর ইচ্ছা ভিন্ন কিছুই হয় না।
নাগ-মঃ॥ তাঁর ইচ্ছা আর আপনার ইচ্ছা এক হয়ে গেছে; আপনার যা ইচ্ছা, তা ঠাকুরেরই ইচ্ছা। জয় রামকৃষ্ণ! জয় রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী॥ কাজ করতে মজবুত শরীর চাই; এই দেখুন, এদেশে এসে অবধি শরীর ভাল নেই; ওদেশে বেশ ছিলুম
। নাগ-মঃ॥ শরীর ধারণ করলেই—ঠাকুর বলতেন—‘ঘরের টেক্স দিতে হয়।’ রোগশোক সেই টেক্স। আপনি যে মোহরের বাক্স; ঐ বাক্সের খুব যত্ন চাই। কে করবে? কে বুঝবে? ঠাকুরই একমাত্র বুঝেছিলেন। জয় রামকৃষ্ণ! জয় রামকৃষ্ণ!
স্বামীজী॥ মঠের এরা আমায় যত্নে রাখে।
নাগ-মঃ॥ যাঁরা করছেন তাঁদেরই কল্যাণ, বুঝুক আর নাই বুঝুক। সেবার কমতি হলে দেহ রাখা ভার হবে।
স্বামীজী॥ নাগ-মহাশয়! কি যে করছি, কি না করছি—কিছু বুঝতে পাচ্ছিনে। এক এক সময়ে এক এক দিকে মহা ঝোঁক আসে, সেই মত কাজ করে যাচ্ছি, এতে ভাল হচ্ছে কি মন্দ হচ্ছে, কিছু বুঝতে পারছি না।
নাগ-মঃ॥ ঠাকুর যে বলেছিলেন—‘চাবি দেওয়া রইল।’ তাই এখন বুঝতে দিচ্ছেন না। বুঝামাত্রই লীলা ফুরিয়ে যাবে।
স্বামীজী॥ একদৃষ্টে কি ভাবিতেছিলেন। এমন সময়ে স্বামী প্রেমানন্দ ঠাকুরের প্রসাদ লইয়া আসিলেন এবং নাগ-মহাশয় ও অন্যান্য সকলকে দিলেন। নাগ-মহাশয় দুই হাতে করিয়া প্রসাদ মাথায় তুলিয়া ‘জয় রামকৃষ্ণ’ বলিয়া নৃত্য করিতে লাগিলেন। সকলে দেখিয়া অবাক। প্রসাদ পাইয়া সকলে বাগানে পায়চারি করিতে লাগিলেন। ইতোমধ্যে স্বামীজী একখানি কোদাল লইয়া আস্তে আস্তে মঠের পুকুরের পূর্বপারে মাটি কাটিতেছিলেন—নাগ-মহাশয় দর্শনমাত্র তাঁহার হস্ত ধরিয়া বলিলেন, ‘আমরা থাকতে আপনি ও কি করেন?’ স্বামীজী কোদাল ছাড়িয়া মাঠে বেড়াইতে বেড়াইতে গল্প বলিতে লাগিলেনঃ
ঠাকুরের দেহ যাবার পর একদিন শুনলুম, নাগ-মহাশয় চার-পাঁচ দিন উপোস করে তাঁর কলিকাতার খোলার ঘরে পড়ে আছেন; আমি, হরি ভাই ও আর একজন মিলে তো নাগ-মহাশয়ের কুটীরে গিয়ে হাজির; দেখেই লেপমুড়ি ছেড়ে উঠলেন। আমি বললুম—আপনার এখানে আজ ভিক্ষা পেতে হবে। অমনি নাগ-মহাশয় বাজার থেকে চাল, হাঁড়ি, কাঠ প্রভৃতি এনে রাঁধতে শুরু করলেন। আমরা মনে করেছিলুম—আমরাও খাব, নাগ-মহাশয়কেও খাওয়াব। রান্নাবান্না করে তো আমাদের দেওয়া হল; আমরা নাগ-মহাশয়ের জন্য সব রেখে দিয়ে আহারে বসলুম। আহারের পর, ওঁকে খেতে যেই অনুরোধ করা আর তখনি ভাতের হাঁড়ি ভেঙে ফেলে কপালে আঘাত করে বলতে লাগলেন—‘যে দেহে ভগবান্ লাভ হল না, সে দেহকে আবার আহার দিব?’ আমরা তো দেখেই অবাক! অনেক করে পরে কিছু খাইয়ে তবে আমরা ফিরে এলুম।
স্বামীজী॥ নাগ-মহাশয় আজ মঠে থাকবেন কি?
শিষ্য॥ না। ওঁর কি কাজ আছে, আজই যেতে হবে।
স্বামীজী॥ তবে নৌকা দে। সন্ধ্যা হয়ে এল।
নৌকা আসিলে শিষ্য ও নাগ-মহাশয় স্বামীজীকে প্রণাম করিয়া কলিকাতা অভিমুখে রওনা হইলেন।