স্কুল ছুটির পর আমরা বাসায় যাচ্ছি, কোর্টের কাছাকাছি কিছু একটা দেখে মিঠুন দাঁড়িয়ে গেল। আমরাও দাড়িয়ে গেলাম। কোর্টে দেওয়ালে একটা পোস্টার, পোস্টারে বড় বড় করে লেখা, আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা। নিচে লেখা আমাদের ছোট শহরের সব স্কুল কলেজ মিলে একটা আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তিনদিন ধরে এই মেলা চলবে, শেষ দিনে পুরস্কার দেয়া হবে।
মিঠুন বলল, “আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা, আমরা সেখানে যোগ দিচ্ছি না কেন?”
“বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিব? আমরা?” বলে ঝুম্পা হি হি করে হাসতে লাগল। জিনিষটা এতোই হাস্যকর যে আমরাও হি হি করে হাসতে লাগলাম।
মিঠুন অবাক হয়ে বলল, “এর মাঝে হাসির কী আছে? গত বছর বিজ্ঞান বেলায় আমি ফার্স্ট প্রাইজ পেয়েছিলাম।”
আমি বললাম, “গত বছর তুই ছিলি অকুব্রীজ স্কুলে। এই বহুর তুই মহব্বতজান স্কুলে। মহব্বতজান স্কুল থেকে কেউ কোনোদিন বিজ্ঞান মেলায় যোগ দেয় নাই।”
মিঠুন মুখ শক্ত করে বলল, “এটা হতেই পারে না যে আমরা বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিব না। আমাদেরকে জানানো হল না কেন? আমাদের স্কুলে চিঠি পাঠানো হল না কেন?”
ঝুম্পা হি হি করে হেসে বলল, “নিশ্চয়ই চিঠি পাঠিয়েছে। সেই চিঠি কেউ কোনোদিন খুলে দেখে নাই। সোজাসুজি ছিড়ে ফেলে দিয়েছে।”
আমি বললাম, “ভালই হয়েছে ছিড়ে ফেলে দিয়েছে, চিঠি খুললে এর ভিতরে কী লেখা আছে কেউ কোনোদিন বুঝতে পারত না। এই স্কুলের কেউ বিজ্ঞান বানান পর্যন্ত করতে পারে না।”
মিঠুন বলল, “আমি এখনই খোঁজ নিব বিজ্ঞান মেলায় যোগ দিতে হলে কী করতে হয়। তারপর কাল স্যারদেরকে বলব।”
বগা বলল, “তোর ইচ্ছা হলে বল, আমি আগে থেকে তোকে বলে দিতে পারি বলে কোনো লাভ হবে না। ক্ষতি হতে পারে।”
“ক্ষতি? কী ক্ষতি হবে?”
“এটা বলার জন্যে তোকে আচ্ছামতন বানাতে পারে। স্যারেরা তোকে সাইজ করে ছেড়ে দিতে পারে।”
“সাইজ করলে করবে। আমি স্যারকে বলব।”
পরের দিন ক্লাশে বিজ্ঞান স্যার আসতেই মিঠুন দাঁড়িয়ে গেল, বলল, “স্যার।”
কালাপাহাড় স্যার খুব অবাক হলেন। এই স্কুলে নিজে থেকে কোন ছাত্র-ছাত্রী, স্যারদের কিছু বলে না, স্যারেরা কিছু বললে তার উত্তর দেয়। কালাপাহাড় স্যার ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হল?”
“আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা পরশু দিন থেকে। আমাদের স্কুল থেকে আমরা যোগ দিতে চাই।”
“কীসে যোগ দিতে চাস?”
“বিজ্ঞান মেলা। সায়েন্স ফেয়ারে স্যার।” কালাপাহাড় স্যারের ভুরু আরো বেশী কুঁচকে গেল, “সেটা আবার কী?”
“আমরা স্যার বিজ্ঞানের প্রজেক্ট নিয়ে যাব। যে স্কুলের প্রজেক্ট ভালো হবে সেই স্কুল পুরস্কার পাবে।”
কালাপাহাড় স্যার মিঠুনের কথা শুনে হা হা করে হাসতে শুরু করলেন। আমরা এর আগে কখনো কালাপাহাড় স্যারকে হাঁসতে দেখিনি। তার হাসি দেখে ভয়ে আমাদের আত্মা শুকিয়ে গেল। একজন মানুষ হাসলে তাকে যে এতো ভয়ংকর দেখাতে পারে আমরা সেটা জানতাম না। মিঠুনের কৃথাটা এতোই অবাস্তব যে স্যার তার উত্তরে কিছু বলা দরকার পর্যন্ত মনে করলেন না। হাসতে হাসতে চেয়ারে ঠেলে ঢুকে পড়ে বসে ঘুমিয়ে গেলেন।
ক্লাশের পর মিঠুন বলল, “বিজ্ঞান স্যার যদি রাজী না থাকে তাহলে আমরা হেড স্যারের কাছে যাব।”
বগা জিজ্ঞেস করল, “হেড স্যার? হেড স্যার কে?”
দেখা গেল আমরা কেউই মহব্বতজান স্কুলের হেড স্যার কে সেটা জানি না। এই স্কুল, স্কুলের স্যার ম্যাডাম কোনো কিছু নিয়েই আসলে আমাদের উৎসাই নাই। আমরা স্কুলে আসি, স্যার ম্যাডামদের বকাবকিইনি, পিটুনি খাই তারপর বাসায় চলে যাই। স্কুলের এসেম্বলী হয় না, জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয় না তাই যে সব স্যার ম্যাডাম আমাদের ক্লাশে আসেন না আমরা তাদেরকে চিনিও না।
মিঠুনের উৎসাহের জন্যে শেষ পর্যন্ত একটা দরখাস্ত লিখে আমরা কয়েকজন হেড স্যারের সাথে দেখা করতে গেলাম, যেতে যেতে আমাদের দলটা বেশ ভারী হয়ে গেল। মিঠুনের সাথে আমি, বগা, ঝুম্পা, ফারা তো আছিই, গুললু এমন কী রোল নম্বর তেতাল্লিশ পর্যন্ত আমাদের পিছু পিছু রওনা দিল।
আমরা আবিষ্কার করলাম স্কুলের একটা অফিস আছে আর সেই অফিসের পাশে হেড মাস্টারের রুম। দরজায় ভারী পর্দা তাই ভেতরে কেউ আছে কী না বোঝা গেল না। মিঠুন তাই আমাদেরকে নিয়ে প্রথমে অফিসে হাজির হল। সেখানে শেয়ালের মত দেখতে একজন মানুষ টেবিলে ঝুঁকে এক কপি দৈনিক মহব্বত পড়ছে। আরেক পাশে একজন চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আমাদের স্যার ম্যাভামরা যেরকম কোনো কাজ কর্ম করেন না, অফিসের লোকজনেরাও সেরকম কোনো কাজকর্ম করে না।
আমাদের দেখে শেয়ালের মত মানুষটা বলল, “কী ব্যাপার?”
মিঠুন বলল, “আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলায় আমাদের স্কুল থেকে টিম পাঠানোর ব্যাপারে কথা বলতে এসেছি।”
মানুষটা বলল, “অ।” তারপর আবার দৈনিক মহব্বত পড়তে শুরু করল। যে মানুষটা ঘুমাচ্ছিল সে হঠাৎ জেগে উঠল, চমকে উঠে বলল, “কী হয়েছে? কী হয়েছে? এ্যাঁ? কী হয়েছে?”
ঝুম্পা বলল, “আমরা হেড স্যারের সাথে দেখা করতে এসেছি।”
শেয়ালের মত মানুষটা দৈনিক মহব্বত থেকে চোখ না তুলে বলল, “দেখা হবে না। যাও।”
ঘুম থেকে জেগে ওঠা মানুষটা বলল, “কেন? কেন দেখা করতে চাও? কী হয়েছে? হ্যা? কী হয়েছে?”
ঝুম্পা বলল, “আয় যাই। এইখানে কথা বলে লাভ নাই।”
তাই আমরা অফিস থেকে বের হয়ে সরাসরি হেড স্যারের রুমের সামনে দাঁড়ালাম। মিঠুন পর্দা সরিয়ে বলল, “স্যার, আসতে পারি?”
আমরা সবাই তখন হেড স্যারকে দেখলাম, বড় একটা টেবিলের সামনে বসে দৈনিক মহব্বত পড়ছেন। হেড স্যারকে দেখে আমরা সবাই বুঝতে পারলাম এই মানুষটাকে আমরা আগেও দেখেছি। মানুষটা যে হেড মাস্টার বুঝতে পারি নাই, ভেবেছি দপ্তরী না হয় কেরানী।
হেড স্যার চোখ পাকিয়ে তাকালেন। জিজ্ঞেস করলেন, “কী হইছে?”
“আপনার সাথে কিছু কথা বলতে চাই। আসব স্যার?”
আমি নিশ্চিত ছিলাম হেড স্যার ধমক দিয়ে বের করে দিবে। কিন্তু মিঠুনের চোখে চশমা, কথা বলার স্টাইল এগুলো দেখে মনে হয় হেড স্যার
একটু অবাক হলেন, বললেন, “আয়।”
মিঠুনের পিছু পিছু আমরা সবাই ঢুকে গেলাম, হেড স্যার তখন একটু চমকে উঠলেন, আমরা এতোজন ঢুকে যাব বুঝতে পারেননি। আঁতকে উঠে বললেন, ‘এঁ! এতোজন? এতোজন আসার দরকার কী?”
মিঠুন বলল, “স্যার। আন্তঃস্কুল বিজ্ঞান মেলা হচ্ছে, আমরা সেই মেলায় যোগ দিতে চাই।”
হেড স্যার মিঠুনের কথা শুনে খুবই অবাক হলেন, কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “কিসের জন্য? হেইখানে গিয়া মাইরপিট করবি?”
মিঠুন বলল, “না স্যার। আমরা সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে যাব।”
“প্রজেক্ট পাইবি কই? বাজারে কিনতে পাওয়া যায়?”
না স্যার। আমরা প্রজেক্ট তৈরি করব।”
“তোরা প্রজেক্ট তৈরি করবি? আমারে সেই কথাটা বিশ্বাস করতে কইতাছস?
“জী স্যার। আমরা ল্যাবরেটরি ঘরটা ঠিক করেছি। সেখানে প্রজেক্ট তৈরি হবে।”
“এই স্কুলে কারা পড়ে তুই জানস? এই স্কুলে পড়ে শহরের যত চোর ডাকাইত গুণ্ডা বদমাইসের পোলাপান। এই পোলাপান বড় হইয়া কী হইব জানস? তারাও বড় হইয়া হইব চোর ডাকাইত গুণ্ডা বদমাইস। তাই আমার লগে মশকরা করনের দরকার নাই। বিজ্ঞান মেলায় যাওনের কথা বলার দরকার নাই। চুরি ডাকাতি গুণ্ডা বদমাইসী করনের মেলা থাকলে খবর নিস কয়েক হালি টিম পাঠামু।”
মিঠুন শেষ চেষ্টা করল, বলল, “স্যার আপনাকে কিছুই করতে হবে না। আমরা সবকিছু করব। আমরা একটা দরখাস্ত লিখে এনেছি, আপনি শুধু একটা সাইন দিয়ে দিবেন তাহলেই আমাদের টিমকে জায়গা দিবে। আমরা সব কিছু করব। খালি একটা সাইন।”।
হেড স্যার খেকিয়ে উঠলেন, “যা! ভাগ।”
“একটা খালি সিগনেচার সার।”
“দূর হ এইখান থেকে। পাজী বদমাইস বেআদপ বেআক্কেল বেতমিজ।” এক নিঃশ্বাসে বে দিয়ে শুরু এতোগুলো শব্দ বলা যেতে পারে আমরা কখনো চিন্তা করি নাই।
মিঠুন প্রায় ভাঙ্গা গলায় বলল, “আমাদের খুব শখ ছিল স্যার। আপনি শুধু একটা সাইন দিবেন স্যার। প্লীজ স্যার।”
হেড স্যার এইবার লাফ দিয়ে উঠলেন, চিৎকার করে বললেন, “কথা কানে যায় না। হেই মাইনকা, আমার বেতটা লইয়া আয় তো।”
হঠাৎ পিছন থেকে অপরিচিত একটা গলার স্বর শুনতে পেলাম, কে যেন বলল, “এখানে সময় নষ্ট করে লাভ নাই। আমি তোমাদের পারমিশান নিয়ে দেব। আমাকে দরখাস্তটা দাও।”
কে কথা বলে দেখার জন্যে আমরা ঘুরে তাকালাম, অবাক হয়ে দেখলাম রোল নাম্বার তেতাল্লিশ দরখাস্তটা নেবার জন্যে হাত বাড়িয়েছে। সে কোনোদিন কথা বলে নাই তাই আমরা কোনোদিন তার গলায় সুর শুনি নাই। মিঠুন কী করবে বুঝতে না পেরে রোল নাম্বার তেতাল্লিশকে দরখাস্তটা দিল। হেড স্যার কেমন যেন ভ্যাবেচেকা খেয়ে গেলেন, তারপরে হুংকার দিয়ে বললেন, “তুই কোন লাটসাহেবের বাচ্চা? তুই কোনখান থাইকা পারমিশান আনবি?”
“হাজী মহব্বতজান আমার চাচা। আমি চাচার কাছ থেকে পারমিশান আনব।”
জোঁকের মুখে চুন পড়লে জোকের যেরকম অবস্থা হয় হেড স্যারের ঠিক সেই অবস্থা হল। এক সেকেন্ডের মাঝে তার মুখটা রক্তশূন্য ফ্যাকাসে হয়ে গেল। হেড স্যার কেমন যেন কাঁপতে লাগলেন, তার মুখটা একবার খুলতে লাগল একবার বন্ধ হতে লাগল। কয়েকবার চেষ্টা করে বললেন, “তু-তু-ই মানে তু-তু-তুমি হা-হাজী সাহেবের ভা-ভা-ভাতিজা? সেইটা তো আগে বলবা।”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশ আমাদের বলল, “আয় যাই।”
হেড মাস্টার তখন প্রায় আর্তনাদ করে উঠলেন, “না না যাইও না। দরখাস্তটা দেও আমি সিগনেচার কইরা দেই।” হেড স্যার টেবিলের পিছন থেকে ছুটে আসতে চেষ্টা করলেন, শেলফ টেবিল চেয়ারে ধাক্কা খেলেন, একটা চেয়ার উল্টে পড়ে গেল।
রোল নাম্বার তেতাল্লিশ বলল, “চাচার কাছ থেকে সিগনেচার নিলে ভালো। সায়েন্স ফেয়ারে কিছু খরচ হয়। ভলান্টিয়ারদের খাওয়া দিতে হয় টুকিটাকি যন্ত্রপাতি কিনতে হয় যাতায়াতের খরচ হয়। চাচা সেই ফাটার ব্যবস্থা করে দিবে।”
হেড স্যার প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আমি স্কুল ফান্ড থেকে ব্যবস্থা কইরা দিমু।”
তারপর রোল নাম্বার তেতাল্লিশের হাত থেকে দরখাস্ত টা ছিনিয়ে নিয়ে সেখানে সিগনেচার করে দিলেন। তারপর চিৎকার করে বললেন, “মানিক্যা আমার সিল আর চেক বইটা তাড়াতাড়ি আন।”
আমরা কিছুক্ষণ পর বিজয়ীর মত হেড স্যারের সিগনেচার সিলসহ দরখাস্ত আর পাঁচ হাজার টাকার একটা চেক নিয়ে বের হলাম। সবাই যখন হই হই করতে করতে যাচ্ছে তখন আমি একটু পিছিয়ে রোল নাম্বার তেতাল্লিশকে ধরলাম। বললাম, “তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশ কোনো কথা না বলে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি বললাম, “হাজী মহব্বতজান আসলে তোর কেউ হয় না, তুই হেড স্যারের রুমে যা বলেছিস সেগুলো পুরোটা বানানো। ঠিক?”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশের মুখে খুবই সূক্ষ্ম একটা হাসি ফুটে উঠল। আমি বললাম, “পুরোটা একটা ভাওতাবাজী। ঠিক?”
রোল নাম্বার তেতাল্লিশের মুখের হাসিটা একটু বিস্তৃত হল। তারপর হ্যাঁ বলার ভঙ্গী করে সে মাথাটা ওপর থেকে নিচে নামাল। আমার দিকে তাকিয়ে একবার চোখ টিপল তারপর একটা আঙুল ঠোটের উপর রাখল।
আমি গলা নামিয়ে বললাম, “ভয় নাই। আমি কাউকে বলব না।”
বছর খানেক পরে রোল নাম্বার তেতাল্লিশ আমাদের স্কুল থেকে চলে গিয়েছিল, এর মাঝে সে আর একটা কথাও বলেনি।
বিজ্ঞান মেলায় যাবার জন্যে অনেক ছেলে মেয়ে ল্যাবরেটরিতে হাজির হল। শুধু ছেলে মেয়ে না, কয়েকজন স্যার ম্যাডামও চলে এলেন। আমরা একটু পরে বুঝতে পারলাম হাজী মহব্বতজান স্কুলের ইতিহাসে যেটা ঘটেনি সেটা ঘটেছে, প্রথমবার স্কুল ফান্ড থেকে পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হয়েছে। সেই টাকা দিয়ে খাওয়া দাওয়া করা ছেলেমেয়েদের প্রধান উদ্দেশ্য আর ভাগ বাটোয়ারা করা স্যারদের উদ্দেশ্য।
সবাইকে নিয়ে বসায় কিছুক্ষণের মাঝেই বোঝা গেল বিজ্ঞান মেলা কী জিনিষ, কেমন করে বিজ্ঞান মেলা করতে হয় সেটা নিয়ে মিঠুন ছাড়া আর কারো কোনো ধারণা নেই। বেশীর ভাগ ছেলেমেয়ের ধারণা ছিল এটা যেহেতু মেলা এখানে কিছু একটা বিক্রি করতে হবে। মিঠুন বোঝাল এখানে বিজ্ঞানের প্রজেক্ট না হয় বিজ্ঞানের এক্সপেরিমেন্ট নিয়ে যেতে হবে। সবাই সেটা দেখতে আসবে আর যেটা ভালো হবে সেটাকে পুরস্কার দেয়া হবে।
বিজ্ঞানের কী প্রজেক্ট নেওয়া যায় সেটা নিয়ে প্রথমে একটু আলোচনা করার চেষ্টা করা হল কিন্তু খুব লাভ হল না। যেমন একজন বলল, “আমি একবার ইলেকট্রিক শক খেয়েছিলাম। খুবই আজিব ব্যাপার এক শক খেয়েই আধমরা হয়ে গিয়েছিলাম, বিজ্ঞান মেলায় তাই আমরা সবাইকে ইলেকট্রিক শক দিতে পারি। খুবই সোজা, খালি পাগপয়েন্ট লাগবে আর একটা তার লাগবে।”
আরেকজন বলল, “একটা গরু নিয়ে যেতে পারি। গরুর গোবর দিয়ে সার তৈরী হয়। গোবরটা কোথা থেকে আসে সবাই দেখতে পারবে। খুবই বৈজ্ঞানিক দৃশ্য।”
আরেকজন বলল, “এক বস্তা তেলাপোকা নিয়ে যেতে পারি। যখন অনেক ভীড় হবে তখন তেলাপোকাগুলো ছেড়ে দিতে পারি, সেইগুলো যখন উড়বে তখন পাবলিক দৌড়াবে। খুবই বৈজ্ঞানিক।”
আরেকজন বলল, “ব্যাঙকে কয়েকটা আছাড় দিলে সেইটা কাহিল হয়ে যায়। তখন সেটা লাফ দিতে পারে না। মানুষের মতো হাঁটে। খুবই বৈজ্ঞানিক দৃশ্য।”
আরেকজন বলল, “লোহার রড় গরম করে ছ্যাকা দিতে পারি। তখন শিক কাবারে মতো গন্ধ বের হয়। সেটা দেখাতে পারি।”
এরকম সময় আমি মিঠুনকে ফিস ফিস করে বললাম, “খামোখা আলোচনা করে লাভ নাই। তুই কয়েকটা ঠিক করে দে, যার যার ইচ্ছা তারা সেটা নিয়ে যাবে।”
শেষ পর্যন্ত সেটাই করা হল। মিঠুনের মাথায় বিজ্ঞানের প্রজেক্ট কিলবিল কিলবিল করছে। আমরা সেখান থেকে বেছে বেশ কয়েকটা নিয়ে সেগুলো তৈরি করতে শুরু করলাম। মিঠুন যখন বলেছে তখন বিষয়টাকে খুবই সোজা মনে হয়েছে, তৈরী করার সময় দেখা গেল জিনিষগুলো আসলে তত সোজা না। তব যন্ত্রপাতির ব্যাপারে মিঠুনের হাত খুব ভালো। সে সত্যি সত্যি প্রজেক্টগুলো দাড়া করে ফেলল।
যেদিন বিজ্ঞান মেলা শুরু হবে আমরা সবাই প্রজেক্টগুলো নিয়ে হাজির হয়েছি। সকাল দশটা থেকে বিকাল পাঁচটা পর্যন্ত মেলা। সকালে উদ্বোধন অনুষ্ঠান। উদ্বোধন করবে ভিসি না যেন কে। আমাদেরকে বড় একটা হল ঘরে বসিয়ে রাখল, কিন্তু ডিসি সাহেবের দেখা নেই। আমরা গরমে প্রায় সেদ্ধ হয়ে গেলাম, পাকা দেড়ঘণ্টা পর ডিসি সাহেব আসলেন। তারপর শুরু হল বক্তৃতা। বিজ্ঞান যে কতো ভালো সবাই ইনিয়ে বিনিয়ে সেইগুলো বলতে শুরু করল-শুনে শুনে আস্তে আস্তে আমাদের মেজাজ গরম হতে থাকে, কিন্তু কিছু করার নাই তাই চুপ করে সহ্য করলাম। তারপর শুরু হল ডিসি সাহেবকে তেল দেওয়া বক্তৃতা, তিনি এতো ব্যস্ত মানুষ তারপরও সময় করে এসেছেন সে জন্যে পারলে একেকজন তার পায়ে চুমো খেতে শুরু করে।
সবার শেষে ডিসি সাহেব বক্তৃতা শুরু করলেন। ছোট থাকতে তিনি কতো ভালো ছাত্র ছিলেন, কোন পরীক্ষায় কতো মার্কস পেয়েছিলেন, তখন তার স্যারেরা কীভাবে তার সম্পর্কে কী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন এবং সেই ভবিষ্যদ্বাণী কীভাবে অক্ষরে অক্ষরে মিলে গিয়েছে, এবং তার জীবন থেকে আমাদের কতো কী শেখার আছে সেটা বলতে শুরু করলেন। বক্তৃতা যখন শেষ হল তখন আমরা সবাই নেতিয়ে পড়েছি, এমন খিদে পেয়েছে যে মনে হচ্ছে ডিসি সাহেবকে ধরে কাবাব বানিয়ে খেয়ে ফেলি।
ডিসি সাহেব আর তার সাঙ্গোপাঙ্গোরা তখন হলঘরে বিজ্ঞানের প্রজেক্টগুলো দেখতে গেলেন। অক্সব্রীজ স্কুলের কয়েকটা প্রজেক্ট দেখলেন, ক্যামেরা দিয়ে কয়েকটা ছবি তোলা হল। টেলিভিশন ক্যামেরার সামনে দাঁড়িয়ে কয়েকটা কথা বললেন, তারপর চলে গেলেন।
বিকেল বেলা স্কুলের ছেলেমেয়েরা তাদের বাবা মা আত্মীয় স্বজন আর শহরের পাবলিক বিজ্ঞান মেলা দেখতে এল। আমরা লক্ষ করলাম আমাদের প্রজেক্টগুলোতে মানুষের বেশী কৌতূহল নাই, মিঠুন অনেক চিন্তা ভাবনা করে একেবারে খাঁটি বিজ্ঞানের প্রজেক্ট তৈরি করেছে (আলো কেন তরঙ্গ, আকাশ কেন নীল, চৌম্বক ক্ষেত্রে চার্জ কেন বল অনুভব করে। কিন্তু সাধারণ পাবলিকরা সেগুলো দেখতে চায় না। মিঠুন আমাদের সবকিছু মুখস্ত করিয়ে এনেছে আমরা সেগুলো বলার চেষ্টা করি কিন্তু পাবলিক সেগুলো না শুনেই সুড়ুৎ করে সরে যায়।
পাবলিকের ভীড় অক্টব্রীজ স্কুলের প্রজেক্টগুলোর সামনে, তাদের প্রজেক্টগুলোতে বিজ্ঞান খুব কম মজা অনেক বেশী। যেমন একটা ছেলে রবোট সেজে এসেছে। কার্ডবোর্ড দিয়ে শরীর ঢাকা, মাথার ওপর বুকের মাঝে বাতি জ্বলছে। সে রবোটের মতন হাঁটে, মাথা নাড়ে কথা বলে সব পাবলিক সেই রবোটের পিছনে পিছনে ঘুরে। শুধু তাই না সেই রবোটটা হেঁটে হেঁটে আমাদের প্রজেক্টগুলোর পাশে দাঁড়াল। তারপর রবোটের মত গলায় বলল, “ম-হ-ব-ব-ট জান-ই-শ-কু-ল-কী-ফা-নি-হা-হা-হা।”
শুধু তাই না তারপর আমাদের প্রজেক্টগুলো দেখে ভান করল যে তার ব্রেনের সার্কিট উল্টাপাল্টা হয়ে গেছে। রবোটের সাথে সাথে অক্সব্রীজ স্কুলের কয়েকটা ছাত্রছাত্রী ছিল। মিঠুন তাদের বলল, “এটা বিজ্ঞান মেলা। তোমরা একটা ক্লাউনকে রবোট সাজিয়ে এনেছ কেন? এটা কী বিজ্ঞান হয়েছে?”
ছেলেমেয়েগুলো নিশ্চয়ই মিঠুনকে আগে থেকে চিনে, একজন ইংরেজীতে বলল, “মিঠুন তুমি ভুলে গেছ আমরা সব সময় এটা করি। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করার জন্যে একটা ফান প্রজেক্ট করি। এটা সেই ফান প্রজেক্ট।”
আরেকজন বলল, “তোমার সেন্স অফ হিউমার চলে গেছে।”
সুন্দর টিস টসে একটা মেয়ে বলল, “তুমি যে স্কুলে গেছ সেখানে সেন্স অফ হিউমার তো অনেক পরের ব্যাপার কোনো সেন্সই তো থাকার কথা না।”
আরেকজন বলল, “তোমার কী এখন যথেষ্ট মহব্বত হয়েছে?” তারপর সবাই হি হি করে হাসতে লাগল।।
মিঠুন মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল, ঝুম্পা বলল, “মিঠুন, দিব একটা রা? জন্মের মতো বাপের নাম ভুলিয়ে দিব?”
মিঠুন মাথা নাড়ল বলল, “না, না খবরদার।”
বিকেলবেলা আমরা যখন প্রজেক্টগুলো গুছিয়ে ফিরে যাচ্ছি তখন মিঠুনকে খুবই মনমরা দেখা গেল! আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কী হয়েছে?”
মিঠুন একটা ছোট নিশ্বাস ফেলে বলল, “নাহ কিছু না।”
আমি বললাম, “তুই খামোখা সায়েন্সের প্রজেক্টগুলো করেছিস। কেউ সায়েন্স প্রজেক্ট দেখতে চায় না–ঠাট্টা তামাশা দেখতে চায়। অক্সব্রীজ স্কুলের মত আমাদের রবোট ফবোট বানানো উচিত ছিল।”
ঝুম্পা বলল, “এখনো সময় চলে যায় নাই। কাল পরশু সময় আছে।”
বগা বলল, “এতো কম সময়ে নূতন কিছু করা যাবে?”
আমি বললাম, আসল প্রজেক্ট করা যাবে না। কিন্তু ইয়াকী মার্কা প্রজেক্ট করতে সমস্যা কী?”
মিঠুন চোখ কপালে তুলে বলল, “ইয়াকী মার্কা? ইয়াকী মার্কা সায়েন্স প্রজেক্ট হয় নাকি?”
আমি বললাম, হয় একশবার হয়।”
কাজেই পরের দিন আমরা আগের প্রজেক্টগুলো পাল্টে ফেললাম। সবগুলো ফাটাফাটি প্রজেক্ট—প্রথম দিকে গাইগুই করলেও শেষে মিঠুন আমাদের একটু সাহায্য করল বলে এগুলো শুধু ইয়ারকী মার্কা থাকল না। এর মাঝে বেশ ভালো মতন সায়েন্স পর্যন্ত ঢুকে গেল।
যেমন ধরা যাক অদৃশ্য কালির প্রজেক্ট। সিরিঞ্জের ভিতর টকটকে লাল রং কেউ এলেই তার গায়ে ছিটিয়ে দেয়া হয়। যার গায়ে ছিটিয়ে দেয়া হয় সে প্রথমে খুব রেগে ওঠে, রাগটা বাড়াবাড়ি হতেই হঠাৎ করে রংটা অদৃশ্য হয়ে যায়। এটা মিঠুন তৈরী করে দিয়েছে-সে বলেছে এটা নাকী ছেলেমানুষী প্রজেক্ট কিন্তু দেখা গেল মোটেও ছেলেমানুষী না, এটা পাবলিক খুব পছন্দ করছে।
এই প্রজেক্টটা আমরা একশগুণ মজাদার করে ফেললাম। দোকান থেকে সত্যিকারের লাল কালি এনে অন্য আরেকটা সিরিঞ্জে ভর্তি করে এনে রেখে দিয়েছি। যখন অক্সব্রীজ স্কুলের কোনো ছেলেমেয়ে আমাদের প্রজেক্ট দেখতে আসে আমরা অদৃশ্য কালির সিরিঞ্জটা সরিয়ে আসল লাল কালির সিরিঞ্জটা রেখে দিই। তারা নিজেদের ধবধবে সাদা শার্টে সেই রং লাগায় সেই রং আর উঠে না। পাকা রং ছয় মাসেও উঠবে না। সেটা নিয়ে আমাদের সাথে ঝগড়া করে তারা সুবিধা করতে পারে না কারণ ঝগড়াঝাটি মারপিটে আমাদের সাথে কেউ কোনোদিন পারবে না।
আমাদের দুই নম্বর প্রজেক্টটাও খুবই মজার। একটা বিশাল গামলার মাঝে গ্লিসারিন মেশানো সাবানগোলা পানি, তার মাঝে একটা বড় রিং। গামলাতে দাঁড়িয়ে রিংটা ওপরে তুলেই আস্ত মানুষটা একটা বিশাল সাবানের বুদবুদের ঢুকে যায়। মিঠুন আমাদের শিখিয়ে দিয়েছে কতোখানি সাবান গোলা পানিতে কতোখানি গ্লিসারিন মিশাতে হবে আমরা সেটা তৈরি করে যাচ্ছি আর ছেলে মেয়েরা নিজের শরীরের সমান সাবানের বুদবুদ তৈরি করে যাচ্ছে।
এটাও আরো বেশী মজার এক্সপেরিমেন্ট করে ফেলেছি। অক্সব্রীজ স্কুলের কোনো ছেলেমেয়ে এলেই আমরা সাবানগোলা পানি গামলার ঢালার ভান করে তাদের শরীরে ঢেলে দিই।
তবে সবচেয়ে ফাটাফাটি হয়েছে যে প্রজেক্ট তার নাম ট্রান্সক্রেনিয়াল স্টেমুলেটর। নামটা খুবই কঠিন আমরা কেউ সেটা উচ্চারণ করতে পারি না, তাই বড় কাগজে সেটা লিখে টানিয়ে রেখেছি। এই প্রজেক্টটা করতে আমাদের গুলুকে আনতে হয়েছে। সে প্রথমে আসতে রাজী হয়নি। শেষে দিনে একশ টাকা আর প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় খেতে দিব বলে তাকে শেষ পর্যন্ত আনা গেছে।
প্রজেক্টটার বর্ণনা দেবার জন্যে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি, একটা চেয়ারে গুলু বসে থাকে। তার মাথায় আমরা কয়েকটা তার লাগিয়ে রেখেছি। সেই তারগুলো এসেছে একটা বাক্সে। বাক্সটার ওপরে কয়েকটা সুইচ কয়েকটা নব আর কয়েকটা বাতি জ্বলতে নিভতে থাকে। সামনে যখন বেশ কয়জন দর্শক হাজির হয় তখন আমরা বক্তৃতার ভঙ্গীতে বলি, “এই যন্ত্রটা সরাসরি এই ছেলেটার মস্তিষ্কের সাথে যোগাযোগ করতে পারে। আমরা এই সুইচগুলো দিয়ে আর এই নবগুলো দিয়ে এই ছেলেটার মনের ভাব কন্ট্রোল করতে পারি।”
আমরা তখন সুইচটা অন অফ করে বলি, “এখন তার মস্তিষ্কে হাসির অনুভূতি দিয়েছি।”
গুললু তখন হা হা করে হাসে। তার সেই বিকট হাসি শুনে মানুষ থতমত খেয়ে যায়। তখন আমরা আবার সুইচ অন অফ করে বলি, “এখন আমরা এই ছেলেটার ভিতরে দুঃখের অনুভূতি দিচ্ছি।”
গুললু তখন বুক চাপড়ে হাউ মাউ করে কান্নার ভঙ্গী করে, সেটা দেখে তাকে ঘিরে থাকা পাবলিক আনন্দে হাততালি দেয়। তখন আমরা সবচেয়ে মজার অংশটা করি, আমরা বাক্সটায় সুইচগুলি আরো কয়েকবার অন অফ করে নবগুলো ঘুরাই তারপর বলি, “এখন সবাই সাবধান, কারণ এখন আমরা ছেলেটার ভিতরে রাগের অনুভূতি দিচ্ছি।”
তখন গুললু হঠাৎ চিৎকার করে উঠে, টান দিয়ে সার্ট ছিড়ে ফেলে, টেবিলে থাবা দেয়, লাফিয়ে কুঁদিয়ে জিনিষপত্র ভেঙ্গে একটা তুলকালাম কাণ্ড করে ফেলে। গুললুর সারা শরীর স্টীলের তৈরি, সে থাবা দিয়ে ইটের টুকরা গুড়া করে ফেলতে পারে। কাজেই তার রাগের অভিনয়টা এতো ভয়ংকর হয় যে সব মানুষজন হতবাক হয়ে যায়। হলের যত দর্শক তারা সবকিছু ছেড়ে গুললুর লাফঝাপ দেখতে চলে আসে।
লাফঝাপ দেওয়ার সময় যদি অক্সত্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়ে চলে আসে তাহলে তার কপালে অনেক দুঃখ থাকে। গুললু তাকে ধাওয়া করে, হুংকার দিয়ে তার পিলে চমকিয়ে দেয়।
আমাদের এই নূতন সায়েন্স প্রজেক্ট গুলো দেখার জন্যে সবাই আমাদের কাছে চলে আসতে শুরু করল। অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েরা শুকনো মুখে বসে থাকে। রবোট বেচারাকেও আজকে আর কেউ দেখতে চায় না। সে তার মাথাটা খুলে হাতে মনমরা হয়ে নিয়ে একটা চেয়ারে বসে থাকে, কেউ তার দিকে ঘুরেও তাকায় না।
বিজ্ঞান মেলা পুরোপুরি দখল করেই আমরা শান্ত হলাম না। অক্সব্রীজ স্কুলকেও একটা শিক্ষা দিয়ে দেয়া হল। ব্যাপারটা ঘটল এভাবে, ঝুম্পা প্রথমে গেল অক্সব্রীজ স্কুলের প্রজেক্ট দেখতে। ছেলেমেয়েগুলো যখনই কথা বলতে শুরু করেছে তখন কথার মাঝখানে হঠাৎ করে ঝুম্পা জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের স্কুলের নাম হচ্ছে অক্সব্রীজ। অক্স মানে ষাঁড়। তোমরা ষাঁড়ের নাম দিয়ে স্কুলের নাম রেখেছ কেন?”
ছেলেমেয়েগুলো থতমত খেয়ে কিছু একটা বলতে শুরু করতেই ঝুম্পা তাদের থামিয়ে বলে, “তার মানে তোমরা সঁড়ের স্কুল? তোমাদের ছাত্রছাত্রী ইচ্ছে ষাড় আর গরু?”
ছেলেমেয়েগুলো তখন খুব রেগে ইংরেজীতে গালাগাল দিতে শুরু করেতই ঝুম্পা গরুর মতো করে ডাকলো, “হাম্বা-হাম্বা!” তারপর চলে এল।
এরপর আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরাও একজন একজন করে অকুব্রীজ স্কুলের প্রজেক্ট দেখতে গেল আর তার কথা শুরু করতেই আমাদের স্কুলের ছেলেমেয়েরা গরুর মত করে ডাকতে শুরু করল, “হাম্বা-হাম্বা–
তখন যা একটা মজা হল সেটা বলার মত না। শুধু যে আমরা অব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদেরকে হাম্বা করে ডাকতে লাগলাম তা নয়, বিজ্ঞান মেলার অন্যান্য স্কুলের ছেলেমেয়েরাও তাদের দেখে গরুর মত হাস্থা হাম্বা করে ডাকতে লাগল। আমরা যেরকম অক্সব্রীজ স্কুলের ছেলেমেয়েদের দেখতে পারি না সেরকম মনে হয় অন্য স্কুলের ছেলেমেয়েরাও অক্সব্রীজ স্কুলকে দেখতে পারে না। আমরা তাদের সবাই মিলে এতই জ্বালাতন করলাম যে তখন তাদের একজন টিচার তাদের কয়েকজন ছাত্রছাত্রীদেকে নিয়ে আমাদের কাছে এল, আমরা দেখলাম এটা সেই সায়েন্স টিচার।
মিঠুনের সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, “মিঠুন তোমাদের টিচাররা কোথায়?
মিঠুন উত্তর দেবার আগেই ঝুম্পা উত্তর দিল, “আমাদের কোনো টিচার আসে নাই।”
সায়েন্স টিচার তখন মিঠুনকে বললেন, “যেহেতু তোমাদের স্কুলের কোনো টিচার নেই তাহলে আমি তোমাকেই বলি। তোমরা যেটা শুরু করেছ সেটা মোটেও গ্রহণযোগ্য কাজ না।”
কথাটা সত্যি। তাই আমরা চুপ করে রইলাম।
“স্যায়েন্স ফেয়ারে সায়েন্স প্রজেক্ট নিয়ে আসার কথা। তোমরা সেরকম প্রজেক্ট আননি। তোমরা কিছু তামাশা নিয়ে এসেছ। সারাদিন ধরে তামাশা করে বেড়াচ্ছ। আমি তোমাদের নামে কমপ্লেন করব যেন ভবিষ্যতে তোমাদের আসতে না দেয়।”
কথাগুলো সত্যি তাই আমরা চুপ করে থাকলাম। সায়েন্স টিচার বললেন, “মিঠুন, তুমি যতদিন আমাদের স্কুলে ছিলে আমরা তোমার সায়েন্স প্রজেক্ট দাড়া করাতে সাহায্য করেছি। অন্যান্য বছর অক্সব্রীজ স্কুলের পক্ষ থেকে তুমি চ্যাম্পিয়ান হয়ে পুরস্কার এনেছ। এখন দেখো তোমার অবস্থা। তুমি কি করছ? কিছু বেয়াদপ ছেলেমেয়ে নিয়ে হাম্বা হাম্বা করে বেড়াচ্ছ। ছিঃ মিঠুন ছিঃ। আমি খুবই দুঃখিত হলাম।”
কথাগুলো সত্যি কিন্তু চুপ করে থাকা কঠিন। তারপরেও চুপ করে রইলাম আর দেখতে পেলাম মিঠুনের মুখটা লজ্জায় কেমন যেন কালো হয়ে গেল।
সায়েন্স টিচার এখানেই থামলেন না, বলতে থাকলেন, “কালকে বড় বড় ইউনিভার্সিটির বড় বড় প্রফেসররা প্রজেক্টগুলো দেখতে আসবে। তারা কী তোমাদের তামাশা প্রজেক্টকে কোনো গুরুত্ব দেবে? না, দেবে না। তুমি কিংবা তোমার স্কুল কোনো পুরস্কার পাবে না। কোন স্কুল চ্যাম্পিয়ন হবে? আমাদের স্কুল। তার কারণ আমাদের স্কুলের প্রজেক্ট হচ্ছে সত্যিকারের প্রজেক্ট। আমরা তৈরি করেছি ভ্যান ভি গ্রাফ জেনারেটর। সোলার পাওয়ার্ড কার। সিনথেসিস অফ ডিজেল অয়েল। বুঝেছ মিঠুন, ভেবেছিলাম তুমি একদিন সত্যিকারের সায়েন্টিস্ট হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে আমার ধারণা ভুল। তুমি আসলে সায়েন্টিস্ট হবে না। তুমি কিছু বেয়াদপ ছেলেমেয়েদের সাথে থেকে বেয়াদপ একজন মানুষ হয়ে বড় হবে। তুমি আর তোমার বন্ধুরা এসে সায়েন্স ফেয়ারের মতো সুন্দর একটা পরিবেশকে নষ্ট করে দিবে।”
কথাগুলো সত্যি তাই আমরা চুপ করে রইলাম।
স্যায়েন্স টিচার বললেন, “তুমি যখন আমাদের স্কুলে ছিলে তখন তোমাকে নিয়ে আমরা গর্ব করতাম। আজকে তোমাকে নিয়ে আমি লজ্জা পেলাম।”
স্যায়েন্স টিচার চলে যাবার পর মিঠুন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। ঝুম্পা বলল, “কতো বড় সাহস। আমাদের স্যার ম্যাডামেরা আমাদের সাথে কথা বলতে সাহস পায় না। আর অন্য স্কুল থেকে একজন মাস্টার এসে আমাদের বকে যাবে? কতো বড় সাহস?”
বগা বলল, “গুললুকে বলি ওদের প্রজেক্ট গুড়ো করে দিয়ে আসুক।”
মিঠুন মাথা নাড়ল, বলল, “না না। খবরদার। তাছাড়া
“তাছাড়া কী?”
“স্যার তো ভুল বলেননি। সত্যি কথাই বলেছেন। ওদের প্রজেক্ট কতো ভালো। নিশ্চয়ই কয়েক মাস থেকে কাজ করেছে, স্যারেরা সাহায্য করেছে। প্রজেক্টের পিছনে হাজার হাজার টাকা খরচ করেছে। আসলেই তো আমরা কোনো পুরস্কার পাব না। আমাদের প্রজেক্টগুলো তো আসলেই তামাশা।”
বিকেল বেলা আমরা যখন ফিরে যাচ্ছি তখন আমি নিচু গলায় মিঠুনকে বললাম, “মিঠুন।
মিঠুন বলল “কী?”
“তুই আসলেই বিজ্ঞান মেলায় চ্যাম্পিয়ন হতে চাস?”
“হতে চাইলেই কী হওয়া যায়? তার জন্যে পরিশ্রম করতে হয়।”
আমি ফিস ফিস করে বললাম, “তোর ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা নিয়ে আয়, তুই চ্যাম্পিয়ান হয়ে যাবি।”
“ব্ল্যাকহোলের বাচ্চা?”
“হ্যাঁ।”
কাজেই পরের দিন সবাই প্রথমবার ব্ল্যাকহোলের বাচ্চাকে দেখতে পেল।