[১৯৯০ খ্রীঃ ১৯ মার্চ, সোমবার ‘ওকল্যাণ্ড এন্কোয়ারার’-পত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্য সহ বক্তৃতাটির সারমর্ম প্রকাশিত।]
সোমবার রাত্রে স্বামী বিবেকানন্দ নূতন পর্যায়ে ‘ভারতের মানুষ’ সম্পর্কে যে ভাষণ দেন, তা শুধু সে-দেশের লোকের সম্বন্ধে তথ্য-বর্ণনার জন্যই নয়, এরূপ কোন উদ্দেশ্য না নিয়েও তাদের মানসিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সংস্কার-সম্পর্কে যে অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় দিয়াছেন, তার জন্যই মনোজ্ঞ হয়েছিল। বস্তুতঃ বালবিধবা, নারী-পীড়ন এবং ভারতীয়দের বিরুদ্ধে এরূপ নানা বর্বরতার অভিযোগের আলোচনা শুনে শুনে তিনি স্পষ্টতই অনেকটা বিরক্ত হয়েছেন এবং উত্তরে পাল্টা অভিযোগ করার কিছুটা প্রবণতা তাঁর মধ্যে দেখা যায়।
ভাষণের প্রারম্ভে তিনি শ্রোতৃমণ্ডলীর নিকট ভারতবাসীর জাতিগত বৈশিষ্ট্যের পরিচয় প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, এশিয়ার অন্যান্য দেশের মত ভারতে ঐক্যের বন্ধন হল ধর্ম, ভাষা বা গোষ্ঠী (race) নয়। ইওরোপে গোষ্ঠী (race) নিয়েই জাতি (nation)। কিন্তু এশিয়ায়—যদি ধর্ম এক হয়, তবে বিভিন্ন বংশোদ্ভূত এবং বিভিন্ন ভাষা-ভাষীদের নিয়ে এক একটি জাতি গড়ে ওঠে।
উত্তর-ভারতের মানুষকে চারটি বৃহত্তর শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, কিন্তু উত্তর-ভারতের তুলনায় দক্ষিণ-ভারতের ভাষাগুলি এতই স্বতন্ত্র যে, কোন সম্পর্কই খুঁজে পাওয়া যায় না। উত্তর-ভারতের লোকেরা মহান্ আর্যজাতিসম্ভূত—যা থেকে পিরেনিজ পর্বতমালার (Pyrenees) বাস্ক্ জাতি (Basques) এবং ফিন্ জাতি (Finns) ভিন্ন সমগ্র ইওরোপের মানুষ উদ্ভূত বলে অনুমিত হয়। দক্ষিণ-ভারতের আদিম অধিবাসিগণ প্রাচীন মিশর বা সেমিটিক জাতির সমগোত্রীয়। ভারতবর্ষে পরস্পরের ভাষা-শিক্ষার অসুবিধার কথা বোঝাতে গিয়ে স্বামীজী বলেন যে, যখন তাঁর দক্ষিণ-ভারতে যাবার সুযোগ হয়েছিল, তখন সংস্কৃত-জানা মুষ্টিমেয় কয়েকজন বাদ দিয়ে তাঁকে স্থানীয় অধিবাসিগণের সঙ্গে ইংরেজীতেই কথা বলতে হত।
জাতিভেদ-প্রথার আলোচনাতেই বক্তৃতার অনেকাংশ নিয়োজিত হয়। এর বৈশিষ্ট্য বর্ণনা করে স্বামীজী বলেনঃ প্রথাটি অবশ্যই এখন খারাপ দিকে যাচ্ছে, পূর্বে অসুবিধার চেয়ে সুবিধাই ছিল বেশী, অপকারিতার চেয়ে উপকারিতাই ছিল বেশী। সংক্ষেপে বলা চলে, পুত্র সর্বক্ষেত্রে পিতার বৃত্তি গ্রহণ করবে—এই রীতি থেকেই এর উৎপত্তি। কালক্রমে এই বৃত্তিগত সম্প্রদায় বিভিন্ন শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে পড়ে এবং প্রত্যেক শ্রেণী নিজ নিজ গণ্ডির মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ হয়। এই প্রথা মানুষকে যেমন বিভক্ত করেছে, তেমনি আবার সম্মিলিতও করেছে, কারণ এক শ্রেণী বা জাতি-ভুক্ত ব্যক্তি তার স্বজাতিকে প্রয়োজনের সময় সাহায্য করতে দায়বদ্ধ, এবং যেহেতু কোন ব্যক্তিই তার নিজের শ্রেণী বা জাতির গণ্ডির ঊর্ধ্বে উঠতে পারে না, সেজন্য অন্যান্য দেশের মানুষের মধ্যে সামাজিক ও ব্যক্তিগত প্রাধান্য-বিস্তারের যে-সংগ্রাম দেখতে পাওয়া যায়, হিন্দুদের মধ্যে তা দেখা যায় না।
জাতিভেদের সবচেয়ে মন্দ দিক হল এই যে, এতে প্রতিযোগিতা দমিত থাকে এবং প্রতিযোগিতার অভাবই বাস্তবিক পক্ষে ভারতের রাজনীতিক অধঃপতন ও বিদেশী জাতি কর্তৃক ভারত-বিজয়ের কারণ।
বহু-আলোচিত বিবাহ-ব্যাপারে হিন্দুরা সমাজতান্ত্রিক; সমাজের কল্যাণের কথা চিন্তা না করে যুবক-যুবতীর পরস্পরের সঙ্গে বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারটা তারা মোটেই ভাল বলে মনে করে না, কারণ যে-কোন দুটি মানুষের কল্যাণের চেয়ে সমাজের কল্যাণ অবশ্যই বড়। ‘আমি জেনীকে ভালবাসি এবং জেনী আমাকে ভালবাসে—অতএব আমাদের এই বিবাহ করতে হবে’—এ-যুক্তির কোন সঙ্গত কারণ নেই।
বালবিধবাদের শোচনীয় অবস্থার যে-চিত্র আঁকা হয়ে থাকে, তার সত্যতা অস্বীকার করে তিনি বলেন যে, ভারতে সাধারণভাবে বিধবাদের বিস্তর প্রতিপত্তি, কারণ সে-দেশে সম্পত্তির বড় অংশ বিধবাদের করায়ত্ত। বস্তুতঃ বিধবারা এমন একটা স্থান অধিকার করে আছে যে, মেয়েরা এবং হয়তো পুরুষরাও পরজন্মে ‘বিধবা’ হবার জন্য সম্ভবতঃ প্রার্থনাও করে থাকে!
বিবাহের পূর্বেই মারা গেছে—এমন বালকদের সঙ্গে বাগ্দত্তা যে-সব মেয়ে, তাদের ও বালবিধবাদের প্রতি করুণা-প্রদর্শন সাজত তখনই, যদি বিবাহই জীবনের একমাত্র বা মূল উদ্দেশ্য হত। কিন্তু হিন্দু চিন্তাধারা অনুসারে বিবাহ বরং একটি কর্তব্য, কোন বিশেষ অধিকার ও সুযোগ নয়; এবং বালবিধবাদের পুনর্বিবাহে অধিকার না থাকা বিশেষ একটা কষ্টকর ব্যাপার নয়।