০৬. সাহাবুদ্দিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন

সাহাবুদ্দিন গাড়ি চালাচ্ছিলেন। ভদ্র চেহারার মানুষটির মুখে হাসি লেগেই আছে। পরিচয় করার সময় বললেন, আমাকে মনুভাই বলবেন।

অতএব মনুভাইয়ের পাশে অর্জুন বসল। পেছনের আসনে ইউসুফভাই। এখানকার বেশিরভাগ মানুষ, যাঁরা স্বাধীনতার পর জন্মেছেন, তারা বাংলা নাম পছন্দ করেছেন। তার আগের মানুষরা ডাকনামটাকেই আসল নামের সঙ্গে ব্যবহার করা শুরু করেছেন। মনুভাই গাড়ি চালাতে-চালাতে বললেন, নামের ব্যাপারে এখন আমরা আপনাদের থেকে এগিয়ে আছি। আচ্ছা, আপনাদের একটি মেয়ের আধুনিক নাম বলুন তো!

অর্জুন মনে করার চেষ্টা করে না পেরে বুদ্ধদেব গুহর শরণাপন্ন হয়ে বলল, যোজনগন্ধা।

মনুভাই বললেন, ভাল। তবে আমাদের মেয়েদের নাম এখন একা রাখা হচ্ছে। একা, স্নেহা।

অর্জুন অবাক হল। কোনও বাঙালি তাঁর মেয়ের নাম একা রেখেছেন, তা সে ভাবতে পারছিল না।

সুন্দর চওড়া রাস্তা দিয়ে গাড়ি ছুটে যাচ্ছিল। এদিকটায় রিকশার ভিড় কমে আসছে। ডানদিকের পাঁচিলঘেরা বিশাল বাড়িটি যে ঢাকার টেলিভিশন কেন্দ্র, তা ইউসুফভাই জানালেন। ক্রমশ নির্জন এলাকার সুন্দর সুন্দর বাড়ি নজরে এল। এসব বাড়িতে বিদেশি মানুষেরা বিপুল ভাড়া দিয়ে বাস করেন। তারপরেই শিল্প এলাকা। পেট্রল পাম্পের নামগুলোও চমৎকার। কোনওটা পদ্ম, কোনওটা মেঘনা। যমুনাও নাকি আছে। চল্লিশ মিনিট পরে দুপাশে গ্রামবাংলা এসে গেল। এবার হাইওয়ে ছেড়ে ডানদিকের অপেক্ষাকৃত ছোট রাস্তায় বাঁক নিল গাড়ি। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেললাইন পার হতেই দুপাশে আম কাঁঠালের গ্রামগুলো। মনুভাই বললেন, এগুলো এখন আর আগের মতো গ্রাম নেই। লোকে এখান থেকে ঢাকা শহরে ডেইলি প্যাসেঞ্জারি করে। চাকরিটাই গ্রামের মানুষদের আসল জীবিকা।

একসময় গাড়িটা থামতে বাধ্য হল। একটি ছোট নদী সামনে। পাশে ব্রিজ তৈরির চেষ্টা হচ্ছে। নৌকো করে গাড়িটা পার করা হবে। মনুভাই বললেন, এটি শীতলক্ষ্যার একটা শাখা।

অর্জুন দেখল খানিকটা দূরে গোটাকুড়ি ছাউনি দেওয়া নৌকো বাঁধা আছে। নৌকোর ওপর যারা বসে, তাদের বেদে-বেদেনি বলে মনে হচ্ছিল। মনুভাই বললেন, , ওরা তাই। এই শাখা নদীটির একটি বিশেষত্ব আছে। এর বালি থেকে ঝিনুকের বুকে মুক্তো তৈরি হয়। কুড়ি-পঁচিশটা ঝিনুক তুলতে পারলে একটা মুক্তো আবিষ্কার করা অসম্ভব নয়। বেদেরা ওই মুক্তোর লোভে এই নদীতে আসে। অবশ্য এ. খন সরকার অনেক কড়াকড়ি করেছেন।

গাড়িটা যতক্ষণে ওপারে না গেল, ততক্ষণ কাজে লাগাল অর্জুন। বেদেদের নৌকোর গায়ে চলে এল সে পাড় ধরে। বেদেদের চেহারা, পোশাক একই রকম হয়। তারা অর্জুন সম্পর্কে একটুও আগ্রহ দেখাল না। সে গায়ে পড়েই একজনকে জিজ্ঞেস করল, মুক্তো পেয়েছেন?

লোকটা বিড়ি খাচ্ছিল নৌকোর গায়ে হেলান দিয়ে। বলল, কিনবেন নাকি কত?

না, মুক্তো কেনার ক্ষমতা আমার নেই।

ঢাকায় থাকেন নাকি?

না। আমি জলপাইগুড়ি থেকে এসেছি।

জলপাইগুড়ি? লোকটা সোজা হয়ে বসল। তারপর চিল্কার করে সঙ্গীদের যা বলল, তা উচ্চারণের জন্য অর্জুনের বোধগম্য হল না। কিন্তু কথাটা শুনে সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। অর্জুন দেখল, সবাই তাকে নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা শুরু করল। এবার প্রথম লোকটা বলল, দুধ-কলা খাওয়াইলেও সাপে ছোবল মারে। যে আসছিল সে কি আপনার পার্টনার?

ইতিমধ্যে মনুভাই এবং ইউসুফভাই এসে পড়েছেন অর্জুনের কাছে। অনেক কষ্টে চিৎকার-চেঁচামেচি এবং হাতজোড় করে তাঁরা বেদেদের শান্ত করে উত্তেজনার কারণটা জানতে পারলেন। বেদেরা জানাল, কদিন আগে একটি ছেলে অত্যন্ত অসুস্থ হয়ে এখানে এসেছিল। বেদেরা তাকে আশ্রয় দেয়। দুদিন থাকে সে নৌকোয়। তখন বেদেরা জানতে পারে, সে এসেছে ইন্ডিয়ার জলপাইগুড়ি থেকে। হঠাই গতকাল ছেলেটি উধাও হয়ে গিয়েছে। যাওয়ার সময় একটি বেদের সংগ্রহ করা চারটে মুক্তোও নিয়ে গেছে। ওই মুক্তোগুলোর দাম যাই হোক না কেন, ওর বিশ্বাসঘাতকতা ভুলবে না এরা কখনও। অর্জুন। যেহেতু জলপাইগুড়ি থেকে এসেছে, তাই ওরা ধরে নিয়েছে দুজনের মধ্যে যোগাযোগ আছে। মুক্তো ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত ওরা অর্জুনকে ছাড়বে না।

শেষপর্যন্ত অনেক কথা খরচ করার পর ইউসুফভাইরা বেদেদের শান্ত করতে পারলেন। অর্জুন কথা দিল ছেলেটিকে দেখতে পেলে সে পুলিশের হাতে তুলে দেবে। কিন্তু এইসঙ্গে অর্জুনের একটা চিন্তা দূর হল। কাজল তা হলে এই পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে এবং অকুস্থলে পৌঁছলেও এত তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করতে না পারার কথা। বেদেরা বলছে গতকাল সে এখান থেকে চলে গিয়েছে।

নৌকো ওদের গাড়ি ওপারে পৌঁছে দিলে আবার চলা শুরু হল। মনুভাই বললেন, কী ব্যাপার বলুন তত? জলপাইগুড়ি থেকে হঠাৎ এই অঞ্চলে আপনার আগে আর-একজন তস্কর উপস্থিত হলেন কেন?

আমার আগে আর-একজন তস্কর মানে? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।

সরি! আমার কথাটা ওইভাবে বলা ঠিক হয়নি। মনুভাই লজ্জিত হলেন।

ইউসুফ বললেন, জলপাইগুড়ি থেকে কেউ যদি এসে বেদেদের প্রতারণা করে, তা হলে তার আসার কারণ অর্জুন জানবে কী করে মনুভাই?

মনুভাই মাথা নাড়লেন, তা অবশ্য ঠিক। কিন্তু অর্জুনভাই, যে-লোকটি এসেছে, সে সুবিধের নয়। আমার মনে হয় আপনার পরিচয় জলপাইগুড়ির লোক না বলাই ভাল। মানুষ খুব সহজে ভুল বোঝে।

কথাগুলো ভাল না লাগলেও অর্জুন কিছু বলল না। হ্যাঁ, কাজল নিশ্চয়ই অন্যায় করেছে। ওই গরিব বেদের মুক্তো চুরি করেছে আশ্রয় পাওয়ার পরেও। এর কোনও ক্ষমা নেই। এই চরিত্র একদিনে তৈরি হয় না। অবনীবাবু ঠিক কাজ করেছেন ভিসার জন্য সুপারিশ না করে। কিন্তু টুকু কী করে এমন খারাপ ছেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করল!

এখন রাস্তা ঘোট, কিন্তু পরিষ্কার। দুপাশের ছবি যেন বইয়ের পাতা থেকে উঠে এসেছে। যে-গ্রামবাংলার কাহিনী এবং কবিতা একসময় পাঠ্য বইয়ে পড়া যেত, তাই দুপাশে দৃশ্যমান। খুব ভাল লাগছিল অর্জুনের। মনুভাই বললেন, সামনেই খ্রিস্টানপাড়া। এখানকার সবাই খ্রিস্টান। অনেকেই ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনে চাকরি করেন। ঢাকার বড় হোটেলগুলোর কর্মচারীরা এখান থেকেই যান। মিশনারিরা জায়গাটা চালান।

পাঁচিলঘেরা একটি বিশাল এলাকায় সুন্দর ঘরবাড়ি, গিজা দেখা গেল। শান্ত, শব্দহীন। জানা গেল, অনেকেই সুযোগসুবিধে বেশি পাওয়ার আশায় এখানে এসে ধর্মান্তরিত হয়েছেন। কিন্তু এই নিয়ে এলাকায় কোনও ঝামেলা হয়নি। ভেতরের ব্যবস্থা নাকি অত্যন্ত আধুনিক।।

খানিক বাদেই ক্ষুধিত পাষাণের বাড়িটির মতো একটি বিশাল বাড়িকে দেখা গেল। এটি নাকি জমিদারের পরিত্যক্ত বাসভবন। এখন সরকার এটাকে ভবঘুরেদের আশ্রম করেছেন। ঢাকা শহরের রাস্তা থেকে ভবঘুরেদের তুলে এনে এখানে রাখা হয়। তাদের অবশ্য এই নিরাপদে বেশিদিন থাকার বাসনা কখনওই হয় না।

শেষপর্যন্ত কালীগঞ্জ এসে গেল। ঢোকার মুখেই বাজারের গায়ে একটি সুন্দর মসজিদ। এখানে একসময় বিশাল মাটির ঢিবি ছিল। জমিটা মনুভাইদের। তাঁর পূর্বপুরুষ ওই ঢিবি খুঁড়ে এই বাড়ি আবিষ্কার করে তাকে মসজিদে রূপান্তরিত করেছেন।

মনুভাই গাড়ি চালিয়ে চলে এলেন গ্রামের শেষপ্রান্তে। ওঁদের বাড়ির মধ্যেও একটি ছোট মসজিদ আছে। গাড়ি দেখে ছুটে এল অনেক মানুষ। এরা সবাই এই বাড়ির বিভিন্ন কাজে আছে। মনুভাই কাউকে চাচা, কাউকে খালা বলে ডেকে কাজের কথা বলতে লাগলেন। তারপর ইউসুফভাই এবং অর্জুনের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে বনি, আজ কী খাওয়াবেন?

ওঁদের মধ্যে যিনি বৃদ্ধ তিনি বললেন, ছার, মেহমান আইছেন, তাঁদের সম্মান তো রাখতেই হইব। গ্রামের মানুষের যা ক্ষমতা তাই দিয়াই মেহমানদের সেবা করব।

মনুভাই বললেন, অৰ্জুনবাবু, এ হচ্ছে ইদ্রিস, আমার ঠাকুদার আমলের মানুষ। ছেলেবেলায় ওর কোলে-পিঠে চড়েছি কত। আর এ হল দুর্গাদাস। বাবার সবসময়ের সঙ্গী ছিল।

দুগার্দাস খুবই বৃদ্ধ, কিন্তু এখনও তার শরীর সোজা। নমস্কার করে বলল, পুরা নাম দুর্গাদাস কৈবর্ত। কতা আমারে ভালবাসতেন। যৌবনে ডাকাতি করতাম। এই বাড়ির পেছনে যে বিল, তার সব পানি আমার কথা শুনত। একদিন ধরা পড়লাম, জেল হল। কতা আমাকে এই বাড়িতে কাজ দিয়া বললেন, দুর্গা, এবারে আমারে বাঁচা। চারপাশে অনেক শত্রু। কে কাকে বাঁচায়। তিরিশ বছর তাঁর ছায়ার পাশে কোনও দুশমনরে আসতে দিই নাই, কিন্তু ভগবান যেদিন কর্তারে ডাক দিলেন সেদিন আমার মতো মানুষ.. দুর্গাদাস চোখের জল মুছল।

এদের ভাল লাগছিল অর্জুনের। প্রচুর গাছগাছালি চারপাশে, বাড়ির ভেতর পুকুর। ওরা বাড়ির পেছনে যেতেই অর্জুন অবাক। আকাশের শেষ দেখা যাচ্ছে না, শুধু জল আর জল। মনুভাই বললেন, এই হচ্ছে কালীর বিল। এর কথাই দুর্গাদাস আপনাকে বলছিল। আগে এই বিল পেরিয়েই আমাদের যাতায়াত করতে হত। ওই যে আকাশছোঁয়া বটগাছ দেখছেন, দূর থেকে ওটাকে দেখেই নৌকোর মাঝিরা দিক ঠিক করত।

বিলের ধারে গাছের তলায় টেবিল, চেয়ার পেতে দেওয়া হল। অর্জুন, ইউসুফভাই সেখানে বসতেই মনুভাই কাজকর্মের কথা বলতে গেলেন। এখানে তাঁরা নতুন করে মাছচাষের প্রকল্প নিয়েছেন। ইদ্রিস এবং দুর্গাদাস ডাব নিয়ে এল প্রথমে। সেই ডাবের জল গাছের ছায়ায় বসে খোলা জলের দিকে তাকিয়ে খেতে-খেতে অর্জুনের মনে হল এর চেয়ে আরাম সে কখনও পায়নি। ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন, আচ্ছা মিঞা, এখানে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ভাব কীরমকম?

ইদ্রিস বলল, জবাব দাও হে দুর্গাদাস।

দুর্গাদাস বলল, ওই যে দেখতেছেন বাড়িঘর, ওখানে মোছলমানের বাস আর তার এদিকের বাড়িগুলান হিন্দুদের। বাপ-ঠাকুদার মুখেও ধর্ম নিয়ে কাউরে কাজিয়া করতে শুনি নাই। ওসব জিনিস শহরে হইলেও হইতে পারে, কালীগঞ্জে হয় নাই, হইব না।

অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এখানে হিন্দু কত আছেন?

অনেক। তবে বেশিরভাগই গরিব। থাকার মধ্যে আছেন ঘোমশাইরা। তবে তাঁদেরও অনেকে শহরে গিয়া আছে। এখন শেষদশা। ইদ্রিস জবাবটা দিল।

ঘোষমশাইরা কি একসময় বড়লোক ছিলেন?

হ্যাঁ ছার। বাপের মুখে শুনছি সেসব বৃত্তান্ত। এখন কিছু নাই।

শহরে যাঁরা গিয়েছেন তাঁরা আর আসেন না?

না বললেই হয়। আকাশবাবু মাঝে-মধ্যে আসেন।

আকাশ।

ইউসুফভাই মাথা নাড়লেন, সম্ভবত এ.বি.।

অর্জুনের মুখে হাসি ফুটল। তা হলে এ.বি.র পুরো নাম আকাশবিহারী।

গতকাল ইন্ডিয়ার এক মেহমান আসছেন ওই বাড়িতে।

ইন্ডিয়া থেকে প্রায়ই লোক আসে বুঝি?

না ছার। সেই বড় ঘোষবাবুর দেহ রাখার পর আসছিল, তারপর তো কাউরে দেখি নাই।

ওঁদের বাড়িটা কত দুরে?

কাছেই। দুর্গাদাস ঘুরে দাঁড়াল, ওই যে শিমুলগাছটা দেখতেছেন, ওইখানে।

এই সময় মনুভাই ফিরে এলেন, কীরকম লাগছে আমাদের গ্রাম!

দারুণ। বাংলাদেশে এসে যদি ঢাকা থেকেই ফিরে যেতাম, তা হলে কিছুই দেখা হত না। এত সুন্দর জায়গা, ইচ্ছে হচ্ছে কটা দিন থেকে যাই। অর্জুন বলল।

থাকুন। কোনও সমস্যা নেই। এরা আপনার দেখাশোনা করবে। ঘরগুলো তো সব খালি পড়ে আছে। মনুভাই হাসলেন, কিন্তু আমাকে আজই ফিরে যেতে হবে। ইউসুফভাই, আপনিও থাকবেন নাকি?

আমি তো বাড়িতে বলে আসিনি কিছু।

সেটা আমি জানিয়ে দিতে পারি।

তা হলে একটা দিন থাকা যায়।

ভাত এবং মাছের ঝোল খেয়ে মনুভাই প্রায়-বিকেলে গাড়ি নিয়ে ফিরে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন যখনই অর্জুনদের ঢাকায় যাওয়ার ইচ্ছে হবে, কালীগঞ্জের পোস্ট অফিস থেকে টেলিফোন করে দিলে দেড় ঘণ্টার মধ্যে ড্রাইভার এখানে গাড়ি নিয়ে আসবে।

ধুলো উড়িয়ে ওঁর গাড়ি মিলিয়ে গেলে অর্জুন জিজ্ঞেস করল, ইউসুফভাই, আমার জন্য নিশ্চয়ই আপনার কাজকর্মের ক্ষতি হবে?

সেটা সামলে নিতে পারব। কিন্তু ভাই, জীবনে কোনও রহস্য সন্ধানে শামিল হইনি। সুযোগ যখন পাওয়া গেল তখন হাতছাড়া করি কেন? একবার যাবেন নাকি ঘোষবাড়িতে? ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন।

অর্জুন মাথা নাড়ল, এখনই নয়। আপনি নিশ্চয়ই দুর্গাদাসের কথাটা শুনেছেন। ওই বাড়িতে গতকাল একজন অতিথি এসেছেন ইন্ডিয়া থেকে।

হ্যাঁ, শুনেছি।

আমার ধারণা, এই অতিথিটিই বেদেদের মুক্তো চুরি করেছেন।

কাজলবাবু? তা কী করে হবে? উনি তো ঘোষ নন।

মুখার্জি। কিন্তু দূর দেশে এসে ঘোষ সাজতে অসুবিধে কোথায়? অবশ্য এসবই আমার অনুমান। হয়তো কাজল নয়। অন্য লোক এসেছেন। কিন্তু কাজল যদি হয়, তা হলে বলব সাহস আছে ওর। চলুন, গ্রামটা ঘুরে দেখি। বিকেলে হাঁটতে খারাপ লাগবে না। অর্জুন বলল।

ইউসুফভাই হাত নেড়ে দূরে দাঁড়ানো ইদ্রিসকে ডাকলেন, আমরা একটু আপনাদের গ্রাম ঘুরে দেখতে যাচ্ছি।

ইদ্রিস বলল, চলেন, আমিও আপনাদের সঙ্গে যাই।

কালীগঞ্জের রাস্তায় এখনও পিচ পড়েনি। অবশ্য যে প্রধান পথে বাস চলাচল করে, সেটি পিচের। আজকাল এখানে ঢাকার বাস সরাসরি আসে। ইদ্রিস সঙ্গে থাকায় সুবিধে হচ্ছিল। বিভিন্ন বাড়ি, গাছ, মাঠ দেখিয়ে সে একটার পর একটা কাহিনী শুনিয়ে যাচ্ছিল। একটা বিরাট ঝাঁকড়া তেঁতুলগাছ দেখিয়ে ইদ্রিস বলল, এখানে ঘোষবাবুদের এক ছেলে গলায় রশি দিছিল।

ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন, কত বছর আগে?

তা ধরেন, যে বছর পাকিস্তান হইল সেই বছর।

অর্জুন হেসে ফেলল। ছেচল্লিশ বছর ধরে কোনও ভূত তেঁতুলগাছে বসে থাকবে, এমন হতে পারে না। ভূতেদেরও কাজকর্ম থাকে। সেটা দেখে ইদ্রিস বলল, হাসবেন না ছার, অমাবস্যার রাইতে এখনও তিনি আসেন। ঘোষবাবুদের পুকুর থেকে মাছ ধরেন।

আপনি দেখেছেন?

বিমানবাবু দেখছেন।

উনি কি নেশাভাঙ করেন?

প্রশ্নটা ইদ্রিসের পছন্দ হল না। সে গম্ভীর হয়ে গিয়ে বলল, ইনশাআল্লা!

দেখা গেল পুলিশের পোশাক পরা দুজন লোক সামনের পথ ধরে এগিয়ে আসছেন। ওঁদের একজন অবশ্যই অফিসার। ইদ্রিস বলল, সামনের দারোগাবাবু, খুব রাগী।

ওরা যখন মুখখামুখি হল তখন দারোগাবাবু দাঁড়িয়ে গেলেন, নতুন মুখ দেখছি। মহাশয়দের পরিচয় জানতে পারি?

ইদ্রিস বলল, ছার, ইনারা আমাদের বাবুর মেহমান।

কোন বাবু?

মনুভাই।

ও। সাহাবুদ্দিন সাহেব এসেছেন নাকি?

এবার ইউসুফভাই জবাব দিলেন, ওঁর সঙ্গেই আমরা এসেছিলাম। কিন্তু উনি কাজ থাকায় চলে গেছেন, আমরা থেকে গেলাম। আমি মোহম্মদ ইউসুফ। ঢাকায় থাকি, ব্যবসা করি। আর ইনি অর্জুন, ইন্ডিয়া থেকে বেড়াতে এসেছেন।

ইন্ডিয়া থেকে? ওয়েস্ট বেঙ্গল? ওয়েস্ট বেঙ্গলের কোন পার্ট?

জলপাইগুড়ি।

সে কী! আপনি কবে এসেছেন এদিকে?

আজই।

অসম্ভব। আমার কাছে রিপোর্ট আছে আপনি কয়েকদিন আগে এদিকে এসেছেন অসুস্থ হয়ে। আপনাকে আমার সঙ্গে থানায় যেতে হবে।

ইউসুফভাই কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, অর্জুন তাঁকে বাধা দিল, আমি আপনার সমস্যাটা বুঝতে পারছি। থানাটা কত দূরে?

কাছেই। চলেন। মেঘ না চাইতেই পানি পেয়ে গেলাম।

ওঁরা প্রায় পাহারা দিয়ে অর্জুনকে থানায় নিয়ে এলেন। ঘরে ঢুকে ইউসুফভাই বেশ রাগত গলায় বললেন, আপনি খুব ভুল করছেন। এখনই মনুভাইকে পাবেন না, ঘন্টা খানেক বাদে ঢাকায় ফোন করুন, উনি বলবেন অর্জুনবাবু আজই ওঁর সঙ্গে এসেছেন। আচ্ছা, আর-একটা কাজ করা যেতে পারে, আপনি আমার বাসায় ফোন করে জিজ্ঞেস করুন অর্জুন কবে এসেছে?

আপনি কার হয়ে সওয়াল করছেন তা জানেন?

জানি। উনি একজন সত্যসন্ধানী।

কী সন্ধানী?

সত্যসন্ধানী। খুব জোরে জবাব দিলেন ইউসুফভাই।

ব্যাপারটা কী ভাই?।

অর্জুন অস্বস্তিতে পড়ল। সে জবাব দিল, কিছু না। আপনার সমস্যা হল জলপাইগুড়ি শব্দটা। আমরাও আজ বেদেদের মুখে ঘটনাটা শুনেছি। আপনি যাকে খুঁজছেন তিনি আমি নই।

অফিসার কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বসতে বললেন। ওরা বসার পর তিনি বললেন, আপনার কোনও আইডেন্টিটি কার্ড সঙ্গে আছে?

পাশপোর্ট আছে।

দেখি।

অর্জুন পাশপোর্ট বের করে দিলে.ভদ্রলোক পাতা ওলটাতে লাগলেন, পরশু রাত্রে এসেছেন। অতএব সন্দেহ দূর হল। এটা বললেই হত। প্রফেশন টুথ ইনভেস্টিগেটার। মানে কী?

সত্যসন্ধানী। জবাব দিলেন ইউসুফভাই।

কী সত্য খোঁজেন আপনি?

যে-সত্য আগে থেকে বোঝা যায় না।

তার মানে আপনি ডিটেকটিভ?

না। ডিটেকটিভরা অন্য ধরনের মানুষ। আমি সাধারণ।

হুম! এখানে কোন সত্য খুঁজতে এসেছেন?

এখানে এসেছি বাংলাদেশের গ্রাম দেখতে। সত্যিকারের গ্রাম।

অফিসার চিৎকার করে চায়ের হুকুম দিয়ে বললেন, মশাই, সত্য খোঁজা আমাদের চাকরির মধ্যে পড়ে। সেটা খুঁজতে গিয়ে হিমশিম খাই আমরা। আর আপনারা মোটা টাকা দক্ষিণা নিয়ে সেই কাজটা করেন। গোয়েন্দা-উপন্যাসে পুলিশ যা পারে না, তাই গোয়েন্দারা পারে। আপনারা কি আমাদের চেয়ে বেশি বোঝেন?

মোটেই নয়। আমি গোয়েন্দাও নই।

শুনুন। জলপাইগুড়ি থেকে এক জোচ্চোর এখানে এসেছে। অবশ্য কালীগঞ্জেই যে আছে এমন কোনও প্রমাণ নেই। এখানে আর-এক ভদ্রলোক এসেছেন ঘোষবাড়িতে, কিন্তু তাঁর দাড়ি নেই।

দাড়ি নেই মানে?

বেদেরা বলেছে, যাকে ওরা আশ্রয় দিয়েছিল তার দাড়ি ছিল।

ও। দেখুন, দাড়ি তো কেটে ফেলা যায়।

তা যায় কিন্তু…। চিন্তায় পড়লেন অফিসার। উনি কদিন থাকবেন এখানে?

দু-চারদিন।

নামটা কী?

সাগরবিহারী ঘোষ।

অর্জুন হেসে ফেলল। কাজল মুখার্জি নিঃসন্দেহে বুদ্ধিমান। এই পরিবারের সঙ্গে মেলানো নাম খুঁজে পেয়েছে। খাওয়া হয়ে গেলে অর্জুনরা বিদায় চাইল। অফিসার পাশপোর্ট ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, যদি কোনও প্রয়োজন হয় নির্দ্বিধায় চলে আসবেন।

অনেক ধন্যবাদ।

ইদ্রিস তাদের বাইরে আসতে দেখে খুশি হল। তখন ধুপছায়া নেমে গেছে পৃথিবীতে। অর্জুন ইদ্রিসকে বলল, রাত হওয়ার আগে আমরা একবার ঘোষবাবুদের বাড়িটা দেখতে চাই।

চলেন কর্তা। ইদ্রিস এগিয়ে চলল।

ঘোষবাবুদের অবস্থা যে এককালে ভাল ছিল, তা দূর থেকে বাড়িটাকে দেখেই বোঝা যায়। এখন অযত্ন এবং অর্থাভাব একসঙ্গে মিশে যাওয়ায় হতশ্রী হয়ে আছে। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই অর্জুন ছাদে একজন যুবককে দেখতে পেল। কৌতূহলী চোখে তাদের দেখছে। তারপর ধীরে ধীরে সরে গেল। বাড়িটা দোতলা। ঘর অনেক।

অর্জুন জিজ্ঞেস করতে গিয়ে থমকে গেল। বাড়ির সামনেই একটি শিবমন্দির। মন্দিরের দশা খুবই করুণ। এখন নিয়মিত পুজো হয়তো হয়, কিন্তু অনেককাল সংস্কার হয়নি, শিবমন্দিরের ডান দিকে কোনও বটগাছ নজরে পড়ল না। বস্তুত কোনও বটগাছই ধারেকাছে নেই। সে বলল, বাড়িটার যা চেহারা, তাতে আশেপাশে একটা বটগাছ থাকলে ভাল হত।।

ইদ্রিস সঙ্গে সঙ্গে মাথা নাড়ল, ছিল ছার। একটা বটগাছ এখানে ছিল। যে বছর দেশ স্বাধীন হইল, সেই বছরের ঝড়ে গাছ ভাঙ্গে। এনারা তখন গাছ কেটে ফেলেন।

বটগাছটা কোথায় ছিল? অর্জুন উত্তেজিত।

হেইডা তো মনে নাই।

এই সময় একটি কণ্ঠস্বর ভেসে এল, কী ব্যাপার ইদ্রিস মিঞা?

ওরা দেখল প্রায়-অন্ধকার বাড়ি থেকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন। মানুষটি ফর্সা কিন্তু রুগণ চেহারা। পরনের ধুতি, গেঞ্জি পরিচ্ছন্ন।

সালাম কতা। ওই বটগাছটার কথা বলতে ছিলাম।

হঠাৎ বটগাছের কথা কেন?

ছার নিজেই–।

ইদ্রিসকে বাধা দিলেন ইউসুফ ভাই, আমরা আজই আপনাদের গ্রামে এসেছি। মনুভাই, মানে সাহাবুদ্দিন আমাদের বন্ধু। বেড়াতে-বেড়াতে এখানে এসে মনে হল আপনার বাড়ির সঙ্গে বটগাছ থাকলে ভাল হত।

তা অবশ্য, আরও প্রাচীন দেখাত। আমার নাম বিমানবিহারী ঘোষ।

আচ্ছা! আপনার কথা আমি আকাশবিহারীর কাছে শুনেছি।

ও। সে আমার ভাইপো। লোক পাঠিয়ে খবর দিয়েছে দুদিন বাদে শুটিং করতে আসবে। ওসবের সঙ্গে সে কবে জড়িত হল আপনি জানেন?

খুব সম্প্রতি বলে মনে হয়।

হুম! আমাদের অবস্থা খুব ভাল নয়। চাষবাস থেকে কোনওমতে চলে। কদিন থাকবেন আপনারা? বিমানবিহারী জানতে চাইলেন।

দু-একদিন। অর্জুন জবাব দিল, তা হলে এখানে বটগাছ ছিল?

অবশ্যই ছিল। একাত্তর সালে বাজ পড়ে। সেইরাত্রে ঝড়ও হয়েছিল। ফলে কেটে ফেলতে হয়। গাছটা ছিল খুব পুরনো। এবাড়িব একজন হয়ে গিয়েছিল। বিমানবিহারী যখন কথা বলছিলেন তখন অর্জুন আশপাশে পুকুর খুঁজছিল। বটবৃক্ষ থেকে দশ পা পূর্ব দিকে গেলে এবাড়ির দোতলার শেষ জানলাটাকে দেখা যাবে। সেই জানলাটাকে নজরে রেখে একটু ডান দিকে হাঁটলেই পুকুরের ধাপ শুরু হওয়ার কথা। কিন্তু পুকুরের কোনও চিহ্ন আশপাশে নেই। বটগাছ যখন ছিল, তখন পুকুরটারও তো থাকার কথা।

হঠাৎ বোধ হয় খেয়াল হয়েছে বিমানবিহারীর, বললেন, আপনারা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন কেন? আসুন, ভেতরে আসুন।

অর্জুন বলল, আজ নয়। আর-একদিন আসা যাবে। এখানে এসে দেখছি বিল থাকা সত্ত্বেও সবার বাড়িতে পুকুর আছে। আপনাদের নেই?

আছে। আগে দু-দুটো ছিল, এখন একটা। সেটা পেছনে।

আগেরটা?

ওই জমিটা বিক্রি করে দিয়েছি খালেদকে। ওখানে একটা পুকুর ছিল। কেনার পরে খালেদ পুকুরটাকে বুজিয়ে দিয়েছে। আচ্ছা, অবস্থাপন্ন বাড়িতে বটগাছ এবং পুকুর থাকাটা কি খুব স্বাভাবিক? বিমানবিহারী হেসে জিজ্ঞেস করলেন।

কেন বলুন তো? অর্জুন জানতে চাইল।

আমার এক জ্ঞাতি এসেছেন ইন্ডিয়া থেকে, তিনিও বটগাছ এবং পুকুরের খোঁজ করছিলেন।

তাই নাকি? বটগাছটা ছিল কোথায়?

ওইখানে। আঙুল দিয়ে জায়গাটা দেখালেন বিমানবিহারী।

অর্জুন ওপরে মুখ তুলল। তার মনে হল, অন্ধকার নেমে আসা বাড়ির ছাদে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। লোকটা কাজল হতে পারে। ওকে তো সবসময় সতর্ক থাকতেই হবে। কিন্তু ওর কথা বিমানবিহারীকে কীভাবে বলা যায়? মানুষটাকে জটিল মনে হচ্ছে না, ওঁকে সতর্ক করে দেওয়া উচিত।

আপনাদের নাম জানতে পারলাম না। বিমানবিহারী বললেন।

আমি ইউসুফ, ঢাকায় থাকি, ব্যবসা করি। উনি অর্জুন।

এখনও ছাত্র?

না, না। আচ্ছা নমস্কার। অর্জুন আর কথা বাড়াতে চাইল না। বিদায় নিয়ে ওরা ফিরে যাচ্ছিল মনুভাইয়ের বাড়ির দিকে। ইদ্রিস পিছিয়ে পড়েছে দেখে ইউসুফভাই জিজ্ঞেস করলেন, ওই বাড়ির মাটির তলায় যে সোনা লুকনো আছে, তা পেলে বিমানবিহারী বাকি জীবনটা আরামে থাকতে পারবেন। কিন্তু ওঁকে সে-কথা বললেন না কেন?

অর্জুন বলল, প্রথম আলাপেই ওসব বলা ঠিক নয়। তা ছাড়া খবরটা যদি মিথ্যে হয়?

তা বটে। আমি একটু বুদ্ধি খরচ করব?

অর্জুন হাসল, অবশ্যই।

ওই বটগাছটার সঙ্গে কি সোনাদানার কোনও সম্পর্ক আছে?

বাঃ। আরও বলুন।

বিমানবিহারীর বাড়িতে জ্ঞাতি হিসেবে যে এসেছে সে হল কাজল। তাই তো?

অনুমান সেইরকমের। তা হলে কথাটা আমি কাউকে জানাচ্ছি না কেন?

অবশ্যই। বাজে লোককে প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয়।

আর-একটু দেখাই যাক না।

মনুভাইয়ের বাড়িতে ইলেকট্রিক লাইট আছে। সন্ধের পর ঘরে বসে মুড়ি আর চা খাওয়া চলছিল। অর্জুন দুর্গাদাসকে খবর দিয়েছিল দেখা করার জন্য। ইদ্রিস মিঞা তখন গল্প শোনাচ্ছিল, বড়বাবুর ইন্তেকাল হওয়ার পর এই বাড়ির পতন হইছে ছার। তাঁকে সবাই এত ভালবাসত যে, আট হাজার মানুষকে খাওয়াইতে হইছিল। সেসব দিন আর নাই।

ডাকছেন ছার? দুর্গাদাস দরজায় এসে দাঁড়াল।

হ্যাঁ। তুমি তো এককালে নৌকো নিয়ে বিলে ঘুরে বেড়াতে। আজ রাত্রে আমাদের নিয়ে বের হবে?

নিশ্চয়ই।

নিশ্চয়ই, এর বুদ্ধি আছে কিন্তু মাথায় নাই। খেকিয়ে উঠল ইদ্রিস মিঞা, বুড়া হইছিস, কত্তদিন নৌকা চালাস না, রাতের বেলা মেহমানদের যদি বিপদ হয়, কী জবাব দিবি?

আরে মিঞা, মরা হাতি লাখ টাকা। ভরসা রাখো। তাকে আশ্বাস দিল দুর্গাদাস।

আজ কৃষ্ণপক্ষের রাত হলেও আকাশে মায়াময় আলো ছিল। রাতের খাওয়া সেরে ওরা দুগদাসের নৌকোয় উঠল। বৃদ্ধ বয়সেও দুগাদাসের শরীর ঈর্ষা করার মতো। খালি গা, মালকোঁচা মারা ধুতি, লগি নিয়ে বসেছে নৌকোর একপ্রান্তে। পাশে একটা সড়কি। ওই অস্ত্রটির কী প্রয়োজন, জিজ্ঞেস করাতে জানাল, কখন কী হয় তা কে বলতে পারে?

দিগন্তবিস্তৃত বিলে মিনিট পনেরো এলোমলো ঘুরে বেড়াল অর্জুনরা। চমৎকার বাতাস বইছে। একটু শীত শীত করছে। ধীরে-ধীরে গ্রামের সব আলো নিভে গেল। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখনও এই অন্ধকারে দেখতে পাচ্ছ দুর্গাদাস?

হুকুম করেন।

শিমুলগাছটা কোথায়?

মুখ ঘুরিয়ে দেখে নিয়ে দুর্গাদাস হাত তুলল, ওই যে।

কালচে আকাশের সামনে ঝাপসা কিছু নজরে এল অর্জুনের। সে বলল, কাউকে জানান না দিয়ে আমরা ওখানে যেতে চাই দুর্গাদাস।

নৌকো ঘুরল। সামান্য জলের শব্দ ছাড়া কোনও আওয়াজ নেই কোথাও। যদি কেউ এ আসা বাড়ির ছাদ থেকে তাদের লক্ষ করে, তা হলে চিনতে পারবে কি না সন্দেহ। গাছটার কাছে পৌঁছে যাওয়ামাত্র চাপা গলায় অর্জুন দুর্গাদাসকে থামতে বলল। মুহূর্তেই যেন অতীতের রক্তের ডাক শুনতে পেল দুর্গাদাস। লগি রেখে সড়কি তুলে নিয়ে যেরকম সতর্ক ভঙ্গিতে বসল, তাতে সেইরকম মনে হল অর্জুনের। ঘোষবাড়ির কারও কোনও সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। এবার হাওয়ায় দুলছে নৌকো। অর্জুনের বিশ্বাস, আজ রাত্রে কাজল একটা চেষ্টা করবে। সে যদি বটগাছটা কোথায় ছিল জেনে গিয়ে থাকে, তা হলে দেরি করার ঝুঁকি নিশ্চয়ই নেবে না।

রাত যখন বারোটা, মশার কামড়ে বসে থাকা কষ্টকর হয়ে উঠছে, সেই সময় দুর্গাদাস চাপা গলায় বলল, ছার। দ্যাখেন! একজনার মতলব ভাল নয়।

ওরা দেখতে পেল। একটি মানুষ বারংবার বিশেষ একটা জায়গায় পায়চারি করছে। শিবমন্দির সামনে থাকায় তাকে মাঝে-মাঝেই দেখা যাচ্ছে না। অর্জুন বুঝতে পারল ওটা পায়চারি নয়, জমি মাপছে কাজল। বটগাছ থেকে দশ পা পুব দিকে গেলে বাড়িটির দোতলার শেষ জানলা দেখা যাবে। দশ পা মিলিয়ে নিচ্ছিল সে।