সামবেদের উৎস
সামবেদের সূক্তসমূহের উৎস রহস্যাবৃত, যেহেতু তা পরিচিত ইতিহাসের সীমাকে অতিক্রম করেছে। প্রত্ন-প্ৰস্তর যুগের শেষ পর্যায়ে মানুষ গান গাইতে শিখেছিল। সমালোচক সি. এম. বাওরা বলেছেন যে, একদিকে নৃত্য থেকে গান সংগ্রহ করেছে ছন্দ এবং অন্যদিকে বাক্ থেকেও সংগীত ভাষাগত উপাদানে নিজেকে সৃষ্টি করেছে। সুর সন্নিবেশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে নৃত্যছন্দ গীতছন্দে রূপান্তরিত হ’ল; শব্দ সন্নিবেশিত হওয়ার পরে অর্থহীন একাক্ষর-কেন্দ্রিক সুর পূর্ণ–বিকশিত গানে পরিণত হ’ল। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্বিংশতি শতাব্দীতে প্রথম নৃত্যের নিদর্শণ পাওয়া যায়; কোনও-না-কোন-ভাবে গান নিশ্চয়ই নৃত্যের সঙ্গে সঙ্গেই উদ্ভূত হয়েছিল। পরবর্তীকালে শামান বা জাদু-পুরোহিতরা অলৌকিক লক্ষ্য পূরণের জন্য গানের ব্যবহার করতেন। ধর্মীয় উদ্দেশ্যে গানের প্রয়োগ বহু প্ৰাচীনকালেই আরম্ভ হয়েছিল–ঐন্দ্ৰজালিক এবং জাদু-পুরোহিতসুলভ কাৰ্যকলাপ কিংবা দেবতার প্রতি প্রার্থনারাপেও গান ব্যবহৃত হত। গাভীর্যপূর্ণ ভাবনার অভিব্যক্তির প্রয়োজনে গানে লঘু-গতির ছন্দ বর্জন করা হ’ত; তবে গোষ্ঠীগত সন্মোহনের উদ্দেশ্যে বিশেষভাবে পরিকল্পিত দ্রুতগতির ছন্দ প্রযুক্ত হ’ত যাতে এক ধরনের আবেশের সৃষ্টি হয়।
সমস্ত ধর্মীয় সংগীতের প্রাথমিক উৎস হ’ল সাধারণ লোকগীতি, গোষ্ঠীজীবনে যে সুর নির্দিষ্ট প্রতিক্রিয়া তৈরি করে; তবে এই সব সুর সূক্তে সন্নিবেশিত হওয়ার সময় অধিকতর ফলপ্ৰসু হওয়ার প্রয়োজনে বহুলাংশে পরিমার্জিত হয়েছিল। সামবেদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট শ্রৌতিসূত্রগুলি বিশ্লেষণ করে আমরা বুঝতে পারি যে, বিভিন্ন চারণকবিদের পরিবারের নিজস্ব ঐতিহ্য অনুযায়ী পরিমার্জনের প্রক্রিয়া ভিন্ন ভিন্ন ও কালে কালে ক্রমশ জটিল হয়ে উঠেছিল। তবে, লোকগীতির সঙ্গে সম্পর্ক থাকার ফলে দূরে থেকে যারা নিস্ক্রিয়ভাবে যজ্ঞে যোগ দিতে সমাজের সেই সব লোকের মনে গানের সুর নিশ্চিত একটি প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করত; বিধিবদ্ধ স্বরভঙ্গি যখন পরিমার্জিত সুর ও আঙ্গিকগত সিদ্ধিসহযোগে নিরন্তর প্রচেষ্টায় ও পরিমার্জনে নান্দনিক স্তরে উন্নীত হয়ে শিল্পকুশলতা অর্জন করল, তখন পূর্বোক্ত সামাজিক প্রতিক্রিয়াকে বিষয়বস্তু ও পরিস্থিতি অনুযায়ী একটি, বিশেষ মহত্ত্বপূর্ণ পর্যায়ে তা উন্নীত করতে পেরেছিল। এই প্রক্রিয়া বহুকাল ধরে চলেছিল এবং ক্রমবর্ধমান সোমচৰ্যার সঙ্গে এর সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। সুতরাং, সামবেদ নিছক প্রাচীনতর বৈদিক চারণকবিদের স্বতঃস্ফুর্ত উন্মাদনার অভিব্যক্তি নয়; নির্দিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্য থেকে উদ্ভূত ধর্মীয় চৰ্যার ফলশ্রুতি এই বেদ, এবং এর সঙ্গে সম্পূক্ত যজ্ঞানুষ্ঠান। ঋগ্বেদের সূক্ত সমাজকে বাচনিক প্রত্নকথা ও স্বতঃস্ফুর্তি যোগান দিয়েছিল, অন্যদিকে আদিম গীতি তাদের সামনে মূল সুরের কাঠামোটি উপস্থাপিত করেছিল। এই সব সূক্ত ও গীতি সোমচৰ্যার সঙ্গে সমন্বিত হয়ে যখন প্রত্নকথা, ধর্মচৰ্যা, সংগীত, ছন্দ, লয়, উত্তেজক পানীয় এবং তার আনুষঙ্গিক উন্মাদনা, ইচ্ছাপূরণের প্রত্যাশা ও সামাজিক কল্যাণের স্বাকল্পিত ধারণার এক জটিল আবহ নির্মাণ করল, তখন মূলগত রূপান্তরের মাধ্যমে এই সব সূক্ত ও গীতি তাদের আদিম অসংস্কৃত উৎস থেকে গুণগতভাবে প্রায় সম্পূর্ণ পৃথক একটি অভিব্যক্তি লাভ করেছিল।