৬ষ্ঠ অধ্যায় – সেনাপতিপদে শল্যের নিৰ্বাচন
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! এইরূপে মহারথ শল্য, চিত্রসেন, শকুনি, অশ্বত্থামা, কৃপাচার্য্য, কৃতবর্ম্মা, সুষেণ, অরিষ্টসেন, ধৃতসেন ও জয়সেন প্রভৃতি যুদ্ধবিশারদ নরপালগণ সকলে সমবেত হইয়া হিমালয়প্রস্থে সেই রজনী অতিবাহিত করিলেন। জয়শীল পাণ্ডবগণকর্ত্তৃক মহাবীর কর্ণ নিহত হওয়াতে আপনার পুত্রগণ নিতান্ত ভীত হইয়া হিমালয়পৰ্ব্বত ভিন্ন আর কুত্রাপি শান্তিলাভে সমর্থ হইলেন না। তৎকালে তাঁহারা সকলে একত্র হইয়া শল্যসমক্ষে দুর্য্যোধনকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, “হে মহারাজ! আপনি একজনকে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত করিয়া শত্রুগণের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হউন; তাহা হইলে আমরা সেই সেনাপতিকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া সমরে শত্রুগণকে পরাজিত করিব।’
“তখন রাজা দুর্য্যোধন রথ হইতে অবতীর্ণ না হইয়াই সৰ্ব্বযুদ্ধবিশারদ, প্রচ্ছন্নমস্তক [উষ্ণীষবদ্ধ–পাগড়ীদ্বারা আবৃত], কম্বুগ্রীব [শঙ্খবৎ রেখায়যুক্ত কণ্ঠ], মহারথ অশ্বত্থামার সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। মহাবীর দ্রোণপুত্রের লোচনদ্বয় বিকসিত পদ্মপত্রের ন্যায়, আস্যদেশ ব্যাঘ্রের ন্যায়, গাত্র মেরুপৰ্ব্বতের ন্যায় এবং স্কন্ধ, নেত্র, গতি ও কণ্ঠস্বর মহাদেবের বৃষভের ন্যায়। তাঁহার বাহুযুগল পুষ্ট ও আয়ত এবং বক্ষঃস্থল দৃঢ় ও বিশাল। তিনি গরুড় ও বায়ুর ন্যায় বলবেগশালী এবং তেজে দিবাকর, বৃদ্ধিতে শুক্রাচাৰ্য্য ও রূপে সূধাকরসদৃশ। তাঁহার ঊরুদেশ, কটিদেশ ও জঙ্ঘা অতি সুবৃত্ত, পাদ, অঙ্গুলি ও নখর অতি মনোহর। বোধহয়, যেন বিধাতা গুণগ্রাম বারংবার স্মরণ করিয়া অতি যত্নসহকারে তাঁহাকে নির্ম্মাণ করিয়াছেন। তাঁহার কিছুমাত্র অঙ্গবৈলক্ষণ্য নাই। তিনি সকল কার্য্যে দক্ষ এবং বিদ্যার সাগর। তিনি বলপূৰ্ব্বক অরাতিগণকে পরাজয় করিতে পারেন, কিন্তু শত্রুগণ কদাচ তাঁহাকে জয় করিতে সমর্থ নহে। তিনি দশ-অঙ্গ [সংযম, জাগরণ, ধৈৰ্য্য, পুষ্টি, স্মৃতি, বাণক্ষেপণাদি নিপুণতা, শত্রুভেদন, চিকিৎসা, কাৰ্যে উদ্দীপনা ও বিধিবিষয়ক বিজ্ঞান] ও চতুষ্পদযুক্ত অস্ত্রবিদ্যা এবং চারি বেদ, উপবেদ ও আখ্যান বিশেষরূপ অবগত আছেন। অযোনিজ [গর্ভসম্বন্ধ বিনা জন্ম–গর্ভে যাহার জন্ম নহে] মহাতপাঃ দ্রোণাচার্য অতি কঠোর তপশ্চরণপূৰ্ব্বক মহাদেবের আরাধনা করিয়া অযোনিজার গর্ভে তাঁহার উৎপত্তি-সাধন করিয়াছেন। তিনি অদ্ভুতকৰ্ম্মা ও অলৌকিক রূপসম্পন্ন। রাজ দুর্য্যোধন সেই অরাতিনিপাতন দ্রোণপুত্রের সমীপে সমুপস্থিত হইয়া কহিলেন, “হে গুরুপুত্র! আজ আপনিই আমাদিগের অনন্যগতি; অতএব কাহাকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিব, আদেশ করুন।’
“মহাবীর অশ্বত্থামা দুৰ্য্যোধনের বাক্য শ্রবণ করিয়া কহিলেন, “হে মহারাজ! মদ্ৰাধিপতি শল্য বলবীৰ্য্য, শ্রী ও যশ প্রভৃতি অশেষ গুণসম্পন্ন এবং সৎকুলসদ্ভূত; অতএব ঐ কার্ত্তিকেয়সদৃশ প্রভাবশালী মহাবীরই আমাদিগের সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হউন। ঐ কৃতজ্ঞ মহাত্মা স্বীয় ভাগিনেয়গণকে পরিত্যাগ করিয়া আমাদিগের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন। দেবগণ কার্তিকেয়কে সেনাপতি করিয়া যেমন জয়লাভ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আমরাও ইহাকে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিয়া জয়লাভে সমর্থ হইব।’
“হে মহারাজ! আচাৰ্য্যতনয় এই কথা-কহিলে সমুদয় মহারথ শল্যকে পরিবেষ্টনপূৰ্ব্বক জয়ধ্বনি করিয়া যুদ্ধার্থে উৎসুক হইলেন। ঐ সময় রাজা দুর্য্যোধন রথ হইতে ভূতলে অবতীর্ণ হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে ভীষ্ম-দ্রোণসদৃশ সমরপারদর্শী রথস্থিত মহাবীর শল্যকে কহিলেন, “হে মিত্রবৎসল! যে সময় বিদ্বান ব্যক্তিরা মিত্র ও অমিত্রের পরীক্ষা করিয়া থাকেন, এক্ষণে সেই সময় সমুপস্থিত হইয়াছে। আপনি আমাদিগের বন্ধু, অতএব এক্ষণে সেনাপতিপদে অভিষিক্ত হউন। আপনি সমরাঙ্গনে অবতীর্ণ হইলে পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ অমাত্যগণের সহিত সমরে নিরুৎসাহ হইবে।’
“শল্য কহিলেন, হে কুরুরাজ! তুমি আমাকে যাহা অনুমতি করিতেছ, আমি তাহাই করিব। আমার রাজ্য, ধন, প্রাণ প্রভৃতি যাহা কিছু আছে, তৎসমুদয়ই তোমার প্রিয়কাৰ্য্যসাধনার্থ নিবেশিত হইবে।’ তখন দুর্য্যোধন কহিলেন, “হে মাতুল! আমি আপনাকে সেনাপতিপদে বরণ করিতেছি। কার্তিকেয় যেমন সমরাঙ্গনে দেবগণকে রক্ষা করিয়াছিলেন, তদ্রূপ আপনিও আমাদিগের রক্ষায় প্রবৃত্ত হউন এবং দেবরাজ ইন্দ্র যেমন দানবগণকে বিনাশ করিয়াছিলেন, আপনিও তদ্রূপ শত্রুগণকে বিনাশ করুন।’”