[১০ এপ্রিল, ১৯০০ খ্রীঃ আমেরিকার সান ফ্রান্সিস্কো শহরে প্রদত্ত বক্তৃতা]
আপনাদের মধ্যে যাঁহারা বাইবেল পড়িয়াছেন, তাঁহারা জানেন, ইহুদি-জাতির সমগ্র ইতিহাস এবং চিন্তাধারার মূলে রহিয়াছেন দুই শ্রেণীর শিক্ষক—পুরোহিত ও ধর্মগুরুগণ। পুরোহিতগণ রক্ষণশীলতার এবং ধর্মগুরুগণ প্রগতিশীলতার প্রতীক। মোট কথা এই সমাজে ক্রমে ক্রমে গোঁড়া আনুষ্ঠানিকতা প্রবেশ করে, বাহ্য আচার সবকিছুকে অধিকার করিয়া বসে। প্রত্যেক দেশ এবং প্রত্যেক ধর্মের ক্ষেত্রেই ইহা সত্য। তারপর কয়েকজন সত্যদ্রষ্টা মহাপুরুষ নূতন দৃষ্টিভঙ্গী লইয়া আবির্ভূত হন। তাঁহারা নূতন ভাব ও নূতন আদর্শ প্রচার করেন এবং সমাজকে গতিশীল করিয়া তোলেন। কয়েক পুরুষ যাইতে না যাইতেই শিষ্যগণ নিজ নিজ গুরুর প্রচারিত ভাবসমূহের প্রতি এত বেশী অনুরক্ত হইয়া পড়ে যে, ঐগুলি ছাড়া তাহারা অন্য কিছু দেখিতে পায় না। এই যুগের সর্বাপেক্ষা প্রগতিশীল এবং উদার-মতাবলন্বী প্রচারকগণও কয়েক বৎসরের মধ্যে সর্বাপেক্ষা গোঁড়া পুরোহিতে পরিণত হইবেন। আবার প্রগতিবাদী মনীষিগণও—কাহারও মধ্যে সামান্য প্রগতি দেখিলে উহার বিরুদ্ধাচরণ করিতে আরম্ভ করিবেন। তাঁহাদের চিন্তাধারা অতিক্রম করিয়া সমাজ অগ্রসর হউক—ইহা তাঁহারা চাহিবেন না। যাহা-কিছু যেভাবে চলিতেছে, ঐভাবে চলিলেই তাঁহারা সন্তুষ্ট।
প্রত্যেক দেশে প্রত্যেক ধর্মের প্রাথমিক নীতিগুলির মধ্যে যে-শক্তি কাজ করে, তাহা ধর্মের বাহ্যরূপে প্রকাশিত হয়। … নীতি বা গ্রন্থ, কতকগুলি নিয়ম, বিশেষ প্রকারে অঙ্গ-সঞ্চালন, দাঁড়ানো বা বসিয়া পড়া—এ-সবই উপাসনার পর্যায়ভুক্ত। অধিকসংখ্যক লোক যাহাতে ধারণা করিতে পারে, সে-জন্য পূজা স্থূল রূপ পরিগ্রহ করে। প্রত্যেক দেশের অধিকাংশ লোকই একটি ভাবকে কখনও ভাবরূপে পূজা করে না। ইহা এখনও সম্ভব হইয়া উঠে নাই। ভবিষ্যতে যে কোনদিন হইবে, তাহাও মনে হয় না। এই শহরের কয় সহস্র ব্যক্তি ঈশ্বরকে একটি ভাব-রূপে পূজা করিবার জন্য প্রস্তুত? অতি সামান্যই। মানুষ ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে বাস করে, তাই ঐরূপ করিতে পারে না। মানুষকে আরও পূর্ব হইতে ধর্মভাব দিতে হইবে। তাহাকে স্থূলভাবে কিছু করিতে বলোঃ কুড়িবার উঠিতে এবং কুড়িবার বসিতে বল, সে উহা বুঝিবে। তাহাকে এক নাসারন্ধ্র দিয়া শ্বাস গ্রহণ করিতে এবং অপর রন্ধ্র দিয়া নিঃশ্বাস ফেলিতে বলো—সে উহা বুঝিবে। নিছক ভাবগত আদর্শ মানুষ মোটেই গ্রহণ করিতে পারে না। ইহা তাহাদের দোষ নয়। … ঈশ্বরকে ভাব-রূপে পূজা করার শক্তি যদি তোমার থাকে, তবে উত্তম। কিন্তু এমন এক সময় ছিল, যখন তুমি উহা পারিতে না। … লোকেরা যদি স্থূলবুদ্ধিসম্পন্ন হয়, তাহা হইলে ধর্ম সন্বন্ধে ধারণাগুলি অপরিণত এবং ধর্মের বহিরঙ্গগুলি স্থূল ও অমার্জিত হইয়া পড়ে। লোকেরা যদি মার্জিত ও শিক্ষিত হয়, তাহাদের বাহ্য অনুষ্ঠানগুলি আরও সুন্দর হয়। বাহ্য অনুষ্ঠানাদি থাকিবে, সেগুলি শুধু কালের প্রয়োজনে পরিবর্তিত হইবে।
ইহা আশ্চর্য যে, মুসলমানধর্ম যেভাবে বাহ্যপূজার বিরুদ্ধাচরণ করিয়াছে, পৃথিবীতে অন্য কোন ধর্ম কখনও সেরূপ করে নাই। … চিত্র, স্থাপত্য বা সঙ্গীত— মুসলমানদের থাকিতে পারিবে না, কেন-না এইগুলি বাহ্যপূজার সহায়ক। জনসাধারণের সঙ্গে পুরোহিতের কখনও যোগাযোগ হইবে না, হইলেই পার্থক্যের সৃষ্টি হইবে। এইভাবে কোন পার্থক্য নাই। কিন্তু তবু পয়গন্বরের দেহত্যাগের পর দুই শতাব্দী যাইতে না যাইতেই সাধু-সন্তের পূজা প্রবর্তিত হইল। এইখানে সাধুর পায়ের অঙ্গুষ্ঠ! ঐখানে তাঁহার গাত্রচর্ম!—এইভাবে চলিতে লাগিল। বাহ্যপূজা আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে অন্যতম সোপান এবং আমাদিগকে উহার মধ্য দিয়াই যাইতে হইবে।
সুতরাং বাহ্যপূজার বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা না করিয়া উহার যেটুকু ভাল, তাহা গ্রহণ করা উচিত, এবং অন্তর্নিহিত ভাবগুলি বিবেচনা করিয়া দেখা কর্তব্য। অবশ্য সর্বাপেক্ষা নিম্নস্তরের পূজা বলিতে গাছ-পাথরের পূজাই বুঝায়। প্রত্যেক অমার্জিত ও অশিক্ষিত ব্যক্তিই যে-কোন পদ্ধতি গ্রহণ করিয়া উহাতে নিজস্ব ভাব যোগ করিয়া দিবে, তাহাতেই তাহার সাহায্য হইবে। সে একখণ্ড অস্থি বা পাথর পূজা করিতে পারে। বাহ্যপূজার এই সকল অপরিণত অবস্থায় মানুষ কিন্তু কখনও পাথরকে পাথর হিসাবে বা গাছকে গাছ হিসাবেই পূজা করে নাই—সাধারণ বুদ্ধি দ্বারাই তোমরা এটুকু জান। পণ্ডিতেরা অনেক সময় বলেন—মানুষ গাছ-পাথরের পূজা করিত। এ-সবই অর্থহীন। মানবজাতি যে-সকল নিম্নস্তরের পূজানুষ্ঠানের মধ্য দিয়া অগ্রসর হইয়াছে, বৃক্ষ-পূজা ঐগুলির অন্যতম। প্রকৃতপক্ষে কখনই মানুষ ভাব ছাড়া অন্য কিছুরই পূজা করে নাই। মানুষ ভাবস্বরূপ এবং ভাব ব্যতীত অন্য কিছুই অনুভব করিতে পারে না। দেবভাবে পূর্ণ মনুষ্য-মন সূক্ষ্মভাবকে জড়বস্তুরূপে উপাসনা করার মত এত বড় ভুল কখনও করিতে পারে না। এই ক্ষেত্রে মানুষ পাথর বা গাছকে ভাবরূপেই চিন্তা করিয়াছে। সে কল্পনা করিয়াছে যে, সেই পরম সত্তার কিছুটা এই পাথর বা গাছে রহিয়াছে এবং ইহাদের মধ্যে আত্মা আছেন। বৃক্ষপূজা এবং সর্পপূজা সর্বদা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জ্ঞান-বৃক্ষ আছে। বৃক্ষ অবশ্যই থাকিবে এবং সর্পের সহিত ঐ বৃক্ষ কোন-না-কোন ভাবে জড়িত থাকিবে। এগুলি প্রাচীনতম পূজা-পদ্ধতি। সেখানেও দেখিবে, কোন বিশেষ প্রস্তর বা বিশেষ বৃক্ষই পূজিত হইয়াছে—পৃথিবীর যাবতীয় বৃক্ষ এবং যাবতীয় প্রস্তরকে পূজা করা হয় নাই।
বাহ্যপূজার উন্নততর সোপানে ঈশ্বরের বা পূর্বপুরুষদের প্রতিমূর্তিকে পূজা করা হয়। লোকে মৃত ব্যক্তিগণের প্রতিকৃতি এবং ঈশ্বরের কাল্পনিক প্রতিমা নির্মাণ করে। পরে তাহারা ঐগুলি পূজা করে।
আরও উন্নততর পূজা—মৃত সাধু-সন্ত, সজ্জন বা সতী-সাধ্বীদের পূজা। লোকে তাঁহাদের দেহাবশেষ পূজা করে। তাহারা ঐ দেহাবশেষের মধ্যে সাধু-মহাপুরুষগণের উপস্থিতি অনুভব করে এবং মনে করে যে, তাঁহারা তাহাদিগকে সাহায্য করিবেন। তাহারা বিশ্বাস করে যে, ঐ সাধু-মহাপুরুষগণের অস্থি স্পর্শ করিলে তাহাদের রোগ সারিবে। দেহাস্থিই যে তাহাদিগকে নিরাময় করিবে তাহা নয়, দেহাস্থির মধ্যে যিনি আছেন, তিনিই তাহাদের রোগ আরোগ্য করিবেন।
এ-সবই নিম্নাঙ্গের পূজা, তথাপি এগুলি পূজা। আমাদিগকে ঐগুলি অতিক্রম করিতে হইবে। বুদ্ধি-বিচারের দিক্ দিয়া দেখিলে শুধু ঐগুলি যথেষ্ট বলিয়া বোধ হয় না, কিন্তু অন্তরের দিক্ দিয়া আমরা এগুলি ছাড়িতে পারি না। যদি তুমি কোন ব্যক্তির নিকট হইতে সাধু-মহাপুরুষদের প্রতিমূর্তিগুলি সরাইয়া লও এবং তাহাকে কোন মন্দিরে যাইতে না দাও, তাহা হইলে সে মনে মনে ঐগুলি স্মরণ করিবে। সে উহা না করিয়া পারিবে না। একজন অশীতিবর্ষ বৃদ্ধ আমাকে বলিয়াছিলেন যে, ভগবানের বিষয় ভাবিতে গেলেই মেঘের উপর উপবিষ্ট দীর্ঘশ্মশ্রুবিশিষ্ট একজন বৃদ্ধ ছাড়া অন্য কাহারও কথা তাঁহার মনে উদিত হয় না। ইহা দ্বারা কি প্রতীত হয়? তাঁহার শিক্ষা সম্পূর্ণ হয় নাই। কোন আধ্যাত্মিক শিক্ষাই তিনি পান নাই এবং মানবিক ভাব ছাড়া অন্য কিছু চিন্তা করিতে তিনি অক্ষম।
বাহ্য উপাসনার আরও একটি উন্নততর সোপান আছে—প্রতীক-উপাসনা। বাহ্যবস্তু সেখানেও বর্তমান, কিন্তু তাহা বৃক্ষ প্রস্তর বা সাধু-মহাত্মাদের স্মৃতিচিহ্ন নয়। ঐগুলি প্রতীক। পৃথিবীতে সর্বপ্রকার প্রতীকই বর্তমান। বৃত্ত অনন্তের একটি মহৎ প্রতীক। … ইহার পর সমচতুর্ভুজ; সুপরিচিত ক্রুশপ্রতীক এবং ইংরেজী S ও Z পরস্পরকে আড়াআড়িভাবে কাটিয়াছে—এরূপ দুইটি আঙুল প্রভৃতি রহিয়াছে।
কেহ কেহ মনে করে, এই প্রতীকগুলির কোন সার্থকতা নাই। … আবার কেহ কেহ অর্থহীন কোন জাদুমন্ত্র চায়। যদি তুমি উহাদিগকে সহজ সরল সত্য কথা বলো, তবে উহারা গ্রহণ করিবে না। … মানুষের স্বভাবই এই—তাহারা তোমাকে যত কম বুঝে, ততই তোমাকে ভাল ও বড় মনে করে। প্রত্যেক দেশে সব যুগেই এরূপ উপাসকেরা কতগুলি জ্যামিতিক চিত্র এবং প্রতীক দ্বারা বিভ্রান্ত হয়। একদা জ্যামিতি সকল বিজ্ঞানের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ছিল। অধিকাংশ লোকই এই বিষয়ে অনভিজ্ঞ ছিল। তাহাদের বিশ্বাস ছিল, জ্যামিতিবিদ্ একটি সমচতুর্ভুজ অঙ্কিত করিয়া উহার চারি কোণে অর্থহীন জাদুমন্ত্রবিশেষ বলিলেই সমগ্র পৃথিবী ঘুরিতে শুরু করিবে, স্বর্গের দ্বার উন্মুক্ত হইবে এবং ভগবান্ অবতরণ করিয়া লাফাইতে থাকিবেন ও মানুষের ক্রীতদাস হইয়া পড়িবেন। দলে দলে এইরূপ উন্মাদ দিবারাত্র এ-সকল বিষয় একাগ্রমনে পড়ে। এ-সবই ব্যাধিবিশেষ। ইহাদের চিকিৎসক প্রয়োজন। দার্শনিকদের জন্য এ-সব নয়।
আমি কৌতুক করিতেছি, কিন্তু এজন্য খুবই দুঃখিত। সমস্যাটি ভারতে অত্যন্ত গুরুতর। এইগুলি জাতির ধ্বংস, অবনতি এবং অবৈধ বলপ্রয়োগের লক্ষণ। তেজ, বীর্য, জীবনীশক্তি, আশা, স্বাস্থ্য এবং যাহা কিছু মঙ্গলকর তাহার লক্ষণই হইল শক্তি। যতদিন শরীর থাকিবে, ততদিন দেহ, মন এবং বাহুতে বল থাকা আবশ্যক। এই-সব অর্থহীন জাদুমন্ত্রবিশেষ দ্বারা অধ্যাত্মশক্তি অর্জনের চেষ্টা বিশেষ ভয়ের কারণ—ইহাতে জীবন-নাশের ভয়ও আছে। ‘প্রতীক উপাসনা’ বলিতে আমি ঐগুলি বলি নাই। কিন্তু এই প্রতীকোপাসনায় কিছু সত্য নিহিত আছে। কিছু সত্য ব্যতিরেকে কোন মিথ্যাই দাঁড়াইতে পারে না। কোন বস্তুর বাস্তব সত্তা না থাকিলে উহার অনুকরণও হইতে পারে না।
বিভিন্ন ধর্মে প্রতীক-পূজা বর্তমান। এমন সব প্রতীক আছে, যেগুলি সুন্দর, শক্তিপ্রদ, বলিষ্ঠ এবং ছন্দোময়। ভাবিয়া দেখ, লক্ষ লক্ষ লোকের উপর ক্রুশের কি আশ্চর্য প্রভাব! অর্ধচন্দ্ররূপ প্রতীকের কথা ধর। এই একটি প্রতীকের যে কি আকর্ষণী শক্তি, সে-কথা চিন্তা করিয়া দেখ। পৃথিবীতে সর্বত্রই সুন্দর ও চমৎকার প্রতীকসমূহ বর্তমান। এই প্রতীকগুলি ভাব প্রকাশ করে এবং কতকগুলি বিশেষ মানসিক অবস্থার সৃষ্টি করে। সচরাচর প্রতীকগুলি বিশ্বাস ও ভালবাসার প্রচণ্ড শক্তি স্ফুরণ করে।
প্রোটেস্টাণ্টদের সঙ্গে ক্যাথলিকদের তুলনা করিয়া দেখ। বিগত চারিশত বৎসরের মধ্যে এই দুইটি সম্প্রদায়ের কোনটি হইতে অধিকসংখ্যক সাধক ও শহীদ জন্মগ্রহণ করিয়াছেন? ক্যাথলিকদের ধর্মানুষ্ঠানের অঙ্গীভূত আলোক, ধূপধুনা, মোমবাতি, যাজকদের পোষাক প্রভৃতির একটা স্বকীয় প্রভাব রহিয়াছে। প্রোটেস্টাণ্ট ধর্ম অতি শুষ্ক ও গদ্যময়। প্রোটেস্টাণ্টরা অনেক বিষয়ে জয়যুক্ত হইয়াছে, কয়েকটি দিকে ক্যাথলিকদের অপেক্ষা অধিক পরিমাণে স্বাধীনতা দিয়াছে, সুতরাং তাহাদের ধারণাগুলি স্পষ্টতর এবং অধিকতর ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য-ভিত্তিক। এই পর্যন্ত ঠিক থাকিলেও তাহারা অনেক কিছু হারাইয়াছে। … গির্জার মধ্যে চিত্রগুলির কথাই ধরা যাক। এগুলি কবিত্ব-শক্তিকে ভাষা দিবার একটি প্রচেষ্টা, কবিতার যদি প্রয়োজন থাকে, তবে কেন আমরা উহা গ্রহণ করিব না? অন্তরাত্মা যাহা চাহিতেছে, তাহা অন্তরাত্মাকে দিব না কেন? আমাদিগকে সঙ্গীতও গ্রহণ করিতে হইবে। প্রেসবিটেরিয়ানরা আবার সঙ্গীতেরও বিরোধী, খ্রীষ্টধর্মাবলম্বিগণের মধ্যে উহারা যেন মুসলমান। সমস্ত কবিতা ধ্বংস হউক! সমস্ত অনুষ্ঠান বিলুপ্ত হউক! তারপর তাহারা যে সঙ্গীত সৃষ্টি করে, সে সঙ্গীত ইন্দ্রিয়ের উপর প্রভাব বিস্তার করে। আমি দেখিয়াছি, কিরূপে তাহারা বক্তৃতামঞ্চের উপর আলোকের জন্য সমবেতভাবে চেষ্টা করে।
বহির্জগতে রূপায়িত কবিতায় ও ধর্মে অন্তঃকরণ পূর্ণ হউক। কেন না হইবে? বাহ্য উপাসনার বিরুদ্ধাচরণ করিতে পার না—বার বার ইহা সমাজে জয় লাভ করিবে। … ক্যাথলিকরা যাহা করে, তাহা যদি তোমার রুচিসম্মত না হয়, তবে ইহা অপেক্ষা আরও ভাল কিছু কর। কিন্তু আমরা আরও ভাল কিছু করিতেও পারিব না, অথচ যে কবিত্ব পূর্ব হইতে বিদ্যমান, তাহাও গ্রহণ করিব না—এটি এক ভয়ঙ্কর অবস্থা। জীবনে কবিত্ব থাকা একান্ত আবশ্যক। তুমি পৃথিবীতে একজন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক হইতে পার, কিন্তু দর্শনশাস্ত্র জগতের শ্রেষ্ঠ কাব্য। ইহা শুষ্ক অস্থি নয়, ইহা সমস্ত বস্তুর সার। যাহা নিত্য সত্তা, তাহা দ্বৈতভাবাপন্ন যে-কোন বস্তু অপেক্ষা অধিকতর কবিত্বপূর্ণ।
পাণ্ডিত্যের স্থান নাই। অধিকাংশের পক্ষেই পাণ্ডিত্য সাধন-পথে একটি বাধা। … একজন পৃথিবীর সমস্ত গ্রন্থাগারের যাবতীয় পুস্তক পড়িয়াও মোটেই ধার্মিক না হইতে পারে, আর একজন হয়তো নিরক্ষর হইয়াও ধর্ম প্রত্যক্ষ অনুভব করিতে সমর্থ। নিজের প্রত্যক্ষ অনুভুতিতেই সমগ্র ধর্ম নিহিত। আমি যখন ‘মনুষ্যত্ব-লাভের বা মানুষ-গড়ার ধর্ম’—এই শব্দ-কয়টি ব্যবহার করি, তখন আমি ঐগুলি দ্বারা কোন পুস্তক, অনুশাসন বা মতবাদের কথা বুঝি না। যে-ব্যক্তি সেই অনন্ত সত্তার এতটুকুও তাহার অন্তরে অনুভব করিয়াছে বা ধারণা করিয়াছে, আমি তাহার কথাই বলি।
আমি সারা জীবন যাঁহার পদতলে বসিয়া শিক্ষালাভ করিয়াছি, যাঁহার কয়েকটিমাত্র ভাব শিক্ষা দিতে চেষ্টা করিতেছি, তিনি কোনক্রমে তাঁহার নিজের নাম লিখিতে পারিতেন। আমি সমগ্র পৃথিবী পরিভ্রমণ করিয়াছি, কিন্তু সারা জীবনে আমি তাঁহার মত আর একজনকেও দেখিলাম না। তাঁহার সম্বন্ধে ভাবিলে নিজেকে নির্বোধ বলিয়া মনে হয়, কেন-না আমি বই পড়িতে চাই, অথচ তিনি কোনদিনই বই পড়েন নাই। অন্যের উচ্ছিষ্ট তিনি কখনও গ্রহণ করিতে চাহিতেন না অর্থাৎ অন্যের চিন্তাধারাকে কোনদিন তিনি নকল করিবার চেষ্টা করেন নাই। এই কারণে তিনি নিজেই নিজের বই ছিলেন। সারা জীবন জ্যাক (Jack) কি বলিল, জন (John) কি বলিয়াছে—তাহাই বলিয়া আসিতেছি; নিজে কিছুই বলিলাম না। জন পঁচিশ বৎসর পূর্বে এবং জ্যাক পাঁচ বৎসর পূর্বে যাহা বলিয়াছে, তাহা জানিয়া তোমার কী লাভ হইয়াছে? তোমার নিজের কি বলিবার আছে, তাই বলো।
মনে রাখিও—পাণ্ডিত্যের কোন মূল্য নাই। পাণ্ডিত্য সম্বন্ধে তোমাদের সকলেরই ধারণা ভুল। মনকে বলিষ্ঠ ও সুনিয়ন্ত্রিত করার মধ্যেই জ্ঞানের একমাত্র মূল্য। আমি অবাক্ হইতেছি যে অনন্ত কাল ধরিয়া এই গলাধঃকরণের দ্বারা আমাদের বদহজম হইতেছে না কেন? আমাদের এইখানেই থাকিয়া যাবতীয় পুস্তক পুড়াইয়া ফেলা প্রয়োজন এবং নিজেদের অন্তরে চিন্তা করা কর্তব্য। তোমরা অনেক বিষয়ে কথা বলো এবং তোমাদের ‘ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্য’কে হারাইবার আশঙ্কায় চঞ্চল হইয়া ওঠ। এই অন্তহীন গলাধঃকরণের দ্বারা প্রতি মুহূর্তেই তোমরা ব্যক্তিত্ব হারাইতেছ। আমি যাহা শিক্ষা দিতেছি, তাহা যদি তোমাদের মধ্যে কেহ শুধু বিশ্বাস করে, তাহা হইলে আমি দুঃখিত হইব; তোমাদের মধ্যে যদি স্বাধীন চিন্তাশক্তি উদ্দীপিত করিতে পারি, তবেই আমি বিশেষ আনন্দিত হইব। … আমার উদ্দেশ্য—নরনারীকে বলা, মেষগুলিকে নয়। ‘নরনারী’ বলিতে আমি ‘মানুষ’ বুঝি। তোমরা ক্ষুদ্র মানুষ নও যে, পথের নোংরা ন্যাকড়া টানিয়া আনিয়া খেলার পুতুল তৈরি করিবে।
এই জগৎ একটি শিক্ষার স্থান! মানুষ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করিয়াছে। মিঃ ব্ল্যাঙ্ক যাহা বলিয়াছেন, তাহা সে সবই জানে! কিন্তু ব্ল্যাঙ্ক কিছুই বলেন নাই! খুশীমত কাজ করিবার ক্ষমতা থাকিলে আমি অধ্যাপককে বলিতাম, ‘বাহিরে যাও! তোমার কোন প্রয়োজন নাই!’ এই ব্যক্তি-স্বাতন্ত্র্যবোধকে যে-কোন উপায়ে মনে রাখিবে! তোমার চিন্তা যদি ভুল হয় হউক, তুমি সত্য লাভ করিলে কি না করিলে তাহাতে কিছু আসে যায় না। মূল কথাটি হইল—মনকে নিয়ন্ত্রিত করা। যে-সত্য তুমি অপরের নিকট হইতে লইয়া গলাধঃকরণ করিবে, তাহা তোমার নিজস্ব হইবে না। আমার মুখে সত্য শুনিয়া তাহা শিক্ষা দিতে পার না এবং আমার মুখে শুনিয়াও কোন সত্য তুমি শিখিতে পার না। কেহ কাহাকেও শিখাইতে পারে না। সত্য অনুভব করিয়া নিজ প্রকৃতি অনুয়ায়ী তাহা কার্যে পরিণত করিতে হইবে। … নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়াইয়া, নিজেদের চিন্তা করিয়া, নিজেদের আত্মা উপলব্ধি করিয়া, সকলকেই শক্তিমান্ হইতে হইবে। কারাগারে আবদ্ধ সৈনিকদের মত একসঙ্গে উঠা, একসঙ্গে বসা, একই খাদ্য খাওয়া, একসঙ্গে মাথা নাড়িয়া অন্যের প্রচারিত মতবাদ গলাধঃকরণ করা প্রভৃতিতে কোন ফল নাই। বৈচিত্র্যই জীবনের লক্ষণ। সমতাই (একই রকম চিন্তা করা) মৃত্যুর লক্ষণ।
একবার একটি ভারতীয় শহরে অবস্থানকালে এক বৃদ্ধ আমার নিকট আসিয়া বলিল, ‘স্বামীজী, আমার পথ নির্দেশ করুন।’ আমি দেখিলাম যে, লোকটি আমার সম্মুখের টেবিলটির মত একেবারে জড় হইয়া গিয়াছে; মানসিক এবং আধ্যাত্মিক দিক্ দিয়া তাহার প্রকৃত মৃত্যু হইয়াছিল। আমি বলিলাম, ‘তোমাকে যাহা নির্দেশ দিব, তাহা পালন করিবে কি? তুমি কি চুরি করিতে পার? তুমি মদ খাইতে পার? মাংস খাইতে পার? লোকটি চীৎকার করিয়া বলিয়া উঠিল, ‘এ আপনি আমাকে কী শিক্ষা দিতেছেন?’ আমি তাহাকে বলিলাম, ‘এই দেওয়ালটি কি কখনও চুরি করিয়াছে? এ কি কখনও মদ খাইয়াছে?’ লোকটি উত্তর দিল, ‘না, মহাশয়।’ মানুষই চুরি করে, মদ খায়, আবার ঈশ্বরত্ব লাভ করে।
‘বন্ধু, আমি জানি, তুমি একটি দেওয়াল মাত্র নও। কিছু একটা কর! কিছু একটা কর!’ আমি অনুভব করিয়াছিলাম, লোকটি চুরি করিলে তাহার আত্মা মুক্তির দিকে অগ্রসর হইবে। তোমাদের যে ব্যক্তিত্ব আছে, তাহা কিরূপে বুঝিব?—তোমরা তো এক সঙ্গে ওঠ, একসঙ্গে বস এবং একই কথা বল। ইহা মৃত্যুর পথ জানিবে। তোমার আত্মার জন্য কিছু কর। যদি ইচ্ছা হয়, তবে অন্যায় কর, কিন্তু একটা কিছু কর! আমাকে তোমরা এখন বুঝিতে না পারিলেও ক্রমে বুঝিতে পারিবে। আত্মা যেন বার্ধক্যগ্রস্ত হইয়াছে, উহার উপর মরিচা ধরিয়াছে। এই মরিচা ঘষিয়া মাজিয়া ছাড়াইতে হইবে, তবেই আমরা অগ্রসর হইতে পারিব। জগতে এত অন্যায় কেন, তাহা তোমরা এখন বুঝিতেছ। এই মরিচা হইতে নিজেদের মুক্ত করিবার জন্যই গৃহে ফিরিয়া এ-বিষয়ে চিন্তা কর।
আমরা জাগতিক বস্তুসকলের জন্য প্রার্থনা করি। কোন উদ্দেশ্য-সাধনের নিমিত্ত আমরা ব্যবসায়ী বুদ্ধি লইয়া ভগবানের পূজা করি। খাওয়া-পরার জন্য আমরা প্রার্থনা করি। পূজা উত্তম। কিছু না করা অপেক্ষা কিছু একটা করা ভাল। ‘নাই মামার চেয়ে কানা-মামা ভাল।’ অত্যন্ত ধনী এক যুবক রোগাক্রান্ত হইল, অমনি সে আরোগ্যলাভের জন্য গরীবদের দান করিতে আরম্ভ করিল। ইহা ভাল কাজ, কিন্তু ইহা ধর্ম নয়—আধ্যাত্মিকতা নয়, ইহা জাগতিক ব্যাপার। কোন্টা জাগতিক এবং কোন্টা জাগতিক নয়? যখন উদ্দেশ্য ইহজীবন, এবং ভগবান্ সেই উদ্দেশ্য-লাভের উপায়রূপে ব্যবহৃত হন, তখন তাহা জাগতিক। আবার যেখানে ঈশ্বর-লাভই উদ্দেশ্য এবং জাগতিক জীবন সেই লক্ষ্যে পৌঁছিবার উপায়রূপে ব্যবহৃত হয়, সেখানেই অধ্যাত্মিক জীবনের আরম্ভ। সুতরাং যে-ব্যক্তি এই জাগতিক জীবনে প্রাচুর্য কামনা করে, তাহার নিকট এই জীবনের স্থায়িত্ব তাহার ঈপ্সিত স্বর্গ বলিয়া বিবেচিত হয়। সে পরলোকগত ব্যক্তিদের দেখিতে চায় এবং তাহাদের সহিত আবার সুখে দিন কাটাইতে চায়।
যে-সকল মহিলা প্রেতাত্মাদের সম্মুখে আনিতে চেষ্টা করেন, তাঁহাদের মধ্যে একজন ছিলেন মিডিয়াম বা মাধ্যম। দেখিতে দীর্ঘাকার, তবু তিনি মাধ্যম। বেশ! এই মহিলা আমাকে খুবই পছন্দ করিতেন এবং তাহার নিকট যাইবার জন্য আমন্ত্রণ করিয়াছিলেন। প্রেতাত্মারা সকলেই আমার প্রতি বিনম্র ছিল। আমার অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হইয়াছিল। বুঝিতেই পারিতেছ, ইহা ছিল মধ্যরাত্রে প্রেতশক্তি-বাদীদের বৈঠক। মাধ্যম বলিল, ‘… আমি একজন প্রেতকে এখানে দাঁড়াইয়া থাকিতে দেখিতেছি। প্রেত আমাকে বলিতেছে যে, ঐ বেঞ্চের উপর একজন হিন্দু ভদ্রলোক বসিয়া আছেন।’ আমি দাঁড়াইয়া উঠিয়া বলিলাম, ‘তোমাকে এই কথা বলিবার জন্য কোন প্রেতাত্মার সাহায্য প্রয়োজন হয় না।’
সেখানে একজন সুশিক্ষিত, বুদ্ধিমান্ এবং বিবাহিত যুবক উপস্থিত ছিল। সে তাহার মাতাকে দেখিবার জন্য আসিয়াছিল। মাধ্যম বলিল, ‘অমুকের মা এখানে আসিয়াছেন।’ যুবকটি তাহার মায়ের বিষয় আমাকে বলিতেছিল—তাহার মা মৃত্যুকালে খুবই ক্ষীণদেহ হইয়া পড়েন। কিন্তু পর্দার অন্তরাল হইতে যে-মা বাহির হইল! তোমরা যদি তাহাকে দেখিতে! যুবকটি কি করে, তাহা দেখিতে চাহিলাম। আমি দেখিয়া বিস্মিত হইলাম যে, যুবকটি লাফাইয়া সেই প্রেতাত্মাকে আলিঙ্গন করিয়া বলিল, ‘মাগো, তুমি প্রেতলোকে গিয়া অপরূপ হইয়াছ!’ আমি বলিলাম, ‘আমি ধন্য যে আমি এইখানে উপস্থিত আছি। এই-সব ঘটনা মানুষের প্রকৃতি সম্বন্ধে আমার অন্তর্দৃষ্টি খুলিয়া দিয়াছে।’
বাহ্য উপাসনার প্রসঙ্গে আবার বলি, ইহজীবন এবং জাগতিক সুখের লক্ষ্যে উপনীত হইবার জন্য ঈশ্বরকে উপাসনা করা অতি নিম্নস্তরের পূজা। … অধিকাংশ লোকই দেহের এই মাংসপিণ্ড এবং ইন্দ্রিয়ের সুখ অপেক্ষা উচ্চতর কোন চিন্তা করিতে পারে না। এই বেচারারা এই জীবনেই যে-সুখের সন্ধান করে, সে-সুখ পাশব সুখ … । তাহারা প্রাণিখাদক। তাহারা তাহাদের সন্তান-সন্ততিদের ভালবাসে। ইহাই কি মানুষের সব গৌরব? আমরা আবার সর্বশক্তিমান্ ঈশ্বরকে পূজা করি। কি জন্য? কেবল এই-সব জাগতিক বস্তু পাইবার জন্য এবং সর্বদা ঐগুলিকে রক্ষা করিবার জন্য। … ইহার অর্থ এই যে, আমরা এখনও পশুপক্ষীর জীবনের ঊর্ধ্বে উঠিতে পারি নাই। পশু-পক্ষী অপেক্ষা আমরা মোটেই উন্নততর নই। আমরা উন্নততর কিছু জানিও না। আমাদিগকে ধিক্! আমাদের আরও উচ্চতর শিক্ষা পাওয়া উচিত। পশুপক্ষীদের সহিত আমাদের তফাত এই যে, আমাদের মত তাহাদের ঈশ্বর বলিয়া কিছু নাই। … পশুদের মত আমাদেরও পাঁচটি ইন্দ্রিয় আছে, কিন্তু তাহাদের ইন্দ্রিয়গুলি আরও তীক্ষ্ণ। একটি কুকুর যেরূপ তৃপ্তি সহকারে একখণ্ড হাড় চিবায়, আমরা একগ্রাস অন্ন তেমন তৃপ্তির সহিত খাই না। আমাদের অপেক্ষা তাহাদের জীবনে আনন্দ বেশী। সুতরাং আমরা পশুদের চেয়ে একটু নিকৃষ্ট।
তোমরা কেন এমন কিছু হইতে চাহিবে যাহাতে প্রকৃতির কোন শক্তি তোমাদের উপর অধিকতর কার্যকরী হইবে? ইহা একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ চিন্তনীয় বিষয়। কি তোমাদের কাম্য—এই জীবন, ইন্দ্রিয়সুখ, এই শরীর অথবা অনন্তগুণে মহৎ এবং উচ্চতর কোন কিছু বস্তু, এমন একটি অবস্থা যাহার কোন চ্যুতি নাই. যেখানে কোন পরিবর্তন নাই?
অতএব ইহা দ্বারা কি প্রতীত হয়? তোমরা বল, ‘হে প্রভু, অন্ন দাও, অর্থ দাও, আমার রোগ নিরাময় কর, ইহা কর, তাহা কর!’ যখনই তোমরা এইরূপ প্রার্থনা কর, তখনই ‘আমি জড়বস্তু, জড়জগৎই আমার লক্ষ্য’—এই ভাবে নিজেদের সম্মোহিত করিয়া থাক। প্রত্যেকবারই যখন তোমরা জাগতিক অভিলাষ পূরণের জন্য উদ্যোগী হও, ততবারই তোমরা বলিতে থাক—‘আমরা জড়দেহ মাত্র, আমরা আত্মা নই।’ …
ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, এইগুলি সব স্বপ্ন মাত্র। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, এইগুলি অদৃশ্য হইয়া যাইবে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ যে, সৃষ্টিতে মৃত্যু—সেই মহান্ মৃত্যু আছে, যাহা সব ভ্রান্তি, সব স্বপ্ন, এই দেহবাদিতা, এই মর্মবেদনার অবসান ঘটাইয়া দেয়। কোন স্বপ্নই চিরস্থায়ী হইতে পারে না—শীঘ্র অথবা বিলম্বে ইহা অবশ্যই শেষ হইবে। স্বপ্নকে চিরস্থায়ী করিতে পারে, এমন কেহ নাই। আমি ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিতেছি যে, তিনি এরূপ ব্যবস্থা করিয়াছেন। তবুও বলিব, এই প্রকারের উপাসনার সার্থকতা আছে। এভাবে চলিতে থাকো। প্রার্থনা একেবারে না করা অপেক্ষা কোন কিছুর জন্য প্রার্থনা করা ভাল। এই সোপানগুলি অতিক্রম করিয়া যাইতে হইবে। এগুলি প্রাথমিক শিক্ষা। মন ক্রমশঃ ইন্দ্রিয়, দেহ, এই জাগতিক ভোগসুখের ঊর্ধ্বে কোন বস্তুর বিষয় চিন্তা করিতে আরম্ভ করে।
মানুষ কিরূপে ইহা করে? প্রথমে মানুষ চিন্তাশীল হয়। তুমি যখন কোন একটি সমস্যা চিন্তা করিতে থাক, তখন সেখানে চিন্তারই এক অপূর্ব আনন্দ আসে, ইন্দ্রিয়ের ভোগসুখ বলিয়া কিছু থাকে না। … এই আনন্দই মানুষকে মনুষ্যত্বের দিকে লইয়া যায়। … একটি মহৎ ভাবের বিষয় চিন্তা কর। … চিন্তা যতই গাঢ় হইবে এবং মন সংযত হইবে, তখন তোমার দেহের বিষয় আর মনে উদিত হইবে না। তোমার ইন্দ্রিয়গুলির কাজ বন্ধ হইয়া যাইবে। তখন তুমি সমস্ত দেহ-জ্ঞানের ঊর্ধ্বে চলিয়া যাইবে। তখন ইন্দ্রিয়ের মধ্য দিয়া যাহা কিছু প্রকাশিত হইতেছিল, সবই ঐ একটি ভাবে কেন্দ্রীভূত হইবে। ঠিক সেই মুহূর্তে তুমি পশু অপেক্ষা উন্নত। সেই সময় দেহাতীত এমন একটি অনুভূতি, এমন একটি প্রত্যক্ষ উপলব্ধি তুমি লাভ করিবে, যাহা কেহই তোমার নিকট হইতে কাড়িয়া লইতে পারিবে না। … মনের লক্ষ্য সেখানে—ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগতে নয়।
এইরূপে এই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎ হইতে আরম্ভ করিয়া তুমি অন্য অনুভূতির রাজ্যে একটু করিয়া প্রবেশাধিকার লাভ করিবে। তখন এই জগৎ বলিয়া তোমার নিকট আর কিছুই থাকিবে না। যখন তুমি সেই আত্মার একটু আভাস পাইবে, তখন তোমার ইন্দ্রিয়বোধ, তোমার ভোগাকাঙ্ক্ষা, তোমার দেহাসক্তি চলিয়া যাইবে। সেই ভাররাজ্যের আভাস একের পর এক তোমার নিকট উদ্ঘাটিত হইবে। তোমার যোগ সম্পূর্ণ হইবে এবং আত্মা তোমার নিকট আত্মারূপেই প্রতিভাত হইবে। তখনই তুমি ঈশ্বরকে আত্মারূপে উপাসনা করিতে আরম্ভ করিবে। তখনই তুমি বুঝিতে পারিবে যে, উপাসনা কোন স্বার্থসাধনের নিমিত্ত নয় | অন্তরের অন্তরে এই পূজা ছিল ভালবাসা, যাহা অসীম হইয়াও সসীম; ঈশ্বররের পাদপদ্মে ইহা অন্তরের চিরন্তন আত্মনিবেদন—সর্বস্ব অর্পণ। সেখানে কেবল ‘তুমি’, ‘আমি’ নই। ‘আমি’ সেখানে মৃত—‘তুমি’ই সেখানে আছ, ‘আমি’ নাই। সেখানে আমি ধন, সৌন্দর্য, এমন কি পাণ্ডিত্যও কামনা করি না। আমি মুক্তি চাই না। যদি তোমার অভিপ্রেত হয়, তবে বিশ হাজার বার নরক গমন করিব। আমি কেবল একটি বস্তু কামনা করিঃ হে ঈশ্বর, তুমি আমার প্রেমাস্পদ হও।