০৬. সারাটা দিন বই পড়ে

সারাটা দিন বই পড়ে আর ঘণ্টাখানেক সময় ডক্টর পত্ৰনবীশের সঙ্গে গল্প করে দিব্যি সময় কেটে গেল। ভদ্রলোক তাঁর গবেষণার বিষয় ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনও খবরে যেমন আকৃষ্ট নন, তেমনই কথা বলতে গেলেও নিজের বিষয় চলে আসে তাঁর ঠোঁটে। শুনতে-শুনতে অর্জুনের মনে হচ্ছিল, সত্যি, আমরা কিছুই জানি না। সমুদ্রের নীচে জলের তলায় প্রতিনিয়ত কত কী সংঘর্ষ হচ্ছে এবং তার ফলে যে শব্দমালা জলের মধ্যে জন্মে জলেই মুখ ড়ুবিয়ে মরে যাচ্ছে, তার খবর কি আমরা রাখি? আকাশ তো আরও বিশাল ব্যাপার। শব্দ তৈরি হতে গেলে সংঘর্ষ দরকার। এটা প্রাথমিক নিয়ম। কিন্তু মেয়েদের ওপাশে অনন্ত আকাশে কোনও বস্তু নেই, যা পরস্পরকে আঘাত করবে। তা হলে শব্দ হবে কী করে? যেখানে বাতাস নেই সেখানে? একেবারে অজ্ঞ গলায় এই প্রশ্নটি সে ডক্টর পত্ৰনবীশকে করেছিল। ডক্টর পত্ৰনবীশ বলেছিলেন, বস্তু নেই কে বলল? এত গ্রহ উপগ্রহ নক্ষত্র মহাকাশের সংসারে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা কী করতে আছে? অৰ্জুন বলেছিল, তারা তো প্রতিনিয়ত পরস্পরকে আঘাত করছে না। ডক্টর হাসলেন, যা করছে তার অনুরণন দীর্ঘকাল ধরে অনুরণিত হয়ে চলেছে, যার খবর পৃথিবীর মানুষের কাছে অজানা। আর প্রতিনিয়ত যে হচ্ছে না তাই বা জানছি কী করে? আজ রাত্রে আমার গবেষণাঘরে তুমি একবার এসো। গতকাল আমি এক শব্দ পেয়েছি। খুব ক্ষীণ। তোমাকে শোনাব।

বিকেলবেলায় অর্জুন বেরিয়ে পড়ল সেজেগুজে। ডক্টর পত্ৰনবীশের কথা তার মাথায় পাক খাচ্ছিল। আমরা যেটা বুঝি না সেটাকে অস্তিত্বহীন ভাবলে খুশি হই অথবা আমাদের জাগতিক ধ্যানধারণী থেকে যা সত্যি বলে মনে হয় তার বাইরে কোনও কিছুর অস্তিত্বকে স্বীকার করতে চাই না। আবার একদল আছেন যাঁরা জোর করে অস্তিত্বহীনকে স্থায়ী প্রমাণ করতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। লোকে যা বলে তার উলটোটা ভাবাই তাঁদের নেশা। ডক্টর পত্ৰনবীশকে এঁদের দলে ফেলতে ইচ্ছে করছে না। ভূত নেই তা আমরা সবাই জানি। কিন্তু পৃথিবীর অনেক শিক্ষিত মানুষও ভূতে বিশ্বাস করেন। তাঁরা প্রমাণ করার চেষ্টাও করেছেন। তেমন পরিস্থিতিতে সবল মানুষও ভীত হন। মনের ডাক্তাররা বলবেন মানুষের মনে সবসময় যে আতঙ্ক সুপ্ত থাকে ভৌতিক পরিবেশ তাকে উসকে দেয়। এই ব্যাখ্যা অনেকে মানতে চান না। বস্তুত ব্যাখ্যা করে কি কারও বিশ্বাস অর্জন করা যায়? পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘজীবী প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম হল কচ্ছপ। তারা সমুদ্রে থাকে। যখন তাদের ডিম পাড়ার সময় হয় তখন তারা জল ছেড়ে তীরে উঠে আসে কেন? কে শিখিয়েছে তাদের জলে ডিম পাড়লে তা অন্য মাছ খেয়ে নেবে, নষ্ট হয়ে যাবে? বালিতে উঠে এসে তারা কেন বালি খুঁড়ে গর্ত করে! কে বলে দিয়েছে বালির ওপর ডিম পাড়লে পাখিরা খেয়ে নেবে? সেই গর্তে ডিম পেড়ে তারা বমি করে অনেকটা। তারপর বালিচাপা দিয়ে আবার ফিরে যায় জলে। বালির উত্তাপে ডিম ফেটে বাচ্চা বেরিয়ে প্রথম কয়েকদিন ওই বমি খেয়ে বালির তলায় বেঁচে থাকে। তারপর একটু শক্ত হলে বালি ফুঁড়ে বেরিয়ে জলে নামে। ডিম থেকে বাচ্চা বের হলে তার খাদ্যের প্রয়োজন হবে এটা মা কচ্ছপ জানল কী করে? তার তো কোনও অভিজ্ঞতা নেই, কেউ শেখায়নি। আবার বালি কুঁড়ে বেরিয়ে বাচ্চা কচ্ছপ মাটির দিকে না এগিয়ে জলের দিকে হাঁটে কেন? কোন যুক্তিতে? জীববিজ্ঞানীরা এর ব্যাখ্যায় যে শব্দটি ব্যবহার করেন তা হল ইনস্টিংক্ট। যুক্তি যখন ধারালো নয় তখন ওই শব্দটির নির্বাচন চমৎকার আড়াল তৈরি করতে পারে।

একটা কচ্ছপের এই আচরণের কৈফিয়ত যখন আমরা ঠিকঠাক দিতে পারি তখন ডক্টর পত্ৰনবীশের গবেষণা নিয়ে মাথা ঘামানোর অধিকার তার নেই। উনি যদি সফল হন তা হলে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। ততদিন অপেক্ষা করাই ভাল। অর্জুন যখন হেঁটে গতকালের ফুচকাওয়ালার কাছে পৌঁছল তখন সন্ধে হয়ে গেছে। দুটো বাচ্চাকে নিয়ে একজন মহিলা ফুচকা খাচ্ছিলেন। গত সন্ধের বৃদ্ধকে সে দেখতে পেল না। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ফুচকাওয়ালা হাতের কাজ শেষ করে জিজ্ঞেস করল, দেব বাবু?

অর্জুন মাথা নেড়ে না বলল। তারপর জিজ্ঞেস করল, গতকাল আমি এখানে এসে একজন বুড়োমানুষের সঙ্গে কথা বলেছিলাম মনে আছে? লোকটা সামান্য ভেবে বলল, । ওই মোড়ের বাড়ির বাবু।

উনি তো রোজ তোমার ফুচকা খেতে আসেন। আজ আসেননি?

না।

আসার সময় তো যায়নি, তাই না?

না বাবু। রোজ বিকেলে হাঁটতে খাওয়ার আগে উনি বলে যান ওঁর জন্যে আলাদা মশলা বানাতে। ফিরে যাওয়ার সময় যান। কিন্তু আজ আসেননি। বোধ হয় শরীর ভাল নেই, বুড়োমানুষ তো!

ওঁর সঙ্গে আমার একটু দরকার ছিল যে–কোন বাড়িতে থাকেন বললে?

ফুচকাওয়ালা একটু এগিয়ে এসে আঙুল তুলে দেখাল! রাস্তাটা যেখানে বাঁক নিয়েছে তার বাঁ দিকের হলুদ বাড়িটায় বৃদ্ধ থাকেন বলে সে জানাল।

অর্জুন একটু রোমাঞ্চিত হল। ওই পথে সেই ফোটোগ্রাফার ভদ্রলোক হেঁটে গিয়েছিল দূর্বাঘাস নিয়ে। দুপাশের বাড়িগুলো নিঝুম। ভেতরে আলো জ্বললেও জানলা-দরজা বন্ধ। ডক্টর পত্ৰনবীশ বলছিলেন সল্ট লেকের বাসিন্দাদের প্রধান শত্রুদের মধ্যে অন্যতম হল মশা এবং চোর। একপাশের খাল আর অন্যপাশের জলাভূমি থেকে জন্মমাত্র হাজার-হাজার মশা সল্ট লেকের বাসিন্দাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আর সন্ধের পর তো বটেই, দিনদুপুরে একতলা, কখনও দোতলার জানলা খোলা পেলে ছিচকে চোরের দল সরু লাঠি ঢুকিয়ে জিনিসপত্র জামাকাপড় নিয়ে যায়। এই দুই দুবৃত্তের হাত থেকে বাঁচবার জন্যে প্রতিটি বাড়ির জানলা-দরজা বন্ধ রাখা হয়। অর্জুন দেখল এর ফলে এত সুন্দর সাজানো উপনগরীর কোথাও প্রাণের স্পর্শ নেই। ডান দিকের মোড় ঘোরার সময় দাঁড়িয়ে গেল অর্জুন। হলুদ বাড়িটার জানলা দরজা বন্ধ। গেটের গায়ে লেখা আছে, কমলাপতি মুখোপাধ্যায়, সন্ধ্যারানি মুখোপাধ্যায়। তা হলে কি বৃদ্ধের নাম কমলাপতি? সে এগিয়ে গিয়ে গেট খুলে ভেতরে ঢুকে দরজার পাশে বেলের বোতামে চাপ দিল।

অর্জুন চারপাশে তাকাল। কোনও মানুষ নেই। সে যে একটি বাড়িতে আগন্তুক তা কেউ লক্ষ করছে না। দ্বিতীয়বার চাপ দেওয়ার পর দরজা সামান্য ফাঁক হল। ভেতরে চেন আটকানো রয়েছে। জোর করলেও খুলবে না কিন্তু এক ইঞ্চিটাক ফাঁক থাকবে। সেই ফাঁকের ভেতর থেকে একজন মহিলা প্রশ্ন করলেন, কী চাই? ঘরের হালকা আলোয় কিছুই দেখা যাচ্ছে না।

কমলাপতিবাবু আছেন?

ওঁর শরীর খারাপ।

ও!

কিছু দরকার আছে? কোত্থেকে আসছেন?

বলুন, কাল সন্ধেবেলা ওঁর সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছিল। ডক্টর হালদারের বাড়িতে যে ফোটোগ্রাফার আছেন তাঁকে নিয়ে কথা হয়েছিল।

আমার নাম অর্জুন। যদি একটু দেখা করেন তা হলে খুব খুশি হব।

জবাব না দিয়ে মহিলা চলে গেলেন। মিনিট দুয়েক পরে ঘরে বড় আলো জ্বলল। মহিলাই দরজা খুলে বললেন, বসুন।

অর্জুন ঘরে ঢুকল। নিপাট ভদ্রলোকের ড্রইংরুম। মহিলাটি যে বাড়িতে কাজ করেন, তা সে অনুমান করল। একটা ছোট সোফায় বসল অর্জুন। মহিলা দরজা বন্ধ করে চলে গেলেন ভেতরে। এবং তখনই সেই বৃদ্ধ দরজায় এসে দাঁড়ালেন, কে? হ্যাঁ, দেখেছি মনে হচ্ছে। কালকেই তো পার্কে দেখা হল, তাই না? বৃদ্ধ অনাবশ্যক জোরে কথাগুলো বললেন। অর্জুন ঘাড় নাড়ল। কিন্তু সে আপত্তি জানাবার আগেই বৃদ্ধ বললেন, তা পার্কে যখন কথা হল তখন তো বললানি বাড়িতে আসবে। কী দরকার বলো, আমার শরীরটা ভাল নেই। বৃদ্ধ ধীরে-ধীরে উলটোদিকের সোফায় এসে বসলেন।

অর্জুন নিচু গলায় বলল, আপনার দেখছি মনে নেই, পার্কে নয়, ফুচকাওয়ালার সামনে আপনার সঙ্গে আমি কথা বলেছিলাম।

সঙ্গে-সঙ্গে ঠোঁটের ওপর আঙুল তুলে চুপ করতে বললেন বৃদ্ধ। চট করে দরজাটা একবার দেখে নিলেন। তারপর টেবিল থেকে কাগজ তুলে পকেট থেকে কলম বের করে ফস ফস করে লিখলেন, আমি ফুচকা খাই, বাড়িতে জানে না। জানলে কুরুক্ষেত্র হবে। কাল ওই ফুচকা খেয়ে সাতবার টয়লেট ছুটেছি। কারণ কাউকে বলতে পারছি না বলে ফুচকাওয়ালা বেঁচে গেল এ-যাত্রায়। লেখাটা অর্জুনকে পড়িয়ে কাগজটা ফিরিয়ে নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে ফেলে সেগুলো কলমের সঙ্গে পকেটে ভরে ফেললেন।

অর্জুন হাসল এই লুকোচুরি দেখে। বলল, আপনার শরীর খারাপ জানতাম না–।

ঠিক আছে। আমার কাছে কী উদ্দেশ্যে এলে? দ্যাখো বাপু, আমি কোনওরকম ডোনেশন করতে পারব না। তা ছাড়া তোমাকে আমি চিনিও না। কোথায় যেন থকো বলছিলে?

পাশের পাড়ায়। ডক্টর পত্ৰনবীশের বাড়িতে এসেছি। আমার বাড়ি জলপাইগুড়িতে।

জলপাইগুড়ি? চমৎকার শহর ছিল। নাইনটিন ফিফটি টু থেকে ফিফটি ফাইভ আমি ওখানে ছিলাম চাকরিসূত্রে। এন সি রায়, চারু সান্যাল এঁদের নাম শুনেছ?

আজ্ঞে হ্যাঁ।

তা এবার খোলসা করে বলো।

আপনি বলেছিলেন এ-পাড়ায় ডক্টর হালদারের বাড়িতে একজন ফোটোগ্রাফার থাকেন। আপনার মনে পড়ছে?

বিলক্ষণ। কেয়ারটেকার করে গেছে ডক্টর হালদারের মেয়ে।

কতদিন আগে?

মাসদেড়েক হবে। কী ব্যাপার?

উনি যে ফোটোগ্রাফার তা আপনি জানলেন কী করে?

প্রায়ই ক্যামেরা কাঁধে নিয়ে বেরোতে দেখি। আমার শোয়ার ঘর থেকে ওদের সদর দরজা স্পষ্ট দেখা যায়।

আপনার সঙ্গে আলাপ নেই?

আলাপ বলতে যা বোঝায় তা নেই। এক-আধবার যেচে কথা বলে দেখেছি তিনি মুখ খোলেননি।

আর কে আছে ওই বাড়িতে?

ভদ্রলোক তো একাই যাওয়া-আসা করেন। বাড়িতে কাজের লোকও রাখেননি। হয়তো বিদেশে ছিলেন বলে নিজের কাজ নিজেই করে নেন। কিন্তু ভাই, তুমি ওর সম্পর্কে এত ইন্টারেস্টেড কেন?

এই দূর্বাঘাসই আমাকে সমস্যায় ফেলেছে।

দূর্বাঘাস? ঠিক বুঝলাম না।

আপনি বলেছিলেন ওবাড়িতে কোনও পোষা প্রাণী নেই। অথচ ভদ্রলোক তাঁর অসুস্থ পোষা প্রাণীর জন্যে পার্ক থেকে দূর্বাঘাস তুলে নিয়ে গেছেন।

তাতে তোমার কী? আরে সল্ট লেকের নিয়ম হল কেউ, কারও ব্যাপারে নাক না গলানো। তুমি কী করো? প্রশ্ন করার সময় কমলাপতিবাবু সোজা হয়ে বসলেন হঠাৎই।

আমি সত্যসন্ধান করি।

সত্যসন্ধান? তার মানে গোয়েন্দাগিরি? উঃ। একটু দাঁড়াও, ফুচকার রিঅ্যাকশন, আমি এখনই ঘুরে আসছি। প্রায় বিদ্যুদ্বেগে ভদ্রলোক ঘর ছেড়ে গেলেন।

জানলা বন্ধ। অর্জুনের খুব ইচ্ছে হচ্ছিল বাড়িটাকে ভাল করে দেখতে। কিন্তু তার পক্ষে এখনই উঠে যাওয়া সম্ভব নয়। কমলাপতিবাবু ফিরে এলেন মিনিট পাঁচেক বাদে। এখন তাঁকে বেশ হালকা দেখাচ্ছে। এসে বললেন, এত কম বয়সের গোয়েন্দা দেখা যায় না। কার্ড আছে?

অর্জুন সদ্য করানো কার্ড পার্স থেকে বের করে দিল। সেটা ভাল করে পড়ে কমলাপতিবাবু বললেন, তুমি করেছ কী হে? জলপাইগুড়ির ঠিকানা, তার মানে সেখানে বসেই গোয়েন্দাগিরির ব্যবসা চালাচ্ছ? কেস পাও?

আমি একে ঠিক ব্যবসা বলে ভাবি না। আচ্ছা, অনেক ধন্যবাদ। অর্জুন উঠে দাঁড়াতে কমলাপতি হাঁ-হাঁ করে উঠলেন, কীরকম গোয়েন্দা হে তুমি? আমাকে ভাল করে জেরা না করেই চলে যাচ্ছ?

অর্জুন হেসে ফেলল, আপনার এব্যাপারে কিছু বলার আছে?

অবশ্যই। তুমি ওই ফোটোগ্রাফারকে কোনও কারণে সন্দেহ করছ। নিশ্চয়ই ব্যাটা কোনও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। আমি তখনই ভেবেছিলাম ওইভাবে একা-একা থাকার পেছনে নিশ্চয়ই কোনও কারণ আছে। আমার কাছে ডক্টর হালদারের ছেলের টেলিফোন নাম্বার আছে। তাকে ফোন করলেই লোকটার সম্পর্কে জানা যাবে।

উনি কোথায় থাকেন?

নিউ জার্সি, আমেরিকায়। ছেলের সঙ্গে ও-দেশে যাওয়ার আগে ওর মা আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন। তখনই ঠিকানা, নাম্বার দিয়ে যান। ফোন করবে?

করলে তো ভাল হয়।

কমলাপতি বললেন, বেশ, তা হলে ওপরে চলল। নীচের লাইনটা গোলমাল করছে। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, আমার স্ত্রীকে খবরদার ফুচকার কথা বলবে না।

ঠিক আছে। কিন্তু বিদেশে ফোন করার খরচ তো অনেক।

আঃ, ছাড়ো তো। এ বয়সে জীবন আলুনি হয়ে যাচ্ছে। রোজ-রোজ তো এমন উত্তেজনার সুযোগ পাওয়া যায় না। চলো। ।

অগত্যা কমলাপতিকে অনুসরণ করল অর্জুন। তার কার্ড দেখার পর থেকেই যে ভদ্রলোকের ব্যবহার পালটে গিয়েছে এটা স্পষ্ট। দোতলায় উঠে ভদ্রলোক ডাকলেন, ওগো শুনছ? একটু বেরিয়ে এসো।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গে এক বৃদ্ধা জায় এসে দাঁড়ালেন। কম বয়সে যে তিনি অত্যন্ত সুন্দরী ছিলেন তা এখনও বোঝা যায়। কমলাপতি পরিচয় করিয়ে দিলেন, এই ছোকরার নাম অর্জুন। জলপাইগুড়িতে থাকে। ডক্টর চারু সান্যালকে চেনে। কী করে জানো?

বৃদ্ধা নীরবে ঘাড় নাড়লেন।

সত্যসন্ধান। হা হা হা। ইংরেজিতে যাকে বলে ডিটেকটিভ, এ হল তাই।

বৃদ্ধা বললেন, বাঃ, ভালই হল। আমি ভাবছিলাম কোনও কারণ ছাড়াই মাঝে-মাঝে তোমার পেট কেন খারাপ হয় তা খুঁজে বের করতে ডিটেকটিভ লাগাব।

কমলাপতি আচমকা গম্ভীর হয়ে গিয়ে বললেন, এসো অর্জুন, এই ঘরে।

ঘরে ঢুকে বোঝা গেল এটা একটা বেডরুম কিন্তু সেই কাজে ব্যবহৃত হয় না। টেবিলের ওপর ফোনের পাশে থাকা একটা ডায়েরি খুললেন কমলাপতি। অর্জুন জিজ্ঞেস করল, এদিকের জানলাটা একটু খুলতে পারি?

জানলা? মশা ঢুকবে যে। অবশ্য এখন সন্ধে পেরিয়ে গিয়েছে, খোলো।

অর্জুন জানলা খুলল। সামনেই রাস্তা। রাস্তার ওপাশে লম্বা দেবদারু গাছের সারি। উলটো দিকের বাড়িটা সেই গাছের আড়ালে অনেকটাই চাপা পড়ে গিয়েছে। শুধু দেখা যাচ্ছে দোতলায় আলো জ্বলছে এবং তার একটি জানলা খোলা। অর্থাৎ ফোটোগ্রাফার বাড়িতে আছে। বাড়ির একতলা অন্ধকার এবং সদর দরজা বন্ধ।

বিদেশের নাম্বার ডায়াল করা ঝকমারি। আঙুল ব্যথা হয়ে যায়। আচ্ছা, এখন ওদের সময়টা কী? সকাল হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়ই। নিজের মনেই কথা বলতে বলতে কমলাপতি বলে উঠলেন, হ্যালো? হ্যাঁ, মিসেস হালদার আছেন? ও, আপনি ওঁর ছেলে? আমি কমলাপতি মুখোপাধ্যায় বলছি, সল্ট লেকের উলটো দিকের বাড়ি। চিনতে পেরেছেন? গুড! আচ্ছা, আপনার বাড়িতে যিনি কেয়ারটেকার হিসেবে আছেন তাঁকে চেনেন ভাল করে? কী? আপনি জানেন না কেউ এখানে কেয়ারটেকার হিসেবে আছে কিনা? আরে আপনার বোনই তো কিছুদিন আগে রেখে গেছেন। আপনার বোন বলেননি? তাঁকে জিজ্ঞেস করুন। আমার নাম্বার আপনার মায়ের কাছে আছে। জেনে আমাকে জানালে খুশি হব। একটু সমস্যা হয়েছে। রাখছি। ঝপ করে টেলিফোন নামিয়ে রেখে কমলাপতি চোখ বড় করলেন, বোন দাদাকে না জানিয়ে লোকটাকে এখানে রেখেছে।

তাই?

কীরকম বিল উঠবে বলো তো?

আচমকা প্রসঙ্গ পালটাতে হেসে ফেলল অর্জুন, আমার ধারণা নেই।

যাকগে। এখন কী করা যায়? আচ্ছা, লোকটাকে গিয়ে চার্জ করব?

কী ব্যাপারে?

ওর আইডেন্টিটি?

উনি যা বলবেন তাই আপনাকে মেনে নিতে হবে। তারপর?

এই সময় কাজের লোকটি এক কাপ চা নিয়ে এল। কমলাপতি বললেন, উনি তোমাকে ঘুষ দিচ্ছেন। চা খাও কিন্তু ওঁর কেসটা হাতে নিয়ো না।

চা খাওয়ার ইচ্ছে ছিল না। কিন্তু খেতে হল। আর তখনই টেলিফোন বেজে উঠল। রিসিভার তুলে হ্যালো বলে কমলাপতি গলা শুনে ইশারায় বোঝালেন বিদেশের ফোন। বললেন, হ্যাঁ। আপনার বোন বললেন তিনিই রেখে গেছেন। ওঁর পরিচিত? ওয়াশিংটনে থাকেন। ও, ফোনে এর মধ্যে কথা বলা হয়ে গেল! না, না, ওঁকে টেলিফোন করার দরকার নেই। সমস্যাটা হল, এ-পাড়ার দেখাশোনা করার জন্যে যে কমিটি তৈরি হচ্ছে তাতে আপনাদের তরফে ওঁকে নেওয়া যায় কিনা তাই নিয়ে সমস্যায় পড়েছি সবাই। নেব না। বেশিদিন থাকবেন না। আচ্ছা। রিসিভার নামিয়ে হাসলেন কমলাপতি, যৌবনে কলেজের নাটকে অভিনয় করতাম। সেই অভিজ্ঞতাটা চালিয়ে কীরকম ম্যানেজ করে নিলাম বলো! বেশিদিন থাকবে না।

নতুন কোনও ঘটনা ঘটলে কমলাপতিকে জানিয়ে দেবে এই প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে এল অর্জুন। গঙ্গাপদ বলল ডক্টর পত্ৰনৰীশ গবেষণাঘরে ঢুকেছেন। তিনি আজ রাত্রে নামবেন না। অর্জুনকে খেয়ে নিতে বলেছেন।

রাত্রে একা-একা খেতে-খেতে অর্জুন পুরো ব্যাপারটা ভাল করে বলল। সে এখানে এসে যে জায়গায় ছিল তার থেকে এক পাও এগোতে পারেনি। ওই তথাকথিত ফোটোগ্রাফারকে নিয়ে সে অনর্থক মাথা ঘামাচ্ছে। ডক্টর হালদারের মেয়ে যখন তাকে চেনেন তখন আর রহস্যের কিছু নেই।

গঙ্গাপদ খাবার দেওয়ার সময় টেলিফোন বাজল। সে রিসিভার তুলে দুবার হ্যালো বলে কাছে এসে জানাল, সেই সাহেব বোধ হয়, বাবুর নাম বলছে। কিন্তু বাবু তো আজ রাত্রে তাঁকে ডাকতে নিষেধ করেছেন। আপনি একটু বলে দিন না বাবু।

অর্জুন রিসিভার তুলে ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করল, আপনি কে বলছেন?

কাটাকাটা গলায় জবাব এল, আমি ডক্টরের হিতৈষী। আপনি কে বলছেন?

আমি ডক্টর পত্ৰনবীশের সেক্রেটারি। উনি এখন ল্যাবরেটরিতে আছেন, যদি কিছু বলার থাকে তা হলে আমাকে বলতে পারেন।

ডক্টরকে আমি একটা প্রস্তাব দিয়েছিলাম, তার কী সিদ্ধান্ত হল?

ডক্টর পত্ৰনবীশ ওব্যাপারে মন স্থির করতে পারেননি। কারণ আপনি আপনার নাম-ঠিকানা জানাননি। এব্যাপারে আপনার কোনও শর্ত আছে কিনা তাও জানা যাচ্ছে না।

উনি রাজি হলে এ-সবই জানানো হবে।

তা হলে আপনার সঙ্গে আলোচনায় বসতে হয়। আপনি এ বাড়িতে কাল চলে আসুন।

একটা ছোট্ট হাসির শব্দ পাওয়া গেল। তারপর গলা শোনা গেল, দেখতে পাচ্ছি ডক্টর আমাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। আমরা জানতাম ওঁর কোনও সেক্রেটারি ছিল না। আপনি কি ওই লোকাল পুলিশ অফিসারের লোক যিনি আমি শেষবার কোথা থেকে ফোন করেছি জেনে আমায় খুঁজতে লোক পাঠিয়েছিলেন?

আপনি এসব কী বলছেন?

উত্তর না দিয়ে লাইনটা কেটে দিল লোকটা। অর্জুন কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে রইল। এতক্ষণে রহস্য জট বাঁধছে। যে ফোন করছে সে হেঁজিপেজি কেউ নয়। সে মুখ ফিরিয়ে দেখল গঙ্গাপদ দরজার গায়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিশ্চয়ই এতক্ষণ তার কথা শুনছিল। এই লোকটা স্পাই নয় তো! অর্জুন বিরক্ত হল, কী চাই?

খাবার দেব?

দাও।

খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই ফোন বাজল। অবনীবাবুর গলা, কে? অর্জুনবাবু নাকি? আজও তো ডক্টরের সেই ফোন এসেছিল। আপনি কথা বলেছেন?

হ্যাঁ।

আমরা ট্র্যাক রেখেছিলাম। লোকটা এয়ারপোর্ট থেকে ফোন করেছিল। ওই পাবলিক বুথ। ব্যাপারটা বেশ সিরিয়াস হয়ে উঠেছে।

আপনি কথাবার্তা শুনেছেন?

হ্যাঁ। অপারেটর আমায় রেকর্ড বাজিয়ে শুনিয়েছে। অবনীমোহন হাসলেন, ও যখন জানতে পেরেছে আমি এর মধ্যে এসে গেছি তখন আর দেখা করার সাহস পাবে না। ঠিক আছে, গুড নাইট।

রাত্রের খাওয়া শেষ করে অর্জুন একবার ওপরে গেল। গবেষণাঘরের দরজা বন্ধ। ডক্টরকে এখন ডাকাডাকি করে লাভ নেই। সে নীচে নেমে গঙ্গাপদকে জিজ্ঞেস করল, বাইরের দরজার চাবি তোমার কাছে আছে?

গঙ্গাপদ মাথা নাড়ল, না বাবু।

আমি একটু বেরুচ্ছি। ফিরতে রাত হবে। শব্দ পেলে দরজা খুলে দিতে পারবে?

হ্যাঁ বাবু। আমি তো বাইরের ঘরেই শুই। ঘুম আমার খুব পাতলা।

সাড়ে দশটা নাগাদ অর্জুন বেরিয়ে পড়ল। এমনিতেই সল্ট লেকের রাস্তায় মানুষজন কম দেখা যায়, এই সময়ে মনে হল পরিত্যক্ত শহরে হাঁটছে সে। মাঝে-মাঝে হেডলাইট জ্বেলে হুসহাস করে ছুটে যাওয়া কয়েকটা গাড়ি ছাড়া কোথাও কোনও প্রাণের স্পর্শ নেই। জলপাইগুড়ির রাস্তায় মাঝরাত্রে হাঁটলে কুকুরেরা চিৎকার করে। এখানকার পথের কুকুরগুলোর বোধ হয় সেই শক্তিও নেই। অর্জুন পার্কটার কাছে পৌঁছতেই একটা গাড়িকে খুব জোরে বেরিয়ে যেতে দেখল। গাড়িটা বেশ খানিকটা গিয়ে সজোরে ব্রেক কষল। তারপর আচমকা আলো নিভিয়ে দিয়ে রাস্তার একপাশে দাঁড়িয়ে পড়ল। লক্ষ্য রেখেছিল বলে অর্জুনের বেশ কৌতূহল হল। গাড়ির ড্রাইভার দেখা যাচ্ছে খুব খামখেয়ালি। কিন্তু আলো নিভিয়ে দাঁড়িয়েও গাড়ি থেকে কেউ নামেনি এটা স্পষ্ট। অর্জুন এগিয়ে যাচ্ছিল। ওই পথ দিয়ে তাকে যেতে হবে।

দূরত্বটা কমে গেলে অর্জুনের মনে হল গাড়িটা চলে যাওয়া পর্যন্ত তার অপেক্ষা করা উচিত। অত জোরে গাড়ি চালিয়ে যে চট করে থামে তার নিশ্চয়ই কোনও মতলব আছে। সে একটা গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে পড়ল। সল্ট লেকের সুবিধে হল সে যে লুকিয়ে আছে তা দেখতে কেউ জানলা খুলবে না। মিনিটপাঁচেক দাঁড়াবার সময়ে মশার আক্রমণে তটস্থ হল অর্জুন। তার এবার মনে হল এমন হতে পারে ড্রাইভার নেমে পাশের বাড়িতে ঢুকে গিয়েছে, সে দেখতে পায়নি। সেক্ষেত্রে মশার কামড় হজম করা বোকামিই হবে।

এই সময় সে পাশের গলি দিয়ে একজনকে এগিয়ে আসতে দেখল। গাড়ির পাশে আসামাত্র দরজা খুলে গেল। লোকটা ঢুকল কিন্তু দরজা বন্ধ করল না। তারপরই একটা তীব্র শিস বাজল কোথাও। আধা-অন্ধকার থাকায় অর্জুন কিছু বুঝতে পারল না। গাড়ির দরজা বন্ধ হয়ে গেল। এবং সঙ্গে-সঙ্গে হেডলাইট জ্বালিয়ে গাড়িটা যে-গতিতে এসেছিল, সেই গতিতে বেরিয়ে গেল। অর্জুন এবার এগিয়ে গেল গাড়িটা যেখানে দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। পাশের বাড়িটার দরজা-জানলা স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ, আলো নেভানো। ওই বাড়ির বাসিন্দাদের সঙ্গে এই গাড়ির কোনও সম্পর্ক নেই বলেই মনে হল তার। তা হলে গাড়িটা এসেছিল কাউকে তুলে নিতে। তা যদি হয়, সেই লোকটা গাড়িতে ওঠার পরও দরজা খুলে কার জন্যে অপেক্ষা করছিল ওরা?

খামোকা মাথা না ঘামিয়ে অর্জুন গলিতে ঢুকল। সেই ফুচকাওয়ালার জায়গাটা এখন খালি। কমলাপতি মুখোপাধ্যায়ের বাড়ির আলো নেভানো। পুরো পাড়াটাই ঘুমিয়ে রয়েছে। উলটোদিকের বাড়িটাকে ঘুরে-ঘুরে দেখল সে। বাড়ির কোথাও আলো জ্বলছে না। ভাল করে দেখার পর সে একটা রাস্তা খুঁজে পেল। সল্ট লেকের বাড়িগুলো আধুনিক, নতুন স্টাইলে তৈরি। জলপাইগুড়ির বেশিরভাগ বাড়ির মতো লুডোর গুটির মতো চৌকো নয়। এখানে দৃষ্টিনন্দন করতে বাড়ির গায়ে অনেক ভাঁজ, অনেক কায়দা। পাশের দেবদারু গাছের সাহায্য নিয়ে অর্জুন খানিকটা ওপরে উঠে বাড়ির গায়ে পা রাখল। তারপর খাঁজে-খাঁজে পা রেখে সন্তর্পণে ওপরে উঠতে লাগল। দোতলার বারান্দায় নেমে সে দরজা ঠেলে বুঝল ওটা ভেতর থেকে বন্ধ। দোতলা থেকে ছাদে যাওয়া অসম্ভব হত, যদি না দেবদারু গাছটা থাকত। অনেক চেষ্টা করে অনেকটা ঝুঁকি নিয়ে অর্জুন শরীরটাকে টেনে-হিচড়ে ছাদের আলসেতে পৌঁছে দিতে পারল। প্রাচীর ডিঙিয়ে ছাদে পৌঁছে সে কয়েক সেকেন্ড স্থির হয়ে বসে নিজেকে সামলাল।

রাস্তার আলো ছাদে না আসায় তারার আলো সম্বল। খানিকটা ধাতস্থ হয়ে অর্জুন দরজার দিকে এগোল। যা স্বাভাবিক তাই, দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। অর্জুন পকেট থেকে একটা চ্যাপটা চামড়ার খাপ বের করল। জলপাইগুড়ির এক ওস্তাদ তালা খুলিয়েকে অর্জুন পুলিশের হাত থেকে বাঁচিয়েছিল এক শর্তে যে, সে আর তার আগের জীবিকায় ফিরে যাবে না। লোকটি এখন পর্যন্ত কথা রেখেছে। সেই জীবিকা ছেড়ে দেওয়ার সময় এই খাপটা সে অর্জুনকে দিয়েছিল। বলেছিল ওটা দেখলেই তার হাত নিশপিশ করে। মনকে শক্ত রাখতে তাই সে খাপটা অর্জুনকে উপহার দিয়ে দিয়েছিল। ওই খাপের মধ্যে তালা খোলার নানান ধরনের সরু শক্ত তার, ল্যাচ-কি খোলার জন্যে চ্যাপটা ইস্পাত ইত্যাদি নানা সরঞ্জাম ছিল।

ছাদের দরজায় ল্যাচ-কি লাগানো। বাইরে থেকে সাধারণভাবে খোলা অসম্ভব কিন্তু যন্ত্রটা অদ্ভুত কাজ করল। একচিলতে ফাঁক দিয়ে চ্যাপটা ইস্পাত ঢুকিয়ে সামান্য চাপ নিতেই খুট করে শব্দ হল, দরজাটা খুলে গেল। অর্জুন সিঁড়িতে পা দিল।

দোতলায় তিনখানা ঘর। কোনও ঘরেই মানুষ নেই। অর্জুন একতলায় নামল। একতলাও ফাঁকা। অর্থাৎ এই মুহূর্তে এই বাড়িতে কোনও মানুষ নেই। এত রাত্রে লোকটা গেল কোথায়? হঠাৎ অর্জুনের চোখের সামনে সেই ছায়ামূর্তি ভেসে উঠল যে অন্ধকার গলি থেকে বেরিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা গাড়িতে উঠেছিল। তা হলে এই লোকটাকে দিতেই কি গাড়িটা এসেছিল?

অর্জুন ওপরে উঠল। দ্বিতীয় ঘরটাতে লোকটা থাকে, জিনিসপত্র জামাকাপড়ে বোঝা যাচ্ছে। সুটকেসগুলো এদেশি নয়। পকেট থেকে টর্চ বের করে আলো জ্বেলে দেখতে লাগল অর্জুন। ট্রাকসুট রয়েছে। সন্দেহজনক আর কিছু খুঁজে পেল না সে।

পাশের ঘরে ঢুকে টর্চের আলো ফেলতেই চোখে পড়ল খাটের ওপর ছোট্ট বিছানা। এত ছোট যে, বাচ্চা ছেলেরাই শুতে পারে। পাশের টেবিলে আধখাওয়া কলা, আপেল এবং ছবি রয়েছে। আর তারপরেই অর্জুন দেখতে পেল টেবিলের একপাশে প্লেটের ওপর কিছু শুকিয়ে যাওয়া দূর্বাঘাস পড়ে আছে।

অর্জুন আবার বিছানার দিকে তাকাল। কুকুর-বেড়ালের শোয়ার জন্যে মানুষ ওভাবে বিছানা পেতে দেয় না। অথচ এই ঘরে যে জন্তু থাকে তা পরিষ্কার। অর্জুন বিছানাটা পরীক্ষা করল। প্রাণীটি আজও এখানে শুয়েছিল। বিছানার ওপর বাদামি রঙের লোম পড়ে আছে কিছু। এবং তখনই তার মনে পড়ল ওরাং ওটাংটার কথা। এই ফোটোগ্রাফারের পোষা প্রাণী নয় তো? দোতলার বারান্দা থেকে দেবদারু গাছে উঠে গেলে পাড়ার লোকদের চোখ এড়িয়ে জন্তুটা বহুদূরে যেতে পারে। আর সন্ধের পর বের হলে কাকদের চোখে পড়ার ভয় নেই। শুধু একারণেই কমলাপতিবাবুর পক্ষে জানা অসম্ভব এবাড়িতে কোনও পোষা প্রাণী আছে কিনা! কিন্তু লোকটা একাই গাড়িতে উঠেছে ধরে নিলে ওরাং ওটাংটা গেল কোথায়?

অর্জুন আবার পাশের ঘরে ফিরে এল। পার্ক থেকে যে লোকটা দূর্বাঘাস নিয়ে এসেছিল তার সঙ্গে ডক্টর পত্ৰনবীশের বর্ণনা দেওয়া মন্মথ দত্তর বেশ মিল আছে। ট্রাক ড্রাইভাররা যদিও সঠিক বর্ণনা দিতে পারেনি তবু ওরা যা বলেছে তার সঙ্গে ওই মন্মথ দত্তকে মিলিয়ে দেওয়া যায়। অর্জুন তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোনও বই বা ডায়েরি পেল না। এমন একটা কাগজও নেই যাতে মন্মথ দত্ত শব্দদুটো লেখা। কিন্তু খুঁজতে-খুঁজতে সে ইংরেজি খবরে কাগজের ওপর অন্যমনস্কভাবে লেখা টেডি শব্দটাকে অনেকবার দেখতে পেল। টেডি টেডি টেডি! টেডি কারও নাম। কার নাম?

ভদ্রলোকের জামাকাপড়গুলো পরীক্ষা কল। সবই বিদেশে কেনা। বেশিরভাগই হয় তাইওয়ান, নয় ইন্দোনেশিয়ার। এখন অবশ্য শিলিগুড়িতেও এগুলো পাওয়া যায়, নেপাল হয়ে আসে। কিন্তু এই ভদ্রলোক যে এদেশীয় জিনিস ব্যবহার করেন না তা স্পষ্ট।

এই অভিযান কোনও কাজে লাগল না। বেশ হতাশ হয়ে অর্জুন নীচে নেমে এল। সদর দরজা খুলে সেটা বাইরে থেকে চেপে দিতেই ল্যাচ কি আটকে গেল। আধা-অন্ধকার পথে হেঁটে সে যখন বড় রাস্তায় পৌঁছল তখন সল্ট লেক আরও গভীর ঘুমে।