মহামান্য থুল হলঘরে প্রবেশ করা মাত্রই তাকে সম্মান দেখানোর জন্যে সবাই দাঁড়িয়ে গেল। ছোট শিশুটি মেঝেতে বসে একটা চতুষ্কোণ খেলনা দিয়ে খেলছিল, সবাইকে দাঁড়াতে দেখে সেও তার মায়ের হাত ধরে দাঁড়িয়ে যায়।
বিজ্ঞান আকাদেমীর সভাপতি মহামান্য থুল একটু এগিয়ে গিয়ে ছোট শিশুটির থুতনি ধরে আদর করে বললেন, বস। তোমরা সবাই বস।
তিনি নিজে এসে একটি চেয়ারে বসার পর সবাই তাদের জন্যে নির্দিষ্ট করে রাখা চেয়ারে বসে পড়ল। মহামান্য থুল সবার দিকে এক নজর তাকিয়ে বললেন, আমি তোমাদের শুধু বিদায় দিতে আসি নি তোমাদের এক নজর দেখতে এসেছি। পৃথিবীর বাইরে যারা নতুন পৃথিবী সৃষ্টি করবে আমি নিজের চোখে তাদের একটিবার দেখতে চাই।
।টুরান বলল, আমাদের এতো বড় দায়িত্ব দিয়েছেন সেজন্যে আপনাদের সবার প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আমাদের কৃতজ্ঞতা।
আমরা তোমাদের দায়িত্ব দিই নি, তোমরা দায়িত্বটুকু নিয়েছ। সেজন্যে তোমাদের প্রতি আমার কৃতজ্ঞতা। আমি তোমাদের ফাইলগুলো খুটিয়ে খুটিয়ে পড়েছি। আমার ধারণা তোমরা চমৎকার একটি দল হবে। তোমাদের মতো একটি দলের হাতে আমরা নিঃসন্দেহে আরো অনেকের দায়িত্ব দিতে পারি। মহামান্য থুল সবার দিকে তাকালেন তারপর নরম গলায় বললেন, তোমরা নিশ্চয়ই জান তোমাদের মহাকাশযানে তোমাদের সাথে আরো বেশ কিছু মানুষ, মানুষের ভ্রণ এবং জিনোম পাঠানো হচ্ছে। যখন তোমরা নিশ্চিতভাবে একটি বাসস্থান খুঁজে নেবে শুধুমাত্র তখন পর্যায়ক্রমে তাদের জাগিয়ে তোলা হবে কিংবা বড় হতে দেয়া হবে।
ইহিতা জিজ্ঞেস করল, সেই ধরনের মানুষের সংখ্যা কত?
থুল একটু হাসলেন, হেসে বললেন, সংখ্যাটি আমি জানি, কারণ অনেক ভেবে-চিন্তে সংখ্যাটি ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু আমরা ঠিক করেছি সংখ্যাটির কথা তোমাদের বলব না। এটি থাকুক তোমাদের জন্যে একটা বিস্ময়।
টর ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করল, মহামান্য থুল, যাত্রার শুরুতেই আমাদেরকে শীতল ঘরে ঘুমিয়ে পড়তে হবে। আমরা কেউ যদি চাই তাহলে কী আমরা জেগে থাকতে পারি?
না। তোমাদের জেগে থাকার কোনো সুযোগ নেই। ইচ্ছে করে সেই সুযোগ রাখা হয় নি। তেমাদের ভ্রমণটি তো আর এক দুই দিন বা এক দুই মাসের নয়। এটি কয়েকশ বছরের হতে পারে। আমরা চাই না তোমরা মহাকাশযানের কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে বসে থেকে থুথুড়ে বুড়ো হয়ে যাও!
মহামান্য থুলের কথা বলার ভঙ্গি শুনে সবাই হালকা গলায় হেসে ওঠে। টর কিছু একটা বলতে চাইছিল গুল তাকে থামালেন, বললেন, টর! তোমার হতাশ হবার কোনো কারণ নেই। আমি জানি সারাজীবন তুমি শুধু উত্তেজনা খুঁজে বেড়িয়েছ! তোমাকে আমরা মোটেই নিরাশ করব না। এই মহাকাশযানে যদি কিছুমাত্র উত্তেজনার সৃষ্টি হয় সেটা মোকাবেলা করার জন্যে অবশ্যই তোমাদের ঘুম থেকে ডেকে ওঠানো হবে।
ধন্যবাদ মহামান্য থুল।
তোমাদের আর কারো কোনো প্রশ্ন আছে?
কেউ কিছু বলার আগেই ক্লদ বলল, আমি কি ক্লাটুনকে সাথে নিতে পারি?
ক্লাটুন? ক্লাটুন কে?
ক্লদের মা সুহা বলল, ওর পোষা কুকুর।
থুল মাথা নাড়লেন, বললেন, আমি দুঃখিত ক্লদ। মহাকাশযানে তুমি ক্লাটুনকে নিতে পারবে না। কিন্তু তোমার দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নেই কারণ তোমাদের মহাকাশযানে কুকুর বেড়াল পশুপাখি সবকিছু আছে। তুমি নিশ্চয়ই অন্য একটি ক্লাটুন পেয়ে যাবে!
ক্লদ মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। পাব না।
কেন পাবে না?
আমার ক্লাটুনের বুদ্ধি অন্য সব কুকুর থেকে বেশি।
সুহা তার ছেলেকে থামিয়ে বলল, ঠিক আছে ক্লদ, এখন আমি একটু কথা বলি?
ক্লদ মাথা নেড়ে চুপ করে গেল। সুহা এবারে মহামান্য থুলের দিকে তাকিয়ে বলল, মহামান্য থুল, আমার একটা প্রশ্ন ছিল আমি কী আপনাকে সেটা জিজ্ঞেস করতে পারি?
কর।
আমি কখনো ভাবি নি চার বছরের একটা শিশুকে নিয়ে আমার মতো একজন মাকে এই মহাকাশযানে যেতে দেয়া হবে। আমি ধরেই নিয়েছিলাম সবাই হবে পূর্ণবয়স্ক অভিজ্ঞ মহাকাশচারী। এরকম একটি অভিযানে কেন আমাদের দুজনকে নেয়া হল?
থুল একটু হাসলেন, বললেন, তার কারণ এটি অন্যরকম একটি অভিযান। এই মহাকাশযানে আরো অনেক মানুষ, অনেক প্রাণী, গাছপালা, পশুপাখি অনেক কিছু থাকবে, কিন্তু তারা জেগে উঠবে যখন তোমরা তোমাদের অভিযান শেষ করে বেঁচে থাকার মতো একটা আবাসস্থল খুঁজে পাবে তখন। মূল অভিযানে তারা কেউ নেই, তাদের ভূমিকা মহাকাশযানের যন্ত্রপাতির মততা, জ্বালানির মতো, রসদের মতো! শুধু তোমাদের ভূমিকা হচ্ছে মানুষের।
থুল একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বললেন, মানুষের শক্তি হচ্ছে বৈচিত্র্যে, তাই তোমাদের দলটি তৈরি করা হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন ধরনের মানুষ দিয়ে। তোমরা সবাই একে অন্যের থেকে ভিন্ন। আমরা চাই তোমাদের মানবিক অনুভূতিগুলি প্রবলভাবে থাকুক। সেটা করার সবচেয়ে সহজ উপায় হচ্ছে একটি শিশুর উপস্থিতি। তাই এখানে একটা শিশুকে আনা হয়েছে। শিশু থাকতে হলে তার মাকে থাকতে হয়। তাই তুমি এসেছ।
কিন্তু যদি কখনো কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি হয়?
ছোট শিশুকে নিয়ে বিপজ্জনক পরিস্থিতি পাড়ি দেয়ার অনেক উদাহরণ এই পৃথিবীতে আছে। কাজেই সেটা নিয়ে আমরা মোটেও চিন্তিত নই।
থুল একবার সবার দিকে তাকালেন, তারপর জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের আর কোনো প্রশ্ন আছে?
ক্লদ হাত তুলে আবার কিছু একটা জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল সুহা তাকে থামাল। নীহা তখন দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, মহামান্য থুল শীতল ঘরে থাকার সময় আমাদের মস্তিষ্ক কি পুরোপুরি অচল হয়ে থাকবে?
থাকার কথা। তাপমাত্রা কমিয়ে তোমাদের জড় পদার্থ তৈরি করে ফেলা হবে।
আমরা কী তখন মস্তিষ্ক একটুও ব্যবহার করতে পারব না?
থুল হাসলেন, বললেন, তুমি চেষ্টা করে দেখ পার কিনা। না পারলেও ক্ষতি নেই, কারণ তুমি যে চিন্তাটি করতে করতে শীতল ঘরে ঘুমিয়ে পড়বে, ঘুম ভাঙবে ঠিক সেই চিন্তাটি নিয়ে। তুমি জানতেও পারবে না তার মাঝে হয়তো কয়েকশ বছর কেটে গেছে।
নীহা বলল, আমি এই অভিজ্ঞতাটুকু পাওয়ার জন্যে আর অপেক্ষা করতে পারছি না।
তোমাকে আর বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না। মহামান্য থুল আবার সবার দিকে তাকালেন, জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনো প্রশ্ন আছে?
সবাই মাথা নাড়ল, জানাল তাদের আর কোনো প্রশ্ন নেই। থুল এবারে মুটের দিকে তাকিয়ে বললেন, নুট, সবাই কিছু না কিছু বলেছে। তুমি এখনো কিছু বল নি। তুমি কি কিছু জিজ্ঞেস করবে?।
নুট নিঃশব্দে মাথা নেড়ে জানাল সে কিছু জিজ্ঞেস করবে না। মহামান্য থুল তখন উঠে দাঁড়ালেন, বললেন, তোমাদের সাথে আমার কিংবা পৃথিবীর কোনো মানুষের সাথে সম্ভবত আর কখনো দেখা হবে না। আমি তোমাদের জন্যে শুভ কামনা করছি।
তিনি উঠে দাঁড়িয়ে সবাইকে একবার আলিঙ্গন করে ধীর পায়ে হেঁটে হলঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।