আমরা দেখিয়াছি, বৈরাগ্য বা ত্যাগই এই সকল বিভিন্ন যোগপথের সন্ধিস্থল। কর্মী কর্মফল ত্যাগ করেন। ভক্ত সেই সর্বশক্তিমান্ সর্বব্যাপী প্রেমস্বরূপের জন্য সমুদয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্রেম ত্যাগ করেন; যোগী যাহাতে কিছু অনুভব করেন, তাঁহার জন্য কিছু অভিজ্ঞতা—সব পরিত্যাগ করেন, কারণ তাহার যোগশাস্ত্রের শিক্ষা এই যে, সমগ্র প্রকৃতি যদিও আত্মার ভোগ ও আভিজ্ঞতার জন্য, তথাপি উহা শেষে তাঁহাকে জানাইয়া দেয় তিনি প্রকৃতিতে অবস্থিত নন, প্রকৃতি হইতে তিনি নিত্য-স্বতন্ত্র। জ্ঞানী সব ত্যাগ করেন, কারণ জ্ঞান শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত এই যে, ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান কোনকালেই প্রকৃতির অস্তিত্ব নাই। আমরা ইহাও দেখিয়াছি, এই-সকল উচ্চতর বিষয়ে এ প্রশ্ন করা যাইতে পারে না : ইহাতে কি লাভ? লাভালাভের প্রশ্ন-জিজ্ঞসা করাই এখানে অসম্ভব, আর যদিই এই প্রশ্ন জিজ্ঞাসিত হয়, তাহা হইলেও আমরা উহা উত্তমরুপে বিশ্লেষণ করিয়া কি পাই?—যাহা মানুষের সাংসারিক অবস্থার উন্নতিসাধন করে না, তাহার সুখ বৃদ্ধি করে না, তাহা অপেক্ষা যাহাতে তাহারা বেশী সুখ, তাহারা বেশী লাভ—বেশী হিত তাহাই সুখের আদর্শ। সমুদয় বিজ্ঞান ঐ এক লক্ষ্যসাধনে অর্থাৎ মনুষ্যজাতিকে সুখী করিবার জন্য চেষ্টা করিতেছে, আর যাহা বেশী পরিমাণ সুখ আনে, মানুষ তাহাই গ্রহণ করে; যাহাতে অল্প সুখ, তাহা ত্যাগ করে। আমরা দেখিয়াছি সুখ হয় দেহে, না হয় মনে বা আত্মায় অবস্থিত। পশুদের এবং পশুপ্রায় অনুন্নত মনুষ্যগণের সকল সুখ দেহে। একটা ক্ষুধার্ত কুকুর বা ব্যাঘ্র যেরূপ তৃপ্তির সহিত আহার করে, কোন মানুষ তাহা পারে না। সুতরাং কুকুর ও ব্যাঘ্রের সুখের আদর্শ সম্পূর্ণরূপে দেহগত। মানুষের ভিতর আমরা একটা উচ্চস্তরের চিন্তাগত সুখ দেখিয়া থাকি—মানুষ জ্ঞানালোচনায় সুখী হয়। সর্বোচ্চ স্তরের সুখ জ্ঞানীর—তিনি আত্মানন্দে বিভোর থাকেন। আত্মাই তাহার সুখের একমাত্র উপকরণ। অতএব দার্শনিকের পক্ষে এই আত্মজ্ঞানই পরম লাভ বা হিত, কারণ ইহাতেই তিনি পরম সুখ পাইয়া থাকেন। জড়বিষয়সমূহ বা ইন্দ্রিয়-চরিতার্থতা তাহার নিকট সর্বোচ্চ লাভের বিষয় হইতে পারে না, কারণ তিনি জ্ঞানে যেরূপ সুখ পাইয়া থাকেন, উহাতে সেরূপ পান না। প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানই সকলের একমাত্র লক্ষ, আর আমরা যত প্রকার সুখের বিষয় আবগত আছি, তন্মধ্যে জ্ঞানই সর্বোচ্চ সুখ। ‘যাহারা অজ্ঞানে কাজ করিয়া থাকে, তাহারা যেন দেবগণের ভারবাহী পশু’ —এখানে দেব অর্থে বিজ্ঞ ব্যক্তিকে বুঝিতে হইবে। যে সকল ব্যক্তি যন্ত্রবৎ কার্য ও পরিশ্রম করিয়া থাকে, তাহারা প্রকৃতপক্ষে জীবনটাকে উপভোগ করে না, বিজ্ঞ ব্যক্তিই জীবনটাকে উপভোগ করেন। একজন বড় লোক হয়তো এক লক্ষ টাকা খরচ করিয়া একখানি ছবি কিনিল, কিন্তু যে শিল্প বুঝিতে পারে, সেই উহা উপভোগ করিবে। ক্রেতা যদি শিল্পজ্ঞানশূন্য হয়, তবে তাহার পক্ষে উহা নিরর্থক, সে কেবল উহার আধিকারি মাত্র। সমগ্র জগতে বিজ্ঞ বিচক্ষণ ব্যক্তিই কেবল সংসারে সুখ উপভোগ করেন। অজ্ঞান ব্যক্তি কখনও সুখভোগ করিতে পারে না, তাহাকে অজ্ঞাতসারে অপরের জন্যই পরিশ্রম করিতে হয়।
এ পর্যন্ত আমরা অদ্বৈতবাদীদের সিদ্ধান্তসমূহ দেখিলাম, দেখিলাম তাঁহাদের মতে একমাত্র আত্মা আছে, দুই আত্মা থাকিতে পারে না। আমরা দেখিলাম—সমগ্র জগতে একটি মাত্র সত্তা বিদ্যমান, আর সেই এক সত্তা ইন্দ্রিয়গণের ভিতর দিয়া দৃষ্ট হইলে উহাকেই এই জড়জগৎ বলিয়া বোধ হয়। যখন কেবল মনের ভিতর দিয়া উহা দৃষ্ট হয় তখন উহাকে চিন্তা বা ও ভাবজগৎ বলে, আর যখন উহার যথার্থ জ্ঞান হয়, তখন উহা এক অনন্ত পুরুষ বলিয়া প্রতীত হয়। এই বিষয়টি আপনারা বিশেষরূপে স্মরণ রাখিবেন—ইহা বলা ঠিক নয় যে, মানুষের ভিতর একটি আত্মা আছে, যদিও বুঝাইবার জন্য প্রথমে আমাকে ঐরূপ ধরিয়া লইতে হইয়াছিল। বাস্তবিকপক্ষে কেবল এক সত্তা রহিয়াছে এবং সেই সত্তা আত্মা—আর তাহাই যখন ইন্দ্রিয়গণের ভিতর দিয়া অনুভূত হয়, তখন তাহাকেই দেহ বলে; যখন উহা চিন্তা বা ভাবের মধ্য দিয়া অনুভূত হয়, তখন উহাকেই মন বলে; আর যখন উহা স্ব-রূপে উপলব্ধ হয়, তখন উহা আত্মারূপে—সেই এক অদ্বিতীয় সত্তারূপে প্রতীয়মান হয়। অতএব ইহা ঠিক নয় যে, দেহ, মন ও আত্মা—একত্র এই তিনটি জিনিস রহিয়াছে, যদিও বুঝাইবার সময় ঐরূপে ব্যাখ্যা করায় বুঝাইবার পক্ষে বেশ সহজ হইয়াছিল; কিন্তু সবই সেই আত্মা, আর সেই এক পুরুষই বিভিন্ন দৃষ্টি কোণ হইতে কখন দেহ, কখন মন, কখন বা আত্মারূপে কথিত হয়। একমাত্র পুরুষই আছেন, অজ্ঞানীরা তাঁহাকেই জগৎ বলিয়া থাকে। যখন সেই ব্যক্তিই জ্ঞানে অপেক্ষাকৃত উন্নত হয়, তখন সে সেই পুরুষকেই ভাবজগৎ বলিয়া থাকে। আর যখন পূর্ণ জ্ঞানোদয়ে সকল ভ্রম দূর হয়, তখন মানুষ দেখিতে পায়, এ সবই আত্মা ব্যতীত আর কিছুই নয়। চরম সিদ্ধান্ত এই যে, ‘আমি সেই এক সত্তা’। জগতে দুইটি বা তিনটি সত্তা নাই, সবই এক। সেই এক সত্তাই মায়ার প্রভাবে বহুরূপে দৃষ্ট হইতেছে, যেমন অজ্ঞানবশতঃ রজ্জুতে সর্পভ্রম হইয়া থাকে। সেই দড়িটাই সাপ বলিয়া দৃষ্ট হয়। এখানে দড়ি আলাদা ও সাপ আলাদা—এরূপ দুইটি পৃথক্ বস্তু নাই। কেহই সেখানে দুইটি বস্তু দেখে না। দ্বৈতবাদ ও অদ্বৈতবাদ বেশ সুন্দর দার্শনিক পারিভাষিক শব্দ হইতে পারে, কিন্তু পূর্ণ অনুভূতির সময় আমরা একই সময়ে সত্য ও মিথ্যা কখনই দেখিতে পাই না। আমরা সকলেই জন্ম হইতে একত্ববাদী, উহা হইতে পালাইবার উপায় নাই। আমরা সকল সময়েই ‘এক’ দেখিয়া থাকি। যখন আমরা রজ্জু দেখি, তখন মোটেই সর্প দেখি না; আবার যখন সর্প দেখি, তখন মোটেই রজ্জু দেখি না—উহা তখন উড়িয়া যায়। যখন আপনাদের ভ্রম হয়, তখন আপনারা যথার্থ বস্তু দেখেন না। মনে করুন, দূর হইতে রাস্তায় আপনার একজন বন্ধু আসিতেছেন। আপনি তাহাকে অতি ভালভাবেই জানেন, কিন্তু আপনার সম্মুখে কুজ্ঝটিকা থাকায় আপনি তাহাকে অন্য লোক বলিয়া মনে করিতেছেন। যখন আপনি আপনার বন্ধুকে অপর লোক বলিয়া মনে করিতেছেন, তখন আপনি আর আপনার বন্ধুকে দেখিতেছেন না, তিনি অন্তর্হিত হইয়াছেন। আপনি একটি মাত্র লোককে দেখিতেছেন। মনে করুন আপনার বন্ধুকে ‘ক’ বলিয়া অভিহিত করা গেল। তাহা হইলে আপনি যখন ‘ক’ কে ‘খ’ বলিয়া দেখিতেছেন, তখন আপনি ‘ক’কে মোটেই দেখিতেছেন না। এইরূপ সকল স্থলে আপনদের একেরই উপলব্ধি হইয়া থাকে। যখন আপনি নিজেকে দেহরূপে দর্শন করেন, তখন আপনি দেহমাত্র, আর কিছুই নন, আর জগতের অধিকাংশ মানুষেরই এইরূপ উপলব্ধি। তাহারা মুখে আত্মা মন ইত্যাদি কথা বলিতে পারে, কিন্তু তাহারা অনুভব করে, এই স্থূল দেহ-স্পর্শ, দর্শন, আস্বাদ ইত্যাদি।
আবার কেহ কেহ কোন চেতন অবস্থায় নিজদিগকে চিন্তা বা ভাবরূপে অনুভব করিয়া থাকেন। আপনারা অবশ্য স্যার হাম্ফ্রি ডেভি সম্বন্ধে প্রচলিত গল্পটি জানেন। তিনি তাহার ক্লাসে ‘হাস্যজনক বাষ্প’ (Laughing gas) লইয়া পরীক্ষা করিতেছিলেন। হঠাৎ একটা নল ভাঙিয়া ঐ বাষ্প বাহির হইয়া যায় এবং তিনি নিঃশ্বাসযোগে উহা গ্রহণ করেন। কয়েক মুহূর্তের জন্য তিনি প্রস্তরমূর্তির ন্যায় নিশ্চলভাবে দণ্ডায়মান রহিলেন। অবশেষে তিনি ক্লাসের ছেলেদের বলিলেন, যখন আমি ঐ অবস্থায় ছিলাম, আমি বাস্তবিক অনুভব করিতেছিলাম যে, সমগ্র চিন্তা বা ভাবে গঠিত। ঐ বাষ্পের শক্তিতে কিছুক্ষণের জন্য তাহার দেহবোধ চলিয়া গিয়াছিল, আর যাহা পূর্বে তিনি শরীর বলিয়া দেখিতেছিলেন, তাহাই এক্ষণে চিন্তা বা ভাবরূপে দেখিতে পাইলেন। যখন অনুভূতি আরও উচ্চতর অবস্থায় যায়, যখন এই ক্ষুদ্র অহংজ্ঞানকে চিরদিনের জন্য অতিক্রম করা যায়, তখন সকলের পশ্চাতে যে সত্য বস্তু রহিয়াছে, তাহা প্রকাশ পাইতে থাকে। উহাকে তখন আমরা অখণ্ড সচ্চিদানন্দ-রূপে-সেই এক আত্মারূপে-বিরাট পুরুষরূপে দর্শন করি। ‘জ্ঞানী ব্যক্তি সমাধিকালে অনির্বচনীয়, নিত্যবোধ, কেবলানন্দ, নিরুপম, অপার, নিত্যমুক্ত, নিষ্ক্রিয়, অসীম, গগনসম, নিষ্ফল, নির্বিকল্প পূর্ণব্রহ্মমাত্র হৃদয়ে সাক্ষাৎ করেন।’ ১
অদ্বৈতমত এই বিভিন্ন প্রকার স্বর্গ ও নরকের এবং আমরা বিভিন্ন ধর্মে যে নানাবিধ ভাব দেখিতে পাই, এই সকলের কিরূপ ব্যাখ্যা করে? মানুষের মৃত্যু হইলে বলা হয় যে, সে স্বর্গে বা নরকে যায়, এখানে ওখানে নানা স্থানে যায়, অথবা স্বর্গে বা অন্য কোন লোকে দেহ ধারণ করিয়া জন্মপরিগ্রহ করে। এ-সমুদয়ই ভ্রম। প্রকৃতপক্ষে কেহই জন্মায় না বা মরে না; স্বর্গও নাই নরকও নাই অথবা ইহলোকও নাই; এই তিনটি কোন কালেই অস্তিত্ব নাই। একটা ছেলেকে অনেক ভূতের গল্প বলিয়া সন্ধাবেলা বাহিরে যাইতে বলো। একটা ‘স্থাণু’ রহিয়াছে। বালক কি দেখে? সে দেখে একটা ভূত হাত বাড়াইয়া তাহাকে ধরিতে আসিতেছে। মনে করুন, একজন প্রণয়ী রাস্তার এক কোণ হইতে তাহা প্রণয়িনীর সহিত দেখা করিতে আসিতেছে—সে ঐ শুষ্ক বৃক্ষকাণ্ডটিকে তাহার প্রণয়িনী মনে করে। একজন পাহারাওয়ালা উহাকে চোর বলিয়া মনে করিবে, আবার চোর উহাকে পাহারাওয়ালা মনে করিবে। সেই একই স্থাণু বিভিন্নরূপে দৃষ্ট হইতেছে। স্থাণুটিই সত্য, আর এই যে উহাকে বিভিন্নভাবে উহাকে দর্শন করা—তাহা নানা প্রকার মনের বিকারমাত্র। একজন পুরুষ এই আত্মাই আছেন। তিনি কোথাও যানও না, আসেনও না। অজ্ঞান মানুষ স্বর্গ বা সেরূপ কোন স্থানে যাইবার বাসনা করে, সারাজীবন সে ক্রমাগত উহার চিন্তা করিয়াছে। এই পৃথিবীর স্বপ্ন—যখন তাহারা চলিয়া যায়, তখন সে এই জগৎকেই স্বর্গরূপে দেখিতে পায়; দেখে এখানে দেব ও দেবদূতেরা বিচার করিতেছেন। যদি কোন ব্যক্তি সারাজীবন তাহার পূর্বপুরুষদিগকে দেখিতে চায়, সে আদম হইতে আরম্ভ করিয়া সকলকেই দেখিতে পায়, কারণ সে নিজেই উহাদিগকে সৃষ্টি করিয়া থাকে। যদি কেহ আরও অধিক আজ্ঞান হয় এবং ধর্মান্ধেরা চিরকাল তাহাকে নরকের ভয় দেখায় তবে সে মৃত্যুর পর এই জগৎকেই নরক রূপে দর্শন করে, আর ইহাও দেখে যে, সেখানে লোকে নানাবিধ শাস্তিভোগ করিতেছে। মৃত্যু বা জন্মের আর কিছুই অর্থ নাই, কেবল দৃষ্টির পরিবর্তন। আপনি কোথাও যান না, বা যাহা কিছুর উপর দৃষ্টিনিক্ষেপ করেন, সেগুলিও কোথাও যায় না। আপনি তো নিত্য অপরিণামী। আপনার আবার যাওয়া আসা কি? ইহা অসম্ভব, আপনি তো সর্বব্যাপী। আকাশ কখন গতিশীল নয় কিন্তু উহার উপর মেঘ এদিক ওদিক যাইয়া থাকে- আমরা মনে করি, আকাশই গতিশীল হইয়াছে। রেলগাড়ি চড়িয়া যাইবার সময় যেমন পৃথিবীকে গতিশীল বোধ হয়, এও ঠিক সেরূপ। বাস্তবিক পৃথিবীতো নড়িতেছে না, রেলগাড়িই চলিতেছে। এইরূপে আপনি যেখানে ছিলেন সেইখানেই আছেন, কেবল এই সকল বিভিন্নস্বপ্ন মেঘগুলির মতো এতিক ওদিক যাইতেছে। একটা স্বপ্নের পর আর একটা স্বপ্ন আসিতেছে-ঐগুলির মধ্যে কোন সম্বন্ধ নাই। এই জগতে নিয়ম বা সম্বন্ধ বলিয়া কিছুই নাই, কিন্তু আমরা ভাবিতেছি, পরস্পর যথেষ্ট সম্বন্ধ আছে। আপনারা সকলেই সম্ভবতঃ ‘এলিসের অদ্ভুত দেশদর্শন’ (Alice in Wonderland) নামক গ্রন্থ পড়িয়াছেন। এই শতাব্দীতে শিশুদের জন্য লেখা একখানি আশ্চর্য পুস্তক। আমি ঐ বইখানি পড়িয়া বড়ই আনন্দলাভ করিয়াছিলাম—আমার মাথায় বারবার ছোটদের জন্য ঐরূপ বই লেখার ইচ্ছা ছিল। এই পুস্তকে আমার সর্বাপেক্ষা ভাল লাগিয়াছিল এই ভাবটি যে, আপনারা যাহা সর্বাপেক্ষা অসঙ্গত জ্ঞান করেন, তাহাই উহার মধ্যে আছে—কোনটির সহিত কোনটির কোন সম্বন্ধ নাই। একটা ভাব আসিয়া যেন আর একটার ঘাড়ে লাফাইয়া পড়িতেছে—পরস্পর কোন সম্বন্ধ নাই। যখন আপনারা শিশু ছিলেন, তখন আপনারা ভাবিতেন—ঐগুলির মধ্যে অদ্ভুত সম্বন্ধ আছে। এই গ্রন্থাগার তাঁহার শৈশবাবস্থার চিন্তাগুলি—শৈশবাবস্থায় যাহা তাঁহার পক্ষে সম্পূর্ণ সম্বন্ধযুক্ত বলিয়া বোধ হইত, সেগুলি লইয়া শিশুদের জন্য এই পুস্তকখানি রচনা করিয়াছেন। আর অনেকে ছোটদের জন্য যেসব গ্রন্থ রচনা করেন, সেগুলি বড় হইলে তাহাদের যেসকল চিন্তা ও ভাব আসিয়াছে, সেই সব ভাব ছোটদের গিলাইবার চেষ্টা করেন, কিন্তু ঐ বইগুলি তাহাদের কিছুমাত্র উপযোগী নয়—বাজে অনর্থক লেখা মাত্র। যাহা হউক, আমরা সকলেই বয়ঃপ্রাপ্ত শিশুমাত্র। আমাদের জগৎও ঐরূপ অসম্বন্ধ—যেন ঐ এলিসের অদ্ভুত রাজ্য—কোনটির সহিত কোনটির কোনপ্রকার সম্বন্ধ নাই। আমরা যখন কয়েকবার ধরিয়া কতকগুলি ঘটনাকে একটি নির্দিষ্ট ক্রমানুসারে ঘটিতে দেখি, আমরা তাহাকেই কার্য কারণ নামে অভিহিত করি, আর বলি উহা আবার ঘটিবে। যখন এই স্বপ্ন চলিয়া গিয়া তাহার স্থলে অন্য স্বপ্ন আসিবে, তাহাকেও ইহারই মতো সম্বন্ধযুক্ত বোধ হইবে। স্বপ্নদর্শনের সময় আমরা যাহা কিছু দেখি সবই সম্বন্ধযুক্ত বলিয়া বোধ হয়, স্বপ্নাবস্থায় আমরা সেগুলিকে কখনই অসম্বন্ধ বা অসঙ্গত মনে করি না—কেবল যখন জাগিয়া উঠি, তখনই সম্বন্ধের অভাব দেখিতে পাই। এইরূপ যখন আমরা এই জগদ্রূপ স্বপ্নদর্শন হইতে জাগিয়া উঠিয়া ঐ স্বপ্নকে সত্যের সহিত তুলনা করিয়া দেখিব, তখন ঐ সমুদয়ই অসম্বন্ধ ও নিরর্থক বলিয়া প্রতিভাত হইবে—কতকগুলি অসম্বন্ধ জিনিস যেন আমাদের সম্মুখ দিয়া চলিয়া গেল-কোথা হইতে আসিল, কোথায় যাইতেছে, কিছুই জানি না। কিন্তু আমরা জানি যে উহা শেষ হইবে। আর ইহাকেই ‘মায়া’ বলে। এই সমুদয় পরিমাণশীল বস্তু-রাশি রাশি সঞ্চরমান মেঘলোমতুল্য মেঘের ন্যায় এবং তাহার পশ্চাতে অপরিণামী সূর্য আপনি স্বয়ং। যখন সেই অপরিণামী সত্তাকে বাহির হইতে দেখেন, তখন তাহাকে ঈশ্বর বলেন, আর ভিতর হইতে দেখিলে উহাকে আপনার নিজ আত্মা বা স্বরূপ বলিয়া দেখেন। উভয়ই এক। আপনা হইতে পৃথক দেবতা বা ঈশ্বর নাই, আপনা অপেক্ষা-যথার্থ যে আপনি তাহা অপেক্ষা-মহত্তর দেবতা নাই; সকল দেবতাই আপনার তুলনাই ক্ষুদ্রতর; ঈশ্বর স্বর্গস্থ পিতা প্রভৃতি ধারণা আপনারই প্রতিবিম্ব মাত্র। স্বয়ং ঈশ্বর আপনর প্রতিবিম্ব বা প্রতিমাস্বরূপ। ‘ঈশ্বর মানুষকে নিজ প্রতিবিম্বরূপে সৃষ্টি করিলেন’ —এ কথা ভুল। মানুষ নিজ প্রতিবিম্ব আনুযায়ী ঈশ্বর বা দেবতা সৃষ্টি করিতেছে। আমরাই দেবতা সৃষ্টি করি, তাঁহার পদতলে পতিত হইয়া তাঁহারই উপাসনা করি, আর যখনই ঐ স্বপ্ন আমাদের নিকট আসে, তখন আমরা তাঁহাকে ভালবাসিয়া থাকি।
—————-
১ কিমপি সততোবোধং কেবলানন্দরূপং নিরুপমমতিবেলং নিত্যমুক্তং নিরীহম্।
নিরবধি গগনাভং নিষ্কলং নিবিকল্পং হৃদি কলয়তি বিদ্বান্ ব্রহ্মপূর্ণং সমাধৌ।।
—বিবেকচূড়ামণি, ৪১০
—————-
এই বিষয়টি বুঝিয়া রাখা বিশেষ প্রয়োজন যে, আজ সকালের বক্তৃতার সার কথাটি এই যে, একটি সত্তা মাত্র আছে, আর সেই এক সত্তাই বিভিন্ন মধ্যবর্তী বস্তুর ভিতর দিয়া দৃষ্ট হইলে তাহাকেই পৃথিবী স্বর্গ বা নরক, ঈশ্বর ভূতপ্রেত মানব বা দৈত্য, জগৎ বা এইসব যতকিছু বোধ হয়। কিন্তু এই বিভিন্ন পরিণামী বস্তুর মধ্যে যাঁহারা কখন পরিণাম হয় না—যিনি এই চঞ্চল মর্ত্য জগতের একমাত্র জীবনস্বরূপ, যে পুরুষ বহু ব্যক্তির কাম্যবস্তু বিধান করিতেছেন, তাহাকে যে সকল ধীর ব্যক্তি নিজ আত্মার মধ্যে অবস্থিত বলিয়া দর্শন করেন, তাঁহাদেরই নিত্য শান্তিলাভ হয়—আর কাহারও নয়। ১
সেই ‘এক সত্তা’র সাক্ষাৎ লাভ করিতে হইবে। কিরূপে তাহার অপরোক্ষানুভূতি হইবে—কিরূপে তাহার সাক্ষাৎ লাভ হইবে, ইহাই এখন জিজ্ঞাস্য। কিরূপে এই স্বপ্নভঙ্গ হইবে, আমরা ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নরনারী—আমাদের ইহা চাই, ইহা করিতে হইবে, এই যে স্বপ্ন—ইহা হইতে আমরা কিরূপর জাগিব? আমরাই জগতের সেই অনন্ত পুরুষ আর আমরা জড়ভাবাপন্না হইয়া এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নরনারীরূপ ধারণ করিয়াছি—একজনের মিষ্ট কথায় গলিয়া যাইতেছি, আবার আর একজনের কড়া কথায় গরম হইয়া পড়িতেছি—ভালমন্দ সুখদুঃখ আমাদিগকে নাচাইতেছে! কি ভয়ানক পরনির্ভরতা, কি ভয়ানক দাসত্ব! আমি যে সকল সুখদুঃখের অতীত, সমগ্রই যাহার প্রতিবিম্বস্বরূপ, সূর্য চন্দ্র তারা যাহারা মহাপ্রণের ক্ষুদ্র উৎসাহমাত্র—সেই আমি এইরূপ ভয়ানক দাসভাবাপন্ন রহিয়াছি! আপনি আমার গায়ে একটি চিম্টি কাটিলে আমার ব্যাথা লাগে। কেহ যদি একটি মিষ্ট কথা বলে, আমনি আমার আনন্দ হইতে থাকে। আমার কি দুর্দশা দেখুন—দেহের দাস, মনের দাস, জগতের দাস, একটা ভাল কথার দাস, একটা মন্দ কথার দাস, বাসনার দাস, সুখের দাস,জীবনের দাস, মৃত্যুর দাস—সব জিনিষের দাস! এই দাসত্ব ঘুচাইতে হইবে কিরূপে?
—————
১ কঠোপনিষদ্, ৫।১৩
—————
এই আত্মার সম্বন্ধে প্রথমে শুনিতে হইবে, উহা লইয়া মনন অর্থাৎ বিচার করিতে হইবে, অতঃপর উহার নিদিধ্যাসন অর্থাৎ ধ্যান করিতে হইবে।১
অদ্বৈতবাদীর ইহাই সাধনপ্রণালী। সত্যের সম্বন্ধে প্রথমে শুনিতে হইবে, পরে উহার বিষয় চিন্তা করিতে হইবে, তৎপর ক্রমাগত সেইটি মনে মনে দৃঢ়ভাবে বলিতে হইবে। সর্বদাইভাবুন-‘আমি ব্রহ্ম’, অন্য চিন্তা দুর্বলতাজনক বলিয়া দূর করিয়া দিতে হইবে। যে কোন চিন্তায় আপনাদিগকে নর-নারী বলিয়া জ্ঞান হয়, তাহা দূর করিয়া দিন, দেহ যাক, মন যাক, দেবতারাও যাক, ভূত-প্রেতাদিও যাক, সেই এক সত্তা ব্যতীত আর সবই যাক।
যেখানে একজন আপর কিছু দেখে, একজন আপর কিছু শুনে, একজন অন্য কিছু জানে, তাহা ক্ষুদ্র বা সসীম; আর যেখানে একজন অপর কিছু দেখে না, একজন অপর কিছু শুনে না, আর যেখানে একজন অপর জানে না, তাহাই ভূমা অর্থাৎ মহান্ বা অনন্ত।২
তাহাই সর্বোত্তম বস্তু, যেখানে বিষয়ী ও বিষয় এক হইয়া যায়। যখন আমিই শ্রোতা ও আমিই বক্তা, যখন আমিই আচার্য ও আমিই আমিই শিষ্য, যখন আমিই স্রষ্টা ও আমিই সৃষ্ট, তখনই কেবল ভয় চলিয়া যায়। কারণ আমাকে ভীত করিবার অপর কেহ বা কিছু নাই। আমি ব্যতীত যখন আর কিছুই নাই, তখন আমাকে ভয় দেখাইবে কে? দিনের পর দিন এই তত্ত্ব শুনিতে হইবে। অন্য সকল চিন্তা দূর করিয়া দিন। আর সব কিছু দূরে ছুঁড়ে ফেলিয়া দিন, নিরস্তর হইয়া আবৃত্তি করুন। যতক্ষণ না উহা হৃদয়ে পৌঁছায়, যতক্ষণ পর্যন্ত না প্রত্যেক স্নায়ু, প্রত্যেক মাংসপেশী, এমনকি প্রত্যেক শোনিত বিন্দু পর্যন্ত, ‘আমি সেই, আমিই সেই’ —এইভাবে পূর্ণ হইয়া যায়, ততক্ষণ কর্ণের ভিতর দিয়া ঐ তত্ত্ব ক্রমাগত ভিতরে পবেশ করাইতে হইবে। এমনকি মৃত্যুর সম্মুখীন হইয়াও বলুন-‘আমিই সেই।’ ভারতে এক সন্ন্যাসী ছিলেন তিনি ‘শিবোহহং, শিবোহহং’ আবৃত্তি করিতেন। একদিন একটা ব্যাঘ্র আসিয়া তাহার উপর লাফাইয়া পড়িল এবং তাহাকে টানিয়া লইয়া গিয়া মারিয়া ফেলিল। যতক্ষণ তিনি জীবিত ছিলেন, ততক্ষণ ‘শিবোহহং, শিবোহহং’ ধ্বনি শুনা গিয়াছিল! মৃত্যুর দ্বারে, ঘোরতর বিপদে, রণক্ষেত্রে, সমুদ্রস্থলে, উচ্চতম পর্বত শিখরে, গভীরতম অরন্যে-যেখানেই থাকুন না কেন, সর্বদা মনে মনে বলিতে থাকুন— ‘আমি সেই, আমিই সেই’। দিন রাত্রি বলিতে থাকুন— ‘আমিই সেই।’ ইহা শ্রেষ্ঠ তেজের পরিচয়, ইহাই ধর্ম।
—————
১ বৃহ উপ., ৫।৬
২ যত্র নান্যং নান্যচ্ছৃণোতি নান্যদ্ বিজানাতি স ভূমা।
অথ যত্রান্যৎ পশ্যতান্যচ্ছৃণোত্যোন্যদ্ বিজানাতি তদল্পম্।।—ছান্দোগ্য উপ., ৭।২৪
—————
দুর্বল ব্যক্তি কখন আত্মা লাভ করিতে পারে না।১ কখনই বলিবেন না, ‘হে প্রভো, আমি অতি অধম পাপী।’ কে আপনাকে সাহায্য করিবে? আপনি জগতের সাহায্যকর্তা—আপনাকে আবার এ জগতে কে সাহায্য করিতে পারে? আপনাকে সাহায্য করিতে কোন্ মানুষ, কোন দেবতা বা কোন্ দৈত্য সমর্থ? আপনার উপর আবার কাহার শক্তি খাটিবে? আপনিই জগতের ঈশ্বর—আপনি আবার কোথায় সাহায্য আন্বেষণ করিবেন? যাহা কিছু সাহায্য পাইয়াছেন, আপনার নিজের নিকট হইতে ব্যতীত আর কাহারও নিকট পান নাই। আপনি প্রার্থনা করিয়া যাহার উত্তর পাইয়াছেন, অজ্ঞতাবসতঃ আপনি মনে করিয়াছেন, অপর কোন পুরুষ তাহার উত্তর দিয়াছেন। আপনার নিকট হইতেই সাহায্য আসিয়াছিল, আর আপনি সাগ্রহে কল্পনা করিয়া লইয়াছিলেন যে, অপর কেহ আপনাকে সাহায্য প্রেরণ করিতেছে। আপনার বাহিরে আপনার সাহায্যকর্তা আর কেহ নাই—আপনিই জগতের স্রষ্টা। গুটিপোকার মতো আপনিই আপনার চারিদিকে গুটি নির্মাণ করিয়াছেন। কে আপনাকে উদ্ধার করিবে? আপনার ঐ গুটি কাটিয়া ফেলিয়া সুন্দর প্রজাপতিরূপে—মুক্ত আত্মারূপে বাহির হইয়া আসুন। তখনই—কেবল তখনই আপনি সত্যদর্শন করিবেন। সর্বদা নিজের মনকে বলিতে থাকুন, ‘আমিই সেই’। এই বাক্যগুলি আপনার মনের অপবিত্রতারূপ আবর্জনারাশি পুড়াইয়া ফেলিবে, আপনার ভিতরে পূর্ব হইতেই যে মহাশক্তি আছে, তাহা প্রকাশ করিয়া দিবে, আপনার হৃদয়ে যে অনন্ত শক্তি সুপ্তভাবে রহিয়াছে, তাহা জাগাইয়া তুলিবে। সর্বদাই সত্য—কেবল সত্য শ্রবণ করিয়াই এই মহা শক্তির উদ্বোধন করিতে হইবে। যেখানে দুর্বলতার চিন্তা আছে, সেদিকে ঘেঁষিবেন না। যদি জ্ঞানী হইতে চান, সর্বপ্রকার দুর্বলতা পরিহার করুন।
————–
১ নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্যঃ ।—মুণ্ডকোপনিষদ্, ৩।২।৪
————–
সাধন আরম্ভ করিবার পূর্বে মনে যত প্রকার সন্দেহ আসিতে পারে সব দূর করুন। যতদূর পারেন, যুক্তি-তর্ক-বিচার করুন। তারপর যখন মনের মধ্যে স্থির সিদ্ধান্ত করিবেন যে, ইহাই—কেবল ইহাই সত্য, আর কিছুই নয়, তখন আর তর্ক করিবেন না, তখন মুখ একেবারে বন্ধ করুন। তখন আর তর্কযুক্তি শুনিবেন না, নিজেও তর্ক করিবেন না। আর তর্কযুক্তির প্রয়োজন কি? আপনি তো বিচার লাভ করিয়া তৃপ্তিলাভ করিয়াছেন, আপনি তো সমস্যার সিদ্ধান্ত করিয়াছেন, তবে আর এখন বাকি কি? এখন সত্যের সাক্ষাৎকার করিতে হইবে। অতএব বৃথা তর্কে এবং অমূল্যকাল-হরণে কি ফল? এখন ঐ সত্যকে ধ্যান করিতে হইবে, আর যে কোন চিন্তা আপনাকে তেজস্বী করে, তাহাই গ্রহণ করিতে হইবে; এবং যাহা দুর্বল করে, তাহাই পরিত্যাগ করিতে হইবে। ভক্ত মূর্তি-প্রতিমাদি এবং ঈশ্বরের ধ্যান করেন। ইহাই স্বাভাবিক সাধনপ্রণালী, কিন্তু ইহাতে অতি মৃদু গতিতে অগ্রসর হইতে হয়। যোগীরা তাহাদের দেহের অভ্যন্তরে বিভিন্ন কেন্দ্র বা চক্রের উপর ধ্যান করেন এবং মনোমধ্যস্থ শক্তিসমূহ পরিচালনা করেন। জ্ঞানী বলেন, মনের অস্তিত্ব নাই, দেহেরও নাই। এই দেহ ও মনের চিন্তা দূর করিয়া দিতে হইবে, অতএব উহাদের চিন্তা করা অজ্ঞানোচিত কার্য। ঐরূপ করা যেন একটা রোগ আনিয়া আর একটা রোগ আরোগ্য করার মতো। জ্ঞানীর ধ্যানই সর্বাপেক্ষা কঠিন—নেতি নেতি; তিনি সব কিছুই অস্বীকার করেন, আর যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহাই আত্মা। ইহাই সর্বাপেক্ষা অধিক বিশ্লেষণাত্মক (বিলোম) সাধন। জ্ঞানী কেবল বিশ্লেষণ বলে জগৎটা আত্মা হইতে বিচ্ছিন্ন করিতে চান। ‘আমি জ্ঞানী’-এ কথা বলা খুব সহজ, কিন্তু যথার্থ জ্ঞানী হওয়া বড়ই কঠিন। বেদ বলিতেছেনঃ
পথ অতি দীর্ঘ, এ যেন শাণিত ক্ষুরাধারের উপর দিয়া ভ্রমণ; কিন্তু নিরাশ হইও না। উঠ, জাগো, যতদিন না সেই চরম লক্ষে পৌঁছিতেছ, ততদিন ক্ষান্ত হইও না।১
অতএব জ্ঞানীর ধ্যান কি প্রকার? জ্ঞানী দেহমন বিষয়ক সর্বপ্রকার চিন্তা অতিক্রম করিতে চান। তিনি যে দেহ, এই ধারণা দূর করিয়া দিতে চান। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখুন, যখনই আমি বলি, ‘আমি স্বামী অমুক’ তৎক্ষণাৎ দেহের ভাব আসিয়া থাকে। তবে কি করিতে হইবে? মনের উপর সবলে আঘাত করিয়া বলিতে হইবে, ‘আমি দেহ নই, আমি আত্মা।’ রোগই আসুক, অথবা অতি ভয়ানক আকারে মৃত্যুই আসিয়া উপস্থিত হউক, কে তাহা গ্রহ্য করে? আমি দেহ নই। দেহ সুন্দর রাখিবার চেষ্টা কেন? এই মায়া এই ভ্রান্তি—আর একবার উপভোগের জন্য? এই দাসত্ব বজায় রাখিবার জন্য? দেহ যাক, আমি দেহ নই। ইহাই জ্ঞানীর সাধনপ্রণালী। ভক্ত বলেন, ‘প্রভু আমাকে এই জীবনসমুদ্র সহজে উত্তীর্ণ হইবার জন্য এই দেহ দিয়াছেন, অতএব যতদিন না সেই যাত্রা শেষ হয়, ততদিন ইহাকে যত্নপূর্ব্বক রক্ষা করিতে হইবে।’ যোগী বলেন, ‘আমাকে অবশ্যই দেহের যত্ন করিতে হইবে, যাহাতে আমি ধীরে ধীরে সাধনপথে অগ্রসর হইয়া পরিণামে মুক্তিলাভ করিতে পারি।’ জ্ঞানী মনে করেন, তিনি আর বিলম্ব করিতে পারেন না। তিনি এই মুহূর্তেই চরম লক্ষে পৌঁছিবেন। তিনি বলেন, ‘আমি নিত্যমুক্ত, কোন কালেই বদ্ধ নই; অনন্তকাল ধরিয়া আমি এই জগতের ঈশ্বর। আমাকে আবার পূর্ণ করিবে কে? আমি নিত্য পূর্ণস্বরূপ।’ যখন কোন মানুষ স্বয়ং পূর্ণতা লাভ করে, সে অপরের মধ্যেও পূর্ণতা দেখিয়া থাকে। যখন অপরের মধ্যে অপূর্ণতা দেখে, তখন তাহার নিজ মনেরই ভাব বাহিরে প্রক্ষিপ্ত হইতেছে বুঝিতে হইবে। তাহার নিজের ভিতৱ যদি অপূর্ণতা না থাকে, তবে সে কিরূপে অপূর্ণতা দেখিবে? অতএব জ্ঞানী পূর্ণতা বা অপূর্ণতা কিছুই গ্রহ্য করেন না। তাহার পক্ষে উহাদের কোনটিরই অস্তিত্ব নাই। যখন তিনি মুক্ত হন, তখন হইতেই তিনি আর ভাল মন্দ দেখেন না। ভাল মন্দ কে দেখে?—যাহার নিজের ভিতর ভাল-মন্দ আছে। দেহ কে দেখে?—যে নিজেকে দেহ মনে করে। যে মুহূর্তে আপনি দেহভাব-রহিত হইবেন, সেই মুহূর্তেই আপনি আর জগৎ দেখিতে পাইবেন না। উহা চিরদিনের জন্য অন্তর্হিত হইয়া যাইবে। জ্ঞানী কেবল বিচার-জনিত সিদ্ধান্তবলে এই জড়বন্ধন হইতে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করিতে চেষ্টা করেন। ইহাই ‘নেতি, নেতি’ মার্গ।
——————
১ তুলনীয়ঃ উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত। ক্ষুরস্য ধারা নিশিতা দূরত্যয়া দুর্গং পথস্তৎ কবয়ো বদন্তি।।—কঠ. উপ, ১।৩।১৪
——————