প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

০৬. ভগ ও অংশ : ধনবণ্টন

ভগ ও অংশ : ধনবণ্টন

ঋগ্বেদের নবম মণ্ডলে (৯.১১৪.৩) সাতজন এবং দশম মণ্ডলে (১০.৭২.৮) আটজন আদিত্যের উল্লেখ দেখা যায়; কিন্তু সেখানে তাঁদের নামের তালিকা পাওয়া যায় না। দ্বিতীয় মণ্ডলে (২.২৭.১) ছয়জন আদিত্যের উল্লেখ দেখা যায় এবং তাঁদের নামের তালিকাও পাওয়া যায়; মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ, অংশ। এদের মধ্যে আমরা বিশেষ করে ভগ ও অংশের কথা আলোচনা করবো।

ভগ শব্দের অর্থগুলি(২৭) দেখা দরকার। প্রথমত ভগ মানে হলো dispenser, giver—যিনি দেন। কী দেন? প্রাচুর্য, ধন, সৌভাগ্য—bounty, wealth, fortune। এই হলো ভগ-র দ্বিতীয় অর্থ। এবং এই অর্থেই ভগবান শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য হলো ঐশ্বর্যবান, ধনবান, প্রাচুর্যবান, সৌভাগ্যবান। যেমন, ইন্দ্রের বিশেষণ মঘবান—মঘ মানে ধন, ঐশ্বর্য; মঘবান মানে ধনবান, ঐশ্বর্যবান। ভগবান মানেও তাই। কিন্তু ভগের একটি তৃতীয় অর্থও আছে এবং সেই অর্থে ভগ ও অংশ অভিন্ন। অর্থাৎ, ভগের তৃতীয় অর্থ হলো অংশ, share। অধ্যাপক ম্যাক্‌ডোন্যাল(২৮) বলছেন,

The word Amsa which occurs less than a dozen times in the Rigveda is almost synonymous with bhaga, expressing both the concrete sense of ‘share, protion’ and that of ‘apportioner’,

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের শেষ সূক্তে বলা হয়েছে, “অতীতে দেবতাগণ সচেতনভাবে একত্র তাঁহাদের ভাগ গ্রহণ করিতেন”। আবার সপ্তম মণ্ডলে বলা হয়েছে, ইন্দ্রের অংশ অন্যদের চেয়ে বেশি। ভগ বলতে যদি অংশ বা share বোঝায় তাহলে ভগের ইতিহাস বৈদিক সমাজের একটি বৈশিষ্ট্যর উপরও আলোকপাত করতে পারে। কিন্তু আমাদের আধুনিক ধ্যানধারণার সাহায্যে সে বৈশিষ্ট্যকে বোঝা যাবে না; অগ্রসর হতে হবে প্রাচীন প্রাক-বিভক্ত সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে পারা তথ্যের উপর নির্ভর করে।

প্রাচীন প্রাক-বিভক্ত সমাজে মানুষ যেটুকু ধনসম্পদ আহরণ বা উৎপাদন করতে পেরেছে তার উপর কারুরই ব্যক্তিগত মালিকানা জন্মায়নি—তা পুরো দলের সম্পদ, সমষ্টিগত সম্পদ। দলের সকলেই এ-সম্পদের সমান অংশীদার। অতএব, এ-সমাজে একটি প্রধানতম কাজ হলো ধনবণ্টন। সে-বণ্টন সমবণ্টন হতে হবে, কেননা সকলেই এই ধনে সমান অংশীদার। একটি ট্রাইব যে-সম্পদ সংগ্রহ করবে তা ট্রাইবের অন্তর্গত বিভিন্ন ক্লানের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করার প্রয়োজন, একটি ক্লান যে-সম্পদ সংগ্রহ করবে তা ক্লানের অন্তর্গত সকলের মধ্যে সমানভাবে বণ্টন করা প্রয়োজন। বণ্টনের বা রিভাগের দায়িত্ব ট্রাইব বা ক্লানের প্রধানদের উপরে এবং সমবণ্টনের কৌশল হিসেবে অক্ষ বা পাশার ছক ব্যবহৃত হয় (casting the lot) : যার যা দান পড়লো সে তাই পাবে—অতএব কারুর পক্ষেই অনুযোগ-এর সুযোগ নেই। মনে রাখা দরকার, ‘দান পড়া’ অর্থে ‘দান’ শব্দটির সঙ্গে দয়ার দানের সম্পর্ক নেই— প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ভেঙে যাবায় পরই দান-পড়ার দান দয়ার-দান অর্থে পর্যবসিত হয়েছে কিনা ভেবে দেখা যেতে পারে। দান-পড়ার দান হলো ভাগ্যের কথা, বিধাতার ব্যাপার—যদিও এই বিধাতা শব্দের আদি-তাৎপর্য সংক্রান্ত আলোচনা এখনো বাকি আছে। এবং এই দিক থেকে ভাগ ও ভাগ্য শব্দের মধ্যেও সম্পর্ক থাকা অসম্ভব নয়।

এই হলো আদিম সমাজের ধনবণ্টন ব্যবস্থা এবং এই ব্যবস্থার সাহায্যেই সে-সমাজের অর্থনৈতিক সাম্য বজায় থাকে। আদিম সমাজের অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকৈও তাই primitive communism বা আদিম সাম্যব্যবস্থা বলা হয়। এইদিক থেকেই অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন প্রাচীন গ্ৰীক সাহিত্যের moira, lachos s kleros otor bota নূতন আলোকপাত করেছেন। আমরা তাঁরই গবেষণা অনুসরণ করে প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যের ভগ এবং অংশকে বোঝাবার চেষ্টা করবো। বৈদিক সাহিত্যের আদিম সমবণ্টন পদ্ধতির স্মারকগুলিকে বোঝবার সুবিধে হতে পারে এই আশায় প্রাচীন গ্ৰীকসাহিত্য প্রসঙ্গে অধ্যাপক জর্জ টমসনের(২৯) মন্তব্য কিছুটা উদ্ধৃত করা যায়:

The basic meaning of the word moira is a share or portion. As John the Deacon remarked in his commentary on Hesoid, the Moirai (goddesses of Fate) are “dispensations.” or “divisions”. With moira is associated another word, lachos, a portion given or received by the process of casting lots. One of the Moirai bore the name of Lachesis, the goddess of Allotment. In this sense lachos is synonymous with kleros, which, commonly used of a lot or holding of land, originally denoted a piece of wood used for casting lots……The land was to be distributed by lot among the tribes, and the territory of each tribe was to be subdivided by lot among the “Families” or clans. In the seventh Olympian, Pindar relates how the island of Rhodes was divided into three moirai by the sons of Helios. That these three moirai correspond to the three immigrant tribes is clear from the Homeric version of the same tradition….. Booty was distributed in the same-way. Just as the island of Rhodes, allotted to Helios, is described by Pindar as his lachos or geras, his lot or his privilege, so the same terms-moira or lachos, geras or time—are applied to the share of the spoils allotted to each warrior. The process of distribution is called as before a dasmos; and just as the king received a temenos which was “set apart” for him, so in the distribution of booty he received a “chosen gift” reserved from the general allotment. And here, too, the ultimate authority seems to have been vested in the people……
Plutarch goes on to remark that the equality of the common meal was destroyed in course of time by the growth of luxury (he should, rather, have said the growth of private property) but persisted in the public distribution of meat at state sacrifices…It may therefore be concluded that in its application to food, booty and land the idea of Moira reflects the collective distribution of wealth through three successive stages in the evolution of tribal society. Oldest of all was the distribution of food, which goes back to the hunting period. Next came the distribution of chattels and inanimate movables acquired by warfare, which was a development of hunting; and, last, the division of land for purposes of agriculture.
The use of the lot was, of course, a guarantee of equality, The goods were divided as equally as possible, and then the portions were distributed by a process which, since it lay outside human control, was impartial……

প্রাচীন গ্রীক-সংস্কৃতি প্রসঙ্গে অধ্যাপক জর্জ টমসনের এই মন্তব্যগুলি মনে রেখে এবার আমরা ঋগ্বেদের ধনবণ্টন-সংক্রান্ত তথ্যগুলি বোঝবার চেষ্টা করবো।

প্রথমত দেখা যাক, ঋগ্বেদে ধন-বিভাগের প্রসঙ্গ কতোখানি মৌলিক।

রায়ো বন্তারো বৃহতঃ স্তামাস্মে অস্তু ভগ ইন্দ্র প্রজাবান॥
অর্থাৎ –হে ইন্দ্র, আমরা ধনের বণ্টনকর্তা হইয়া মহান হইব। তুমি আমাদিগকে প্রজাযুক্ত ভগ দাও॥ ঋগ্বেদ : ৩.৩০.১৮ ॥

এখানে বণ্টনকর্তা বলতে “আমরাই”; ইন্দ্র প্রজাযুক্ত যে-ভগ দেবেন তা আমরা বণ্টন করে নেবো। তাই ভগ বলতে এখানে হয়তো ধন বা ঐশ্বর্যই। কিন্তু অন্তর দেখা যায় বৈদিক দেবতারাই বিভাগকর্তা বা বণ্টনকর্তা।

যো গা উদাজৎস দিবে বি চাভজন্মহীব রীতিঃ শবসাসরৎপৃথক্ ॥
অর্থাৎ —যিনি (ব্রহ্মণস্পতি) গরুগুলিকে আবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিলেন, তিনিই নিজবলের দ্বারা মহাস্রোতের ন্যায় সেই গরুগুলিকে দেবতাদের মধ্যে ভাগ করিয়া দিলেন ॥ ঋগ্বেদ : ২.২৪.১৮ ॥

আ নঃ স্পার্হে ভজনতা বলব্যে যদীং সুজাতং বৃষণো বো অন্তি।
অর্থাৎ,—আমাদের অর্জিত ধনসমূহে আমাদিগকে ভাগধেয় কর, যেহেতু তোমরা (মরুৎগণ) সুজাত এবং কামবর্ষী ॥ ঋগ্বেদ : ৭.৫৬.২১ ॥

বিভক্তাসি চিত্রভানো সিদ্ধোরূর্মা উপাক আ সদ্যো দাণ্ডষে ক্ষরসি ॥
অর্থাৎ, —হে চিত্ৰভানু, তুমি যজমানদিগকে সদ্য (ধন) দান কর, তুমি যেন বিভাগকর্তা— সিন্ধু যেমন তাহার সমীপন্থ তরঙ্গগুলিকে বিভাগ করে, তদ্রুপ ॥ ঋগ্বেদ : ১.২৭.৬ ॥

বিভক্তারং হবামহে বসোশ্চিত্রস্য রাধসঃ সবিতারং নৃচক্ষসম্‌॥
অর্থাৎ,—বৈচিত্র্যযুক্ত ধনসমূহের বিভক্ত, ময়ূন্যের প্রকাশকারী সবিতাকে আহ্বান করি ॥ ঋগ্বেদ : ১.২২.৭ ॥

যদস্য ভাগং বিভজাসি নৃভ্য উষো দেবি মর্ত্যত্রা সুজাতে॥
অর্থাৎ, —হে সুজাতা দেবি উষা, মনুষ্যের রক্ষাকর্ত্রি, তুমি আজ মনুষ্যদিগের মধ্যে (ধন) ভাগ করিতে যাইতেছ॥ ঋগ্বেদ : ১.১২৩.৩॥

যুবামন্দ্রাগ্নী বসুনো বিভাগে তবস্তমা শুশ্রব বৃত্ৰহত্যে॥
অর্থাৎ, —ইন্দ্র ও অগ্নি, তোমরা দুইজন বৃত্রের অনলের জন্য অতিশয় বলপ্রকাশ করিয়াছিলে এবং ধন বিভাগ করিয়াছিলে॥ ঋগ্বেদ : ১.১০৯.৫ ॥

য আদৃত্যা পরিপন্থীব শূরোহষজ্বনো বিভজন্নেতি বেদঃ॥
অর্থাৎ, —যিনি সমাদরে পরিপন্থী যজ্ঞবিহীন ব্যক্তিদিগের ধন অপহরণপূর্বক ভাগ করিতে করিতে আসিতেছেন, সেই ইন্দ্র॥ ঋগ্বেদ : ১.১০৩.৬॥
(এখানে war booty-র বা যুদ্ধলব্ধ সম্পদের বিভাগ-বর্ণন হচ্ছে; পরে আমরা এ বিষয়ে আরো দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করবো। যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বিভাগ প্রসঙ্গে অধ্যাপক জর্জ টমসনের আলোচনা দ্রষ্টব্য।)

প্রজাভ্যঃ পুষ্টিং বিভজন্ত আসতে রয়িমিব পৃষ্ঠং প্রভবন্তমায়তে॥
অর্থাৎ, —প্রজাদিগের মধ্যে ধন বিভক্ত করিয়া দিয়া (গৃহস্থগণ) গৃহে বাস করেন, যেমন গৃহাগত অতিথিগণকে ধন বিভক্ত করিয়া দেন, সেইরূপ॥ ঋগ্বেদ : ২.১৩.৪ ॥

ক্ষপাং বস্তা জনিতা সূর্যস্য বিভক্তা ভাগং ধিষণেব বাজম্॥
অর্থাৎ, —যিনি (ইন্দ্র) রাত্রির আচ্ছাদয়িত সূর্যের জনক এবং ঐশ্বর্ধশালীর ন্যায় অন্নের ভাগগুলি বিভক্ত করেন॥ ঋগ্বেদ : ৩.৪৯.৪॥

দেবং বো অদ্য সবিতারমেষে ভগং চ রত্নং বিভজন্তমায়োঃ॥
অর্থাৎ, —আজ সেই দেবতা সবিতার নিকট গমন করি, যিনি ভগ, রত্ন এবং আয়ুকে বিভাগ করিতে করিতে আসেন॥ ঋগ্বেদ : ৫.৪৯.১ ॥ (এর পরের ঋক্‌টিতেও সবিতার বর্ণনাতেই বলা হয়েছে—জ্যেষ্ঠং চ রত্নং বিভজন্তমায়োঃ।)

ভগো বিভক্ত শবসাবসা গমছুক্ষব্যচা অদিতিঃ শ্রোতু মে হবম্‌।
অর্থাৎ,–ভগ, অন্ন এবং রক্ষণ বিভক্ত করিয়া আগমন করুন এবং সর্বব্যাপী অদিতি আমার আহ্বান শুনুন ॥ ঋগ্বেদ : ৫.৪৬.৬ ॥

সত্রা মদাসস্তব-বিশ্বজন্যাঃ সত্রা রায়োহধ যে পার্থিবাস।
সত্রা বাজানামভবো বিভক্ত যদেবেষু ধারয়থা অসূৰ্যম্॥
অর্থাৎ,—(হে ইন্দ্র), তোমার পানজনিত শক্তি বিশ্বহিতের জন্যই; অধোদেশে যে ধনসমূহ আছে তাহাও (বিশ্বহিতের জন্যই)। তুমি প্রকৃতই অল্প এবং অয়ের বিভক্ত হইয়াছিলে এবং এইজন্যই তুমি দেবগণের মধ্যে বলবত্তম ॥ ঋগ্বেদ : ৬.৩৬.১ ॥

…ইন্দ্রঃ একো বিভক্তা তরণির্মঘানাম্।
অর্থাৎ, —ইন্দ্র ত্রাণকর্তা এবং ধনসমূহের একমাত্র বিভক্তা ॥ ঋগ্বেদ : ৭.২৬.৪ ॥

…মহো অর্ভস্য বসুনো বিভাগে।
উভ তে পূর্ণা বসুনা গভস্তী।
অর্থাৎ, —মহান ও অল্প (উভয়) ধনের বিভাগকালে তোমার (ইন্দ্রের) উভয় হস্ত ধনের দ্বারা পুর্ণ ছিল ॥ ঋগ্বেদ : ৭.৩৭.৩ ॥

যদদ্য দেবঃ সবিতা সুবাতি স্যামাস্য রত্নিনো বিভাগে॥
অর্থাৎ, —আজ যে দেব সবিতা আমাদিগকে দিতেছেন, আমরা সেই রত্নবানের বিভাগ কার্যে উপস্থিত থাকিব ॥ ঋগ্বেদ : ৭.৪০.১ ॥

ত্বং নো মিত্রো বরুণে ন মায়ী পিত্বো ন দস্ম দয়সে বিভক্তা।
অর্থাৎ, —মিত্র ও বরুণের ন্যায় মায়াযুক্ত হইয়া হে দর্শনীয় (ইন্দ্র), তুমি আমাদিগের অন্নের বিভক্ত ও দাতা হও ॥ ঋগ্বেদ : ১০.১৪৭.৫ ॥

তাহলে ঋগ্বেদের কবিতা ও গানগুলি প্রধানতই কামনার কবিতা ও গান। সে-কামনা প্রধানতই পার্থিব সম্পদের কামনা। এই পার্থিব সম্পদ একার জন্য নয়, সকলের জন্য : “আমার” জন্য চাওয়া নয়, “আমাদের” জন্য চাওয়া। সকলের জন্য বা সাধারণের জন্য এই সম্পদ সকলের মধ্যে বিভাগ করে দেবার কামনাও জানানো হয়েছে। এইভাবে সকলের মধ্যে অর্জিত ধন। বিভাগ করবার ব্যবস্থাও প্রাচীন প্রাক-বিভক্ত সমাজেরই বৈশিষ্ট্য।

নিম্নোক্ত ঋকটি অপেক্ষাকৃত দুর্বোধ্য; সায়নভাষ্য থেকে অনুমান হয় এর মধ্যে কোনো আদিম জাদুবিশ্বাসগত অনুষ্ঠানের ইংগিত থাকা সম্ভব। তবুও আদিম সাম্যাবস্থার সাক্ষ্য হিসেবে ঋক্‌টি মূল্যবান বিবেচিত হতে পারে; কেননা এর মধ্যে সমবণ্টনের একটা ইংগিত পাওয়াও হয়তো অসম্ভব নয়।

যুযু্যতঃ সবয়সা তদিদ্বপুঃ সমানমৰ্থং বিতরিত্রতা মিথঃ।
আদীং ভগো ন হব্যাঃ সমস্মদা বোল্‌হর্ন রশ্মীস্ত্‌ সমযংস্ত সারথি ॥
অর্থাৎ, —পরস্পর সমান অর্থ বিতরণ করিতে প্রবৃত্ত হইয়া সমানবয়স্ক (ব্যক্তিগণ) তাহার (অগ্নির) শরীরকে যেমন স্ব স্ব ব্যাপারে নিযুক্ত করিতে চেষ্টা করে, ভগ আমাদিগের হব্যকে তদ্রুপ করেন, সারথি যেরূপ রশ্মিদ্বারা রথকে সংযত করে ॥ ঋগ্বেদ : ১.১৪৪.৩ ॥

নিম্নোক্ত ঋক্‌টিতে ভগ শব্দ অংশ বা share হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে এবং ঋক্‌টির প্রতি বৈদিক কবি নিশ্চয়ই বিশেষ গুরুত্ব অর্পণ করতে চেয়েছিলেন, কেননা ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মণ্ডলে এই ঋকটিই সাতটি সূক্তে পাওয়া যায় :

নূনং সা তে প্রতি বরং জরিত্রে দুহীয়দিন্দ্র দক্ষিণা মঘোনী।
শিক্ষা স্তোতৃভ্যো মাতি ধগ্‌ভগো নো বৃহদ্বদেম বিদথে সুবীরাঃ।
অর্থাৎ, —হে ইন্দ্র, স্তোতাদিগের প্রতি দেয় দক্ষিণা তুমি দোহনপূর্বক আমাদের দাও। স্তোতৃদের শিক্ষা দাও, আমাদের ভগ পুর্ণ কর, আমরা বিশেষভাবে এই সভায় বীরপুত্রের জন্য তোমাকে অনুরোধ করি। ॥ ঋগ্বেদ : ২.১১.২১ : ২.১৫.১০ : ২.১৬.৯ : ২.১৭.৯ : ২.১৮.৯ : ২.১৯.৯ : ২.২০.৯ ॥

 

এবার অংশের আলোচনা করা যাক। অংশ ও তৎজাত শব্দ ঋগ্বেদে এগারো বার উল্লিখিত হয়েছে। অংশ মানে যে ভাগ বা share এ-বিষয়ে নিশ্চয়ই সন্দেহ নেই; কিন্তু অংশ শব্দ প্রসঙ্গে একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ে। অংশ শব্দের ব্যবহারের সঙ্গে প্রায়ই যুদ্ধের প্রসঙ্গ দেখতে পাওয়া যায়। তাই অংশ শব্দ বিশেষ করে war booty-র share বা যুদ্ধে অর্জিত ধনসম্পদের ভাগ বোঝাতে পারে। যদি তাই হয় তাহলে অনুমান করবার অবকাশ থাকে যে, অন্যান্য প্রাচীন সমাজের মতোই বৈদিক সমাজেও যুদ্ধেজেতা ধনসম্পদের উপর কারুর একার অধিকার ছিলো না; তাতেও সকলের অংশ বা ভাগ ছিলো।

বয়ং জয়েম ত্বজা যুতা বৃতমস্মাকমংশমুদবা ভরেভরে।
অর্থাৎ,–(হে ইন্দ্র), আমরা তোমার সহিত যুক্ত হইয়া শত্রুকে জয় করি। তুমি আমাদের অংশ রক্ষা কর ॥ ঋগ্বেদ : ১.১০২.৪ ॥

যাভির্ভরে কারমংশায় জিন্বথ…
অর্থাৎ, —যাঁহাদের (অশ্বিনীদ্বয়ের) সহায়তায় তুমি (অগ্নি) যুদ্ধে ধ্বনি করিয়া আমাদের অংশ জয় কর ॥ ঋগ্বেদ : ১.১১২.১ ॥

আ নস্তুজং রয়িং ভরাংশং ন প্রতিজানতে।
বৃক্ষং পক্কং ফলমন্ত্ৰীব গৃহহীন্দ্র সংপারণং বস্তু।
অর্থাৎ, —হে ইন্দ্র, আমাদের শক্রদের ধনের অংশ আমাদিগকে দিতে প্রতিজ্ঞা কর; যেমন অঙ্কুশহস্ত ব্যক্তি বৃক্ষ আন্দোলিত করিয়া পক্ষ ফল (আহরণ করে) সেইরূপ আমাদের ধন আহরণ কর।। ঋগ্বেদ : ৩.৪৫. ৪।।

দেবো ভগঃ সবিতা রায়ো অংশ ইন্দ্রো বৃত্ৰস্য সংজিতো ধনানাম্।
ঋভূক্ষা বাজ উত বা পুরুদ্ধিরবন্ধ নো অমৃতাসস্তুরাসঃ।
অর্থাৎ, —ভগ, সবিতা, বৃত্রের বিজেতা ইন্দ্র, জিত ধনের অংশ আমাদিগকে দিন। সেই মৃত্যুহীন (দেবগণ) ত্বরান্বিত হইয়া, বহুভাবে আমাদিগকে এবং আমাদের ধন ও অল্পকে রক্ষা করুন ॥ ঋগ্বেদ : ৫.৪২.৫।।

প্রাচীন গ্রীক-সাহিত্য বিচার করে অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন তা মনে রাখলে ঋগ্বেদের এই বিভাগ, ভগ, অংশ প্রভৃতির সাক্ষ্যগুলিকে বোঝবার সুবিধে হতে পারে। প্রধানত তিন রকম প্রসঙ্গে তিনি moira-র উল্লেখ লক্ষ্য করেছেন। এক, অল্পবিভাগ। দুই যুদ্ধের অর্জিত ধনের বিভাগ। তিন, বিভিন্ন ট্রাইব ও ক্লানের মধ্যে চাষের জমি বিভাগ। এবং তিনি বলছেন, এ-থেকে ট্রাইব্যাল-সমাজের তিনটি পর্যায়ের সমবণ্টন-ব্যবস্থা অনুমান করা যায়। প্রাচীনতম বণ্টন-ব্যবস্থা বলতে অল্প-বিভাগ, শিকারজীবী পর্যায় থেকেই এর শুরু। তারপর শিকার থেকে (পশুপালন এবং প্রধানতই পশুলাভের কামনায়) যুদ্ধ বিগ্রহের পর্যায়ে উপনীত হবার সময় থেকে, বন্টন বলতে প্রধানতই যুদ্ধে জিত গোসম্পদ প্রভৃতিরই বন্টন। সর্বশেষে, কৃষিজীবী পর্যায়ে পৌঁছে চাষের জমি বিভাগ বা বন্টন করবার ব্যবস্থা।

অধ্যাপক জর্জ টম্‌সনের এই সিদ্ধান্তকে প্রাচীন সমাজের সম-বণ্টন সংক্রান্ত সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্য হিসেবে গ্রহণ করে আমরা ঋগ্বেদের সাক্ষ্যগুলি বোঝবার চেষ্টা করবো।

অন্ন-বিভাগের কথা ঋগ্বেদে বিরল নয়; আমরা ইতিপূর্বে সে-বিষয়ে কিছু দৃষ্টান্ত উদ্ধৃত করেছি। এবং এমনকি আদিম শিকারজীবী পর্যায়ের বন্টন ব্যবস্থার কথাও যে বৈদিক ঋষিদের স্মৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুছে যায়নি তারই একটি চিত্তাকর্ষক সাক্ষ্য হিসেবে আমরা বৈদিক সাহিত্যে শ্বঘ্নিন শব্দের উল্লেখ পাই কিনা সে-বিষয়ে ভেবে দেখবার অবকাশ আছে। শ্বঘ্নিন বলতে একদিকে যেমন শিকারী বোঝায় আবার অপরদিকে তেমনি দূতকারকেও বোঝায়(৩০)। শিকারের সঙ্গে পাশার এই সম্পর্ক শিকারজীবী পর্যায়ের অক্ষের সাহায্যে (casting the lot) অন্ন-বন্টনের আদিম কৌশলটির ইতিহাসের ইংগিত দেয় কিনা, সে-বিষয়ে বেদবিদেরা আশা করি চিন্তা করবেন।

যুদ্ধে-জিত ধন-বন্টনের কথাও ঋগ্বেদে বিরল নয়; আমরা অংশ শব্দটির সূত্রে বিশেষ করে এই ইংগিতটিরই সন্ধান করেছি।

বৈদিক আর্যরা প্রধানতই পশুপালক ছিলেন; তাই কৃষির জন্য জমিবিভাগের কথা বৈদিক সাহিত্যের মধ্যে ততো বেশি করে বা ততো স্পষ্টভাবে পাবার কথা নয়। তবুও, আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো ঋগ্বেদের অর্বাচীনতম অংশে—দশম মণ্ডলে—কৃষির সঙ্গে অক্ষের সম্পর্কের ইংগিত পাওয়া যায় এবং প্রাচীন সমাজের সমবণ্টন-কৌশল হিসেবে অক্ষের ব্যবহারকে যদি আমরা সাধারণভাবে জানতে-পারা তথ্য হিসেবে গ্রহণ করতে স্বীকৃত হই, তাহলে কৃষিপ্রসঙ্গে এই অক্ষের উল্লেখের পিছনে আমরা হয়তো ভূমিবণ্টন-ব্যবস্থার ইংগিত অনুসন্ধান করতে পারি।

কিন্তু এ-আলোচনা তোলবার আগে ঋগ্বেদের অক্ষ সংক্রান্ত তথ্যের উল্লেখ প্রয়োজন।

 

প্রাচীন সমাজে সম-বন্টনের কৌশল হিসেবে অক্ষের ব্যবহার চোখে পড়ে। —যার যা দান পড়বে সে তাই পাবে। অধ্যাপক জর্জ টম্‌সন(৩১) দেখাচ্ছেন, আদিম সাম্যসমাজের স্মারক হিসেবে এই কৌশলটির পরিচয়, এমনকি গ্রীসে নগররাষ্ট্র গড়ে ওঠবার পরেও গণতান্ত্রিক শাসন-নীতির অঙ্গ হিসেবে বহুলাংশেই বর্তমান ছিলো। বৈদিক সাহিত্যেও অক্ষ-প্রসঙ্গের অভাব নেই, যদিও আধুনিক বিদ্বানেরা(৩২) একে জুয়াখেলা অর্থেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু সেই অর্থই একমাত্র অর্থ কিনা তা ভেবে দেখবার অবকাশ আছে।

দশম মণ্ডলের অক্ষসূক্তে (ঋগ্বেদ : ১০.৩৪) নিশ্চয়ই জুয়াখেলার বর্ণনা রয়েছে এবং জুয়া অর্থে অক্ষের নিন্দাও রয়েছে। “যে-ব্যক্তি পাশা ক্রীড়া করে তাহার শত্রু তাহার উপর বিরক্ত, স্ত্রী তাহাকে ত্যাগ করে, যদি কাহারও কাছে কিছু যাঞ্চা করে, দিবার লোক কেহ নাই। যেরূপ বৃদ্ধ ঘোটককে কেহ মূল্য দিয়া ক্রয় করে না, সেইরূপ দ্যূতকার কাহারও নিকট সমাদর পায় না”— (ঋগ্বেদ : ১০.৩৪.৩)—ইত্যাদি, ইত্যাদি। এবং অতএব, “অক্ষৈঃ মা দীব্যঃ কৃষিম্ ইৎ কৃষস্ব” (১০.৩৪.১৩),—অর্থাৎ অক্ষের সাহায্যে কখনো জুয়া খেলো না, বরং কৃষিকাজ করো, ইত্যাদি ইত্যাদি।

কিন্তু ঋগ্বেদের এই মণ্ডলই সবচেয়ে অর্বাচীন এবং আমরা দেখাবার চেষ্টা করবে, ঋগ্বেদের এই মণ্ডলটিতেই প্রাচীন প্রাক্-বিভক্ত সমাজ ভেঙে যাবার পরিচয় প্রকট হয়েছে। তাই দশম মণ্ডলে অক্ষকে যে-ভাবে জুয়াখেলায় প্রযুক্ত হতে দেখা যায় তা বৈদিক সাহিত্যে অক্ষের আদি-তাৎপর্য না হতেও পারে। তাছাড়া দ্রষ্টব্য হলো, জুয়াখেলার অর্থ ছাড়াও এই অক্ষমূক্তেই অক্ষের অন্য প্রয়োগ সংক্রান্ত কিছু কিছু ইংগিত আছে। অক্ষস্থক্তের ব্যাখ্যার ভূমিকায় সায়ন সর্বানুক্রমণী থেকে উদ্ধৃত করছেন, প্রাবেপাঃ সলূনা মৌজবাম্বাক্ষোহক্ষ কৃষিপ্রশংসা চাক্ষকিতবনিন্দ চ। অর্থাৎ, কিতব বা জুয়া অর্থে অক্ষের নিন্দা এবং অক্ষ-কৃষি-প্রশংসাই এই অক্ষমূক্তের মূল প্রতিপাদ্য। এ-কথার মানে যাই হোক না কেন অন্তত এটুকু নিশ্চয়ই বোঝা যায় যে, জুয়াখেলার অর্থ ছাড়াও বৈদিক মানুষদের কাছে অক্ষের একটা অন্য ব্যবহার জানা ছিলো। এবং অক্ষের অন্য কোনো ব্যবহারের কথা অনুমান না করলে নিম্নোক্ত সাক্ষ্যগুলিকেও নেহাতই বৈদিক যুগের জুয়াড়িদের মাত্রারিক্ত উচ্ছৃঙ্খলতা বলেই গ্রহণ করতে হয়। আমাদের যুক্তি হলো, বৈদিক সাহিত্য প্রাচীন বলেই আধুনিক ধ্যানধারণা দিয়ে বা আধুনিক জীবনের বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে তার ব্যাখ্যা পাওয়ার সম্ভাবনা সুদূরপরাহত। আধুনিক লাম্পট্য-ব্যবহারের অনুরূপ হিসেবে বৈদিক বামাচারকে (পৃ. ১০২-১১২) বা আধুনিক সুঁড়িখানার আলোয় বৈদিক সুরাপানকে বোঝা যায় না। তেমনিই, আধুনিক জুয়াড়ির উপমান হিসেবে বৈদিক মানুষদের অক্ষ দেবতা এবং দ্যূতকার দেবতাকে (ঋগ্বেদ : ১০.৩৪) চেনবার চেষ্টা করা ভুল হবে। অর্থাৎ, কালক্রমে এই অক্ষত্ৰীড়াই যদিও জুয়াখেলায় পরিণত হয়েছিলো, তবুও বৈদিক সাহিত্যে অক্ষের প্রতি যে-সন্মান ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে তার পিছনে অক্ষের প্রাচীন মহিমার স্মারক থাকতে পারে।

অথৰ্ববেদে(৩৪) পাশার দান ফেলার সঙ্গে বরুণের নিয়ম প্রবর্তনের তুলনা করা হয়েছে; দ্যূতকার যে-ভাবে অক্ষের দান ফেলেন দেবতা বরুণও সেইভাবেই নিয়মের প্রবর্তক হন। এর মধ্যে নিশ্চয়ই অংশ-বন্টনের কথা নেই; কিন্তু পাশার দান পড়ার সঙ্গে অমোঘ নিয়মের—ঋতের—সম্পর্কও তুচ্ছ নয়।

তারই পরিচয় পাওয়া যায় শতপথব্রাহ্মণের রাজসূয় যজ্ঞের(৩৫) বর্ণনায়, যদিও বৈদিক সাহিত্যের অন্যান্য উল্লেখের মতো এই উল্লেখটিতেও পাশা বা অক্ষের ব্যবহার অনেকাংশেই দুর্বোধ্য। কিন্তু এটুকু বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই যে, শতপথব্রাহ্মণের এই বর্ণনায় রাজা ন্যায় ও নিয়মের ধারক হবার প্রতিজ্ঞা প্রসঙ্গেই পাশার ছকগুলি হাতে গ্রহণ করেন। এর থেকে কি অনুমান করা যায় না যে, এখানেও অক্ষ জুয়ার আয়োজনে নয়, তার বদলে ওই অক্ষ ন্যায় ও নিয়মের সঙ্গে জড়িত?

ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলে অক্ষমূক্তেও অক্ষগুলি হাতে ধারণ করে ঋতের বা সত্য ও নিয়মের আনুগত্য অঙ্গীকার করবার ইংগিত রয়েছে; এবং এই ইংগিতকে শুধুমাত্র পাশাখেলার ব্যাপারে নিয়মনিষ্ঠ হবার অঙ্গীকার বলে কল্পনা করায় বাধা হলো, অক্ষকেই(৩৬) এখানে মহৎ গণের সেনানী এবং ব্রাতের রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে :

যো বঃ সেনানীর্মহতো গণস্য
রাজা ব্রাতস্য প্রথমো বভূব
তস্মৈ কৃণোমি ন ধনা রুণষ্মি
দশাহং প্রাচীস্তদৃতং বদামি।
অর্থাৎ, —যিনি তোমাদিগের মহৎ গণের দলপতি (সেনানী) এবং ব্রাতের শ্রেষ্ঠ রাজা হইলেন, তাহাকেই আমি বলিতেছি যে, আমি ধন রোধ করিতেছি না, দশ অঙ্গুলি বিস্তৃত করিয়া ঋত বলিতেছি॥ ঋগ্বেদ : ১০:৩৪.১২॥

শেষ অংশে ধন রোধ না করবার অঙ্গীকারটি অবশ্যই উল্লেখযোগ্য। অধ্যাপক ম্যাকডোন্যাল(৩৭) বলছেন, ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলেই ধনদায়ী অক্ষের দানের সঙ্গে দেবতাদের তুলনা করা হয়েছে।

ছান্দোগ্য-উপনিষদে (৪.১.৪) যা ভালো তার সবকিছু রৈক্কর ভাগে পড়বার কথা পাওয়া যায় এবং সেই সঙ্গেই পাওয়া যায় অক্ষের উল্লেখ; যদিও অবশ্যই ছান্দোগ্যর এই অংশটির প্রকৃত তাৎপর্য অনেকাংশেই দুর্বোধ্য। তেমনিই ঋগ্বেদের উপরোক্ত উক্তিগুলির দুর্বোধ্যতা সত্ত্বেও অক্ষের সঙ্গেই অংশবন্টনের ও ধনপ্রাপ্তির একটা অস্পষ্ট ইংগিত খুঁজে পাওয়া যায় কি না তা বেদবিদেরা বিচার করে দেখতে পারেন।

অক্ষ-প্রসঙ্গেই আরো একটি কথা মনে রাখা প্রয়োজন। অন্যান্য প্রাচীন সমাজের মতোই বৈদিক সমাজেও সভা-সমিতির স্থান যে কী রকম পরম গুরুত্বপূর্ণ, সে-বিষয়ে একটু পরেই আমরা আলোচনা তুলবো। আপাতত আমাদের মন্তব্য শুধু এই যে, এই কথাটি মনে রাখলে বৈদিক মানুষের জীবনে অক্ষের গুরুত্বকেও নেহাত জুয়াখেলা মনে করবার অবকাশ থাকে না। কেননা অক্ষরাজকে সভাস্থানু

(pillar of the assembly) বলা হয়েছে এবং সেই সভার একটি অন্যতম কাজ বলতে যে পাশার দান ফেলাই ছিলো—সেবিষয়ে আধুনিক বেদবিদেরা নিঃসন্দেহ। কেবল, প্রাচীন সমাজের শাসন-ব্যবস্থায় পাশার দান-ফেলাসংক্রান্ত সাধারণভাবে-জানতে পারা তথ্যের ভিত্তিতে বিষয়টিকে বোঝবার চেষ্টা করেননি বলেই তারা এ-বিষয়ে অস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছতে বাধ্য হয়েছেন :

Sabha is the name of the assembly of the Vedic Indians as well as the hall where they met in assembly…The hall was clearly used for dicing, presumably when the assembly was not transacting public business: a dicer is called Sabha sthanu, pillar of the assembly, doubtless because of his constant presence there.(৩৮)

বৈদিক মানুষদের সভায় দূতকারের যে-এতোখানি গুরুত্ব তার কারণ কি এই যে, ওই সভায় তিনিই ছিলেন ধনের বিভাগকর্তা এবং অক্ষই ছিলো সে-বিভাগের কৌশল? এই প্রশ্নটি অন্তত অপ্রাসঙ্গিক নয়; কেননা ঋগ্বেদে সমিতি এবং ধনবিভাগ বা অংশ-বণ্টনের উল্লেখ একত্রে পাওয়া যায়।

যদগ্ন এষা সমিতির্ভবাতি দেবী দেবেষু যজতা যজত্র।
রত্না চ যদ্‌বিভজাসি স্বধাবো ভাগং নো অত্র বসুমন্তং বীতাৎ ॥
অর্থাৎ, —হে অগ্নি, যখন এই সমিতিতে আসিয়া যজনীয় দেবতাগণের মধ্যে সর্বাপেক্ষ দীপ্তিমান হও; এবং যে রত্নসমূহ ও অন্নসমূহ তুমি বিভক্ত কর তাহার সমৃদ্ধ ভাগ এইস্থানে (সমিতিতে) আমাদিগকে দাও। ঋগ্বেদ : ১০.১১.৮ ৷৷

ত্বমগ্নে রাজা বরুণো ধৃতব্রতত্ত্বং মিত্রো ভবসি দষ্ম ঈড্যঃ।
ত্বমৰ্ষমা সৎপতির্ষস্য সংভূজং ত্বমংশো বিদথে দেব ভাজযুঃ।।
অর্থাৎ,—হে অগ্নি, যেহেতু তুমি ব্রতধারী, সেইহেতু তুমি রাজা বরুণের তুল্য; শত্রুর অভিভবকারী এবং স্তুতিযোগ্য বলিয়াই তুমি মিত্র-(দেবতা)র তুল্য; তুমি সাধুগণের পালক বলিয়াই অর্যমার তুল্য; এবং তাহার ধনের অংশ তুমি এই বিদথে (সভায়) দান করিয়া থাক।। ঋগ্বেদ : ২.১.৪।।

এমনকি, বেতাগণও এই সভাতেই তাদের হাৰ্য ভাগ পেয়ে থাকেন।

অগ্নে যহ্বস্য তব ভাগধেয়ং ন প্র মিনন্তি বিদথেষু ধীরাঃ।।
অর্থাৎ, —হে অগ্নি, ধীরগণ সভাগুলিতে (বিদথগুলিতে) তোমার মহান ভাগটিকে হিংসা করে না।। ঋগ্বেদ : ৩.২৮.৪।।

অতএব, ধনবণ্টন-প্রসঙ্গ থেকে আমরা সভা-সমিতির আলোচনায় উপনীত হই।

——————
২৭. M. Monier-Williams SED–bhaga.
২৮. A. A. Macdonell op. cit. 45-6.
২৯. G. Thomson AA 38-9, 41-3.
৩০. A. B. Keith & A. A. Macdonell VI: svagnin.
৩১. G. Thomson AA 42.
৩২. A. B. Keith & A. A. Macdonell op. cit. 1:2.
৩৩. ঐতরেয় ব্রাহ্মণ (ত্রিবেদী) ৪৭২, ৪৭৫, ৪৯১ ।
cf. A. B. Keith & A. A. Macdonell op. cit. 2:458.
৩৪. SBE 42:88, 391.
৩৫. SBE 41:106ff.
৩৬. সায়নভাষ্য দ্রষ্টব্য। cf. A. B. Keith & A. A. Macdonell op. cit. 1:2.
৩৭. A. B. Keith & A. A. Macdonell op. cit. 1:2.; ঋগ্বেদ ১০.১১৬.৯।
৩৮. Ibid 2:426.