সেদিনটা ছিল রবিবার। অফিস আদালত সব বন্ধ।
লালবাজার থেকে বের হয়ে সোজা কিরীটী সোমনাথ ভাদুড়ীর গৃহের দিকে গাড়ি চালাতে বলল সর্দারজীকে!
বেলা তখন প্রায় সাড়ে বারোটা। সোমনাথ ভাদুড়ীর ঘর প্রায় খালিই ছিল। একজন মাত্র মক্কেল ছিল ঘরে। সোমনাথ ভাদুড়ী তার সঙ্গেই কথা বলছিলেন।
কিরীটীকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে সাদর আহ্বান জানালেন সোমনাথ ভাদুড়ী, আসুন রায়মশাই, বসুন–
কিরীটী উপবেশন করবার পর সোমনাথ ভাদুড়ী তাড়াতাড়ি শেষ মক্কেলটিকে বিদায় করলেন।
আপনাকে ফোন করেছিলাম বাড়িতে—আপনার স্ত্রী বললেন আপনি সকালেই বের হয়েছেন। ভাদুড়ী বললেন।
হ্যাঁ, লালবাজারে গিয়েছিলাম।
আজকের সকালবেলার কাগজ পড়েছেন রায় মশাই?
না, সময় পাইনি। তাছাড়া আমি সাধারণত কাগজ দুপুরে বিশ্রামের সময় পড়ি।
সুদীপ রায়—
কি হয়েছে সুদীপের?
সে খুন হয়েছে—
খুন! কে বললে?
সংবাদপত্রে বের হয়েছে। তার গুলিবিদ্ধ রক্তাক্ত মৃতদেহটা রেল লাইনের ধারে গতকাল সকালে পাওয়া গিয়েছে।
তার মানে যেদিন সন্ধ্যায় সে আপনার এখানে এসেছিল, সেইদিনই রাত্রে সে খুন হয়েছে!
হিসাবমত তাই দাঁড়াচ্ছে। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন।
কিন্তু প্রতুলবাবু তো কিছু বললেন না!
বোধ হয় ব্যাপারটা এখনো তিনি শোনেননি।
হয়ত তাই, কিন্তু লোকটা যে ওই সুদীপ রায়ই–সেটা জানলেন কি করে?
কাগজে অবিশ্যি বের হয়েছে এক ব্যক্তির মৃতদেহ আবিষ্কৃত হয়েছে এবং মৃতের মুখটা কোন ধারানো অস্ত্রের সাহায্যে ক্ষত-বিক্ষত করা হয়েছে। আইডেনটিফাই নাকি করেছে আজই তার স্ত্রী রমা।
খবরের কাগজে কি সংবাদ বের হয়েছে?
না। আসলে আমিও সংবাদপত্রে নিউজটা পড়িনি রায়মশাই-আজ সকালে একটা ফোন পাই–
ফোন!
হ্যাঁ, অজ্ঞাতনামা এক নারীর কাছ থেকে। সে-ই সংবাদটা দেয়। সংবাদটা দিয়েই সে ফোনের কানেকশন কেটে দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আপনাকে ফোন করি সংবাদটা দেবার জন্য।
ফোনে ঠিক কি বলেছিল আপনাকে সেই মহিলা?
বলেছিল রেল লাইনের ধারে যে মৃতদেহটা পাওয়া গিয়েছে সেটা সুদীপ রায়ের।
যিনি ফোন করেছিলেন তাঁর কণ্ঠস্বর আপনি চিনতে পারেননি।
না।
ঠিক আছে—বলতে বলতে সামনেই টেবিলের উপর রক্ষিত ফোনের রিসিভারটা তুলে নিয়ে কিরীটী ডায়েল করল লালবাজারে।
কিন্তু প্রতুল সেনকে তার অফিসে পেল না।
কাকে ফোন করছিলেন? সোমনাথ ভাদুড়ী জিজ্ঞাসা করলেন।
প্রতুল সেনকে, পাওয়া গেল না—অফিসে নেই।
আচ্ছা রায়মশাই, কে আপনাকে ফোন করেছিল বলুন তো?
মনে হয় হত্যাকারীর সহকারিণী এবং হত্যাকারীরই নির্দেশে?
কিন্তু আমাকে সংবাদটা দেবার কি প্রয়োজন ছিল?
ভাদুড়ী মশাই, হত্যাকারী বরাবরই সজাগ ছিল। সুদীপবাবু যে আপনার কাছে। এসেছিলেন তাও সে জানত। তাই সে আপনাকে জানিয়ে দিল—ভবিষ্যতের কথা ভেবেই সুদীপবাবুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দেওয়া হলো।
তার মানে–যাতে সে ভবিষ্যতে আরো কিছু প্রকাশ করতে না পারে!
হ্যাঁ—সেই সন্দেহেই তাকে এ পৃথিবী থেকে সরানো হয়েছে। তবে একটা ব্যাপার সুদীপবাবুর মৃত্যুতে পরিষ্কার হয়ে গেল
কোন্ ব্যাপারের কথা বলছেন?
তপন ঘোষের হত্যার ষড়যন্ত্রের মধ্যে সুদীপবাবু না থাকলেও তিনি ব্যাপারটা অনুমান করতে পেরেছিলেন।
আমি কিন্তু একটা ব্যাপার বুঝতে পারছি না রায়মশাই।
সুদীপবাবু এগিয়ে এসে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে কেন সাক্ষী দিলেন তাই বোধ হয়।
হ্যাঁ। সে যদি ষড়যন্ত্রের মধ্যে ছিলই—
সুদীপবাবুর মনের মধ্যে একটা ভয় ঢুকেছিল।
ভয়! কিসের ভয়?
তার নিজের প্রাণের ভয়।
প্রাণের ভয়!
হ্যাঁ। তার মনে ভয় ঢুকেছিল, বিজিত মিত্র যদি প্রাণের ভয়ে শেষ পর্যন্ত অ্যাপ্রুভার হয়ে সব কিছু প্রকাশ করে দেয়–
তাই সে সাক্ষী দিয়ে বিজিত মিত্রকে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বলতে চান?
হ্যাঁ-বিজিত মিত্রকে আইন-আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে নিয়ে যেতে চেয়েছিল।
কেমন যেন সব কিছু গোলমাল হয়ে যাচ্ছে আমার রায়মশাই। সোমনাথ ভাদুড়ী বললেন দু আঙুলের মাঝখানে মোটা পেনসিলটা নাচাতে নাচাতে।
একটা ব্যাপার কিন্তু পরিষ্কার হয়ে গেল ভাদুড়ী মশাই। কিরীটী বললে।
কি বলুন তো? সোমনাথ ভাদুড়ী তাকালেন কিরীটীর মুখের দিকে।
তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায় সব একদলের এবং সত্যিই ওরা পরস্পর কোন দুষ্কর্মের সঙ্গী ছিল পরস্পরের।
চোরাকারবার!
হতে পারে। আমি কিন্তু ব্যাপারটা পূর্বাহ্রেই অনুমান করেছিলাম—তাই আজ ফাঁদ পাতার ব্যবস্থা করে এসেছি।
ফাঁদ।
হ্যাঁ–আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো আজই রাত্রে ফাঁদে নাটের গুরুকে আটকা পড়তে হবে।
কার কথা বলছেন?
রহস্যের মেঘনাদ যিনি—তারই কথা বলছি। ব্যাপারটা সত্যি কথা বলতে কি, আমি কিন্তু এত সহজে নিষ্পত্তি হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি। ভাবতে পারিনি হত্যাকারী এত বড়।
একটা ভুল তড়িঘড়ির মাথায় করে বসবে বা করে বসতে পারে।
তাহলে সুদীপবাবুর নিহত হওয়াটা এ ব্লেসিং ইন ডিসগাইজ বলুন রায়মশাই, সোমনাথ বললেন।
তাই।
কিরীটীর অনুমান যে মিথ্যা নয় সেটা ওই রাত্রেই প্রমাণিত হয়ে গেল।
ব্যবস্থামত রাত্রি এগারোটা নাগাদ কিরীটী ও প্রতুল সেন এসে খিড়কির দরজাপথে বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করে খোলা বাথরুমের দরজা দিয়ে মৃণালের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল।
ঘরের মধ্যে পূর্ব হতেই অন্ধকারে ঘাপটি মেরে ছিল প্রতুল সেনের এক বিশ্বস্ত অনুচর।
ফিসফিস করে প্রতুল সেন শুধালেন, কেউ এসেছে মৃণালের পাশের ঘরে?
না, স্যার।
মিনতি আছে তো ঘরে?
আছে।
প্রার্থিত আগন্তুক ঠিক এল রাত বারোটায়।
টুক টুক করে পাশের ঘরের দরজায় নক করলো।
দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।
তাদের মধ্যে সেরাত্রে যে সব কথাবার্তা হয়েছিল, পরে টেপ থেকেই তা শোনা যায়।
কে? মিনতির প্রশ্ন।
আমি।
তুমি? আবার কেন তুমি এসেছো?
তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যেতে, চল আমার সঙ্গে–
না।
চুল।
না, কিন্তু এখানে আর তুমি থেকো না—চলে যাও, আমি টের পেয়েছি পুলিস ছদ্মবেশে এ বাড়ির আশেপাশে ওৎ পেতে রয়েছে।
পুলিসের সাধ্যও নেই আমাকে ধরে।
বিশ্বাস করো, আমি সত্যি বলছি, আর তুমি হয়ত একটা কথা জানো না—
কিরীটী রায়–
সেই ছুঁচোর ব্যাটা চামচিকেতার সঙ্গে আমার মোলাকাত হয়েছে। চল—আর দেরি করো না।
তুমি আমার কথা শোন। আমি বলছি তুমি চলে যাও।
একা চলে যাবো-তাই কি হয়, তোমাকে একা ফেলে তো যেতে পারি না।
ওগো—
তারপরই একটা গোঁ গোঁ শব্দ।
কিরীটী পাশের ঘরে প্রস্তুতই ছিল। সঙ্গে সঙ্গে পরদা তুলে পাশের ঘরে ঢুকে পড়ে, তার পশ্চাতে প্রতুল সেন, তার হাতে ধরা পিস্তল।
বলাই বাহুল্য, আততায়ী পালাবার পথ পায় না। যে দুটো হাত তার মিনতির গলায় ফস পরিয়েছিল—তার সেই হাতের মুষ্টি আপনা থেকেই শিথিল হয়ে আসে। সে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় প্রতুল সেনের হাতে ধরা উদ্যত পিস্তলটার দিকে। লোকটার পরনে পাজামা ও গায়ে কালো শার্ট। মুখে চাপদাড়ি।
কিরীটী কঠিন কণ্ঠে বললে, মিঃ সেন, ওই তপন ঘোষ ও সুদীপের হত্যাকারীঅ্যারেস্ট করুন।
প্রতুল সেন ডাকলেন, বীরবল, ওর হাতে হ্যান্ডকাপ লাগাও।
বীরবল পশ্চাতেই ছিল, হাতকড়া নিয়ে এগিয়ে এলো। লোকটার হাতে হাতকড়া পরাল।
মিনতিকেও ছাড়বেন না। ওর হাতেও হ্যান্ডকাপ পরান। আর এক জোড়া আনেননি?
বীরবলের কাছে আর এক জোড়া হাতকড়া ছিল; সে সেটার সদ্ব্যবহার করল।
ইতিমধ্যে গোলমাল শুনে বাড়ির অনেকে সেখানে এসে ভিড় করে।
তারা ব্যাপার দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত।
কিরীটী এবার বললে প্রতুল সেনের দিকে তাকিয়ে, মহাপুরুষটিকে চিনতে পারলেন মিঃ সেন?
না তো।
অবিনাশ—
অবিনাশ সেন!
হ্যাঁ, দাড়িটা উৎপাটন করুন—বেশি লাগবে না কারণ স্পিরিট গামের সাহায্য নেওয়া হয়েছে—উৎপাটন করলেই আসল চেহারাটা প্রকাশ পাবে।
কিরীটীর কথা মিথ্যে নয় দেখা গেল।
অবিনাশ সেনই।
সেইদিন রাত্রিশেষে লালবাজারে প্রতুল সেনের অফিস কক্ষে—
কিরীটীকে ফিরে যেতে দেননি প্রতুল সেন। টেনে এনেছিলেন সঙ্গে করে।
প্রতুল সেন বলছিলেন, ব্যাপারটা কি আপনি বুঝতে পেরেছিলেন আগেই—মানে আসল হত্যাকারী কে?
বুঝতে পেরেছিলাম প্রথমেই বললে ভুল হবে—তবে কিছুটা অনুমান করেছিলাম।
কি?
বুঝতে পেরেছিলাম তপন ঘোষ, বিজিত মিত্র ও সুদীপ রায়—আপনার কাহিনীগুলির একঝকের পাখী—বার্ডস অফ দি সেম ফেদার। আর এও বুঝেছিলাম ওরা যন্ত্র মাত্র, আসল যন্ত্রী ওদের পশ্চাতে কেউ ছিল। কিন্তু কে সে? একটা ধাঁধা থেকে গিয়েছিল। তারপর মিনতির সঙ্গে দেখা করতেই ব্যাপারটাকে ঘিরে সন্দেহ আরো ঘনীভূত হলো।
কি রকম?
বিজিত মিত্রের স্ত্রী দেবিকার পরিচয় দিয়ে ভাদুড়ী মশাইয়ের পায়ে যে গিয়ে পড়েছিল সে আসলে দেবিকা নয়। বিজিত মিত্রের স্ত্রী নেই।
প্রতুল সেন বললেন, কি বলছেন আপনি?
ঠিকই বলছি। বিজিত মিত্রের কোন স্ত্রীই ছিল না।
তবে কে সে?
সে ওই মিনতি।
মিনতি।
হ্যাঁ। মনে আছে আপনার, অমিয়বাবুর সঙ্গে একটি মেয়ে ঘোমটা মাথায় এসে দেখা করেছিল?
মনে আছে।
সেই মেয়েটি ও দেবিকা নাম ধরে যে মেয়েটি ভাদুড়ী মশাইয়ের কাছে গিয়েছিল তারা এক ও অকৃত্রিম।
ও-ই মিনতি কি করে বুঝলেন?
ব্যাপারটা আমার কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেইদিনই, যেদিন আমি আর ভাদুড়ী মশাই মিনতির সঙ্গে দেখা করতে যাই। মিনতির হাতে উল্কিতে লেখা এম অক্ষরটা দেখে। একবার ঘোমটা খুলে, একবার ঘোমটা দিয়ে গিয়েছিল সে। সঙ্গে সঙ্গে আমি অনুমান করছিলাম-মিনতিও ওই দলে আছে। আর তাই আজ রাত্রে ফাদটা পেতেছিলাম আপনার সক্রিয় সাহায্যে।
আচ্ছা সেদিন রাত্রে কি ঘটেছিল বলে আপনার মনে হয় মিঃ রায়?
অনুমানে মনে হয়–ওই অবিনাশ সেনই সে-রাত্রে পাশের ঘর থেকে মাঝের দরজা খুলে ওই ঘরে ঢুকে তপন ঘোষকে হত্যা করে। তারপর এক ঢিলে দুই পাখী মারার প্ল্যান। করে বিজিত মিত্রের মাথায় আঘাত করে এবং তার হাতে পিস্তলটা গুজে দিয়ে পালিয়ে যায়।
আচ্ছা মিনতি যদি ওই দলেরই, তবে সে অত কথা আপনাকে বললে কেন?
তার উপর থেকে সন্দেহটা দূর করবার জন্য। কারণ সে আমাকে দেখে আমার কথাবার্তা শুনে বুঝতে পেরেছিল, আদালতে যে মামলা শেষ হয়ে গিয়েছে সেটা আমার বিচারে শেষ নিষ্পত্তি নয়। এবারে হয়ত কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বেরুবে। তাই অত কথা সে বলে আমাদের। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি তখন তার ওই সব কথা তার বিরুদ্ধে আমার মনে সন্দেহ জাগাবে।
বিজিত মিত্রর কি হলো?
সম্ভবত মৃত্যুভয়ে সে আত্মগোপন করে আছে।
আর মৃণাল?
মনে হয় মৃণালকে আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না।
কিন্তু এরপর আমি–
নিরস্ত হবেন না, এই তো, তা খুঁজুন–যদি কখনো খুঁজে পান তাকে। কথাটা বলে কিরীটী মৃদু হাসলো।