০৬. ভালোবাসার নীল আলো

সন্ধ্যা হয় নি তখনো, শেষ বিকেলের লালচে আলো গাছের পাতায় চিকচিব করছে। ফিহা বারান্দায় চেয়ার পেতে শূন্যদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। বিকাল হলেই তাঁর মনে এক ধরনের বিষণ্ণ অনুভূতি হয়।

নিকি চায়ের পেয়ালা হাতে বাইরে এসে দেখে, ফিহা ভু কুচকে দূরের গাছপালার দিকে তাকিয়ে আছেন। বাতাসে তাঁর রূপালি চুল তিরতির করে উড়ছে। নিকি কোমল কণ্ঠে ডাকল, ফিহা।

ফিহা চমকে উঠে ফিরে তাকালেন। নিচু গলায় প্রায় ফিসফিস করে বললেন, নিকি! আমার মনে হয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনা অর্থহীন।

নিকি কিছু বলল না, চায়ের পেয়ালা নামিয়ে রেখে পাশেই দাঁড়িয়ে রইল। ফিহা বললেন, জ্ঞান-বিজ্ঞান তো মানুষের জন্যে, আর একটি মানুষ কতদিন বাঁচে? তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথেই জ্ঞান-বিজ্ঞানের সঙ্গে তার সব সম্পর্কের ইতি। ঠিক নয় কি?

নিকি শক্ত মুখে বলল, না ঠিক নয়। ফিহা চুপ করে চায়ে চুমুক দিতে লাগলেন। একটু অস্বস্তির সাথে নিকি বলল, দেখুন ফিহা, আপনার সাথে তর্ক করা আমার সাজে না। কিন্তু নবম গণিত সম্মেলনে আপনি একটা ভাষণ দিয়েছিলেন–।

কী বলেছিলাম। আমার মনে নেই।

বলেছিলেন, মানব জাতি জন্মমুহূর্তেই একটা অত্যন্ত জটিল অঙ্ক কষতে শুরু করছে। এক-এক যুগে এক-এক দল মানুষ এসেছে, আর সে জটিল অঙ্কের এক একটি ধাপ কষা হয়েছে। অজানা নতুন নতুন জ্ঞান মানুষের ধারণায় এসেছে।

বেশ।

আপনি বলেছিলেন, একদিন সে অঙ্কটির সমাধান বের হবে। তখন সব রহস্যই এসে যাবে মানুষের আওতায়। বের হয়ে আসবে মূল রহস্য কী। মানুষের ছুটি হচ্ছে সেই দিন।

ফিহা বললেন, এইসব বড় বড় কথা অর্থহীন নিকি।

নিকি কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থেকে এলোমেলোভাবে বসে থাকা ফিহাকে লক্ষ করল। তারপর বলল, আপনি কি অসুস্থ বোধ করছেন ফিহা?

না নিকি, আজ আমার মতো সুস্থ আর কেউ নেই। একটু থেমে অন্যমনষ্ক স্বরে ফিহা বললেন, পৃথিবী রক্ষার উপায় বের হয়েছে নিকি। পৃথিবী এবারেরও বেঁচে গেল।

 

 

 

ফিহা বসে বসে সন্ধ্যা মিলান দেখলেন। চাঁদ উঠে আসতে দেখলেন। তাঁর মনে হল, এত ঘনিষ্ঠভাবে প্রকৃতিকে তিনি কখনো দেখেন নি। তাঁর কেমন যেন বেদনাবোধ হতে লাগল। যাবতীয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মানুষের মনে সুপ্ত বেদনাবোধ জাগিয়ে তোলে কেন কে জানে! এক সময় নিকি ভিতর থেকে ডাকল, ফিহা ভিতরে এসে পড়ুন। ভারি ঠান্ডা পড়েছে।

ফিহা নিঃশব্দে উঠে এলেন। চাবি ঘুরিয়ে নিজের ঘরের দরজা খুলে বিরক্ত গলায় বললেন, আবার–আবার এসেছ তুমি?

ভৌতিক ছায়ামূর্তি অন্ধকারে দৃশ্যান হয়ে উঠেছে। তার হাতে অদ্ভুত একটি সুঁচাল যন্ত্র। সে হতাশাগ্রস্ত কণ্ঠে বলল, আপনি আমাকে ক্ষমা করুন ফিহা।

আমি তখনি ক্ষমা করব, যখন তুমি আমার ঘর ছেড়ে চলে যাবে।

কিন্তু ফিহা, আমি ঘর ছেড়ে চলে যেতে আজ আসি নি।

তবে কী জন্যে এসেছ?

আপনাকে হত্যা করতে।

ফিহা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বললেন, তাতে তোমার লাভ?

তাহলেই আমি আমার ছেলেমেয়ের কাছে ফিরে যেতে পারব।

ফিহা মৃদু গলায় বললেন, ঠিক আছে। কীভাবে হত্যা করবে?

আমার কাছে শক্তিশালী রেডিয়েশন গান আছে মহামান্য ফিহা।

ফিহি জানালা খুলে দিলেন! বাইরের অপরূপ জোছনা ভাসতে ভাসতে ঘরের ভেতর চলে এল। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ফিহা অভিভূতের মতো বললেন, দেখ দেখ, কী চমৎকার জোছনা হয়েছে!

ছায়ামূর্তির রেডিয়েশন গানের অগ্নিঝলক সেই জোছনাকে স্নান করে দিল। কিন্তু তা মুহূর্তের জন্যেই। আবার সেই উথাল-পাথাল আলো আগের মতোই নীরবে ফুটে রইল।

—————

পরিশিষ্ট

পৃথিবী কিন্তু ধ্বংস হয়ে যায় নি।

স্রুরার কথা তো আগেই বলেছি। অসাধারণ চিন্তাশক্তির অধিকারী ছিলেন তিনি। সন্মানসূচক এক লালতারা পেয়েছিলেন খুব কম বয়সেই। শেষ পর্যন্ত তিনিই ফিহার চতুর্মাত্রিক সময় সমীকরণটিকে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে পেরেছিলেন।

আর সেই স্ত্রী-পুত্রের মায়ায় অন্ধ যুবকটি? চুতর্মাত্রিক জগতের জীবরা যাকে পাঠাল ফিহাকে হত্যা করার জন্যে?

না, তার উপর পৃথিবীর মানুষের কোনো রাগ নেই। তার লেখা থেকেই তো মাথুর জানলেন। ফিহার চতুর্মাত্রিক সময় সমীকরণটি, যা তিনি ভুল ভেবে ফেলে রেখেছিলেন—তা ভুল নয়।

আর তার সাহায্যেই তো চতুর্মাত্রিক মহাপ্লাবন রোধ করা গেল।

 

তারপর কত যুগ কেটে গেছে।

কত নতুন জ্ঞান, নতুন পথ, আপনি এসে ধর দিয়েছে মানুষের হাতে। এখন শুধু ছুটে চলা, জ্ঞানের সিঁড়ি বেয়ে সৃষ্টির মূল রহস্যের দিকে। ফিহার মত নিবেদিত প্রাণ বিজ্ঞানীরা কতকাল ধরে অপেক্ষা করে আছেন। কবে মানুষ বলবে,

তোমাদের আত্মত্যাগ মানুষদের বাঁচিয়ে রাখবার জন্যে তোমাদের সাধনা আমরা ভুলি নি। আমরা আমাদের কাজ শেষ করেছি। আমাদের কাছে কোনো রহস্যই আর রহস্য নয়।

ঠিক সন্ধ্যাবেল পুবের আকাশে যে ছোট্ট তারাটি অল্প কিছুক্ষণের জন্যে নীল আলো জ্বেলে আপনিতেই নিভে যায়, পৃথিবীর মানুষ সেটি তৈরি করেছেন ফিহার স্মরণে। সেই কৃত্রিম উপগ্রহটির সিলঝিন নির্মিত কক্ষে পরম যত্নে রাখা হয়েছে ফিহার প্রাণহীন দেহ। সে সব কতকাল আগের কথা।

আজও সে উপগ্রহটি ঘুরে বেড়াচ্ছে পৃথিবীর চারিদিকে। হিসেব মতো জ্বলে উঠছে মায়াবী নীল আলো। পৃথিবীর মানুষ যেন বলছে, ফিহা, তোমাকে আমরা তুলি নি, আমাদের সমস্ত ভালোবাসা তোমাদের জন্যে। ভালোবাসার নীল আলো সেই জন্যেই তো জ্বলে রেখেছি।