মধুসূদন সরকার।
পরিধানে দামী সার্জের মভ কলারের লংস।
গায়ে গলাবন্ধ কালো ভেনিসিয়ান সার্জের লম্বা কোট।
পায়ে ডার্বী সু।
চেহারাটা বেশ লম্বা-চওড়া ও বলিষ্ঠ।
মাথার চুল পালিশ করা। রগের দুপাশে সামান্য পাক ধরেছে চুলে, বয়সের ইঙ্গিত।
মুখে ফ্রেঞ্চ-কাট দাড়ি। পাকানো গোঁফ।
ছড়ানো চৌকো চোয়াল। চোখে পুরু লেন্সের কালো সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
বসুন, বিমল সেন বললে।
বিশেষ একটা ব্যাপারে সাহায্যপ্রার্থী হয়েই আমি এসেছি দারোগাবাবু।
খালি একটা চেয়ারে বসতে বসতে মধুসূদন সরকার বললেন।
বলুন।
আপনারা হয়তো জানেন না, মৃত সারদা সরকার আমার কাকা ছিলেন। অবিশ্যি কথাটা আপনাদের না জানবারই কথা। বাবার মৃত্যুর পর তাঁর সঙ্গে মতের অমিল হওয়ায় বছর দশেক আগে আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। নানা জায়গায় ঘুরে শেষ দুটো বছর আমি রেঙ্গুনেই ছিলাম। মাত্র পরশু জাহাজ থেকে নেমেছি। সেখানেই আমাদের কলকাতার দোকানের ম্যানেজার মৃগাঙ্কবাবুর মুখে সব শুনলাম। প্রথমটায় ভেবেছিলাম ব্যাপারটা বুঝি একটা পিওর অ্যাণ্ড সিম্পল সুইসাইডই। কিন্তু আজ সকালে এখানে এসে বৃন্দাবন ও শকুন্তলা দেবীর মুখে সব ব্যাপার আদ্যোপান্ত শুনে মনে হচ্ছে-দেয়ার মাস্ট বি সাম ফাউল প্লে সামহোয়ার। তাই আপনার কাছে সোজা চলে এলাম।
কিন্তু–
শুনুন দারোগাবাবু, কথাটা তাহলে খুলেই বলি, আমি চাই ব্যাপারটার একটি মীমাংসা হোক। কাকা যদি সত্যি-সত্যিই আত্মহত্যা করে থাকেন তো কথাই নেই, তা যদি না হয়, যদি সত্যিই তাঁকে কেউ হত্যা করে থাকে, তাহলে যেমন করেই হোক হত্যা-ব্যাপারটার একটা কিনারা করতে চাই আমরা দু ভাই-ই। একসময় কাকার সঙ্গে আমার সম্পর্ক যতই তিক্ত হোক না কেন, কাকা আমাকে স্নেহ করতেন। এই দীর্ঘ দশটা বছর দুরে থাকলেও, নিজের ব্যবহারের জন্য অনুতাপের আমার অন্ত ছিল না। কতবার মনে হয়েছে ফিরে এসে ক্ষমা চেয়ে ব্যাপারটা মিটিয়ে নেব। হাজার হোক গুরুজন। তাছাড়া আমরাই তো তাঁর সব ছিলাম। বলতে বলতে একটু যেন দম নিয়ে পুনরায় শুরু করলেন, ক্ষমা চাইব বলে কত আশা করে ফিরে এসেছিলাম কিন্তু সে সুযোগটুকুও ভগবান দিলেন না। শেষের দিকে অশ্রুতে কণ্ঠস্বর মধুসূদনের রুদ্ধ হয়ে যায়।
বেশ। কিন্তু
না না, দারোগাবাবু, এ ব্যাপারে আপনার আমি সাহায্য চাই আর আপনাকে সাহায্য করতেই হবে। এমন কি এই অনুসন্ধানের ব্যাপারে খরচপত্র যাই হোক সব আমি দেব।
উপরওয়ালাকে অবিশ্যি সবই আমি জানিয়েছি–
সে আপনাদের আইনের দিক থেকে যা করবার আপনি করুন। কিন্তু শুধু ঐ আইনের উপরেই নির্ভর করে থাকতে আমি চাই না দারোগাবাবু। বেসরকারী ভাবে অনুসন্ধান করবারও যদি প্রয়োজন হয় তাও আমি করতে প্রস্তুত জানবেন।
বেসরকারী ভাবে তদন্ত?
হ্যাঁ, এদেশে ওসব ব্যাপার নেই বটে, তবে বইতে পড়েছি বিলেতে নাকি আছে। সেই রকম কিছু–
দেখুন মধুসূদনবাবু, এখানে আমি অবিশ্যি তৃতীয় ব্যক্তি-সম্পূর্ণ আউটসাইডার, কথা বললে এবারে সহসা সুশান্ত, কিন্তু ব্যাপারটা আমিও গোড়া থেকে অল্পবিস্তর জানি, তাই যদি একটা কথা বলি অন্যায় ধরবেন না, বিশেষ করে একটু আগে আপনি যা বললেন তার উত্তরে–
নিশ্চয়ই না। কিন্তু আপনি–
বিমলই অতঃপর সকলের পরিচয়টা করিয়ে দিল।
কিন্তু কি যেন বলছিলেন সুশান্তবাবু–
আপনার কাকার মৃত্যুর ব্যাপারটা হত্যাই বা ভাবছেন কেন?
দেখুন সুশান্তবাবু, কাকাকে খুব ভাল করে চিনবারই আমার সৌভাগ্য হয়েছিল দীর্ঘদিন ধরে। তাঁর মত আনস্ক্রপলাস, স্বার্থান্ধ, অর্থপিশাচ লোক ভীরুর মত আত্মহত্যা করবে, বিশেষ করে ঐ বয়সে-যখন মান সম্রম প্রতিপত্তি অর্থ সব তাঁর করায়ত্ত, আর যে-ই বিশ্বাস করুক কথাটা অন্ততঃ আমি করতে রাজী নই।
কথাগুলো বলতে বলতে মধুসূদন সরকার যেন বেশ একটু উত্তেজিতই হয়ে ওঠেন এবং ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলে বেশ একটু বিস্মিত ভাবেই ওঁর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে।
প্রথম পরিচয়ের মুহূর্তেই স্বর্গগত কাকা সম্পর্কে ভাইপোর শ্রদ্ধাটা যেন একটু বিসদৃশ বলেই ওদের মনে হয়।
কিন্তু মধুসূদনের বক্তব্য যে তখনও শেষ হয়নি পরক্ষণেই বোেঝা গেল। কারণ তিনি আবার তখনই বলতে শুরু করেছেন।
আমার কথাগুলো শুনে হয়তো আপনারা সকলেই একটু বিস্মিত হচ্ছেন। কিন্তু আমার একটা কি দোষ জানেন, সত্য চিরদিনই অপ্রিয় এবং যত অপ্রিয়ই হোক না কেন, সত্যভাষণে কখনও আমি পেছপাও হই না। আর স্পষ্টবক্তা ও চিরদিন সত্যাশ্রয়ী বলেই কাকার অপ্রিয়ভাজন আমাকে একদিন হতে হয়েছিল।
কি রকম?
বাবার আকস্মিক মৃত্যুর পর দশ বৎসর আগে কাকা অন্যায়ভাবে আমাদের ঠাকুরদামশাইয়ের এক উইল দেখিয়ে তাঁর সম্পত্তির সমান অংশ থেকে বঞ্চিত করেছিলেন বলেই তার প্রতিবাদে আমার প্রতি তিনি একান্ত বিরূপ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু যাক সেসব কথা। অতীত। তাছাড়া সেই কাকাও আজ আর বেঁচে নেই যখন, ঐসব পুরাতন কথা ভেবেও তখন আর কোন লাভ নেই। তবু কাকা আমাদের প্রতি যে ব্যবহারই করে থাকুন না কেন একদা, তাঁর মৃত্যুর ব্যাপারে সাহায্য করতে দারোগাবাবু আপনি যোগ্যতম ব্যক্তি জেনে আপনারই সাহায্যপ্রার্থী হয়ে এসেছি।
আমি আপনাকে একটা উপায় বলে দিতে পারি মিঃ সরকার। সহসা আবার সুশান্তই কথা বললে।
নিশ্চয়ই, বলুন?
আপনি কিরীটী রায়ের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন?
না।
শোনেননি?
না। শুনলেনই তো, দীর্ঘদিন বাইরেই আমার কেটেছে।
আপনি মিঃ রায়ের সাহায্য নিন। আমি হলফ করে বলতে পারি, সত্যিই যদি ব্যাপারটা, আমরা সকলেই যা অনুমান করছি-হত্যাই করা হয়ে থাকে সারদাবাবুকে, তাহলে সে হত্যার পিছনে যে রহস্যই থাকুক না কেন, জানবেন কিরীটী রায়ের সাহায্য নিলে নিশ্চয়ই সেটা আপনি জানতে পারবেন।
কিন্তু তাঁর সঙ্গে তো আমার কোন পরিচয় নেই সুশান্তবাবু, আমার কথায় তিনি কি আসবেন! তাঁর পারিশ্রমিক অবশ্যই যা তিনি চান আমরা দিতে রাজি আছি। মধুসূদন সরকার বললেন।
বেশ, আমি লিখব তাঁকে। সুশান্ত বললে।
অতঃপর সেরাত্রের মত মধুসূদন সরকার সকলের কাছ থেকে বিদায় নিলেন।
সেই রাত্রেই সুশান্ত কিরীটীকে চিঠি দিল।
প্রিয়বরেষু,
নিশ্চয়ই সুশান্ত ঘোষালকে ভুলে যাননি। বৎসরখানেক পূর্বে, মনে আছে বোধ হয় আপনার, সেই চেতলার অবিনাশ মল্লিকের কেসে আপনার সঙ্গে আমার আলাপ হবার সৌভাগ্য হয়েছেল। যাহোক আজ তার চাইতেও বিচিত্র একটা মামলার রহস্য উদঘাটনের ব্যাপারে স্থানীয় একজন ভদ্রলোক আপনার সাহায্য চান। অবিশ্যি কেবল তিনিই নন—আমি এবং আমার বন্ধু, এখানকার থানা অফিসারও ব্যাপারটার একটা মীমাংসার জন্য ইনটারেস্টেড, তাই এই পত্র আপনাকে দিচ্ছি। কলকাতার বিখ্যাত জুয়েলারী ফার্ম সরকার ব্রাদার্সের নাম নিশ্চয়ই শুনেছেন। তারই মালিক সুবিখ্যাত ধনী প্রৌঢ় সারদাচরণ সরকারকে দিন পনের পূর্বে একদিন সকালে তাঁর শয়নঘরে মৃত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখা যায়। বিস্তারিত বিবরণ হয়তো সংবাদপত্রেই আপনার নজরে পড়ে থাকবে ইতিমধ্যে। ময়না তদন্তে জানা গিয়েছে।–ইট ইজ এ কেস অফ নিকোটিন পয়েজনিং। ব্যাপারটা কিন্তু আমাদের কারোরই সুইসাইড কেস বলে মনে হচ্ছে না, তার কারণ ঐ গৃহে মৃত সারদাচরণের পার্সোন্যাল অ্যাটেনডেন্ট ছিলেন এক তন্বী সুন্দরী শকুন্তলা দেবী, যিনি এখনও সরকার ভিলা ছেড়ে যাননি। এখানে। এলে বাকি কথা সব জানতে পারবেন। যদি আসেন তা জানালে স্টেশনে উপস্থিত থাকব।
প্রীত্যর্থী
সুশান্ত ঘোষাল
তিন দিন পরেই চিঠির জবাব এল।
সুভাষণেষু,
কাল সন্ধ্যার গাড়িতে রওনা হচ্ছি। সাক্ষাতে বাকী কথা হবে। স্টেশনে থাকবেন আপনাদের বাসাতেই উঠব। নমস্কার।
ভবদীয়—কিরীটী রায়
সুশান্তর ইচ্ছা ছিল সংবাদটা পাওয়া মাত্রই মধূসুদন সরকারকে জানায় কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি ভেবে আর জানালো না।
পরের দিন প্রত্যুষেই একেবারে কিরীটীকে সঙ্গে করে নিয়ে সরকার ভিলায় যাবে ঠিক করল।
কলকাতার ট্রেনটা আসে রাত প্রায় সাড়ে নটা নাগাদ। স্টেশনটি ঘোট। দুধারে বাঁধানো প্ল্যাটফরম।
একপাশে অ্যাসবেসটাসের সেডের নীচে স্টেশন মাস্টারের ঘর, যাত্রীদের ওয়েটিং রুম ও টিকিট ঘর পাশাপাশি।
নির্দিষ্ট সময়েই কলকাতার ট্রেনটা এসে প্ল্যাটফরমে দাঁড়াল। যাত্রী সামান্যই।
স্টেশনের টিমটিমে কেরোসিনের আলোয় সুশান্ত এদিক-ওদিক অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টিতে তাকায়।
কিন্তু আকাঙিক্ষত ব্যক্তিটি তার নজরে পড়ে না।
তবে কি মিঃ রায় এলেন না।
সহসা ঐ সময় পশ্চাৎ থেকে মৃদুকণ্ঠের সম্বোধন এল, এক্সকিউস মি, আপনিই বোধ হয় সুশান্তবাবু?
কে? মিঃ রায় নিশ্চয়ই—
মৃদু হেসে কিরীটী বলে, নিঃসংশয়ে।
পরিধানে ধুতি, গায়ে কালো রংয়ের গ্রেট কোট, চোঁখে সেই কালো মোটা সেলুলয়েডের ফ্রেমের চশমা।
মুখে পাইপ। সেই পরিচিত চেহারা।
কিন্তু কোন কম্পার্টমেন্ট থেকে নামলেন দেখতে পাইনি তো! গার্ডের ভ্যানের লাগোয়া থার্ড ক্লাস ও সেকেণ্ড ক্লাস কামরাগুলোর দিকে চেয়ে দেখে দেখে হতাশ হয়ে পড়েছিলাম।
চলুন, আপনাদের ডেরা কতদূর এখান থেকে?
তা মাইলখানেক হবে। মেঠো কাঁচা রাস্তা তবে ধুলো তেমন নেই।
তা হোক, খোলা হাওয়ায় তবু তো খানিকটা হাঁটতে হাঁটতে পিওর অক্সিজেন পাওয়া যাবে, শহরে তো সে বালাই আর নেই! খুশিভরা কণ্ঠে কিরীটী বলে।
তা যা বলেছেন।
রাত্রে বাসায় ফিরে আহারাদির পর গল্পে গল্পে সুশান্ত সংক্ষেপে কিরীটীকে সারদাচরণের মৃত্যুর ব্যাপারটা বললে।
কিরীটী পাইপটা মুখে লাগিয়ে সোফার উপর হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে সব শুনে গেল নিঃশব্দে, কোন মন্তব্যই প্রকাশ করল না।
আগাগোড়া সমস্ত কাহিনীটা বিবৃত করার পরও কিরীটীর দিক থেকে কোনরূপ সাড়ামাত্রও না পেয়ে অগত্যা সুশান্তই প্রশ্ন করে, আচ্ছা মিঃ রায়, যা শুললেন তাকে কি আপনার মনে হয় কেসটা–
কি?
হ্যাঁ, মানে বলছিলাম-সুইসাইডই কিনা?
আপনার কি ধারণা?
আমার তো ধারণা, নট এ কেস অফ সুইসাইড!
ইউ আর রাইট! তবে-সারদাবাবুর মৃত্যু-সম্পর্কে যতটা শুনলাম তাতে সুইসাইড যে নয় এটা স্পষ্টই বোঝা যায়। তবে কেস অফ হোমিসাইড বললেই তো চলবে না প্রমাণ চাই!
বিমলেরও তাই ধারণা। কিন্তু বৃন্দাবনবাবুর ধারণা, কেসটা সিম্পল সুইসাইড-
মধুসূদনবাবুরও তাই ধারণা নাকি?
না। আর তাইতেই তো তিনি বিমলের কাছে সাহায্যের জন্য এসেছিলেন এবং তখনই আপনার কথা তাকে আমি সাজেস্ট করি।
শকুন্তলা কি বলে?
শকুন্তলা!
হ্যাঁ, আপনার চিঠির মধ্যে বর্ণিত সেই সুন্দরী তন্বীটি?
তা তো জানি না।
জানেন না! এত করে চিঠিতে বর্ণনা দিলেন, তার মনের কথাটাই এখনো জানেন না? তারপর মৃদু হেসে বললে, যাক চলুন তো, আগে কাল একবার সরেজমিন তদন্ত করি। তবে আর একটা কথা, শ্রীমান্ কেতুচরণের অনুসন্ধানটা করা আপনার দারোগা বন্ধুর কিন্তু উচিত ছিল সর্বাগ্রে।
কিন্তু তার তো সেইদিন সকাল থেকে কোন পাত্তাই নেই!
তারপর দশরথ। দশরথের কাছেও হয়তো অনেক কিছু জানা যেতে পারে!
দশরথ!
হ্যাঁ, কোন কু হয়তো সে আমাদের দিতে পারে। হ্যাঁ ভাল কথা, শকুন্তলা দেবী তো এখন সরকার ভিলাতেই অবস্থান করছেন, তাই না?
হ্যাঁ।