০৬. স্কুলে গিয়ে তিতুনি

স্কুলে গিয়ে তিতুনি ক্লাশে তার ব্যাগটা রেখে বের হয়ে এলো। সাধারণত সে সামনের দিকে বসে। কী ভেবে সে আজকে সবচেয়ে পিছনে তার স্কুলের ব্যাগ রাখল। স্কুলে এখনো সব মেয়েরা আসেনি-তিতুনি চোখের কোনা দিয়ে অন্য-তিতুনিকে খুঁজতে থাকে। তাদের দুইজনকে একসাথে কেউ দেখে ফেলবে আর তখন সেটা নিয়ে মহা কেলেঙ্কারি শুরু হয়ে যাবে, সেটা নিয়ে এখন আর তার ভেতরে কোনোরকম আতঙ্ক নাই।

তিতুনি স্কুলের বারান্দায় এসে ডানে-বাঁয়ে তাকাল তখন দেখল বারান্দার অন্য মাথা থেকে অন্য-তিতুনি হনহন করে হেঁটে আসছে। মুখটা খুবই গম্ভীর।

তিতুনি দাঁড়িয়ে রইল আর অন্য-তিতুনি কাছাকাছি এসে নিচু গলায় বলল, “সর্বনাশ হয়েছে।”

“কী সর্বনাশ?”

মেয়েটা ডানে-বামে তাকিয়ে বলল, “এখানে বলা যাবে না।”

“কোথায় বলবে?”

“লাইব্রেরিতে যাও। আমিও যাচ্ছি।”

তিতুনি মাথা নাড়ল, লাইব্রেরিটাই ভালো জায়গা। তাদের স্কুলে কীভাবে কীভাবে জানি একটা বেশ সুন্দর আর বড় লাইব্রেরি আছে, সেই লাইব্রেরিটা ফাঁকাই থাকে, পিছনে বসে নিরিবিলি কথা বলা যাবে। তিতুনি হেঁটে হেঁটে লাইব্রেরিতে গিয়ে পিছনের দিকে একটা বইয়ের আলমারির পিছনে বসে পড়ল। কী সর্বনাশ হয়েছে সেটা চিন্তা করে তার বুকটা ধুকপুক করছে।

কিছুক্ষণের মাঝেই অন্য-তিতুনি এসে তার সামনে বসে এদিক সেদিক তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, “মাহতাব চাচার স্মৃতি মুছে দিয়েছি মনে আছে?”

“হ্যাঁ। মাহতাব চাচার কিছু মনে নাই।” তিতুনি তখনো বুঝতে পারল না ঠিক কোন ব্যাপারটা সর্বনাশ।

“মাহতাব চাচা আব্বুকে একট জিনিস বলতে চেয়েছিলেন মনে আছে?”

“হ্যাঁ।” তিতুনি মাথা নাড়ল, “মাহতাব চাচা সেটা মনে করতে পারে নাই। সেটাও ভুলে গেছে।”

তিতুনির মতো দেখতে মেয়েটা মুখ গম্ভীর করে বলল, “আমি যখন স্মৃতি মুছে দিচ্ছিলাম তখন সেটা মুছে গেছে।”

তিতুনি মাথা নাড়ল, বলল, “আমারও তাই মনে হচ্ছিল।”

“কত বড় সর্বনাশ।”

তিতুনি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, “কোন জিনিসটা সর্বনাশ?”

“এই যে আমি অন্য একটা স্মৃতি মুছে দিলাম–”

“সর্বনাশের কী আছে? আমরা সব সময় এইটা-সেইটা ভুলে যাই। সবকিছু মনে রাখলে উপায় আছে?”

মেয়েটা কঠিন মুখ করে বলল, “তোমরা ভুলে যাও সেটা তোমাদের ব্যাপার, কিন্তু আমাদের একটা নিয়ম মানতে হয়।”

“নিয়ম?”

“হ্যাঁ। খুবই কঠিন একটা নিয়ম। আমরা যখন কোনো গ্রহে যাই সেই গ্রহটাতে যদি কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী থাকে তাহলে সেই গ্রহের কোনো কিছু আমরা পরিবর্তন করি না। কিন্তু আমি পরিবর্তন করে ফেলেছি। যেটুকু মোছা দরকার তার থেকে বেশি মুছে ফেলেছি। আমরা যে সেই গ্রহে গিয়েছি সেটা গ্রহের একটা প্রাণীও জানতে পারে

যে আমরা এসেছি।”

“আমি যে জানলাম?”

“সেটা সাময়িক।”

 “সাময়িক মানে?”

মেয়েটা বলল, “সাময়িক মানে হচ্ছে আমি যাবার সময় তোমার সব স্মৃতি মুছে দিয়ে যাব।”

তিতুনি চোখ কপালে তুলে বলল, “কী বললে?”

“কী বলেছি তুমি শুনেছ।”

তিতুনি হিংস্র চোখে বলল, “তুমি খালি চেষ্টা করে দেখো। আমি তোমাকে খুন করে ফেলব।”

তিতুনি খুন করে ফেলবে শুনেও মেয়েটা খুব ঘাবড়ে গেল মনে হলো না, বলল, “সেটা পরে দেখা যাবে। কিন্তু এখন কী করি বলো দেখি? আমি যে মাহতাব চাচার নিজস্ব কিছু স্মৃতি মুছে ফেলোম। এত বড় একটা নিয়ম ভেঙে ফেলোম–”

তিতুনি বলল, “তোমার নিয়মের খেতা পুড়ি। আমার উল্টো একটা আইডিয়া মাথায় এসেছে। ফাটাফাটি মারামারি কাটাকাটি আইডিয়া।”

“কী আইডিয়া?”অন্য-তিতুনি বলল, “আমি ইচ্ছে করলে তোমার মাথায় ঢুকে দেখতে পারি।”

তিতুনি চোখ পাকিয়ে বলল, “খবরদার, তুমি আমার মাথায় ঢুকবে। খবরদার।”

“তাহলে বলো।”

“আজকে ফার্স্ট পিরিয়ড ফাক্কু স্যারের ক্লাশ। ফাক্কু মানে হচ্ছে ফখরুল–”

“জানি।”

“ফাক্কু স্যার হোম ওয়ার্ক দিয়েছে। আজকে জমা দেওয়ার কথা।”

“জানি।”

“আমি হোম ওয়ার্ক করি নাই। করতে ভুলে গেছি, তুমি এসে সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে।”

“জানি।”

“হোম ওয়ার্ক না আনলে ফাক্কু স্যার মারে।”

“জানি।”

“খপ করে চুলটা ধরে ফেলে। এমনি করে ঝাঁকুনি দেয়।” তিতুনি হাত দিয়ে দেখাল।

“গত মাসে ফারিয়ার চুল ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বেঞ্চে মেরেছে, নাকটা বোঁচা হয়ে গেছে।”

“জানি।”

“ফারিয়ার নাকটা অবশ্যি আগে থেকেই একটু বোঁচা।”

“জানি।”

“তাই আমি বলছিলাম ফাক্কু স্যারের ক্লাশে গিয়ে তুমি তার মাথার মাঝে ঢুকবে। ঢুকে সে যে হোম ওয়ার্ক দিয়েছে সেটা ভুলিয়ে দেবে।”

অন্য-তিতুনি মুখটা শক্ত করে বলল, “অসম্ভব।”

“অসম্ভব?”

“হ্যাঁ। তোমাদের পৃথিবীর কোনো কিছু আমাদের পরিবর্তন করার কথা না।”

তিতুনি গরম হয়ে বলল, “এই রকম বড় বড় বোলচাল করা বন্ধ করো। আমাদের পৃথিবীতে এসেছ, পৃথিবীর নিয়ম মেনে চলো।”

“পৃথিবীর নিয়ম?”

“হ্যাঁ। পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে বদমানুষকে সাইজ করা। ফাক্কু স্যার হচ্ছে বদ নাম্বার ওয়ান। কাজেই তাকে সাইজ করা দরকার।”

অন্য-তিতুনি মুখটা আরো শক্ত করে বলল, “অসম্ভব।”

“তুমি করবে না? শুধুমাত্র ছোট একটা জিনিস তাকে ভুলিয়ে। দেবে না?”

তিতুনির এমন রাগ উঠল সেটা আর বলার মতো না। কিন্তু রাগ করে তো আর লাভ নেই, তাই কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “ঠিক আছে, তুমি তাহলে ফাক্কু স্যারের ক্লাশে যাও। আমি যাচ্ছি না।”

“তুমি কী করবে?”

“আমি এইখানে বসে থাকব।”

অন্য-তিতুনি রাজি হয়ে গেল, বলল, “ঠিক আছে।”

“যখন দেখবে তুমি হোম ওয়ার্ক আনো নাই তখন তোমার চুলগুলি খপ করে ধরে যখন ডেস্কের মাঝে তোমার নাকটা তেলে দিবে তখন আমার কাছে নালিশ করতে এসো না।”

অন্য-তিতুনি কোনো কথা বলল না, তিতুনি বলল, “আমি ক্লাশে সবার পিছনে বসেছি। আমার ব্যাগটা খুঁজে বের করতে পারবে তো?”

অন্য-তিতুনি মাথা নাড়ল। জানাল, সে পারবে।

.

ফাক্কু স্যারের ক্লাশটা ঠিক যেভাবে শুরু হওয়ার কথা সেইভাবে শুরু হলো। ঘণ্টা বাজার সাথে সাথে ফাক্কু স্যার ক্লাশে ঢুকলেন। হাতে চক, ডাস্টারের সাথে সাথে রেজিস্টার খাতা, বই, কলম আর একটা রুলার। যে কেউ মনে করতে পারে ক্লাশে পড়ানোর জন্যে একজন স্যার এগুলো তো আনতেই পারে, আসলে ব্যাপারটা মোটেই সে রকম না। এর সবগুলি হচ্ছে ক্লাশের মেয়েদের শাস্তি দেওয়ার অস্ত্র। আগে বেত নিয়ে ক্লাশে আসতেন, গভর্নমেন্ট বেত মারা বেআইনি করে দেবার পর প্রথম প্রথম ফাক্কু স্যারের খুব মন খারাপ ছিল, তারপর আস্তে আস্তে শাস্তি দেওয়ার এই অস্ত্রগুলো আবিষ্কার করেছেন। যেমন চক কিংবা কলম দুই আঙুলের মাঝখানে রেখে আঙুল দুটো চেপে ধরা ফাক্কু স্যারের খুবই প্রিয় শাস্তি। বই আর রেজিস্টার খাতা দিয়ে দড়াম করে মাথার মাঝে মারা তার আরেকটা প্রিয় শাস্তি। দূর থেকে কাউকে শাস্তি দিতে চাইলে ডাস্টারটা ক্রিকেট বলের মতো ছুঁড়ে মারেন। পুরানো দিনের মতো বেত মারার ইচ্ছা করলে স্টিলের রুলারটা দিয়ে হাতের মাঝে মারেন। ফাক্কু স্যারের সবচেয়ে প্রিয় শাস্তি হচ্ছে খপ করে চুলগুলো ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ডেস্কের সাথে মাথাটা ঠুকে দেওয়া। স্যারকে প্রমোশন দিয়ে ছেলেদের স্কুলে পাঠানোর চেষ্টা করা হয়েছিল, স্যার রাজি হননি। তার আসল কারণ হচ্ছে ছেলেদের মাথার চুল ছোট করে ছাঁটা থাকে বলে খপ করে ধরা যায় না। মেয়েদের চুল এভাবে ধরা সোজা।

ক্লাশে ঢুকেই স্যার সবাইকে একনজর দেখে মুখে একটু লোল টানলেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “তোরা সবাই হোম ওয়ার্ক এনেছিস?”

ক্লাশের প্রায় সবাই মাথা নাড়ল, কেউ মুখে কোনো কথা বলল না। যারা হোম ওয়ার্ক আনেনি শুধু তাদের চেহারা কেমন যেন রক্তশূন্য হয়ে গেল। ফাক্কু স্যার কেমন যেন ক্ষুধার্ত বাঘের মতো সবার দিকে তাকিয়ে বললেন, “কারা কারা হোম ওয়ার্ক আনিসনি?”

পাঁচজন খুব ধীরে ধীরে হাত তুলল। তাদের চেহারা দেখে মনে হলো তাদের শরীরে এক ফোঁটা রক্ত নেই। ফাক্কু স্যার মুখে একটা হিংস্র হাসি ফুটিয়ে কাছাকাছি মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলেন, নাগালের মাঝে চলে আসতেই খপ করে মেয়েটার চুল ধরে ফেললেন, মেয়েটা একটা আর্তচিৎকার করল। ফাক্কু স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “তুই কেন হোম ওয়ার্ক আনিসনি?”

“শরীর খারাপ ছিল স্যার। জ্বর আর মাথাব্যথা।”

ফাক্কু স্যার চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “মাথাটা টান দিয়ে ছিঁড়ে ফেলি? তাহলে তো আর মাথাব্যথা থাকবে না!”

মনে হলো মেয়েটা সত্যি সত্যি ভাবল ফাক্কু স্যার তার মাথাটা টেনে ছিঁড়ে ফেলবেন। সে ভয় পাওয়া গলায় বলল, “না স্যার। না স্যার! প্লিজ স্যার। প্লিজ স্যার।”

ফাক্কু স্যার বড় একটা ঝাঁকুনি দিয়ে পরের মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেলেন। মুখে লোল টেনে বললেন, “তুই কেন হোম ওয়ার্ক করিসনি?”

“করেছি স্যার, খাতাটা আনতে ভুলে গেছি।”

ফাক্কু স্যার খপ করে মেয়েটার চুল ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, “শুধু যে হোম ওয়ার্ক আনিসনি তা না, আবার আমার সাথে মিথ্যা কথা?”

মেয়েটা প্রায় হাহাকারের মতো শব্দ করে বলল, “না স্যার, সত্যি স্যার। সত্যি হোম ওয়ার্ক করেছি স্যার।”

ফাক্কু স্যার গর্জন করে বললেন, “আবার মিথ্যা কথা?” তারপর চুলের মুঠি ধরে মেয়েটার মাথাটা প্রচণ্ড জোরে ডেস্কে মেরে বসলেন। খটাস করে এত জোরে শব্দ হলো যে মনে হলো মেয়েটার মাথাটা বুঝি দুই টুকরো হয়ে ভেতরের মগজ বের হয়ে এসেছে।

ক্লাশের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে বসে রইল আর ফাক্কু স্যার তখন তিন নম্বর মেয়েটার কাছে এগিয়ে গেলেন। এতক্ষণে এই মেয়েটি বুঝে গেছে যে শুধু শুধু কোনো একটা অজুহাত দেখিয়ে লাভ নেই, তাতে শাস্তিটা বরং আরো বেশি হতে পারে, তাই সে একেবারে সরাসরি স্যারেন্ডার করে বলল, “ভুল হয়ে গেছে স্যার। আর কখনো ভুল হবে না।”

ফাক্কু স্যার তার চুলের ঝুঁটি ধরে তাকে টেনে মেঝে থেকে কয়েক ইঞ্চি উপরে তুলে নিয়ে বললেন, “ভুল? আর যদি ভুল হয় তাহলে তোর মাথার সব চুল ছিঁড়ে ফেলব।”

মেয়েটা কোনোমতে বলল, “আর ভুল হবে না স্যার।”

চতুর্থ মেয়েটির কাছে যাবার আগেই মেয়েটি ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে শুরু করেছে। ফাক্কু স্যার তাকে কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই সে বলল, “মাফ করে দেন স্যার। মাফ করে দেন।”

“কী জন্যে মাফ করব? চুরি করেছিস নাকি কারো পকেট মেরেছিস?”

“না স্যার।” মেয়েটা ফ্যাসফ্যাস করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “হোম ওয়ার্ক আনি নাই স্যার।”

ফাক্কু স্যার খুবই অবাক হয়েছেন সে রকম ভান করে বললেন, “কী আশ্চর্য। হোম ওয়ার্ক আনিস নাই বলে এত কান্না!” তারপর খপ করে মেয়েটার চুল ধরে হঠাৎ করে মুখ খিঁচিয়ে বললেন, “কান্না বন্ধ করবি কি না বল। না হলে চোখ দুটো খাবলে বের করে নিব।”

ভয়ে মেয়েটার কান্না বন্ধ হয়ে গেল, শুধু হেঁচকি উঠতে লাগল। ফাক্কু স্যার চুল ধরে মাথাটা ডানে-বাঁয়ে সামনে-পিছনে এক পাক ঘুরিয়ে একটা ধাক্কা দিয়ে ছেড়ে দিলেন, আর সে একেবারে পিছনে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। সেটা দেখে ফাক্কু স্যার খুবই তৃপ্তির একটা শব্দ করে বললেন, “আর কে যেন হোম ওয়ার্ক আনে নাই।”

একেবারে পিছনে বসে থাকা তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটি হাত তুলে বলল, “আমি স্যার।”

গলার স্বরে ভয়-ভীতি-আতঙ্ক কিছু নেই। ফাক্কু স্যর খুব অবাক হয়ে অন্য-তিতুনির দিকে তাকালেন, বললেন, “তুই হোম ওয়ার্ক আনিসনি?”

“না স্যার।” এবারেও গলার স্বর বেশ স্বাভাবিক, প্রায় হাসি-খুশি বলা যায়।

ফাক্কু স্যারের মুখটা দেখতে দেখতে কেমন যেন হিংস্র হায়েনা কিংবা বেজির মতো হয়ে গেল। দাঁতে দাঁত কষে বললেন, “কেন আনিসনি?”

অন্য-তিতুনি খুবই স্বাভাবিক গলায় বলল, “কেন আনিনি সেটার ইতিহাস খুবই জটিল। আপনাকে সেটা বললে আপনি বুঝবেন বলে মনে হয় না।”

মেয়েটার কথা শুনে ফাক্কু স্যার যত অবাক হলেন ক্লাশের মেয়েরা তার থেকে অনেক বেশি অবাক হয়ে তিতুনির দিকে তাকাল। বলে কী মেয়েটা! তার কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে? ফাক্কু স্যার নাক দিয়ে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে ক্লাশের পিছনের দিকে এগুতে লাগলেন, মুখে বললেন, “তুই কী বললি? আমি বুঝব বলে মনে হয় না?”

অন্য-তিতুনি বলল, “না স্যার।”

“একবার বলেই দেখ আমি বুঝি কি না।”

“কোনো লাভ নাই স্যার। আমার মনে হয়–”

“কী মনে হয়?”

“অন্যদের যে রকম শাস্তি দিয়েছেন, আমাকেও দিয়ে ঝামেলা চুকিয়ে ফেলেন।”

ফাক্কু স্যার কেমন যে হাঁ হয়ে গেলেন। একবার খাবি খেয়ে বললেন, “ঝামেলা চুকিয়ে ফেলব?”

মেয়েটা মাথা নাড়ল, “জি স্যার।”

শিকার ধরার আগে বাঘ যে রকম এক পা এক পা করে গিয়ে যায় ফাক্কু স্যার ঠিক সে রকম এক পা এক পা করে তিতুনির মতো মেয়েটার দিকে এগিয়ে গিয়ে খপ করে তার চুলগুলো ধরলেন। তারপরে একটা ঝাঁকুনি দিতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন তার ঘাড়টা লোহার মতো শক্ত, ঝাঁকুনি দিয়ে এক বিন্দু নাড়াতে পারলেন না। ফাক্কু স্যার চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে আবার খাবলা দিয়ে আরো ভালো করে চুলগুলো শক্ত করে ধরে আরো জোরে একটা ঝাঁকুনি দেয়ার চেষ্টা করলেন কিন্তু মেয়েটার মাথাটা এক বিন্দু নাড়াতে পারলেন না, মনে হলো ঘাড়টা বুঝি কংক্রিট দিয়ে তৈরি।

ফাক্কু স্যার আরো কয়েকবার ঝাঁকুনি দেওয়ার চেষ্টা করে চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে ক্ষিপ্ত চোখে মেয়েটার দিকে তাকালেন। মেয়েটা হাসি হাসি মুখে বলল, “আমার শাস্তি শেষ স্যার?”

ফাক্কু স্যার বললেন, “তুই তুই তুই–”

ফাক্কু স্যারের কথা শেষ হবার জন্যে মেয়েটা অপেক্ষা করতে লাগল কিন্তু ফাক্ব স্যার কথা শেষ করতে পারলেন না। মেয়েটা জিজ্ঞেস করল, “আর কিছু বলবেন স্যার?”

ফাক্কু স্যার হুংকার দিয়ে বললেন, “তোকে আজকে খুন করে ফেলব। পিটিয়ে তক্তা করে দেব। বেয়াদব মেয়ে, আমার সাথে টিটকারি?”

তারপর ফাক্কু স্যার পিটিয়ে তক্তা করার জন্যে ক্লাশের সামনে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে স্টিলের রুলারটা হাত নিলেন, তারপর সেটা ঘুরাতে ঘুরাতে স্টিম ইঞ্জিনের মতো ক্লাশের পিছনে অন্য তিতুনির দিকে এগুতে লাগলেন।

ক্লাশের সব মেয়েরা নিঃশ্বাস বন্ধ করে এই ভয়ংকর দৃশ্যটি দেখতে লাগল। ফাক্কু স্যার রুলারটা তরবারির মতো ঘুরাতে ঘুরাতে এগিয়ে আসতে আসতে হঠাৎ করে মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেলেন, তাকে দেখে মনে হলো কী করছেন, কোথায় যাচ্ছেন হঠাৎ করে ভুলে গেছেন। খানিকক্ষণ চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলেন, দেখে মনে হতে লাগল

যন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঘুমিয়ে গেছেন। তারপর হঠাৎ করে যেন জেগে উঠলেন, জেগে উঠে হাতে ধরে রাখা স্টিলের রুলারটা অনিশ্চিতের মতো ঘুরাতে লাগলেন এবং এদিক-সেদিক তাকাতে লাগলেন। দেখে বোঝা যাচ্ছে ফাক্কু স্যার কী করছেন নিজেই ভালো করে জানেন না।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে স্টিলের রুলারটা ঘুরাতেই থাকলেন, ঘুরাতেই থাকলেন। ঘুরাতে ঘুরাতে একসময় হঠাৎ করে তার সবকিছু মনে পড়ল, তখন আবার তিতুনির মতো দেখতে এলিয়েন মেয়েটির দিকে তাকালেন আর তার চোখ দুটি ধক করে জ্বলে উঠল। হিংস্র গলায় বললেন, “তোকে আমি খুন করে ফেলব।” তারপর নাক দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, “তক অম খন কর ফলব।” বলেই কেমন যেন ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলেন। কী বললেন স্যার?

ফাক্কু স্যার আবার বলার চেষ্টা করলেন, সবাই শুনল স্যার বললেন, “তক অম খন কর ফলব।” নিশ্চিতভাবেই বলার চেষ্টা করছেন তোকে আমি খুন করে ফেলব, কিন্তু বলছেন অন্যভাবে।

তিতুনির মতো মেয়েটাকে খুন করে ফেলার কাজটা আপাতত বন্ধ করে ফাক্কু স্যার ঠিক করে কথা বলার চেষ্টা করলেন, বিড়বিড় করে বললেন, “ক হল অমর? অম ঠক কর কথ বলত পরছ ন কন?”

ক্লাশের মেয়েদের ভেতর অবাক হওয়ার বিষয়টা শেষ হয়ে হঠাৎ করে একধরনের মজা পাওয়ার বিষয়টা শুরু হলো। কে যেন খুকখুক করে হেসে উঠল। হাসি ব্যাপারটা সংক্রামক এবং হঠাৎ করেই অনেকে খুকখুক করে হাসতে শুরু করল। ফাক্কু স্যার ক্লাসের দিকে তাকালেন এবং হুংকার দিয়ে বললেন, “খবরদর! চপ কর সবই।”

যদিও কথার উচ্চারণ বিচিত্র কিন্তু সবাই বুঝল, ফাক্কু স্যার সবাইকে চুপ করতে বলছেন, তাই আপাতত তারা হাসি থামিয়ে আর কী মজা হয় সেটা দেখার জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। স্যার একবার সেঁক গিললেন, তারপর বিড়বিড় করে বললেন, “হল! হল! হল মক্ৰফন টস্টং। ওন ট থ্র ফর ফভ–”

মাইক টেস্ট করার সময় যেভাবে বলে, “হ্যালো! হ্যালো! হ্যালো মাইক্রোফোন টেস্টিং। ওয়ান টু থ্রি ফোর ফাইভ” ঠিক সেভাবেই ফাক্কু স্যার তার কথা বলার সিস্টেম টেস্ট করে দেখছেন। কাজ হচ্ছে না।

ফাক্কু স্যার ক্লাশের দিকে তাকালেন, ফ্যাকাসে মুখে বললেন, “ক হল অমর?”

অন্য-তিতুনি হাসি হাসি মুখে বলল, “স্যার, আপনি আকার উকার-একার ব্যবহার না করে কথা বলার চেষ্টা করছেন।”

স্যার ফ্যাকাসে মুখে মাথা নাড়লেন। ক্লাশের ফার্স্ট গার্ল যে সবকিছু জানে সে বলল, “স্যার আপনার মনে হয় ব্রেন স্ট্রোক করেছে।”

ফাক্কু স্যার চোখ কপালে তুলে বললেন, “ব্রন স্টর্ক?”

“জি স্যার। ব্রেন স্ট্রোক হয়ে ব্রেনের যে জায়গায় আকার-উকার একার আছে সেটা ড্যামেজ হয়ে গেছে। তাই আকার-উকার-একার বলতে পারছেন না।”

ফাক্কু স্যারের মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল, স্যার বললেন, “তই কমন কর জনস?” কারো বুঝতে সমস্যা হলো না স্যার বলার চেষ্টা করছেন, “তুই কেমন করে জানিস?”

মেয়েটা উত্তর দেওয়ার আগেই অন্যেরা বলল, “ওর আব্বু ডাক্তার।”

ডাক্তারের মেয়ে নিশ্চয়ই অর্ধেক ডাক্তার হবে, তাই ফাক্কু স্যার তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওখন ক হব?” অর্থাৎ “এখন কী হবে?”

ডাক্তারের মেয়ে মাথা চুলকাতে থাকে, এখন কী হবে সে জানে। তখন অন্য-তিতুনি বলল, “স্যার, মনে হয় আপনাকে আবার নূতন করে শিখতে হবে।”

ফাক্কু স্যার মুখ কালো করে বললেন, “নতন কর শখত হব?”

“জি স্যার, প্রথমে আকার বলা প্র্যাকটিস করেন, তারপর ইকার, তারপর উকার এভাবে। আস্তে আস্তে শিখতে হবে।”

ফাক্কু স্যার একটু আগে স্টিলের রুলার দিয়ে পিটিয়ে অন্য তিতুনিকে খুন করে ফেলতে চেয়েছিলেন। ঠিক করে কথা বলতে না পারায় এই ভয়াবহ বিপদে পড়ে এখন সেসব ভুলে গেছেন। যে যেই পরামর্শ দিবে সেটাই মেনে নিতে রাজি। অন্য-তিতুনির পরামর্শ খুব আগ্রহ নিয়ে শুনলেন।

অন্য-তিতুনি বলল, “জি স্যার, একটা কবিতা আবৃত্তি করার চেষ্টা করেন। সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি’ কবিতাটা আপনি জানেন স্যার?”

ফাক্কু স্যার মাথা নেড়ে জানালেন যে কবিতাটা জানেন। তিতুনি বলল, “তাহলে আপনি এখন প্রথমে এটাকে বলবেন এভাবে

সকল উঠয় অম মন মন বল
সরদন যন অম ভল হয় চল।

তারপর এর সাথে আকার লাগিয়ে বলার চেষ্টা করবেন। তখন এটা হবে

সাকালা আঠায়া আমা মানা মানা বালা
সারাদান যানা আমা ভালা হায়া চালা।

যখন আকার প্র্যাকটিস হয়ে যাবে তখন ইকার লাগাবেন। তখন বলবেন

সিকিলি ইঠিয়ি ইমি মিনি মিনি বিলি
সিরিদিন যিনি ইমি ভিলি হিয়ি চিলি।

যখন এইটা প্র্যাকটিস হবে তখন–”

ফাক্কু স্যার হাত তুলে অন্য-তিতুনিকে থামালেন, বললেন, “বঝছ। অম বঝছ।” অর্থাৎ “বুঝেছি। আমি বুঝেছি।”

একটু পরে দেখা গেল ফাক্কু স্যার চেয়ারে গুটিশুটি হয়ে বিড়বিড় করে কবিতা বলার চেষ্টা করছেন।

ক্লাশ শেষ হওয়ার আগে ক্লাশের বেশিরভাগ মেয়েই আকার-ইকার ছাড়া কথা বলতে এবং সেই কথা বুঝতে শিখে গেল।

স্কুল ছুটির পর আসল তিতুনি যখন বাসায় ফিরে যাচ্ছে তখন তাদের ক্লাশের একজন মেয়ে ঝিনু ছুটে এসে তাকে ধরে বলল, “ততন, ও ততন!”

তিতুনি অবাক হয়ে বলল, “কী বলছিস তুই?”

মেয়েটি হি হি করে হাসতে হাসতে বলল, “অম বলছ অজক ক মজ হল, তই ন?”

তিতুনি সাথে সাথে বুঝে গেল অন্য-তিতুনি ক্লাশে নিশ্চয়ই কোনো একটা অঘটন ঘটিয়েছে। কী অঘটন ঘটিয়েছে এখন জানার উপায় নেই কিন্তু যেটাই ঘটে থাকুক সেটা নিশ্চয়ই খুবই মজার। তা না হলে সবাই এই বিচিত্র ভাষায় কথা বলছে কেন?

মেয়েটা বলল, “ক হল? তই কথ বলস ন কন?”

তিতুনি বলল, “বলছ। অম কথ বলছ।”

তারপর দুইজনে মিলে হি হি করে হাসতে লাগল। শুধু তিতুনি তখনো জানে না সে কেন হাসছে।