রাত্তিরবেলা ঘরে যে-কোনও শব্দ হলেই কাকাবাবুর ঘুম ভেঙে যায়। প্রথমে তিনি বুঝতে পারলেন না শব্দটা কীসের।
তারপর আবার সামান্য ক্যাঁচ করে শব্দ হল। দরজাটা খুলে যাচ্ছে। চাবি দিয়ে কেউ দরজাটা খুলেছে।
বালিশের নীচে রিভলভার রাখা কাকাবাবুর বরাবরের অভ্যেস। সেটা বার করে কাকাবাবু উঠে বসলেন।
ঘর অন্ধকার, তবু বোঝা গেল একটি ছায়ামূর্তি পা টিপেটিপে ঢুকছে ঘরে।
সে মাঝখানে আসবার পর কাকাবাবু ঠাণ্ডা গলায় বললেন, মাথার ওপর হাতদুটো তুলে দাঁড়াও। একটু নড়বার চেষ্টা করলেই আমি গুলি করব।
খুট করে তিনি বিছানার পাশে একটা আলো জ্বাললেন। এবং অবাক হয়ে দেখলেন, কাঁচুমাচু মুখে দাঁড়িয়ে আছে মণ্টা সিং।
সে হাতজোড় করে বলল, আপনি জেগে আছেন! আমায় মাপ করবেন স্যার, আপনার ঘুম ভাঙাতে চাইনি। খুব দরকারে পড়ে আসতে হল একটা জিনিস নিতে। আমার কাছে ড়ুপ্লিকেট চাবি থাকে, কিন্তু এবাংলো থেকে কারও কোনও জিনিস হারায় না। আমি ভেবেছিলাম স্যার, আপনার ঘুম না ভাঙিয়ে জিনিসটা নিয়ে যাব।
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, কী জিনিস?
মণ্টা সিং বললেন, বালিশ। আপনার মাথার কাছে আলমারিতে স্যার একস্ট্রা বালিশ রাখা আছে। হঠাৎ দরকার পড়ল।
কাকাবাবু বললেন, এত রাতে হঠাৎ একস্ট্রা বলিশের দরকার পড়ল কেন?
মণ্টা সিং বলল, দু জন গেস্ট এসে একখানা ঘর চাইছে স্যার। পুলিশের দু জন অফিস্যার। তাদের তো থাকতে দিতেই হয়। ও-ঘরে একটা বালিশ কম আছে, একটা কম্বলও লাগবে, তাই ভাবলাম আপনাকে না বিরক্ত করে কীভাবে নিয়ে যাই–
কাকাবাবু দিনের বেলা ওই আলমারিটা খুলে দেখেছিলেন, সত্যি ওটার মধ্যে অনেক বালিশ আর কম্বল রাখা আছে। মন্টা সিংয়ের কথাটা মিথ্যে নয়। রিভলভারটা নামিয়ে রেখে তিনি বললেন, ঠিক আছে, নিয়ে যাও!
মন্টা সিং কাকাবাবুর খাটের পিছনে এসে আলমারি খুলে বালিশ বার করতে লাগল।
তারপর হঠাৎ সে ঘুরে গিয়ে, কাকাবাবুর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে একটা রুমাল চেপে ধরল তাঁর নাকে।
মণ্টা সিং বেশ বলশালী লোক। কিন্তু কাকাবাবুর সঙ্গে পারবে কেন? কাকাবাবু একটু পরেই এক ঝটকা দিয়ে তাকে ফেলে দিলেন মাটিতে।
তাকে ধমকে বললেন, স্টুপিড, এত রাতে গুণ্ডামি করতে এসেছ? তোমার চাকরি থাকবে?
মণ্টা সিং আবার লাফিয়ে এসে কাকাবাবুর মাথাটা চেপে ধরার চেষ্টা করল। কাকাবাবু ভাবলেন, এবার লোকটিকে কঠিন শাস্তি পেতে হবে। তিনি লোহার মতন দুহাতে মণ্টা সিংয়ের গলা টিপে ধরলেন।
ঠিক তখনই ঘরের মধ্যে আরও দুটো লোক ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল কাকাবাবুর ওপর। তারা কী একটা ভিজে-ভিজে ন্যাকড়া তাঁর নাকে ঠেসে দেওয়ার চেষ্টা করল।
কাকাবাবু এই তিনজনের সঙ্গে লড়তে গিয়েও টের পেলেন তাঁর হাতের জোর কমে আসছে, ঝিমঝিম করছে মাথা। পাশের ঘরেই সন্তু আর জোজো ঘুমোচ্ছে, ওদের জানানো দরকার।
তিনি ডাকতে গেলেন, গলা দিয়ে স্বর বেরোল না, চোখ অন্ধকার! এলিয়ে পড়লেন জ্ঞান হারিয়ে।
কাকাবাবুর যখন জ্ঞান ফিরে এল, তখন প্রায় ভোর হয়ে এসেছে। চোখ মেলার আগেই তিনি শুনতে পেলেন কিচির মিচির পাখির ডাক। প্রথমে তাঁর মনে হল, ডাকবাংলোর ঘরেই শুয়ে আছেন, সেখানেও বাগানে অনেক পাখি ডাকে, ভোরবেলা সেই ডাক শুনে তাঁর ঘুম ভাঙে।
চোখ মেলে কাকাবাবু দেখলেন, তাঁর মাথার ওপর মস্ত বড় একটা গাছ, তার ডালপালার ফাঁক দিয়ে একটু-একটু ভোরের আকাশ দেখা যাচ্ছে।
তারপর মাথাটা একটু উঁচু করে দেখলেন, একটু দূরে বসে আছে তিনটি লোক, মাঝখানে আগুন জ্বলছে, পিছন দিকে ঘন জঙ্গলে এখনও আলো ফোটেনি।
তখন তাঁর একটু-একটু করে সব মনে পড়ল। মাঝরাতে মণ্টা সিং ঢুকেছিল ঘরে, বিশ্বাসঘাতক মন্টা সিং! বাংলোর কেয়ারটেকার হয়েও সে আচমকা তাঁকে আক্রমণ করেছিল, তারপর পিছন থেকে আরও কয়েকজন…। নাকে ক্লোরোফর্ম ঠেসে তাঁকে অজ্ঞান করে ফেলেছিল, তারপর এই জঙ্গলে নিয়ে এসেছে…।
কাকাবাবু মাথায় হাত বুলিয়ে দেখলেন, কোথাও চোট লেগেছে কি না। না, রক্তক্ত কিছু নেই, সারা গায়ে ব্যথাও নেই। রিভলভারটা রয়ে গেছে বালিশের নীচে, নাকি এরা চুরি করে নিয়েছে?
তিনি দেখলেন, লম্বা কোটটা তাঁর গায়েই রয়েছে। এটা পরে তো তিনি ঘুমোত যাননি, খুলে রেখেছিলেন। খুব শীত বলে এরা কোটটা তার গায়ে পরিয়ে এনেছে। কোটের পকেটে হাত দিয়ে তিনি তাঁর চশমাটা পেয়ে গেলেন।
এবারে তিনি দেখলেন, সেই লোক তিনটি কাপে করে চা খাচ্ছে।
প্রথমেই তাঁর মনে হল, এরা এই জঙ্গলে চায়ের কাপ আর চা-দুধ-চিনি কোথায় পেল? সব সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে, না এখানেই কোথাও এসব লুকিয়ে রাখার ব্যবস্থা আছে? কাছাকাছি কুঁড়ে ঘরটরও কিছু দেখা যাচ্ছে না।
ওদের একজন বলল, জ্ঞান ফিরেছে দেখছি, চা খাবে?
কাকাবাবু জিজ্ঞেস করলেন, আমার ক্রাচ দুটো কোথায়?
অন্য একজন বলল, তা আমরা কী জানি! কেন, ক্রাচ দিয়ে কী হবে?
কাকাবাবু বললেন, ক্রাচ না হলে হাঁটতে পারি না। আমি এখন ডাকবাংলোয় ফিরে যাব। দাঁত না মেজে আমি খাই না কিছু।
লোক তিনটি হাসতে লাগল।
এবার কাকাবাবু ওদের মধ্যে একজনকে চিনতে পারলেন। জলিল শেখ, সেই পাখি-চোর, যার সব পাখি উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। অন্য দু জনের চেহারা দুগাঠাকুরের অসুরের মতন।
কাকাবাবু বললেন, জলিল শেখ, তোমায় থানায় ধরে নিয়ে যাচ্ছিল, আমি বাঁচিয়ে দিলাম। তারপরেও তুমি এইসব অপকর্ম শুরু করেছ?
জলিল বেশ জোরে থুঃ শব্দ করে মাটিতে থুথু ফেলল। তারপর বলল, তুমি আমার ভাত মারতে চেয়েছিলে। আমার রোজগার বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলে। তখনই আমি মনে-মনে বলেছিলাম, তোমাকে আবার বাগে পেলে দেখে নেব।
কাকাবাবু বললেন, কেন, দেখলাম তো তোমার বেশ ভাল বাড়ি। পুকুর আছে, বাগান আছে, তুমি চাষবাস করলেই পারো! তোমার মেয়ে ফিরোজা কেমন আছে?
অন্য একজন বলল, এই জলিল, কথা বলিস না, কথা বলিস না। হুকুম নেই।
এই সময় জঙ্গলের মধ্যে কীসের যেন শব্দ শোনা গেল। গাছপালা ভেদ করে কেউ আসছে, খুব জোরে।
জলিলরা একসঙ্গে ফিরে তাকাল। একজন হাতে তুলে নিল বন্দুক।
তারপরই শোনা গেল ঘোড়ার পায়ের শব্দ। দেখা গেল একটা কালো রঙের ঘোড়া ছুটে আসছে, তার ওপর কালো পোশাক পরা একজন সওয়ার।
একেবারে কাছে এসে ঘোড়ার রাশ টেনে থামাল টিকেন্দ্রজিৎ। তারপর সাকাসের খেলোয়াড়ের মতন লাফিয়ে নেমে পড়ল। তার কোমরে একটা চওড়া বেল্ট, এক পাশে রিভলভারের খাপ। হাতে চাবুক।
সে কাকাবাবুর সামনে এসে পা ফাঁক করে, কোমরে দু হাত দিয়ে দাঁড়াল। তার পায়ে গাম বুট, মাথায় টুপি।
কাকাবাবু তার পা থেকে মাথা পর্যন্ত ভাল করে তাকিয়ে দেখলেন। টিকেন্দ্রজিতের চেহারাটা সত্যি সুন্দর। প্রায় ছ ফুটের কাছাকাছি লম্বা, সারা শরীরে একটুও চর্বি নেই, সরু কোমর, চওড়া বুক, চওড়া কাঁধ। চোখ দুটো টানা-টানা, ধারালো নাক। একেবারে ইংরেজি সিনেমার নায়কের মতন। কাকাবাবুদের ছেলেবেলায় গ্যারি কুপার নামে একজন নায়ক ছিল, অনেকটা সেইরকম, যদিও টিকেন্দ্রজিতের গায়ের রং ফরসা নয়।
কাকাবাবু দু হাত জোড় করে কপালের কাছে তুলে বললেন, নমস্কার, আপনিই তো কুমার টিকেন্দ্রজিৎ? আপনার সঙ্গে আলাপ করার খুব ইচ্ছে ছিল।
টিকেন্দ্রজিৎ কাকাবাবুর চোখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। কোনও কথা বলল না।
কয়েক মুহূর্ত পরে জলিলদের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করল, একে চা দিয়েছিস?
একজন বলল, জিজ্ঞেস করেছিলাম, দাঁত না মেজে চা খায় না বলল।
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, একটা নিমডাল ভেঙে দে। দাঁতন করে নিক।
নিজে সে এক কাপ চা নিয়ে আস্তে-আস্তে হেঁটে চলে গেল জঙ্গলের দিকে।
জলিল কাকাবাবুকে একটা নিমগাছের ডাল আর এক মগ জল এনে দিল। কাকাবাবু আর আপত্তি না জানিয়ে মুখ ধুয়ে নিলেন। ভোরবেলা তাঁর চা খাওয়ার অভ্যেস।
কাকাবাবুর চা খাওয়া শেষ হতেই ফিরে এল টিকেন্দ্রজিৎ। লোক তিনটিকে বলল, এবার ওকে ওই শিমুলগাছটার সঙ্গে বাঁধ ভাল করে। নায়লনের দড়ি এনেছিস তো?
লোক তিনটি কাকাবাবুর দিকে এগিয়ে আসতেই তিনি টিকেন্দ্রজিতকে বললেন, আমাকে বাঁধবার দরকার কী? এমনিই তো আমরা কথা বলতে পারি। খোঁড়া পা নিয়ে আমি তো দৌড়ে পালাতে পারব না!
টিকেন্দ্রজিৎ কাকাবাবুর দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি দিয়ে বলল, তুমি পালাতে পারবে না জানি। পালাবার কোনও উপায় তোমার নেই। তবে, তুমি যদি বাধা দেওয়ার চেষ্টা করো, তা হলে প্রথমেই ছুরি দিয়ে তোমার একটা কান কেটে নেওয়া হবে। এ পর্যন্ত তোমাকে কোনও আঘাত করা হয়নি।
ওরা এসে কাকাবাবুর দু হাত ধরে টানতে লাগল। কাকাবাবু বুঝলেন, বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে সত্যিই কোনও লাভ নেই।
ওরা একটা গাছের কাছে নিয়ে এসে কাকাবাবুর হাত দুটো পিছনে মুড়িয়ে বাঁধল, তারপর পা দুটোও বেঁধে দিল। কাকাবাবুর আর নড়বার চড়বার ক্ষমতা এই না।
টিকেন্দ্রজিৎ এবার গাছটা ঘুরে-ঘুরে কাকাবাবুর হাত ও পায়ের বাঁধন পরীক্ষা করে দেখল। সন্তুষ্ট হওয়ার পর সে তার প্যান্টের পকেট থেকে এক প্যাকেট বিস্কুট বার করে ঢুকিয়ে দিল কাকাবাবুর কোটের পকেটে। কাকাবাবু এর মানে বুঝতে পারলেন না। চা খাওয়ার সময় বিস্কুট দিল না, এখন বিস্কুট দিয়ে কী হবে? হাত বাঁধা, ইচ্ছে করলেও তো বিস্কুট খেতে পারবেন না।
টিকেন্দ্রজিৎ মুখের সামনে এসে বলল, সেদিন আমি নিজে আপনার সঙ্গে আলাপ করতে গিয়েছিলাম। আপনি আলাপ করেননি, আমাকে একবার বসতেও বলেননি। সেইজন্যই এই ব্যবস্থা।
কাকাবাবু আকাশ থেকে পড়ে বললেন, সে কী! আপনি ঝড়ের বেগে ঘোড়ায় চড়ে এলেন। হিম্মত রাওয়ের বাড়ি চায়ের নেমন্তন্নের কথা বললেন। আপনি কে, আপনার নাম কী, কোনও পরিচয়ই দেননি!
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, কুমার টিকেন্দ্রজিৎ কখনও নিজে থেকে পরিচয় দেয় না। তাকে চিনে নিতে হয়।
কাকাবাবু বললেন, আমি নতুন এসেছি, কী করে আপনাকে চিনব?
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, কিন্তু আমাকে দেখে কি সাধারণ চাকরবাকর মনে হয়? আমাকে একবার বসতেও বলেননি!
কাকাবাবু বললেন, আপনি এমন ছটফট করছিলেন, শুধু চায়ের নেমন্তন্নের কথা, যাই হোক, আমাদের ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে অবশ্যই বসতে বলা উচিত ছিল।
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, এখন আর ওসব বললে কী হবে? শুনুন, মিস্টার রায়চৌধুরী, আপনাকে আমি ছেড়ে দেব। কেউ কিছু জানবার আগেই আপনাকে সসম্মানে বাংলোতে পৌঁছে দেব। সবাই ভাববে, আপনি মর্নিং ওয়াক করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু আজ দুপুরের মধ্যেই ছেলে দুটিকে নিয়ে আপনাকে কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। তিনটের সময় ফ্লাইট আছে।
কাকাবাবু বললেন, হঠাৎ ফিরে যাব কেন? আমরা বেড়াতে এসেছি।
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, আপনি বেড়াতে আসেননি। আপনি কে, কীজন্য এসেছেন, তা আমরা সব জানি। বড়ঠাকুর আর রাজ সিংয়ের সঙ্গে আপনি। গোপন শলা-পরামর্শ করেছেন। ওরা যতই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করুক, গণ্ডার আমরা মারবই! বিদেশ থেকে ব্যবসাদাররা এসেছে, আপনারাও জানেন, আমরাও জানি, প্রায় দশ কোটি টাকার কারবার, এই সুযোগ কেন ছাড়ব? আপনি আজই ফিরে যেতে রাজি আছেন?
কাকাবাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, কুমার টিকেন্দ্রজিৎ, আপনি যদি আমাকে চিনে থাকেন, তা হলে এটাও আপনার জানা উচিত যে, কারও হুকুমে আমি ভয় পেয়ে পালাই না।
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, প্রাণ বাঁচাবার চেষ্টা সবাই করে। প্রাণ বাঁচাবার জন্য লোকে আত্মীয়স্বজন ত্যাগ করে, দেশ ছেড়ে চলে যায়, কত কী করে! দশ কোটি টাকার কারবার, এবারে আমরা দু-চারটে মানুষ মারতেও দ্বিধা করব না। জেনে রাখবেন, কুমার টিকেন্দ্রজিৎকে বাধা দেওয়ার সাধ্য কারও নেই। হ্যাঁ, আপনি হঠাৎ ফিরে গেলে বড়ঠাকুররা কী ভাববে, তাই তো? ডাকবাংলোয় ফিরে গিয়েই আপনি শুয়ে পড়বেন। যন্ত্রণায় ছটফট করার ভাব দেখাবেন। সবাইকে বললেন, আপনার বুকে খুব ব্যথা হচ্ছে। হার্ট অ্যাটাক। আপনার চিকিৎসার জন্যই তো ফিরে যাওয়ার দরকার। হার্ট অ্যাটাক নিয়ে তো আর আপনি জঙ্গলে পাহারা দিতে পারবেন না! আপনি পশ্চিমবাংলার লোক, অসমের জঙ্গলে গণ্ডার মারা হচ্ছে কি না হচ্ছে, তা নিয়ে আপনার মাথা ঘামাবার কী দরকার?
কাকাবাবু মৃদু হেসে বললেন, এখন অধিকাংশ জঙ্গলকেই বলে ন্যাশনাল ফরেস্ট। সংরক্ষিত জাতীয় অরণ্য। এর মধ্যে অসম, বাংলা, বিহারের তো কোনও ব্যাপার নেই। এই অরণ্যের প্রাণীরা আমাদের জাতীয় সম্পদ। এদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা আমাদের সবারই করা উচিত।
টিকেন্দ্রজিৎ বিদ্রুপের সুরে বলল, গণ্ডার একটা বিশ্রী প্রাণী। কুৎসিত দেখতে। সব সময় কাদায় গড়াগড়ি যায়। ওদের বাঁচিয়ে রাখার কী এমন দায় পড়েছে? গণ্ডার মেরে যদি এত টাকা পাওয়া যায়, তা হলে মারব না কেন?
কাকাবাবু বললেন, এই রে, এটা আপনি কী বললেন কুমার? দেখতে খারাপ বলেই মেরে ফেলতে হবে? আপনার চেহারা সুন্দর, আপনার তুলনায় আমি দেখতে খারাপ, পৃথিবীতে আরও কত লোক আছে, যারা আপনার তুলনায় দেখতে খারাপ, তাদের সবাইকে আপনি মেরে ফেলবেন? আর একটা কথা কী জানেন, আপনি বলছেন, গণ্ডাররা বিশ্রী দেখতে। গণ্ডাররা হয়তো আপনাকে, আমাকেও মনে করে বিশ্রী প্রাণী। ওদের মতন আমাদের মাথায় শিং বা খাঁড়া নেই। তা বলে গণ্ডাররা তো আমাদের মেরে ফেলতে চায় না। ওরা আপনমনে জঙ্গলে থাকে। আমরাও ওদের মারব না, ওরাও আমাদের মারবে না, এই তো সবচেয়ে ভাল।
টিকেন্দ্রজিৎ একবার পেছন ফিরে নিজের লোকদের দিকে তাকাল। তারপর হঠাৎ কাকাবাবুর চুলের মুঠি ধরে কর্কশ গলায় বলল, তর্কের শেষ! তোমাকে বাঁচার সুযোগ দিয়েছিলাম, রাজা রায়চৌধুরী, তুমি তা নিলে না!
কাকাবাবু বললেন, খুব তাড়াতাড়ি মরে যাওয়ার ইচ্ছে আমার একটুও নেই। শুধু-শুধু মরতে যাব কেন?
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, এক্ষুনি এক কোপে তোমার মুণ্ডু উড়িয়ে দিতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, দাও না দেখি! তুমিই তো প্রথম নও, আমাকে এ রকম কথা আগেও অনেকে বলেছে। কিন্তু কেউ তো পারেনি এ-পর্যন্ত!
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, তুমি তো আগে টিকেন্দ্রজিৎকে দ্যাখোনি? আমার মায়াদয়া নেই। গণ্ডার আমি মারব। গণ্ডার শিকার আমার কাছে একটা চ্যালেঞ্জ। এবার আমি মারবই, মারবই, মারবই! অন্তত একশোটা গণ্ডার মারব! তোমাকেও মারতে আমার হাত কাঁপবে না!
এবার সে জলিলদের বলল, তোরা চলে যা। তোদের আর দরকার নেই। এর ব্যবস্থা আমি করছি!
ওরা তিনজন জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে খুব তাড়াতাড়ি সরে পড়ল। ওদের মুখ-চোখ দেখলেই বোঝা যায় টিকেন্দ্রজিৎকে দারুণ ভয় পায়।
আগুন নিবে গেছে। আকাশ ভরা এখন সকালের আলো। প্রচুর পাখি তো ডাকছেই, একঝাঁক টিয়া উড়ে গেল সামনে দিয়ে। টিকেন্দ্রজিৎ তার ঘোড়ার সঙ্গে বাঁধা একটা থলি নিয়ে এল কাঁধে ঝুলিয়ে।
কাকাবাবু বললেন, টিকেন্দ্রজিৎ, তুমি কথা বলতে বলতে হঠাৎ আমার চুলের মুঠি চেপে ধরলে কেন? ছিঃ আমার মনে মনে একটা প্রতিজ্ঞা আছে। কেউ যদি আমার গায়ে হাত দেয়, তা হলে আমি তার শোধ না নিয়ে ছাড়ি না। আমাকেও একদিন তোমার চুলের মুঠি চেপে ধরতে হবে।
টিকেন্দ্রজিৎ দারুণ অবাক হয়ে ভুরু তুলে রইল।
তারপর বলল, তুমি এখনও ভাবছ, তুমি ছাড়া পাবে? এই বাঁধন তুমি খুলতে পারবে? তা ছাড়া এক্ষুনিই তো আমি তোমায় মেরে ফেলতে পারি।
কাকাবাবু বললেন, আমায় মেরে ফেললে আর-একজন আসবে। আমি এমন ব্যবস্থা করে এসেছি যে, আমায় সত্যি-সত্যি কেউ মেরে ফেললেও তার শোধ নেওয়া হবেই। তুমি কিছুতেই নিস্তার পাবে না টিকেন্দ্রজিৎ!
টিকেন্দ্রজিৎ হা-হা করে হেসে উঠে বলল, আমায় কেউ কোনও দিন ধরতে পারবে না। সে সাধ্য কারও নেই। আমি অদৃশ্য হয়ে যেতে পারি, তা জানো? শোনো, তোমাকে আমি নিজের হাতে মারব না। এই রকম অবস্থায় ফেলে রেখে যাব। পুলিশ তোমায় খোঁজাখুঁজি করবে নিশ্চয়ই। পুলিশে আমাদের লোক আছে। তারা এই জায়গাটা বাদ দিয়ে সারা কাজিরাঙ্গা জঙ্গল খুঁজে বেড়াবে। এখানে যদি আসেও, অন্তত তিনদিন লাগবে। এই তিনদিনে তোমার অবস্থা কী হবে বলছি।
থলে থেকে একটা চুরুট বের করে জ্বালিয়ে আরাম করে ধোঁয়া ছেড়ে টিকেন্দ্রজিৎ বলল, খুব সম্ভবত আজ রাতের মধ্যেই তুমি ভালুকের পাল্লায় পড়বে।
কাকাবাবু ধমকের সুরে বললেন, আমার দিকে ধোঁয়া ছেড়ো না। আমি চুরুটের গন্ধ সহ্য করতে পারি না।
এবার অবাক হওয়ার বদলে সাঙ্ঘাতিক চটে গেল টিকেন্দ্রজিৎ। চোখ দুটো জ্বলতে লাগল হিরের টুকরোর মতন। সে গর্জন করে বলল, কী? তুমি এখনও আমাকে ধমকাচ্ছ, তোমার এত সাহস? কুমার টিকেন্দ্রজিৎ কখনও কারও ধমক সহ্য করে না!
একমুখ ধোঁয়া সে কাকাবাবুর মুখের ওপর ছাড়ল। কাকাবাবু নাক কুঁচকে ফেললেন।
তারপর সে সেই জ্বলন্ত চুরুট চেপে ধরল কাকাবাবুর বুকে।
কাকাবাবুর বুকের রোম পুড়ে গেল, চামড়া গোল হয়ে পুড়তে লাগল।
কাকাবাবু ঠাণ্ডা গলায় বলল, টিকেন্দ্রজিৎ, ও রকম কোরো না। আমি ঠিক শোধ নেব! শোধ নেব!
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, তুমি মরে ভূত হয়ে শোধ নেবে? আমি ভূতের ভয় পাই না!
চুরুটটা সেখান থেকে তুলে সে এবার কাকাবাবুর ঘাড়ের কাছে চেপে ধরল। অসহ্য যন্ত্রণা হলেও কাকাবাবু মুখ বিকৃত করলেন না, ফিসফিস করে আবার বললেন, মানুষকে কষ্ট দেওয়ার সময় মনে থাকে না যে, নিজেকেও একদিন এ রকম কষ্ট পেতে হবে! তোমার বুকে ও ঘাড়ে ঠিক এইরকমভাবে কেউ একদিন জ্বলন্ত চুরুট চেপে ধরবে!
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, সেরকম মানুষ জন্মায়নি।
চুরুটটা ফেলে দিয়ে সে এবার একটা লম্বা চকোলেট বের করল তার ঝোলা থেকে। সেটার ওপরের রাংতা ছাড়িয়ে এক কামড় খেয়ে বাকিটা রেখে দিল কাকাবাবুর কোটের পকেটে। আরও একমুঠো লজেন্সের কাগজ ছাড়িয়ে সে রাখতে লাগল সেখানে।
তারপর একটু সরে এসে বলল, তোমাকে আমি দগ্ধে-দগ্ধে মারব রাজা রায়চৌধুরী। এগুলো কেন রাখলাম জানো? তোমার যখন খুব খিদে পাবে, তখনও তুমি জানবে, তোমার কোটের পকেটেই বিস্কুট, চকোলেট, লজেন্স রয়েছে, তবু তুমি খেতে পারবে না। তুমি খেতে পারবে না, কিন্তু পিঁপড়েরা আসবে। বড় বড় লাল পিঁপড়ে। হাজার-হাজার পিঁপড়ে ঘুরবে তোমার শরীরে। তাদের কামড়ে বিষের জ্বালা। তারপর রাত্তিরবেলা জন্তু-জানোয়াররা তোমায় ছিঁড়ে খাবে।
ঝোলা থেকে একটা গণ্ডারের শিং বের করে সে বলল, এই দ্যাখো, দুটো গণ্ডার এর মধ্যেই মেরেছি। আরও মারব, অন্তত আটানব্বইটা! সব গণ্ডার শেষ হয়ে গেলেই বা ক্ষতি কী? শিং বিক্রি করা ছাড়া এই জন্তুগুলো দিয়ে মানুষের আর কী উপকার হয়!
কাকাবাবুর খুব ইচ্ছে হল জিনিসটা একবার হাত দিয়ে ধরে দেখতে। কিন্তু উপায় তো নেই!
কাকাবাবু বললেন, তুমি একলাই সব গণ্ডার মারবে? নিজের সম্পর্কে দেখছি তোমার খুব উঁচু ধারণা! গণ্ডার শিকার করা এত সহজ? তুমি আমাকে যেটা দেখালে, সেটা আসল গণ্ডারের শিং নয়, নকল!
টিকেন্দ্রজিৎ আবার কাকাবাবুর চুলের মুঠি ধরে সেই শিংটা কাকাবাবুর নাকের ওপর চেপে ধরে বলল, এই দ্যাখো, আসল কি না!
কাকাবাবু অনুভব করলেন, সেটা আঠা দিয়ে জট পাকানো শক্ত লোমের মতন জিনিস। বিশ্রী গন্ধ!
টিকেন্দ্রজিৎ বলল, আমি একলাই সব কটাকে মারব কি মারব না, তুমি তা দেখতে আসবে না। পরের ব্যাপারে তোমার নাক গলানো এই শেষ!
কাকাবাবুর মাথাটায় একবার প্রবল ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে দিল টিকেন্দ্রজিৎ। তারপর ঘোড়াটাতে উঠে পড়ল।
এদিকে সে মুখ ফেরাতেই কাকাবাবু বললেন, আবার দেখা হবে। টিকেন্দ্রজিৎ হা-হা শব্দে অট্টহাসি করে উঠল। সেই হাসিতে যেন কেঁপে উঠল জঙ্গলের গাছপালা। হাসতে-হাসতেই সে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। এক সময় সেই হাসি আর ঘোড়ার পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল অনেক দূরে।