কৈকেয়ী বলেন, সত্য আপনি করিলা।
সত্য করি বর দিতে কাতর হইলা।।
সত্য ধর্ম্ম তপ রাজা করে বহু শ্রমে।
সত্য নষ্ট করিলে কি করিবেক রামে।।
সত্য লঙ্ঘে যে তার হয় সর্ব্বনাশ।
সে সত্য পালন করে, স্বর্গে তার বাস।।
যত রাজা হইলেন চন্দ্র সূর্য্যবংশে।
সে সবার যশ গুণ সকলে প্রশংসে।।
যযাতি নামেতে রাজা পালিল পৃথিবী।
দেবযানী নামে তার মুখ্যা মহাদেবী।।
শর্ম্মিষ্ঠার পুত্র হৈল সবার কনিষ্ঠ।
পত্নীর বচনে রাজা তাঁর দিল রাষ্ট্র।।
শিবি নামে রাজা ছিল পৃথিবীর পাতা।
অসম সাহসী বীর, দানে বর দাতা।।
এক দ্বিজ ছিল তাঁর অন্ধ দুই আঁখি।
অত্যন্ত দরিদ্র কিছু উপায় না দেখি।।
সেই অন্ধ শিবিরাজে সত্য করাইল।
নিজ দুই চক্ষু শিবি তাঁরে দান দিল।।
আপনি হইল অন্ধ চক্ষে নাহি দেখে।
সত্য পালি সেই রাজা গেল স্বর্গলোকে।।
ইক্ষ্বাকু নামেতে রাজা ছিল সূর্য্যবংশে।
ইক্ষ্বাকুর বংশ বলি সকলে প্রশংসে।।
পিতৃ-সত্য করিলেন ইক্ষ্বাকু পালন।
কনিষ্ঠ ভায়ের তরে দিল রাজ্যধন।।
পৃথ্বী ডুবাইতে পারে সাগরের নীরে।
সাগর না বাড়ে পূর্ব্ব সত্য পালিবারে।।
দিবা সত্য করিলা আমারে দুই বর।
এখন কাতর কেন হও নৃপবর।।
নারীর মায়ার সন্ধি পুরুষে কি পায়।
দশরথ পড়িলেন কৈকেয়ী মায়ায়।।
ভূমে গড়াগড়ি রাজা যায় অভিমানে।
এতেক প্রমাদ কথা কেহ নাহি জানে।।
অধিবাস হইয়াছে জানে সর্ব্বজন।
সবে বলে বশিষ্ঠ হইল শুভক্ষণ।।
কালি শ্রীরামের হইয়াছে অধিবাস।
আজি কেন বিলম্ব, না জানি কি আভাষ।।
রাজার প্রতাপে হয় ত্রিভুবন বশ।
ভিতরে যাইতে কেহ না করে সাহস।।
পাত্র মিত্র বলে শুন সুমন্ত্র সারথি।
তোমা বিনা অন্তঃপুরে কারো নাহি গতি।।
ঝাট যাহ সুমন্ত্র সারথি অন্তঃপুরে।
সকল দেশের রাজা আসিয়াছে দ্বারে।।
রাম অভিষেকে আসিয়াছে দেবগণ।
এতক্ষণ বিলম্ব রাজার কি কারণ।।
সমুন্ত্র সারথি গেল সকলের বোলে।
দেখে, রাজা অজ্ঞান লোটায় ভূমিতলে।।
সুমন্ত্র বলিছে কেন লোটাও রাজন।
রামে রাজা করিতে হইল শুভক্ষণ।।
শত শত রাজগণ আসিয়াছে দ্বারে।
বিলম্ব না কর রাজা, চলহ বাহিরে।।
রাজা বলিলেন, পাত্র না জান কারণ।
মোরে বধ করিতে কৈকেয়ীর যতন।।
বুকে শেল মারিয়াছে বলিয়া কুবানী।
তার সত্যে বন্দী আমি হয়েছি আপনি।।
শীঘ্র রামে আন গিয়া আমার বচনে।
তুমি আমি রাম যুক্তি করি তিন জনে।।
কৈকেয়ী বলেন যাহ সুমন্ত্র ত্বরিত।
শীঘ্র রামে আন, নহে বিলম্ব উচিত।।
শুনিয়া চলিল রথ লইয়া সারথি।
উপস্থিত হইল যেখানে রঘুপতি।।
বাহিরে থুইয়া রথ গেল অন্তঃপুরে।
যোড়হাতে কহে গিয়া রামের গোচরে।।
কৈকেয়ীর সঙ্গে রাজা যুক্তি করে ঘরে।
আমারে পাঠাইলেন লইতে তোমারে।।
মুখ্যপাত্র সুমন্ত্র শ্রীরাম তাহা জানি।
গৌরবে দিলেন তাঁরে আসন আপনি।।
শ্রীরাম বলেন, পিতৃ-আজ্ঞা শিরে ধরি।
বিলম্ব না করি আর, চল যাত্রা করি।।
যাত্রাকালে বলেন শ্রীরাম শুন সীতা।
আমি রাজ্য পাইব, বিমাতা চিন্তান্বিতা।।
কোন্ যুক্তি কুঁজী দিল বিমাতার তরে।
না জানি বিমাতা আজি কোন্ যুক্তি করে।।
রাজা সহ কৈকেয়ী কি করে অনুমান।
জানি আসি পিতা কি করেন সম্বিধান।।
সীতা স্থানে হইলেন শ্রীরাম বিদায়।
প্রকোষ্ঠ অবধি সীতা অনুব্রজি যায়।।
বাটীর বাহির হইলেন রঘুনাথ।
চারিভিতে ধায়া লোক করি যোড়হাত।।
শ্রীরাম লক্ষ্মণ দোঁহে চড়িলেন রথে।
দেখিতে সকল লোক ধায় চারিভিতে।।
ঊর্দ্ধশ্বাসে ধাইলেক নারী গর্ভবতী।
লজ্জা ভয় নাহি মনে কুলের যুবতী।।
কি করিবে স্বামী, কি করিবে ধনে জনে।
ঘুচিবে সকল পাপ রাম দরশনে।।
সারি সারি লোক সবে দাণ্ডাইয়া চায়।
শ্রীরামের যত গুণ সর্ব্বলোকে গায়।।
বহু ভাগ্যে পাইলাম তোমা হেন রাজা।
জন্মে জন্মে রাম যেন করি তব পূজা।।
সর্ব্বক্ষণ দেখি যেন তোমার বদন।
সর্ব্বলোক মুক্ত হবে দেখিয়া চরণ।।
রামরূপে নারীগণ মজাইল চিত।
নয়নে না চান রাম পরনারী ভিত।।
রূপ দেখি নারী সব মনে পুড়ে ঘরে।
কপাল নিন্দিয়া সবে গেল নিজ ঘরে।।
ঘরে গিয়া স্ত্রী সবার মন নহে স্থির।
পিতৃকাছে প্রবেশ করেন রঘুবীর।।
এক প্রকোষ্ঠের বহিঃ রহেন লক্ষ্মণ।
ভিতর আবাসে রাম করেন গমন।।
দশরথ রাজা ভূমে লোটে অভিমানে।
কৈকেয়ী রাজার কাছে আছে সেইখানে।।
শ্রীরাম বলেন মাতা কহ ত কারণ।
কেন পিতা বিষাদিত ভূমিতে শয়ন।।
কোপ যদি করেন, হাসেন আমা দেখে।
আজি কেন জিজ্ঞাসিলে কথা নাহি মুখে।।
কোন্ দোষ করিলাম পিতার চরণে।
উত্তর না দেন পিতা কিসের কারণে।।
ভরত শত্রুঘ্ন দুই ভাই নাহি দেশে।
মাতুলের আলয়েতে রহিল প্রবাসে।।
বহু দিন গত, না আইল দুই জন।
সেই মনোদুঃখে বুঝি বিরস বদন।।
কোন্ জন কিম্বা করিয়াছে অপরাধ।
ভূমে লোটাইয়া তেঁই করেন বিষাদ।।
তুমি বুঝি পিতারে কহিলা কটুবাণী।
সত্য করি কহ গো বিমাতা ঠাকুরাণী।।
কি করিবে রাজভোগে পিতার অভাবে।
আমার কহ গো সত্য, প্রাণ পাই তবে।।
কি আজ্ঞা পিতার আমি করিব পালন।
সেই কথা মাতা মোরে কহ বিবরণ।।
আছুক পিতার কার্য্য তোমার বচনে।
রাজ্য ছাড়ি, প্রাণ ছাড়ি, কি ছার জীবনে।।
শ্রীরাম সরল, সে কৈকেয়ী পাপ হিয়া।
কহিতে লাগিল কথা নিষ্ঠুর হইয়া।।
দৈত্যযুদ্ধে মহারাজ ঘায়েতে জর্জ্জর।
তাতে সেবিলাম, দিতে চাহিলেন বর।।
বিস্ফোট হইলে পুনঃ করি সেবা পূজা।
তাহে অন্য বর দিতে চাহিলেন রাজা।।
এক বরে ভরতে করিব দণ্ডধর।
আর বরে রাম তুমি হও বনচর।।
দুই বারে দুই বর আছে মম ধার।
মম ধার শুধি তাঁরে সত্যে কর পার।।
শিরে জটা ধরি তুমি পরিবা বাকল।
বনে চৌদ্দ বৎসর খাইবা ফল মূল।।
শুনিয়া কহেন রাম সহাস্য বদনে।
তোমার আজ্ঞায় মাতা এই যাই বনে।।
করিয়াছে কোন্ কাজে পিতারে মুর্চ্ছিত।
লঙ্ঘিতে তোমার আজ্ঞা নহে ত উচিত।।
আছুক পিতার কাজ, তুমি আজ্ঞা কর।
তব আজ্ঞা সকল হইতে মহত্তর।।
তব প্রীতি হবে, রবে পিতার বচন।
চতুর্দ্দশ বৎসর থাকিব গিয়া বন।।
ভরতেরে ত্বরিতে আনাও মাতা দেশ।
ভরত হইলে রাজা আনন্দ অশেষ।।
কোন দোষ নাহি মাতা তাহার শরীরে।
ধন জন রাজ্য ভোগ দেহ ভরতেরে।।
কৈকেয়ী বলেন রাম আগে যাহ বন।
ভরত আসিবে তবে এই নিকেতন।।
আমার কথাতে কোপ না করিহ মনে।
শিরে জটা ধরি তুমি আজি যাহ বনে।।
হেঁটমাথা করিয়া শুনেন মহারাজ।
কি কহিব কৈকেয়ীর নাহি ভয় লাজ।।
কৈকেয়ীর প্রতি রাম করেন আশ্বাস।
বিলম্ব নাহিক আজি যাব বনবাস।।
যাবৎ মায়েরে সীতা করি সমর্পণ।
তাবৎ বিলম্ব মাতা সহিবা এখন।।
ভূমে লোটাইয়া রাজা আছেন বিষাদে।
শুনেন দোঁহার বাক্য স্বপ্ন হেন বোধে।।
রামচন্দ্র পিতার চরণদ্বয় বন্দে।
দশরথ ক্রন্দন করেন নিরানন্দে।।
পিতারে প্রণমি রাম চলেন ত্বরিত।
হা রাম বলিয়া রাজা হলেন মূর্চ্ছিত।।
মুখে নাহি শব্দ রাজার, নাহিক চেতন।
হইলেন বাহির যে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।।
রামের এ সব কথা কেহ নাহি শুনে।
প্রাণের দোসর মাত্র লক্ষ্মণ সে জানে।।
করেন কৌশল্যাদেবী দেবতা-পূজন।
ধূপ ধূনা ঘৃত দীপ জ্বালিয়া তখন।।
নানা উপহারে রাণী পূরিয়াছে ঘর।
সাতশত সপত্নী সে ঘরের ভিতর।।
সবেমাত্র কৈকেয়ী নাহিক একজন।
সাতশত রাণী আর বহু নারীগণ।।
কৌশল্যার কাছে থাকে সাতশত রাণী।
রামজয় এই মাত্র শব্দ সদা শুনি।।
হেনকালে শ্রীরাম মায়ের পদ বন্দে।
আশীর্ব্বাদ করে রাণী পরম আনন্দে।।
তোমারে দিলেন রাজা নিজ রাজ্যদান।
সুপ্রসন্না রাজলক্ষ্মী করুন কল্যাণ।।
নানাবিধ সুখ ভুঞ্জ, হও চিরজীবী।
চিরকাল রাজ্য কর পালহ পৃথিবী।।
সেবিলাম শিব শিবা চরণ-কমলে।
তুমি পুত্র রাজা হও সেই পুণ্যফলে।।
শ্রীরাম বলেন, মাতা হর্ষ হও কিসে।
হাতেতে আইল নিধি, গেল দৈবদোষে।।
তুমি আমি সীতা আর অনুজ লক্ষ্মণ।
শোকসিন্ধু-নীরে আজি মজি চারি জন।।
তোমারে কহিতে কথা আমি ভীত হই।
প্রমাদ পাড়িল মাতা বিমাতা কৈকেয়ী।।
বিমাতার বচনে যাইতে হৈল বন।
ভরতেরে রাজ্য দিতে বিমাতার মন।।
শুনিয়া পড়িল রাণী মূর্চ্ছিত হইয়া।
ডাকেন ত্বরিত রাম মা মা মা বলিয়া।।
মা মা বলিয়া রাম উচ্চৈঃস্বরে ডাকে।
মাতৃবধ করি বুঝি ডুবিনু নরকে।।
কৌশল্যারে ধরি তোলে শ্রীরাম লক্ষ্মণ।
বহুক্ষণে কৌশল্যার হইল চেতন।।
চেতন পাইয়া রাণী বলে ধীরে ধীরে।
সকল বৃত্তান্ত সত্য বলহ আমারে।।
তোর দিব্য লাগে যদি ভাঁড়াও আমায়।
কি দোষে কৈকেয়ী বনে তোমারে পাঠায়।।
শ্রীরাম বলেন মাতা দৈবের ঘটন।
বিমাতার দোষ নাই, বিধির লিখন।।
পিতৃসেবা বিমাতা করিল বারে বার।
দুই বর দিতে ছিল পিতার স্বীকার।।
আজি আমি রাজা হৈব সকলের আগে।
শুনিয়া বিমাতা সেই দুই বর মাগে।।
এক বরে ভরতে করিতে দণ্ডধর।
আর বরে আমি যাই বনের ভিতর।।
স্বামী বিনা স্ত্রীলোকের আর নাহি গতি।
বিমাতার সেবায় পিতার প্রীতি অতি।।
তুমি যদি সেবা মাতা করিতে পিতার।
তবে কেন এত তাপ ঘটিবে তোমার।।
এত যদি কহিলেন শ্রীরাম মায়েরে।
ফুটিল দারুণ শেল কৌশল্যা অন্তরে।।
কাটিলে কদলী যেন লোটায় ভূতলে।
হা পুত্র বলিয়া রাণী রাম প্রতি বলে।।
গুণের সাগর পুত্র যার যার বন।
সে নারী কেমনে আর রাখিবে জীবন।।
রাজার প্রথম জায়া আমি মহারাণী।
চণ্ডালী হইল মোর কৈকেয়ী সতিনী।।
ঘটাইল প্রমাদ কৈকেয়ী পাপীয়সী।
রাজারে কহিয়া রামে করে বনবাসী।।
সূর্য্যবংশ রাজ্যে নাহি অকাল-মরণ।
এই সে কারণে মম না যায় জীবন।।
পূজিলাম কত শত দেব-দেবীগণে।
তার কি এ ফল বাছা তুমি যাও বনে।।
যত যত সূর্য্যবংশ রাজা জন্মেছিল।
বল দেখি, স্ত্রীর বাক্যে কে হেন করিল।।
অযশ রাখিল রাজা নারীর বচনে।
স্ত্রীবাধ্য পিতার বাক্যে কেন যাবে বনে।।
স্ত্রীর বাক্যে যিনি পুত্রে পাঠান কাননে।
এমন পিতার কথা না শুনিহ কাণে।।
লক্ষ্মণ বলেন, সত্য তব কথা পূজি।
স্ত্রীবশ পিতার বাক্যে কেন রাজ্য ত্যজি।।
জ্যেষ্ঠপুত্র রাজ্য পায় ইহা সবে ঘোষে।
হেন পুত্র বনে রাজা পাঠান কি দোষে।।
অগ্রে রাজা দিয়া পরে পাঠান কাননে।
হেন অপযশ রাজা রাখেন ভুবনে।।
যাবৎ এ সব কথা না হয় প্রচার।
তাবৎ শ্রীরামচন্দ্র লহ রাজ্যভার।।
বার্দ্ধক্যে দুর্ব্বুদ্ধি রাজা নিতান্ত পাগল।
করিয়াছে বাধ্য তাঁরে কৈকেয়ী কেবল।।
যদি রঘুনাথ আমি তব আজ্ঞা পাই।
ভরতে খণ্ডিয়া রাজ্য তোমারে দেওয়াই।।
আমি এই আছি ভাই তোমার সেবক।
আজ্ঞা কর, ভরতের কাটিব মস্তক।।
তুমি যদি হস্তে প্রভু ধর ধনুর্ব্বাণ।
তব রণে কোন্ জন হবে আগুয়ান।।
কৌশল্যা বলেন রাম কি বলে লক্ষ্মণ।
বিমাতার বাক্যে তুমি কেন যাবে বন।।
এক সত্য পালহ পিতার অঙ্গীকার।
ভরতের করে দেহ সব রাজ্যভার।।
অন্য সত্য পালিতে নাহিক প্রয়োজন।
দেশে থাক রাম, তুমি না যাইও বন।।
মায়ের বচন লঙ্ঘি পিতৃবাক্য ধর।
পিতা হৈতে মাতা তব অতি মহত্তর।।
গর্ভে ধরি দুঃখ পায়, স্তন দিয়া পোষে।
হেন মাতৃ-আজ্ঞা রাম লঙ্ঘ তুমি কিসে।।
বাপের বচন রাখ, লঙ্ঘ মাতৃ-বাণী।
কোন্ শাস্ত্রে হেন কথা কোথাও না শুনি।।
শ্রীরাম বলেন মাতা, শুন এক কথা।
পিতা অতিশয় মান্য তোমার দেবতা।।
দেখহ পরশুরাম পিতার কথায়।
অস্ত্রাঘাত করিলেন মায়ের মাথায়।।
পিতার আজ্ঞায় অষ্টাবক্রের গোবধ।
সগর জন্মায় পুত্রগণের আপদ।।
সত্য না লঙ্ঘেন পিতৃ-সত্যেতে তৎপর।
মম দুঃখে পিতা কত হবেন কাতর।।
পিতৃসত্য আমি যদি না করি পালন।
বৃথা রাজ্যভোগ মম, বৃথাই জীবন।।
বর্জ্জিবেন বিমাতারে পিতা লয় মনে।
কহির তাঁহার সেবা তুমি রাত্রি দিনে।।
কৌশল্যা বলেন, রাম সত্যে যাও বন।
তুমি বনে গেলে আমি ত্যজিব জীবন।।
মাতৃবধ করিলে হইবে তব পাপ।
মাতৃবধ পাপে রাম বড় পাবে তাপ।।
পিতৃসত্য পালিবা যে মায়ের মরণে।
কোন্ পাপ বড় রাম ভাব দেখি মনে।।
আস্ফালন লক্ষ্মণ করেন অতিশয়।
শ্রীরাম বলেন, তব বুদ্ধি ভাল নয়।।
যত যত্ন কর তুমি রাজ্য লইবারে।
তত যত্ন করি আমি যাইতে কান্তারে।।
বিমাতার দোষ নাহি, দোষী কহে কুঁজী।
সকল দেখিবা ভাই বিধাতার বাজী।।
বিমাতা জানেন ভাল আমার চরিত।
জানিয়া শুনিয়া করিলেন বিপরীত।।
ভরত হইতে তাঁর আমা প্রতি আশা।
বিমাতার দোষ নাই, আমার দুর্দ্দশা।।
যে দিন যে হবে তাহা বিধি সব জানে।
দুঃখ না ভাবিহ তাই ক্ষমা দেহ মনে।।
দুঃখ না ভুঞ্জিলে কর্ম্ম না হয় খণ্ডন।
দুঃখ সুখ দেখ ভাই ললাট-লিখন।।
প্রবোধ না মানে, কালসর্প যেন গর্জ্জে।
সুমিত্রা কুমার বীর ঘন ঘন তর্জ্জে।।
ধনুকেতে গুণ দিয়া ফিরে চারিভিতে।
কুপিয়া লক্ষ্মণ বীর লাগিল কহিতে।।
রাজ্যখণ্ড ত্যজিয়া হইব বনবাসী।
রাজ্যভোগ ত্যজি ফল মূল অভিলাষী।।
সন্ন্যাস তপস্যা যত ব্রাহ্মণের কর্ম্ম।
ক্ষত্রিয়ের সদা যুদ্ধ, সেই তার ধর্ম্ম।।
ক্ষত্রিয় কোথায় কে করেছে বনবাস।
শত্রুর বচনে কেন ছাড়ি রাজ্য-আশ।।
সবে জানে, বিমাতা শত্রুর মধ্যে গণি।
তার বাক্যে রাজ্য ছাড়ে, কোথাও না শুনি।।
তোমা বিনা পিতার মনেতে নাহি আন।
তুমি বনে গেলে রাজা ত্যজিবেন প্রাণ।।
তোমা বিনা পিতা যাইবেন পরলোকে।
প্রাণ ত্যজিবেন মাতা তোমা পুত্রশোকে।।
এই শোকে মাতা পিতা ত্যজিবে জীবন।
মাতৃ-পিতৃ হত্যা তুমি কর কি কারণ।।
অকারণে হের এ আজানু বাহুদণ্ড।
অকারণে ধরি আমি ধনুক প্রচণ্ড।।
অকারণে ধরি খড়্গ চর্ম্ম ভল্ল শূল।
আজ্ঞা কর, ভরতেরে করিব নির্ম্মূল।।
সকল হইল ব্যর্থ এ সব সম্পদ।
আমি দাস থাকিতে প্রভুর এ আপদ।।
শ্রীরাম বলেন, তার নাহি অপরাধ।
ভরত না জানে কিছু এতেক প্রমাদ।।
অকারণে ভরতেরে কেন কর রোষ।
বিধির নিব্বন্ধ ইহা তাহার দোষ।।
রামেরে প্রবোধ দেন কৌশল্যা লক্ষ্মণ।
দয়াময় রাম নাহি শুনেন বচন।।
মায়েরে কহেন রাম প্রবোধ বচন।
আজ্ঞা কর মাতা, আজি যাই আমি বন।।
কৌশল্যা কহেন রামে সজল নয়নে।
না জানি হইবে কবে দেখা তব সনে।।
যে মন্ত্র কৌশল্যা পেয়েছিল আরাধনে।
সেই মন্ত্র দিল রাণী শ্রীরামের কাণে।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ বনে থাকিবে কুশলে।
অষ্ট লোকপাল রাখ আমার ছাওয়ালে।।
ব্রহ্মা বিষ্ণু রাখুন কার্ত্তিক গণপতি।
লক্ষ্মী সরস্বতী রক্ষা করুন পার্ব্বতী।।
একাদশ রুদ্র আর দ্বাদশ যে রবি।
জলে স্থলে রক্ষা আর করুন পৃথিবী।।
চৌদ্দবর্ষ রহে যদি আমার জীবন।
তবে তোমা সনে মম হবে দরশন।।
বিদায় হইয়া রাম মায়ের চরণে।
গেলেন লক্ষ্মণ সহ সীতা সম্ভাষণে।।
শ্রীরাম বলেন, সীতা নিজ কর্ম্মদোষে।
বিমাতার বাক্যে আমি যাই বনবাসে।।
বিবাহ করিয়া এক বর্ষ আছি ঘরে।
হেনকালে বিমাতা ফেলিল মহাফেরে।।
তাঁহার বচনে আমি যাই বনবাস।
ভরতেরে রাজ্য দিতে বিমাতার আশ।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ আমি থাকি গিয়া বনে।
তাবৎ মায়ের সেবা কর রাত্রি দিনে।।
জানকী বলেন, সুখে হইয়া নিরাশ।
স্বামী বিনা আমার কিসের গৃহবাস।।
তুমি ত পরম গুরু, তুমি সে দেবতা।
তুমি যাও যথা প্রভু, আমি যাই তথা।।
স্বামী বিনা স্ত্রীলোকের আর নাহি গতি।
স্বামীর জীবনে জীয়ে, মরণে সংহতি।।
প্রাণনাথ কেন একা হবে বনবাসী।
পথের দোসর হব করে লও দাসী।।
বনে প্রভু ভ্রমণ করিবে না ক্লেশে।
দুঃখ পাসরিবে যদি দাসী থাকে পাশে।।
যদি বল সীতা বনে পাবে নানা দুঃখ।
শত দুঃখ ঘুচে যদি দেখি তব মুখ।।
তোমার কারণে রোগ শোক নাহি জানি।
তোমার সেবায় দুঃখ সুখ হেন মানি।।
শ্রীরাম বলেন, শুন জনক-দুহিতা।
বিষম দণ্ডক বন না যাইহ সীতা।।
সিংহ ব্যাঘ্র আছে তথা রাক্ষসী রাক্ষস।
বালিকা হইয়া কেন কর এ সাহস।।
অন্তঃপুরে নানা ভোগে থাক মনোসুখে।
ফল-মূল খাইয়া কেন ভ্রমিবে দণ্ডকে।।
তোমার সুসজ্জা শয্যা পালঙ্ক কোমল।
কুশাঙ্কুরে বিদ্ধ হবে চরণ-কমল।।
তুমি আমি দোঁহে হব বিকৃতি আকৃতি।
দোঁহে দোঁহাকারে দেখি না পাইব প্রীতি।।
চতুর্দ্দশ বর্ষ গেলে দেখ বুঝি মনে।
এই কাল গেলে সুখে থাকিব দুজনে।।
চিন্তা না করিহ কান্তে ক্ষান্ত হও মনে।
বিষম রাক্ষসগুলো আছে সেই বনে।।
শ্রীরামের বচনে সীতার ওষ্ঠ কাঁপে।
কহেন রামের প্রতি মনের সন্তাপে।।
পণ্ডিত হইয়া বল নির্ব্বোধের প্রায়।
কেন হেন জনে পিতা দিলেন আমায়।।
নিজ নারী রাখিতে যে করে ভয় মনে।
দেখ তারে বীর বলে, কোন্ বীর জনে।।
রাজ্য নিতে ভরত না করিল অপেক্ষা।
তার রাজ্যে স্ত্রী তোমার কিসে পায় রক্ষা।।
পেয়েছিলে রাজ্য তুমি লইল যে জন।
স্ত্রী লইতে বিলম্ব তাহার কতক্ষণ।।
তব সঙ্গে বেড়াইতে কুশ কাঁটা ফুটে।
তৃণ হেন বাসি তুমি থাকিলে নিকটে।।
তব সঙ্গে থাকি যদি লাগে ধূলি গায়।
অগুরু চন্দন চুয়া জ্ঞান করি তায়।।
তব সহ থাকি যদি পাই তরুমূল।
অন্য স্বর্গ গৃহ নহে তার সমতুল।।
তব দুঃখে দুঃখ মম সুখে সুখভার।
আহারে আহার আর বিহারে বিহার।।
ক্ষুধা তৃষ্ণা যদি লাগে ভ্রমিয়া কানন।
শ্যামরূপ নিরখিয়া করিব বারণ।।
বহু তীর্থ দেখিব অনেক তপোবন।
নানাবিধ পর্ব্বতে করিব আরোহণ।।
যখন পিতার ঘরে ছিলাম শৈশবে।
বলিতেন আমাকে দেখিয়া মুনি সবে।।
শুন হে জনকরাজ, তোমার দুহিতা।
করিবেন বনবাস পতির সহিতা।।
ব্রাহ্মণের কথা কভু না হয় খণ্ডন।
বনবাস আছ মম ললাটে লিখন।।
তুমি ছাড়ি গেলে আমি ত্যজিব জীবন।
স্ত্রীবধ হইলে নহে পাপ বিমোচন।।
শ্রীরাম বলেন, বুঝিলাম তব মন।
তোমারে পরীক্ষা করিলাম এতক্ষণ।।
বনে বাস হেতু হইয়াছে তব মন।
খসাইয়া ফেলহ গায়ের আভরণ।।
এতেক শুনিয়া সীতা হরিষ অন্তরে।
খুলিলেন অলঙ্কার যে ছিল শরীরে।।
সম্মুখে দেখেন যত ব্রাহ্মণ সজ্জন।
তা সবারে দেন তিনি নিজ আভরণ।।
আভরণ অর্পিয়া বলেন সীতা বাণী।
ভূষণ পরেন যেন তোমার ব্রাহ্মণী।।
সীতার ভাণ্ডারে ছিল বহু বস্ত্র ধন।
সে সকল করিলেন তিনি বিতরণ।।
শ্রীরাম বলেন, শুন অনুজ লক্ষ্মণ।
দেশেতে থাকিয়া কর সবার পালন।।
দাস দাসী সবাকারে করিহ জিজ্ঞাসা।
রাজ্য লইবারে ভাই না করিহ আশা।।
পিতা মাতা কাতর হবেন মম শোকে।
কতক হবেন শান্ত তব মুখ দেখে।।
যেই তুমি, সেই আমি, শুনহ লক্ষ্মণ।
একেরে দেখিলে হয় শোক পাসরণ।।
লক্ষ্মণ বলেন, আমি হই অগ্রসর।
আমি সঙ্গে থাকিব হইয়া অনুচর।।
যেই তুমি, সেই আমি, বিধাতা তা জানে।
যদি আমি থাকি, তুমি কি করিবে বনে।।
সীতা সঙ্গে কেমনে ভ্রমিবে বনে বনে।
সেবক ছাড়িলে দুঃখ পাবে দুই জনে।।
রাজার কুমারী সীতা দুঃখ নাহি জানে।
সেবক বিহনে দুঃখ পাবেন কাননে।।
শ্রীরাম বলেন, ভাই যদি যাবে বন।
বাছিয়া ধনুক বাণ লহ রে লক্ষ্মণ।।
বিষম রাক্ষস সব আছে সেই বনে।
ধনুর্ব্বাণ লহ যেন জয়ী হই রণে।।
পাইয়া রামের আজ্ঞা লক্ষ্মণ সত্বর।
ভাল ভাল বাণ সব বান্ধিল বিস্তর।।
শ্রীরাম বলেন বলি লক্ষ্মণ তোমারে।
তল্লাস করহ ধন, কি আছে ভাণ্ডারে।।
ধনে আর আমার নাহিক প্রয়োজন।
ব্রাহ্মণ সজ্জনে দেহ যত আছে ধন।।
মুনি ঋষি আদি করি কুল-পুরোহিত।
তা সবারে ধন দিয়া তোষহ ত্বরিত।।
বাছিয়া বাছিয়া আন কুলীন ব্রাহ্মণ।
যেবা যত চাহে, তাঁরে দেহ তত ধন।।
যতেক দরিদ্র আছে ভিক্ষা মাগি খায়।
তা সবারে দেহ ধন, যেবা যত চায়।।
মম দুঃখে যত লোক হইবেক দুঃখী।
চতুর্দ্দশ বর্ষ যেন তারা হয় সুখী।।
পাইলেন লক্ষ্মণ শ্রীরামের আদেশ।
তাঁহার সম্মুখে ধন আনেন অশেষ।।
ভাণ্ডার করেন শূন্য ধন বিতরণে।
সবারে তোষেন রাম মধুর বচনে।।
আমা লাগি তোমরা না করহ ক্রন্দন।
করিবে ভরত ভাই সবারে পালন।।
কোন দোষ নাহি ভাই ভরত-শরীরে।
বড় তুষ্ট আছি আমি তার ব্যবহারে।।
নানা রত্ন রাম করিলেন পরিহার।
দানে শূন্য করিলেন শতেক ভাণ্ডার।।
সকল ভাণ্ডার শূন্য আর নাহি ধন।
হেনকালে বার্ত্তা পায় ত্রিজটা ব্রাহ্মণ।।
বড়ই দরিদ্র সে, ত্রিজটা নাম ধরে।
দান-কথা শুনিয়া সে ধড়ফড় করে।।
চলিতে শকতি নাই তনু ক্ষীণ হয়।
ব্রাহ্মণী তাহাকে হিত উপদেশ কয়।।
দীনেরে করেন ধনী রাম দিয়া ধন।
তুমি আমি বুড়া বুড়ী মরি দুই জন।।
তুমি বৃদ্ধ আমি নারী, দুঃখ সে অপার।
কে আর পুষিবে, কোথা মিলিবে আহার।।
শুনিয়া ব্রাহ্মণ তব নড়ি ভর করে।
অতি কষ্টে গিয়া কহে রামের গোচরে।।
আমি দ্বিজ দরিদ্র, ত্রিজটা নাম ধরি।
বৃদ্ধকালে ব্রাহ্মণীকে পুষিতে না পারি।।
পুত্র নাই আমারে কে করিবে পালন।
অনাহারে বুড়া বুড়ী মরি দুই জন।।
নড়ি ভর করিয়া আইলাম সম্প্রতি।
তোমা বিনা দরিদ্রের আর নাহি গতি।।
শ্রীরাম বলেন, দ্বিজ আসিয়াছ শেষে।
ধন নাই, পেয়ে দ্বিজ হরিষ অন্তরে।।
কাপড় আঁটিয়া যায় পালের ভিতরে।
দৃঢ় করি চুল বান্ধি নড়ি করি হাতে।
পালেতে প্রবেশ করে উঠিতে পড়িতে।।
বৃড়ার বিক্রম দেখি ভাবে সর্ব্বজনে।
ধেনুতে মারিবে নাকি এ বৃদ্ধ ব্রাহ্মণে।।
হাসিয়া বিহ্বল কেহ কেহ বা বিষাদে।
ব্রহ্মবধ হেতু রাম পড়িলা প্রমাদে।।
শ্রীরাম বলেন দ্বিজ কহিতে ডরাই।
না পারিবে লইবারে এক লক্ষ গাই।।
এক ধেনু লইতে তোমার সঙ্কট।
মরিবারে যাহ কেন ধেনুর নিকট।।
ধেনুর সহিত দান দিলাম গোয়াল।
গোয়ালে রাখিবে ধেনু থাকে যতকাল।।
অনুমানে জানি তুমি বড়ই নির্ধন।
আজ্ঞা কর, দিতে পারি আর কিছু ধন।।
দ্বিজ বলে, প্রভু নাহি চাহি আর ধন।
ধেনু-ধন বিনা নাহি অন্য প্রয়োজন।।
বুড়া বুড়ী ধেনু-দুগ্ধ খাইব অপার।
কত দুগ্ধ বিকি দিয়া পূরিব ভাণ্ডার।।
অনাথের নাথ তুমি সকলের গতি।
কহিতে তোমার গুণ কাহার শকতি।।
এক লক্ষ ধেনু লৈয়া দ্বিজ গেল দেশে।
রচিল অযোধ্যাকাণ্ড কবি কৃত্তিবাসে।।