০৬. সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে

সে রাত্রে ছাড়া পেতে পেতে প্রায় রাত সোয়া এগারোটা বেজে গিয়েছিল সকলের। শ্রান্ত-অবসন্ন হয়ে ফিরেছিল যে যার গৃহে। ফিরতে ওরা সকলে পারত না হয়, যদি থানার একজন সেপাই কলকাতার দিকে ফিরতি একটা খালি ট্যাক্সি থামিয়ে ওদের ফিরে যাবার ব্যবস্থা করে না দিত।

থানা-অফিসার সুশীল নন্দী একটা কথা বিশেষ করে ওদের বলে দিয়েছিলেন, কলকাতা থেকে কেউ যেন অন্যত্র কোথাও না যায়—তাকে না জানিয়ে।

মিত্রানীর প্রৌঢ় বাপ অবিনাশ ঘোষালকে তার কন্যার মৃত্যু-সংবাদটা ওরা কেউই দিতে সম্মত হয়নি–তাই অগত্যা সুশীল নন্দী স্থির করেছিলেন পরের দিন সকালে তিনিই অবিনাশ ঘোষালকে সংবাদটা দেবেন। কিন্তু তা আর তাকে দিতে হয়নি—তার আগেই অর্থাৎ সেই রাত্রেই–

রাত একটা নাগাদ বিদ্যুতের কাছ থেকেই সংবাদটা পেয়েছিল মিত্রানীর দাদা ডাঃ প্রণবেশ ঘোষাল।

কি একটা সরকারী কাজে প্রণবেশ কলকাতায় একদিনের জন্য এসেছিল।

রাত্রি নয়টা নাগাদও যখন মিত্রানী ফিরে এলো না—অবিনাশ ঘোষাল ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন, ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন, প্রণব, খুকী তো এখনো ফিরল না-বলেছিল সন্ধ্যার মধ্যেই ফিরে আসবে—

প্রণবেশ বলেছিল, বন্ধুবান্ধবরা মিলে বটানিকসে হৈ চৈ করতে গিয়েছে—একা তো নয়-ভাবছেন কেন?

রাত নটা বাজে, তুমি বরং এক কাজ করো—বিদ্যুতের বাড়িতে একটা ফোন কর—

প্রণবেশ ফোন করে জানলো, তখনও বিদ্যুৎ ফেরেনি—

তারপর রাত সাড়ে নয়টা, পৌনে দশটা—পৌনে এগারোটা-পনেরো মিনিট অন্তরঅন্তর ফোন করে গিয়েছে প্রণবেশ।

কিন্তু ঐ একই জবাব—বিদ্যুৎ এখনো ফেরেনি—-

শেষটায় কিন্তু প্রণবেশ নিজেও বেশ চিন্তিত হয়ে উঠেছিল। এত রাত হয়ে গেল, এখনো না ফেরার কারণটা কি? পথে কোন দুর্ঘটনা কিছু ঘটেনি তো? ঘটাটা এমন কিছু আশ্চর্যও নয়। সে একবার ঘর একবার বাইরে করতে থাকে।

সাড়ে এগারোটা—বারোটা-সাড়ে বারোটা না তখনো ফেরেনি বিদ্যুৎ। অবশেষে প্রণবেশই লালবাজারে ফোন করে তারা কোন সংবাদ জানে না–তারা বলে শিবপুর থানায় ফোন করতে।

রাত তখন একটা প্রায়।

হঠাৎ ঐসময় ফোন ক্রিং ক্রিং করে বেজে উঠলো।

হ্যালো-ডাঃ প্রণবেশ ঘোষাল—

প্রণবেশবাবু—আপনি তো মিত্রানীর দাদা?

হ্যাঁ—

শুনুন—একটা স্যাড নিউজ আছে।

স্যাড নিউজ–কি?

মিত্রানী ইজ ডেড।

কি-কি বললেন—চিৎকার করে ওঠে প্রণবেশ—প্রৌঢ় অবিনাশ ঘোষাল ঐ সময় পুত্রের পাশেই দাঁড়িয়ে।

হ্যাঁ-মিত্রানীকে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছে—

না, না—এ আপনি কি বলছেন—মিতু-মিতু। কিন্তু কে-কে আপনি! কি আপনার নাম?

বিদ্যুৎ সরকার—

তারপরই অপর প্রান্তে একটা ঠং করে শব্দ ও ফোনটা ডিসকানেকটেড হয়ে গেল।

হ্যালো হ্যালো—অধীরভাবে ট্যাপ করে প্রণবেশ–কিন্তু না, অন্য প্রান্ত ফোন ছেড়ে দিয়েছে ততক্ষণে।

কি! কি হয়েছে প্রণব! অবিনাশ ঘোষাল আশঙ্কায় যেন একেবারে ভেঙে পড়ল।

বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ সরকার কে বাবা? প্রণবেশ বলে উঠল।

মিতুর ক্লাস-ফ্রেণ্ড—

প্রণবেশ তখুনি আবার ফোন করল। কিছুক্ষণ রিং হবার পর অপর প্রান্ত থেকে সাড়া এলো—কে!

বিদ্যুৎ সরকার আছেন?

কথা বলছি—

আমি মিত্রানীর দাদা কথা বলছি একটু আগে আপনি ফোন করেছিলেন—

ফোন করেছিলাম, আমি!—বিস্ময় বিদ্যুতের কণ্ঠে।

হ্যাঁ—একটু আগে আপনিই তো আমাদের বাড়িতে ফোন করে বললেন—

আমি তো এইমাত্র—নট ইভন টু মিনিটস-ফিরছি—

আপনি আমাকে ফোন করেননি?

না—

মিত্রানী-মিত্রানীর মানে আমার বোন মিত্রানীর কোন খবর কিছু জানেন? আপনারা তো একসঙ্গে আজ সকালে বটানিকসে গিয়েছিলেন?

কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে কোন সাড়া এলো না।

বিদ্যুৎবাবু—শুনছে–বিন্দুবাবু-হ্যালো—হ্যালো–

কোনো সাড়া নেই—অথচ প্রণবেশ বুঝতে পারছে অপর প্রান্ত তখনো ফোন ছেড়ে দেয়নি!

কি হলো প্রণবেশ? অবিনাশ ঘোষাল আবার প্রশ্ন করেন অধৈর্য কণ্ঠে।

প্রণবেশ ফোনটা নামিয়ে আবার ডায়েল করে—রিং হয়ে যাচ্ছে–কেউ ধরছে না।

প্রণবেশ শেষ পর্যন্ত ফোনটা নামিয়ে রাখল।

একটু আগে কে ফোন করেছিল প্রণব?

বিদ্যুৎ সরকার—অথচ বিদ্যুৎ সরকার এইমাত্র বললে সে ফোন করেনি—এই নাকি ফিরছে–

মিতুর খবর

সে কিছু বলল না—অথচ–আমি আসছি বাবা—প্রণবেশ কোনমতে শার্টটা গায়ে চাপিয়ে যেন ঝড়ের মত বের হয়ে গেল।

স্থাণুর মত দাঁড়িয়ে রইলেন অবিনাশ ঘোষাল।

কালীঘাট থেকে শ্যামবাজার অনেকটা পথ-প্রণবেশ রাস্তায় বের হয়ে দেখলো— জনহীন রাস্তা খাঁ খাঁ করছে–কোনরকম যানবাহনের চিহ্নমাত্রও নেই–যতদূর দৃষ্টি চলে। রাস্তার এ-প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত পর্যন্ত। এত রাত্রে যে ট্যাক্সি পাওয়া যাবে না তা জানত প্রণবেশ। একটু এগিয়ে গেলেই হালদার-পাড়ায় একটা ট্যাক্সির আড্ডা আছে—অনেক বছর পাঞ্জাবীদের ঐ পাড়ায় বসবাস করার জন্য প্রণবেশের সেটা জানা ছিল, আর বুড়ো ট্যাক্সি ড্রাইভার কর্তার সিংকে চিনতে প্রণবেশ-প্রণবেশ হাঁটতে লাগলো।

প্রণবেশের ভাগ্য ভাল, কর্তার সিং দূরপাল্লার এক সওয়ারীকে মাত্র কিছুক্ষণ পূর্বে পৌঁছে দিয়ে আস্তানায় ফিরে খাটিয়া পেতে শয়নের উদ্যোগ করছিল।

প্রণবেশ এসে সামনে দাঁড়াল। সর্দারজী!

প্রণববাবু–ইতনি রাত মে কেয়া বাৎ হ্যায়—

বড় বিপদে পড়েছি সর্দারজী, একবার এখুনি শ্যামবাজার যেতে হবে—অথচ কোন ট্যাক্সি এত রাত্রে পাচ্ছি না–

ঠিক হ্যায়, চলিয়ে—

 

শ্যামবাজারে অ্যাডভোকেট সমর সরকারের বাড়িটা খুঁজে বের করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি প্রণবেশের। বিদ্যুৎ তখনো জেগেই ছিল।

ফোনে প্রণবেশের প্রশ্নের জবাবে সে কোন কথা বলতে পারেনি। কেমন করে দেবে সে অত বড় দুঃসংবাদটা

গলা যেন কেউ তার চেপে ধরেছিল। দোতলায় নিজের ঘরের মধ্যে একটা ইজিচেয়ারের উপরে বিদ্যুৎ জেগে বসে ছিল। গাড়ির শব্দে জানলায় উঁকি দিয়ে দেখতে পেল তাদের বাড়ির সামনে ট্যাক্সিটা থেমেছে–

কে একজন তাদের সদরে দাঁড়িয়ে।

 

দুর্ঘটনার সংবাদটা ছোট্ট করে সংবাদপত্রে তৃতীয় পৃষ্ঠায় নীচের দিকে প্রকাশিত হয়েছিল ঘটনার পরের পরের দিন।

বটানিক্যাল গার্ডেনে গত পরশু পিকনিক করতে গিয়ে দলের মধ্যে একটি তরুণীর রহস্যজনক মৃত্যু। মৃত্যু ঘটেছে রুমালের ফাসে। উক্ত তরুণীর নাম মিত্ৰানী ঘোষাল। পরে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ।

কিরীটী সকালবেলা তৃতীয় কাপ চায়ের সঙ্গে ঐ দিনকার সংবা ত্রের পাতা ওলটাচ্ছিল—অন্যমনস্কভাবে–তরুণীর বাড়ি যে কালীঘাট অঞ্চলেই কিরীটী বুঝতে পারেনি এবং শুধু তাই নয়—তারই পরিচিত মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে ঐ মিত্রানী তাও বুঝতে পারেনি। পিরবার কথাও নয়—সংবাদটার মধ্যে এমন কিছু বিশেষত্ব ছিল না, যেটা তার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে। যেমন প্রত্যহ সংবাদটা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ে তেমনি পড়তে থাকে কিরীটী!

ঘণ্টাখানেক বাদে কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকলো,—শুনছো, তোমার মাস্টারমশাই—

কার কথা বলছো? কিরীটী স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।

কালীঘাটে তোমার সেই পুরনো মাস্টারমশাই থাকেন না!

অবিনাশবাবু–

হ্যাঁ—তার মেয়ে নাকি গত পরশু বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে বটানিক্যাল গার্ডেনে পিকনিক করতে গিয়েছিল—

সঙ্গে সঙ্গে কিরীটী সজাগ হয়ে বসে, কি হয়েছে তার?

গলায় রুমালের ফাঁস দিয়ে কে যেন তাকে হত্যা করেছে—

তুমি—তুমি কার কাছে শুনলে?

এই তো একটু আগে আমাদের পাশের বাড়ির যশোদাবাবু বলছিলেন–যশোদাবাবু আর অবিনাশবাবু তো শালা-ভগ্নীপতি।

কিরীটী তাড়াতাড়ি আবার সংবাদপত্রের পাতা উল্টে সংবাদটা খুঁজে বের করে বার দুই ভাল করে সংবাদটা পড়লো, তারপর উঠে দাঁড়াল।

একটু বেরুচ্ছি কৃষ্ণা।

এই সকালে আবার কোথায় বেরুবে। সকালে তো হেঁটে এসেছো—

একবার মাস্টারমশাইয়ের ওখানে যাবো।

অবিনাশবাবুর ওখানে?

হ্যাঁ–ব্যাপারটা আমাকে একটু জানাতে হচ্ছে–

অবিনাশ ঘোষালের সঙ্গে কিরীটীর পরিচয় সেই যখন সে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবে– ফার্স্ট ক্লাসের ছাত্র—অবিনাশবাবু সেই সময়েই স্কুলে সেকেন্ড টীচার হয়ে আসেন–অঙ্ক করাতেন ক্লাসে—পরে, বৎসর চারেক পরে, ঐ স্কুলেরই প্রধান শিক্ষক হন।

সবে তখন এম, এস-সি. পাস করে অবিনাশ ঘোষাল স্কুলের শিক্ষকতার চাকরি নিয়ে এসেছিলেন–

কতই বা বয়স তখন তাঁর, বছর আটাশ-ঊনত্রিশ হবে।

মাত্র মাস আষ্টেক পড়েছিল কিরীটী অবিনাশবাবুর কাছে–গণিতশাস্ত্রের প্রতি তিনিই কিরীটীর মনের মধ্যে একটা আকর্ষণ ও প্রীতি জাগিয়ে তোলেন।

যার ফলে শিক্ষা সমাপ্ত করেছিল কিরীটী পরবর্তীকালে রসায়ন-শাস্ত্রে শেষ ডিগ্রী নিয়ে এবং যে শ্রদ্ধা ও প্রীতির সম্পর্ক সেদিন শিক্ষক ও ছাত্রের মধ্যে গড়ে উঠেছিল সেটা সেদিন পর্যন্তও অক্ষুন্ন ছিল। সময় পেলেই কিরীটী যেতো অবিনাশবাবুর ওখানে। সহজ সরল আত্মভোলা মানুষটিকে ওর বড় ভাল লাগে।

অবিনাশবাবু খুব খুশি হতেন কিরীটীকে দেখলে।

এসো–এসো, কিরীটী রায় যে—-

পায়ের ধুলো নিয়ে প্রণাম করে কিরীটী বলেছে, ভাল আছেন তো মাস্টারমশাই?

হ্যাঁ-বাবা, ভালই তো আছি। তার পরই বলতেন, তোমার নতুন রহস্য উদঘাটনের কাহিনী কিছু শোনাও।

কিরীটী হাসতে হাসতে বলতো, আমার চাইতে সুব্রতই ভাল বলতে পারে মাস্টারমশাই-একদিন তাকে নিয়ে আসবো, শুনবেন।

মধ্যে মধ্যে সুব্রতও কিরীটীর সঙ্গে আসততা—সে তখন বেশ জমিয়ে বসে কিরীটীকাহিনী শোনাত।

কি শ্রদ্ধা–কি আগ্রহ নিয়েই যে শুনতেন অবিনাশ ঘোষাল সেসব কাহিনী—শোনা নয় যেন গিলতেন।

একদিন বলেছিলেন সুব্রতকে অবিনাশ ঘোষাল–-বুঝলে সুব্রত, প্রবলেম সলভ করবার অদ্ভুত এক ন্যাক ছিল কিরীটীর–কঠিন কঠিন প্রবলেম ও অনায়াসেই সলভ করে দিত—রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারেও তার সেই প্রতিভার স্ফুরণ–

কিরীটীর প্রশংসায় যেন একেবারে শিশুর মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতেন।

মিত্রানীকে কিরীটী কয়েকবার দেখেছে, বেশ স্থির বুদ্ধিমতী মেয়েটি, মনে হয়েছে।

কিরীটী যখন অবিনাশ ঘোষালের ওখানে পৌঁছাল বেলা তখন প্রায় সাড়ে আটটা হবে। ইতিমধ্যে রৌদ্রের তাপ বেড়েছে–আর একটা রৌদ্রতাপ-দগ্ধ দিন।

প্রথমেই প্রণবেশের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আকস্মিক বিপর্যয়ে প্রণবেশ আর কর্মস্থলে ফিরে যায়নিকটা দিন ছুটি নিয়েছে।

কিরীটীর সঙ্গে প্রণবেশেরও পরিচয় ছিল।

এই যে কিরীটীবাবু, আপনার কথাই ভাবছিলাম, প্রণবেশ বললে।

মাস্টারমশাই কোথায় প্রণবেশবাবুঃ কিরীটী শুধাল।

বাবা উপরের ঘরে—আমাদের বাড়িতে গত পরশু একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে কিরীটীবাবু-আমার বোন মিতু–

আমি জানি—

জানেন! কার কাছে শুনলেন—

সংবাদটা আজকের সংবাদপত্রেও ছাপা হয়েছে, তাছাড়া আমার স্ত্রীকে আপনার মামা যশোদাবাবু

কি করে যে হলো এখনো যেন কিছুই মাথায় আসছে না। কিরীটীবাবু, মিতুর মত মেয়েকে—কথাটা আর শেষ করতে পারে না প্রণবেশ—তার গলার স্বর যেন বুজে আসে–চোখের কোণ দুটো জলে ভরে ওঠে।

সমস্ত ব্যাপারটা আপনি বোধ হয় জানেন?

হ্যাঁ-মোটামুটি শুনেছি ওর বন্ধু বিদ্যুৎ সরকারের মুখে আর বাকিটা শিবপুর থানার ও. সি. সুশীল নন্দীর মুখ থেকে গতকাল দ্বিপ্রহরে। বাবার সঙ্গে দেখা করবেন?

হ্যাঁ—

কেমন যেন হঠাৎ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেন বাবা। বড় ভালবাসতেন মিতুকে—

চলুন মাস্টারমশাইয়ের সঙ্গে দেখা করে আসি।

দুজনে দোতলায় এলো।

বাড়িতে সর্বক্ষণ লেখাপড়া নিয়েই ব্যস্ত থাকেন অবিনাশ ঘোষাল–একটা চৌকির উপরে মাদুর বিছানো—একটা বালিশ শিয়রের দিকে-গ্রীষ্মকালে ঐ মাদুর আর বালিশটিই তার শয্যা—আর শীতকালে একটি চাদর।

চারিদিকে ছোট বড় আলমারীতে একেবারে ঠাসা-গণিতশাস্ত্রের বইতে-চৌকির অর্ধেকটায়ও খাতাপত্র বই সব ছড়ানো

ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিলেন অবিনাশ ঘোষাল। পরনে একখানি মোটা খদ্দরের ধুতি—বক্ষে মোটা উপবীত।

মাথাভর্তি কাঁচাপাকা চুল অবিন্যস্ত। একমুখ কাঁচাপাকা দাড়িও।

চোখে মোটা কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমে পুরু লেন্সের চশমা। পায়চারি করতে করতে মধ্যে মধ্যে অবিনাশ ঘোষাল বাঁ হাতে আঙুলগুলো দিয়ে অবিন্যস্ত চুলগুলো যেন টানছেন।

ওরা যে দুজন ঘরে ঢুকেছে সেটা টেরও পান না অবিনাশ ঘোষাল। একমাত্র আদরিণী কন্যার আকস্মিক মৃত্যু যেন প্রচণ্ড আঘাত হেনেছে মানুষটার ওপরে।

মাস্টারমশাই।

পায়চারি থামিয়ে ফিরে তাকালেন অবিনাশ ঘোষাল। কে?

মাস্টারমশাই আমি কিরীটী।

ওঃ কিরীটী—ও, তুমি এসেছো। জানো, জানো কিরীটী, আমার মিতু মা—

সব শুনেছি মাস্টারমশাই—

কিন্তু কেন এমন হলো বল তো! আমার মিতু মাকে কে এমন করে খুন করলো! তুমি তো জানো, তুমি তো দেখেছো আমার মিতু মাকে—এত নিরীহ, এত সরল, এত পবিত্র—আচ্ছা কিরীটী, তুমি তো অনেক কঠিন রহস্য উদ্ঘাটন করেছে—তুমি–তুমি পারবে না কিরীটী তাকে খুঁজে বের করতে, যে আমার মিতু মাকে—

পারবো মাস্টারমশাই—

পারবে!

হ্যাঁ—আপনার আশীর্বাদে নিশ্চয়ই পারবো।

জানি, জানি, তুমি পারবে—কেউ যদি তাকে খুঁজে বের করতে পারে সে একমাত্র তুমিই পারবে–আমি, তাকে শুধু একটা প্রশ্ন করবো–কেন, কি জন্য সে আমার মিতু মাকে এমন করে খুন করলো। একবারও কি হাত দুটো তার কাঁপলো না! অমন করে শ্বাসরোধ করে—না জানি মা আমার কত কষ্ট পেয়েছে। উঃ, কি নৃশংস! আমার কি মনে হয় জানো কিরীটী—

বলুন—

সেদিন যারা গার্ডেনে পিকনিকে উপস্থিত ছিল সেই বন্ধুদের মধ্যেই কেউ একজন

বাধা দিল প্রণবেশ। বললে, না, না—এ আপনি কি বলছেন বাবা, ওদের পরস্পরের মধ্যে কত দিনের বন্ধুত্ব–সেই কলেজ লাইফ থেকে। তা ছাড়া ওদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা–

প্রণবেশবাবু—কিরীটী বলে, মাস্টারমশাইয়ের কথাটা হয়তো একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। একজনকে দেখে বা কিছু সময়ের জন্য মিশে তার ভিতরের কতটুকুই বা আমরা জানতে পারি, তার সত্যিকারের বা আসল চেহারার কতটুকুই বা আমাদের চোখের সামনে ধরা দেয়। তাছাড়া একটা কথা ভুলে যাবেন না, ওদের সকলেরই বয়স অল্প–ঐ বয়সে সাধারণত মানুষ যতটা সেন্টিমেন্টালস্পর্শকাতর ও ভাবপ্রবণ। হয়–বয়েসটা একটু বেশী হলে ততটা হয়ত হয় না। ইমোশান বা ঝোকের মাথায় কোন বিশেষ এক মুহূর্তে এমন অনেক কিছুই হয়ত তারা করে বা করতে পারে যেটা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ক্রমশ থিতিয়ে আসে।

কিরীটী—

বলুন মাস্টারমশাই। অবিনাশ ঘোষালের ডাকে ফিরে তাকিয়ে কিরীটী সাড়া দিল।

দোষ হয়ত আমারও আছে, সন্তানের প্রতি বাপের কর্তব্য পালনের ত্রুটি আমারও আছে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেলে বোধ হয় এমন একটা দুর্ঘটনা ঘটতো না—

মাস্টারমশাই, একটা কথা বলবো।

বলো।

মিত্রানী কাউকে ভালবাসতো কিনা আপনি জানেন?

তুমি তো জানো কিরীটী, আমার সন্তানদের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় কখনো আমি বাধা দিইনি—আমার কাছে সেটা অপরাধ বলেই বরাবর মনে হয়েছে–তাছাড়া আমাদের বাপ ও মেয়ের মধ্যে সব কথাই খোলাখুলি হতো–সে রকম কিছু থাকলে বোধ হয় আমি জানতাম।

আর একটা কথা মাস্টারমশাই, কখনো তার বিয়ের চেষ্টা করেছেন বা সে সম্পর্কে তার সঙ্গে কোন আলোচনা করেছেন?

করেছি বৈকি। কিছুদিন আগেও বিয়ের কথাটা তার কাছে তুলেছিলাম, সে তখন বলেছিল

কি বলেছিল মিত্রানী?

সময় হলেই সে আমাকে জানাবে।

কি জানাবে?

তা তো কিছু বলেনি, ঐটুকুই কেবল বলেছিল আর আমিও কিছু বলিনি।

কিরীটী কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আবার মৃদু কণ্ঠে বললে, আচ্ছা তার পুরুষ বন্ধুদের মধ্যে কারোর প্রতি

যতদূর জানি-বন্ধুদের মধ্যে সে সুহাস ছেলেটিকে একটু বেশী বোধ হয় পছন্দ করতো।

সুহাস!

ঐ যে সুহাস মিত্র। ওর কলেজের সহপাঠী। ছেলেটি শুনেছি—লেখাপড়ায় খুব ভাল ছিল বরাবরই—বি.এ.-তে ইকনমিকসে অনার্স পেয়েও আর নাকি পড়েনি, একটা বড় ফার্মে চাকরি করছে। মধ্যে মধ্যে আসতোও এখানে বেশ স্মার্ট ও ভদ্র ছেলেটি, মনে হত মিতু যেন সুহাসকে একটু বেশী পছন্দ করতো।

আর কে আসতো এখানে?

বিদ্যুৎ আসতো।

আর কেউ?

সতীন্দ্র আর সজলও কয়েকবার এসেছে। তবে ইদানীং আর সজলকে এখানে গত দুবৎসর হতে আসতে দেখিনি—তবে দিন চারেক আগে হঠাৎ এসেছিল।

অবিনাশ ঘোষালের দুচোখের কোণ বেয়ে দুফোটা জল গড়িয়ে পড়ল।

মাস্টারমশাই, যা হয়ে গিয়েছে তা তো আর ফিরবে না। আপনি যদি এভাবে ভেঙে পড়েন—

না, না—আমার জন্য ভেবো না কিরীটী, আমি ঠিক আছি—ঠিক আছি, বলতে বলতে অবিনাশ ঘোষাল চোখের জল মুছে নিলেন।

অতঃপর কিরীটী সেদিনকার মত প্রণাম জানিয়ে বিদায় নিল।

নীচে এসে প্রণবেশের সঙ্গে তারপর অনেকক্ষণ কথা বলেছিল এবং প্রণবেশ বিদ্যুতের মুখে ও থানায় সুশীল নন্দীর কাছে যা শুনেছিল সব বললে।

প্রণবেশই একসময় অতঃপর প্রশ্ন করে, আচ্ছা কিরীটীবাবু, আপনারও কি সত্যি মনে হয় যে—

কি?

ঐ মানে মিতুর বন্ধুদের মধ্যে কেউ একজন—

নিশ্চিত হয়ে এই মুহূর্তে তা বলতে পারি না, তবে এটা ঠিক, সমস্ত ঘটনা শোনার পর যা মনে হয়—

কি! কি মনে হয় আপনার?

কিরীটী নিজেকে যেন হঠাৎ সামলে নিল। বললে, কি জানেন প্রণবেশবাবু–ইট ইজ টু আরলি টু সে এনিথিং। আচ্ছা আমি এখন চলি-মাস্টারমশাইয়ের দিকে একটু নজর রাখবেন—মিত্রানীর মৃত্যুতে একটু বেশী রকমই আঘাত পেয়েছেন বলে যেন মনে হলো—

ভাবছি কিছুদিনের জন্য বাবাকে আমি সঙ্গেই নিয়ে যাবো।