রোমাঞ্চকর রাত
সে-ভয়ঙ্কর হাসির শব্দটা যখন থামল, তখনও মনে হতে লাগল ঝন্টিপাহাড়ির ডাকবাংলোটা ভয়ে একটানা কেঁপে চলেছে। আমি বিদ্যুৎবেগে আবার চাদরের তলায় ঢুকে পড়েছি, সাহসী ক্যাবলাও এক লাফে উঠে গেছে তার বিছানায়। আমার হাত-পা হিম হয়ে এসেছে—দাঁতে-দাঁতে ঠকঠকানি শুরু হয়েছে। যতদূর বুঝতে পারছি, ক্যাবলার অবস্থাও বিশেষ সুবিধের নয়।
প্রায় দশ মিনিট।
তারপর ক্যাবলাই সাহস ফিরে পেল। শুকনো গলায় বললে, ব্যাপার কী রে প্যালা?
চাদরের তলা থেকেই আমি বললাম, ভু–ভূ-ভূত!
ক্যাবলা উঠে বসেছে। আমি চাদরের তলা থেকে মিটমিট করে ওকে দেখতে লাগলাম।
ক্যাবলা বললে, কিন্তু কথা হল, ভূত এখানে খামকা হাসতে যাবে কেন?
ভুতুড়ে বাড়িতে ভূত হাসবে না তো হাসবে কোথায়? তারও তো হাসবার একটা জায়গা চাই। আমি বলতে চেষ্টা করলুম।
ক্যাবলা মাথা চুলকে বললে, তাই বলে মাঝরাতে অমন করে হাসতে যাবে কেন? লোকের ঘুম নষ্ট করে অমন বিটকেল আওয়াজ ঝাড়বার মানে কী?
আমি বললুম, ভূত তো মাঝরাতেই হাসে। নইলে কি দুপুরবেলা কলকাতার কলেজ স্কোয়ারে বসে হাসবে নাকি?
ক্যাবলা বললে, তাই তো উচিত! তাহলে অন্তত ভূতের সঙ্গে একটা মোকাবিলা হয়ে যায়। তা নয়, সময় নেই অসময় নেই, যেন ‘হাহা’ শব্দরূপ আউড়ে গেল–হাহা-হাহৌ-হাহাঃ! আচ্ছা প্যালা, ভূতদের যখন-তখন এরকম যাচ্ছেতাই হাসি পায়। কেন বল দিকি?
আমি চটে গিয়ে বললুম, তার আমি কী জানি! তোর ইচ্ছে হয় ভূতের কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করে আয় না।
ক্যাবলা আবার চুপ করে নেমে পড়ল খাট থেকে। বললে, তাই চল না প্যালা—ভূতের চেহারাটা একবার দেখেই আসিগে! সেইসঙ্গে একথাও বলে আসি যে আপাতত এবাড়িতে চারটি ভদ্রলোকের ছেলে এসে আস্তানা নিয়েছে। এখন রাত দুপুরে ওরকম বিটকেল হাসি হেসে তাদের ঘুমের ব্যাঘাত করা নিতান্ত অন্যায়।
বলে কী ক্যাবলা! আমার চুল খাড়া হয়ে উঠল।
-খেপেছিস নাকি তুই?
—খেপব কেন? বুকের পাটা আছে বটে ক্যাবলার! একটুখানি হেসে বললে, আমার কী মনে হয় জানিস? ভূতও মানুষকে ভয় পায়।
কী বকছিস যা-তা?
—ভয় পায় না তো কী! নইলে কলকাতায় ভূত আসে না কেন? দিনের বেলায় তাদের ভুতুড়ে টিকির একটা চুলও দেখা যায় না কেন? বাইরে বসে বসে হাসে কেন? ঘরে ঢুকতে ভূতের সাহস নেই কেন?
আমি আঁতকে উঠে বললুম, রাম রাম! ওসব কথা মুখেও আনিসনি ক্যাবলা! হাসির নমুনাটা একবার শুনলি তো? এখুনি হয়তো দুটো কাটা মুণ্ডু ঘরে ঢুকে নাচতে শুরু করে দেবে!
ক্যাবলাটা কী ডেঞ্জারাস ছেলে! পটাং করে বলে ফেলল—তা নাচুক না। কাটা মুণ্ডুর নাচ আমি কখনও দেখিনি, বেশ মজা লাগবে! আচ্ছা—আমি ওয়ান-টু-থ্রি বলছি। ভূতের যদি সাহস থাকে, তাহলে থ্রি বলবার মধ্যেই এই ঘরে ঢুকে নাচতে আরম্ভ করবে। আই চ্যালেঞ্জ ভূত! ওয়ান-টু-
কী সর্বনাশ? করছে কী ক্যাবলা! ভূতের সঙ্গে চালাকি। ওরা যে পেটের কথা শুনতে পায়! ভয়ে সিঁটিয়ে গিয়ে আমি চাদরের তলায় মুখ লুকোলুম। এবার এল—নির্ঘাত—এল—
ক্যাবলা বললে, থ্রি!
চাদরের তলায় আমি পাথর হয়ে পড়ে আছি। একেবারে নট-নড়নচড়ন ঠকাস মার্বেল। এক্ষুনি একটা যাচ্ছেতাই কাণ্ড হয়ে যাবে! এলএল—ওই এসে পড়ল
কিন্তু কিছুই হল না। ভূতেরা ক্যাবলার মতো নাবালককে গ্রাহ্যই করল না বোধহয়।
ক্যাবলা বললে, দেখলি তো! চ্যালেঞ্জ করলুম—তবু আসতে সাহস পেল না। চল—এক কাজ করি। টেনিদা আর হাবুল সেনও নিশ্চয়ই জেগেছে এতক্ষণে। আমরা চারজনে মিলে ভূতেদের সঙ্গে দেখা করে আসি।
ভয়ে আমার দম আটকে গেল।
-ক্যাবলা, তুই নির্ঘাত মারা যাবি? ক্যাবলা কর্ণপাত করল না। সোজা এসে আমার হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারলে।
–ওঠ—
আমি প্রাণপণে চাদর টেনে বিছানা আঁকড়ে রইলুম!
–কী পাগলামি হচ্ছে ক্যাবলা! যা, শুয়ে পড়—
ক্যাবলা নাছোড়বান্দা। ওর ঘাড়ে ভূতই চেপে বসেছে না কি কে জানে! আমাকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বললে, ওঠ বলছি! ভূতে মাঝরাতে আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেবে আর আমরা চুপটি করে সয়ে যাব! সে হতেই পারে না। ওঠ ওঠ-শিগগির
এমন করে টানতে লাগল যে চাদর-বিছানাসুন্ধু আমাকে ধপাস্ করে মেঝেতে ফেলে দিলে।
এই ক্যাবলা, কী হচ্ছে?
ক্যাবলা কোনও কথা শোনবার পাত্রই নয়। টেনে আমাকে দাঁড় করিয়ে দিলে। বললে, চল দেখি, পাশের ঘরে টেনিদা আর হাবুল কী করছে!
বলে লণ্ঠনটা তুলে নিলে।।
অগত্যা রাম রাম দুর্গা-দুগা বলে আমি ক্যাবলার সঙ্গেই চললুম। ও যদি লণ্ঠন নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় তাহলে এক সেকেন্ডও আর আমি ঘরে থাকতে পারব না! দাঁতে দাঁতে লেগে যাবে, অজ্ঞান হয়ে যাব—হয়তো মরেও যেতে পারি। এমনিতেও তো আমার পালাজ্বরের পিলেটা থেকে-থেকে কেমন গুরগুরিয়ে উঠছে।
পাশের দরজাটা খোলাই ছিল। ওদের ঘরে ঢুকেই ক্যাবলা চেঁচিয়ে উঠল : এ কী, ওরা। গেল কোথায়?
তাই তো কেউ নেই! দুটো বিছানাই খালি! না টেনিদানা হাবুল। অথচ দুটো ঘরের মাঝের দরজা ছাড়া আর সমস্ত জানালা-দরজাই বন্ধ। আমাদের ঘরের ভেতর দিয়ে ছাড়া। ওদের তো আর বেরুবার পথ নেই।
ক্যাবলা বললে, গেল কোথায় বল দিকি!
আমি কাঁপতে কাঁপতে বললুম, নির্ঘাত ভূতে ভ্যানিশ করে দিয়েছে! এতক্ষণে ঘাড় মটকে রক্ত খেয়ে ফেলেছে ওদের!
এতক্ষণে বোধহয় ক্যাবলার খটকা লেগে গিয়েছিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললে, তাই তো রে, কেমন যেন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে সব! দু-দুটো জলজ্যান্ত মানুষ হাওয়ায় মিলিয়ে গেল নাকি!
আর ঠিক তক্ষুনি—
ক্যাঁক ক্যাঁক করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ। যেন ঘরের মধ্যে সাপে ব্যাঙ ধরেছে কোথাও। ক্যাবলা চমকে একটা লাফ মারল, একটুর জন্যে পড়তে-পড়তে বেঁচে গেল হাতের লণ্ঠনটা। আর আমিও তিড়িং করে একেবারে টেনিদার বিছানায় চড়ে বসলুম।
আবার সেই ক্যাঁক ক্যাঁক-কোঁক!
নির্ঘাত ভূতের আওয়াজ! আমার পালাজ্বরের পিলেতে প্রায় ম্যালেরিয়ার কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে। চোখ বুজে ভাবছি এবার একটা যাচ্ছেতাই ভুতুড়ে কাণ্ড হয়ে যাবে, ঠিক সেই সময় হঠাৎ বেখাপ্পাভাবে ক্যাবলা হা-হা করে হেসে উঠল।
চমকে তাকিয়ে দেখি, লণ্ঠনটা নিয়ে হাবুলের খাটের তলায় ঝুঁকে রয়েছে ক্যাবলা। তেমনি বেয়াড়াভাবে হাসতে হাসতে বললে, দ্যাখ প্যালা আমাদের লিডার টেনিদা আর হাবুলের কাণ্ড! ভূতের ভয়ে এ-ওকে জাপটে ধরে খাটের তলায় বসে আছে!
বলেই ক্যাবলা দস্তুরমতো অট্টহাসি করতে শুরু করলে।
খাটের তলা থেকে টেনিদা আর হাবুল গুঁড়ি মেরে বেরিয়ে এল। দুজনেরই নাকে-মুখে ধুলো আর মাকড়সার ঝুল। টেনিদার খাঁড়ার মতো নাকটা সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে, আর হাবুল সেনের চোখ দুটো ছানাবড়ার মতো গোল গোল হয়ে প্রায় আকাশে চড়ে বসে আছে।
ক্যাবলা বললে, টেনিদা, এই বীরত্ব তোমার। তুমি আমাদের দলপতি—আমাদের পটলডাঙার হিরো—গড়ের মাঠে গোরা পিটিয়ে চ্যাম্পিয়ন–
টেনিদা তখন সামলে নিয়েছে। নাক থেকে ঝুল ঝাড়তে ঝাড়তে বললে, থাম থাম, মেলা ফ্যাঁচ-ফ্যাঁচ করিসনি! আমরা খাটের তলায় ঢুকেছিলুম একটা মতলব নিয়ে।
হাবুলের কাঁধের ওপর একটা আরশোলা হাঁটছিল। হাবুল টোকা মেরে সেটাকে দূরে ছিটকে দিয়ে বলল, হহ, আমাগো একটা মতলব আছিল!
ক্যাবলা বললে, শুনি না—কেয়া মতলব সেটা! বাতলাও। ক্যাবলা অনেকদিন পশ্চিমে ছিল, কথায় কথায় ওর রাষ্ট্রভাষা বেরিয়ে পড়ে দুএকটা।
টেনিদা তখন সাহস পেয়ে জুত করে বিছানার ওপর উঠে বসেছে। বেশ ডাঁটের মাথায় বললে, বুঝলি না? আমরা খাটের তলায় বসে ওয়াচ করছিলুম। যদি একটা ভূত-টুত ঘরের মধ্যে ঢোকে—
হাবুল টেনিদার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললে, তখন দুইজনে মিল্যা ভূতের পা ধইরা একটা হ্যাঁচকা টান মারুম—আর ভূতে—
টেনিদা বললে, একদম ফ্ল্যাট! ক্যাবলা খিকখিক করে হাসতে লাগল।
টেনিদা চটে গিয়ে বললে, অমন করে হাসছিস যে ক্যাবলা? জানিস ওতে আমার ইনসাল্ট হচ্ছে? টেক কেয়ার! গুরুজনকে যদি অমন করে তুরু করবি, তা হলে চটে গিয়ে এমন একখানা মুগ্ধবোধ বসিয়ে দেব
টেনিদা বোধহয় ক্যাবলার নাকে একটা মুগ্ধবোধ বসাবার কথাই ভাবছিল, সেই সময় আবার একটা ভীষণ কাণ্ড ঘটল।
পাশের জানালাটার কাচে ঝনঝন করে শব্দ হল একটা। কতকগুলো ভাঙা কাচ ছিটকে পড়ল চারিদিকে আর সঙ্গে সঙ্গে মধ্যে শাদা বলের মতো কী একটা ঠিকরে পড়ল এসে—একেবারে ক্যাবলার পায়ের কাছে গড়িয়ে এল।
আর লণ্ঠনের আলোয় স্পষ্ট দেখলুম-ওটা আর কিছু নয়, স্রেফ মড়ার মাথার খুলি।
—ওরে দাদা।
আমি মেঝেতে ফ্ল্যাট হলুম সঙ্গে সঙ্গেই। হাবুল আর টেনিদা বিদ্যুৎবেগে আবার খাটের তলায় অদৃশ্য হল। শুধু লণ্ঠন হাতে করে ক্যাবলা ঠায় দাঁড়িয়ে রইল—শুয়ে পড়ল না, বসেও পড়ল না।
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেই পৈশাচিক অট্টহাসি উঠল। সেই হাসির সঙ্গে থরথর করে কাঁপতে লাগল ঝন্টিপাহাড়ির ডাকবাংলো।