এইরূপে বলাবলি হইল বিস্তর।
গর্জ্জিয়া উঠিল কৃতবর্ম্মা ধনুর্দ্ধর।।
হাতে অসি করি যায়, কাটিবার আশে।
গর্জ্জন করিয়া বলে বচন কর্কশে।।
আরে দুরাচার পাপী শিনির নন্দন।
এতেক তোমার গর্ব্ব না বুঝি কারণ।।
গোবিন্দের নিন্দা কর দুষ্ট অধোগামী।
ইহার উচিত ফল তোরে দিব আমি।।
ভূরিশ্রবা ঢাল খাঁড়া লৈয়া বীর দাপে।
কোন্ পরাক্রম কর এতেক প্রতাপে।।
নৃপতি সমুহ মধ্যে কৈল অপমান।
কোন্ লাজে ধর দুষ্ট এ পাপ পরাণ।।
অপমান হৈতে মৃত্যু শ্রেষ্ঠ শত গুণে।
ধিক্ ধিক্ আরে দুষ্ট নির্লজ্জ জীবনে।।
আমার নিন্দহ দুষ্ট না বুঝি কারণ।
পাণ্ডবের সর্ব্বনাশ কৈল কোনজন।।
দ্রোণপুত্র প্রবেশিল শিবির ভিতরে।
সকল করিল ক্ষয় দ্রোণি একেশ্বরে।।
আমা দোঁহে আছিলাম দাণ্ডাইয়া দ্বারে।
রে দুষ্ট আমারে গালি দেহ অহঙ্কারে।।
এত বলি অসি ল’য়ে কাটবারে ধায়।
গর্জ্জিয়া সাত্যকি বলে জমদগ্নি প্রায়।।
উচিত কহিতে ক্রোধ হইল তোমার।
আমারে মারিতে এস আরে দুরাচার।।
তোর দর্প ঘুচাব কাটিব তোর শির।
এত বলি অসি ল’য়ে ধায় মহাবীর।।
অসির প্রহারে বীর কাটে তার শির।
ভূমেতে লোটায় কৃতবর্ম্মার শরীর।।
হাহাকার শব্দে ডাকে যতেক যাদব।
মার মার বলিয়া ধাইল যত সব।।
দেখিয়া অদ্ভুত কর্ম সবিস্ময় মন।
আত্মা আত্মা বিবাদী হইল সর্ব্বজন।।
কৃতবর্ম্মা বধ হইল দেখিয়া নয়নে।
সাত্যকিরে মারিবারে ধায় যদুগণে।।
নানা অস্ত্র ফেলি মারে সাত্যকি উপর।
মুষলধারায় যেন বর্ষে জলধর।।
স্নেহ করি কেহ হৈল সাত্যকির ভিত।
অস্ত্র বৃষ্টি করে কেহ অতি ক্রোধচিত।
সহোদরে সহোদরে হৈল দুই দল।
মার মার শব্দেতে হইল কোলাহল।
প্রলয় সময়ে যেন উথলে সাগর।
দেবাসুরে হয় যেন যুদ্ধ ঘোরতর।
ঘোরতর গর্জ্জন সঘনে সিংহনাদ।
ঝাঁকে ঝাঁকে বাণ বৃষ্টি নাহি অবসাদ।।
ধনুকে যুড়িতে বাণ বিলম্ব না করে।
হাতে অস্ত্র বীর সব করয়ে প্রহারে।।
অস্ত্রে অস্ত্র নিবারণ করে জনে জনে।
সর্ব্ব অস্ত্র ক্ষয় হৈল অস্ত্র নাহি তূণে।।
ক্রোধমনে যুদ্ধ করে নাহি অবসান।
দাণ্ডাইয়া কৌতুক দেখেন ভগবান।।
অদ্ভুত দেখিয়ে রাম বিষন্নবদন।
বৃত্তান্ত জানিয়া স্থির হৈলেন তখন।
যুঝয়ে যাবদকূল আপনা আপনি।
খড়গ ল’য়ে কেহ কেহ করে হানাহানি।।
ধনুকে ধনুকে যুদ্ধ অস্ত্র বরিষণ।
ঝঞ্চনা পড়য়ে যেন ভীষণ দর্শন।।
ধনুক টঙ্কার শব্দে পূরিল গগন।
ভয়ে ভীত তিন লোক শুনিয়া গর্জ্জন।।
রনস্থলে গালাগালি করে ভাই ভাই।
ইষ্ট বন্ধু কার’ পানে কেহ নাহি চাই।।
শক্তি তুলি হানে কেহ কাহার’ উপর।
শেল জাঠা শক্তি মারে ভুষণ্ডী তোমর।।
আপনা পাসরি সবে কোপে অচেতন।
পাথর তুলিয়া মারে ঘোর দরশন।
মুদ্গর তুলিয়া কেহ মারে কার’ মাথে।
রথ অশ্ব সারথি মারে এক ঘাতে।।
আঁকড়ি করিয়া কেহ ধরে রথখান।
সিংহনাদ ছাড়ি ফেলে দিয়া এক টান।।
প্রহারে না করে ভয় অভেদ্য শরীর।
অতুল সাহস সবে রণে মহাবীর।।
হেনমতে যুঝে যত যাদব-কুমার।
শূন্য কর হৈল কার’ অস্ত্র নাহি আর।।
যতেক বিক্রম কৈল কিছু না হইল।
যাদবগণের অঙ্গ তিল না ভেদিল।।
উপায় করেন তবে দেব ভগবান।
নিকটে খগ্ড়ার নল বন উপজিল।।
যদুগণে দেখাইয়া কন দামোদর।
নল বৃক্ষ ফেলি মার সবে পরস্পর।।
এই উপদেশ যদি যদুগণে পায়।
শীঘ্রগতি নলবন উপাড়িতে যায়।।
নল খাগ্ড়ার গাছ ধরি যদুগণ।
অন্যে অন্যে প্রহার করয়ে জনে জন।।
অস্ত্রেতে না ভেদে যেই যাদব শরীর।
নল খাগ্ড়ার ঘায় পড়ে সব বীর।।
অঙ্গে পরিশিবামাত্র পড়ে সেইক্ষণ।
ব্রহ্মশাপে ধ্বংস হয় যত যদুগণ।।
জনে জনে মারামারি অতিশয় ক্রোধ।
ভাই ভাই খুড়া জ্যেঠা নাহি উপরোধ।।
হেনমতে যদুগণে হয় মহারণ।
দারুকে ডাকিয়া কন শ্রীমধুসূদন।
সত্বরে দারুক যাহ মথুরানগরে।
মম রথ করি লহ বজ্র মহাবীরে।।
মথুরায় রাখ নিয়া প্রপৌত্র আমার।
অস্ত গেল যদুকুল কিবা দেখ আর।।
সে কারণে বজ্র লৈয়া যাও মথুরায়।
স্ত্রীগণ লইয়া পিছে যাইবে তথায়।।
আমিও পৃথিবী ছাড়ি যাব নিজস্থানে।
আজি হৈতে সপ্তম দিবস পরিমাণে।।
কার্ত্তিকী পূর্ণিমা হবে কৃত্তিকানক্ষত্র।
সেই দিনে দ্বারাবতী গ্রাসিবে সমুদ্র।।
এই সব বিবরণ কহিবে সবারে।
ব্রহ্মশাস্ত্র বুঝাইবে শোক নাশিবারে।।
তথা হৈতে হেথায় আইস শীঘ্রগতি।
পুনঃ যাইবারে হবে হস্তিনা বসতি।।
পাণ্ডবগণেরে দিয়া মম সমাচার।
আনিবেক প্রিয়সখা অর্জ্জুন আমার।।
এত বলি দারুকেরে দিলেন বিদায়।
বজ্রে ল’য়ে দারুক গেল মথুরায়।।
প্রদ্যুম্নের পৌত্র অনুরুদ্ধের তনয়।
উষার উদরে জন্ম বজ্র মহাশয়।।
মধুপুরে রাখি তারে কৃষ্ণের আদেশে।
সবাকারে সমাচার দিলেক বিশেষে।।
দারুক বচনে সবে হৈল চমৎকার।
আকাশ ভাঙিয়া শিরে পড়ে সবারকার।।
অস্থিত হইয়া সবে ভূমিতলে পড়ি।
চিত্রের পুত্তলি প্রায় যায় গড়াগড়ি।।
অচেতন দেখিয়ায় দারুক সবাকারে।
ব্রহ্মশাপ বুঝাইল বিধিধ প্রকারে।।
ব্রহ্মে মন নিযুক্ত করিয়া সবাকার।
শ্রীকৃষ্ণের নিকটে চলিল পুনর্ব্বার।।
আসিয়া দেখিল সেই প্রভাসের তীরে।
ভূমিতলে পড়িয়াছে যত যদুবীরে।।
অন্যে অন্যে মারি সবে হইল নির্ম্মূলে।।
ধূলায় ধুসর তনু অবনী লোটাই।
কেবল আছেন রামকৃষ্ণ দুই ভাই।।
শোকেতে আকুল হৈল দারুক সারথি।
মূর্চ্ছিত হইয়া সেই পড়িলেক ক্ষিতি।।
প্রবোধিয়া গোবিন্দ কহেন দারুকেরে।
সত্বর দারুক যাহ হস্তিনানগরে।।
আমার পরম বন্ধু পাণ্ডুর নন্দন।
অর্জ্জুনে আনিতে শীঘ্র করহ গমন।।
কৃষ্ণ আজ্ঞা পেয়ে চলে দারুক সারথি।
হস্তিনানগরে গেল বিষাদিত মতি।।
বলভদ্রে কহিলেন দেব নারায়ণ।
অবধান কর দেব করি নিবেদন।
এইখানে আপনি থাকহ একেশ্বর।
দ্বারকা হইতে আমি আসি ত্বরাপর।।
মাতা পিতা পরিজন না পায় বারতা।
সবা সম্বোধিতে আমি যাই শীঘ্র তথা্
যাবৎ না আসি আমি দ্বারকা হইতে।
তাবৎ আপনি হেথা থাক এইমতে।।
কৃষ্ণবাক্যে বলভদ্র করেন স্বীকার।
তোমা বিনে গতি ভাই কে আছে আমার।।
রামেরে রাখিয়া কৃষ্ণ করেন গমন।
দ্বারকানগরে আসি দেন দরশন।।
জনক জননী পুরনারীগণ যত।
সবাকারে প্রবোধ করেন সমুচিত।
পূর্ব্বে যত অমঙ্গল হইল অপার।
প্রভাসে গেলাম করিবারে প্রতীকার।।
স্নান করি একত্রে বসিল সর্ব্বজন।
কথায় কথায় দ্বন্ধ করিল সৃজন।।
সেই দ্বন্ধে মহাকোপ হয় সবাকার।
আত্ম আত্ম যুদ্ধ করি হইল সংহার।।
একজন যদুকূলে আর কেহ নাই।
কেবল আছি যে রামকৃষ্ণ দুই ভাই।।
শোকেতে আকুল রাম না আইসে ঘরে।
তপ আচরেণ তিনি প্রভাসের তীরে।।
আমিও শোকেতে প্রাণ ধরিতে না পারি।
গৃহবাস ছাড়িলাম হব তপশ্চারী।।
সংসার অসার মাত্র সব মায়াজাল।
ইহাতে মোহিত হৈলে বৃথা যায় কাল।।
এমতি সংসার ধ্বন্ধ দেখ ভাবি মনে।
স্থিরমতি করি মন দেহ তত্ত্বজ্ঞানে।।
বিষাদ ত্যজিয়া সবে ধর্ম্মে দেহ মন।
এত বলি মেলানি মাগেন নারায়ণ।।
সবার জীবন হরি নিল নারায়ণ।
চিত্রের পুত্তলি প্রায় রহে সর্ব্বজন।।
শ্বাসমাত্র শরীরে আছিল সবাকার।
অবনী লোটায় লোক শবের আকার।।
রামের নিকটে আসি শ্রীমধুসূদন।
ভাই ভাই মিলিয়া করেন আলিঙ্গন।।
প্রভাসের তীরে রাম যোগাসন করি।
হৃদয়ে পরমব্রহ্ম জপে মন করি।।
যুগল নয়নে হেরি কৃষ্ণের বদন।
যোগে তনু ত্যজিলেন রোহিণীনন্দন।
ভারত মুষলপর্ব্ব ব্যাস বিরচিত।
কাশীরাম দাস কহে করিয়া সঙ্গীত।।