০৬. মবিনুর রহমান নৌকার ছাদে

মবিনুর রহমান নৌকার ছাদে বসে আছেন। নদীতে জোছনা যেন গলে গলে পড়ছে। পৃথিবী তাঁর কাছে এত সুন্দর এর আগে কখনো মনে হয় নি। এই ব্যাপারটাও তার কাছে অস্বাভাবিক লাগছে। পৃথিবীর সৌন্দর্য নিয়ে তাঁর কোনো মাথাব্যথা ছিল না। তিনি কবি নন। বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ। প্রকৃতির সৌন্দর্যের চেয়ে প্রকৃতির নিয়ম-নীতির সৌন্দর্য তাঁকে অনেক বেশি আকর্ষণ করে। আজ সারাদিন তিনি কিছু খান নি। কারণ ঘরে কোনো খাবার নেই। সব এক সঙ্গে শেষ হয়েছে। হরলিক্সের একটা কোটায় চিড়া ছিল। মুখ খুলে দেখা গেল পোকা পড়ে গেছে। ডালের টিনে ডাল আছে। দুপুরে একমুঠ ডাল চিবিয়ে খেলেন। নাড়িতুড়ি উল্টে আসার জোগাড় হলো। বিকেল পর্যন্ত তিনি ক্ষিধেয় কষ্ট পেয়েছেন। এখন আর পাচ্ছেন না। ববং এখন মনে হচ্ছে পৃথিবীর সৌন্দর্য দেখতে হয় ক্ষুধার্ত অবস্থায়। ক্ষুধার্ত মানুষের স্নায়ু থাকে তীক্ষ্ণ। আহারে পরিতৃপ্ত একজন মানুষ ভোঁতা। স্নায়ু নিয়ে তেমন কিছু বোঝে না।

রাত নটার দিকে জালালুদ্দিন এসে উপস্থিত হলেন।

ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে অনেক ডাকাডাকি করলেন। কেউ সাড়া দিল না। সাপেব ভয়ে তিনি ঘরে ঢুকলেন না। নদীর দিকে রওনা হলেন। ঘরে যখন নেই। নৌকায় থাকতে পারে। না-কি সাপের কামড়ে ঘরে মরে পড়ে আছে?

দূর থেকে জালালুদিনের মনে হলো নৌকার উপর একটা পাথরের মূর্তি বসে আছে। জীবন্ত মানুষ এইভাবে বসে থাকতে পারে না। সামান্য হলেও নড়াচড়া করে। জালালুদ্দিন ডাকলেন, মবিন, এই মবিন!

পাথরের মূর্তি ডাক শুনতে পেল না। জালালুদিনের কেন জানি মনে হচ্ছিল শুনতে পাবে না। চিৎকার করে ডাকলেও এই মানুষ কিছু শুনবে না। গায়ে ঝাঁকি দিয়ে তাকে জাগাতে হবে।

তিনি নৌকায় উঠে এলেন।

মবিনুর রহমান চমকে উঠে বললেন, আপনি!

স্কুলে যাও নাই, খোঁজ নিতে আসলাম। করছ কী?

জ্যোৎস্না দেখছি।

কবি-সাহিত্যিকরা জ্যোৎস্না দেখে বলে শুনি–তুমি হলে গিয়ে সায়েন্সের লোক। আজ স্কুলে যাও নাই কেন? শরীব ভালো আছে?

জি, শরীর ভালোই আছে।

শরীর ভালো তো স্কুলে যাও নাই কেন? সারাদিন করেছ কী? ঘরে বসে ছিলে?

জি-না। নৌকায় ছিলাম। কিছু করছিলাম না–এই দৃশ্য-টুশ্য দেখছিলাম।

কী দৃশ্য দেখছিলে?

সন্ধ্যাবেলা কয়েক ঝাক পাখি উড়ে গেল। দেখতে খুব ভালো লাগল। পাখির ঝাকে একটা ইন্টারেস্টিং জিনিস লক্ষ করলাম। সব ঝাকে পাখি থাকে বেজোড় সংখ্যা।

এর মধ্যে ইন্টারেস্টিং কী?

খুবই ইন্টাবেষ্টিং। পাখিদের নিয়ম হচ্ছে এবং সব সময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। একটা পুরুষ পাখির সঙ্গে একটা মেয়ে পাখি থাকবেই। কিন্তু ঝাঁকগুলোয় একটা পাখি আছে সঙ্গীহীন। এর কারণটা কী? আর এই নিঃসঙ্গ পাখিটা পুরুষ না মেয়ে এটাও আমার জানার ইচ্ছ। কীভাবে সম্ভব হবে বুঝতে পারছি না। কীভাবে এটা বের করা যায় বলুন তো?

জালালুদ্দিন কিছু বললেন না। অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন। এই মানুষটিকে তিনি আট বছর ধরে চেনেন। তবু মনে হচ্ছে আট বছরে ঠিকমতো চেনা হয় নি।

মবিন।

জি।

ইয়ে একটা কাজে তোমার কাছে এসেছিলাম।

কী কাজ?

ফুড ফর ওয়ার্ক প্রোগ্রামে তুমি একবার কিছু গম এনেছিলে মনে আছে?

হ্যাঁ–মনে আছে।

কয় বস্তা গম ছিল?

দশ বস্তা।

তোমার পরিস্কার মনে আছে তো?

মনে থাকবে না কেন, আমি নিজে সই করে আনলাম।

দশ বস্তাই ছিল? এর বেশি না?

বেশি থাকবে কেন? অবশ্যি বস্তা আমি গুনি নাই। হেডসার গুনলেন। আমি শুধু সই করে দিয়েছি।

হেড স্যার বস্তা গুনেছিলেন?

এইসব জিজ্ঞেস করছেন কেন?

এমনি। এমনি জিজ্ঞেস করছি। তোমার ঘরে কি চায়ের ব্যবস্থা আছে?

না, আমি তো চা খাই না।

চায়ের একটা বাজে নেশা হয়েছে। বিকালে চা না খেলে ভালো লাগে না। আচ্ছা! আসছি। যখন তোমার চোঙটা দিয়ে আকাশ দেখে ফুই। শনির বলয় দেখা যাবে না?

আজ দেখা যাবে না। চাঁদের আলো খুব বেশি।

তাহলে থাক। নৌকায় বসে থাকতে তো ভালোই লাগছে। বড় সৌন্দর্য। কোরান মজিদে আল্লাহপাক কী বলেছেন জানো? সুরা কাহাফ-এর সপ্তম পারায় আছে–পৃথিবীর উপর যা কিছু আছে। আমি সেগুলিকে তার শোভা কবেছি। এই অর্থ ধরলে চন্দ্র হচ্ছে পৃথিবীর শোভা। কি, ঠিক না?

মবিনুর রহমান জবাব দিলেন না। তার মাথায চমৎকার একটা চিন্তা এসেছে। যদি পৃথিবীর আহ্নিক গতি না থাকত তাহলে পৃথিবীব একদিকে থাকত সূর্যের আলো, অন্যদিকে চির অন্ধকার। তখন যদি চাদটার অবস্থান এমন হতো যে, চির-অন্ধকার পৃথিবীতে থাকবে চির-জ্যোৎস্না–তাহলে ব্যাপারটা কী দীড়াত? সেই চির জোৎস্নাব জগতের গাছগুলি নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো। মানুষগুলিও হতো অন্যরকম। সেই অন্যরকমটা কী রকম?

জালালুদ্দিন ডাকলেন, মবিন!

মবিন জবাব দিলেন না। তার সমস্ত চিন্তা-চেতনায় আছে চির-জ্যোৎস্নার দেশ। ঠিক এই রকম অবস্থায় মবিনুর রহমান দ্বিতীয় স্বপ্নটা দেখলেন। এই স্বপ্ন জাগ্রত অবস্থায্য ঘোরের মধ্যে দেখা। কাজেই তাকে হয়তো স্বপ্ন বলা যাবে না। মবিনুব রহমান স্পষ্ট দেখলেন–অসংখ্য বুড়ো মানুষ তার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। তারা এক সঙ্গে বলে উঠল— হচ্ছে, তোমার হচ্ছে। তুমি একজন প্রথম শ্রেণীর নি। তুমি তোমার প্ৰচণ্ড ক্ষমতা ব্যবহার কর।

মবিন। এই মবিন!

জি।

কী হচ্ছে তোমার, এই রকম কবছ কেন?

কী করছি?

গোঁ গোঁ শব্দ করছিলে।

মবিনুর রহমান ক্লান্ত গলায় বললেন, স্বপ্ন দেখছিলাম।

স্বপ্ন দেখছিলে মানে? তুমি ঘুমুচ্ছিলে না-কি?

মবিনুর রহমান বিব্রত গলায় বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। মনে হয়। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।