মেজর চেঁচিয়ে উঠলেন, এ হে হে। তুমি শেষপর্যন্ত একটা শকুন ধরে নিয়ে এলে! বাক্যটি ইংরেজিতে বলা হয়েছিল। গোরানসাহেব হাসলেন। পাখিটাকে ওপরে তুলে দেখলেন, আমি জানতাম না শকুনেরা এত ভিতু হয়। তারপর এ বেচারা খোঁড়া!
খোঁড়া? খোঁড়া শকুন? মেজর জিজ্ঞেস করলেন।
ইয়েস। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছিল বলে সহজে ধরতে পারলাম। এটার ডানায় বোধ হয় জোর কম। গোরানসাহেব দুচোখ ভরে শকুনটাকে দেখছিলেন।
ছেড়ে দাও। ওটাকে ছেড়ে দাও। মেজর চিৎকার করলেন।
কেন? ওইভাবে চিৎকার করে ছেড়ে দিতে বলছ কেন?
কী করবে ওটা দিয়ে? শকুন পোষ মানে না।
পোষ মানে না?
হ্যাঁ। যে প্রাণীর চোখে পলক পড়ে না, সে কখনওই পোষ মানে না। শকুনের মাংস অত্যন্ত কুৎসিত, কেউ কখনও খেয়েছে বলে জানি না। তা ছাড়া এদেশে সবাই শকুনকে অমঙ্গলের পাখি বলে এড়িয়ে যায়।
অমঙ্গলের পাখি?
তোমার তো আমার চেয়ে ভাল জানা উচিত।
অর্জুন এবং গোরক্ষনাথ চুপচাপ শুনছিল সংলাপগুলো। হঠাৎ গোরক্ষনাথ ফিসফিস করে বলল, ওই শকুনটাকে যেন ছেড়ে না দেয়।
অর্জুন জিজ্ঞেস করল, কেন?
গোরক্ষনাথ বলল, দেতে হবে জন্ম থেকে খোঁড়া কিনা!
গোরানসাহেব মেজরের পাশে পৌঁছে গিয়েছিলেন, এটাকে ঠিক ফরেস্ট বলা যায় না। সাধুটার ব্যাপারে কিছু খবর পেলে?কথা বলার সময় ওঁর হাতে শকুনটা ছটফটিয়ে উঠতেই গোরক্ষনাথ চেঁচিয়ে উঠল, ছেড়ে দেবেন না।
গোরানসাহেব এবার গোরক্ষনাথের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন, এ কে?
অর্জুন এগিয়ে গেল, ওঁর নাম গোরক্ষনাথ।
গোরক্ষনাথ দুই হাত কপালে তুলে নমস্কার করল।
মেজর বাংলায় বললেন, এরকম নাম এখনও কেউ রাখে? উচ্চারণ করতে গোরানের দাঁত ভেঙে যাবে। তা বাবা গোরক্ষনাথ, তুমি কী করো?
গোরক্ষনাথ হাত নামাল না কপাল থেকে, আজ্ঞে, শান্তি স্বস্ত্যয়ন।
সেটা কী জিনিস?
আজ্ঞে, তেনারা যাতে মানুষের অপকার না করতে পারে তাই মন্ত্র পড়ে সব শুদ্ধ করে দিই। আমার গুরুর কাছ থেকে এসব শিক্ষা পাওয়া।
তেনারা মানে?
দুষ্ট আত্মা।
আচ্ছা! মেজর গোরানসাহেবের দিকে ঘুরলেন। তাঁকে ইংরেজিতে গোরক্ষনাথের পরিচয়টা দিলেন। গোরানসাহেব পাখিটাকে তুলে জিজ্ঞেস করলেন, এটাকে তুমি চাও? ইংরেজিতে প্রশ্নটা করা সত্ত্বেও বলার ভঙ্গিতে বুঝে নিয়ে গোরক্ষনাথ দ্রুত মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলল।
গোরানসাহেব কিছুক্ষণ গোরক্ষনাথের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। দেখা গেল গোরক্ষনাথও চোখ সরাচ্ছে না। হঠাৎ সাহেবের ঠোঁটে অদ্ভুত একটা বাঁকা হাসি ফুটল। তিনি হাত বাড়ালেন, নাও।
গোরক্ষনাথ দ্রুত এগিয়ে গিয়ে পাখিটাকে ধরল। ওর মাথা নীচের দিকে ঝুলছিল। হাতবদলের সময়ে সেটা তুলে ঠোকরাবার চেষ্টা করেও বিফল হল। ঝোলা থেকে একটা দড়ি বের করে প্রথমে এক হাতেই পাখির পা দুটো বেঁধে ফেলল গোরক্ষনাথ। তারপর মাটিতে শুইয়ে ঠোঁট দুটো শক্ত করে বেঁধে খোঁড়া পায়ের দিকে তাকাল। অনেকক্ষণ ধরে সেটাকে পরীক্ষা করতে লাগল সে।
মেজর উঠে দাঁড়িয়েছিলেন, কী দেখছ ওরকম করে?
আজ্ঞে, দেখছি এর পা জন্ম থেকে খোঁড়া কিনা। ঠিক বুঝতে পারছি না। এই হয় মুশকিল। হয়তো জন্মাবার পরে চোট লেগে খোঁড়া হয়েছে, এখন কোনও টাটকা ঘা নেই, গোলমাল হয়ে যাবে।
কীসের গোলমাল?
এই সময় হরিধ্বনি উঠল। বোঝা গেল শ্মশানে মৃতদেহ এসেছে। বেশ সাজ সাজ রব পড়ে গেল যেন। মেজর গোরানসাহেবকে বললেন, তুমি খুব ভাগ্যবান। আজই ডেডবডি নিয়ে এসেছে সকার করার জন্যে।
গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, তা হলে ওই সাধুটার দেখা পাওয়া যাবে?
তাই তো বলেছে। চলো, ওদিকে যাই। দুপা হেঁটে আবার পেছন ফিরে তাকালেন মেজর, এ, এতক্ষণ কী খেলাম হে! নেশার ন পর্যন্ত হয়নি। অথচ তখন কী স্বাদ লাগছিল। যাঃ, মেজাজটাই চলে গেল।
অর্জুন এবার মেজরের মুখমুখি, কী ব্যাপার বলুন তো?
কোন ব্যাপারের কথা জানতে চাইছ তা না জানলে কী করে বলব?
এই যে আপনারা শ্মশানে শ্মশানে ঘুরছেন, তার কারণটা কী?
তোমাকে বলিনি? আচ্ছা, পরে বলব। আজকাল সব কথা মনে থাকে না। কিন্তু এই লোকটি খুব ইন্টারেস্টিং। কী হে, কী বুঝলে? প্রশ্নটা গোরক্ষনাথকে।
ধরতে পারছি না বাবু। পরীক্ষা করতে হবে।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে? অর্থপেডিক ডাক্তার?
না বাবু। তার দরকার নেই। অন্ধকারে চোখ জ্বলে এমন কালো বেড়ালের সামনে নিয়ে গেলে সে ব্যাটা যদি চোখ বন্ধ করে তা হলেই কেল্লা ফতে। পাখিটাকে নিয়ে গোরক্ষনাথ উঠে দাঁড়াল।
গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, ও পাখিটাকে নিয়ে কী করবে? তুমি বললে শকুন পোষ মানে না, মাংস খাওয়া যায় না, তোমরা এটাকে অমঙ্গল বলে মনে করো। তা হলে এই লোকটা নিয়ে যাচ্ছে কেন?
অর্জুন ইংরেজিতে জবাবটা দিল, ওর ধারণা আমরা সাদা চোখে যা দেখতে পাই না, জন্ম থেকে খোঁড়া শকুন তা দেখতে পায়। তবে একা শকুন থাকলে হবে না, জন্ম থেকে কানা কাক আর কালো বেড়াল যার চোখ অন্ধকারে জ্বলে, তাদেরও সঙ্গে থাকতে হবে। এই মিটে প্রাণী দিয়ে গোরক্ষনাথ প্রেতাত্মা তাড়ায়।
মেজর হো হো করে হাসতে লাগলেন। তাঁর বিশাল ভুঁড়ি কাঁপতে লাগল। হাসতে হাসতে তিনি বেঁকে যাচ্ছিলেন। সেটা সামলে বললেন, বিজ্ঞান, তোমার বারোটা বাজিয়ে এরা ছাড়বে। অবশ্য গোরানসাহেব যখন ড্রাকুলা আছে বলে বিশ্বাস করে তখন এদের দোষ কী?
কাল রাত্রে আপনিই কিন্তু বলেছিলেন, আপনার জ্ঞান শেষ কথা নয়।
বলেছিলাম। তবু মাঝে মাঝে যখন হজম করতে অসুবিধে হয় তখন প্রাণ খুলে হেসে নিই। যাকগে, চলো, সাধুর দর্শন পাওয়া যায় কিনা দেখি।
মাঠের মধ্যে ইতিমধ্যেই চিতা সাজানোর কাজ চলছে। মৃতদেহটিকে একপাশে মাটির ওপরে শুইয়ে রাখা হয়েছে। একজন যুবক তার পা ছুঁয়ে বসে আছে বিমর্ষ মুখে। যে লোকটি মেজরকে দিশি মদ বিক্রি করছিল এখন তার চারপাশে ভিড় জমে গেছে। সেই রোগা লোকটি এখন চিতা সাজানোর কাজটা তদারকি করছে।
ওরা হেঁটে এল মৃতদেহের পাশে। লোকটি প্রবীণ। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। একটা বড় আঁচিল রয়েছে নাকের ওপর। খুব কষ্ট পেয়ে মারা গিয়েছে বলে মনে হচ্ছে না। সাহেব দেখেই বোধ হয় শ্মশানযাত্রীদের দুজন পাশে এসে দাঁড়াল।
একজন বলল, কাল বিকেলেও গগনদা গল্প করেছে। সন্ধের পরে তেঁতুলতলায় গিয়েছিল। সেখানেই পড়ে যায় মাটিতে।
তেঁতুলতলা মানে?
আজ্ঞে, আমাদের গাঁয়ের উত্তর দিকে একটা তেঁতুলবন আছে। সূর্য ড়ুবে গেলে ওদিকে কেউ যেতে চায় না। বুঝতেই পারছেন। গগনদা যে কেন গেল! লোকটা নিশ্বাস ফেলল।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, আপনাদের গ্রামটা কতদূরে?
এই তো। আট ক্রোশ হবে। গ্রামের নাম হুতুমপুর।
পুলিশকে জানিয়েছেন? অর্জুন জিজ্ঞেস করল।
পুলিশ?
হ্যাঁ। এঁর মৃত্যুটা তো স্বাভাবিকভাবে হয়নি।
না বাবু। পুলিশ মানেই ঝামেলা। সকালে খবর দিলে বিকেলে আসবে। এসে ওঁকে নিয়ে গিয়ে থানায় ফেলে রাখবে। গাড়ি পেলে সদরে নিয়ে যাবে পরীক্ষা করতে। সেখান থেকে যখন ছাড়িয়ে আনব তখন পচে-গলে যা হবে তাতে গগনদাকে আর চেনা যাবে না। মানুষটা ভাল ছিল, মরার পর অত কষ্ট দিয়ে লাভ কী? পুলিশকে খবর দিলে তো তারা এসে জীবন ফিরিয়ে দেবে না।
কিন্তু এই যে দাহ করতে এসেছেন, ডেড সার্টিফিকেট লাগবে না?
অসুখ হলে ওষুধ দেওয়ার ডাক্তার যেখানে নেই, সেখানে–। লোকটি হাসল।
গোরানসাহেব জিজ্ঞেস করলেন, কী ব্যাপার?
মেজর তাঁকে ইংরেজিতে বুঝিয়ে দিতেই তিনি উত্তেজিত হলেন, ওদের বলো, আমরা ওই তেঁতুলতলায় যেতে চাই।
ঠিক আছে, এত ব্যস্ত হওয়ার কিছু নেই। গ্রামের নাম তো জেনে নিয়েছি, যাওয়া যাবে। এখন এদের সবার মনখারাপ, সত্ত্বারটা করতে দাও। মেজর কথা শেষ করতেই রোগা লোকটা চেঁচিয়ে উঠল, লাশটাকে চিতায় ওঠাও।
সঙ্গেসঙ্গে সবাই তৎপর হল। হরিধ্বনি উঠল। গগনকে চিতায় শোওয়ানো হল।
রোগা লোকটা ছুটে গেল বন্ধ ঘরের সামনে। কী বলছে শোনা গেল না এত দূর থেকে। বলাবলির পর সে চিৎকার করল, সরে যাও, চিতার সামনে থেকে সরে যাও। পরমপূজনীয় বাবা ত্রিকালজ্ঞনাথ এখন দর্শন দেবেন।
দরজা খুলে গেল। দীর্ঘকায় একজন প্রৌঢ়, পরনে লাল কৌপীন, হাতে ত্রিশূল, সমস্ত শরীর ছাই-এ ঢাকা, মাথায় বিশাল জটা, ওই ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কোনওদিকে না তাকিয়ে সোজা চিতার সামনে এসে দাঁড়ালেন। কয়েক সেকেন্ড চোখ বন্ধ করে থাকার পর আচমকা চিৎকার করে উঠলেন, যাঃ। যাঃ। এখান থেকে দূর হ৷ যা করার তো করেছিস, এবার ওকে যেতে দে। মা, মাগো, এই অভাগাকে পার করে দাও মা।
অর্জুনের পেছনে দাঁড়িয়ে গোরক্ষনাথ ফিসফিস করে বলল, বৈতরণীর কথা বলছে। স্বর্গে যেতে হলে বৈতরণী পার হতে হয়। তিস্তার চেয়েও ভয়ঙ্কর নদী।
এবার ত্রিশূল হাতে বাবা ত্রিকালজ্ঞনাথ চিতা-পরিক্রমা শুরু করলেন। মাঝে মাঝে শূন্যে ত্রিশূলটাকে এমনভাবে ঘোরাচ্ছেন, যেন কাউকে সরিয়ে দিচ্ছেন। তারপর মৃতদেহের পায়ের কাছে দাঁড়িয়ে হাঁক দিলেন, দে, ওর শরীর মাটিতে মিশিয়ে দে।
সঙ্গে সঙ্গে হরিধ্বনি উঠল। সাধুবাবা হাঁটতে লাগলেন তাঁর ঘরের দিকে, পেছন পেছন সেই রোগা লোকটা। গোরান বললেন, চলো, ওর সঙ্গে কথা বলা যাক।
সাধুবাবা ঘরে ঢোকেননি। দরজার পাশে একটা কাঠের টুল এনে দিল রোগা লোকটা, তার ওপর বসে নিবার মা ডাক ছাড়লেন। তারপর অর্জুনদের দিকে তাকিয়ে বেশ কড়া গলায় জিজ্ঞেস করলেন, কী চাই?
মেজর অর্জুনের দিকে তাকাতেই ওর একটু বদমায়েশি করার ইচ্ছে হল। অর্জুন বলল, এঁরা আপনাকে দর্শন করতে আমেরিকা থেকে এসেছেন।
আমেরিকা। সেখানে আমার খবর পৌঁছে গেছে নাকি?
আপনি বাবা ত্রিকালজ্ঞনাথ। তিনকাল একসঙ্গে দেখতে পান। আমেরিকা তো বাড়ির কাছেই।অর্জুন সবিনয়ে বলল।
গোরানসাহেব ইংরেজিতে জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি প্রেতাত্মা দেখেছেন?
সাধুবাবা সন্দেহের চোখে তাকালেন, কী বলছে ও?
মেজর বললেন, আপনি তো এই শ্মশানে থাকেন। তাই সাহেব জানতে চাইছেন আপনার সঙ্গে পরলোকে যাঁরা থাকেন তাঁদের দেখাসাক্ষাৎ হয় কিনা?
আলবত হয়। একশোবার হয়। কিন্তু তাতে ওর কী এসে যাচ্ছে?
আজ্ঞে, এই সাহেব ওঁদের নিয়ে গবেষণা করেন।
কী শোনা?
আজ্ঞে, শোনা নয়, গবেষণা। পরীক্ষা।
ও মাস্টার। খপ করে এক মুঠো মাটি তুললেন ত্রিকালজ্ঞনাথ, কী আছে আমার হাতের মুঠোয়? মুঠো বন্ধ করে জিজ্ঞেস করলেন।
আজ্ঞে, মাটি। মেজর জবাব দিলেন।
বাঃ। তুমি যেভাবে দেখতে পেলে ঠিক সেইভাবেই আমি ওদের দেখতে পাই। যে লোকটা মরেছে তার আত্মা বেচারি চিতার পাশে ঘুরঘুর করছে। পুরনো আত্মারা ওকে দলে নেবে বলে এসেছে কিন্তু যতক্ষণ না ওর শরীর ছাই হয়ে যাচ্ছে ততক্ষণ ওকে একা থাকতে হবে। সাধুবাবা মুঠোর মাটি ছুঁড়ে দিলেন রোগা লোকটার গায়ে। সঙ্গে সঙ্গে চিকার করে উঠল, আঃ, ওঃ, মারবেন না।
কেন ঢুকেছিস? ওকে ছেড়ে ওই জঙ্গলে গিয়ে দাঁড়া। সাধুবাবা বলমাত্র রোগা লোকটি হাঁটু মুড়ে মাটিতে বসে পড়ল। সাধুবাবা হাসলেন, ব্যাটারা এত দুষ্টু, একটু সুযোগ পেলেই শরীরে ঢুকে পড়ে। প্রাকৃতিক কাজ করে হাত না ধুলে আর রক্ষে নেই। গলা খুলে বলো সবাই..মা, মা। মা ডাক শুনলে ওরা পালাবে।
একমাত্র রোগা লোকটি কয়েকবার মা মা বলে উঠে দাঁড়াল। তারপর ঘরে ঢুকে গেল। মেজর গোরানসাহেবকে বললেন, ইনি ঘোস্ট দেখেছেন। তাঁদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেন। কিছু যদি জিজ্ঞেস করার থাকে তো করতে পারো।
গোরানসাহেব বললেন, একটা প্রমাণ দিতে বলো।
মেজর সেটা জানাতে ত্রিকালজ্ঞনাথ খেপে গেলেন, কী? মাস্টার আমাকে পরীক্ষা করতে চাইছে? দেব বাণ মেরে, মুখ দিয়ে গলগল করে রক্ত বের হবে। হুঁ।
আপনি রাগ করবেন না। উনি খ্রিস্টান সাহেব, সহজে বিশ্বাস করেন না।
কেন? একটু আগে আমি একটাকে ওর শরীর থেকে তাড়ালাম, দ্যাখোনি? গোরানসাহেবকে সেটা অনুবাদ করে শোনাতে তিনি বললেন, ওটা তো অভিনয় হতে পারে। সত্যি-মিথ্যে বুঝব কী করে?
মেজর অর্জুনের দিকে তাকালেন, একথা বাংলায় ওকে বলার সাহস হচ্ছে না হে।
অর্জুন বলল, আপনি একটা কথা ভুলে যাচ্ছেন বাবা। উনি একে খ্রিস্টান, তার ওপর সাহেব। আপনি যেমন বাণ মারতে জানেন তা হিন্দুদের ওপর কাজ হলেও হতে পারে, কিন্তু সাহেবদের ওপর নয়।
কী করে সেটা বোঝা গেল?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন সাহেবরা আমাদের দেশে দুশো বছর রাজত্ব করেছিল। তাদের তাড়াবার জন্যে কত আন্দোলন হয়েছিল। সে সময় আপনার মতো কয়েকজন সাধু সাহেবদের ক্ষতি করার জন্যে বাণ ছেড়েছিলেন। কোনও কাজ হয়নি। অর্জুন চটপট বানিয়ে গল্পটা শোনাল।
দ্রুত মাথা দোলালেন ত্রিকালজ্ঞনাথ, তার একটাই কারণ, ওরা ফ্লেচ্ছ ভাষায় কথা বলে। মা, মাগে। এই সময় রোগা লোকটা এক ছিলিম গাঁজা নিয়ে এসে ওঁর হাতে দিতেই তিনি আবার মা মাগো বলে টান দিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রোগী লোকটা হাত পাতল, অনেক কথা হয়েছে। এবার বাবার সেবার জন্যে শখানেক টাকা ছাড়ুন।
গোরানসাহেব ওর হাত বাড়ানো দেখে কিছুটা আন্দাজ করে মেজরকে বললেন, বোধ হয় টাকা চাইছে, ওকে জিজ্ঞেস করুন, এদিকে কোনও ড্রাকুলা আছে নাকি! ঠিকঠাক খবর দিলে অনেক টাকা দেব।
মেজর সেটা বাংলায় বুঝিয়ে বলতেই ত্রিকালজ্ঞনাথ চোখ কপালে তুললেন। লাল টকটকে চোখ। উদ্ভ্রান্তের মতো জিজ্ঞেস করলেন, ড্রাকুলা? সেটা কী?
কিছু প্রেতাত্মা আছে যারা মানুষের শরীর ধারণ করে দিনের বেলায় ঘুমিয়ে থাকে। রাত নামলেই তারা সক্রিয় হয়। রক্তচোষা বাদুড়ের মতো মানুষের গলায় দাঁত বসিয়ে রক্ত চুষে খায়। ওরা খুব ভয়ঙ্কর এবং নিষ্ঠুর। এদের ড্রাকুলা বলে।
শরীর পাবে কোথায়? নিজের শরীরটাকে তো আত্মীয়রা ছাই করে দেবে। অন্যের শরীরে ঢুকলে ঘুমিয়ে পড়লে বিপদ হতে পারে।
যাদের কবর দেওয়া হয়–
অ। সেটা বলতে পারে হাসিমারার পীর ফকির আলি। ভাল লোক। খুব ধর্মবিশ্বাসী লোক।
ওপাশে হরিধ্বনি হচ্ছিল বারংবার। অর্জুন দেখল চিতা দাউদাউ করে জ্বলছে। গগন নামের মানুষটির আত্মা নিজের জ্বলন্ত চিতা দেখে নিশ্চয়ই খুব কষ্ট পাচ্ছে। হঠাৎ খেয়াল হল গোরক্ষনাথ আশপাশে নেই। ত্রিকালজ্ঞনাথের সঙ্গে কথা বলার সময় সে কি সঙ্গে আসেনি?
মেজর একটি একশো টাকার নোট দিলেন রোগা লোকটির হাতে। সে যে খুব খুশি হল না বোঝা গেল মুখ দেখে। ত্রিকালজ্ঞনাথ বললেন, যাচাই করো।
লোকটার যেন মনে পড়ে গেল, হ্যাঁ। বাবার কাছে তো অনেক মানুষ আসে। কদিন আগে দুজন তিব্বতি এসেছিল। সব জানার পর খুশি হয়ে ওরা একটা জিনিস দিয়ে গিয়েছে। পছন্দ হলে আপনারা নিতে পারেন।
অর্জুন জানতে চাইল, কী জিনিস?
রোগা লোকটা ঘরে ঢুকে এল। ফিরে এল তক্ষুনি, এই যে।
অর্জুন দেখল কালো কষ্টিপাথরের একটি মূর্তি। ভয়ঙ্কর দর্শন। এটি কার মূর্তি তা সে জানে না। গোরানসাহেব হাত বাড়িয়ে নিলেন। হঠাৎ তাঁর মুখে সেই হাসি ফুটে উঠল, যে হাসিটাকে অর্জুন অমল সোমের বাগানে দেখেছিল। শঙ্খচূড় সাপটাকে যখন কাক ঠোকরাচ্ছিল তখন গোরানসাহেবের মুখে এইরকম শিরশিরে হাসি ফুটে উঠেছিল।
মেজর বললেন, বাপরে বাপ। কী ভয়ঙ্কর। কার মূর্তি?
ত্রিকালজ্ঞনাথ বললেন, কালভৈরব। এই মূর্তি সঙ্গে থাকলে কেউ তোর অনিষ্ট করতে পারবে না। হ্যাঁ।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন গোরানসাহেবকে, নেবে?
নিশ্চয়ই। কত দাম?
মেজর অনুবাদ করলেন। ত্রিকালজ্ঞনাথ বললেন, যাঃ তোদের শস্তায় দিয়ে দিলাম। পাঁচ হাজার দিয়ে যা।
অর্জুন চমকে উঠল, পাঁচ হাজার?
দশ বিশ পঞ্চাশ যা চাইব পাবলিক তাই দেবে। এ হল কালভৈরব।
কিন্তু সরকার যদি জানতে পারে তা হলে বিপদে পড়ব। পুলিশ ধরবে।
পুলিশ? এটা কি পুলিশের বাবার সম্পত্তি? এদেশের জিনিসই নয়। এটা আমায় দিয়েছিল তিব্বতিরা আমাকে পুলিশ দেখাচ্ছ তুমি?
কোনও অনুরোধ শুনলেন না তিনি। অগত্যা গোরানসাহেব কড়কড়ে পাঁচ হাজার টাকা গুনে দিয়ে দিল রোগা লোকটাকে।
গাড়ির কাছে ফেরার পথে অর্জুন ইংরেজিতে বলল, ওরকম ভয়ঙ্কর মূর্তির জন্যে পাঁচ হাজার টাকা নষ্ট করার কোনও মানে হয় না।
গোরানসাহেব বললেন,মূর্তিটার বিশেষত্ব আছে। এর দাম অনেক বেশি হতে পারে। আমি তিব্বতি তান্ত্রিকদের ওপর লেখা একটা বইয়ে মনে হচ্ছে এইরকম এক মূর্তির ছবি দেখেছি।
কিন্তু ভারতবর্ষ থেকে কোনও মূর্তি বিদেশে নিয়ে যাওয়া বেআইনি।
সেটা আমি জানি না। তবে এটা তো ভারতবর্ষের কোনও মূর্তি নয়। যাকগে, এ নিয়ে পরে আলোচনা করা যাবে। গোরানসাহেব গাড়ির দরজা খুললেন।
মেজর জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কোথায় যাবে?
বাড়ি ফিরব। আপনারা?
দেখি গোরান কী বলে? তিনি গোরানসাহেবকে জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, ওই লোকটা কীভাবে মারা গেল তা জানতে চাই। জায়গাটা জেনে নিয়েছ তো?
হুঁ। হুতুমপুর। মেজর ঘুরে দাঁড়ালেন, পড়েছি মোগলের হাতে। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। বুঝলে!
অর্জুন ঘড়ি দেখল। এখন দুপুর। সে বলল, হুতুমপুরের ব্যাপারটা সন্ধের আগে গেলে জানা যাবে না। এখন জলপাইগুড়িতে ফিরে চলুন। বিকেলে আবার রওনা হবেন। এর মধ্যে খেয়েদেয়ে বিশ্রাম নিয়ে নেবেন।
মেজরসাহেবকে অনেক বলে রাজি করাতে পারলেন। ওদের গাড়িটা শহরের দিকে বেরিয়ে যেতেই গোরক্ষনাথের দেখা পাওয়া গেল। চোরের মতো এগিয়ে এসে বাইকের পেছনে উঠে বসল।
কোথায় ছিলে এতক্ষণ। বিরক্ত হল অর্জুন।
যা সন্দেহ করেছিলাম তাই ঠিক। এ ব্যাটা সাধু নয়, ভণ্ড।
কী করে বুঝলে?
আপনারা যখন বাইরে কথা বলছিলেন তখন আমি পেছনের জানলা দিয়ে ঘরে ঢুকেছিলাম। চোরাই জিনিসে ভর্তি। এ, এখানে এসে কোনও লাভ হল না। আপনি তো শহরে ফিরে যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। তবে প্রথমে আপনার বাড়িতে যাব।
কেন?
বেড়ালটাকে দেখতে। অর্জুন বাইক চালালো।