ছুরি আছে?
ছুরি!
হ্যাঁ।
আছে—তবে কি হবে ছুরি দিয়ে?
নিয়ে আসুন একটা ছুরি।
সমীরণ একটা ছুরি নিয়ে এল—তারই সাহায্যে তালা ভেঙে সুটকেসটা খুলে ফেলল সুদৰ্শন।
আর খুলতেই যেন ও চমকে ওঠে।
রক্তমাখা কাপড়!
টেনে বের করল। সুদৰ্শন। রক্তমাখা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি—আর কাপড়ের মধ্যে জড়ানো ছিল একটা ধারালো বড় ছোরা।
ছোরাটার গায়েও রক্তের দাগ শুকিয়ে আছে।
সমীরণ যেন বোবা হয়ে গিয়েছে। ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে রক্তমাখা জামাকাপড়ের দিকে।
সুদৰ্শনের মুখ দিয়ে কয়েকটা মুহুর্ত কোন কথা বের হয় না।
এই ধুতি আর পাঞ্জাবি-চিনতে পারছেন?
কেমন যেন অসহায় বোবোদৃষ্টিতে তাকায় সমীরণ সুদর্শনের মুখের দিকে। কোন কথায় বের হয় না তার মুখ দিয়ে।
চিনতে পারছেন না?
না তো–
আপনার ধুতি-পাঞ্জাবি কোথায় থাকে?
ওই যে আলমারির মধ্যে—হাত তুলে ঘরের মধ্যে একটা আলমারি দেখিয়ে দিল। সমীরণ।
আলমারিতে চাবি দেওয়া থাকে না?
না।
সুদৰ্শন উঠে গিয়ে আলমারির বন্ধ দরজা দুটো টানতেই খুলে গেল। একটা তাকে কিছু ধুতি-পাঞ্জাবি দলামোচা করে রাখা—অন্য তাকে কিছু ভাঁজ করা জামাকাপড়। হ্যাঙারে একটা কোট—একটা শাল। আলমারির থেকে একটা ভাঁজকরা ধুতি নিয়ে ফিরে এল সুদৰ্শন-। সেটা রক্তমাখা ধুতি-পাঞ্জাবি-গেঞ্জি সুটকেসের মধ্যে ভরল। সন্তৰ্পণে ছোরাটাও একটা রুমালে ভাজ করে সুটকেসের মধ্যে ভরে ডালটা বন্ধ করল।
সমীরণবাবু?
অ্যাঁ?
আমার সঙ্গে যে একবার আপনাকে যেতে হবে!
কেন?
চলুন, প্রয়োজন আছে—
আমাকে কি আপনি অ্যারেস্ট করছেন?
আই অ্যাম সরি সমীরণবাবু-ঠিক অ্যারেস্ট নয়, তবে আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে হবে।
কিন্তু কেন, আমাকে আপনি অ্যারেস্ট করছেন কেন?
না, না—সমীরণবাবু, অ্যারেস্ট আপনাকে আমি ঠিক করছি না—বললাম তো! আপাততঃ লালবাজারে আপনাকে আমি নিয়ে যাচ্ছি—চলুন। আর দেরি করবেন না।
আপনিও কি সন্দেহ করছেন। আমিই বিজিতা আর তার মেয়েকে হত্যা করেছি?
চলুন আপনি আমার সঙ্গে।
কিন্তু কেন? কেন আমি আপনার সঙ্গে যাব? ঐ সুটকেসের ব্যাপারটা কিছুই আমি জানি না বিন্দুবিসর্গ। কোথা থেকে এল, কেমন করে এল
তবু সুটকেস আপনার কাছেই পাওয়া গিয়েছে। আপনি তাকে চিনতেন, দীর্ঘদিন ধরে পরিচয় ছিল আপনাদের পরস্পরের, আপনি তাকে ভালবাসতেন—
ভাল যদি বিজিতাকে আমি বেসেই থাকি কোন দিন সেটা নিশ্চয়ই একটা অপরাধ নয়?
দেখুন সমীরণবাবু, তর্ক করতে আমি চাইনা। আপনি আমার সঙ্গে যাবেন কিনা সেটা কেবল আমি জানতে চাই—
যদি না যাই?
তবে বাধ্য হয়েই আপনাকে আমায় অ্যারেস্ট করে নিয়ে যেতে হবে।
বেশ চলুন।
সুদৰ্শন সমীরণকে সঙ্গে করে লালবাজারে নিয়ে এল। এবং তাকে লক-আপে রেখে দেবার ব্যবস্থা করল।,
রাত অনেক হয়ে গিয়েছিল। প্রায় এগারোটা।
বাসায় ফিরবার আগে সুদৰ্শন কিরীটীকে ফোন করল।
কে? কিরীটীর গলা ফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল।
দাদা আমি সুদৰ্শন।
কি ব্যাপার, এত রাত্রে?
সেই সুটকেসটা পাওয়া গিয়েছে দাদা।
পেয়েছ?
হ্যাঁ। তার মধ্যে রক্তমাখা ধুতি, পাঞ্জাবি, গেঞ্জি আর একটা ছোরাও পাওয়া গিয়েছে।
কোথায় পেলে?
সমীরণ দত্তর কাছে?
সমীরণকে অ্যারেস্ট করেছ?
নিশ্চয়ই।
কি বললে সে?
সংক্ষেপে সুদৰ্শন ঘটনোটা বলে গেল কিরীটীকে ফোনে। সব শুনে কিরীটী বলল, একটা কথা সুদৰ্শন—
বলুন দাদা?
মণিশঙ্করের ফ্ল্যাটে পুলিস-প্রহরা রেখেছতো?
রেখেছি।
কাল একবার ভোরেই গোপেনবাবুর ওখানে যেও—
যাব। কিন্তু গোপেনবাবুর এভিডেন্সটা কি খুব প্রয়োজনীয় দাদা?
নিঃসন্দেহে। হয়তো তিনি তোমার বর্তমান হত্যা-রহস্যের ব্যাপারে আলোক সম্পাত করতে পারেন।
কিন্তু আমার মনে হচ্ছে দাদা-সমীরণ দত্তকে যখন হাতের মুঠোর মধ্যে পেয়েছি, হত্যা-রহস্যের কিনারা আমরা সহজেই করতে পারব।
তাহয়তো পারবে,কিন্তু তবু গোপেনবাবুকিছু জানেন কিনা জানা একান্তই প্রয়োজন।কিন্তু আর রাত করো না, এবার বাড়ি যাও—সাবিত্রী হয়ত তোমার জন্য বসে আছে। গুডনাইট।
কিরীটী অন্য প্রান্তে ফোনটা রেখে দিল।
সত্যিই সাবিত্রী জেগে বসেছিল সুদর্শনের জন্য।
রাত তখন প্রায় পৌনে বারোটা।
কলিংবেল টিপতে সাবিত্রীই এসে দরজা খুলে দিল, এত রাত হল যে!
খেয়েছে?
না।
কেন খেয়ে নিলে না! কতদিন বলেছি। রাত হলে আমার জন্যে বসে থেকে না।
সাবিত্রী মৃদু হাসে।
হাসলে যে? সুদর্শন জিজ্ঞাসা করে।
হাত-মুখ ধুয়ে নাও-এত রাত্রে নিশ্চয়ই স্নান করবে না!
স্নান না করলে আমার ঘুমাই হবে না—চট্পট সেরে নিচ্ছি। আমি। জান সাবি—
কি?
কেসটার আরো ডেভলপমেন্ট হয়েছে। খেতে খেতে তোমাকে সব বলব-তুমি খাবাব রেডি কর-আমি আসছি!
খাবারের টেবিলে বসে খেতে খেতে সুদৰ্শন সব বলে গেল।
কি তোমার মনে হয় সাবি?
কিসের কি?
ঐ সমীরণ দত্তই নিশ্চয় খুন করেছে?
আমার কিন্তু তা মনে হয় না।
কেন?
কি জানি! আমার মন যেন বলছে সমীরণ দত্ত বিজিতাকে খুন করেনি।
কিন্তু কেন কেন তোমার ওকথা মনে হচ্ছে?
জানি না, তবে মনে হচ্ছে
তুমি একেবারে ছেলেমানুষ।
সাবিত্রী সে কথার জবাব না দিয়ে বললে, জান, ছোড়দা এসেছিল আজ!
অমলেন্দুবাবু?
হ্যাঁ।
তোমার মা-বাবা কেমন আছেন?
বাবার শরীরটা খুব খারাপ।
যাও না ওখানে গিয়ে কিছুদিন থেকে এস।
আমার লজ্জা করে।
লজ্জা কিসের তোমার—যা ঘটেছিল তার জন্য তো তুমি দায়ী নও—হলই বা মাধবী তোমার বোন।
সে আমার বোন বলেই তো যেতে পারি না।
তবে না হয় তোমার মা বাবাকে এখানে এসে কিছুদিন রাখ।
বাবা আসবেন না।
কেন?
সে তুমি বুঝবে না।
খাওয়া শেষ হয়ে গিয়েছিল, সুদৰ্শন টেবিল ছেড়ে উঠে পড়ল।
সাবিত্রী যখন শুতে এল সুদৰ্শন নাক ডাকাচ্ছে। গভীরভাবে নিদ্রিত।
কয়েকটা মুহুর্ত সাবিত্রী গভীর মমতায় ঘুমন্ত স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। ফ্যানের হাওয়ায় সুদর্শনের চুলগুলো উড়ে উড়ে তার চোখে-মুখে এসে পড়ছে।
মনে মনে স্বামীকে প্ৰণতি জানায় সাবিত্রী। তুমি আমাকে যে কি লজ্জা থেকে বাঁচিয়েছ। তুমি জান না! আশীবার্দ কর আমাকে, যেন তোমার ভালবাসার যোগ্য হতে পারি আমি।
খুব ভোরেই উঠে-হাত-মুখ ধুয়ে, শেভ করে, চা পান করেই সুদৰ্শন লালবাজার চলে গিয়েছিল।
অফিস-ঘরে ঢুকতেই একজন সার্জেণ্ট এসে স্যালুট করে দাঁড়াল!
কি খবর বিশ্বনাথ?
একটু আগে এখানে একটা ফোন এসেছিল।
ফোন? কার?
আপনার কাছেই এসেছিল ফোন-কলাটা। তবে কে যে ফোন করেছিল জানি না। তবে কালকের সেই সি. আই. টি.-র ফ্ল্যাট বাড়িতে আর একটা খুন হয়েছে।
খুন! সে কি?
হ্যাঁ স্যার—বিকাশবাবু ফোন পেয়েই স্পটে চলে গিয়েছেন।
কিন্তু কে-কে খুন হয়েছে?
তা জানি না, স্যার।
সুদৰ্শন আর দেরি করে না। তখুনি বের হয়ে পড়ে।
অকুস্থলে পৌঁছে দেখল নীচে ফ্ল্যাট বাড়িটার সামনে পুলিসের একটা কালো ভ্যান দাঁড়িয়ে—চার-পাঁচজন কনস্টেবল দাঁড়িয়ে।
সুদৰ্শন তাদেরই একজনকে প্রশ্ন করে, বিকাশবাবু কোথায়?
উপরে স্যার। দোতলায় উঠতেই সিঁড়ির মাথায় একজন সার্জেন্টির সঙ্গে দেখা হল। সুদৰ্শন তাকেই জিজ্ঞাসা করে, কোথায় খুন হয়েছে?
তিনতলার ফ্ল্যাটে, স্যার।
তরতর করে সুদৰ্শন তিনতলায় উঠে যায়।
দুটো ফ্ল্যাট সিঁড়ির ল্যানডিংয়ের দুই দিকে।
একটার দরজায় তালা দেওয়া।
অন্য দরজাটা খোলা—তার সামনে একজন সেপাই দাঁড়িয়ে। দরজার গায়ে ইংরেজীতে নেমপ্লেটে লেখা—শ্ৰীগোপেন বসু, বি. ই.।
ঘরে পা দিতেই চোখে পড়ল সুদর্শনের বীভৎস দৃশ্যটা।
বছর পঞ্চাশ-বাহান্ন হবে একটি ভদ্রলোক-মাথার চুল অনেকটা সাদা হয়ে গিয়েছে— সামনের দিকে টাক-পরনে শ্লিপিং সুট, খালি পা—উপুড় হয়ে পড়ে আছে মেঝেতে দেহটা-কিছু দূরে একটা চশমা পড়ে আছে। ও-দুপটি চপ্পল।
মেঝেতে চাপ-চাপ রক্ত।
বিকাশ মধ্যবয়সী ভৃত্যশ্রেণীর লোকটিকে নানা প্রশ্ন করছিল, আর লোকটা কঁদেছিল।
সুদৰ্শনকে ঢুকতে দেখেই বিকাশ তাকে একটা স্যালুট করে, এই যে স্যার, এসে গেছেন। কাল রাত্রে–কোন এক সময় ব্যাপার ঘটেছে মনে হচ্ছে।
গোপেন বসু?
হ্যাঁ স্যার—
ঐ লোকটা কে?
গোপেনবাবুর চাকর দাশু!
আর কেউ নেই বাড়িতে?
না, গোপেনবাবুর স্ত্রী দিনসাতেক হল মুর্শিদাবাদে তাঁর বাপের বাড়ি গিয়েছেন
ছেলেমেয়েদের নিয়ে।
বাড়িতে তাহলে আর কেউ ছিল না?
না। স্যার, ঐ দাশু আর গোপেনবাবু।