ষষ্ঠ পরিচ্ছেদ – বজ্রসম্ভব
দিবা অনুমান এক প্রহর সময়ে ইক্ষুযন্ত্রে আখ মাড়াই কার্য সবেমাত্র আরম্ভ হইয়াছে, এমন সময় একদল সৈন্য হুম্ হুম্ শব্দ করিয়া বেতসগ্রামে ঢুকিয়া পড়িল। গ্রামের পুরুষেরা ভয় পাইল বটে, কিন্তু পলায়ন করিল না। যুবতী মেয়েরা কতক আখের ক্ষেতে, কতক বেতসবনে লুকাইল। গত ত্রিশ বছর ধরিয়া যে যুদ্ধবিগ্রহ চলিতেছে তাহাতে শত্রুসৈন্য একবারও গৌড়ের মাটিতে পদার্পণ করিতে পারে নাই সত্য, কিন্তু নানা লোকের মুখে নানা লোমহর্ষণ কাহিনী শুনিয়া গ্রামবাসীদের মনে বিজয়োন্মত্ত সৈন্যদলের স্বভাব-চরিত্র আচার-ব্যবহার সম্বন্ধে একটা বিভীষিকাপূর্ণ ধারণা জন্মিয়াছিল।
সৈন্যদল কিন্তু সংখ্যায় বেশি নয়; মাত্র কুড়ি পঁচিশজন পদাতিক, হাতে ঢাল সড়কি। ইহারা ভাস্করবর্মার দলের সৈন্য। গতকল্য যুদ্ধ জিতিয়া ভাস্করবর্মা সদলবলে কর্ণসুবর্ণের অভিমুখে ধাবিত হইয়াছিলেন, ইহারা সেই বিশাল বাহিনীর একটি বিচ্ছিন্ন প্রশাখা।
সৈন্যদল প্রথমেই জানিতে চাহিল, গৌড়ের রাজা বা তৎস্থানীয় কেহ গ্রামে লুকাইয়া আছে কিনা। গ্রামবাসীরা একবাক্যে বলিল, রাজা-গজা কেহ এখানে নাই। অনুসন্ধান করিবার ছুতায় কিছু লুঠপাট করিবার ইচ্ছা সৈনিকদলের ছিল; কিন্তু তাহারা দলে ভারী নয়। গ্রামবাসীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ তো বটেই, উপরন্তু বিলক্ষণ হৃষ্টপুষ্ট। সৈনিকদের অস্ত্র আছে সত্য, কিন্তু অমন দুই চারিটা সড়কি বল্লম গ্রামেও আছে। সুতরাং তাহারা কোনও প্রকার উপদ্রব করিতে সাহস করিল না, প্রত্যেকে একটি একটি ইক্ষুদণ্ড লইয়া চিবাইতে চিবাইতে প্রস্থান করিল।
সৈন্যদল চলিয়া যাইবার পর গুড়নির্মাণ কার্য স্বভাবতই শ্লথ হইয়া পড়িল। সকলে জটলা করিয়া জল্পনা করিতে লাগিল; কোথায় যুদ্ধ হইয়াছে? ইহারা কোন্ রাজার সৈন্য? বাহিরের শত্রু ঘরে প্রবেশ করিয়াছে, এখন আত্মরক্ষার উপায় কি? গৌড়ের রাজা কি রাজ্য ছাড়িয়া পলাতক?
মধ্যাহ্নকালে গোপা অলক্ষিতে দেবস্থানে গেল। কুটির-চক্রের বাহিরে নির্জন অশ্বত্থ বৃক্ষতলে দেবস্থান, পাশেই চাতক ঠাকুরের একচালা। গোপা দেখিল, ঠাকুর অশ্বত্থ বৃক্ষের একটি উদ্ গত শিকড়ে মাথা রাখিয়া ঊর্ধ্বমুখে শয়ান রহিয়াছেন, তাঁহার দৃষ্টি শূন্যে নিবদ্ধ।
গোপা আসিলে, চাতক ঠাকুর উঠিয়া বসিলেন। দুই একটা অন্য কথার পর গোপা গত রাত্রির ঘটনা বলিল।
চাতক ঠাকুর অবহিত হইয়া শুনিলেন। গোপা নীরব হইলে তিনি একবার চোখ তুলিয়া তাহার পানে সপ্রশ্ন দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন। গোপা তাঁহার চোখের প্রশ্ন বুঝিয়া নীরবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। ঠাকুর তখন দীর্ঘকাল চিন্তা করিয়া বলিলেন— ‘একথা চেপে রাখা চলবে না। গাঁয়ের সকলকে জানিয়ে দেওয়া ভাল।’
গোপা বুঝিল, ঠাকুর কি ভাবিয়া একথা বলিলেন। সে বলিল— ‘আপনি যা ভাল বোঝেন।’
ঠাকুর নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন— ‘আমি যা দেখেছিলাম তা মিথ্যে নয়। কিন্তু ভেবেছিলাম একরকম, হল আর একরকম। যাক, যা হবার তাই হয়েছে। সব তো মনের মত হয় না, গোপা-বৌ। হয়তো ভালই হবে, রাঙার রাজপুত্তুর ফিরে আসবে। কিন্তু—
‘কিন্তু কি ঠাকুর?’
‘আমার মন বলছে বড় দুঃসময়ে আসছে। শুধু তোমার আমার নয়; আমরা তো খড়-কুটো। সারা দেশের দুঃসময়। ঝড় উঠেছে; রাজার সিংহাসন ভেঙে পড়বে, মন্দিরের চূড়া খসে পড়বে। সব ওলট-পালট হয়ে যাবে—’
ভীত হইয়া গোপা বলিল— ‘দীনদুঃখীদের কি হবে ঠাকুর?’
ঠাকুর বলিলেন— ‘যদি কেউ রক্ষা পায়, দীনদুঃখীরাই পাবে। জানো গোপা-বৌ, যখন কালবোশেখী আসে তখন তালগাছ শালগাছ ভেঙে পড়ে, কিন্তু বেতসলতার মত যারা নুয়ে পড়ে তারা বেঁচে যায়।’
সন্ধ্যার প্রাক্কালে কয়েকজন গ্রামবৃদ্ধ মহত্তর মহাশয়ের কুটিরমণ্ডপে পাটি পাতিয়া বসিয়াছিলেন। প্রাতঃকালের আকস্মিক সৈন্যসমাগমের আলোচনা হইতেছিল, এমন সময় চাতক ঠাকুর তাঁহাদের মধ্যে আসিয়া বসিলেন। আলাপ আলোচনা চলিতে লাগিল। — আজ শশাঙ্কদেব বাঁচিয়া নাই, তাই শত্রুর এত সাহস। …মানব কি সত্যই যুদ্ধে হারিয়া পলায়ন করিয়াছে?…কোথায় লুকাইয়া আছে?
চাতক ঠাকুর একটু কাশিয়া বলিলেন— ‘মানবদেব কাল রাত্রে আমাদের গ্রামে লুকিয়ে ছিলেন।’
সকলে উচ্চকিত হইয়া উঠিলেন। নানাবিধ উত্তেজিত প্রশ্নের উত্তরে চাতক ঠাকুর সংক্ষেপে ঘটনা বিবৃত করিয়া শেষে বলিলেন— ‘কাল রাত্রে রাঙার সঙ্গে মানবদেবের বিয়ে হয়েছে। আজ ভোরে তিনি কানসোনায় ফিরে গেছেন।’
আবার তুমুল তর্ক উঠিল। চাতক ঠাকুর স্মিতমুখে বসিয়া শুনিতে লাগিলেন। অবশেষে এক বৃদ্ধ সন্দিগ্ধভাবে তাঁহাকে প্রশ্ন করিলেন— ‘তুমি এত কথা জানলে কোথা থেকে ঠাকুর? রাজা রাঙাকে বিয়ে করেছে তুমি চোখে দেখেছ?’
চাতক ঠাকুর শান্তস্বরে একটি মিথ্যা কথা বলিলেন— ‘আমিই বিয়ে দিয়েছি।’
সে-রাত্রে দেবস্থানে ফিরিবার পথে ঠাকুর গোপাকে চুপি চুপি বলিয়া গেলেন— ‘গোপা-বৌ, রাঙার সিঁথেয় সিঁদুর দিও। আর যদি কেউ জানতে চায়, বোলো আমি রাঙার বিয়ে দিয়েছি।’
রঙ্গনা সীমন্তে সিন্দূর পরিল। যেন সোনার কমলে রক্ত-চন্দনের ছিটা। রঙ্গনাকে কেন্দ্র করিয়া সারা গ্রামে উত্তেজনার ঘূর্ণাবর্ত বহিয়া গেল। সকলের কৌতূহলী দৃষ্টি রঙ্গনার দিকে, সকলের চটুল রসনায় রঙ্গনার কথা। কিন্তু রঙ্গনার কোনও দিকে লক্ষ্য নাই, সে যেন স্বপ্নের ঘোরে আচ্ছন্ন আছে। বরং গোপা গ্রামীণ-গ্রামীণাদের ঔৎসুক্য ও কৌতূহল দেখিয়া গর্বিত অবজ্ঞায় ঘাড় বাঁকাইয়া ভ্রূকুটি করে; কিন্তু রঙ্গনার গর্বও নাই, অভিমানও নাই। সে তন্দ্রাচ্ছন্নের ন্যায় নদীতে স্নান করিতে যায়; মেয়েদের কৌতুক-কানাকানি তাহার কর্ণে প্রবেশ করে, কিন্তু অন্তর স্পর্শ করে না। তাহার সূক্ষ্ম অন্তঃ-প্রকৃতি যেন গ্রামের পরিবেশ ছাড়িয়া বহু দূরে চলিয়া গিয়াছে, জড় দেহটাই পিছনে পড়িয়া আছে।
একটি একটি করিয়া দিন কাটে, পক্ষ কাটে, মাস কাটিয়া যায়। হেমন্ত গিয়া হিম আসে, হিমের শেষে বসন্ত। রঙ্গনা নিজ দেহের অভ্যন্তরে নূতন জীবনের প্রাণ-স্পন্দন অনুভব করে। তাহার দেহ-মন ভরিয়া বিপুল হৃদয়াবেগ উথলিয়া উঠে। সে চুপি চুপি মানবের অঙ্গদটি পেটরা হইতে বাহির করিয়া বুকে চাপিয়া ধরে।
কিন্তু মানব ফিরিয়া আসে না; তাহার কোনও সংবাদও নাই। বহির্জগতের সহিত বেতসগ্রামের যোগাযোগ অতি অল্প; সেই যে একদল শত্রু-সৈন্য আসিয়াছিল, তারপর বাহির হইতে আর কেহ আসে নাই। গ্রামিকেরা কেহ কেহ কদাচ বাহিরে গিয়া কিছু সংবাদ সংগ্রহ করিয়া আনে। সে সংবাদও পাকা খবর নয়, জনশ্রুতি মাত্র। কর্ণসুবর্ণ পর্যন্ত যাইবার সাহস কাহারও নাই; সেখানে নাকি মারামারি কাটাকাটি চলিতেছে, রক্তের স্রোত বহিতেছে। কোনও এক ভাস্করবর্মা নাকি গৌড়দেশ গ্রাস করিয়াছে। মানবদেবের কথা কেহ জানে না; সে মরিয়াছে কি বাঁচিয়া আছে তাহাও অজ্ঞাত।
এ সকল কথা রঙ্গনার কানে পৌঁছায় না; কে পৌঁছাইবে? চাতক ঠাকুর জানেন, কিন্তু তিনি নীরব থাকেন। মাঝে মাঝে গোপা ব্যাকুল হইয়া তাঁহার কাছে উপস্থিত হয়, ঠাকুর তাহার প্রশ্ন এড়াইয়া যান। গোপার বুক দমিয়া যায়। কিন্তু সে নিজের আশঙ্কার কথা রঙ্গনাকে বলে না, আশায় বুক বাঁধিয়া থাকে।
রঙ্গনা প্রত্যহ দ্বিপ্রহরে বেতসকুঞ্জে গিয়া শুইয়া থাকে। স্বপ্নালসার কল্পনায় নানা ক্রীড়া চলিতে থাকে। সে কল্পনায় শুনিতে পায়, বহু দূর হইতে জয়ন্তের ক্ষুরধ্বনি আসিতেছে…সাদা ঘোড়ার পিঠে দীর্ঘকান্তি আরোহী… দূর্বা-হরিৎ প্রান্তরের উপর দিয়া অশ্বের মৃদু ক্ষুরধ্বনি ক্রমে কাছে আসিতেছে…ঐ কুঞ্জের বাহিরে আসিয়া থামিল!— রঙ্গনা চমকিয়া উঠিয়া বসে; বেতস-শাখার ফাঁকে বাহিরে দৃষ্টি প্রেরণ করে; আবার নিশ্বাস ফেলিয়া শয়ন করে।
বেতসকুঞ্জে মন যখন বড় অধীর হয় তখন রঙ্গনা মৌরীর কিনারা ধরিয়া দক্ষিণদিকে যায়। দক্ষিণে গ্রামের সীমান্তে একটি বৃদ্ধ জটিল ন্যগ্রোধ বৃক্ষ দাঁড়াইয়া আছে; তাহার ঘন-শীতল ছায়াতলে বসিয়া অপলক নেত্রে দূরের পানে চাহিয়া থাকে— দূরে মাঠের শেষে বন আরম্ভ হইয়াছে; বনের শেষে নাকি আবার মাঠ আছে, তারপর কর্ণসুবর্ণ নগর। কত বিস্তীর্ণা এই পৃথিবী! এই পৃথিবীর অন্য প্রান্ত হইতে একটি মানুষ কি আসিবে? কিন্তু সে যে আসিবে বলিয়া গিয়াছিল! কেন আসিবে না? কবে আসিবে?
এইভাবে বসন্ত ফুরাইয়া গেল। রঙ্গনা যখন প্রায় পূর্ণগর্ভা তখন একটি ঘটনা ঘটিল, রঙ্গনার জীবনের যাহা দৃঢ়তম অবলম্বন ছিল তাহা হঠাৎ খসিয়া গেল।
গোপা একদিন অপরাহ্ণে শিকড়-বাকড়ের অন্বেষণে গ্রামের বাহিরে মাঠের দিকে গিয়াছিল। মাঠে এক বেদিয়া রমণীর সহিত তাহার সাক্ষাৎ হইল। বেদিয়ারা সাপ ধরে যত্রতত্র সাপের খেলা দেখাইয়া বেড়ায়, জাঙ্গলিক বিষবৈদ্যের কাছে সাপের বিষ বিক্রয় করে; আবার তুকতাক মন্ত্রৌষধি জানে, গুপ্তচরের কাজও করে। বেদেনীর সহিত গোপার অনেকক্ষণ ধরিয়া কথা হইল! কি কথা হইল তাহা কেহ জানিল না। সন্ধ্যার সময় গোপা কুটিরে ফিরিয়া আসিল।
রঙ্গনা লক্ষ্য করিল না, তাহার মায়ের মুখ কালীবর্ণ, হাত-পা কাঁপিতেছে। গোপা আহার না করিয়াই শুইয়া পড়িল। স্বভাবতই সে আজকাল কম কথা বলে, আজ একটিও কথা বলিল না।
গভীর রাত্রে গোপার ত্রাস দিয়া জ্বর আসিল। প্রচণ্ড তাপ, গা পুড়িয়া যাইতেছে, চক্ষু জবা ফুলের ন্যায় রক্তবর্ণ। এই মরণান্তক জ্বর আর নামিল না! দুই দিন অঘোর অচৈতন্য থাকিবার পর গোপার প্রাণবিয়োগ হইল। মরণের পূর্বে কিন্তু সে একবার মুখ খুলিল না, একটি বাক্য নিঃসরণ করিল না। বেদেনীর মুখে যে ভয়ঙ্কর সংবাদ সে শুনিয়াছে তাহার ইঙ্গিত পর্যন্ত দিল না।
গ্রামবাসীরা মৃত্যু-মুহূর্তে বিবাদ-বিসংবাদ মনে রাখিল না, মৌরীর তীরে লইয়া গিয়া গোপার অন্ত্যেষ্টি করিল। তাহার দেহ ভস্ম হইয়া মৌরীর জলে মিশিল। গোপার জীবন-জ্বালা জুড়াইল।
গ্রামের কেহ কেহ গোপাকে বেদেনীর সহিত মাঠে কথা কহিতে দেখিয়াছিল, তাহারা বলাবলি করিতে লাগিল— বেদেনীই তুকতাক করিয়া গোপাকে মারিয়াছে। মৃত্যুর যে অন্য কারণ থাকিতে পারে তাহা কেহ ভাবিল না। গোপার জন্য অবশ্য কেহ শোক করিল না, কিন্তু রঙ্গনার প্রতি অনেকেরই মন সদয় হইল। গ্রামের বিবাদ ছিল গোপার সঙ্গে, কারণ গোপা ছিল মুখরা-প্রখরা। রঙ্গনার স্বভাব মায়ের মত নয়; সে নমনীয়া, মৃদু-স্বভাবা। সে অপরূপ রূপসী, তার উপর রাজবধূ। হোক এক রাত্রির বধূ, তবু রাজবধূ। কে বলিতে পারে, হয়তো মানবদেব কোন্ দিন ফিরিয়া আসিবে, রঙ্গনাকে চতুর্দোলায় তুলিয়া লইয়া যাইবে। গ্রামবাসীদের মন তাহার প্রতি প্রসন্ন হইল। গোপা যেন মরিয়া তাহাকে জাতে তুলিয়া দিয়া গেল।
মাতার মৃত্যুর পর দুই দিন রঙ্গনা ভূমিশয্যা ছাড়িয়া উঠিল না। চাতক ঠাকুর আসিলেন; স্বয়ং রন্ধন করিয়া তাহাকে খাওয়াইলেন। স্নিগ্ধস্বরে দুই চারিটি কথা বলিলেন।
‘মা কারও চিরকাল থাকে না, রাঙা। স্বামীর কথা ভাব। তোর পেটে যে আছে তার কথা ভাব।’
রঙ্গনা মনে বল পাইল। মা চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু ঠাকুর আছেন। না, সে সাহস হারাইবে না, হাল ছাড়িয়া দিবে না। যে-জন আসিবে বলিয়া চলিয়া গিয়াছে তাহার জন্য প্রতীক্ষা করিবে। অনাগত জীবন-কণিকার জন্য প্রস্তুত থাকিবে।
রঙ্গনার জীবনযাত্রা আবার পূর্ববৎ চলিতে লাগিল। কুটিরে সে একা। কিন্তু ক্রমে তাহাও অভ্যাস হইয়া গেল। পূর্বে মাতার আদেশে কাজ করিত; এখন নিজেই রন্ধন করে, নদীতে জল আনিতে যায়; সন্ধ্যায় চুল বাঁধে, সিঁথি ভরিয়া সিঁদুর পরে। আর প্রতীক্ষা করে—
চাতক ঠাকুর সময়ে অসময়ে আসিয়া তাহার দেখাশুনা করেন, গল্প করেন, জাতক-পুরাণের উপাখ্যান বলেন। রাত্রে তাহার দেহলীতে আসিয়া শয়ন করেন।
এইভাবে নিদাঘও শেষ হইতে চলিল।
সূর্য আর্দ্রা নক্ষত্রে সংক্রমণ করিলে, একদিন সায়াহ্নে আকাশের দক্ষিণ হইতে কালো কালো মেঘ উঠিয়া আসিল। পুঞ্জ পুঞ্জ মেঘ দ্রুত আকাশ ঢাকিয়া ফেলিল। কুটির দেহলীতে রঙ্গনা তখন চুল বাঁধিয়া পিত্তলের থালিকা মুখের কাছে ধরিয়া সীমন্তে সিন্দূর পরিতেছে, চাতক ঠাকুর অদূরে বসিয়া এক কৌতুককর কাহিনী বলিতেছেন, এমন সময় দশদিক ধাঁধিয়া নীল বিদ্যুৎ ঝলকিয়া উঠিল, পরক্ষণেই বিকট বজ্রনাদে আকাশ যেন ফাটিয়া পড়িল। রঙ্গনা হঠাৎ ভয় পাইয়া মাটির উপর উপুড় হইয়া পড়িল।
বজ্রের হুঙ্কারধ্বনি প্রশমিত হইলে তীব্র ধারায় বৃষ্টি আরম্ভ হইল; তখন রঙ্গনা মাটি হইতে পাংশু-পাণ্ডুর মুখ তুলিল, একবার ভয়-বিস্ফারিত চক্ষে ঠাকুরের পানে চাহিল, তারপর টলিতে টলিতে উঠিয়া কুটির কক্ষে প্রবেশ করিল।
ঠাকুর তাহার ভয়-বিস্ফারিত দৃষ্টির অর্থ বুঝিলেন। তিনি বৃষ্টির মধ্যে ছুটিয়া গিয়া আশেপাশের কুটির হইতে দুই জন স্ত্রীলোককে ডাকিয়া আনিলেন।
দুইদণ্ড মধ্যে রঙ্গনা সন্তান প্রসব করিল; বজ্র-বিদ্যুতের হুড়ুকধ্বনির মধ্যে শিশু কণ্ঠের ক্ষীণ কাকুতি শুনা গেল। ঠাকুর দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়াছিলেন, উচ্চকণ্ঠে প্রশ্ন করিলেন— ‘কী হল, ছেলে না মেয়ে?’
বদ্ধ দ্বারের ওপার হইতে একটি স্ত্রীলোক বলিল— ‘ছেলে।’
আহ্লাদে ঠাকুরের মন ভরিয়া উঠিল। তিনি দুই হস্ত সহর্ষে ঘর্ষণ করিতে করিতে নিজ মনেই বলিতে লাগিলেন— ‘ভাল ভাল! আহা ভাল হয়েছে। রাজার ছেলে, বজ্রের ভেরী বাজিয়ে এসেছে। ওর নাম রাখলাম— বজ্র। শশাঙ্কদেবের পৌত্র, মানবদেবের পুত্র বজ্রদেব। ওর মায়েরও নাম রেখেছিলাম, আবার ওর নাম রাখলাম। আহা বেঁচে থাক, মা’র কোল জুড়ে থাক।’
আকাশে ঘন দুর্যোগ; ধরণীপৃষ্ঠে বৃষ্টির লাজাঞ্জলি বর্ষণ। মেঘের বিতানতলে মর্দলঝল্লরীর রণবাদ্য বাজিতেছে, আবার তড়িল্লতার নৃত্যবিলাস চলিয়াছে। সদ্যোজাত শিশুর অদৃষ্টদেবতা যেন জন্মকালেই তাহার ললাটে ভবিতব্যের তিলক পরাইয়া দিলেন।